ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা

লিখেছেন লিখেছেন বিবেকবান ২০ নভেম্বর, ২০১৪, ০৮:৪৮:৪৮ রাত



অনূদিত

ইসলাম তার ঊষালগ্নেই স্বাধীনতার মূলনীতি ঘোষণা করেছে। বিশ্বাসীদের নেতা, আমিরুল মুমিনিন হযরত ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা.) সেই বিখ্যাত উক্তিটি আমরা স্মরণ করতে পারি, যেখানে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘পৃথিবীর বুকে তুমি মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছো, অথচ তার মা তাকে স্বাধীন মানুষ রূপেই জন্ম দিয়েছেন।’ চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) একবার কিছু লোককে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সৃষ্টির শুরু থেকে আল্লাহই যখন তোমাকে স্বাধীন মানুষ করে সৃষ্টি করেছেন, তখন কোনো মানুষ কখনো তোমাকে দাস বানাতে পারে না।’

আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন করেই সৃষ্টি করেছেন এবং এই স্বাধীনতা নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং তার জন্মগত অধিকার হচ্ছে কেউ তাকে তার এই স্বাধীনতা ভোগের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না এবং জোর-জবরদস্তি তাকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি করবে না। ইসলাম যখন স্বাধীনতাকে তার মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করে তখন সময়টি ছিল এমন যে, অধিকাংশ মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনীতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিকভাবে আক্ষরিক অর্থেই ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল।

মানুষের এই বহুরূপ দাসত্ব-শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে ইসলাম স্বাধীনতা ঘোষণা করল। বিশ্বাসের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা এবং সমালোচনার স্বাধীনতা সব ক্ষেত্রেই ইসলাম এই স্বাধীনতা দিয়েছে। আর চিরকাল ধরে এসব বিষয়েই মানুষ তাদের স্বাধীনতা প্রত্যাশা করে আসছে।

ধর্মীয় স্বাধীনতা বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা

ইসলাম স্বয়ং একটি ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম বা বিশেষ কোনো ধর্মগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দমননীতি অনুমোদন করে না। এ প্রসঙ্গে ইসলাম ধর্মগ্রন্থের বহু উদ্ধৃতি এখানে দেয়া যাবে। পবিত্র কুরআনের মক্কী যুগের সূরায় আল্লাহ বলছেন, ‘এবং যদি তোমার প্রভু ইচ্ছা করতেন তাহলে পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী সকল মানুষকেই এক সাথে বিশ্বাসী বানিয়ে ফেলতে পারতেন। সুতরাং (হে মুহম্মদ!) তুমি কি তাহলে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য লোকদের বাধ্য করতে চাও?’ [সূরা ইউনুস, আয়াত-৯৯]।

মাদানী যুগেও আমরা আল কুরআনের এই বিস্ময়কর প্রকাশ দেখতে পাই: ‘ধর্মের ক্ষেত্রে জবরদস্তি নেই। মিথ্যা থেকে সত্যকে যথার্থভাবেই পৃথক করে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে।’ [সূরা আল বাকারা: ২৫৬]

এই বিস্ময়কর আয়াতের তাৎপর্য এখানে যে, ইসলাম স্বাধীনতাকে কতটা পবিত্র করেছে এবং একে কতটা মর্যাদা দিয়েছে তা এ আয়াতে দীপ্যমান হয়ে উঠেছে।

ইসলাম-পূর্ব অজ্ঞতা ও ভ্রষ্টতার যুগের আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকদের মধ্যে প্রচলিত একটি প্রথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে সময় কোনো মহিলা যদি গর্ভবতী হতে ব্যর্থ হতো, তখন সে ঈশ্বরের নামে মানত করতো যে, ঈশ্বর যদি তাকে একটি বাচ্চা দেন, তাহলে সে তাকে ইহুদি বানাবে। এটা এ কারণে করা হতো যে, আরব উপদ্বীপের এই দুই গোত্রের মধ্যে ইহুদিদের একটা প্রভাব ছিল। যখন ইসলামের অভ্যুদয় হলো এবং আওস ও খাজরাজ গোত্রের কিছু লোক যখন আল্লাহর প্রতি পরম বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে ইসলাম গ্রহণ করলো, তখন যেসব বাবা-মা তাদের মানত পূরণের জন্য নিজেদের সন্তানদের ইহুদী ধর্মের দীক্ষা দিয়েছিল, তারা তখন এই বিরুদ্ধ ধর্ম থেকে সন্তানদের নিষ্কৃতি দিয়ে তাদের নিজ ধর্ম ইসলামে ফিরিয়ে আনতে চাইল।

এ প্রেক্ষাপটে ইসলামের অবস্থা কি ছিল? যদিও ঐ লোকদের ইহুদী সন্তানরা বৈরী পরিবেশের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করছিল এবং যদিও সে সময় ইসলাম ও ইহুদীদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সংঘাত বিরাজ করছিল, কিন্তু তারপরও ইসলাম কাউকে অন্যের ধর্ম ত্যাগে বাধ্য করানো কিংবা জোর করে ইসলাম গ্রহণ করানো অনুমোদন করেনি।

উল্লেখ্য, এটি ছিল সেই বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সময়, যখন বলা হতো, ‘হয় খ্রিস্টান হও, না হয় মরো’। ঠিক তখনই ধ্বনিত হয়ে উঠল আল কুরআনের চিরন্তন বাণী: ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো বাড়াবাড়ি নয়।’ ইসলামের এই জ্যোতির্ময় ঘোষণা যখন উচ্চারিত হচ্ছিল, তখন পারস্যেও বিরাজ করছিল অস্বাভাবিক অবস্থা। সেখানেও ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল।

তবে বলে রাখা ভাল যে, ইসলামের এই স্বাধীনতার মূলনীতি কোনো সামাজিক বিবর্তনের পরিণতি হিসেবে প্রতীয়মান হয়ে ওঠেনি কিংবা কোনো বিপ্লবের প্রেক্ষিতেও এই স্বাধীনতার দাবি উচ্চকিত হয়নি। অথবা এটি কোনো সমাজ বিকাশের চূড়ান্ত পরিণতি বা প্রান্তিকতার প্রেক্ষিতেও দুর্বর হয়ে ওঠেনি। বরং ইসলামের এই স্বাধীনতার বাণী তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু এবং সে সময় বিদ্যমান সামাজিক প্রেক্ষিতের নিছক প্রতিক্রিয়া থেকে তা ছিল অনেক ঊর্ধ্বে।

ইসলামের এই স্বাধীনতার বাণী নিছক কালের কোলাহল ছিল না, কারণ কোনো মানুষের চিন্তাপ্রসূত বাণীতো এ নয়! এ যে স্বর্গবাণী, এ যে জান্নাতি আবেহায়াত, এ যে আল্লাহর কালাম, এ যে ঐশীবাণী। মানুষকে উন্নত পথের দিশা দিতে, তাদের পরিশুদ্ধ করতে এবং মানবতাকে সমুন্নত করতেইতো এই হেদায়াত বা ঐশী পথ নির্দেশের আবির্ভাব। আর এ সবকিছুকেই মাথায় রেখে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, ইসলামের এই বিশ্বাস ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ধারণা এবং তার জন্য যে মূলনীতি ইসলাম অনুমোদন করে তা অবশ্য গতানুগতিক ও বল্গাহীন নয়, শর্তহীন ও বাধ্যবাধকতামূলকও নয়।

প্রধান শর্ত হচ্ছে, ধর্মকে খেলনায় পরিণত করা উচিত নয়। ইহুদীরা যেমন বলে, ‘মুসলমানদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি সকাল বেলা ঈমান আনও আর সন্ধ্যা বেলায় অস্বীকার কর, তাহলেই তারা তাদের ধর্ম থেকে ফিরে যাবে।’ (আলে ইমরান: ৭২)। তারা পরস্পরকে ঈমানদারীর ভান করে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য প্ররোচিত করে এবং একদিন বা এক সপ্তাহ পর ইসলামের ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তা ত্যাগ করার জন্য কুমন্ত্রণা দেয়। ধর্মকে এভাবে খেলাতে পরিণত করা আল্লাহর পছন্দ নয়।

এ কারণে সর্ব প্রশংসিত আল্লাহর অমোঘ বিধান হচ্ছে, যে কেউই একে গ্রহণ করুক না কেন, সে যাতে দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয় সহকারে একে গ্রহণ করে, যাতে সে বিশ্বস্তা বজায় রাখতে পারে এবং সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে এর ওপর অটল-অবিচল থাকতে পারে। যদি তা না করা হয়, তাহলে স্বধর্ম ত্যাগের জন্য তাকে শাস্তি মাথা পেতে নিতে হবে। সুতরাং এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ধর্ম গ্রহণের জন্য আপনাকে বাধ্য করা হচ্ছে না, কিন্তু যদি গ্রহণ করেন, তাহলে সম্পূর্ণ সচেতনভাবেই আপনাকে এটি গ্রহণ করতে হবে এবং আপনার বিশ্বাসের প্রতি আপনাকে অবশ্যই সৎ থাকতে হবে।

চিন্তার স্বাধীনতা

দ্বিতীয় স্বাধীনতা হচ্ছে চিন্তা ও গবেষণার স্বাধীনতা। ইসলাম তার অভ্যুদয়কাল থেকেই সমগ্র বিশ্বজগত সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

মহাগ্রন্থ আল কুরআনের আহ্বান হচ্ছে: ‘হে নবী এদেরকে বল, আমি তোমাদের শুধু একটি উপদেশ দিচ্ছি, আল্লাহর ওয়াস্তে তোমরা একাকী ও যুগলবদ্ধভাবে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ, তোমাদের এই সঙ্গীর মধ্যে পাগলামীর কোন জিনিসটি রয়েছে?’ [সারা: ৪৬); তাদের বল, জমিন ও আসমানে যা কিছু আছে, তা চোখ মেলে দেখ।’ [ইউনুস: ১০১]; ‘এই লোকেরা কি ভূ-পৃষ্ঠে চলাফেরা করে না? তাহলে তাদের হৃদয় বুঝতে পারতো, তাদের কান শুনতে পারতো। আসল কথা হলো, চোখ কখনো অন্ধ হয় না, কিন্তু সেই হৃদয় অন্ধ হয়, যা বুকের মাঝে রয়েছে’ [আল হজ্জ: ৪৬]

ইসলাম অলিক কল্পনা, বদ্ধমূল ধারণা ও আন্দাজ-অনুমানের অনুসরণকে নিন্দা করে। বলা হয়েছে: ‘অথচ এ ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। তারা নিছক আন্দাজ-অনুমানের অনুসরণ করছে মাত্র। আর দৃঢ় প্রত্যয়ের পরিবর্তে আন্দাজ-অনুমান কোনো কাজে আসে না।’ [আন নাজম: ২৮]

যারা নিজেদের মনগড়া ধারণা কিংবা পূর্ব-পুরুষ ও কর্তাব্যক্তিদের অন্ধ অনুসরণ করে ইসলাম তাদেরকে তিরস্কার করে। তারা পুনরুত্থান দিবসে আহাজারি করে বলবে: ‘হে আমাদের প্রভু! আমরা আমাদের নেতাদের ও মহান ব্যক্তিদের আনুগত্য করেছি, কিন্তু তারা আমাদের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে বিপথে চালিত করেছে।’ [আল আহযাব: ৬৭]।

এদের সম্পর্কে আল কুরআনে বলা হয়েছে: ‘না, বরং এরা বলে, আমরা আমাদের পূর্ব-পুরুষদের একটি পথ ও ধর্মের অনুসারী পেয়েছি আর আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।’ [যুখরুখ: ৬২]

যারা সত্যের বিবেচনার পরিবর্তে অন্ধ অনুসণকেই বেশি প্রাধান্য দেয়, হেদায়েতের পরিবর্তে যারা বিভ্রান্তিকে প্রভু বানায় ইসলাম তাদের ইতর শ্রেণীর বলেই মনে করে। তেমনিভাবে ইসলাম প্রাচীন বা গোঁড়াপন্থীদের প্রগতিবিরোধী ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করে তার অবস্থানকে সুস্পষ্ট করে।

বরং ইসলামের অবস্থান হচ্ছে সব সময় মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ ও গভীর চিন্তা-ভাবনার পক্ষে।

ইসলাম যে অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তিবাদকে প্রাধান্য দেয় তার প্রমাণ হচ্ছে আল কুরআনের এই ভাষ্য: ‘তারা বলে কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত বেহেশতে যেতে পারবে না, যতক্ষণ না সে ইহুদী বা খ্রিস্টান হবে। মূলত এটি তাদের মনের কামনা মাত্র। তাদের বল, তোমাদের দাবিতে তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে এর পক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ পেশ কর।’ [বাকারা: ১১১]

ইসলাম তার ধর্ম-বিশ্বাসের সত্যতা প্রমাণের জন্য সব সময় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ উপস্থাপন করে থাকে। এ কারণেই মুসলিম মনীষীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, যথার্থ বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই ধর্ম-বিশ্বাসের সাথে সত্যিকার সম্পর্কের ভিত রচিত হয়। যেমন, আল্লাহর অস্তিত্ব এবং মহানবীর নবুয়তের মতো বিষয়গুলোর সত্যতা প্রমাণে প্রথমত এই বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিকেই ব্যবহার করা হয়েছে।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুয়তের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য তার অলৌকিকতার পাশাপাশি সকল সাক্ষ্য-প্রমাণসহ যখন বলা হয় যে, এসব প্রমাণ তাঁর সত্যতাকেই দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে, তখন এর মাধ্যমে মূলত যুক্তিবাদকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

তেমনিভাবে ভণ্ড নবীর মোকাবিলায়ও যুক্তিবাদকেই গ্রহণ করা হয় যে, সে মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড, কারণ তার নবুয়তের দাবির পক্ষে কোন ভিত্তি নেই। এর মাধ্যমে মানুষের মন ও চিন্তা তথা বুদ্ধিবৃত্তিকে যে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, তাই প্রমাণ হয়। বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতাকেও যে ইসলাম লালন করে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতাকে জোরালোভাবে সমর্থন করে তার প্রমাণও এখানে পাওয়া যায়।

আমরা ‘উলামাদের (মুসলিম আলেমদের) মত-পার্থক্যের দৃষ্টান্তকে এখানে উল্লেখ করতে পারি। আমরা দেখেছি, তারা একে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, একে অন্যের মত খণ্ডন করেছেন, পরস্পরের সমালোচনা করেছেন এবং এ জন্য তারা কোন অস্বস্তিবোধ করতেন না কিংবা একে কোন দোষণীয় মনে করতেন না। এর একটি বড় উদাহরণ হল ইমাম আর জামাখশারি লিখিত ‘আল কাশশাফ’ নামের একটি গ্রন্থ।

লেখক যদিও একজন মুতাজিলা এবং গ্রন্থটি যদিও চিন্তার ক্ষেত্রে দুটি বিভ্রান্ত গোষ্ঠীর আশীর্বাদপুষ্ট, তবুও সুন্নীরা একে একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে বিবেচনা করেন। ইবনে আল মুনিরের মত সুন্নী আলেম বিশেষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এবং এর কয়েকটি বিষয়ের দুর্বলতা তুলে ধরতে কিংবা এর পাল্টা জবাব দেয়ার জন্য এর উপরে টীকা লিখেছিলেন।

একইভাবে বিখ্যাত সুন্নী ইমাম ইবনে হাজারও ‘আল কাফি আল সাফি’ নামে আরেকটি গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন, যেখানে তিনি জামাখশারির গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসসমূহের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য হাদীসসমূহের আদি উৎস সন্ধান করেছিলেন। সুতরাং মুসলিম আলেমগণ বিতর্ক, পরস্পরের মত খণ্ডন এবং একে অন্যের গবেষণা থেকে উপকৃত হওয়াকে দোষণীয় মনে করতেন না।

গোঁড়ামী, যুক্তিহীনতা ও বিদ্বেষের পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার যথার্থ পরিবেশ, পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছিল। আর এসব কিছুই মুসলিম মিল্লাতের চিন্তার স্বাধীনতা ও জ্ঞানচর্চার প্রমাণ।

বাক ও সমালোচনার স্বাধীনতা

ইসলাম কথা বলার ও সমালোচনার স্বাধীনতাকে শুধুমাত্র এর মূলনীতির অংশ হিসেবেই গ্রহণ করেনি কিংবা একে শুধুমাত্র স্বাধীনতার অংশ হিসেবেই গুরুত্ব প্রদান করেনি, বরং সমাজ-সংস্কৃতি ও গণমানুষের স্বার্থ, সার্বজনীন নৈতিকতা ও জীবন পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত জনগুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে সত্য বলা, সত্য প্রকাশ এবং সমালোচনাকে আইনগত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হক কথা বলা, সমালোচনা করা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করাকে ধর্মীয় কর্তব্যেরও অংশ বলে গণ্য করা হয়েছে।

সত্যের প্রতি আহ্বান, সৎ লোকদের উৎসাহ প্রদান, দুষ্কৃতিকারীদের নিন্দা করাকে ঈমানদারীর লক্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ঈমানদার ব্যক্তির নীরবতা যদি সমাজের ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে এর জন্য আল্লাহর কাছে তাকেও জবাবদিহি করতে হবে। এ কারণে ঈমানদার ব্যক্তির উপর অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে পড়ে সত্যের পক্ষে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসা এবং এক্ষেত্রে কোন রক্ত চক্ষুর হুমকি বা কোন পরিণতির পরোয়া না করে সত্যকে সবার উপরে স্থান দেয়া।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: ‘সৎ কাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখ আর যে বিপদই আসুক না কেন তার জন্য ধৈর্য ধারণ কর। এসবই আল্লাহ প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং এ থেকে অব্যাহতি পাওয়া যেতে পারে না। [সূরা লোকমান: আয়াত ১৭]বস্তুত, এটিই ইসলামের পথ, এটিই ইসলামের ব্যাপ্তি।

ইসলাম লোকদের মুখে ঠুলি পরানোর ধারণা প্রত্যাখ্যান করে; যেখানে লোকেরা কেবল অনুমতি নিয়ে কথা বলবে আর কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে ধর্ম-বিশ্বাস লালন করবে। এমন অবস্থা বিরাজ করছিল ফেরাউনী শাসকদের রাজত্বে। ফেরাউনের কাহিনীতে দেখা যায়, ফেরাউন তার জাদুকরদের বলছে ‘আমার অনুমতি না নিয়েই তোমরা মুসার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছ?’ [ত্ব-হা: ৭১] কত জঘন্য এই আচরণ, কত জঘন্য এই মানসিকতা!

সে লোকদেরকে তার অনুমতি ছাড়া কোন বিশেষ বিশ্বাস লালন করতে দিতেও রাজি নয়! ক্ষমতাসীন লোকদের অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তি মুখে ঠুলি পড়ে থাকবে!

ইসলামের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। বস্তুত ইসলাম এসেছে মানুষকে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ দেয়ার জন্য। চিন্তা-গবেষণার জন্য ইসলাম বরং নির্দেশ প্রদান করে। লোকেরা যে বিশ্বাসকে ভাল মনে করে তাকে লালন করার এবং যাকে অযথার্থ মনে করে তা থেকে বিরত থাকার পূর্ণ অধিকার ইসলাম মানুষকে প্রদান করেছে।

বরং ইসলাম মানুষের উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছে যে, তারা যেন মনের বিরুদ্ধে কোন ধর্ম বিশ্বাসকে গ্রহণ না করে। ইসলাম বলে, এই ধর্মকে যদি কেউ গ্রহণ করে তাহলে যেন সচেতনভাবে জেনে বুঝে আন্তরিকতার সাথেই একে গ্রহণ করে।

ইসলাম মুসলমানদের বিশ্বাসের দৃঢ়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করারও নির্দেশ দেয়। এমনকি ধর্ম বিশ্বাসকে লালন করার ক্ষেত্রে যদি জুলুম নির্যাতনও সহ্য করতে হয় তাহলে তাও করতে হবে এবং জুলুম মোকাবিলায় প্রয়োজনে অস্ত্র ধারণেরও অনুমোদন দেয়, যাতে সমস্ত বাধা অপসারিত হয় এবং আনুগত্য কেবল মাত্র আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত হয়।

ইসলামে সত্যের জন্য সংগ্রাম বা জিহাদের আইনগত যথার্থতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: ‘অস্ত্র ধারণের অনুমতি দেয়া হল সে সব লোকদেরকে, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা হচ্ছে। কেন না, তারা নির্যাতিত। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করার পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। তাদেরকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে শুধু এ কারণে নিজ বাড়ি-ঘর থেকে বাহির করে দেয়া হয়েছে যে, তারা ঘোষণা করে ‘আল্লাহ আমাদের একমাত্র প্রভু। আল্লাহ যদি (এভাবে যুদ্ধে অনুমতি দিয়ে) কিছু লোককে অপর কিছু লোক দ্বারা পরাভূত না করতেন, তাহলে (তাদের ঔদ্ধত্যের কারণে পৃথিবীর বুক থেকে) আশ্রম, গীর্জা, সেনাগণ এবং মসজিদ, যেখানে আল্লাহকে খুব বেশি পরিমাণে স্মরণ করা হয়, সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যেত। [আল হজ্জ: ৩৯-৪০]।

বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন যদি ঈমানদারদেরকে লড়াই করার অনুমতি না দিতেন, তাহলে পৃথিবীতে অশুভ দানবীয় শক্তির ঔদ্ধত্য ও আধিপত্য, এতই বেড়ে যেত যে, তারা পৃথিবীর বুক থেকে আল্লাহর নাম-নিশানাই মুছে দেয়ার চেষ্টা করত, এমনকি আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এমন কোন উপাসনারই আর কোন অস্তিত্ব থাকতো না। সুতরাং এটিই হচ্ছে ইসলাম, যা পৃথিবীতে মানুসের বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে, ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে সমুন্নত করেছে। কিন্তু অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ইসলাম তখনও স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারকে এক করে দেখে না।

বর্তমানে পাপাচার, নৈতিক বিকৃতি আর স্বেচ্ছাচারের পক্ষে সাফাই গাওয়া হচ্ছে আর দাবি করা হচ্ছে এগুলো নাকি ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা।’ মূলত এর মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতারই যে অবমাননা করা হচ্ছে, বিকৃতি করা হচ্ছে তাতে আর কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।

বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত নারী-পুরুষ যদি স্বেচ্ছায় অবৈধভাবে যৌন মিলনে লিপ্ত হয়, মদ পান করে এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে অপরাধ ও পাপাচারের মাধ্যমে নিজেদের বাসনা চরিতার্থ করে আর এর মাধ্যমে সমাজের স্বার্থ জড়িত না থাকে তাহলে তা করার অধিকার তাদের রয়েছে।

কিন্তু সমাজের সত্যিকার স্বার্থ জড়িত থাকলে কোন ব্যক্তির স্বাধীনতাই গ্রহণযোগ্য নয়- এ ধরনের বক্তব্য দ্বারা আসলে কী বুঝানো হচ্ছে? কথিত এই ব্যক্তি স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে আপনি আপনার চরিত্র, নৈতিকতা, আপনার বিবেক, আপনার উপাসনা এবং আপনার পরিবার থেকে আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সম্ভাব্য সব ধরনের পাপাচারে ডুবে থাকার অধিকার আপনার রয়েছে। অন্যদিকে কথিত এ ব্যক্তি স্বাধীনতায় আপনি স্বাধীনভাবে আপনার বিশ্বাস ও মতামত প্রকাশ করতে ও সমালোচনা করতে পারবেন না; স্পষ্টভাবে কথা বলতেও পারবেন না।

ইসলাম এ ধরনের স্বাধীনতাকে কখনোই অনুমোদন করে না। এ স্বাধীনতা পাপাচারের স্বাধীনতা, এ স্বাধীনতাচর্চার কোনো আইনগত অধিকার নেই। ইসলাম যে স্বাধীনতাকে অনুমোদন করে তাতে বিশ্বাস ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ছাড়াও চিন্তার স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, বিজ্ঞান ও শিক্ষার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমালোচনার স্বাধীনতাও রয়েছে। এগুলো হচ্ছে সেই স্বাধীনতা, যা জীবনের ভিত্তিকে রূপায়িত করে। চুক্তি সম্পাদন, আর্থিক লেনদেন, অপরের ক্ষতি না করে আইনসম্মতভাবে ও কোন ধরনের অবৈধ পন্থা অবলম্বন না করে যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে যে কোন কিছুর মালিকানা লাভের মতই এখনো সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ইসলামের একটি সোনালী আইন হচ্ছে নিজের এবং অন্যের কারো ক্ষতিই করা যেতে পারে না। সুতরাং ক্ষতিকর সব স্বাধীনতাই প্রতিরোধযোগ্য এবং নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। মনে রাখা উচিত, আপনার স্বাধীনতার সমাপন অন্যের স্বাধীনতার সূচনা করে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, রাস্তায় চলাচল কিংবা গাড়ি চালানোর অধিকার আপনার রয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে শর্ত হচ্ছে আপনাকে ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাহলে স্বাধীনতার অজুহাতে আপনার দ্বারা পথচারীকে চাপা দেয়া, অন্যের গাড়ির ক্ষতি করা কিংবা ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা আর সম্ভব হবে না। কারণ লাল বাতি জ্বলাকালীন গাড়ি থামানো বা রাস্তায় সঠিকভাবে গাড়ি চালানোর মত বিধি-নিষেধগুলো সম্পূর্ণভাবেই জনস্বার্থের পক্ষে।

এই দৃষ্টান্তটি ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মানব কল্যাণে প্রত্যেক ধর্মেই এবং প্রত্যেক ব্যবস্থাতেই কিছু বিধি-নিষেধ এবং নিয়ন্ত্রণ থাকে। ইসলামও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। যদিও মানবতার কল্যাণে ইসলাম যে আদর্শ পেশ করে তার কাছে পৌঁছতে কোন সভ্যতাই সক্ষম হয়নি। আসলেই ইসলাম মানব জীবনের জন্য সর্বোত্তম পাথেয়।

collected from .................BD today

বিষয়: বিবিধ

১১০৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

286308
২০ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১০:১৮
শেখের পোলা লিখেছেন : "আসলেই ইসলাম মানব জীবনের জন্য সর্বোত্তম পাথেয়।" সব কথার শেষ কথা ও খাঁটি কথা৷ ধন্যবাদ৷
286309
২০ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১০:২০
বিবেকবান লিখেছেন : Those who wish they have a lot of things to learn from Islam...complete code of life..
286555
২১ নভেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:১০
লজিকাল ভাইছা লিখেছেন : very nice and fabulous Speech Brother. Logical also. Thank you so much.
286622
২১ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১০:০৫
বিবেকবান লিখেছেন : Many thank to u to read.......

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File