বায়তুল মোকাররম থেকেঃ শুক্রবারের ঘটনার চাক্ষুষ বর্ণনা

লিখেছেন লিখেছেন মোশাররফ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৫:৩০:৩১ বিকাল

আমি লেখক হিসেবে একেবারেই নবজাতক। জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি শুধুই পাঠক ছিলাম ব্লগগুলোর। কিন্তু শুক্রবার সংবাদমাধ্যমগুলোর নির্লজ্জ মিথ্যাচার দেখে মুখ খুলতে বাধ্য হলাম। মূল কথায় যাওয়ার আগে একটি কথা বলে রাখা সময়ের দাবিঃ আমার সব কথা শোনার পর যাদের ইচ্ছা করবে আমাকে শিবির/রাজাকার/ছাগু ইত্যাদি ইত্যাদি বলে গালাগালি করতে তারা এখনই সসম্মানে ভাগতে পারেন। আর যারা প্রশ্ন করবেন শহীদ মিনার ভাংচুর করা, জাতীয় পতাকায় আগুন দেয়া কেমন কাজ বা কারা করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি তারাও সসম্মানে বিদায় নিতে পারেন কারণ, সেটা অন্য আলোচনা। এটা শুধুই আমার অভিজ্ঞতার বর্ণনা। আমি কখনোই কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না। একেবারেই শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করে আসছি। তবে আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ, তাঁর রাসুল (স) ও ইসলামের জন্য মনে রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাই ব্লগে এসব বিষয় নিয়ে জঘন্যতম ভাষায় কুরূচিপূর্ণ লেখালেখির ব্যাপারে খুবই ক্ষুব্ধ ছিলাম মনে মনে। কিন্তু ক্ষোভ প্রকাশের জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই হেফাযতে ইসলামের পক্ষ থেকে যখন আল্লামা আহমদ শফীর খোলা চিঠি পেলাম, আর ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। ঈমানী দায়িত্ব মনে করেই শুক্রবারের বিক্ষোভে অংশ নিতে গিয়েছিলাম বায়তুল মোকাররমে আমরা তিন বন্ধু। বাস থেকে নামার কথা বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইটে, কিন্তু দৈনিক বাংলা মোড়েই নামিয়ে দিয়ে বাস ঘুরিয়ে দিলো; ঐদিকে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। যেখান থেকে রাস্তা বন্ধ, সেখানে প্রচুর ভীত-সন্ত্রস্ত মুসল্লীর ভিড়, বেশিরভাগই মনে হলো সাধারণ মুসল্লী, খুব কম লোকেই সেই রাস্তায় ঢুকতে সাহস পাচ্ছে। হয়তো কাউকে কাউকে ঢুকতে বাধাও দেওয়া হচ্ছিলো, আমরা কোনদিকে না তাকিয়েই সোজা ঢুকে পড়লাম। কারণ, মনে মনে নিয়ত করে এসেছিলাম, যদি জান চলে যায় যাবে, তবুও আজ সবার সামনে আল্লাহর নবীর শানে বেয়াদবির প্রতিবাদ করেই যাবো, এটা প্রতিটা মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। মসজিদ চত্বরে ঢুকেই মসজিদের সিঁড়িতে বিক্ষোভে শামিল হলাম। গেইট বন্ধ করে অনেককেই ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর মসজিদে ঢুকে পড়লাম নামাজ আদায় করার জন্য। তখন বাজে দুপুর একটার বেশি। অথচ মসজিদের ভেতরটাই ঠিকমতো ভরেনি, বারান্দাতো পুরোই ফাঁকা। সবদিক থেকেই মুসল্লীদের আসতে বাধা দেয়া হচ্ছিলো। মসজিদের মাইকে বারবার প্রতিবাদমূলক বক্তব্য দেওয়া হচ্ছিলো। এর মধ্যেই পেশ ইমাম সাহেব খুতবা দেয়া শুরু করেন। খুতবার মাঝপথে তার কাছ থেকে মাইক নিয়ে আবারো প্রতিবাদ শুরু হয়। এবার প্রতিবাদের বিষয় ছিলো ব্লগারদের কুরূচিপূর্ণ লেখালখির ব্যাপারে ইমাম সাহেবের কোন বক্তব্য না রাখা। শেষ পর্যন্ত ইমাম সাহেব বক্তব্য দিতে রাজি হওয়ায় তাকে মাইক দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি দায়সারা গোছের বক্তব্য দিয়েই (নবীজির সর্বোত্তম চরিত্র নিয়ে হাদিস উদ্ধৃত করে এবং ব্লগারদের নিয়ে কোন কথা না বলেই; উল্লেখ্য, তার এই দায়সারা বক্তব্যও পুরোপুরি শেষ করেননি) আবারো আরবীতে খুতবা শুরু করেন। এসময় সম্ভবত বিটিভির ক্যামেরাম্যান এসে ভিডিও করতে থাকলে তাকে দুই তিনজন ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে থাকেন। কিন্তু এরপরেই অন্য কয়েকজন এসে তাকে রক্ষা করেন এবং সসম্মানে বের করে দেন। এরপর সবাই শান্ত হয়ে বসে খুতবা শোনেন। তারপর নামাজ শুরু হয়। নামাজের সালাম ফেরানোর পরপরই অনেকে উঠে যেতে থাকেন। আমরা কিছুক্ষণ মোনাজাতে শরিক হয়েই উঠে পড়লাম, কারণ বাইরে তখন পরিস্থিতি গরম হতে শুরু করেছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেইট ছেড়ে বের হয়ে গেলাম মিছিলের সাথে। হাজার হাজার মুসল্লি সেই মিছিলে। মিছিলের অগ্রভাগ পল্টন মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই হঠাত অতর্কিতে শুরু পুলিশের টিয়ার শেল ফায়ার। সাথে বৃষ্টির মতো গুলি। কিছু বুঝে উঠার আগেই সবাই মসজিদের দিকে দৌড়াচ্ছে। আমিও দৌড়ে মসজিদ চত্বরে ঢুকলাম। দুই বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি। তাদের দেখা পেতে চত্বরের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম পুলিশ টিয়ার শেল আর গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মসজিদের গেইটের কাছে চলে এসেছে। সবার সাথে আমিও এবার চত্বর ছেড়ে মসজিদের ভেতরে ঢুকলাম। ভয় পেয়েছি বলাই বাহুল্য। জীবনে গুলির শব্দই শুনিনি। আর একসাথে এতো গুলির শব্দ মনে হয় অনেক পোড় খাওয়া রাজনৈতিক কর্মীও কখনো শুনেনি। টিয়ার শেল থেকে বাঁচতে মসজিদের একেবারেই ভেতরে এক খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াতেই একটা শেল উপর থেকে এসে পড়লো সামনে। আবার দৌড়। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। কোথায় গেলে একটু বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পাঁচ বছরের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধ – সবাই ছুটোছুটি করছে। টিয়ার গ্যাস সম্পর্কে আমার ধারণা ছিলো হয়তোবা শুধু চোখ জ্বালা করে, চোখ দিয়ে পানি ঝরে – এতোটুকুই। কিন্তু এই গ্যাসের যে কি জ্বালা, তা বুঝলাম মিনিট দুই পরেই, যখন গ্যাসের অ্যাকশন শুরু হলো। মনে হলো সারা মুখে কেউ পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, কাশতে কাশতে মনে হচ্ছিলো ফুসফুস গলা দিয়ে বের হয়ে আসবে – পড়ে গিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো, চোখের পানি – নাকের পানির কথা নাই বললাম। এদিকে যারা গ্যাস খেয়ে চোখে- মুখে পানি দিতে গেছে তাদের অবস্থা হলো আরো খারাপ; জ্বলুনি গেলো বেড়ে। আমার আগে থেকেই এটা জানা ছিলো যে, টিয়ার গ্যাসের প্রতিষেধক হলো আগুন, তাই কোনোমতে হাঁচড়ে পাঁচড়ে এক জায়গায় জ্বালানো আগুনের সামনে গিয়ে পড়লাম। আমার করুণ অবস্থা দেখে সবাই সরে জায়গা করে দিলো। কিছুক্ষণ আগুন পোহানোর পর ধাতস্থ হলাম। একটু পর সামনে গিয়ে দেখি পুরোপুরি যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। রাস্তায় শুধু পুলিশ, আর মসজিদের ভেতরে মুহুর্মূহু গুলি, সাথে টিয়ার শেল তো আছেই। মসজিদের ভেতরে সবাই শ্লোগান দিচ্ছে, কিন্তু বের হবার সাহস করছে না কেউই। মাঝেমাঝে দুই একজন একটা দুটা ঢিল ছুঁড়ে আসছিলো। সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, কয়েক সেকেন্ড পরপরই পুলিশের ছররা গুলি ছিঁটকে ছিঁটকে আসছিলো ভেতরে। দুঃখের বিষয়, কওমীপন্থী আলেমরা, মানে যারা মূলতঃ এই কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন, তারা সবাই মসজিদের একেবারেই ভেতরে ছিলেন, তাঁদের তেমন একটা দেখিনি। সামনে থেকে যারা দু’ একটি ঢিল ছুঁড়ছিলো তারা সবাইই ছিলো শিবির কর্মী, তাদের কেউ কেউ এই বৃষ্টির মতো গুলির মধ্যেই কলাপ্সিবল গেইট খুলে বের হয়ে যাচ্ছিলো। তাদের সাহস দেখে অভিভূত হলাম। পুরো দুই ঘন্টা (মানে যতক্ষণ মসজিদে ছিলাম) দেখলাম পুলিশকে যতটুকু পেরেছে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে শুধু শিবির। যাহোক, একটু থেমে আবারো শুরু হলো টিয়ার শেল নিক্ষেপ। টিয়ার গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য মসজিদের পুরনো পাটের কার্পেট কলাপ্সিবল গেইটের সামনে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলো শিবির কর্মীরা। মিডিয়ায় এটার অনেক সমালোচনা হয়েছে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে গ্যাস থেকে ভেতরের মুসল্লিদের বাঁচানোর জন্য এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা। এর মধ্যে কে যেনো দু’ তিনটা ইট নিয়ে আসলো। তারপর সেগুলো মসজিদের ভেতরেই ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে পুলিশকে মারা হলো। যুদ্ধসাজে সজ্জিত এক বাহিনীর বিরুদ্ধে যা কিছুই না বললেও বেশি বলা হবে। একটু পরেই দেখলাম সারা শরীর ছররা রাবার বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া এক বিশ একুশ বছর বয়েসী ছেলেকে নিয়ে আসা হলো মসজিদের ভেতরে। পায়ের আঙ্গুল থেকে শুরু করে কপাল পর্যন্ত গুলি চামড়ার ভেতর পর্যন্ত ঢুকে গেছে। তার কাছে এসে বসলাম, কপালে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলাম আর দোয়া করতে থাকলাম আমার মুসলিম ভাইটার জন্য। মসজিদের ভেতরেই তৎক্ষণাৎ ব্লেড আর সেফটিপিন দিয়ে শুরু হলো গুলি বের করার অপারেশন, আর গুলিবিদ্ধ ভাইটার যে কি আর্তনাদ…! এর মধ্যেই এক সাংবাদিক এসে আহতের ছবি তুলতে লাগলেন, আর বললেন, “ভালো হইছে, আপনারা অস্ত্র ছাড়া আসেন কেনো এইসব জায়গায়? এদের কই অস্ত্র ছাড়া মোকাবেলা করা যাবে? পারলে অস্ত্র নিয়া মাঠে নামবেন, আর নাইলে বাসায় শুইয়া শুইয়া ঘুমাইবেন।” সবাই বলল, “ভাই, আমরা তো মারামারি করতে আসি নাই, আসছি শুধু বিক্ষোভ দেখাইতে, বিনা অপরাধে এরা আমাদেরকে এইভাবে মারতেছে।” যাহোক, এইভাবে চললো অনেকক্ষণ। তারপর পরিস্থিতি সামান্য ঠান্ডা হবার পর সাংবাদিকেরা যখন উপরে উঠে আসলো নিউজ নিতে, তখন দেখলাম কিছু ছেলে হঠাত পেছন দিক থেকে দৌড় দিয়ে সামনে চলে গেলো, এদেরকে এতোক্ষণ দেখি নাই, গিয়েই সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা শুরু করে দিলো। তারপর সবাই গেলো সাংবাদিকদের সামনে, গিয়ে শ্লোগান দেয়া শুরু করলো। এর মধ্যেই আমার এক বন্ধুকে এক সাংবাদিক পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, রাস্তায় যেনো কোনো অবস্তাতেই কেউ বের না হয়। রাস্তায় নাকি পুলিশের চেয়ে বেশি ছিলো ছাত্রলীগ ক্যাডাররা এবং সবার কাছেই অস্ত্র ছিলো। যাহোক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার দেখলাম পুর্ব গেইট দিয়ে বের হওয়া যাচ্ছে, বেরিয়ে পড়লাম। দুজন পুলিশ সদস্য ছিলেন সেদিকে, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিচ্ছিলেন। বের হয়ে বাসায় ফিরেই যা নিউজ দেখলাম, মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। জামাত শিবির নাকি মুসল্লিদের সাথে মিশে পুলিশকে আক্রমণ করেছে, তারপর পুলিশ বাধ্য হয়ে অ্যাকশনে গিয়েছে, এক্কেবারে ডাহা মিথ্যা কথা। বিশেষ করে একাত্তর টিভির সাংবাদিক মুহিন যা বললেন তাতে হতবাক হয়ে গেলাম, এমন নির্ভেজাল মিথ্যাও টিভিতে বলতে পারে ধারণাই ছিলোনা! ঘরে ফিরে খুব অসহায় লাগলো, ৯৫% মুসলিমের দেশে প্রাণপ্রিয় নবী মুহাম্মদ (স) কে নিয়ে যারা কটূক্তি করলো তারা পেলো বীরের সম্মান, তাদেরকে দিনের পর দিন পুলিশ প্রহরায় আন্দোলনের নামে রাজপথে খিস্তিখেউড় আর নাচ গান করতে দেওয়া হলো, সরকারী খরচে নানান সুযোগ সুবিধার বন্দোবস্ত করা হলো আর যারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রতিবাদে নেমে এলো রাস্তায় তাদেরকে বিনা অপরাধে মেরে রক্তাক্ত করা হলো। আসলে এটাই হয়তো আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈমানের পরীক্ষা। মাদ্রাসা থেকে ফতোয়া দেয়া হয়েছে যে, শুক্রবারের প্রতিবাদ ছিলো অবশ্যই জিহাদের সমতুল্য, এবং এতে যারা নিহত হয়েছেন তারা অবশ্যই আল্লাহর কাছে শহীদের মর্যাদা পাবেন ইনশাআল্লাহ। সবশেষে মনে বাজছে আগুন পোহানোর সময় কানে আসা কয়েক মুসল্লীর বুকফাটা চিৎকার, “আল্লাহ, এই জালিমের বিচার তুমি করো, আল্লাহ”।

সুত্র: http://loveblogbd.wordpress.com/2013/02/24/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%b0%e0%a6%ae-%e0%a6%a5%e0%a7%87%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%83-%e0%a6%b6%e0%a7%81/

বিষয়: বিবিধ

১৬৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File