রোহিঙ্গারা এখন বিশ্ব রাজনীতির দাবারগুটি
লিখেছেন লিখেছেন বিবেকবান ৩০ নভেম্বর, ২০১৬, ০৯:২৪:২৬ রাত
বিশ্বাস করেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমার আপাতত কিছু যাবে আসবে না! দিব্যি অফিস করে আয়েশি অঘ্রাণের এই সন্ধ্যায় এক কাপ ক্যাপাচুনো খেয়ে বাসায় গিয়ে গান শুনতে থাকবো- ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা’! তবুও মানবতাবাদী একটা স্যাঁতস্যেঁতে হৃদয় আছে, সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডের গীন্সবার্গ আমার প্রিয় কবি আর একাত্তরের উদ্বাস্ত স্মৃতি আমার বাপ-মায়ের জেনেটিক সূত্রে মস্তিষ্কে তৈরি করে মিশ্র অভিঘাত! তাই দুরুদুরু মনের ভাবনা- প্রতি মুহূর্তে রূপ পাল্টানো রাজনীতির বিশ্বে একদিন তো আমিও হতে পারি সাগর ভাসান দেয়া রিফিউজি! তখন যদি এমন হয় পেছনে তাড়া করছে ঘাতক, আর সামনে আশ্রয়ের উপকূল আটকে দাঁড়িয়ে আছে বিমুখ সৈন্য! এই অকূল পাথারে তখন কোথায় যাবো! কবি কামরুজ্জামান কামুর মতন মন চায় বলে উঠি- ‘আয় রে আমার নিখিল-নিরাশ্রয়/ আমার বুকের দুধের ধারার তলে/ আমার দেহের রক্তনদীর ধারে/ কিসের বাঙালি কিসের রোহিঙ্গা রে...’
তারপর বাস্তবতায় ফিরি! রোহিঙ্গাদের জন্যে সীমান্ত খুলে দেয়া উচিত, কিন্তু কে দেবে? আওয়ামী লীগ সরকার? তাতে তার লাভ? কিছু নেই, অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে অথবা পররাষ্ট্রনীতির চাণক্যশাস্ত্রে! সুতরাং সীমান্ত খুলবে না! শত হ্যাশট্যাগেও ফুটবে না ফুল! ওচিত্য, মানবিকতা এইসব পেরিয়ে উপসংহার পেয়ে যাই।
তারপর নির্মোহ শীতল হৃদয়ে সমাজতাত্ত্বিকদের মত ভাবতে বসি! রাজনৈতিক অর্থনীতি যেহেতু পড়েছিলাম, স্বার্থপর সমীকরণগুলো ধরা পড়ে সহজে! রোহিঙ্গাদের এথনিক ক্লিনজিং করার ‘স্টেইট ইনিশিয়েটেড এটেম্পট’ তো আজকের নয়! অনেকে ১৯৭১ এর ভারতের মতন বাংলাদেশকে উদার হতে বলেন, রিফিউজিদের আশ্রয় দিয়ে! আচ্ছা, ভারত কি সত্যিই উদার ছিল? যদি আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস না থাকতো, যদি ২৫ মার্চের প্রথম প্রহর থেকেই রাজারবাগের পুলিশ বাহিনী, পিলখানার ইপিআর আর সারা দেশে ছড়ানো ছিটানো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ না করতো, সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলে স্বাধীন হওয়ার বদলে আমরা যদি ভারতে চিরস্থায়ীভাবে থেকে যেতে চাইতাম, তাহলে কি তারা আমাদের আশ্রয় দিত একই উষ্ণতায়? বাংলাদেশও তো লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে, কিন্ত তাদের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যের কথা কি আমরা স্পষ্টভাবে জানি? তারা কি রাখাইন স্টেটের ভেতরে কোন স্বাধিকার আন্দোলন সংগঠিত করেছে, কিংবা কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধের আগ্রহ কি তাদের আদৌ আছে? নাকি কেবল পালিয়ে এসে এখানে থেকে যাওয়াটাতেই ঘটনার সমাপ্তি? অথবা শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যাওয়া, নইলে টেকনাফ অঞ্চলে যেহেতু জীবিকার তেমন সুযোগ এই বর্ধিত জনসংখ্যার নেই তাই বাধ্য হয়ে ইয়াবা আর চোরাচালানে জড়িত হওয়াই তাদের ভবিতব্য? জিহাদী গ্রুপের রিক্রুট হওয়াও আরেকটা বিকল্প বলে শোনা যায়! এইসব প্রেক্ষাপটে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন আর রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের প্রেক্ষাপট কি মেলে?
রোহিঙ্গা বিতাড়নের পলিটিক্যাল গেইম থিওরির কথাও ভাবতে হয় বৈকি! মিয়ানমার চায় তারা লাশ ফেলুক, আমরা সীমান্ত খুলে দিই! যে মুহূর্তে বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেবে সেই মুহূর্ত থেকে আরো বিপুল উৎসাহে তারা রোহিঙ্গা নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়বে, মূল উদ্দেশ্য চরম আতঙ্ক তৈরি করে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের সবাইকে এই সীমান্তে ঠেলে দেয়া! সুতরাং নন রেসপনসিভ বিহেভিয়ারই এই গেইমে সবচেয়ে যৌক্তিক, কারণ বাঙালি যেমন যুদ্ধ করে নিজ ভূমিতে ফিরে আসতে চাইতো একাত্তরে, রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়! ভূ-রাজনীতির কারণেই, কারণ ওখানে মাথার ওপর চীন, আমেরিকাও গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েছে, ভারতেরও জ্বালানি, শিল্প আর অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে! সেখানে আরো আট লক্ষ রোহিঙ্গাকে নেয়ার জন্যে এখন জাতিসংঘ আহবান জানাচ্ছে, কিছুদিন পর তারা আমাদের বাৎসরিক কিছু খরচা ধরিয়ে দেবে, কিন্ত সমাধান দেবে না! চীন, আমেরিকা, ভারত কাউকেই বাংলাদেশ পাশে পাবে না কারণ তারা কেউই মিয়ানমারের সামরিক+গণতন্ত্র লবিকে ক্ষিপ্ত করে ব্যবসা হারাতে চাইবে না!
এথনিক ক্লিনজিং এর অর্থনীতিও বেশ চমৎকার, লাভজনকও। একদিকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে বাংলাদেশের উপর বোঝা চাপিয়ে দেয়া গেলো, তারপর এই বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল অস্থিতিশীল থাকলে তাকে ঘিরে পর্যটনের সম্ভাবনা আর গভীর সমুদ্র বন্দরকেন্দ্রিক সম্ভাব্য ব্যবসা বাণিজ্যগুলো আকিয়াবের দিকে টেনে নেয়া গেলো (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সোনাদিয়ার সমুদ্র বন্দর যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-চীনের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের ফাঁকে আটকা পড়েছে, ওইদিকে Sittwe তে ভারত একটা গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করেছে যা সেভেন সিস্টার্স এর জন্য ব্যবহৃত হবে, ফলে প্রস্তাবিত সোনাদিয়া ইতোমধ্যেই তার এক বড় বাজার হারিয়েছে)। আবার মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম এনজিওদের টাকা পয়সা এনে জামাতি ও জিহাদী কার্যক্রমকে বেগবান করা গেলে পার্বত্য অঞ্চলে নতুন জটিলতা পাকানো হলো, পাহাড়ি-বাঙ্গালি-রোহিঙ্গা ত্রিমুখী দ্বন্দ্বও তৈরি করা গেলো! ফলাফল- ওদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকা, আরো বেশি অস্ত্র কেনা, চীন-রাশিয়া-ভারত তিন বন্ধুর কাছ থেকেই! আর স্থানীয় অর্থনীতিতে ইয়াবা, চোরাচালান, মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া-থাইল্যন্ড-সিঙ্গাপুরে মানব পাচার তো আছেই! কে জানে, হয়তো রোহিঙ্গাদের জিহাদী শক্তিতে বলবান হয়েই আরেক ‘ইসলামিক স্টেইট’ এর জন্ম হতে পারে বাংলাদেশ আর আরাকানের পাহাড়ে, যেহেতু আমেরিকান নেভির জন্য এই পারের সমুদ্র গুরুত্বপূর্ণ!
এই গেইমে তাই বাংলাদেশের চুপ থাকাকেও দায়ী করা যায় না! কবি, মানবতাবাদী মানুষেরা যা অনুভব করেন রাষ্ট্র তাই মুখ ফুটে বলতে পারে না সব সময়! এখানেই পায়ের শেকল বড় নিষ্ঠুর ঠেকে! কারণ যে শিশুগুলো আরাকানে না খেয়ে আছে, যারা জীবনের ভয় নিয়ে এদিক ওদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছে নাফ নদীর উপকূল ধরে, তাদের কাছে একটাই বাস্তবতা- জীবনটা বাঁচানো! সব কূল রক্ষা করে জাতিসংঘকে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে বলা তাই সবচেয়ে ভালো এসকেইপ, তাতে দায়িত্ব পালনও হয়, আবার দায় এড়ানোও যায়!
এইসব টানাপড়েনে উত্তরাধুনিক শতাব্দীর দ্বিতীয় শতক তাই আশ্চর্য পরাবাস্তব ঠেকে! যেখানে আবেগ উদ্বাহু আহবান জানায় নাফ নদীর তীরে, বিবেচনাবোধ দেয় কোস্টগার্ডের সতর্ক প্রহরা!
বিষয়: বিবিধ
১২১৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গুরুত্বপূর্ণ লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন