হেফাজতের লংমার্চ: আমার একটি সেক্যুলার ভ্রমণ কাহিনী
লিখেছেন লিখেছেন শাবিপ্রবি ১৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:৫০:২৩ দুপুর
[মূল লেখাটি ফেসবুকে পাই। অনেকে হয়ত পড়েছেন। অনেকে পড়েননি। 'হেফাজতের লংমার্চ' নিয়ে রিফাত হাসান এই ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন। অসাধারন সাহিত্যিক ভঙ্গীতে এঁকেছেন মৌলবাদের এক ভিন্ন রুপ, হ্রদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে উপলব্দি করছেন অমানবিক থেকে মানবিক বা মানবিক থেকে অমানবিক হয়ে ঊঠার রহস্যগুলো। আশা করি ভালো লাগবে সবার।]
এতগুলি বন্ধ্যা মুখ খুলে গেল নক্ষত্রের সুরে/ মুখর: অরুণ মিত্র
মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়া একটি আলাপে নিমন্ত্রণ ছিল ঢাকায়। ৬ তারিখ। তাই, হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ আর আমার ঢাকা আসার ঘটনা একই দিন। ঘটনা কাকতালীয় হলেও আমার আসার ঘটনায় কাকতাল নেই। ৬ তারিখে বাংলাদেশে যে মহিরুহ ঘটতে যাচ্ছে, তারে কাছ থেকে দেখার ও বুঝার তাড়না ছিল আমার। অই আগ্রহের কথা বাসায় বলি নাই। বলেছি, মানবাধিকার সংগঠনের নিমন্ত্রণে যাচ্ছি। সেক্যুলার ব্যাপার স্যাপার। যাতে ওরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। বাসা থেকে বেড়ুনোর সময় আম্মার চোখে-মুখে শংকা। এমন অনিরাপত্তার দিনে কেন ঢাকা। ঢাকায় ধড়পাকড় হবে। খুনোখুনিও হতে পারে। আমি বললাম, আমরা মানবাধিকার নিয়া কথা বলবো। ওখানে হামলার সম্ভাবনা নেই। আম্মা বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মাফ দিবি না। নইলে বিপদ হবে। বললাম, আচ্ছা। পড়বো। আসলেই, আমাদের কোন সেক্যুলার দিন যাপনের সুযোগ নেই। আমার মা হতে দেবেন না কখনোই।
দিনটি শুক্রবার। ৫ তারিখ। ভাবছিলাম, হেফাজতের গাড়িতে করে যাবো। ঢাকার একটি জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক বন্ধু কাছ থেকে রিপোর্টিং এর জন্য এমন উপায়ের কথা বলতেছিলেন। লংমার্চ এর রিপোর্টের জন্য উনার চট্টগ্রাম আসা। পরে জানা গেল, সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের চাপের কারণে মালিকরা গাড়ি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তো, কী আর করা। ঝুঁকির মধ্যে থাকা ঠিক হবে না। এদিকে, ট্রেনের টিকিট পাওয়া বেশ মুশকিল। স্টেশনে এক দালালের মাধ্যমে মহানগর প্রভাতিতে একটি কেবিন এর টিকিট নিতে পারলাম, মূল দামের চারগুণ দিয়ে। অবশেষে আমরা উঠলাম। সেই সাংবাদিক বন্ধু, আমি আর এক ছোট ভাই। নাহ। চট্টগ্রামে কোন ঝামেলা দেখা দেয় নাই। সকাল ৭.২০ এর ট্রেন। এত ভোরে কোন ঝামেলা হওয়ার কথাও না। পুলিশ র্যাব হুশিয়ার। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো প্লাটফর্মে। ভাবছিলাম, আমাদের তল্লাশি করবে। ব্যাগ-এ ল্যাপটপ আছে। কিছুদিন আগে কয়েকজন ব্লগার গ্রেফতার হওয়ার পর উদ্ধারকৃত জিনিশপত্রের ভিতর একটি ল্যাপটপসহ মিডিয়ার সামনে পুলিশের সাংবাদিক সম্মেলন- সেইসব তো মনে আছেই। আমি সতর্কতা স্বরূপ ব্যাগ-এ কোন ‘জঙ্গি’ বইপত্র নিলাম না। নিলাম একটি সেক্যূলার উপকরণ। আধুনিক কবিতা। অরুন মিত্রের খুঁজতে খুঁজতে এতদূর। পুলিশ এর আধুনিক কবিতা নিয়া কোন আপত্তি নাই তো? আমি অবশ্যই জিন্স পরতে অভ্যস্ত। এইটারও একটা পোশাকি আধুনিকতা আছে। বাংলাদেশে। পুলিশ আমাদের কোন তল্লাশির ভিতর দিয়া যায় নাই। কারণ হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের বেশ-ভুশা আর আমাদের বেশ-ভুশায় সম্ভবত পার্থক্য আছে। জিন্স, স্যুটেড বুটেড আর ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়া কে হেফাজত করতে যাবে? আমার মুখে হালকা পাতলা দাঁড়ি আছে। মনে হল এইটা হেফাজত স্ট্যাণ্ডার্ড না। আমাদেরকে পথ করে দিল পুলিশ আর র্যাব। তল্লাশি করল না।
২.
মহানগর প্রভাতি ট্রেন এর অবস্থা যারা ভুক্তভোগী সবাই জানেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনের আগে প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে রইল। তারপরে এক সময় দুলতে দুলতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে থামল। পরের দিন মিডিয়ায় দেখেছিলাম, ওখানে ভাঙচুর হামলা হয়েছে। আমরা সেইসব কিছু দেখি নাই। শুধু দেখেছি প্রচুর মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক ও গ্রামের সাধারণ মানুষ ট্রেনে ওঠার জন্য ছুটছে। প্রচুর পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ হাল ছাইড়া দাঁড়াল। এর পরের ট্রেনগুলো সম্ভবত বন্ধ করে দিয়েছিল প্রশাসন, যাতে আর কোন লংমার্চের লোক না আসতে পারে। আমাদেরটাই দিনের শেষ ট্রেন। এক পর্যায়ে ছাত্ররা ছাদে ওঠার চেষ্টা করলে, মাদ্রাসার হুজুররাই পুলিশ সমেত আইসা ওদের নিবৃত্ত করল। ছাদে ওঠা যাবে না। দেখলাম, পুরো ট্রেন টইটম্বুর হয়ে গেছে। ওঠার সময় এদের তাড়াহুড়া ও পুলিশের সাথে কথা কাটাকাটি করতে দেখা গেলেও, ট্রেনে ওঠার পর ওদের কাউকে হৈচৈ করতে দেখা যায় নাই। ওরা বারান্দা ও গলি-ঘুপচির আলো-অন্ধকারে বসে পড়েছে। ওদের চাওয়া খুব সীমিত, নির্লোভ মনে হল। আগ্রাসী তো নয়ই। কারো অবস্থানে জোড় কইরা বসে যাওয়ার চেষ্টা নেই। শুধু ফাঁকা জায়গাগুলো অধিকার করে নেওয়া, সংকোচে এবং বিনয়ে।
৩.
পদ্মপাতার প'রে জল টলমল করে; কাছে কোনো ফুল তো দেখি না/ কুঁড়ি:বিনয় মজুমদার
ট্রেন চলছে। ট্রেনে সব সময়ই একটা অদ্ভূত অনুভূতি হয়। ঝিঝিঁটঝাপ ঝিঝিঁটঝাপ তাল আর নৌকার মত দুলুনি। ক্যাবিনে আমরা স্বার্থপরের মত বসে আছি। কাউরে ঢুকতে দেই নাই। অথচ ট্রেনে তিল ধারণের জায়গা নেই। রেললাইন, রেল আর এই দুলুনি ও ছন্দ, এই স্বার্থপর ঘেরাটোপের ভিতরও কেমন বিভ্রম জাগে। মনে হয়, এটাই বুঝি জীবনের মূল অভিযাত্রা। আমাদের সাংবাদিক বন্ধুটি হঠাৎ করে আমাকে ডেকে নিলেন। তিনি কেবিনের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। কেবিনের দরজা বন্ধ রেখেছিলাম আমরা। দরজার ফাঁক দিয়ে তিনি আঙুলের ইশারায় একটি জায়গার দিকে দেখালেন। ওখানে, কেবিনের বাইরের চিকন বারান্দার মত জায়গাটিতে সারি সারি মাদ্রাসার ছাত্র বইসা আছে। তাদের মধ্যে একজনের বয়স বছর চোদ্দ পনের হবে। ছোট্ট একটি সিগারেটের খোসার মত কাগজে কী যেন লিখছে। গোটা গোটা বাংলা হরফ। দূর থেকেও বুঝা যায়, শুধু পড়া যায় না। লাইনগুলো ভাঙ্গা ভাঙ্গা। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম, কবিতা। আমি চমৎকৃত হলাম। আমার ইচ্ছে হল গিয়ে দেখি ছেলেটি কী লিখছে। কিন্তু একটি কথা মনে হতে দরজা খুললাম না। তার ধ্যান ভঙ্গ হয়ে গেলে, বড় অন্যায় হয়ে যাবে। সে তার কবিতা শেষ করুক। তা আমার নৃতাত্তিক কৌতুহলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। ওরা অনেক দিন ওদের ভাষায় কথা বলেছে। আমরা বর্ণবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা বুঝতে পারি নাই। বুঝার চেষ্টাও করি নাই। এখন ওরা আমাদের ভাষায় কথা বলার জন্য, আমাদের ভাষায় কম্যুনিকেট করার জন্য ঢাকা আসছে। আমরা এতদিন আমাদের ডায়লগে, রাষ্ট্রে, ওদেরে জায়গা দিই নাই। কিন্তু ওরা তেমনতরো বর্ণবাদী না। ওরা আমাদের বর্ণবাদী মনরেও ডায়ালগের জায়গায় রাখতে চায়। তাই কবিতা। তাই ঢাকা। যদিও ওরা ক্বওম-সমাজের লোক, সমাজের মুষ্টি ভিক্ষা দিয়ে মাদ্রাসা চালায়। এইসব ভাবতেই মনে হল, তার এই কবিতার সাধনার আমি কীভাবে মুখোমুখি হই! আমরা দরজা আর খুললাম না।
৪.
আমাদের ঢাকায় পৌঁছুতে বেশ রাত হয়ে গেল। ঢাকার রাস্তা-ঘাট কেমন উৎসব মুখর আবার থমথমে। রাতে এক জায়গায় অপূর্ব দৃশ্য। হেফাজত কর্মীদের অনেকে হেঁটে হেঁটেই লংমার্চে এসেছে, বহুদূর থেকে। ঢাকায় আসার সব পথ, গাড়ি ঘোড়া বাজেয়াপ্ত করেছিল সরকার, আমরা আগেই জেনেছি। দেখলাম, এই হেঁটে হেঁটে আসা-দের একাংশ গোল হয়ে রাস্তায় বসে গেছে। জড়ো হওয়া লোকজনকে বুঝাচ্ছে, ভাই এইটা হজরত শাহজালালের সময়েও হয়েছিল। পথ-ঘাট আটকে, নৌকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জালিম জমিদারের বিরুদ্ধে হজরত শাহজালাল এর জিহাদ বন্ধ হয়নাই। মজলুমই বিজয়ী হয়েছিল। লোকজন গভীরভাবে বুঝার চেষ্টা করছে তাদের কথা। বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছে। তাদের কথায় সায় দিচ্ছে।
শেষ মেষ এইসব দেখতে দেখতে আমাদের পথ শেষ হল। এক বন্ধুর বাসায় উঠছিলাম। আড্ডা আর আলাপে আর ক্লান্তিকর ঘুমে রাত কেটে গেল। পরদিন সকালে নাস্তা করে বেরুলাম আমরা চার জন। সাংবাদিক বন্ধুটিসহ আছে। তাকে লংমার্চ কাভার করতে হবে। দেখলাম, তার সাথে আমরা যে কজন বেরুলাম সবাই যেতে চাই। ধানমণ্ডি থেকে কীভাবে কীভাবে যেন আমরা পৌঁছুলাম কাওরান বাজার। সিএনজি এর চেয়ে সামনে যেতে রাজি নয়। মালিকের নিষেধ। লংমার্চে যাওয়া যাবেনা। ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো আমি খুব চিনি না। কিন্তু দেখলাম, এর পরে আর রিকসা-সিএনজিতে যাওয়া সম্ভবও না। মানুষের যে ভীড়। ধানমণ্ডী থেকে বেরুনোর কালেই মোড়ে মোড়ে স্বেচ্ছাসেবক দাঁড়িয়ে আছে। পানি নিয়ে, শরবত নিয়ে। লোকজনের আবেগ দেইখা অবাক হলাম। শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছে সিএনজির জানালা দিয়ে। খুব গরম পড়ছিল। তারপরও নিলাম না। সৌহার্দ্যমূলক হাসি দিলাম। সিএনজি থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে লংমার্চের মূল স্রোতে প্রবেশ করলাম আমরা। এই অভিজ্ঞতা অপূর্ব। পরের অংশে সেই ঘটনারই বিবরণ দিলাম।
৫.
Paradoxically, modern politics cannot really be separated from religion as the vulgar version of secularism argues it should be- with religion having its own sphere and politics its own. The state (apolitical entity/realm)has the function of defining the acceptable public face of "religion"./Talal Asad, Interview with Nermeen Shaikh, Asia Society Online, Islam,Secularism and the Modern State
এন ইসলামিক জার্নি ইনটু দা হার্ট অব বাংলাদেশ
আমার কেবলই মনে হচ্ছে, এন ইসলামিক জার্নি ইনটু দা হার্ট অব বাংলাদেশ। হেফাজতের লংমার্চরে বর্ণনা করার আর কোন ভাল ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। হেফাজতের লংমার্চে যখন প্রবেশ করলাম, আমি বেশ অবাক হলাম কয়েকটি বিষয়ে। এক. হেফাজতের ছেলেরা কেউ কলেমা খচিত সবুজ পতাকা ওড়ায় নাই আজ। কোথাও হঠাৎ দেখা গেলেও, এইটা এই সমাবেশের মূল স্রোত না। সমাবেশের চারপাশ জুড়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এইটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে আমার। চলচিত্রকার তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর মাটির ময়না বিষয়ক একটা আলোচনায় আমি লিখেছিলাম, 'এদিকে, বহু বছর ধরে চেপে রাখা আনু, রোকন, রুহুল, আরিফ এবং কাজী সাহেবরা কথা বলা শুরু করেছেন, কথা বলতে বলতে তারা যেন হরবোলা হয়ে ওঠেন। বন্ধ জানালার পাকিস্তান থেকে ক্রমশই ‘বাংলাদেশ’। ফলে হুমায়ুন আহমেদের শ্যামল ছায়াতে এসে মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে কুশীলব হয়ে পাক-নিপীড়ণের বিরুদ্ধে ভাষা পায় তারা। মাটির ময়নাতে যারা ছিল বিহ্বল এবং হতচকিত, কিন্তু উন্মুখ। তৌকিরের জয়যাত্রাতে এসে মৌলভী সাহেব চরিত্রে বাংলাদেশ বিপ্লবের ত্রাতা ও পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদও হয় তারা। এইভাবে আনু, রোকন, রুহুল, আরিফ, কাজী সাহেব, এবং মৌলভীদের মুখে যে ভাষা এবং বাংলাদেশ বিপ্লবে দ্বিধায় ও সংগ্রামে, বেড়ে ওঠার ইতিহাসে তাদের যে অংশ, তার সাহস তুলে ধরে তারেক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপর তাদের নৈতিক অধিকার তৈরি করেন। এই ভাষা, এই অধিকার, অনুচ্চারিতকথা প্রগতিশীলদের পরিচিত না, শুধু তাই নয়, তারা পরিচিত হতে চায়ও না, বরং এক বর্ণবাদী আক্রোশে তাদের লড়াই চলে এই অধিকারের বিরুদ্ধে ফুল পাখি লতা পাতার নামে।'..
এই সমাবেশ সবার আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ওন করে। আমি খেয়াল করলাম, হেফাজতের দাবীর মধ্যে কোন ইসলামী রাষ্ট্রের দাবী নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলের কিছু সমস্যা নিয়ে হেফাজতের দাবী দাওয়া। অনেকেই ব্লাসফেমি আইনের কথা বলছেন। এদের তের দফা দাবীর কোথাও ব্লাসফেমি আইন কিন্তু নেই। আবার, খেয়াল করে দেখুন, ব্লাসফেমি আইন কোন ধর্মীয় পরিমণ্ডলের আইন না। এইটা একটা সেক্যুলার রাষ্ট্রের ধর্মীয় সম্প্রীতির গহনা, যা মূলত খ্রীষ্টিয় পরিমণ্ডল থেকে এসেছে। একই সাথে মনে রাখা দরকার, ইতিহাসে এই আইনটা কোন ধর্ম প্রস্তাব করে নাই। প্রস্তাব করেছে সেক্যুলার রাষ্ট্রসমূহ, যারা রাষ্ট্রে অবস্থানরত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে উত্তেজনা কমাতে চায়, রাষ্ট্ররে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এরা গতকাল একটি মিডিয়ায় স্পষ্ট করে বলেছে, ওরা ব্লাসফেমি নামে কোন আইন নয়, মূলত শাস্তির বিধান চায়।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা কম্যুনিস্ট পার্টির অফিসের সামনে এসে দাঁড়ালাম। একদল শার্ট-প্যান্ট পরা লোক ওদিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল, এইটা নাস্তিকদের আখড়া। এইগুলারে গুড়িয়ে দিতে হবে। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম, কী ঘটে দেখার জন্য। কথাটা জনে জনে চাউড় হতেই স্বেচ্ছাসেবকদের কয়েকজন দ্রুত চলে আসল। ভাই, আপনারা শান্ত হয়ে জিকির করুন। সমাবেশের আদব রক্ষা করুন। কোন ধরণের ভাঙচুড়-বিশৃঙ্ক্ষলায় বড় হুজুরের নিষেধ আছে। এই কথা শুনে সবাই তাড়াহুড়ো করে যার যার মত ছড়িয়ে পড়ল আবার। ওদিকে গেল না। চমৎকৃত হলাম আমরা। এতবড় গণ জমায়েত, কিন্তু কোন সহিংসতা-বিশৃঙ্ক্ষলা নাই, বরং এদের উপর আক্রমণ হয়েছে, জমায়েত থেকে ফেরার সময়। এই ঘটনা যারা এতদিন বর্ণবাদী ও সহিংস প্রচারণা চালাচ্ছিল এদের বিরুদ্ধে, তাদের জন্য শিক্ষণীয় হবে নিশ্চয়ই।
একটা ছেলে, বয়স বছর বার হবে। টুপি পাঞ্জাবী পরা। মাদ্রাসার ছাত্র। হাতে এক গোছা টিস্যু। আমাদেরকে টিস্যু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করল। বললাম, লাগবে না। তবে তার কাছে এগিয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,এই টিস্যুগুলো তোমারে কে দিছে। সে বলল, আমি কিনছি। আমার তো ফল-মুল-বিস্কুট কেনার টাকা নেই। আমি অবাক হলাম। তার বয়সে আমার জমানো টাকাগুলোর কথা মনে পড়ল। গ্রামে ছিলাম। সর্বোচ্চ বিশ থেকে পঞ্চাশ টাকার মতো হবে। ছেলেটার প্রতি একধরণের ঈর্ষা বোধ করলাম। আরো একটি বিরল দৃশ্য দেখেছি এরকম। একটি রিকশায় করে স্বামী স্ত্রী দুজনে কিছু পাউরুটি-কলা-বিস্কুটজাতীয় খাবার দ্রব্য নিয়ে ক্ষুধার্ত লংমার্চকারীদের বিলোতে এসেছে। রোদে পুড়ে যাচ্ছে শহর। তার মধ্যে লংমার্চকারীরা এসেছে বহুদূর থেকে, কোন যানবাহন ছাড়া, হেঁটে হেঁটে। এমন অনেকের ক্ষেত্রে হয়েছে, গত দুদিন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওরা শাপলা চত্ত্বরে এসে পৌঁছেছে। ঢাকার বাহির থেকে। তো, এই পরিস্থিতিতেও শহরে মানুষের এমন আতিথেয়তা সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। আমার মোবাইলের ক্যামেরায় স্বামী স্ত্রী দুজনের ছবি তুলে নিলাম। আমরা যেতে যেতে আরো দেখলাম, কয়েকজন ইউরোপিয়ান (মানে শাদা চামড়ার, ইউরোপিয়ান নাও হতে পারেন) মহিলা ও পুরুষ লংমার্চের ভিড়ের ভিতর দিয়ে হাস্যোচ্ছল চেহারায় ঘুরাফেরা করছে। কৌতুহলী হয়ে দেখছে সবকিছু। আমার বন্ধুদের একজন হাত দেখাল। ওরাও হাত দেখাল, বেশ উৎসব মুখর হয়ে।
এই ঘটনাগুলো বর্ণনা করলাম, কারণ মিডিয়া এবং বর্ণবাদী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আমাদেরকে গত কয়েকদিন ধরে বেশ কিছু মেসেজ দিয়েছে। এক. হেফাজতের এই ঘটনায় সাধারণ জন মানুষের অংশগ্রহণ নেই। শুধুমাত্র টাকার খেলা চলেছে এখানে। দুই. এই সমাবেশ নারী বিরোধী। অভিযোগ এসেছে, এখানে একুশে টিভির একজন নারী রিপোর্টারের উপর হামলা হয়েছে। এই হামলাকে উপলক্ষ করেই মিডিয়াগুলোএই সমাবেশকে নারী বিরোধী সমাবেশ বলেছে। কিন্তু আমি কিছুক্ষণ আগেই শুনছিলাম, সমাবেশমঞ্চ থেকে স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, আপনারা সাংবাদিকদেরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করুন। এবং স্বেচ্ছাসেবকরা পুরোমাত্রায় সতর্ক, যে কোন রকম নাশকতা ও সহিংসতা এড়াতে। নারীত্বের উপরে হামলা, এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগে প্রায় অবিশ্বাস্য। কারণ এই শাদা চামড়ার নারীপুরুষরা নির্বিঘ্নে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে লংমার্চের ভিড়ের ভিতর দিয়ে চলাফেরা করছিল। কেউতো কিছু বললো না, বরং উচ্ছাস করছে। যদিও হেফাজত এমন কোন ঘটনা ঘটে থাকলে তার নিন্দা করেছে পরের দিন। আর অর্থলগ্নি? সেটাই তো এতক্ষণ দেখলাম। সাধারণ জনমানুষের যে তৃণমূল অংশগ্রহণ এই লংমার্চের খরচে, তাতে অন্য কোন অর্থ দরকার হয় না। বরং আমার সাংবাদিক বন্ধুটি লংমার্চের চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, চট্টগ্রামে যে ক’জন গাড়িতে করে এসেছে, প্রত্যেকেই সাধ্যমত অংশগ্রহণ করেছে এই গাড়ি ভাড়ার টাকায়। আর, এইরকম একটা মহাসমাবেশের উদ্যোগে, যেখানে ইসলাম ও মুসলমানদের বিষয় আশয়, সেখানে দেশের আরো আরো সাধারণ মানুষ ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সমাজও নিশ্চয়ই অংশগ্রহণ করেছে। এটাই স্বাভাবিক।
৬.
It is a nemesis of biased scholarship that the societies and systems they serve ultimately suffer from their distortions./Islam and Politics/ Eqbal Ahmad
বাঙালী জাতীয়তাবাদ ইসলামী বইপত্তরকে জঙ্গী বই বইলা মিডিয়ায় প্রচার করেছে। এখনো করে। বাঙালী জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রও। নাইন ইলেভেন এর পর আমেরিকার যুদ্ধনীতির সাথে তাল মিলিয়েই এদের এই প্রচারণা। বাংলাদেশে শহুরে মধ্যবিত্তের মিডিয়া বহুদিন ধরে একটা ঘৃণা প্রচার করেছে। নাটক, গল্প, উপন্যাস, খবর, সবতাতে। ইসলাম ও মুসলমানদের যে কোন চিহ্ণ ও গরিব মাদ্রাসার ছাত্রদের বিরুদ্ধে। এরা একাত্তরে ইসলামকে পরাজিত করার কথা বলেছে, অতীতে। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় এরাই ছিল কলকাতায় মদমত্ত জড়বৎ, লেখক আহমদ ছফার জবানীতে সেই কাহন পড়তে পারেন, অলাতচক্রে। এদের বর্ণবাদী প্রচারণার ফ্যাসিস্ট রূপ সর্বশেষ প্রকট হয়ে উঠে শাহবাগের গণজাগরণ বইলা কথিত মঞ্চে। হেফাজতের ভাষাগুলো হয়ত আমাদের ইংরেজি শিক্ষিতদের ভাষার সাথে মিলিয়ে পাঠ করতে হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা, কিন্তু হেফাজতের আন্দোলনের যে ভাব, তাতে ভুল নেই। শাহবাগ জেনারেশনের গন্তব্য যে ইসলাম ও ইসলাম গন্ধের রাজনীতি, তা সচেতন রাজনীতির পাঠক মাত্রই বুঝবেন। এইটাতো শাহবাগিরাই স্পষ্ট করেছে, তাদের প্রথম দিককার কর্মসূচী গুলোতে। তারপরে যখন হেফাজতের নেতৃত্বে প্রতিবাদ দানা বেঁধে উঠল, এই ঘৃণা ও বর্ণবাদিতার বিরুদ্ধে পাল্টা ক্ষমতা তৈরী হলো, তখন গণজাগরণ মঞ্চ তাদের খোলসে একটি অহিংস ও ধর্মঘৃণাহীন প্রতিমূর্তিদাঁড় করানোর চেষ্টা করল। বলার চেষ্টা করল, হেফাজত তাদের ভুল বুঝছে, তাদের আন্দোলনে, কর্মসূচিতে, ধর্মবিদ্বেষী কোন উপাদানই নেই, এমন অপরাধ তারা কষ্মিণকালেও ভাবতে পারেনা। কিন্তু সফল হল না। হরতাল দিল হেফাজতের লংমার্চের দিন। সরকারও ঢাকায় আসার সব পথ বন্ধ করে দিল।
এই বর্ণবাদী গোষ্ঠি সব সময়ই ভেবে এসেছে, রাষ্ট্র শুধু তাদের। কথা কওয়ার অধিকার শুধু তাদের। হুকুম দেওয়ার অধিকার শুধু তাদের। নাগরিক শুধু তারাই। অন্যরা অশিক্ষিত, স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী, সংখ্যালঘু। তাদের নিষিদ্ধ, প্রতিহত ও হত্যা করতে হবে। এজন্য দীর্ঘ তালিকা দেওয়া হয়েছিল। কাদের নিষিদ্ধ করতে হবে, কাদের গ্রেফতার করতে হবে, কোন প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে হবে। শুধু তারাই নয়, রাষ্ট্রও তালিকা তৈরী করছিল। পাড়ায় পাড়ায় তালিকা প্রণয়নের জন্য সন্ত্রাসবিরোধী রাজাকারি কমিটির ঘোষণা। এই প্রেক্ষিতেই হেফাজতের নেতৃত্বে জনগণের পাল্টা ক্ষমতা তৈয়ার হলো, এইটা বুঝতে হবে। চরমভাবে সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ট বাঙালী সংস্কৃতি ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ এর দ্বৈত ও সুবিধাবাদী, আবার সাম্রাজ্যবাদী ও সহিংস চরিত্রের রাজনৈতিক পাঠ না করতে পারলে, এই নতুন জাগরণের মর্ম আপনি বুঝতে পারবেন না। মনে হবে, এইটা স্রেফ ধর্মাশ্রয়ী একটা আন্দোলন।
আমরা আগেই বলেছি, এদের কোন ইসলামী রাষ্ট্রের দাবী নেই। স্রেফ রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করে তোলার দাবী আছে। এদের দাবীগুলো কোন ফ্যাসিস্ট দাবী নয়। এই সমাবেশের লোকজন বিরোধীদের জবাই জবাই জবাই জবাই কর জাতীয় কোন আধুনিক শ্লোগান দেয় নাই। আমার চোখে একবারও পড়ে নাই। তারপরও জবাই এর শ্লোগানদাতারা এদের বর্বর বইলা গাল দেয়। এই ঘৃণাপ্রচারের বিরুদ্ধে ওদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার দাবীতে কোন ইনসাফকামী মানুষের দ্বিমত থাকার কথা নয়। ওদের কর্মসূচিতে দ্বিমত থাকতে পারে। যেমন আমার আছে। তা অন্য কোথাও আলোচনা করব।
৭.
আল্লামা শফির বক্তৃতা শোনার আগেই চলে আসলাম। রোদ্দুরে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। এর আগে, প্রেসক্লাব হয়ে শাহবাগের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। প্রেসক্লাবের আগেই পুলিশের বিশাল ব্যারিকেড। প্রেসক্লাবের পরেও একই রকম ব্যারিকেড। এই দুই ব্যারিকেডের মধ্যিখানে কতিপয় উৎসাহী হেফাজত-সমর্থক জড়ো হয়ে শ্লোগান দিচ্ছে। পুলিশ ওদের আটকে রেখেছে। আমরা চলে আসার সময় দেখলাম, পুলিশ ওদেরকে ধাওয়া করে লংমার্চের মূল স্রোতের ভিতরে পাঠিয়ে দিল। প্রেসক্লাবের আগের ব্যারিকেডের ভিতরে। আমরা প্রেসক্লাব পেরিয়ে শাহবাগের আগে যে ব্যারিকেড, তার কাছাকাছি এসে খবর পেলাম, শাহবাগে লোকজন নেই। সকালে জনা-পঞ্চাশেক লোক ছিল, লংমার্চে লোক সমাগমের সাথে ওরা চলে গেছে। অগত্যা, আমরা চলে আসলাম। সেই চলে আসা এত সহজ ছিল না। পরের দিন মিডিয়াগুলো যেমন বলেছে, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে এমন জন-সমাগম আর হয় নাই। এই জনস্রোত পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা এগুতে থাকলাম। কোথাও কদ্দুর গিয়ে থেমে যেতে হচ্ছে। পথ আর নেই। আবার ঘুরে অন্য পথ দিয়ে যাওয়া। এতক্ষণ হেফাজত কর্মীদের দেওয়া শরবত, পানি, তবরুক এইসবের দিকে মন ছিল না। স্রেফ দর্শক ছিলাম। এইবার পিপাসায় জিহ্বা শুকিয়ে গেছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তারো চেয়ে বড় কথা, মনে হল, এই স্বতঃস্ফূর্ত বরকতময় তবরুক গ্রহণ না করে যদি ফিরে যাই, তাহলে এই ঐতিহাসিক সমাবেশে আমাদের নির্লীপ্ততা প্রমাণ হয়। এইবার যখন একজন শরবতের গ্লাস হাতে এগিয়ে এল, আমরা খুব আনন্দভরে নিলাম ও গ্রহণ করলাম। মনে হল, রহমতের সুধা। এই রহমতের সুধা পান করে আমাদের আর ক্লান্তি রইল না।
৮.
এর মধ্যেই যে মানবাধিকার সংগঠনটির আমন্ত্রণে ঢাকা এসেছিলাম, ওদের ফোন এলো। স্যার, আমাদের অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়েই শুরু হবে। আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই ফোন করলাম। আমি নিশ্চিত করলাম, পৌঁছে যাবো। আমরা একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জনসমাগম থেকে এনজিওগুলোর মানবাধিকার ব্যবসায়ে জ্বালানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। পেছনে যে উচ্ছল জনস্রোত, তাকে উপেক্ষা করে, তাকে নেই করে দিয়ে, মোহাম্মদপুরের একটি জন-বিচ্ছিন্ন কোলাহলহীন নিরাপদ জায়গায়। ওখানে একজন জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলেন এর আগে? বললাম, লংমার্চ। উনি এবং উনারা সবাই আঁতকে উঠলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সেই ভদ্রমহিলা, যিনি এই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের মধ্যে সিনিয়র পার্সন, বললেন, এই মৌলবাদীদের আখড়ার ভিতর দিয়ে কেমনে এলেন? ভয় করল না? আমি হাসলাম। একজন রাগী তরুণ কথা বলতে এসে, কথা না বইলা ঘৃণা ভরে চলে গেলেন। এইটা সেই সম্মিলিত ঘৃণার প্রতীক, যা মিডিয়া ও শহুরে মধ্যবিত্ত্বের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এই ঘটনার আগে এবং পরে সম্প্রচার করেছেন। এই ঘৃণার শেষ কোথায়?
মুল লিখাটা এখানে পাবেন
বিষয়: বিবিধ
১২২৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন