ছাত্রলীগ এখন এক সন্ত্রাসী সংগঠন
লিখেছেন লিখেছেন বিবেকবান ২১ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৯:৩৫:৪৫ রাত
আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দেশজুড়ে বর্বর তাণ্ডব চালাচ্ছে। খুন, হত্যা, টেন্ডারবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়নে এখন এক ত্রাসের নাম ছাত্রলীগ। অতীত সংগ্রাম ও গৌরব ভুলে এটি এখন এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। সংগঠনটির সাবেক নেতারা মনে করেন, ছাত্রলীগ আর আদর্শিক সংগঠন নয়, এটি একটি লাঠিয়াল সন্ত্রাসী বাহিনী। খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি-বাণিজ্যে পটুতাই ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার যোগ্যতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্যই সংগঠনটির বর্তমান কর্মীরা শিক্ষাঙ্গনে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী রূপ ধারণ করছে। অর্থ আর আধিপত্য বিস্তারে প্রতিনিয়ত তারা হামলা-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে।
সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্ত্র, সন্ত্রাস ও পুলিশের সহায়তায় একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে ছাত্রলীগ। একক নিয়ন্ত্রণের সুযোগে তারা যেমন ভিন্ন মতের শিক্ষকদের ওপর হামলা-নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে, তেমনি অবৈধ অর্থ-বিত্তের মালিক হতে টেন্ডার ও চাঁদাবাজি এবং ভর্তি-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থের ভাগাভাগি নিয়েই চলে গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের পালা। আর তা নিয়েই অস্ত্রের ঝনঝনানি ও গোলাগুলির সৃষ্টি হয়। এতে কখনও জীবন হারাচ্ছে সাধারণ ছাত্র, পথচারী এমনকি শিশু। আবার কখনও নিহত হন ছাত্রসংগঠনের কর্মী।
ছাত্রলীগের এসব নিত্যকার সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সরকারি দল আওয়ামী লীগের কোনো উদ্যোগ নেই। ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতার প্রথম বছরে সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সংগঠনটিকে ‘ভ্রাতৃপ্রতীম’ আখ্যা দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচন থেকে অন্যসব ক্ষেত্রে আগের মতোই ভূমিকা রাখছেন তিনি। তবে ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরতে আর কোনো নিয়ন্ত্রক নেই। গত চার বছরে শিক্ষাঙ্গনে নির্যাতক ও লুটেরার ভূমিকায় ছিল এ সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
সর্বশেষ গত বছরের শেষ দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খ আলমগীরের আহ্বানে বিরোধী দল ও মত দমনে নামে ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। পুলিশ-র্যাবকে সহযোগিতা করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাত্রলীগ-যুবলীগকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর এতে ছাত্রলীগ আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের শিকার হয়ে গত শনিবার ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ বছরের শিশু রাব্বী, ৯ ডিসেম্বর পুরোনো ঢাকায় বিশ্বজিত্, সিরাজগঞ্জে হযরত আলীসহ বেশক’জন মানুষ জীবন হারান। বছরের শুরুতে ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে হামলায় নিহত হন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আবদুল মালেক জনি।
দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জেলা ও থানা শহরে প্রতিদিনই চলছে ছাত্রলীগের তাণ্ডব। এসব তাণ্ডবে পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোও অসহায় হয়ে ছাত্রলীগের মার থেকে নিজেদের রক্ষা করে চলছে। তবে শনিবার ছাত্রলীগের নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সাধারণ গ্রামবাসী। ১০ বছরের শিশু রাব্বীর জীবন কেড়ে নেয়ার প্রতিবাদে তারা ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের ওপর পাল্টা আঘাত হানে। প্রতিরোধের মুখে সশস্ত্র ক্যাডাররা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরে বিক্ষুব্ধ জনতা বিশ্ববিদ্যালয়টির দুটি আবাসিক হলে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর চালায়। এভাবে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আশপাশ এলাকায় খুন, হত্যা, টেন্ডারবাজিসহ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে ক্ষুব্ধ হয়ে আছে মানুষ।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত চার বছরে সারাদেশে ছাত্রলীগের হাতে ২৪ মেধাবী ছাত্র নির্মম হত্যার শিকার হন। কমপক্ষে চার শতাদিক বার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায় অর্ধশতাধিকবার। শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্ধারিতভাবে বন্ধ রাখতে হয়।
শনিবার বাংলাদেশ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের গোলাগুলিতে ১০ বছরের শিশু রাব্বী হত্যার ঘটনা দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তুলেছে। গত চার বছরে দুই ডজন মানুষ ছাত্রলীগের হাতে খুন হয়। গত এক বছরে তারা খুন করেছে ৯ জনকে। গত ৯ ডিসেম্বর পুরোনো ঢাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে বিশ্বজিেক হত্যার মধ্য দিয়ে ২০১২ সালকে বিদায় জানায় ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সামনে সাংবাদিক পিটিয়ে ৫ জানুয়ারি সরকারের ক্ষমতার চার বছরের শেষ দিন উদযাপন করে তারা। আর রাজধানীর তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ফেল করা ছাত্রদের পাস করানোর দাবিতে তাণ্ডব চালিয়ে ৬ জানুয়ারি ক্ষমতার চার বছর পূর্তি উত্সব করে এ সংগঠনটি। এরপর ১৯ জানুয়ারি বাকৃবিতে রাব্বী হত্যা, ১০ ও ১২ জানুয়ারি রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বর্বর নির্যাতনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার শেষ বছরকে স্বাগত জানায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। এখন প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে দেশজুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর রূপ।
ছাত্রলীগের সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, যেখানেই ছাত্রলীগ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নিচ্ছে যথাযথ ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল ও ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চক্রান্ত চলছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
তবে এ পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব নিতে চাচ্ছেন না কেউ। সংগঠনের সাবেক নেতারা বর্তমান ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের নিন্দা ও তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু এমপি আমার দেশ-কে বলেন, অতীতে ছাত্রলীগে এ ধরনের সন্ত্রাসের নজির নেই। এ লজ্জা থেকে রক্ষা পেতে আইন প্রয়োগ করে ক্যাডারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি। আবার লেজুড়বৃত্তি বাদ দিয়ে ছাত্রলীগকে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়ার পরামর্শ দেন সংগঠনটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আ খ ম জাহাঙ্গীর। তবে সংগঠনটির সন্ত্রাসে মানুষ যেভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে, তাতে ছাত্রলীগকেই বিলুপ্ত করে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন ’৭০-৭১ সময়ে ছাত্রলীগের সভাপতি বিশিষ্ট রাজনীতিক নূরে আলম সিদ্দিকী।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বলেন, ছাত্রলীগের ৬৫ বছরের গৌরবের ইতিহাস যেমন আমাদের মাথা উঁচু করে, তেমনি ছাত্রলীগের সম্প্রতি কিছু অপকর্ম আমাদের মাথা নিচু করে দিয়েছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, সব উন্নয়ন হোক ডিজিটাল আর ছাত্রলীগের আচরণ হোক অ্যানালগ।
বাকৃবিতে ক্রসফায়ারে শিশু হত্যা : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের মধ্যে পরপর চারদিন সংঘর্ষ হয়। শনিবার চলে বন্দুকযুদ্ধ। আর তাতে দু’পক্ষেও ক্রসফায়ারে জীবন হারান ১০ বছর বয়সী শিশু রাব্বী। মর্মান্তিক এ হত্যাকাণ্ডের জেরে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্রলীগকে প্রতিরোধ করে। তারা শহীদ জামাল হোসেন হল ও ঈশা খাঁ হলসহ চারটি হলে অগ্নিসংযোগ এবং ভাংচুর চালায়। এতে কমপক্ষে ৫০টি কক্ষ পুড়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়। ছাত্রলীগের বাকৃবি শাখা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।
নিহত শিশু রাব্বীর বাবা টেম্পো চালক। বাকৃবির জব্বার মোড় এলাকায় তার দাদি গরু চরাচ্ছিলেন। সে দাদিকে ডেকে আনতে গিয়ে ছাত্রলীগের বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। রাব্বী ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বয়রা এলাকার দরিদ্র দুলাল মিয়া ও মুনিরা বেগমের একমাত্র ছেলে। শিশু সন্ত্রানকে হারিয়ে বাবা-মা এখন নির্বাক। পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে জিম্মি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে জিম্মি হয়ে পড়েছে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ছাত্রলীগই সবকিছু। সংগঠনটির নেতাকর্মীরাই প্রশাসন, কর্তৃপক্ষ ও নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। প্রতিনিয়ত চলছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নির্যাতন। শিক্ষকদের গণপিটুনি সেখানে থেমে থেমেই চলছে। প্রতিবাদ জানানোর কেউ নেই। গত বৃহস্পতিবার শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছাত্রদলের কর্মীরা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হন। সশস্ত্র ক্যাডাররা নিজেদের মজুদ অস্ত্রের পাশাপাশি পুলিশের শটগান কেড়ে নিয়ে ছাত্রদল কর্মীদের গুলি করে। এতে ইবি ছাত্রদলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ কমপক্ষে ৬০ জন আহত হয়।
এর আগে গত ১২ জানুয়ারি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। পুলিশের সামনেই দেশি-বিদেশি অস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৪০ জন শিক্ষককে আহত করে তারা। এরআগে ১৯ নভেম্বরও শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছিল তারা। ছাত্রলীগের ত্রাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছেন। এমনকি আহত শিক্ষকরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় ক্যাম্পাস কিংবা কুষ্টিয়ায় না গিয়ে ঝিনাইদহের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সা নেন। ইবি ছাত্রলীগ সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান তুহিনের নেতৃত্বে এ হামলা হওয়ায় পুলিশ প্রশাসনও শিক্ষকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছেন না। শিক্ষক সমিতিতে ছাত্রলীগ তালা ঝুলিয়ে দেয়। রড দিয়ে শিক্ষকদের পেটানোর সময় ছাত্রলীগ ক্যাডারদের একটি মন্তব্য দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় তোলে। আর তা ছিল- ‘পেটানোর নাম যেহেতু হবেই, তাহলে একটি কষিয়ে পেটাই’, ‘যে রকম কুকুর, সে রকম মুগুর’সহ অনেক সন্ত্রাসী উক্তি করে তারা। পুলিশের সামনেই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগের এ হামলার সময় প্রাণ বাঁচাতে শিক্ষকদের আর্তচিত্কারে পুরো ক্যাম্পাসে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঘটনার পর থেকে ছাত্রলীগের হাতে পুরোপুরি জিম্মি হয়ে আছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর এসিড সন্ত্রাস : গত ১০ জানুয়ারি রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। ভিসিবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ওপর দেশি অস্ত্র দিয়ে হামলার পাশাপাশি এসিড সন্ত্রাস চালায় তারা। এসিড দিয়ে ঝলসে দেয় কয়েক শিক্ষকের মুখমণ্ডল ও শরীর। গুরুতর আহত ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক ড. মতিউর রহমান ও বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। হামলার সময় ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ক্যাম্পাসে অর্ধশতাধিক ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করলেও কাউকে গ্রেফতার করেনি। এমনকি হামলার সময় উপস্থিত পুলিশ কাউকে বাধাও দেয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
রংপুর মেডিকেলে মধ্যরাতে ছাত্রী নিপীড়ন : গত ৯ জানুয়ারি মধ্যরাতে রংপুর মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজানুর রহমান মিরাজ ও সাধারণ সম্পাদক সুমন প্রধানের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন ক্যাডার লাঠিসোটা নিয়ে ছাত্রী হোস্টেলে প্রবেশ করে। এ সময় তারা ইন্টার্নি চিকিত্সক ও ছাত্রীদের মারধর, অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং কয়েকজন ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আহত হন ১০ ছাত্রী ও ইন্টার্নি চিকিত্সক।
পিসি কলেজে শিক্ষকের ওপর হামলা : ৮ জানুয়ারি বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহ আলম ফরাজীর ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এ ঘটনার প্রতিবাদে কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন ও মৌন মিছিল করে।
মাগুরায় পুলিশের সামনে ছাত্রলীগের টেন্ডার ছিনতাই : ৭ জানুয়ারি ছাত্রলীগের একটি সশস্ত্র গ্রুপ পুলিশের উপস্থিতিতে মাগুরা গণপূর্ত বিভাগের অর্ধ কোটি টাকার সিআইডি অফিস ভবন নির্মাণের দরপত্র ছিনতাই করে। টেন্ডার ছিনতাইয়ের পর আওয়ামী লীগ দলীয় দু’দল ঠিকাদার গ্রুপের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়।
ফেল করা ছাত্রদের পাসের দাবিতে ঢাকা পলিটেকনিকে তাণ্ডব : ক্ষমতার চার বছর পূর্তির দিনে ফেল করা ছাত্রদের পাস করানোর দাবি নিয়ে তেজগাঁওয়ে অবস্থতি ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় ছাত্রলীগ। হামলায় শিক্ষক-কর্মচারীসহ ১০ জন আহত হন। ছাত্রলীগের তাণ্ডবের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন অনির্দিস্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে। কলেজের দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষায় বিভিন্ন বিভাগের ৫০৩ জন শিক্ষার্থী ফেল করে। এর মধ্যে কেউ এক বিষয়ে আবার কেউ দুই বিষয়ে রেফার্ড পায়। শিক্ষা অধিদফতরের নিয়ম অনুযায়ী ৪০ দিন পর এসব ছাত্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু তাদের পাস করিয়ে দেয়ার দাবি নিয়ে ছাত্রলীগ এ হামলা চালায়।
একইদিনে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে বসা নিয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে ও তাতে ৫ জন আহত হয়।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের প্রতিক্রিয়া : ছাত্রলীগের চলমান হত্যা-সন্ত্রাসে নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী আমার দেশ-কে বলেন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষ্পাপ শিশু রাব্বির এত মর্মান্তিক মৃত্যুতে গোটা জাতি হতবাক। তারা মুহ্যমান। জাতীয় জীবনে এটি চূড়ান্ত কলঙ্কের দিন বলা যেতে পারে। এটা একদিনে তৈরি হয়নি। এটি সামাজিক নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেন, ছাত্ররাজনীতিতে আদর্শহীনতার কারণে এসব সন্ত্রাসের সৃষ্টি হচ্ছে। এটাকে ছাত্ররাজনীতি বলে না, এখন ছাত্রদের দিয়ে পেটোয়া বাহিনী বানানো হয়েছে। ছাত্র-অধিকার নিয়ে তারা কথা বলছে না। এভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম মানুষ চায় না। আর তাই জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাকৃবিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। শিশু রাব্বি হত্যার প্রতিবাদে তারা ক্যাম্পাসে ঢুকে দু’টি আবাসিক হলে অগ্নিসংযোগ করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এমন বিস্ফোরণ ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী এই বিশিষ্ট রাজনীতিক বলেন, আমাদের সময়ে ছাত্ররাজনীতিতে আদর্শ ও বিশ্বাস কাজ করত। আমি যখন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম, তখন কিছু ছাত্র পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকা যেতে পারে-এমন আদর্শে রাজনীতি করতেন। তবু তারা একটি আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করত। বাম রাজনীতি ছিল শুধু বাংলাদেশ নিয়ে নয়, সারাবিশ্বের মানুষের অধিকারের কথা বলতেন তারা। সেখানেও ছিল আদর্শিক সংঘাত। এখানে টেন্ডারবাণিজ্য, ভত্যি বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, ঠিকাদারের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় ছিল না। এজন্য তখন বন্দুকযুদ্ধ তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের চিন্তাকে ধারণ করতাম। আজকাল সেটা নেই। নব্বইয়ের পরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, যে বেশি অস্ত্র চালাতে পারে, সেই নেতা। আর এজন্যই চাপাতি শাকিলের গুরুত্ব ছাত্রলীগে বেশি থাকবে। খুনিরাই নেতৃত্বে আসবে। বিশ্বজিত্ হত্যা ও রাব্বি হত্যার মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বহুগুণ বেড়ে গেছে। এখন এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার একটি পথ খুঁজতে হবে। তিনি বলেন, স্বাধীন দেশে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের জন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের দরকার নেই। ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কাজ করতে ছাত্রসংসদ কেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতি গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের বলেন, কিছু ‘হাইব্রিড ও ফরমালিন’ ছাত্রলীগে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। যারা সরকার ও সংগঠনের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। বর্তমান সন্ত্রাসের পথ থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে আর ছাত্রলীগের অ্যানালগ আচরণে সৌজন্যবোধ ও মূল্যবোধ থাকতে হবে। ছাত্রলীগকে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে হবে।
ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আ খ ম জাহাঙ্গীর বলেন, ছাত্রলীগের অতীত ও বর্তমানে খুব একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ছাত্রলীগের অতীত ঐতিহ্য ছিল ছাত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দেশ ও জাতির অধিকার নিয়ে আন্দোলনের। তখন সাধারণ ছাত্রদের কাছে যাওয়ার একটি প্রতিযোগিতা ছিল। ছাত্রনেতাদের ভিশন ছিল। ছাত্ররাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছিল। তখন সবাই ভাবতো, সন্ত্রাসে জড়ালে জনপ্রিয়তা কমবে। এখন কিছুই নেই। ছাত্র সংসদ নেই। অস্ত্র ও আধিপত্যই এখন ছাত্ররাজনীতি। আর এজন্যই ছাত্রলীগ অতীত ঐতিহ্য ভুলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ধাবিত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগে এ ধরনের সন্ত্রাসের নজির ছিল না। আমরা এমনটা কখনও আশা করি না। যা ঘটছে তা নিন্দনীয়। বাকৃবিসহ বিভিন্ন স্থানে যেসব নেতবািচক কর্মকাণ্ড ঘটেছে, তাতে যেসব ছাত্রলীগ কর্মী জড়িত, তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। তাদের কেবল ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করলেই চলবে না, সর্বত্রই সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে এসব বিপথগামীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। আশা করি, সরকার এ পদক্ষেপ নেবে।
বিষয়: বিবিধ
১৩১০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন