মুত্তাফাকুন আলাইহি-৫
লিখেছেন লিখেছেন ফাতিমা মারিয়াম ২৮ জুলাই, ২০১৩, ০৩:৫৮:৩৩ দুপুর
তাওবা-২
১২) হযরত কা’ব ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর পুত্র আবদুল্লাহ বর্ণনা করেন, তাঁর পিতা কা’ব ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি (আবদুল্লাহ) তাঁর পরিচালক ছিলেন। তিনি তাবুক যুদ্ধে তাঁর পিতার অংশগ্রহণ না করার কাহিনী বর্ণনা করে বলেন, ‘আমি তাবুক যুদ্ধে রাসূলে আকরাম ﷺএর সঙ্গে না গিয়ে পিছনে থেকে যাবার ব্যাপারে কা’ব ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বক্তব্য শুনেছি।
তিনি (কা’ব) বলেন, ‘একমাত্র তাবুক যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন যুদ্ধে আমি রাসূলে আকরাম ﷺ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম না। অবশ্য বদরের যুদ্ধ থেকেও আমি দূরে থেকে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই যুদ্ধে যারা যোগদান করেননি, তাদের কাউকে সাজা দেওয়া হয়নি। তখন রাসূলে আকরাম ﷺ ও তাঁর সঙ্গী মুসলমানরা কুরাইশদের একটি ব্যবসায়ী কাফেলা থেকে ধন-মাল ছিনিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে রওয়ানা করেছিলেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ তা’য়ালা (দৃশ্যত) অসময়ে মুসলমানদেরকে তাদের শত্রুদের সাথে যুদ্ধের মুখোমুখি করে দিলেন। আমরা আকাবার রাতে যখন ইসলামের উপর অবিচল থাকার দৃপ্ত শপথ নিয়েছিলাম, তখন আমি রাসূলে আকরামﷺএর সঙ্গেই ছিলাম। যদিও বদরের যুদ্ধ লোকদের মধ্যে বেশি স্মরণীয় ঘটনা, তবু আমি আকাবায় উপস্থিতির পরিবর্তে বদরের উপস্থিতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া পছন্দ করি না।
তাবুক যুদ্ধে আমার রাসূলে আকরাম ﷺএর সঙ্গে না যাবার কারণটা হচ্ছে এই যে, এই যুদ্ধের সময় আমি যতটা ধনবান ও শক্তিশালী ছিলাম, ততটা আর কোন সময় ছিলাম না। আল্লাহর কসম! এই যুদ্ধের সময় আমার দু’টি উট ছিল; কিন্তু এর পূর্বে আর কখনো আমার একাধিক উট ছিল না। রাসূলে আকরাম ﷺকোথাও যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে অন্য জায়গার কথা বলে প্রকৃত গন্তব্য স্থানের কথা গোপন রাখতেন। তিনি [রাসূলে আকরাম ﷺ] অত্যধিক গরমের সময় তাবুক যুদ্ধে গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সফরটা ছিল দীর্ঘ পথের; অঞ্চলটা ছিল খাদ্য ও পানিশূন্য। তদুপরি, শক্রসেনার সংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। এসব কারণে তিনি মুসলমানদের কাছে এই যুদ্ধের কথা খোলাখুলি ব্যক্ত করলেন, যাতে করে সবাই যুদ্ধের জন্য সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেন। তিনি সাহাবীদের তাঁর ইচ্ছার কথা খোলাখুলি জানিয়ে দিলেন। অনেক মুসলিম যোদ্ধা এই যুদ্ধে রাসূলে আকরামﷺএর সঙ্গী হলেন। তখনকার দিনে লোকদের নাম তালিকাভূক্ত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট রেজিষ্টি বই ছিল না।
হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,’ তখনকার দিনে যে ব্যক্তি যুদ্ধে (জিহাদে) অংশগ্রহণ না করে লুকিয়ে থাকতে চাইত, সে নিশ্চিতরূপে মনে করত যে, তার সম্পর্কে ওহী নাযিল না হওয়া পর্যন্ত তার অবস্থাটা গোপনই থাকবে। রাসূলে আকরাম ﷺযখন আলোচ্য যুদ্ধের জন্য মদীনা থেকে রওয়ানা হলেন তখন গাছের ফল (খেজুর) পেকে গিয়েছিল এবং গাছ-গাছালির ছায়াও বেশ আরামদায়ক হয়ে উঠেছিল। আমি এ সবের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলাম। যাহোক, রাসূলে আকরাম ﷺএবং তাঁর সাহাবীগণ যথারীতি যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। আমিও তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে সকাল বেলা যেতাম বটে; কিন্তু কাজ না করেই বাড়ী ফিরে আসতাম এবং মনে মনে ভাবতাম যে, আমি ইচ্ছা করলেই এই কাজটি সম্পন্ন করতে পারব। এভাবে টালবাহানা করতে করতে অনেক দিন কেটে গেল। এমনকি, লোকেরা যুদ্ধে যাবার জন্য সবরকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলল। অবশেষে রাসূলে আকরাম ﷺ তাঁর সাহাবী যোদ্ধাদের নিয়ে অতি প্রত্যুষে তাবুকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। কিন্তু আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কোন প্রস্তুতিই গ্রহণ করিনি। তাই আমি প্রস্তুতি নিতে গেলাম। কিন্তু পরদিনও আমি কিছুই করলাম না। এভাবে কিছুদিন আমার এই টালবাহানা চলতে থাকল। অন্যদিকে মুসলিম যোদ্ধারা খুব দ্রুত এগিয়ে গেলেন এবং যুদ্ধও একেবারে কাছাকাছি এসে পড়ল। আমি তখন মনে মনে ভাবতাম, যেকোন মুহুর্তে রওয়ানা হয়ে গিয়ে ওদেরকে ধরে ফেলব। আহা! আমি যদি তা করতে পারতাম! কিন্তু তা আর আমার ভাগ্যেই জুটল না। রাসূলে আকরাম ﷺ রওয়ানা হয়ে যাবার পর আমি রোজকার মতো মদীনার লোকদের মধ্যে চলাফেরা করতে লাগলাম। তখন যাদেরকে মুনাফিক বলে আখ্যায়িত করা হতো এবং যাদেরকে আল্লাহ দুর্বল ও অক্ষম বলে গণ্য করেছিলেন, সে ধরনের লোক ছাড়া আর কাউকে আমার মতো অবস্থায় দেখতে পেতাম না। এ অবস্হা আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিত।
তাবুক যাবার পথে রাসূলে আকরাম ﷺ আমার কথা মনে করেননি। সেখানে পৌঁছেই তিনি লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, কা’ব ইবনে মালিকের কি হয়েছে? বনী সালেমার এক ব্যক্তি বললেন হে আল্লাহর রাসূল! তাঁকে তাঁর দুই চাদর এবং শরীরের দুই পার্শ্বদেশের প্রতি নজর আটকে রেখেছে। (অর্থ্যাৎ সে পোশাক-আশাক ও শরীর চর্চায় ব্যস্ত থাকার দরুন জিহাদে আসতে পারেনি) একথায় হযরত মুআয ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুচমকে উঠে বললেন, তুমি যা বলেছ, তা একদম ভুল কথা। আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল, আমরা তো তাঁর সম্পর্কে ভাল ছাড়া খারাপ কিছুই জানি না। একথায় রাসূলে আকরাম ﷺ চুপ রইলেন। ঠিক এ সময় তিনি সাদা পোশাকধারী এক ব্যক্তিকে মরুভূমির ভিতর দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখলেন। তিনি বললেন, সে তো আবু খায়সামা! লোকটি কাছে আসতেই বুঝা গেল তিনি সত্যিই আবু খায়সামা আনসারী। আর খায়সামা হলেন সেই ব্যক্তি, যাকে মুনাফিকরা ঠাট্টা করেছিল এক সা’ পরিমাণ খেজুর সাদকা হিসেবে দান করেছিলেন বলে।
হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি যখন তাবুক থেকে রাসূলে আকরাম ﷺএর দেশে ফিরে আসার সংবাদ পেলাম, তখন খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আর তাই মিথ্যা অজুহাত খাড়া করার বিষয় ভাবতে লাগলাম। বার বার আমার মনে প্রশ্ন জাগলো এখন কোন্ কৌশল করলে আমি আমাকে রাসূলে আকরাম ﷺএর অসন্তোষ থেকে রক্ষা পাব? আমার পরিবারে যারা বুদ্ধিমান ছিলো, আমি তাদের সাহায্য চাইলাম। এরপর যখন রাসূলে আকরাম ﷺ শীঘ্রই ফিরে আসছেন বলে জানতে পারলাম, তখন আমার মন থেকে সব আজেবাজে চিন্তা দূর হয়ে গেল। আমি স্পষ্টত বুঝতে পারলাম যে, অস্পষ্ট বা দ্ব্যার্থবোধক কথা বলে আমি রেহাই পাব না। তাই সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে আমি সত্য কথা বলারই দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলাম।
রাসূলে আকরাম ﷺ মদীনায় ফিরে এলেন। সাধারণত তিনি সফর থেকে ফিরে প্রথমে মসজিদে গিয়ে দু’রাকাআত নামায আদায় করতেন, তারপর লোকদের মধ্যে আসন গ্রহণ করতেন। এই নিয়ম অনুসারে তিনি যখন মসজিদে বসলেন, তখন যারা তাবুক যুদ্ধে না গিয়ে মদীনায় অবস্থান করছিল তারা কসম খেয়ে খেয়ে ওজর পেশ করতে লাগলো। এইরূপ লোকদের সংখ্যা ছিলো আশি জনের বেশী। রাসূলে আকরাম ﷺ তাদের প্রকাশ্য ওজর গ্রহণ করলেন। তাদের থেকে আনুগত্যের শপথ (বাইয়াত) গ্রহণ করলেন এবং তাদের গুনাহর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের গোপন অবস্থা আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিলেন।
এরপর আমি সামনে উপস্থিত হয়ে সালাম করলাম, তিনি মুচকি হাসি হাসলেন বটে, কিন্তু সে হাসিতে অসন্তুষ্টিই ঝরে পড়ছিল। এরপর তিনি আমায় কাছে ডাকলেন। আমি তাঁর সামনে গিয়ে বসলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বলো, তোমার কি হয়েছিলো? তুমি কি কারণে পিছনে থেকে গিয়েছিলে? তুমি কি তোমার যানবাহন সংগ্রহ করতে পারনি? আমি (কা’ব) নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি আপনি ছাড়া কোন দুনিয়াদার লোকের সামনে বসা থাকতাম, তাহলে নিশ্চয়ই কোন অজুহাত খাড়া করে তার অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে পারতাম। যুক্তি বা অজুহাত খাড়া করার যোগ্যতাও আমার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি খুব ভাল করেই জানি যে, আজ আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বললে আপনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন বটে, কিন্তু আল্লাহ নিশ্চিই আপনাকে আমার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দেবেন। আর যদি আমি সত্য কথা বলার দরুন আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হনও, তবুও আমি আল্লাহর নিকট শুভ ফলাফলের আশা রাখি। আল্লাহর কসম! আমার কোনো ওজর ছিল না। আল্লাহর কসম! আমি আজকের মত আর কখনো এতটা মজবুত ও শক্তিশালী ছিলাম না। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এই লোকটি সত্য কথাই বলেছে। আচ্ছা, তুমি চলে যাও। আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার ব্যাপারে কোনো ফায়সালা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো।
এরপর বনু সালেমার কতিপয় লোক আমার পিছনে পিছনে চলতে লাগল। তারা আমায় বলতে লাগল, আল্লাহর কসম! এর আগে তুমি কোনো অপরাধ করেছ বলে আমাদের জানা নেই। তুমি কেন অন্যান্য লোকদের মতো রাসূলে আকরাম ﷺএর কাছে কোন ওযর পেশ করতে পারলে না? তোমার গুনাহ মার্জনার জন্যে আল্লাহ মার্জনার কাছে রাসূলে আকরাম ﷺএর ক্ষমা চাওয়াইতো যথেষ্ট মনে হতো। এরা আমায় এতটা ভর্ৎসনা করতে লাগলো যে, আমার রাসূলে আকরাম ﷺএর কাছে ফিরে গিয়ে নিজেকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার ইচ্ছা হলো। এরপর আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার মতো এরূপ ঘটনা আর কারো ক্ষেত্রে ঘটেছে কি না? তারা বলল, হ্যাঁ, আরো দু’জনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। তুমি যা কিছু বলেছ, তারাও ঠিক সেরকমই বলেছে। আর তোমাকে যা বলা হয়েছে, তাদেরকেও সে কথাই বলা হয়েছে। হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলামঃ সে দু’জন কারা? লোকেরা বলল, তারা হলেন মুরারা ইবনে রাবীআ ‘আমেরী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হিলাল ইবনে উমাইয়া ওয়াফেকী রাদিয়াল্লাহু আনহু ।
হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, লোকেরা আমায় যে দুই ব্যক্তির নাম বলল, তারা ছিলেন খুবই আদর্শবান ও সৎকর্মশীল; তারা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু আরো বলেন, লোকেরা ঐ দু’জন সম্পর্কে খবর দিলে আমি আমার পূর্বেকার নীতির ওপর অবিচল থাকলাম।
যারা পিছনে থেকে গিয়েছিল, তাদের মধ্য থেকে আমাদের তিন জনের সাথে কথা বলতে রাসূলে আকরাম ﷺলোকদেরকে বারণ করে দিলেন। এর ফলে আশেপাশের সব লোক আমাদের থেকে দূরে সরে থাকতে লাগল। (অর্থ্যাৎ আমাদের ব্যাপারে তাদের মনোভাব একেবারে বদলে গেল) এমনকি, আমার জন্য দুনিয়ার চেহারাটাই একেবারে পাল্টে গেল। আমার চেনাজানা পৃথিবী হঠাৎ যেন অপরিচিত হয়ে গেল। এভাবে আমরা পঞ্চাশটি দিন অতিবাহিত করলাম। আমার দু’জন সঙ্গী নিজেদের ঘরেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। তারা ঘরে বসে কেঁদে কেঁদে সময় কাটাতে লাগলেন। (কারণ তারা উভয়েই বয়োবৃদ্ধ ছিলেন); কিন্তু আমি ছিলাম যুবক ও শক্তিমান। তাই আমি বাইরে গিয়ে সাধারণ মুসলমানদের সাথেই নামায পড়তাম এবং হাট-বাজারেও নির্দ্বিধায় চলাফেরা করতাম। কিন্তু অবাক হয়ে দেখতাম, কেউ আমার সাথে কথা বলছে না। নামাযের সময় রাসূলে আকরাম ﷺ নির্দিষ্ট স্থানে বসলে আমি তাঁকে সালাম করতাম এবং এই ভেবে অপেক্ষা করতাম, দেখি তিনি সালামের জবাব দিতে ঠোঁট নাড়েন কিনা। মসজিদে আমি তাঁর কাছাকাছি নামায পড়তাম এবং চুপিসারে লক্ষ্য রাখতাম, তিনি আমার দিকে তাকান কিনা। আমি যখন নামাযে লিপ্ত থাকতাম তখন তিনি আমার দিকে তাকাতেন। কিন্তু আমি যখন তাঁর দিকে তাকাতাম তিনি আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেন।
এভাবে গোটা মুসলিম সমাজের নির্লিপ্ততার দরুন আমার এ অবস্থা যখন দীর্ঘায়িত হলো, তখন একদিন আমি প্রতিবেশী আবু কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহুর দেয়ালের ভেতরে ঢুকে তাঁকে সালাম দিলাম; কিন্তু আল্লাহর কসম! সে আমার সালামের কোন জবাব দিল না। অথচ সে ছিল আমার চাচাতো ভাই এবং ঘনিষ্টতম বন্ধু। আমি তাঁকে বললাম, আবু কাতাদাহ! আমি তোমায় আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি জানো না যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি? সে যথারীতি চুপ থাকলো। আমি আবার তাঁকে কসম খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম। এবারও সে চুপ থাকলো। আমি পুনরায় কসম দিলে সে কেবল এতটুকু বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তাঁর এ কথায় আমার চোখ দিয়ে দর দর বেগে অশ্রু বেরিয়ে এলো। আমি দেওয়াল ডিঙিয়ে ফিরে এলাম।
এরপর একদিন আমি মদীনার বাজারে ঘুরাফিরা করছিলাম। এমন সময় মদীনায় খাদ্য দ্রব্য বিক্রি করতে আগত এক সিরীয় কৃষক আমায় খুঁজতে লাগল। সে লোকদের কাছে এই মর্মে অনুরোধ করছিল যে, আমাকে কা’ব বিন মালিকের ঠিকানাটা একটু বলে দিন। এর জবাবে লোকেরা আমার দিকে ইঙ্গিত করল। সে আমার কাছে এসে আমায় গাস্সানের বাদশাহ্র একটি চিঠি দিল। আমি চিঠিখানা আদ্যপান্ত পড়লাম। তাতে লেখা ছিল, ‘আমি জানতে পারলাম যে, তোমার সাথী (রাসূলে আকরাম ﷺ) তোমার ওপর জুলুম পীড়ন চালাচ্ছে। অথচ আল্লাহ তোমায় লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হবার জন্য সৃষ্টি করেননি। কাজেই তুমি আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমায় সর্বোত্তমভাবে সাহায্য করব।’ আমি চিঠিখানা পড়ে বললাম এটাও আমার জন্য এক পরীক্ষা। আমি অবিলম্বে চিঠিখানা আগুনে পুড়িয়ে ফেললাম।
এভাবে পঞ্চাশ দিনের মধ্যে চল্লিশ দিন অতিক্রান্ত হলো। এর মধ্যে আর কোন ওহীও নাযিল হলো না। হঠাৎ একদিন রাসূলে আকরাম ﷺএর এক বার্তা-বাহক এসে আমায় জানাল, রাসূলে আকরাম ﷺ আমাকে আমার স্ত্রী থেকে আলাদা থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি জানতে চাইলাম, আমি কি তাকে তালাক দেব নাকি অন্য কিছু করব? বার্তা বাহক জানাল, না, তুমি শুধু তার থেকে আলাদা থাকবে, তার ঘনিষ্ট হবে না। (অর্থ্যাৎ তার সাথে দৈহিক মিলন করবে না)।
আমার অন্য দু’জন সঙ্গীকেও অনুরূপ বার্তা পাঠানো হলো। আমি স্ত্রীকে বললাম, তুমি অবিলম্বে পিত্রালয়ে চলে যাও এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো ফায়সালা না আসা পর্যন্ত তাদের সাথেই থাকো।
হেলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রী রাসূলে আকরাম ﷺএর কাছে এসে নিবেদন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হেলাল ইবনে উমাইয়া খুবই বৃদ্ধ মানুষ; তার দেখাশুনার জন্য কোনো খাদেম নেই। আমি তার দেখাশুনা করলে আপনি কি অসন্তুষ্ট হবেন? রাসূলে আকরাম ﷺবলেন, ‘না, তবে সে যেন তোমার সাথে দৈহিক মিলনে রত না হয়’।
উমাইয়ার স্ত্রী বললেন আল্লাহর কসম! এ ব্যাপারে তার কোনো শক্তিই নেই। আল্লাহর কসম! আজ পর্যন্ত তার ব্যাপারে যা কিছু ঘটেছে তাতে সে অবিরাম কেঁদে চলেছে। (কা’ব বলেন) আমার পরিবারের অন্য সদস্য আমায় বলেন, তুমি রাসূলে আকরাম ﷺএর কাছ থেকে তোমার স্ত্রীর সেবা (খেদমত) গ্রহণের ব্যাপারে অনুমতি নিতে পারতে। তিনি তো হেলাল ইবনে উমাইয়ার সেবা করার জন্য তার স্ত্রীকে অনুমতি দিয়েছেন।’ আমি বললাম, আমি রাসূলে আকরাম ﷺএর কাছে এ বিষয়ে কোন অনুমতি চাইব না। কে জানে, এ বিষয়ে তার কাছে অনুমতি চাইলে তিনি কি বলেন। তাছাড়া আমি হচ্ছি একজন যুবক। এভাবে আরো দশ দিন অতিবাহিত করলাম।
আমদের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ ঘোষণার পর পুরো পঞ্চাশ দিন অতিক্রান্ত হল। এদিন ভোরে ফজরের নামায আদায় করে আমি আমার ঘরের ছাদে এমন অবস্থায় বসা ছিলাম, যে অবস্থার দরুন আল্লাহ তা’য়ালা কুরআন মজীদে আমাদের সম্পর্কে বলেছেন, আমার মন ক্ষুদ্র হয়ে গেছে এবং ধরিত্রি প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও আমার জন্যে তা সংকীর্ণ হয়ে গেছে।
একদিন আমি এরূপ অবস্থায় বসে আছি, এমন সময় হঠাৎ আমি সাল্’আ পাহাড়ের ওপর থেকে এক ব্যক্তির (আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু) চিৎকার শুনতে পেলাম। তিনি খুব চড়া গলায় বলতে লাগলেন, ‘ হে কা’ব তোমাকে মুবারকবাদ, তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর।’ আমি এ কথা শোনামাত্র সিজদায় পড়ে গেলাম এবং বুঝতে পারলাম যে, আমাদের মুক্তির বার্তা এসেছে। আল্লাহ আমাদের তওবা কবুল করেছেন, এ সুসংবাদ রাসূলে আকরাম ﷺফজরের নামায বাদ সমস্ত লোককে জানিয়ে দিলেন। এতে উৎসাহিত হয়ে লোকেরা আমাদের সুসংবাদ দিতে এলো। অন্যদিকে কতিপয় লোক আমার দু’জন সঙ্গীকে সুসংবাদ দিতে গেল। অপর এক ব্যক্তি (যুবাইর ইবনে আওয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহু) ঘোড়ায় চেপে আমার দিকে ছুটে এল। আস্লাম গোত্রের এক ব্যক্তি (হামযা ইবনে উমর আল-আস্লামী রাদিয়াল্লাহু আনহু) ছুটতে ছুটতে পাহাড়ের উপর গিয়ে উঠল। তার আওয়াজ ছিল ঘোড়ার চেয়ে বেশি দ্রুতগামী। যে ব্যক্তি আমায় সুসংবাদ দিচ্ছিল, তার আওয়াজ শোনামাত্র আমি (আনন্দের আতিশয্যে) নিজের দু’প্রস্থ কাপড় খুলে তাকে পরিয়ে দিলাম। আল্লাহর কসম! সেদিন ঐ দু’প্রস্থ কাপড় ছাড়া আমার আর কোনো পোশাক ছিল না। তাই আমি আরো দু’খানা কাপড় ধার করে নিলাম এবং তা পরেই রাসূলে আকরাম ﷺএর উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম।
পথিমধ্যে লোকেরা দলে দলে এসে আমার সাথে সাক্ষাত করে তওবা কবুলের জন্যে আমায় মুবারকবাদ জানাতে লাগল। তারা আমায় বলতে লাগল, আল্লাহ তোমার তওবা কবুল করেছেন বলে তোমাকে আন্তরিক মুবারকবাদ। শেষ পর্যন্ত আমি মসজিদে (নববীতে) প্রবেশ করলাম। তখন রাসূলে আকরাম ﷺ সেখানে বসা ছিলেন; লোকেরা ছিল তাঁর চারদিক পরিবেষ্টন করে। হঠাৎ তাল্হা ইবনে উবায়দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু খুব দ্রুত ছুটে এসে আমার সাথে সজোরে করমর্দন করে আমায় মুবারকবাদ জানালেন। আল্লাহর কসম! তাল্হা ছাড়া এভাবে আর কোনো মুহাজির উঠে আসেননি। (বর্ণনাকারী বলেন) এ জন্যে হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু হযরত তাল্হা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর এই ব্যবহার কোনোদিন ভুলেননি।
হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি যখন রাসূলে আকরাম ﷺকে সালাম দিলাম, তখন তাঁর মুখমণ্ডল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। তিনি বললেন, ‘তোমার জন্মদিন থেকে শুরু করে এ পর্যন্তকার সবচাইতে উত্তম দিনের খোশ-খবর গ্রহণ কর।’ আমি জানতে চাইলাম, এ সুসংবাদ কি আপনার তরফ থেকে না আল্লাহর তরফ থেকে হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন ‘না, আমার থেকে নয়, বরং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে।’ বস্তুত রাসূলে আকরাম ﷺ যখন কোনো ব্যাপারে আনন্দিত হতেন, তাঁর চেহারা যেন এক টুকরা চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। তাঁর চেহারার এই পরিবর্তনটা আমরা বুঝতে পারতাম।
এরপর আমি যখন তাঁর সামনে বসলাম, তখন স্বতস্ফূর্তভাবে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার তওবা কবুল হওয়ায় আমার সমস্ত ধন-মাল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যে সাদকা করে দিতে চাই।’ রাসূলে আকরাম ﷺ বললেন, ‘কিছু মাল তুমি নিজের জন্য রেখে দাও; এটাই তোমার জন্য উত্তম।’ আমি বললাম, ‘বেশ, তাহলে আমার খায়বরের অংশটা রেখে দিলাম।’ আমি আরো নিবেদন করলামঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আমায় সত্য কথা বলার দরুন রেহাই দিয়েছেন। কাজেই আমার তওবার এও দাবী যে, বাকী জীবনে আমি কেবল সত্য কথাই বলে যাব।’
আল্লাহর কসম! আমি যখন এ কথাগুলো রাসূলে আকরাম ﷺএর কাছে বলেছিলাম, কখন থেকে সত্যের ব্যাপারে আল্লাহ অন্য কোন মুসলিমকে আমার মত এমন চমৎকারভাবে পরীক্ষা করেছেন বলে আমার জানা নেই। আল্লাহর কসম! তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমি কোনো মিথ্যা বলার অভিপ্রায় করিনি। অবশিষ্ট জীবনেও আল্লাহ আমাকে মিথ্যার অভিশাপ থেকে রক্ষা করবেন বলে আশা পোষণ করি। তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বিশেষ আয়াত নাযিল করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পয়গাম্বর, মুহাজির ও আনসারদের তওবা কবুল করেছেন। তিনি তাদের প্রতি দয়াশীল ও মেহেরবান। আর যে তিনজন পিছনে থেকে গিয়েছিল, তাদের তওবাও তিনি কবুল করেছেন। এমনকি শেষ অবধি এ দুনিয়া প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ….. আল্লাহকে ভয় করে চলো এবং সত্যনিষ্ঠদের সঙ্গে থাকো।’ (সূরা তওবাঃ ১১৭-১১৯ আয়াত)
হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু আরো বলেন, আল্লাহর কসম! আল্লাহ যখন থেকে আমায় ইসলাম গ্রহণের তওফীক দিয়েছেন, তখন থেকে এ পর্যন্ত আমি রাসূলে আকরাম ﷺএর নিকট সত্য কথাই বলে আসছি এবং এটা আমার জন্য আল্লাহর সবচাইতে বড় নিয়ামত। (আল্লাহর কাছে আমার প্রার্থনা) আমি যেন মিথ্যা কথা না বলে ধ্বংসপ্রাপ্ত না হই, যেমন করে অন্যান্য মিথ্যাবাদীরা ধ্বংস হয়ে গেছে। আল্লাহ অহী অবতরণের যুগে মিথ্যাবাদীদের সবচাইতে বেশি নিন্দা করেছেন। সূরা তওবায় তিনি বলেন, ‘তোমরা যখন তাদের কাছে ফিরে যাবে, তখন তারা আল্লাহর কসম খেয়ে তোমাদের সামনে ওজর পেশ করবে। যেন তোমরা তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না কর। যা হোক, তাদেরকে তুমি ছেড়েই দাও। তারা মূলত অপবিত্র আর (তাই) তাদের স্থান হবে জাহান্নাম। এটা হলো তাদের কৃতকর্মের ফসল। তারা তোমাদেরকে খুশি করার জন্য তোমাদের নিকট হলফ করে মিথ্যা অজুহাত পেশ করবে। তোমরা তাতে ওদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ কিছুতেই এহেন ফাসেকদের প্রতি সন্তুষ্ট হন না।’ (সূরা তওবা ৯৫-৯৬)
হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু আরো বলেন, যারা রাসূলে আকরাম ﷺএর নিকট হলফ করে মিথ্যা অজুহাত পেশ করেছিল, তিনি তাদের ওজুহাত গ্রহণ করে তাদের থেকে বাইয়াত নিয়েছিলেন এবং তাদের গুনাহ মার্জনার জন্য দো’আও করেছিলেন। কিন্তু আমাদের তিনজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণটা পিছিয়ে দিলেন। অবশেষে মহান আল্লাহ বিষয়টির নিস্পত্তি করে দিলেন। আল্লাহ যে বলেছেন, ‘আর যে তিনজন পিছনে থেকে গিয়েছিল’ এর অর্থ জিহাদ থেকে আমাদের পেছনে থাকা নয়; বরং এর অর্থ হলো, যারা মিথ্যা অজুহাত পেশ করেছিল এবং রাসূলে আকরাম ﷺ তা কবুল করেছিলেন। আমাদের ব্যাপারটা তাদের পরে রাখা হয়েছিল।
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, রাসূলে আকরাম ﷺ বৃহস্পতিবার তাবুক যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। কেননা, তিনি বৃহস্পতিবার সফরে যাওয়া পছন্দ করতেন।
অপর এক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, তিনি সাধারণত দিনের বেলা দুপুরের পূর্বে সফর থেকে ফিরতেন এবং সফর থেকে ফিরেই প্রথমে তিনি মসজিদে যেতেন। এরপর সেখানে দু’রাকায়াত নামাজ পড়তেন এবং তারপর বসতেন।
[বুখারী ও মুসলিম]
[ রিয়াদুস সালেহীন থেকে সংগৃহিত। হাদিস নং - ২১ ]
মুত্তাফাকুন আলাইহি-৪
বিষয়: বিবিধ
২১৭২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন