ফ্রান্‌ৎস কাফকা (কপি পেষ্ট)

লিখেছেন লিখেছেন অন্য চোখে ৩০ মার্চ, ২০১৪, ০২:৩৪:৪৪ দুপুর



ফ্রান্‌ৎস কাফকা (৩রা জুলাই, ১৮৮৩ – ৩রা জুন, ১৯২৪) জার্মান ভাষার উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখক। তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের প্রাহা (প্রাগ) শহরে (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী) একটি মধ্যবিত্ত জার্মান-ইহুদী জার্মানভাষী মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কাফকাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কাফকা অস্তিত্ববাদ তত্ত্বকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ কাজগুলো যেমন- "ডি ভারভাণ্ডলাঙ্গ"(রুপান্তর),"ডের প্রোজেন্স"(পথানুসরণ), "ডাস স্কোলস"(দুর্গ) ইত্যাদির বিষয়বস্তু এবং আদর্শিক দিক মূলত বিচ্ছিন্নতাবোধ,শারীরিক এবং মানসিক নিষ্ঠুরতা,অভিবাবক-সন্তান সম্পর্কের সংঘর্ষ,আতঙ্কজনক উদ্দেশ্য চরিতার্থে ব্যস্ত এমন চরিত্র, মানবজীবনে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপএবং রহস্যময় রূপান্তর - এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।

তার সময়কালে প্রাগের অধিকাংশ মানুষ চেক ভাষায় কথা বলতো। চেক আর জার্মান ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বিভাজন ছিল একটি স্পর্শকাতর বাস্তবতা, যেহেতু উভয় পক্ষই একই জাতীয় পরিচয়ের দাবিদার ছিল। ইহুদি সম্প্রদায় প্রায়ই দুই অনুভূতির মধ্যে নিজেদের খুঁজে ফিরত, যেহেতু এই জায়গাটা কোন রাজ্যের সেই প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই উঠতো। কাফকা উভয় ভাষাতেই পারদর্শী হলেও জার্মান ভাষাকে নিজের মাতৃভাষা মেনে নিয়েছিলেন। কাফকা একজন আইনজীবী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

(উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে)



Book Summaryফ্ল্যাপে লিখা কথা

কাফকা সাহিত্যে ‘নিয়তি বা সম্তভবত এই লেখাগুলোর মহত্ত্ব এটাই যে , সবকিছু আছে এতে, কিন্তু কোনো কিছুই নিশ্চিত করা হয়নি’ - আরব্যের কাম্যু

আধুনিক পৃথিবীরর দিকে তাকানো এক অর্থে , ফ্রানৎস কাফকার চোখ দিয়ে তাকানেই। কায়কার ভুবনে প্রবেশ করা লেকখ ও পাঠকদের কাছে তিনি বিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক, শতাব্দীর বিবেক,বিচ্ছিন্নতা, হতাশা আর দূর্বোধ্য কর্তৃপক্ষের হাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার হয়রান হওয়া মানুষের কাছে এ জীবনটিই ‘কাফকায়েস্ত, যে শব্দটি আমরা এখন ব্যবহার করি আমাদের ব্যক্তি জীবনের একই রকম অভিজ্ঞতাগুলোর বর্ণনার সময়ে।

এই মহান ও ‘ভবিষ্যবক্তা’ লেখকের-যিনি তাঁর লেখায় ঘটনার অনেক আগেই ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হলোকাস্ট, কম্যুনিজম ,অস্ত্বিত্ববাদ ও স্নায়ুযুদ্ধের -সব ছোট ও বড় গল্প দুই খণ্ডে ,বিস্তারিত ভূমিকা ও প্রতিটি লেখার ব্যাখ্যা-টীকাসহ, বাংলা ভাষায় এই প্রথম।

প্রথম খণ্ডে থাকছে লেখকের জীবদ্দশায় ছাপা সব লেখা, যার মধ্যে রয়েছে তিনি তাঁর যে কটি লেখা গোনায় ধরা যায় বলে ভাবছেন, সেই সব কটি লেখাই। আজ পর্যন্ত কাফকার ‘জীবদ্দশায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘ ছাপা অসংখ্য ইংরেজী ‍অনুবাদ-গ্রন্থের একটিতেও এতগুলো লেখা একসঙ্গে নেই, যা রয়েছে গল্পসমগ্রের এই প্রথম খণ্ডে। তার মৃত্যুর আগে ছাপা হওয়া সবগুলো গল্পই শুধু নয়, এত থাকছে তাঁর অনবদ্য এক ভ্রমণকাহিনী, ম্যাক্স ব্রডের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা অমাপ্ত এক উপন্যাসের প্রথম খণ্ড, তার আমেরিকা উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়, যা তিনি বই আকারে প্রকাশ করেছিলেন, এমনকি তাঁর লেখা তিনটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধও।

ফ্রানৎস ডকাফকা বিচিত্র ভূবনে স্বাগত , যেখানে এক সেলসম্যান ঘুম থেকে উঠে বিষণ্ন তেলাপোকায় রূপান্তরিত হয়ে যায়; এক ছেলে বিয়ে করে স্বাধীন হতে চায় বলে তার বাবা তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেন; এক অনশন-শিল্পী উপোস করে করে মারা যাওয়ার আগে বলে যায়- এই পৃথিবীতে তার খাওয়ার মতো কোনো খাদ্য নেই বলেই অনশনই ছিল তার শিল্প; এক লোক সারা জীবন অপেক্ষা করে করে ব্যর্থ হয়ে আইনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে; আর তা মৃত্যুর সমসয় বলা হয়, ওই দরজাটি ‍শুধু তার জন্যই বানানো হয়েছিল।

Title : ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র

Author : Masrur Arefine , Franz Kafka

Translator : Masrur Arefine

ফ্রানৎস কাফকা: জীবন ও সাহিত্য

মাসরুর আরেফিন

Published: 2013-02-05 10:35:58.0 BdST Updated: 2013-02-05 18:09:24.0 BdST

ফ্রানৎস কাফকার লেখায় সব বিচিত্র ও উদ্ভট ঘটনা ঘটে এমনভাবে, যেন ওগুলোতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই।

যেমন: গ্রেগর সামসা নামের এক সেলস্ম্যান এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে, সে একটা তেলাপোকায় পরিণত হয়ে গিয়েছে; কিন্তু বেচারা তখনো ভাবছে অফিসে যাওয়ার ট্রেনটা যেন আবার মিস না হয়ে যায় (গল্প ‘রূপান্তর’); জোসেফ কে. নামের এক নিরপরাধ ব্যাংকারকে একদিন সকালে অজানা এক অপরাধের দায়ে দুজন সরকারি এজেন্ট আকস্মিক গ্রেপ্তার করে বসে। কে.র প্রতিবেশী মহিলার ঘরে তার একটা ছোটখাটো বিচার হয়ে যায়। তাকে কেউ গ্রেপ্তার করে কোথাও নিয়ে যায় না, শুধু ‘মুক্ত’ভাবে ঘোরাফেরা করার অনুমতি আর পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করার আদেশ দেওয়া হয় তাকে (উপন্যাস বিচার); কে. নামের এক ভূমিজরিপকারী ভদ্রলোক সারা জীবন ধরে ব্যর্থ চেষ্টা করে যায় গ্রামের শাসকদের দুর্গ বলে পরিচিত রহস্যময় এক দুর্গের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করার আর তার এই গ্রামে অবস্থানের আইনগত স্বীকৃতি ও অনুমতি পাওয়ার (উপন্যাস দুর্গ); এক অদ্ভুতদর্শন মেশিন আক্ষরিক অর্থেই দণ্ডিত আসামিদের গায়ে শত শত সুই দিয়ে নকশা করে লিখে দেয় তাদের অপরাধের কথা, ওভাবেই নির্মম মৃত্যু হয় আসামিদের (গল্প ‘দ- উপনিবেশে’); এক লোক সারা জীবন আইনের দরজার বাইরে অপেক্ষা করে থাকে ভেতরে ঢোকার জন্য, তারপর যখন সে মারা যাচ্ছে, তাকে বলা হয়, এই দরজাটা শুধু তার জন্যই বানানো হয়েছিল (গল্প, ‘আইনের দরজায়’); এক ব্যবসায়ী ছেলে বিয়ে করে স্বাধীনভাবে সংসার করতে চায় আর এতে খেপে গিয়ে তার বৃদ্ধ বাবা, জীর্ণ নোংরা আন্ডারওয়ার পরা এক ক্ষমতা-উন্মাদ বুড়ো, ছেলেকে পানিতে ডুবে মরার মৃত্যুদ- দিয়ে বসেন (গল্প ‘রায়’); এক বৃদ্ধ গ্রাম্য ডাক্তার গভীর রাতে আজব এক ঘোড়াগাড়িতে চড়ে, তার নিজের বাসার কাজের মেয়েটাকে ধর্ষণোদ্যত এক লোকের হাতে ফেলে রেখে রোগী দেখতে যান দূরের গাঁয়ে, রোগীর শরীরে জ্বলজ্বল করছে ফুলের মতো একটা ক্ষত, আর সেখানে কিলবিল করছে পোকা, আর গ্রামবাসীরা ডাক্তারের রোগ সারানোর ব্যর্থতার শাস্তি হিসেবে এই অসহায় ডাক্তারকে শুইয়ে দেয় বিছানায়, রোগীর পাশে (গল্প ‘এক গ্রাম্য ডাক্তার’); সম্রাটের বার্তা নিয়ে এক বাহক কোনো দিনই পৌঁছাতে পারে না তার গন্তব্যে, পথে শুধু বাধা আর বাধা, আক্ষরিক অর্থে গোলকধাঁধার মতো (গল্প ‘সম্রাটের কাছ থেকে একটি বার্তা’); এক লোকের পেশাই হচ্ছে না খেয়ে থাকা, ক্ষুধা-শিল্পী সে, একদিন ওভাবে উপোস করেই সে মারা যায়, আর মরার আগে বলে যায়, তার খাওয়ার মতো কোনো খাবার এই পৃথিবীতে নেই বলেই অনশনই ছিল তার শিল্প (গল্প, ‘এক অনশন-শিল্পী’); এক কিশোর ছেলে, কার্ল রসমান, বাসার কাজের মেয়ের গর্ভে অবৈধ সন্তানের জন্ম দিলে তার বাবা-মা তাকে অভিবাসীদের জাহাজে তুলে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন, এবার এই ভিনদেশে শুরু হয় তার বারবার নানা বিচারের মুখোমুখি হওয়া (উপন্যাস আমেরিকা, প্রথম অধ্যায় এ বইয়ের ‘দি স্টোকার’); এক মেয়ে ইঁদুর, নাম জোসেফিন, মঞ্চে গান গায়, তার জাতির একমাত্র আশা-ভরসা সে, এমনটাই তার দাবি, আর আমরা তার জীবনের গল্পটি শুনি এক কথকের মুখে যে জোসেফিনের দাবিগুলোর প্রতি সন্দিহান কিন্তু একই সঙ্গে বিস্ময়বিমুগ্ধ যে মঞ্চের বাইরের এই অতি সাধারণ মেয়ে ইঁদুরটি মঞ্চে কেন এত পূজনীয় (কাফকার শেষতম গল্প ‘গায়িকা জোসেফিন অথবা ইঁদুর-জাতি’)।

বলে শেষ করা যাবে না কীসব বিচিত্র, আপাত-অর্থহীন, মানসিক ও শারীরিক নৃশংসতার ঘটনা অবলীলায় ঘটে যেতে থাকে কাফকার গল্পের পরে গল্পে, ডায়েরির পাতায় পাতায়; বারবার মনে হয়, সবটা দুঃস্বপ্নে ঘটছে, সবটাতে গল্পের চরিত্রেরা যেন অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছে তাদের জীবনের মানে, কিংবা খুঁজে ফিরছে খোদার সাহায্যের হাত, মালিকের অনুগ্রহ বা শাসকের কৃপাদৃষ্টি। নাকি পুরোটাই ঠাট্টা, নাকি পুরোটাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরের ইউরোপিয়ান অনিশ্চিতির এক গদ্যকবিতা, তখনকার সামাজিক-বাস্তবতার এক কমিক উপস্থাপন (এখানে মনে পড়ে যায় ১৯০৮-এর দিকে চার্লি চ্যাপলিন-হ্যাট-পরা কাফকার বিখ্যাত ছবিটার কথা; চ্যাপলিন বাস্তবেই প্রিয় ছিল কাফকার)?

কতভাবেই-না কাফকা পড়া যায় - ডাক্তারি শাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন কাফকা পড়ার চল আছে (অর্থাৎ কাফকার ‘ক্লিনিক্যাল ব্যাখ্যা’), তেমনি শ্রেণীবৈষম্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও কাফকাকে নিয়ে লেখা হয়েছে কয়েক শ বই (কাফকার ‘ম্যার্ক্সিস্ট ব্যাখ্যা’), আর তেমনই ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণবাদী চোখ দিয়ে কাফকার প্রতিটা লাইন, এমনকি প্রতিটা শব্দের, আর কমা, সেমিকোলন ব্যবহারেরও ব্যাখ্যা হয়েছে কতবার (কাফকার ‘ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা’)। আরো কত কত ব্যাখ্যা হয়েছে এই লেখকের লেখার থিম, তাঁর ব্যবহৃত ইমেজ ও লেখার আবহ নিয়ে- তার ইয়ত্তা নেই। তবে সবকিছু বলা হয়ে যাওয়ার পরেও, বারবারই, কাফকার পোস্টকার্ড ইমেজটি হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘যন্ত্রণা’ ও ‘জ্বালা-পীড়া-দুঃখ-কষ্টে’র। রোনাল্ড হেয়ম্যানের ১৯৮১-তে প্রকাশিত যথেষ্ট বিখ্যাত কাফকা-জীবনীর একেবারে শেষে নির্ঘণ্ট অংশ ‘ফ্রানৎস কাফকা’ নামের পাশের ভুক্তিগুলোর দিকে তাকালে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়:

কাফকা, ফ্রানৎস: ‘আত্মহত্যার বোধ’; ‘আত্মঘৃণা’; ‘আনন্দময় অভিজ্ঞতাগুলো মনে রাখতে পারার অক্ষমতা’; ‘শব্দের জ্বালাতনে পীড়িত’; ‘নিজেকে অপছন্দ করার বাধ্যতামূলক আচরণ’; এমনকি এক রহস্যময় ভুক্তি ‘জীবন যে খাদ্য দেয় তার প্রত্যাখ্যান’।

এটাই আমাদের সেই চিরচেনা কাফকা: খ্যাপাটে, যন্ত্রণাপীড়িত, আত্মবিশ্বাসহীন, নিজের প্রতি ঘৃণায় ভরা এক শিক্ষিত চেক যুবক, যার অদ্বিতীয় মেধার পূর্ণ স্বীকৃতি তাঁর নিজের সামান্য একচল্লিশ বছরের জীবদ্দশায় মেলেনি।

আরেকটু পণ্ডিতি ঢঙে বললে, আমাদের চিরচেনা কাফকার ছবিটা এমন: এক রহস্যময় প্রতিভা, নিঃসঙ্গ এক ইউরোপিয়ান নস্ত্রাদামুস্ (ভবিষ্যদ্বক্তা), যার সৃজনী-ক্ষমতাকে তাঁর সমকালীন লেখকেরা উপেক্ষা করেছিলেন আর যিনি ইহুদিদের প্রতি এক বৈরী পরিবেশে বাবার তাচ্ছিল্য ও অফিসের পীড়ন সয়ে নেমে গিয়েছিলেন তাঁর কুহকী সাধু-সন্তসুলভ চিন্তার গভীরতম প্রদেশে আর ওখান থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন একদিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে, সোভিয়েত গুলাগ আসবে, আমলাতন্ত্র পৃথিবী জুড়ে আরো পোক্ত হবে এবং আধুনিক মানুষের জীবন জটিল থেকে আরো জটিলতর হয়ে উঠবে।

কাফকাকে দেখার এই প্রতিষ্ঠিত ঢং, কাফকা-ব্যাখ্যার সময় শব্দচয়নের এই যে চিরচেনা ভঙ্গি, রোনাল্ড হেয়ম্যানের বইয়ের ‘কাফকা’ নামের পাশে নির্ঘণ্টের এই যে ক্লিশে ভুক্তিগুলো, এর নামই ‘কাফকা-মিথ’। আমরা যত যা-ই বলি না কেন, আমাদের ঐ কাফকা-মিথই ভালো লাগে, মিথের ঐ কাফকাকেই আমরা ভালোবাসি, পূজা করি, পছন্দ করি। তবে কথা হচ্ছে, এসব মিথের গোঁড়ায় আছে বিরাট গলদ এই কাফকা-মিথের অনেকটুকু সত্যিই মিথ বা অসত্য অনুমান।

সত্য তাহলে কী, তা জানার জন্য আমাদের নির্মোহ চোখে তাকাতে হবে কাফকার জীবনের দিকে। কাফকার লেখাগুলো অসংখ্য আত্মজীবনীর উপাদানে ভরপুর (কিন্তু তার মানে এমন না যে কাফকার সাহিত্যকর্ম তাঁর কোনো লুকানো-সাজানো আত্মজীবনী)। কাফকা আসলে বলেওছিলেন যে, তাঁর কোনো কোনো লেখা ‘সত্যিই একদম ব্যক্তিগত স্বভাবের কিছু হিজিবিজি কাটা বা খসড়া নোট টোকার বেশি কিছু না’; কিন্তু জীবনকে সাহিত্যে পরিণত করার তাঁর যে মূল লক্ষ্য ছিল, সেখানে তিনি ঠিকই ঐ ব্যক্তিগত পর্যায়কে অতিক্রম করে, সমগ্র মানব-অস্তিত্বের মৌলিক চেহারাটিই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ‘পৃথিবীকে তার শুদ্ধ, সত্য ও অপরিবর্তনীয় রূপে তুলে ধরতে’ (ডায়েরি, ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯১৭)।

কাফকাকে নিয়ে তৈরি হওয়া মিথগুলো খণ্ডানোর জায়গা এটা নয়, আর তা সাধারণ বাঙালি পাঠকের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছুও নয়। মিথ বলি, আর সত্যই বলি, এই ‘ভূমিকা’র উদ্দেশ্য পরিষ্কার: ১. কাফকার জীবনের মূল দিকগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা (তাতে যদি কোনো-না-কোনো মিথ এমনিতেই খণ্ডানো হয়ে যায়, তো ভালো), যাতে করে তাঁর সময়কার সমাজ, রাজনীতি ও তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানা ঘটনা থেকে পাঠকের কাফকা বুঝতে কিছুটা সুবিধা হয়; ২. কাফকা-সাহিত্যের নানা ব্যাখ্যা ও তত্ত্ব কিছুটা ছুঁয়ে যাওয়া যাতে করে পাঠক আরো আগ্রহী হয়ে ওঠেন ফ্রানৎস কাফকার জীবন ও সাহিত্যকর্ম বোঝার ব্যাপারে এবং এর সূত্র ধরে একসময় প্রবেশ করেন শুধু কাফকার নয় বরং সমগ্র আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের বিশাল ভুবনে; এবং ৩. পাঠককে এ কথাটুকু বলা যে, যেমনটা আলব্যের কাম্যু বলেছিলেন, কাফকার মূল স্বাদ অনুভব করার জন্য তাঁর নিজের লেখা বারবার পড়তে হবে; আর তাঁকে নিয়ে লেখা যত কম পড়া যায় ততই ভালো। মিথের কাফকার বিষয়ে শুধু এটুকুই জানা ভালো যে তাঁকে নিয়ে বিশ্বসাহিত্যে এই এই মিথ বিদ্যমান আছে, কিন্তু মিথের কাফকা মাথায় রেখে কাফকা-পাঠ তাঁর সরল-সুন্দর গল্পগুলো পাঠের আনন্দ শুধু বাধাগ্রস্তই করবে।

কাফকার জীবনে প্রবেশের আগে আসুন আমরা শুধু একবার দেখে নিই প্রধান দশটি কাফকা-মিথ। আবারও বলছি, এখানে ‘মিথ’ বলতে বোঝানো হচ্ছে হয় অর্ধসত্য বা পুরো অসত্য কিছুকে। প্রতিটা মিথের পাশে ব্র্যাকেটে তা সত্য না অসত্য নাকি অর্ধসত্য সেটা বলে দেওয়া হলো:

১. কাফকা তাঁর জীবদ্দশায় লেখক হিসেবে বলতে গেলে অপরিচিত ছিলেন; লেখা প্রকাশে তাঁর ছিল বিরাট অনীহা (অর্ধসত্য)

২. কাফকা তাঁর সমস্ত লেখা ম্যাক্স ব্রডকে তাঁর মৃত্যুর পরে পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিলেন (সত্য)

৩. ভয়ংকর এক আমলাতান্ত্রিক চাকরি তাঁকে নিষ্পেষিত ও শেষ করে দিয়েছিল (অর্ধসত্য)

৪. কাফকার বাবা ছিলেন একজন নিষ্ঠুর একনায়ক; ভালো কিছুই ছিল না তাঁর বাবার মধ্যে (বিতর্কিত)

৫. কাফকা জীবনের বহু বছর যক্ষ্মা রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন (সত্য)

৬. কাফকা তাঁর জীবনে আসা নারীদের সঙ্গে অসম্ভব রকমের সৎ ছিলেন। তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ ও অসহায় (অসত্য)

৭. প্রাগে জার্মানভাষী ইহুদি হিসেবে কাফকা ছিলেন দ্বিগুণ টানাপোড়েনে তিনি ছিলেন সংখ্যালঘুদের মধ্যেও সংখ্যালঘু; সংখ্যাগুরু চেকভাষীদের মধ্যে এক সংখ্যালঘু জার্মানভাষী লেখক এবং চারদিকের অসংখ্য খ্রিষ্টানের মধ্যে সংখ্যালঘু এক ইহুদি (অর্ধসত্য)

৮. কাফকার সাহিত্যকর্ম তাঁর এই জোড়া সংখ্যালঘুত্বের ইহুদি অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা। তাঁর লেখা বুঝতে হলে তাঁর ইহুদিত্বকে আগে বুঝতে হবে (বিতর্কিত সত্য)

৯. কাফকার সাহিত্যকর্ম, যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বন্দিশিবিরের ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিল যুদ্ধের প্রায় কুড়ি বছর আগেই (সত্য, তবে ব্যাপারটি এমন নয়)

১০. নাৎসিরা কাফকার লেখা নিষিদ্ধ করেছিল এবং পুড়িয়ে ফেলেছিল (অর্ধসত্য; মূলত অসত্য)

২.

পরিবার

১৮৮৩ সালের জুলাই মাসের ৩ তারিখে ফ্রানৎস কাফকার জন্ম তখনকার অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগে, এই প্রাচীন শহরটির ওল্ড টাউন স্কোয়ারের একদম কাছে। প্রাগ তখন বোহেমিয়া রাজ্যের রাজধানী। কাফকারা ছিলেন মধ্যবিত্ত, আশ্কেনাজি সম্প্রদায়ের ইহুদি। তাঁর বাবা হারমান কাফকা (১৮৫২-১৯৩১) ছিলেন ইয়াকব কাফকার চতুর্থ সন্তান; ইয়াকব পেশায় ছিলেন ধর্মীয় অনুশাসন-মানা কসাই। ইয়াকবই পরিবারটিকে দক্ষিণ বোহেমিয়ার ইহুদি অধ্যুষিত পল্লি ওসেক্ থেকে প্রাগে নিয়ে আসেন। কিছুদিন সেনাবাহিনীতে, কিছুদিন ভ্রাম্যমাণ সেলস্ম্যান হিসেবে কাটিয়ে হারমান কাফকা তাঁর স্যুভেনির, ফ্যান্সি জিনিসপত্র আর কাপড়চোপড়ের দোকান চালু করেন প্রাগে, ওল্ড টাউন স্কোয়ারে। তাঁর অফিসে কাজ করতেন ১৫ জন কর্মচারী (এতে বোঝা যায়, একদম ছোট ছিল না তাঁর ব্যবসা) আর তাঁর ব্যবসার লোগো ছিল দাঁড়কাক (চেক ভাষায় kavka)। কাফকার মা ছিলেন ইয়ুলি কাফকা (১৮৫৬-১৯৩৪), ইয়াকব লোউভি নামের এক প্রতিষ্ঠিত রিটেল ব্যবসায়ীর মেয়ে; শিক্ষার দিক থেকে তাঁর স্বামীর ওপরে। কাফকার বাবা-মা বাসায় কথা বলতেন ইদ্দিশ (হিব্রু বর্ণমালায় লেখা আশ্কেনাজি ইহুদি মূল থেকে তৈরি হওয়া, গোঁড়া ইহুদিদের ব্যবহৃত হিব্রু ও সেমেটিক সংমিশ্র্রণের এক জার্মান ভাষার রূপ) ঘেঁষা এক জার্মান ভাষায়, কিন্তু ‘শিক্ষিত জার্মান’ ভাষা তখন যেহেতু ছিল সমাজে ও চাকরিতে উপরে ওঠার জন্য জরুরি, তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ‘শিক্ষিত জার্মান’ ভাষা শিখতেই অনুপ্রাণিত করতেন। কাফকারা ছিলেন মোট ছয় ভাই বোন, এঁদের মধ্যে ফ্রানৎস কাফকা সবার বড়। ফ্রানৎসের বয়স ছয় হওয়ার আগেই তাঁর অন্য দুই ভাই গেয়র্গ ও হেইনরিখ একদম শিশু বয়সেই মারা যান। এরপর জন্ম নেন ফ্রানৎসের তিন বোন: গ্যাব্রিয়েল, ডাকনাম এলি (১৮৮৯-১৯৪১); ভ্যালেরি, ডাকনাম ভাল্লি (১৮৯০-১৯৪২); ওটলি, ডাকনাম ওট্লা, আমৃত্যু বড় ভাই ফ্রানৎস কাফকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন ছিলেন এই ওট্লা (১৮৯২-১৯৪৩)। তিন বোনের মৃত্যুসন দেখে নিশ্চয়ই আর বলতে হয় না যে এঁরা তিনজনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি বন্দিশিবিরে প্রাণ হারান।

কাফকারা শুরুর দিকে থাকতেন একটা ছোট, ঠাসাঠাসি অ্যাপার্টমেন্টে। তাঁদের বাসায় এক কাজের মেয়ে থাকত (কাফকার বেশ কিছু গল্প ও তিনটি উপন্যাসে বাসার ঝি বা কাজের মেয়ের কথা বারবার ঘুরেফিরে আসে)। কাফকার ঘর প্রায়ই থাকত অনেক ঠান্ডা; প্রাগে বিদ্যুৎ তখনো আসেনি, হিটিং সিস্টেমের তো প্রশ্নই আসে না; প্রচণ্ড শীতে কয়লাই ছিল একমাত্র ভরসা। ১৯১৩-র নভেম্বরে কাফকা পরিবার বেশ বড় একটা অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ওঠে (প্রায় সাত-আটবার বাসা বদল করেন হারমান কাফকা; সবগুলোই প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারের আশপাশে), যদিও তত দিনে এলি ও ভাল্লির বিয়ে হয়ে গেছে এবং তাঁরা কাফকার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে তাঁদের স্বামীদের সঙ্গে বাস করছেন। ১৯১৪-র আগস্টে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগেভাগে, এ দুই বোন বাবা-মায়ের বড় অ্যাপার্টমেন্টে ফেরত আসেন, যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে তাঁদের স্বামীরা কোথায় তা তাঁরা জানতেন না। দুজনেরই তখন বাচ্চা কোলে। ফ্রানৎস কাফকা, তাঁর বয়স তখন ৩১, ভাল্লির ফেলে আসা নীরব নিশ্চুপ অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ওঠেন; জীবনে এই প্রথম তাঁর একা থাকা। কাজের দিনগুলোতে বাবা-মা দুজনেই কাজে যেতেন, ইয়ুলি কাফকা মাঝেমধ্যে টানা ১২ ঘণ্টা কাজ করতেন স্বামীর দোকানে, ব্যবসা দেখাশোনায়। কাফকার শৈশব তাই ছিল মূলত তিন বোনের সঙ্গে, কিছুটা একা কাজের মেয়ে আর ঠিকা-ঝিদের হাতেই আসলে বেড়ে উঠেছিলেন এই চার ভাইবোন।

শিক্ষা

১৮৮৯ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত কাফকা প্রাগের তখনকার মাসনা স্ট্রিটে ‘জার্মান বয়েজ এলিমেন্টারি স্কুলে’ পড়াশোনা করেন। তাঁর বয়স ১৩ হলে ‘বার মিৎজভাহ্’ (ইহুদি ছেলেদের বালেগ হওয়ার ধর্মীয় অনুষ্ঠান) অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাফকার ছোটবেলার ধর্মীয় পড়াশোনার শেষ হয়। কাফকা কখনোই ইহুদি উপাসনালয় সিনাগগে যেতে পছন্দ করতেন না; বছরে মাত্র চারবার বাবার সঙ্গে ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানাদির জন্য সিনাগগে যেতেন।

১৮৯৩-এ এলিমেন্টারি স্কুল ছেড়ে কাফকা প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারের ওপর অবস্থিত কিন্স্কি প্যালেসে (এটারই নিচতলায় ছিল তাঁর বাবার দোকান) কড়া শাসনের ও ক্ল্যাসিক্যাল শিক্ষাদান রীতিতে চালানো জার্মান মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। এখানে পড়ার মাধ্যমে ছিল জার্মান, কিন্তু কাফকা চেক বলতে ও লিখতে পারতেন। তাঁর চেক ভাষায় দখলের জন্য তিনি প্রশংসাও কুড়িয়েছিলেন, কিন্তু নিজেকে তিনি চেক ভাষায় সাবলীল মনে করতেন না। ১৯০১-এ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে কাফকা প্রাগের জার্মান কার্ল-ফার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শুরু করেন রসায়নে, কিন্তু দুই সপ্তাহ পরে আইনের ছাত্র হয়ে যান। আইন নিয়ে পড়াশোনা তাঁর ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ ছিল না, কিন্তু তাঁর বাবা খুশি হয়েছিলেন, কারণ আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা শেষে ভালো ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। এখানে কাফকার বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক ফেলিক্স ভেলট্শ্, লেখক অস্কার বাউম, ফ্রানৎস ভেরফেল্ প্রমুখ। প্রথম বছরের পড়া শেষ হতেই কাফকার সঙ্গে পরিচয় হয় ম্যাক্স ব্রডের। ম্যাক্সও ছিলেন আইনের ছাত্র। শুরু হয় কিংবদন্তিতে রূপ নেওয়া এক আজীবন বন্ধুত্বের। ম্যাক্স ব্রডই প্রথম খেয়াল করেন খুব কম কথা বলা, লাজুক ধরনের এই ছেলেটির মেধা ও প্রজ্ঞা গভীর ও অগাধ। জীবনভর কাফকা খুব উৎসুক পাঠক ছিলেন। ম্যাক্স ও তিনি একসঙ্গে, ম্যাক্সের পরামর্শে, মূল গ্রিক ভাষায় প্লেটোর Protagoras পড়েন এবং কাফকার পরামর্শে তাঁরা দুজনে আবার একসঙ্গে মূল ফরাসিতে ফ্লবেয়ারের Sentimental Education ও The Temptation of Saint Anthony পড়েন। কাফকা চারজন লেখককে তাঁর ‘সত্যিকারের রক্তের ভাই’ বলে ভাবতেন: দস্তয়ইয়েফ্স্কি, ফ্লবেয়ার, ফ্রানৎস গ্রিলপারসার ও হাইনরিখ ফন ক্লাইস্ট । এর পাশাপাশি চেক সাহিত্য ভালোবাসতেন কাফকা আর গ্যেয়টেকে খুব পছন্দ করতেন। ১৯০৬ সালের ১৮ জুলাই তিনি আইনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি পান এবং এর পরে এক বছর আদালতে বাধ্যতামূলক বেতনহীন ক্লার্কের চাকরি করেন। পড়াশোনার ক্ষেত্রে কাফকার প্রিয় বিষয়, অনুমান করি, ছিল দর্শন ও ধর্ম। কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি কোনো বিশেষ টান তিনি দেখাননি। ১৯১৭ সালের পরে তিনি পাস্কাল, শোপেনহাউয়ার, সাধু অগাস্তিনের Confessions, শেষ দিককার টলস্টয়ের খ্রিষ্টীয় ডায়েরিগুলো– এসব পড়েন। এঁদের মধ্যে অস্তিত্ববাদী দার্শনিক সোরেন কির্য়েকেগার্ড কাফকার ওপর সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেন বলে ধারণা করা হয়। অনেক কাফকা গবেষকে বিশ্বাস করেন, ডেনিশ এই দার্শনিকের মধ্যেই আছে কাফকাকে বোঝার অন্যতম কার্যকর চাবিকাঠি। কাফকার উপন্যাস দুর্গ-এর প্রথম প্রকাশের এপিলোগে ম্যাক্স ব্রডও সে কথা উল্লেখ করে গেছেন। কিন্তু বাস্তবে কাফকা কির্য়েকেগার্ডকে যেভাবে বুঝেছিলেন, তাতে মনে হয় না, কির্য়েকেগার্ডের পক্ষে কাফকার লেখায় বিরাট কোনো ছাপ ফেলা সম্ভব ছিল। কাফকা ও কির্য়েকেগার্ড– এ প্রসঙ্গে আমরা শেষ দিকে আরেকটু আলোচনা করব।

কর্মজীবন

কাফকা মোট দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এবং একটি বড় ব্যবসায়িক উদ্যোগে মাথা ঘামান। প্রথম চাকরিটি ছিল এক ইতালিয়ান বিমা কোম্পানি Assicurazioni Generali-তে। ১৯০৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯০৮-এর ১৫ জুলাই পর্যন্ত ইতালিয়ান এই কোম্পানির প্রাগের অফিসে খুব অসুখী এক সময় কাটে তাঁর। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার দীর্ঘ কর্মঘণ্টা তাঁকে বিষর্ম করে তোলে; বেতনও কম আর সেই সঙ্গে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকা লেখালেখির জন্য সময় দেওয়া যাচ্ছে না, এ দুটো সত্যই পীড়া দিতে থাকে তাঁকে। তাঁর অনেক চিঠিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫ জুলাই ১৯০৮-এ চাকরি থেকে পদত্যাগ করার দুই সপ্তাহ পরে তিনি সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান Workers’ Accident Insurance Institute for the Kingdom of Bohemia-তে যোগ দেন। অফিসে তাঁর দায়িত্ব ছিল মিল-কারখানার শ্রমিকেরা কাজ করতে গিয়ে আহত হলে, সেসব দুর্ঘটনার তদন্ত করা ও ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নির্ধারণ করা; তখনকার দিনে মেশিনে কাটা পড়ে হাতের আঙুল হারানো কিংবা অন্য কোনো অঙ্গের ক্ষতি হওয়া ছিল বেশ নৈমিত্তিক ঘটনা। আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম ম্যানেজমেন্ট গুরু পিটার ড্রাকারের দাবি যে ফ্রানৎস কাফকাই আজকালকার মিল-কারখানায় ব্যবহৃত মাথার শক্ত হেলমেটের মতো জিনিসটার উদ্ভাবক, যদিও এ তথ্যের সমর্থনে কাফকার অফিসের কাগজপত্র থেকে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি (অনুসন্ধিৎসু পাঠক সাম্প্রতিক প্রকাশিত, বিখ্যাত কাফকা স্কলার স্ট্যানলি কর্নগোল্ড ও অন্যদের সম্পাদিত Franz Kafka - The Office Writings বইটি ঘেঁটে দেখতে পারেন)। কাফকার বাবা তাঁর ছেলের এই চাকরিকে Brotberuf বা ‘রুটির চাকরি’ বলে খোঁটা দিতেন; অসংখ্য লেখায় কাফকা নিজেও অফিস-জীবনের অনেক কিছু নিয়ে তাঁর মনঃকষ্টের কথা বলে গেছেন — এর মধ্যে অন্যতম বেশ কিছু ডায়েরি এন্ট্রিতে অফিসের তোষামোদি সংস্কৃতি, বস্-তোষণ ইত্যাদি নিয়ে তাঁর কিছু কমিক্যাল লেখা। কিন্তু এই একই মানুষ অফিসে কাজের বেলায় ছিলেন খুঁতখুঁতে, যত্নশীল, সৃজনশীল এবং নিবেদিতপ্রাণ। এরই ফলস্বরূপ দ্রুত অনেকগুলো পদোন্নতি হয় তাঁর; এবং নভেম্বর ১৯১৫ নাগাদ তাঁর বেতন গিয়ে দাঁড়ায় বছরে ৫ হাজার ৭৯৬ ক্রাউন, যার মূল্য, তখনকার দিনে, এখনকার হিসাবে মোটামুটি মাসে প্রায় সোয়া ৬ লাখ বাংলাদেশি টাকার মতো। কাফকার সময়ে তাঁরই পরিদর্শন করা অফিসগুলোয় শ্রমিকদের গড় বেতন ছিল বছরে ৯০০ থেকে ১০০০ ক্রাউন। দৈনিক মাত্র ছয় ঘণ্টা অফিসে চাকরি করে মাসে ৬ লাখ টাকার উপরে আয় করা কাফকার চাকরিকে কোনোভাবেই বাজে, নিম্নপদের কোনো চাকরি বলা যাবে না। ১৯১৮-র জানুয়ারিতে কাফকার বাবা ৫ লাখ ক্রাউন দিয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন, যার মূল্য তখনকার দিনে আজকের প্রায় ৫ মিলিয়ন পাউন্ডের সঙ্গে তুলনীয়। জেমস্ হয়েস্-এর Excavating Kafka (২০০৮) এবং পিটার-আন্দ্রে অল্ট এর সাড়া-জাগানো জার্মান কাফকা-জীবনী Der ewige sohn (The Eternal Son; ইংরেজি অনুবাদ এখনো বের হয়নি)-এর এই তথ্য কাফকার নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা এবং তাঁর চাকরির ভয়ংকরত্ব বিষয়ে গড়ে ওঠা মিথের ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে। পদোন্নতি পেয়ে একসময় কাফকার কাজ হয় ক্ষতিপূরণ দাবির যথার্থতা নির্ণয় করা, রিপোর্ট লেখা, ব্যবসায়ীদের আবেদন নিষ্পত্তি করা ইত্যাদি। এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন (Annual ReportHappy তৈরি করার মতো বড় কাজটিও কাফকা করেছেন অনেক বছর। তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরির ও সম্পাদনার কাজে তাঁর দক্ষতার বিশেষ প্রশংসা করতেন। দুপুর দুটোয় শেষ হয়ে যেত কাফকার অফিসের কাজ, অতএব সাহিত্যের জন্য দেওয়ার মতো সময় তাঁর মিলত যথেষ্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যখন প্রাগের যুবকদের সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগ দিতে হচ্ছে, তখন অফিসের ঊর্ধ্বতনেরা কাফকাকে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘জরুরি প্রয়োজন’ ঘোষণা করার কারণেই তাঁর আর যুদ্ধে যাওয়া লাগেনি। শুধু সেবারই নয়, পরে তিনি অসুস্থ হলে যেভাবে বারবার তাঁর অফিস তাঁর জন্য দীর্ঘ সব ছুটি মঞ্জুর করেছে এবং শেষে অতি অল্প বয়সে শারীরিক অসুস্থতার কারণে পূর্ণ পেনশন নিয়েই কাফকাকে যেভাবে চাকরিতে ইস্তফা দিতে দেওয়া হয়েছে — এর সবই দানবীয় এক অফিসে আমলাতান্ত্রিক অন্ধকারে হাতড়াতে থাকা ফ্রানৎস কাফকা মিথের বিপরীতে আমাদের নতুন করে তাঁকে নিয়ে ভাবতে উৎসাহ জোগায়।

১৯১১ সালে কাফকার বোন এলির স্বামী কার্ল হারমান ও ফ্রানৎস কাফকা মিলে প্রাগের প্রথম অ্যাজবেস্টস্ কারখানা খোলায় মনস্থির করেন। মেয়ের বিয়েতে কাফকার বাবার দেওয়া যৌতুকের টাকাই ছিল এ ব্যবসার মূল পুঁজি। প্রথমদিকে এই ব্যবসার প্রতি কাফকা খুবই আগ্রহ দেখান, পরে তাঁর লেখালেখিতে ব্যাঘাত ঘটছে বলে তিনি এর ওপর বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন।

জীবনের এরকম এক সময়েই তাঁর পরিচয় ঘটে এক ইদ্দিশ নাট্যদলের সঙ্গে। প্রাগে নাটক মঞ্চায়ন করতে আসা ইদ্দিশ অভিনেতাদের দলটির নেতা ইজাক লাউভির (দুই রকম বানানে Isaak Lowy এবং Jitskhok Levi) সঙ্গে কাফকার গাঢ় বন্ধুত্ব হয়। ১৯১১-এর অক্টোবরে এদের একটি নাটক দেখে কাফকা পরের টানা ছয় মাস ইদ্দিশ ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে ডুবে যান। এই আগ্রহ থেকেই পরে ডানা মেলে কাফকার ইহুদিধর্মের (Judaism) প্রতি আগ্রহের। এর কাছাকাছি সময়েই কাফকা মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে বাকি জীবনের জন্য শাকাহারী (Vegetarian) হয়ে যান। ১৯১৫ সালে তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার ডাক আসে, কিন্তু আগেই যেমন বলা হয়েছে, সরকারি কাজে তাঁর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে অফিস তাঁকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়। পরে অবশ্য, ১৯১৭ সালে, তিনি নিজেই কিছুটা যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতি রোমান্টিসিজম ও কিছুটা রহস্যময় এক কারণে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ দেখান, কিন্তু তত দিনে যক্ষ্মার কারণে ডাক্তারি দৃষ্টিকোণ থেকেই সেনাবাহিনী তাঁকে নিতে অপারগতা জানিয়ে বসে। ১৯১৮ সালে, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে, তাঁর অফিস শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর পেনশন মঞ্জুর করে। এর পরের ছয়টি বছর মোটামুটি নানা স্যানাটোরিয়ামে (হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যনিবাস) ঘুরে ঘুরেই জীবন কাটে তাঁর।

বোনের স্বামীর সঙ্গে অ্যাজবেস্টস্ ফ্যাক্টরি চালু করার আকুতি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে (তারিখ: ৫ নভেম্বর, ১৯১৫) হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের সম্রাট ফ্রানৎস জোসেফের চালু করা অস্ট্রিয়ান যুদ্ধ-বন্ডে বিনিয়োগ করে ১৫ বছর ট্যাক্স-ফ্রি বার্ষিক ৫.৫% সুদ হারে লাভ পাওয়ার জন্য বড় অঙ্কের টাকা খাটানো এবং নিবেদিতপ্রাণ হয়ে অফিসে কাজ করে তাঁর বারবার পদোন্নতি পাওয়ার ও মোটা বেতনের কর্মকর্তা হওয়ার ঘটনাগুলো আমাদের তাঁর অপার্থিব, সাধু-সন্ত রূপের উল্টোদিকে তাঁকে এক প্রখর বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন, বৈষয়িক ও পার্থিব মানুষ হিসেবে দেখতে প্রণোদনা জোগায়।

কাফকার বাবা– হারমান কাফকা

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে খুব কম লেখকের বাবাই ফ্রানৎস কাফকার বাবা হারমান কাফকার মতো বিনা অপরাধে এভাবে নিন্দিত ও গবেষকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। যেকোনো কাফকা-গবেষণায়ই হারমান কাফকা এক অন্যতম বড় চরিত্র এবং তাঁর চেহারাটি সেখানে সব সময়ই নিষ্ঠুর, অনুভূতিশূন্য এক পিতার, যিনি তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তানকে আজীবন আতঙ্কের মধ্যে রেখেছিলেন, বাস্তবিক অর্থেই তাকে পোকার চেয়ে বেশি সম্মান দেখাননি, যার ফলে সন্তানটি বেড়ে উঠেছিল আত্মবিশ্বাসহীন এক ব্যর্থ মানুষ হিসেবে।

কাফকা-গবেষক স্ট্যানলি কর্নগোল্ডের ভাষায় হারমান কাফকা ছিলেন ‘বিশালদেহী, স্বার্থপর ও স্বেচ্ছাচারী এক ব্যবসায়ী’; আর ছেলে ফ্রানৎস কাফকার মতে, তিনি ছিলেন, ‘শক্তি, স্বাস্থ্য, ক্ষুধা, উঁচু গলা, বাকপটুতা, নিজের প্রতি মুগ্ধতা, পার্থিব কর্তৃত্ব, সহ্যক্ষমতা, উপস্থিত বুদ্ধি এবং মানুষের স্বভাব সম্বন্ধে জ্ঞানের দিক থেকে একজন সত্যিকারের কাফকা’ (‘যেমনটা আমি কখনোই হতে পারিনি,’ কাফকা লিখেছেন)।

বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটি কাফকা তাঁর আত্মবিশ্লেষণের সবচেয়ে দামি ও বড় দলিল তাঁর বিখ্যাত বাবাকে লেখা চিঠিতে ((Letter to His Father) লিখে রেখে গেছেন। ১৯১৯ সালের নভেম্বরে লেখা প্রায় ১০০ পাতার এই চিঠি ফ্রানৎস কাফকার আত্মজীবনীমূলক প্রধান রচনা, যার উল্লেখ যেকোনো প্রামাণ্য কাফকা-গবেষণা বইয়ে থাকবেই। তিনি চেয়েছিলেন, বাবাকে এই চিঠি পাঠিয়ে বাবার সঙ্গে সম্পর্কের একটি দফারফা করবেন। কিন্তু তাঁর প্রিয় ছোট বোন ওট্লা এবং তাঁর মা তাঁকে চিঠিটি পাঠাতে নিষেধ করেন। কাফকা এটিকে ব্যক্তিগত এক দলিল হিসেবেই রেখে দেন, পরে ১৯২০ সালে তাঁর প্রেয়সী মিলেনা য়েসেন্স্কাকে তিনি চিঠিটি পড়তে দেন মিলেনার দিক থেকে তাঁকে বোঝার সুবিধা করে দিতে।

এ চিঠিতেই আমরা দেখতে পাই বাবা হারমান কীভাবে ছেলেকে ‘টেবিলের চারপাশে তাড়িয়ে বেড়াতেন’, কীভাবে তাঁকে হুমকি দিতেন (‘আমি তোমাকে মাছের মতো ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলব’), কীভাবে খুব ছোটবেলায় এক রাতে ছেলে কাঁদতে থাকলে বাবা তাঁকে বিছানা থেকে তুলে বাড়ির বাইরে পেছনের বারান্দায় ফেলে রেখেছিলেন, যার ফলে ছেলের মনে হয়েছিল বাবার তুলনায় সে অতি তুচ্ছ কিছু। কাফকার ভাষ্যমতে, তাঁর বাবা দোকানের কর্মচারীদের ওপর জুলুম করতেন, খুব খোঁটা দিয়ে কথা বলতেন তাঁর সন্তানদের সঙ্গে এবং একবার এসব জুলুমে ত্যক্ত হয়ে দোকানের সবাই চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার মনস্থির করলে ছেলেকেই সবাইকে এক-এক করে বুঝিয়ে ঠান্ডা করতে হয়েছিল। বাবাকে কাফকার ‘দৈত্য’ বলে মনে হতো। বাবার সঙ্গে সাঁতারের পুলে গেলে, বাবার বিশাল বপুর সামনে তাঁর নিজেকে মনে হতো, ‘একটা ছোট কঙ্কাল, অনিশ্চিত, ডাইভিং বোর্ডের ওপরে খালি পায়ে ঘোরাঘুরি করছি, পানি ভয় পাচ্ছি; সাঁতারের সময় তুমি যেভাবে হাত-পা চালাও তা আমার পক্ষে করা সম্ভব না।’ খাবার টেবিলে বাবা হারমান গপগপ করে গরম ধোঁয়া ওঠা খাবার গিলতেন বড় বড় গাল ভরে, মাংসের হাড় চিবাতেন কড়মড় করে, কিন্তু তাঁর সন্তানদের বলতেন যে ওভাবে খাওয়া নিষেধ। (চিঠির এ অংশ আমাদের মনে করিয়ে দেয় কাফকার গল্পের মাংসভোজী অনেক চরিত্রের কথা, যেমন আমেরিকা উপন্যাসের ভোজনপ্রিয় গ্রিন কিংবা ‘এক অনশন-শিল্পী’ গল্পের খসড়ার সেই নরমাংসভোজী চরিত্রকে)। কাফকার ভাষায় তাঁর বাবা তাঁর পুরো জীবন দখল করে ছিলেন, ‘পৃথিবীর পুরো মানচিত্রের উপর শুয়ে ছিলেন’ তিনি, ফ্রানৎসের জন্য ‘কোনো জায়গাই রাখেননি’। বাবাকে অনুকরণ করতে ব্যর্থ হয়ে কাফকা তাঁর অক্ষমতার জন্য নিজেকেই দোষী ভাবতে শুরু করলেন; তাঁর নিজের সারাংশ: ‘তোমার জন্য, বাবা, আমি আমার আত্মবিশ্বাস হারিয়েছি, বিনিময়ে পেয়েছি এক সীমাহীন অপরাধবোধ।’

ফ্রানৎস কাফকা জীবনের শেষ দিকে যখন কপর্দকশূন্য মেয়ে ইউলি ওরিৎসেককে বিয়ে করতে চাইলেন, তাঁর বাবা তখন খেপে গেলেন। কাফকার ভাষায়, তাঁর বাবা তাঁকে বললেন: ‘মেয়েটা খুব সম্ভব তার ব্লাউজ একটুখানি উঠিয়েছে, প্রাগের ইহুদি মেয়েগুলো যেভাবে ওঠায় আর কি, আর তুমি? তুমি মজে গেলে, ঠিক করলে ঐ মুহূর্তেই তাকে বিয়ে করবে। তোমাকে আমি একবারেই বুঝি না। তুমি বড় হয়েছ, শহরে থাকছ, কিন্তু তোমার চলার পথে দেখা হওয়া প্রথম মেয়েটাকে বিয়ে করা ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবতে পারছ না। অন্য কোনো “রাস্তা” কি তোমার নেই? ওইসব জায়গায় যেতে যদি তোমার ভয় লাগে, আমি তোমাকে সাথে নিয়ে যাব।’ বাবার কাছ থেকে পাওয়া গণিকালয়ে যাওয়ার এই ইঙ্গিত কাফকার কাছে মনে হয়েছিল পৃথিবীর ‘সবচেয়ে নোংরা জিনিস’। বাবার কর্তৃত্ব থেকে মুক্তির জন্য কাফকা পথ হিসেবে দেখতেন নিজের ক্যারিয়ারকে। চিঠিতে তিনি লিখেছেন যে তাঁর বাবা-মা ছেলে কোন বিষয়ে পড়বে তা নিয়ে তাঁকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, কিন্তু এই স্বাধীনতা, কাফকার মতে, ছিল অর্থহীন। যে অপরাধবোধ তাঁর বাবা তাঁর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, এর ফলে পড়াশোনাতে কাফকা কোনো আনন্দই পেতেন না, প্রতিবছর পরীক্ষার আগে তিনি ভাবতেন যে ফেল করবেন। যদিও প্রতিবছরই তিনি পাস করে গেছেন, তবু তাঁর ভাষায়, পড়াশোনার প্রতি তাঁর ততটুকুই আগ্রহ ছিল যেরকম আগ্রহ কোনো টাকা চুরি করা ব্যাংক কমকর্তার, যেকোনো সময়ে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ের মধ্যে, থাকে তার দৈনন্দিন ব্যাংকিংয়ের কাজে।

পরে তিনি দেখলেন, বাবার হাত থেকে পালানোর আরেকটি রাস্তা হচ্ছে ‘সাহিত্য’। কাফকা এ চিঠিতে স্বীকার করেছেন, সাহিত্যের মধ্যে সত্যিই কিছুটা হলেও তাঁর সান্ত¡না মিলেছিল। কিন্তু তাতে স্বাধীনতা বা মুক্তি আসেনি, কারণ: ‘আমার সব লেখাই যে ছিল তোমাকে নিয়ে; লেখালেখির মধ্যে আমি শুধু ওসব জিনিসেরই বিলাপ করে গেছি যেগুলো তোমার বুকে মাথা রেখে করতে পারিনি।’ কর্তৃত্বপরায়ণ বাবার মূর্তি আমরা কাফকার অন্যতম বিখ্যাত দুটো গল্পের মধ্যে পাই ‘রায়’ ও ‘রূপান্তর’। প্রথমটিতে ছেলে বিয়ে করে স্বাধীন হতে চাইলে তাঁর বুড়ো বাবা তাঁকে তাঁর বিয়ের পাত্রী নিয়ে ওভাবেই খোঁটা দেন, যেভাবে হারমান তাঁর ছেলেকে দিয়েছিলেন, যেমনটা উপরে বলা হয়েছে, সে ইউলি ওরিৎসেককে বিয়ে করতে চাইলে। গল্পের মধ্যে, পরে এই বাবা ছেলেকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। আর দ্বিতীয় গল্পটিতে ছেলে পোকা হয়ে গেলে বাবাই একসময় তার গায়ে একটা আপেল ছুড়ে মেরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

গত ১০০ বছর ধরে ব্যক্তি কাফকাকে বোঝার যতভাবে চেষ্টা হয়েছে তার সবচেয়ে বড় চেষ্টাটাই হয়েছে তাঁর বাবাকে লেখা এই চিঠির মাধ্যমে। এই চিঠি নিয়েই লেখা হয়েছে ১ হাজার ২০০-র উপরে গবেষণা গ্রন্থ।

শেষ বিচারে এটাই মনে হয় যে, এই চিঠি ছিল কাফকার নিজের উদ্ভাবিত, নিজেকে শান্ত করার, সুস্থ করার থেরাপি। কাফকা এখানে, বাবার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে স্বাধীন হওয়ার জন্য, তাঁর সঙ্গে তাঁর বাবার সম্পর্ককে নিজের দিক থেকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন। এই বোঝার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ঢুকেছে কাফকার অতিশয়োক্তি, আত্মপক্ষ সমর্থনের স্বার্থে বাবাকে ছোট করে দেখানো এবং তাঁর লেখকসুলভ সহজাত অনেক কল্পনা প্রবণতা। তবু এটাও বলা যাবে না এই চিঠির সব দাবি মিথ্যা। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বোহেমিয়ার ওসেক্ নামের এক গ্রামে ফেরিওয়ালার গাড়ি ঠেলে বেড়ানো হারমান কাফকার প্রাগে এসে মোটামুটি বড় এক ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার সংগ্রামের গল্প থেকেই বোঝা যায়, কতটা শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল এই লোকের। তাঁর হিসাবেই তিনি মাপতে চাইতেন বাকি সবাইকে, সবাইকে মনে করতেন তারা যেহেতু জীবনসংগ্রাম কী তা দেখেনি, তাই বড় আরামে আছে। কাফকার চিঠিতে বাবার প্রতি তাঁর অনুভূতিগুলো বিধৃত থাকলেও এটা তো নেই যে বাবারও কী পরিমাণ হতাশা ছিল তাঁর খামখেয়ালি, অদ্ভুত স্বভাবের একমাত্র পুত্রসন্তানটিকে নিয়ে (মনে রাখতে হবে এই বাবা-মায়ের অন্য দুই ছেলে মারা গিয়েছিল তাদের ১৫ মাস ও ৭ মাস বয়সে)। কাফকার বাবা-মা কাফকার আপন চাচাতো ভাই ব্রুনো কাফকার (ব্রুনো ছিলেন প্রাগের নামকরা আইনের অধ্যাপক এবং পরে খ্যাতিমান এক রাজনীতিবিদ) সাফল্যের মাপে তাঁদের ছেলের পার্থিব ব্যর্থতাগুলো, বিশেষ করে তাঁর বিয়েশাদি করে সংসার করতে না-পারা ও মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে অ্যাজবেস্টসের ব্যবসা শুরু করেও হাল ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টিকে মাপতেন।

বাবা-ছেলের এই সম্পর্কের ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণবাদী ব্যাখ্যা হয়েছে বিস্তর। কাফকা চিঠিতে ফ্রয়েডের বলা ইডিপাল সম্পর্কের কথাই যেন লিখেছেন (যার মূল কথা, ছেলেকে বড় হতে হলে, তাকে তার বাবার মতোই হতে হয়, যৌন দিক থেকে ওরকম পাকা হতে হয়; কিন্তু ছেলেকে একই সঙ্গে বাড়ির একমাত্র যৌন বিষয়ে অভিজ্ঞ পুরুষের জায়গাটি থেকে বাবাকে সরিয়েও দিতে হয়, বাবার অনুকরণ করার স্বার্থে বাবার বিরুদ্ধেই তাকে দাঁড়াতে হয়)। কাফকা লিখছেন: ‘তোমার সঙ্গে আমার যে অসুখী সম্পর্ক তার থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাকে এমন কোনো কাজ করতে হবে, যার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক সবচেয়ে দূরতম; বিয়ে করা সবচেয়ে বড় কাজ, ও থেকেই সবচেয়ে প্রশংসাযোগ্য স্বাধীনতা আসতে পারে, কিন্তু আমি দেখছি যে বিয়ের সঙ্গেই তোমার সম্পর্কটা সবচেয়ে কাছের।’ কাফকা এখানে তাঁর বাবাকে দোষ দিচ্ছেন, কেন ছেলে বিয়ে করছে না তা নিয়ে হইচই করার জন্য, কিন্তু কাফকার মতে, তাঁর বাবাই তাঁকে এমন আত্মগ্লানি ও পাপবোধে ভোগা, খোঁড়া এক মানুষ বানিয়ে রেখেছেন যে তাঁর পক্ষে বিয়ে করা অসম্ভব। সন্দেহ নেই, এ চিঠির মূল উদ্দেশ্য ছিল বাবার প্রভাবের বলয় থেকে তাঁর নিজের মন ও মানসকে বের করে আনা, মুক্ত হওয়া; কিন্তু এ চিঠিতে কাফকা নিজেকে তাঁর বাবার এতখানিই সৃষ্ট এক চরিত্র করে দেখিয়েছেন যে সেই বাবার থেকে তাঁর একটামাত্র চিঠি লিখে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা অসম্ভব ঠেকে। তাহলে কাফকা কি সেই সময়ের এক্সপ্রেশনস্টিক সাহিত্যের রীতি মোতাবেক পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব নিয়ে রোমান্টিকতায় ভুগতেন? তখনকার দিনে শিল্পসাহিত্যের অন্যতম বিষয়ই ছিল সাহসী, শিল্পীমনের পুত্রের সঙ্গে কর্তৃত্বপরায়ণ বুর্জোয়া পিতার দুর্বোধ্য সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলা। পিতারা ওখানে হতেন মিথ্যা বিশ্বাস ও মিথ্যা নৈতিকতার ধারক ও বাহক, আর তাঁদের সন্তানেরা আধুনিক, মুক্তমনা, প্রথাবিরোধী চরিত্র। এই দুজনের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে কম সাহিত্য হয়নি গত শতাব্দীর শুরুর দিকে।

হয়তো তা-ই হবে, হয়তো না। হয়তো ‘বাবার কর্তৃত্বের সামনে নির্যাতিত, অসহায় কাফকা’ একটি মিথ, কিংবা হয়তো তা কিছুটা সত্য, কিছুটা মিথ্যা। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত যে কাফকার বাবাকে লেখা চিঠি একটি দারুণ গল্প; কাফকার নিজের জীবন নিয়ে নিজেকে বলা একটি চমৎকার কাহিনি। তাতে আমাদের কোনো আপত্তিও থাকার কথা না: সেরা মনঃসমীক্ষণের কাজও তো তাই ; আমরা কী করে আমরা হয়েছি তার একটা সন্তোষজনক গল্প খাড়া করতে পারা।

আমাদের জন্য জরুরি এটুকুই যে, এই ‘চিঠি’ আমাদেরকে কাফকার অপরাধবোধ ও পাপবোধে আকীর্ণ সাহিত্যকর্মগুলোর খুব কাছে নিয়ে আসে এ কথা, বিশেষ করে তাঁর আমেরিকা উপন্যাস থেকে শুরু করে পরের সব লেখার জন্য সত্য (অর্থাৎ ১৯২২ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত)। এই চিঠিতে কাফকার টাকা চুরি করা এক ব্যাংকারের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করার মধ্যে আমরা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম বিচার উপন্যাসের (যেখানে ব্যাংকার জোসেফ কে. বিনা অপরাধে একদিন গ্রেপ্তার হয়ে যায়, কিন্তু তাকে কখনো আটক করা হয় না, সে জীবনভর ঘুরে বেড়ায় ; শেষ দৃশ্যে নিষ্ঠুরভাবে খুন হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার অপরাধ কী তা জানার জন্য) বীজ খুঁজে পাই।

কাফকার মা — ইয়ুলি কাফকা

এই বিশাল বাবাকে লেখা চিঠিতে কাফকার মা ইয়ুলি কাফকা কত ছোট যে একটা চরিত্র তা ভাবতে অবাক লাগে। বাবার সঙ্গে তুলনায় তাঁর মা খুব শান্ত ও লাজুক এক মহিলা ছিলেন। এ চিঠিতে তাঁর ভূমিকা স্বামীর সহকারী একজন হিসেবে, যিনি তাঁর সন্তানদের বাবার সঙ্গে এতই ঘনিষ্ঠ যে বাবার অত্যাচারের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ; কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে আমরা দেখি একজন অসহায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে, অসহায় কারণ তিনি পিষ্ট দুদিকেরই চাপে একদিকে তাঁর স্বামী, অন্যদিকে তাঁর সাহায্যের জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা চার সন্তান। কাফকা বাবাকে লিখেছেন: ‘আমরা তাঁকে (মাকে) সমানে হাতুড়ির বাড়ি মেরে যাচ্ছি, তোমার দিক থেকে তুমি, আমাদের দিক থেকে আমরা।’ ঐ দুটি গল্পেও ‘রায়’ ও ‘রূপান্তর’ যেখানে কাফকা-পরিবারের সবচেয়ে কাছাকাছি এক ছবি পাওয়া যায়, মা চরিত্রটি লক্ষণীয়: ‘রায়’ গল্পে মা মৃত; আর ‘রূপান্তর’ গল্পে তিনি তাঁর ‘দুর্ভাগা ছেলের’ প্রতি মমতায় ভরা, কিন্তু ছেলের বিপদে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ছাড়া তাঁর আর কোনো ভূমিকা নেই। মনঃসমীক্ষণবাদী চোখ দিয়ে দেখলে মনে হয়, কাফকার অরক্ষিত মানসিক অবস্থার কারণ শুধু তাঁর বাবার কর্তৃত্বপরায়ণতাই নয়, তাঁর প্রতি খুব কম বয়সেই তাঁর মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারটাও এর একটা কারণ বটে। কাফকার ডায়েরিতে ইয়ুলি কাফকাকে আমরা দেখি ছেলের অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপারগুলো নিয়ে ‘ঘ্যানঘ্যান’ করছেন, ছেলের বিরক্তি শুধুই বাড়াচ্ছেন আর তাঁকে বুঝতে পুরো ব্যর্থ হচ্ছেন। কাফকা ডায়েরিতে নালিশ জানাচ্ছেন যে তাঁর মা তাঁকে সাধারণ আর দশটা যুবকের মতোই ভাবেন, তাই ‘ঘ্যানঘ্যান’ করেন তাঁর ছেলে কেন ওসব ‘সাহিত্য’ ছেড়ে অন্য সবার মতো বিয়ে-থা করে সংসারী হচ্ছে না। কাফকার দীর্ঘদিনের প্রেমিকা ফেলিস বাউয়ারকে লেখা একটি চিঠির পুনশ্চঃ অংশে আমরা মা ও ছেলের এই পর হয়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে পারস্পরিক স্নেহ-ভালোবাসার এক মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাই:

আমি কাপড়চোপড় ছাড়ব এমন সময় মা কী যেন সামান্য একটা কাজে আমার ঘরে ঢুকলেন, তারপর তিনি চলে যাচ্ছেন এমন সময় আমাকে শুভ রাত্রি জানিয়ে একটা চুমু খেলেন, এরকম ঘটেনি অনেক বছর। ‘ঠিক আছে’, আমি বললাম। ‘আমার কখনো সাহস হয়নি’ আমার মা বললেন, ‘আমি ভাবতাম তুমি এসব পছন্দ করো না। কিন্তু তুমি যদি পছন্দ করে থাকো, তো আমিও করি।’

ব্যক্তিগত জীবন ও কাফকা সাহিত্যে যৌন অনুষঙ্গ

কাফকার যৌন জীবন ছিল বেশ সক্রিয়। ম্যাক্স ব্রডের ভাষায়, কাফকা যৌন কামনার হাতে ‘উৎপীড়িত’ হতেন। কাফকার অন্যতম প্রধান জীবনীকার রাইনার স্টাখের মতে, কাফকা জীবনভর ‘অবিরাম মেয়েদের পেছনে ছুটেছেন’, আর তাঁর মধ্যে সব সময় কাজ করত ‘বিছানায় ব্যর্থ হওয়ার ভয়।’ কাফকা অনেকবার পতিতা সংসর্গ করেছেন; আর পর্নোগ্রাফিতেও তাঁর আগ্রহ ছিল। তাঁর জীবনে প্রেম এসেছে মোট ছয় বার; একেকবার একেক রূপে।

কাফকার ডায়েরি ও চিঠিগুলো পড়লে এরকম মনে হয় যে, বিয়ে করাকে তিনি জীবনের মুখ্যতম ব্যাপার বলে ভাবতেন।

বিয়ে করা, পরিবার গড়ে তোলা, যতগুলো সন্তান ঘরে আসে তাদের গ্রহণ করা, এই অনিশ্চিত পৃথিবীতে তাদের পাশে দাঁড়ানো, এমনকি অল্পস্বল্প পথ দেখানো, আমার হিসেবে এই-ই হচ্ছে মানুষের পক্ষে অর্জনযোগ্য সবচেয়ে বড় সফলতা।

বাবাকে লেখা চিঠিতে কাফকার এই ঘোষণা তিনি নিজের জীবনে বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি কোনো দিন। তাঁর সঙ্গিনী নির্বাচনে সব সময়ই সমস্যা ছিল, সেই সঙ্গে ছিল বিয়ে করে সংসার শুরু করলে, ঘরে সন্তান এলে, সাহিত্যচর্চায় ব্যাঘাত ঘটবে– এই ভয়।

কাফকার প্রথম প্রেমিকা ফেলিস বাউয়ারের কথা বলা যাক। বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের বাসায় ১৯১৩ সালের ১৩ আগস্ট কাফকার সঙ্গে ফেলিসের দেখা হয়। ফেলিস বয়সে ছিলেন তাঁর চেয়ে চার বছরের ছোট এক বুদ্ধিদীপ্ত, অল্পবিস্তর পড়ালেখা করা, অনাকর্ষণীয় চেহারার, ভালো চাকরি করা বার্লিনের মেয়ে। কাফকা তাঁকে ভক্তি করতেন, কিন্তু তাঁর প্রতি কামনা-বাসনা বোধ করতেন না। ১৯১৫ সালে ফেলিসের সঙ্গে সময় কাটানোর পরে কাফকা ডায়েরিতে লেখেন: ‘চিঠির ভুবনে ছাড়া বাস্তবে আমি কখনো ফেলিসের সঙ্গে সম্পর্কের সেই মধুরতাটুকু অনুভব করিনি, যেটা মানুষ প্রেমিকার সঙ্গে করে; তাঁর প্রতি আমার শুধু অসীম ভক্তি।’ এই স্মার্ট ও আত্মবিশ্বাসী ফেলিসের সঙ্গে কাফকার যখন বিয়ের কথা শুরু হয়, তিনি বোধ হয় নিজের অসম্পূর্ণতাগুলো নিয়ে ভয় পেয়ে যান, সঙ্গে তো সাহিত্য ও বিয়ের মধ্যেকার বৈসাদৃশ্য ঘিরে দুশ্চিন্তা এবং নিজের জীবনে বাবার সংসারেরই পুনরাবৃত্তি ঘটানোর ভয় ছিলই। ফেলিস তাঁকে নিয়ে বাসার আসবাব কিনতে গেলে, কাফকার কাছে সেগুলো মনে হয় ‘কবরফলক’; আর ফেলিস যখন বলেন যে তাঁদের দুজনের বাসায় থাকবে তাঁর (ফেলিসের) পছন্দের ছোঁয়া, কাফকার কাছে খুব অসহ্য লাগে কথাটা। ফেলিসের সঙ্গে বাগ্দানের অনুষ্ঠানে কাফকার নিজেকে মনে হয় ‘কোনো আসামির মতো হাত-পা বাঁধা’। ফেলিসকে লেখা ৫০০ চিঠির মধ্যে (Letters to Felice নামে কাফকার বেস্টসেলার বইটি বাজারে সহজলভ্য) আমরা পাই কাফকার মানসিক ও আবেগগত চাহিদার এক রক্তাক্ত ছবি; ফেলিসের জীবনযাপনের প্রতিটি খুঁটিনাটি জানতে চাওয়ার মধ্যে আমরা দেখি হবু বধূর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কলাকৌশল আঁটা এক চতুর কাফকাকে, আর সবচেয়ে বেশি দেখি দুজনের মধ্যে অন্তরঙ্গতার এক প্রগাঢ় অভাব। ফেলিসের চিঠিগুলো যদিও পাওয়া যায়নি, তবু এটুকু নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়, তিনি কাফকা নামের ৬ ফুট লম্বা, সুদর্শন ও আকর্ষণীয় যুবকের খামখেয়ালি, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ও তাঁর প্রতি অবিশ্বস্ততার কারণে মানসিকভাবে যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন। ১৯১৪-র ১২ জুলাই ফেলিস নিজেই তাঁদের প্রথম বাগ্দান ভেঙে দেন; পরে অবশ্য তাঁরা আবার যোগাযোগ শুরু করেন; দ্বিতীয়বারের মতো বাগ্দান হয় ১৯১৭-র জুলাইতে, পরে সে-বছরেরই ডিসেম্বরে এটিও ভেঙে যায়।

ফেলিসের সঙ্গে সম্পর্ক চলাকালীন কাফকা গোপনে ফেলিসের প্রিয়তম বান্ধবী গ্রেটে ব্লখের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। গ্রেটে বার্লিনেরই এক ইহুদি পরিবারের মেয়ে। ম্যাক্স ব্রড দাবি করেন যে গ্রেটের গর্ভে কাফকার একটি পুত্রসন্তান হয়, যার কথা কাফকা কখনো জানতেন না। যদিও সবচেয়ে বিখ্যাত দুই কাফকা-জীবনীকার পিটার-আন্দ্রে অল্ট ও রাইনার স্টাখের মতে এ দাবি সত্য নয়; গ্রেটের সঙ্গে কাফকার ওরকম ঘনিষ্ঠতা কখনোই হয়ে ওঠেনি। গ্রেটে ও কাফকার মধ্যেকার গোপন সম্পর্কের কথা গ্রেটেই বান্ধবী ফেলিসকে জানিয়ে দেন। ফেলিস গ্রেটেকে লেখা কাফকার চিঠিগুলো পড়ে চরম প্রতারিত বোধ করেন।

১৯২০ সালে, অসুস্থ অবস্থায়ই, কাফকা প্রেমে পড়েন চেক সাংবাদিক ও লেখক, সুন্দরী মিলেনা য়েসেন্স্কার। মিলেনাকে লেখা তাঁর চিঠিগুলো Letters to Milena নামের আরেক বেস্টসেলিং বই। এই চিঠিগুলো ফেলিসকে লেখা চিঠিগুলো থেকে অনেক বেশি আন্তরিকতা ও উষ্ণতায় ভরা। এঁদের মূল বৈশিষ্ট্য নিরাপত্তাহীনতার বোধ, তাঁর ভীতি ও নিজের প্রতি ঘৃণার অনুভূতি। তিনি নিজেকে তুলনা করেন ‘নোংরা বিছানায় শোয়া, মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা এক লোক, যাঁকে দেখতে এসেছে মৃত্যুর ফেরেশতা’ হিসেবে। এই দফায় আমরা কাফকার প্রতি তাঁর প্রেমিকার অনুভূতির কথাগুলোও জানতে পারি। ম্যাক্স ব্রডকে লেখা মিলেনার অসংখ্য চিঠির মধ্যে দিয়ে জানা যায়, কাফকার ছোটখাটো বিষয়গুলো সামলানোর (যেমন পোস্ট অফিসে যাওয়া) অপারগতা দেখে মিলেনা বিস্মিত; আর অন্যান্য লোকদের স্মার্টনেস দেখে (যেমন ফেলিসের, সেই সঙ্গে মিলেনার মেয়েবাজ স্বামী আরনস্ট্ পোলাকের) কাফকা কীভাবে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন তা বুঝতে পেরে তিনি কাফকার প্রতি সহানুভূতিতে আর্দ্র। মিলেনা লেখেন:

সে (কাফকা) ভাবে যে সে অপরাধী ও দুর্বল, তার পরও এই পৃথিবীতে তাঁর মতো বিশাল শক্তির আর কেউ নেই; আর কারো নেই উৎকর্ষের পূর্ণমাত্রা অর্জনের, শুদ্ধতা ও সত্য অর্জনের এরকম পরম ও তর্কাতীত প্রয়োজন।

মিলেনাকে কাফকা লেখেন: ‘আমি নোংরা, মিলেনা, আমার ভেতরকার নোংরার কোনো শেষ নেই, সে কারণেই আমি শুদ্ধতা নিয়ে এত জোরে চিৎকার করি।’ (২০ আগস্ট, ১৯২০)।

১৯২০-এর আগস্টে মিলেনা ব্রডকে আরো একটি চিঠি লেখেন, যেটি কাফকার অপাপবিদ্ধ, সাধু-সন্তের ইমেজ (বা মিথ) আরো গাঢ় করে তোলে।

তাঁর [কাফকার] কাছে জীবন অন্যদের কাছে যেমন সেরকম মোটেই নয়…সে একদম সাধারণ জিনিসগুলোও বুঝতে পারে না…এই পুরো পৃথিবীই তাঁর কাছে একটা ধাঁধা…আমি যখন তাকে আমার স্বামীর কথা বললাম, আমার স্বামী যার আমার প্রতি অবিশ্বস্ততার ঘটনা বছরে শতবার ঘটছে, তাঁর মুখটা [আমার সেই স্বামীর প্রতি] সেরকম শ্রদ্ধায়ই উজ্জ্বল হয়ে উঠল যেমনটা হয়েছিল সে আমাকে তার অফিসের বস্ নিয়ে বলার সময়… তাঁর বস্ দ্রুত টাইপ করতে পারেন, আর সেকারণেই [কাফকার হিসেবে] কী চমৎকার একজন মানুষ তিনি… সে [কাফকা] মিথ্যা বলতে সম্পূর্ণ অসমর্থ।

মিলেনার সঙ্গে সম্পর্ক চলার সময়েই কাফকা প্রাগের এক গরিব অশিক্ষিত হোটেল পরিচারিকা ইউলি ওরিৎসেকের প্রেমে পড়েন। ১৯১৯ সালের এক ছুটিতে তাঁদের পরিচয়। ইউলির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে বেশি কিছু জানা যায়নি। এ দুজনের মধ্যে বিয়ের জন্য বাগ্দান হয়, দুজনে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন, বিয়ের তারিখও ঠিক করেন। ইউলির সামাজিক অবস্থান ও জায়োনিস্ট আন্দোলনের (ইহুদিদের স্বাধীন আবাসভূমি ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন) প্রতি সমর্থনের কারণে কাফকার বাবা খেপে যান। এ ঘটনা থেকেই জন্ম হয় কাফকার বিখ্যাত বাবাকে লেখা চিঠির। একসময় ইউলিকে ছেড়ে মিলেনার দিকেই কাফকা বেশি ঝুঁকে পড়েন, ইউলির সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করেন; ইউলি বলেন: ‘তুমি কি সত্যিই আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?’

ইউলির চেয়ে অনেক বেশি গাঢ় ও সম্ভাবনাময় ছিল কাফকার শেষ প্রেম। প্রেমিকার নাম ডোরা ডিয়ামান্ট। কাফকার অন্য দুই মূল প্রেমিকা ফেলিস ও মিলেনার পাশাপাশি ডোরাও এখন অনেক বিখ্যাত এক নাম। ১৯২৩-এর আগস্টে মৃত্যুর মাস দশেক আগে ডোরার সঙ্গে কাফকার পরিচয় হয় এক অবকাশযাপন কেন্দ্রে। ডোরার বয়স তখন ২৫, কাফকার চেয়ে ১৫ বছরের ছোট; বার্লিনে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একা বাস করা এক মেয়ে সে। ডোরা কাফকার কাছে জায়োনিজম ও ইহুদি সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অগাধ আগ্রহ প্রকাশ করেন; পরে দুজনেই পরিকল্পনা করেন যে তাঁরা প্যালেস্টাইনে গিয়ে সংসার পাতবেন, সেখানে তাঁরা একটা রেস্টুরেন্ট খুলবেন, ডোরা হবেন সেটার পাচক, কাফকা ওয়েটার। তা আর হয়ে ওঠেনি; কাফকা মারা যান এর ক’মাস পরেই, কিন্তু ডোরা কাফকাকে জীবনের শেষ ক’মাস — প্রাগ ও পরিবারের শৃঙ্খলমুক্ত অবস্থায় — বার্লিনে সম্ভবত কাফকার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু উপহার দেন। ডোরা এর পরে বেশ নামকরা এক অভিনেত্রী হন, কম্যুনিজমে সক্রিয় হয়ে ওঠেন (মিলেনার মতোই), প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। লন্ডনে ১৯৫২ সালে ডোরার মৃত্যু হয়। ১৯২৪ সালে কাফকার মৃত্যুর সময় ডোরা তাঁর পাশে ছিলেন।

কাফকার লেখার কোনো কোনো অংশ এমন ধারণারও জন্ম দিয়েছে যে তিনি সম্ভবত সমকামী ছিলেন। তবে গবেষকরা এখন একমত যে, তা অসম্ভব ও অস্বাভাবিক এক অনুমান। কাফকার সময়টা ছিল ইউরোপে পুরুষবাদী সংস্কৃতির তুমুল জোয়ারের সময়; সব ছেলে একসঙ্গে মিলে ব্যায়াম, সাইক্লিং, সাঁতার, দীর্ঘ পথ হাঁটা, পুরো জার্মানি জুড়ে হাইকিং করতে বেরোনো — এসব নতুন ফ্যাশন তখন তুঙ্গে। কাফকার তিন-চারটে লেখায় তথাকথিত সমকামী যৌনতার ইঙ্গিত খুব বেশি হলে এসবেরই উদ্যাপন — এমনটাই এখন এ বিষয় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত উপসংহার।

এর বিপরীতে, নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক কাফকার হাতে সব সময়ই অদ্ভুত ও কিম্ভূতকিমাকার চেহারা নিয়েছে। কাফকার লেখায় এই সম্পর্কগুলো সব সময় আতঙ্ক-জাগানো ও নোংরা। আমেরিকা উপন্যাসে ক্লারা যখন কার্লের দিকে যৌনমিলনের জন্য এগিয়ে আসে, সে কার্লকে পেড়ে ফেলে কুংফু স্টাইলে। বিচার উপন্যাসের লেনি তো মনে হয় কোনো জন্তু, তার আঙুলগুলো বাদুড়ের মতো, জোসেফ কে.-কে ভুলিয়েভালিয়ে সে মেঝেতে টেনে আনে, বলে: ‘তুমি এখন আমার।’ আরো খারাপ দুর্গ উপন্যাসের সেই দৃশ্য যখন কে. ও ফ্রিডা সরাইখানার মেঝেতে জমে থাকা নোংরা ময়লা কাদাপানির মধ্যে মিলিত হয় (যদিও এ সময়ে কাফকার বর্ণনা কিছুটা লিরিক্যাল, অর্থাৎ তিনি সম্ভবত বলতে চাইছিলেন যে, সেক্স একটা নোংরা বিষয় হলেও এর মধ্য দিয়ে ভালোবাসা ও আত্মহারা হওয়ারও প্রকাশ ঘটে)। কাফকা মিলেনাকে লিখেছিলেন, সেক্সের জন্য তাঁর তাড়নার কারণে তাঁর নিজেকে পৃথিবীর পথে ঘুরে বেড়ানো ইহুদি (Wandering Jew) বলে মনে হয়: ‘অর্থহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি অর্থহীন, নোংরা এক পৃথিবীর পথে।’ কিন্তু একই সঙ্গে সেক্সের মধ্যে আছে ‘স্বর্গ থেকে পতনের আগে স্বর্গের যে হাওয়ায় আমরা শ্বাস নিতাম সে রকম হাওয়ার কিছু একটা।’

আরেকটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, যৌনতার বেলায় কাফকার ওপর সব সময় ভর করে সমাজের একেবারে নিচু স্তরের, গরিব, কাজের মেয়েরা। আমেরিকা উপন্যাসের প্রথম অধ্যায় ‘দি স্টোকার’-এ আমরা দেখি কাজের মেয়ের গর্ভে বাচ্চা জন্ম দিয়ে আমেরিকায় নির্বাসিত হয়েছে কিশোর কার্ল রসমান; বিচার উপন্যাসে জোসেফ কে.-র নারীরা হয় সামান্য টাইপিস্ট, ধোপানি, না হয় উকিলের কাজের মেয়ে; দুর্গ উপন্যাসের ফ্রিডা পানশালায় কাজ করা নগণ্য এক মেয়ে, আর পেপি (প্রথম দিকে) আরো নিচু শ্রেণীর এক কাজের মেয়ে; ‘রূপান্তর’ গল্পে কমবয়সী চুলে বেণি করা কাজের মেয়েটা পোকা-গ্রেগরকে কত ভয় পায় (কিন্তু বয়স্কা ঝি-টা এই পোকাকে একটুও ভয় পায় না); ‘এক গ্রাম্য ডাক্তার’ গল্পে ঘোড়ার আস্তাবল থেকে উদয় হওয়া দানবীয় সহিস যৌনবাসনা পূরণের জন্য ডাক্তারের কাজের মেয়ে রোজের ওপর এমনভাবে চড়াও হয়, যেন মনে হয়, সে নরমাংসভোজী, রোজকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে; আর ‘অ্যাকাডেমির জন্য একটি প্রতিবেদন’ গল্পের নায়ক পুরুষ শিম্পাঞ্জি রট্পিটারের জন্য সঙ্গী হিসেবে মেলে এক আধা-বশমানা মেয়ে শিম্পাঞ্জি, ‘শিম্পাঞ্জিদের মতো করেই তাঁর সঙ্গসুখ ভোগ করে রট্পিটার’।

কাফকা-সাহিত্যের যৌন বিষয়গুলো যাঁরা ‘অপার্থিব’ বলেন (এবং কাফকা মিথে নতুন পালক যোগ করেন), তারা কোন যুক্তিতে তা বলেন জানি না; আমার বরং Excavating Kafka বইয়ের জেমস হয়েসের মতো করেই মনে হয় যে, কাফকা সাহিত্যে (এবং কাফকার ব্যক্তিজীবনেও) যৌনতা খুব উদ্ভট, প্রথাবিরুদ্ধ ও নোংরা-কাদায় ভরা পার্থিব এক সত্য। ‘রূপান্তর’ গল্পের মানুষ-পোকা গ্রেগর যেভাবে তার বোনের গলায় চুমু খেতে চায়, কিংবা ‘এক গ্রাম্য ডাক্তার’ গল্পে রোগীর ঊরুতে যে রকম গোলাপ-রঙের ক্ষত আমরা দেখি, তার নানা রূপক অর্থ থাকতে পারে, কিন্তু তা সাধু-সন্ন্যাসীর চোখে দেখা কোনো ‘অপার্থিব’, বৈরাগ্যময় যৌনতা নয়।

ব্যক্তিত্ব

কাফকা ভয়ে থাকতেন যে অন্য মানুষের কাছে তিনি বোধ হয় বিরক্তিকর এক চরিত্র– শারীরিক ও মানসিক, দুই দিক দিয়েই। তবে তাঁর সঙ্গে যারা মিশেছেন তাঁদের সবার কাছেই তিনি ছিলেন চুপচাপ ও ঠান্ডা মাথার, যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত ও শুষ্ক রসবোধসম্পন্ন এক ব্যক্তিত্ব; কিশোরসুলভ হ্যান্ডসাম, কিন্তু পোশাকে-আশাকে অনাড়ম্বর এক মানুষ। ব্রডের হিসাবে কাফকা তাঁর দেখা অন্যতম মজার এক মানুষ, যিনি বন্ধুদের সঙ্গে সব সময় হাসি-তামাশা করতেন, তাঁদের কঠিন সময়ে তাঁদের ভালো উপদেশ দিতেন। ব্রড আরো বলছেন, কাফকা ছিলেন খুব আবেগে পূর্ণ একজন আবৃত্তিকার, বক্তৃতার সময়ে তিনি কথা সাজাতেন গানের মতো গুছিয়ে। ব্রডের হিসাবে, কাফকার ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে বড় দুটো দিক ছিল: তাঁর ‘পরম সত্যবাদিতা’ (Absolute Wahrhaftigkeit) এবং ‘সূক্ষ্ম বিবেকবোধ’ (präzise Gewissenhaftigkeit)| । তিনি বিষয়ের এমন খুঁটিনাটি গভীরে চলে যেতেন, এতখানি ভালোবাসা নিয়ে ও নিখুঁতভাবে তা যেতেন যে, আগে চোখে না পড়া অনেক বিষয়ও তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসত, ‘সেগুলো হয়তো অদ্ভুত শোনাত, কিন্তু সেগুলো সত্য ছাড়া আর কিছুই হতো না (nichts als wahr)|।’

কাফকা নিয়মিত ব্যায়াম ও খেলাধুলা ভালোবাসতেন, ভালো সাইকেল চালাতেন, সাঁতার পছন্দ করতেন, নৌকার দাঁড় টানায় দক্ষ ছিলেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাফকাই পরিকল্পনা করতেন বন্ধুরা মিলে কোথায় দীর্ঘ পদযাত্রাতে যাবেন। তাঁর অন্যান্য আগ্রহের মধ্যে ছিল বিকল্প বা প্রাকৃতিক চিকিৎসাপদ্ধতি, অ্যারোপ্লেন ও সিনেমা। লেখালেখি তাঁর কাছে ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তিনি বলতেন যে লেখালেখি ‘প্রার্থনার মতো’ একটা কাজ। কোলাহল তিনি খুব অপছন্দ করতেন, এর পরিচয় পাওয়া যায় এ বইতে অন্তর্ভুক্ত তাঁর প্রথম দিককার ছোট রচনা ‘বিরাট শোরগোল’-এ। কাফকা সিগারেট খেতেন না; মদ, কফি, চা, চকলেটও না। তিনি জীবনের দীর্ঘ অনেকগুলো বছর শুধু শাকাহারীই ছিলেন না, কীভাবে খেতে হবে তার নিয়মও ছিল তাঁর জন্য ধরাবাঁধা। খাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ‘fletcherize’ করতেন আমেরিকার হোরেস ফ্লেচার উদ্ভাবিত খাবার চিবানোর তখনকার দিনের এক ফ্যাশন, যেখানে খাবার মুখে নিয়ে এত বেশি সময় ধরেই চিবানো হতো যে তা তরল স্যুপের মতো হয়ে গলা দিয়ে নেমে যেত। কাফকা বিশ্বাস করতেন, এতে হজমের ওপর সবচেয়ে কম চাপ পড়ে আর খাবার থেকে সবচেয়ে বেশি পুষ্টি পাওয়া যায়।

পেরেজ আলভারেজের দাবি, কাফকার ছিল একধরনের split personality -ভগ্নমনস্ক (schizophrenic) বিভাজিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর ‘রূপান্তর’ গল্পসহ অন্য আরো কিছু লেখার বিস্ময়কর অদ্ভুত ব্যাপারগুলো তাঁর ওই বিভাজিত ব্যক্তিতার কারণেই লেখা সম্ভব হয়েছে — এমন দাবি এই ‘ক্লিনিক্যাল’ ব্যাখ্যাদাতাদের। ১৯১৩-এর ২১ জুনের ডায়েরিতে কাফকা লিখছেন:

আমার মাথার মধ্যে কী ভয়ংকর এক পৃথিবী। মাথা ছিঁড়ে-ফেঁড়ে না ফেলে আমি কী করে নিজেকে মুক্ত করব, ওই পৃথিবীকে [মাথা থেকে] মুক্ত করে আনব! আর মাথার ভেতরে ওগুলোকে ধরে রাখার বা কবর দেওয়ার চেয়ে হাজার গুণে ভালো মাথা ছিঁড়ে-কেটে টুকরো করে ফেলা। আমি যে সে কাজের জন্যই এখানে [এ পৃথিবীতে] আছি, তা আমার কাছে একদম পরিষ্কার।

যৌন বিষয়ে কাফকার ঘৃণা, অপরাধবোধ এবং একই সঙ্গে তার অনেকবার পতিতালয়ে যাওয়া, পর্নোগ্রাফির প্রতি আগ্রহ– এসব নিয়েও কম গবেষণা হয়নি। পাশাপাশি অনেকে এমন দাবিও করেছেন যে কাফকার খাওয়া-সংক্রান্ত অসুখ ছিল। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মানফ্রেড ফিখ্টার তো ‘প্রমাণ হাজির করেছেন যে…কাফকা anorexia nervosa-র (খাদ্যভীতির মানসিক অসুখ, যার পরিণতিতে বিপজ্জনকভাবে মানুষ শুকিয়ে যায়) ব্যতিক্রমী এক লক্ষণে’ ভুগতেন। তাঁর আরো দাবি, কাফকা শুধু ‘নিঃসঙ্গতা ও বিষন্নতার রোগেই ভুগতেন না’, মাঝেমধ্যে ‘আত্মহত্যাপ্রবণও’ ছিলেন। অনেক গবেষকেরই দাবি, কাফকা ছিলেন ‘হাইপোকন্ড্রিয়াক’ (কোনো আপাত-কারণ ছাড়াই যে মানুষ তার অসুখ আছে বলে কল্পনা করে ও অহেতুক উৎকণ্ঠায় ভোগে)। অন্তত একবার যে কাফকা আত্মহত্যা করার সংকল্প করেছিলেন, ১৯১২ সালে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কাফকার এই বিষন্ন, মলিন চেহারাটি প্রতিনিধিত্ব করছে বিশ শতকের (এবং একুশ শতকেরও) আধুনিক পৃথিবীর আধুনিক মানুষের, যেমনটি উনিশ শতকের জন্য করেছিলেন ম্যানিক ডিপ্রেশন ও বাইপোলার ডিজঅর্ডারে ভোগা ব্রিটিশ কবি, অসুখী লর্ড বায়রন। ‘কাফকায়েস্ক’ বিশেষণটি ‘বায়রনিক’ বিশেষণের মতোই অকাট্য ও জোরালো। তবে বায়রনের অভিজাত, অনিষ্টকর ইমেজের (যা সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারগুলোকে তাচ্ছিল্য করছে) চেয়ে কাফকার ইমেজটি অনেক বেশি সর্বজনীন। কাফকার অতি মামুলি জীবনীর দিকে তাকালেই মনে হয় যে তিনি আমাদেরই একজন: অতি সাধারণ এক জীবনের বৃত্তে বন্দী থেকে তিনি অনুভব করে গেছেন সাধারণ সব ভয়, দুশ্চিন্তা, বিষন্নতা ও হতাশা; আমরা তাঁকে সহজেই বুঝতে পারি, কারণ তাঁর অনুভবগুলো আমাদের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে যদি খাপে খাপে না-ও মেলে, তবু আমাদের ভয়-শঙ্কা ও দুঃস্বপ্নগুলোর সঙ্গে মেলে তো বটেই।

কাফকা নিয়ে যা কিছু মিথ (বায়রনকে নিয়ে মিথের মতই), তা কাফকার নিজেরই গড়ে তোলা। ওই মিথগুলোর পেছনে কাফকার বাস্তব অভিজ্ঞতার ভূমিকা না থাকলেও, তিনি তাঁর চিন্তার মধ্যে তাঁর রোজকার অভিজ্ঞতার যেভাবে রূপ দিয়েছিলেন, তারপর লেখনীতে সেগুলো যেভাবে প্রকাশ করেছিলেন (প্রথমত তাঁর নিজের জন্য, আর পরে সবার পড়ার জন্য), তাতেই দাঁড়িয়ে গেছে মিথগুলো। সে কারণেই কাফকার গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলো থেকে তাদের লেখককে আমরা আলাদা করতে পারি না। তাঁর উপন্যাসের নায়কদের নামগুলোও (লেখার তারিখের ক্রম মেনেই) ধাপে ধাপে ছোট হয়ে আসে: আমেরিকা উপন্যাসের কার্ল রসমান থেকে বিচার উপন্যাসের জোসেফ কে. থেকে দুর্গ উপন্যাসের কে.। বাস্তবেও তা-ই হয়েছিল একবার: ১৯২২-এর জানুয়ারিতে কাফকা একটা হোটেলে চেক-ইন করছেন, দেখলেন যে হোটেল কর্তৃপক্ষ তাঁর বুকিং ভুলভাবে পড়ে, তাঁর নামের জায়গায় লিখে রেখেছে ‘জোসেফ কে.’ (Joseph K[afka])| । কাফকা ডায়েরিতে লিখলেন: ‘আমার কি ওদেরকে ঠিক করে দেয়া উচিত, নাকি ওরাই আমাকে ঠিক করুক’। এখানে বাক্যের দ্বিতীয় অংশে কাফকা তাঁর সহজাত কূটাভাস (paradox) করছেন: অর্থাৎ আমিই হয়তো ভুল, আমার নাম আসলেই হয়তো জোসেফ কে., অতএব হোটেল কর্তৃপক্ষই আমাকে, আমার নামটাকে, ঠিক করুক, অর্থাৎ জোসেফ কে.ই রেখে দিক।

যেহেতু সাংস্কৃতিক আইকন ‘ফ্রানৎস কাফকা’ শেষ বিচারে তাঁর নিজেরই সৃষ্টি, সেহেতু এর বাইরে গিয়ে সত্যিকারের কাফকার ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ অনেক কঠিন এক কাজ। গল্প-উপন্যাসের আর ফেলিস ও মিলেনাকে লেখা অসংখ্য চিঠির সেই যন্ত্রণাকাতর কাফকা তাঁর বাস্তব জীবনের দক্ষ অফিস কর্মকর্তা, স্পোর্টসম্যান ও প্রাগের মোটামুটি খ্যাতিমান লেখকে পরিণত হওয়া কাফকার মতোই সত্য। বিষয়টি আসলে কাফকার প্রতিমাসুলভ ইমেজকে ঠিক করা বা না করার নয় (অর্থাৎ তাঁর বাস্তব ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণের নয়), বরং আসল অর্থপূর্ণ কাজ হচ্ছে তাঁর লেখার মধ্যে ফেরত গিয়ে, ওগুলোর মধ্যেই দেখা যে, কীভাবে তিনি তাঁর ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতাগুলো ভেঙে ওই ইমেজ দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। তবে সচেতন পাঠককে সব সময় মাথায় রাখতে হবে, এভাবে কাফকার জীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতাগুলোর সমান্তরালে তাঁর সাহিত্যকর্ম পড়ে যাওয়ার বিপদও আছে। মনে রাখতে হবে, তাঁর সাহিত্য তাঁর নিজের জীবন, সময় ও সমাজকে অনেক-অনেক বেশি গুণে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিল বলেই কাফকা এখনো পৃথিবীতে বেস্টসেলার, এখনো এই ১০০ বছর পরেও, মানুষ তাঁর লেখা পড়ে আর এখনো প্রতি ১০ দিনে তাঁর ওপর একটি করে নতুন বই বের হয় ।

কাফকা ও রাজনীতি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শুরু হয়েছে। ১৯১৪ সালের ২ আগস্টে কাফকার সেই কিংবদন্তিতুল্য ডায়েরি এন্ট্রি: ‘জার্মানি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিকেলে সাঁতার।’ এত বড় বৈশ্বিক ঘটনায়, যেখানে তাঁর নিজের দেশও যুদ্ধের অংশ, কাফকার কী নিরাসক্ত, উদাসীন, নিস্পৃহ উক্তি। একদিকে বিশ্বযুদ্ধ, অন্যদিকে সাঁতার -- কিসের সঙ্গে কী? পড়তে গিয়ে মনে হয় হোরহে লুইস বোরহেসের সম্ভবত শ্রেষ্ঠতম গল্প ‘ট্লন, উকবার, অরবিস, টারটিয়াস’-এর শেষ অংশটুকুর কথা: ট্লন গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে এবং পৃথিবীর মাটিতে ট্লনের বিভিন্ন বস্তুসামগ্রী উড়ে এসে পড়তে থাকার কারণে পৃথিবীর সর্বব্যাপী ধ্বংস নেমে আসছে; এমনকি পৃথিবীর স্কুলগুলোতে মানুষের ইতিহাসের জায়গায় ট্লনের ইতিহাস পড়ানো শুরু হয়েছে; ওষুধশাস্ত্র ও প্রত্নতত্ত্ব পড়ানোর বিষয়বস্তু বদলে গেছে, সামনে বদলে যাবে জীববিজ্ঞান ও অঙ্কশাস্ত্র। এমন এক চরম ও চূড়ান্ত বিপৎসংকুল মুহূর্তে বোরহেস গল্পটি শেষ করছেন এভাবে:

এরপর পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে ইংরেজি, ফরাসি ও স্প্যানিশ ভাষা। পৃথিবী হয়ে যাবে ট্লন। তবে আমার এসবে কোনো মনোযোগ নেই; আমি আদ্রোগের হোটেলে বসে, শান্ত-স্থির দিনগুলোয়, ব্রাউনের Urn Burial বইটির…অনুবাদের (যা আমার প্রকাশ করার ইচ্ছা নেই) কাজ সংশোধন করে যেতে লাগলাম।

কাফকার মতোই আরেক মহান লেখক বোরহেসেরও রাজনীতি বিষয়ে কী নিরাসক্ত ভঙ্গি! পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আর উনি কোথাকার সতেরো শতকের এক লাশের আচার-সংস্কারের ওপরে লেখা বই অনুবাদ করে যাচ্ছেন, তাও কিনা যে অনুবাদ তাঁর প্রকাশ করার ইচ্ছা নেই। চারপাশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে, আর কাফকা বিকেলে সাঁতার নিয়ে ব্যস্ত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে কাফকা ক্লাব ম্লাদিচ্ নামের চেক এক নৈরাজ্যবাদী, সামরিকতন্ত্র-বিরোধী সংগঠনের বেশ কিছু মিটিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন। হুগো বার্গম্যান, যিনি কাফকার সঙ্গে একই স্কুলে গেছেন, ১৯০১ সালে কাফকার থেকে আলাদা হয়ে যান। তিনি লিখেছেন: ‘কাফকার সমাজতন্ত্র আর আমার জায়োনিজম — দুটোই খুব কড়া ধাঁচের।…জায়োনিজম ও সোশ্যালিজমের মিশেল করে কোনোকিছু এখনো উদ্ভাবিত হয়নি।’ চেক নৈরাজ্যবাদীদের (anarchist) বিষয়ে কাফকা পরে ডায়েরিতে লিখেছেন: ‘এরা সবাই মানুষের সুখ আদায় করার সংগ্রাম করছে, এজন্য এরা কোনো ধন্যবাদও পাবে না। আমি এদের বুঝি। কিন্তু…এদের পাশে দাঁড়িয়ে আমার পক্ষে আর মিছিল করে যাওয়া সম্ভব নয়।’

চেকোস্লোভাকিয়ায় কম্যুনিস্ট শাসনের সময় (১৯৪৮ থেকে ১৯৮৯) কাফকার সাহিত্যকর্ম পুরো ইস্টার্ন ব্লক বা মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের কম্যুনিস্ট ব্লকের দেশগুলোতে নিষিদ্ধ করা হবে কি হবে না, তা নিয়ে বিরাট বিতর্ক ছিল। যখন শাসকেরা ভেবেছেন যে কাফকা তাঁর সাহিত্যে পতনশীল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লিখেছেন, তখন কাফকা পড়া গেছে। যখন তারা এর উল্টোটা ভেবেছেন, কাফকা তখন নিষিদ্ধ হয়েছে। আরনস্ট্ পয়েলের বিখ্যাত কাফকা জীবনীগ্রন্থ A Nightmare of Reason (১৯৮৪) বইটির একেবারে শেষে পয়েল লিখছেন: ‘মৃত্যুতেও কাফকা তাঁর বাবা-মায়ের কাছ থেকে পালাতে পারেননি। তাঁরা তার সঙ্গে আছেন একই কবরে, কবরফলকও একটিই। এই বিড়ম্বনা অবশ্য অবাক করে না, কারণ আমরা দেখি যে তাঁর নিজের শহরেই কাফকার কবরকে কীভাবে সম্মান করা হয়েছে, ওদিকে তাঁর লেখা কীভাবে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে।’

কম্যুনিস্ট চেকোস্লোভাকিয়ার জন্য কাফকা-সাহিত্যের আরেক বড় উপাদান ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ’ (alienation) তাদের বড় ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিল। কম্যুনিস্টরা ভাবত, কাফকা তাঁর লেখায় যে অ্যালিয়েনেশনকে চিত্রিত করে গেছেন তা কম্যুনিস্ট সমাজের জন্য প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে; কারণ কম্যুনিস্ট সমাজে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতাবোধ বা নিরাসক্তির কোনো জায়গাই নেই, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে। কাফকার আশিতম জন্মদিনে, ১৯৬৩ সালে, তাঁরা মনস্থির করলেন, অতএব, কাফকার লেখার আমলাতান্ত্রিক চিত্রণ নিয়ে কথা বলতে হবে। কাফকার মূল লেখাগুলোর রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বিস্তর হয়েছে, কিন্তু তিনি আদতে কোনো রাজনৈতিক লেখক কি না তা নিঃসন্দেহে একটি বিতর্কিত বিষয়।

ইহুদি ধর্মের সঙ্গে কাফকার সম্পর্ক তা ইদ্দিশ নাটক দেখে তাঁর মোহগ্রস্ত হওয়ার মধ্যে দিয়েই প্রকাশ হোক কিংবা মার্টিন বুবারের ‘সাংস্কৃতিক জায়োনিজম’ আন্দোলনে বিশ্বাসের মধ্য দিয়েই হোক কিংবা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ম্যাক্স ব্রড ও হুগো বার্গম্যানের সরাসরি জায়োনিস্ট আন্দোলনে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়েই হোক ইদানীংকালের কাফকা-গবেষণার অন্যতম বড় একটি বিষয়। কাফকার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাই চালাতেন প্রাগের জায়োনিস্ট সংবাদপত্র Selbstwehr (Self-Defence বা আত্মরক্ষা)। এঁদের সঙ্গে কাফকা জায়োনিস্ট মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন অনেকবার; ১৯১৩ সালে ভিয়েনায় এগারোতম জায়োনিস্ট কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন, হিব্রু পড়েছেন, এমনকি ডোরাকে নিয়ে প্যালেস্টাইনে গিয়ে বাস করার স্বপ্নও দেখেছেন। কাফকার অনেক লেখায়, যেমন গল্পসমগ্র-এর এই প্রথম খ-ে প্রকাশিত ‘শিয়াল ও আরব’, ‘অ্যাকাডেমির জন্য একটি প্রতিবেদন’ ও ‘গায়িকা জোসেফিন অথবা ইঁদুর-জাতি’ গল্পে এবং দ্বিতীয় খ-ের ‘একটি কুকুরের তদন্তমালা’ ও ‘চীনের মহাপ্রাচীর’ গল্পে তখনকার জায়োনিস্ট মহলে চলমান বিতর্কগুলো আমরা দেখতে পাই, আর ওগুলো মূলত (প্রাথমিক অর্থে) জায়োনিস্ট পাঠকদের জন্যই লেখা হয়েছিল মার্টিন বুবারের সাময়িকী Der Jude (The Jew বা ইহুদি)-এর কাফকা একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন এবং ১৯১৭ ও ১৯১৮ সালে এই পত্রিকায় তিনি বেশ কটি গল্প প্রকাশ করেন।

কাফকার ‘যন্ত্রণা’, তাঁর লেখায় নিজেকে পীড়িত করার, কষ্ট দেওয়ার শ্লেষাত্মক বর্ণনা, তাঁর ‘বিভাজিত’ ব্যক্তিত্ব, এই সবকিছু তখনকার দিনের মধ্য ইউরোপের ইহুদিদের ‘আত্মসমালোচনা’ ও ‘আত্ম-ঘৃণার’ যে সংস্কৃতি চালু ছিল, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। ১৯১০ সালের Selbstwehr পত্রিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, কাফকার অঞ্চলের (বোহেমিয়া রাজ্যের প্রাগ ছিল এর রাজধানী) ইহুদিদের প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে: ‘আপনি যদি শোনেন যে তারা তাদের সঙ্গী ইহুদিদের নিয়ে কী বলছে, আপনার মনে হবে আপনি পৃথিবীর এক নম্বর ইহুদিবিদ্বেষী (anti-semitic) কারো সঙ্গে আছেন।’ কাফকার মধ্যেও যে একই প্রবণতা ছিল, তা তাঁর লেখা ও ডায়েরির পাতায় স্পষ্ট। তখনকার পশ্চিম ইউরোপীয় ইহুদিরা সবাই ‘দলগত সংশয়’-এ ভুগতেন চেক জাতীয়তাবাদী সংখ্যাগুরুরা ইহুদিদের মনে করত তারা ধর্মাচার মেনে গোপনে মানুষ খুন করে; এই সংখ্যাগুরুরা মাঝেমধ্যে ইহুদিদের মেরেও বসত (কাফকার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু তার ছোটবেলায় ইহুদিবিদ্বেষী এক আক্রমণে চোখের দৃষ্টি হারান); ইহুদিদের ব্যঙ্গ করে বলা হতো ‘ছারপোকা’, ‘কুকুর’, ‘শিম্পাঞ্জি’, ও ‘ইঁদুর’ (লক্ষণীয় যে এই চারটি প্রাণী নিয়েই কাফকা তাঁর বিখ্যাত চারটি গল্প লিখেছেন, যদি আমরা ‘রূপান্তর’ গল্পের অনিশ্চিত প্রজাতির পোকাটিকে ছারপোকা হিসেবে ধরি)। সংখ্যাগুরুদের হাতে এসব লাঞ্ছনার জবাব দেওয়ার জন্য ইহুদিদের কোনো শক্ত ধর্মীয় প্ল্যাটফর্ম ছিল না। প্রাগের ইহুদিদের তখন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ কিংবা আত্মহত্যা করা ছিল অনেক নৈমিত্তিক ঘটনা। কাফকা ডায়েরিতে লিখেছেন ‘আমার ক্লাসে সম্ভবত মাত্র দুজন সাহসী ইহুদি ছেলে ছিল, এরা দুজনই স্কুলে থাকতেই কিংবা স্কুল ছাড়ার কিছুদিন পরে গুলিতে আত্মহত্যা করে।’

ইহুদিত্ব ও জায়োনিস্ট আন্দোলন নিয়ে কাফকার মুগ্ধতার পাশাপাশি, আমরা তাঁর ডায়েরিতে অন্য রকম কথাও দেখতে পাই: ‘আমার সঙ্গে ইহুদিদের কোনো মিল আছে কি? আমার নিজের সঙ্গেই আমার কিছুর মিল নেই; আমি যে শ্বাস নিতে পারছি এটুকু ভেবেই তো আমার উচিত খুব চুপচাপ এক কোনায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।’

Excavating Kafka বইতে হয়েস বলছেন, কাফকা তাঁর নিজের ইহুদিত্ব বিষয়ে খুব সচেতন থাকলেও, তাঁর লেখার ইহুদি ব্যাখ্যা করা ভুল হবে, কারণ, হয়েসের মতে, তাঁর লেখায় ইহুদি চরিত্র, দৃশ্য বা থিম অনুপস্থিত। প্রখ্যাত সাহিত্যবোদ্ধা হ্যারল্ড ব্লুম এ কথার বিপরীতে বলেন যে, যদিও কাফকা তাঁর ইহুদি উত্তরাধিকার নিয়ে বিব্রত ছিলেন, তবু তিনি ‘মূলত একজন ইহুদি লেখক’। পাভেল আইজ্নার, কাফকার প্রথম দিককার অনুবাদকদের একজন, তাঁর বিচার উপন্যাসকে বলছেন যে এটি ‘প্রাগে ইহুদিদের ত্রিধারা অস্তিত্বের এক মূর্ত প্রকাশ…নায়ক জোসেফ কে. এখানে (রূপকার্থে) গ্রেপ্তার হলেন একজন জার্মানের (রাবেনস্টাইনার), একজন চেকের (কুলিচ) এবং একজন ইহুদির (কামিনার) হাতে। আধুনিক পৃথিবীর ইহুদিদের “অপরাধহীন অপরাধবোধের” (guiltless guilt) প্রতিমূর্তি জোসেফ কে., যদিও উপন্যাসটির কোথাও এমন কোনো প্রমাণ নেই যে জোসেফ কে. একজন ইহুদি।’

১৯১৭ সালের আগস্টে কাফকার স্বরযন্ত্রের ক্ষয়রোগ (যক্ষ্মা) ধরা পড়ে। ১৯১৮-এর অক্টোবরে তিনি স্প্যানিশ ফ্লুুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর একদম কাছাকাছি চলে যান। উল্লেখ্য, স্প্যানিশ ফ্লুতে সে সময় শুধু জার্মানিরই আড়াই লাখ লোক মারা গিয়েছিল। টানা কয়েক সপ্তাহ ১০৬ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় কাটে তাঁর। আমরা তাঁর যক্ষ্মার প্রসঙ্গেই ফিরে যাই। ১৯১৭-র আগস্টের পর কাফকা তাঁর বাবা-মায়ের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসেন, এরপর বোন ওট্লার কাছে, গ্রামে, গিয়ে থাকেন আট মাস। আবার ফিরে আসেন বাবা-মায়ের কাছে, এরপর প্রাগ ও আধা-স্বাস্থ্যনিবাস ধরনের নানা হোটেলের (যক্ষ্মা উৎপীড়িত পুরোনো ইউরোপে ওরকম হোটেলের কমতি ছিল না) মধ্যে বারবার আসা-যাওয়া; তারপর সত্যিকারের ডাক্তারি স্বাস্থ্যনিবাস হয়ে বার্লিনে ডোরা ডিয়ামান্টের সঙ্গে কয়েক মাস।

১৯২৪-এর মার্চে তিনি খুব অসুস্থ অবস্থায় বার্লিন থেকে প্রাগে ফিরে আসেন। এখানে পরিবারের সবাই, বিশেষ করে তাঁর প্রিয়তম ছোট বোন ওট্লা, তাঁর দেখভাল করেন। ১০ এপ্রিল কাফকাকে নেওয়া হয় ভিয়েনার কাছে কির্য়েলিংয়ে ডক্টর হফমানের স্যানাটোরিয়ামে। কাফকার সঙ্গে ছিলেন প্রেমিকা ডোরা ও রবার্ট ক্লপ্স্টক (১৯২১-এ চেকোস্লোভাকিয়ার মাতলিয়ারি স্যানাটোরিয়ামে কাফকার চেয়ে ১৬ বছরের ছোট মেডিক্যাল ছাত্র রবার্টের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। রবার্ট ওখানে নিজের যক্ষ্মা সারাতে এসেছিলেন। ম্যাক্স ব্রডকে লেখা কাফকার চিঠিতে জানা যায়, কাফকা এই ছেলেটির মধ্যে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সাহিত্যিক ফ্রানৎস ভেরফেলকে খুঁজে পেয়েছিলেন। কাফকা, ডোরা ডিয়ামান্ট ও রবার্ট ক্লপ্স্টক-- এই তিন মিলে আমাদের ‘ছোট পরিবার’; তিনি জীবনের শেষ বছরে এ রকমই বলতেন। রবার্ট ক্লপ্স্টক ১৯৭২ সালে আমেরিকায় মারা যান)। এই স্যানাটোরিয়ামেই ১৯২৪-এর ৩ জুন কাফকা মৃত্যুবরণ করেন। না খেতে পারাই ছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ: গলার অবস্থা ক্ষয়রোগে এতই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তিনি দীর্ঘদিন কোনোকিছু গলা দিয়ে নামাতে পারেননি, আর অন্য কোনোভাবে শরীরে খাবার ঢোকানোর পদ্ধতিও তখনো আবিষ্কার হয়নি। তাঁর মৃত্যুর বিস্তারিত বিবরণটি এরকম:

সোমবার ২রা জুন, কাফকার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি ‘এক অনশন-শিল্পী’ বইটির প্রুফ দেখে কাটান।…কিন্তু পরদিন ভোর চারটার দিকে ডোরা লক্ষ করেন, কাফকা ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছেন না। ডোরা তখন ক্লপ্স্টক ও ডাক্তারকে খবর দেন; ডাক্তার কাফকাকে কর্পূরের ইনজেকশন দেন।

কাফকা খুবই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, তিনি ক্লপ্স্টককে বকতে থাকেন, জানতে চান তাঁকে কেন সেই প্রতিশ্রুত মরফিন দেওয়া হচ্ছে না: ‘তুমি আমাকে সব সময় কথা দিয়েছ। গত চার বছর ধরে তুমি আমাকে কথা দিয়ে আসছ। আমাকে তুমি জ্বালাচ্ছ, সব সময় তুমি আমাকে কষ্ট দিয়ে আসছ। তোমার সঙ্গে আমি আর কথা বলব না। তাহলে তা-ই হোক, ওটা [মরফিন] ছাড়াই আমি মারা যাব।’ তাঁকে তখন মরফিনের দুটো শট দেওয়া হয়, কিন্তু তখনো তিনি বলছেন: ‘আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা কোরো না। তুমি আমাকে রোগ সারানোর ওষুধ [অ্যান্টিডোট] দিচ্ছ।’ এরপর শেষ একটা স্বচ্ছতার খিঁচুনি, তিনি রবার্ট ক্লপ্স্টকের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন: ‘আমাকে হয় মেরে ফেলো, না হলে তুমি খুনি’ (Kill me, or else you are a murderer)|।

শরীরে মরফিনের কাজ শুরু হলে কাফকা ক্লপ্স্টককে তাঁর বোন এলি বলে ভাবা শুরু করেন, ভয় পান যে এলির মধ্যেও এই অসুখ ছড়িয়ে যাবে: ‘বেশি কাছে এসো না এলি, বেশি কাছে না… হ্যাঁ, ওখানে থাকো, ওটাই ঠিক আছে।’

২ তারিখেই, অমানুষিক কষ্ট করে কাফকা তাঁর বাবা-মায়ের কাছে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন, চিঠিতে তাঁর শারীরিক অবস্থার নিখুঁত বিবরণ দেন, তাঁরা তাঁকে দেখতে আসবেন কি না, এলে লাভ কী আর ক্ষতি কী, এ দুয়ের যুক্তি-তর্ক তুলে ধরে শেষে তাদের না আসতে বলেন। চিঠিটি তাঁর হয়ে লেখা শেষ করেন ডোরা, যোগ করেন: ‘আমি ওর হাত থেকে কলম নিয়ে নিলাম…’।

৩ জুন, রবার্ট ক্লপ্স্টকের দিকে তাঁর চিরাচরিত ঢঙে ঐ প্যারাডক্সিকাল চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার পরে, ক্লপস্টক যখন ইনজেকশনের সিরিঞ্জ সাফ করতে যাচ্ছেন, কাফকা মিনতি জানান: ‘আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’ ক্লপস্টক বলেন: ‘আমি যাচ্ছি না।’ কাফকা উত্তরে বলেন: ‘কিন্তু আমি যাচ্ছি’; তারপর তাঁর চোখ বন্ধ করেন।

৩ জুন, মঙ্গলবার, দুপুরের দিকে, তাঁর একচল্লিশতম জন্মদিনের এক মাস আগে, কাফকা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ডোরা তখন প্রচ- ভগ্নহৃদয়, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্থা, কাফকার মৃত শরীর ছেড়ে যাবেন না; ক্লপ্স্টক একসময় ডোরাকে বিশ্রাম নিতে যাওয়ার জন্য জোর করতে থাকেন। ‘শুধু ডোরাকে যারা চেনে, তারাই জানবে ভালোবাসার অর্থ কী,’ এর কয়েক ঘণ্টা পরে ম্যাক্স ব্রডকে লেখেন ক্লপ্স্টক।

এই দফায় মাত্র এক সপ্তাহ লাগল কাফকাকে প্রাগে ফিরিয়ে আনতে। ১১ জুন তাঁকে সমাধিস্থ করা হলো প্রাগের জেলিভ্স্কেহো রেলস্টেশনের পাশে নতুন ইহুদি কবরস্থানে। প্রায় ১০০ লোক জড়ো হয়েছিল তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। ম্যাক্স ব্রড সেখানে মৃত্যুর গাথা পাঠ করেছিলেন, আর যখন শবাধারটি কবরে নামানো হচ্ছিল, ডোরা নিজেকে কবরের মধ্যে বারবার ছুড়ে ফেলতে চাইছিলেন।

প্রাগের যে ছোট পৃথিবীতে কাফকা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন, সেখানে তাঁর মৃত্যু নিয়ে শোক করা হলো। সবচেয়ে বড় দৈনিক Prager Presse-এ ৪ জুন ম্যাক্স ব্রডের লেখা শোকগাথা ছাপা হলো। জার্মান ভাষার পত্রিকাগুলোতে দীর্ঘ শোকসংবাদ বেরোল। ১৯ জুন প্রাগের জার্মান চেম্বার থিয়েটারে ৫০০-এর মতো লোক জড়ো হলো কাফকার স্মৃতিসভায়। ৫ জুন কাফকার প্রাক্তন প্রেমিকা, চেক ভাষায় তাঁর অনুবাদক, মিলেনা য়েসেন্স্কা প্রাগের চেক রক্ষণশীল দৈনিক Narodny Listy-তে কাফকার উদ্দেশে বিদায়বার্তা লিখলেন:

ডক্টর ফ্রানৎস কাফকা, প্রাগে বাস করা জার্মান লেখক, গত পরশু মারা গেছেন ভিয়েনার কাছে ক্লস্টারনুবার্গের কির্য়েলিং স্যানাটোরিয়ামে। অল্প মানুষই তাঁকে চিনতেন, কারণ তিনি চলতেন একা, সন্ন্যাসীর মতো পৃথিবীর রীতিনীতি বিষয়ে সচেতন কিন্তু ওগুলোতে ভীত। কয়েক বছর ধরেই তিনি ভুগছিলেন ফুসফুসের অসুখে, অসুখটি তিনি সযত্নে লালন করতেন…এই অসুখ তাঁকে অনুভূতির এমন এক সূক্ষ্মতা দিয়েছিল, যাকে অলৌকিকের কাছাকাছি কিছু বলতে হবে, আর দিয়েছিল এমন এক আধ্যাত্মিক শুদ্ধতা যার আপসহীনতার ব্যাপারটি ভয়-জাগানোর মতো কিছু হয়ে পড়েছিল…। আধুনিক জার্মান সাহিত্যের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ লেখাগুলো তিনি লিখেছেন; এদের নগ্ন সত্যের কারণে, এমনকি যখন রূপক অর্থেও বলা হচ্ছে, তখনো মনে হয় সবকিছু কত স্বাভাবিক। এদের মধ্যে আছে এমন একজন মানুষের বক্রাঘাত (irony) ও ভবিষ্যদ্বক্তার অন্তর্দৃষ্টি (prophetic vision) যিনি দণ্ডিত ছিলেন পৃথিবীকে এতখানি এক চোখ-ধাঁধানো স্পষ্টতা নিয়ে দেখার কাজে যে, তিনি আর তা সইতে পারেননি, তাই মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন।

কাফকাকে কবর দেওয়া হলো সেই প্রাগেই, যেমনটা তিনি জানতেন ও ভয় পেতেন যে একদিন হবে। ‘ছোট মায়ের থাবা’ (কাফকা এভাবেই বলতেন প্রাগ সম্বন্ধে) একদম তিক্ত এক শেষ পর্যন্ত তাঁকে ধরে রাখল। এখন প্রাগের নতুন ইহুদি কবরস্থানে পাঁচ ভাষায় কাফকা-তীর্থযাত্রীদের তাঁর কবরে পৌঁছানোর রাস্তা দেখানো হচ্ছে। তিনি তাঁর বাবা-মায়ের কাছ থেকেও ছাড়া পেলেন না, এমনকি মৃত্যুতেও না; তাঁরা আছেন তাঁর সঙ্গে একই কবরে, একই কবরফলকের নিচে।

৩.

১৯৪৬ সালে ফরাসি কম্যুনিস্টরা এক জরিপ চালিয়েছিল: ‘কাফকা কি অবশ্যই পুড়িয়ে ফেলা উচিত?’ -- এই শিরোনামে। তাদের যুক্তি ছিল, কাফকা ‘অন্ধকারের সাহিত্যের’ বিপজ্জনক প্রতিনিধিত্ব করছেন, সমাজে কাফকার খুব বাজে প্রভাব পড়তে পারে। খ্রিষ্টানরাও একই রকম কথা বললেন, এমনকি এরিখ হেলারের মতো পণ্ডিত মানুষও। গুন্টার অ্যান্ডার্স তাঁর আলোচনার উপসংহার টানলেন এই কথা বলে: ‘পৃথিবীর যে ছবি কাফকা এঁকেছেন, সে রকম পৃথিবী বাস্তবে হওয়া উচিত নয়; তাতে মানুষের যে রকম আচরণ, সে রকম আচরণ হওয়া ঠিক নয়...ইতিবাচক কিছু হিসেবে তাঁর সাহিত্য কখনোই তাঁর নিজের বা অন্যদের কাজে আসবে না; তবে “সতর্কবাণী” হিসেবে আমাদের জন্য তা কাজে লাগতে পারে।’

ইতির বিপরীতে কাফকার এই নেতিবাচকতার কথা বলতে গেলে সেই ক্লিশে ‘কাফকায়েস্ক’ প্রসঙ্গই বারবার চলে আসে। আমরা যদি ১০০ রকমের ও ধরনের কাফকা-ব্যাখ্যা পাশে সরিয়ে রাখি, এ কথা তো অগ্রাহ্য করা যাবে না যে কাফকার লেখার একেবারে মূলে আছে আধুনিক পৃথিবীতে ব্যক্তির একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা এবং অনাত্মীয় পরিবেশে ‘এই পৃথিবীতে, এই শহরে, আমার পরিবারে পা রাখার ব্যাপারে পুরোপুরি অনিশ্চিত’ মানুষদের কথা ও কাহিনি। কাফকা তাঁর পাঠকের মধ্যেও এই বিচ্ছিন্নতার বোধ জারিত করেন কী সুন্দরভাবে তাঁর লেখায় কোনো দেশ, সময় বা স্থানের নাম থাকে না; এমনকি প্রকৃতির আইনও কাজ করে না (মানুষ পোকা হয়ে যায়), সামাজিক রীতিও মানা হয় না (‘এক গ্রাম্য ডাক্তার’ গল্পের বুড়ো ডাক্তার শীতের নগ্ন পৃথিবীতে ‘এই সবচেয়ে অসুখী সময়ের তুষারের সামনে অনাবৃত হয়ে’ অনন্তকাল ঘুরে বেড়ান); পারিবারিক নিয়মও শ্রদ্ধা করা হয় না (ছেলে বিয়ে করবে তাই বুড়ো বাবা ‘রায়’ গল্পে ছেলেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন)। আরো বেশি স্তম্ভিত হতে হয় তাঁর নিজের লেখা থেকে তাঁর দূরত্বের ব্যাপারটি দেখলে। তাঁর উদ্ভট, নিষ্ঠুর, অবিচারের ঘটনাগুলোয় আমরা দেখি লেখক কত নিস্পৃহভাবে অনুপস্থিত, কখনোই তিনি কোনো পক্ষ নিচ্ছেন না, কখনোই কোনো কিছুতে একটুও অবাক হচ্ছেন না; এর বদলে, সব সময় পক্ষপাতশূন্য, নৈর্ব্যক্তিক এক ভঙ্গিতে গল্প বলে যাচ্ছেন। তাঁর লেখা কেন প্রাসঙ্গিক, কেন আমরা তা পড়ব, এর উত্তরে কাফকার বিখ্যাত ডায়েরি এন্ট্রির কথাটাই মাথায় আসে। আমরা তা পড়ব, কারণ এতে ধরা আছে 'Das Negative meiner Zeit’ ‘তাঁর সময়ের নেতিবাচকতা।’ কাফকা ডায়েরিতে লিখছেন:

আমি প্রচ-ভাবে আত্মস্থ করে নিয়েছি আমার সময়ের নেতিবাচক বিষয়গুলো। এমন এক সময়ে আমি বাস করছি যা, অবশ্যই আমার অনেক কাছের, যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আমার কোনো অধিকার নেই, তবে যেন বা এই সময়টার প্রতিনিধিত্ব করার আমার অধিকার আছে।

কাফকার পৃথিবী এ রকম অ্যান্টি-পৃথিবী বলেই, তা ইতিহাসের নেতিবাচক দর্পণ বলেই ফরাসি কম্যুনিস্টরা কাফকা নিয়ে ওরকম ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।

আমরা ফ্রানৎস কাফকার গল্পসমগ্র পড়ব আর সাহিত্যচর্চা তাঁর কাছে কত বড় পূজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ এক এবাদত ছিল তা জানব না, তা হয় না।

কাফকার ডায়েরিতে ও চিঠিতে আমরা দেখি, যতবারই কাফকা বিয়ের চিন্তা করেছেন, ততবারই তাঁর সাহিত্যচর্চাই তাঁর কাছে প্রধান বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। কোনো ভাষাই নেই এটুকু সত্য বোঝানোর জন্য যে, সাহিত্য তাঁর কাছে তার বেঁচে থাকার জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রেমিকা ফেলিস বাউয়ার একবার যখন বার্লিনে কাফকার চিঠিগুলো এক হাতের-লেখা-বিশারদকে দেখতে দিলেন, সেই লোক বলেছিলেন, এই হাতের লেখা যার, তার ‘সাহিত্যে আগ্রহ’ আছে। ফেলিসকে কাফকা উত্তরে বলেছিলেন: ‘আমার সাহিত্যে আগ্রহ নেই, আমি সাহিত্য দিয়েই গড়া; আমি আর অন্য কিছু না, অন্য কিছু হতেও পারব না।’ তিনি মনে করতেন, বিয়ে করলে তাঁর জীবন থেকে সাহিত্যের জন্য প্রয়োজনীয় নির্জনতাটুকু তিনি হারাবেন। কিন্তু সেই নির্জনতা তিনি যখন খুঁজে পেতেন, তখনো সাহিত্য তাঁর কাছে কঠিন ও হতাশাজনক কিছুই হয়ে থাকত। কাফকার ডায়েরি তাঁর লেখার অক্ষমতা নিয়ে নিজেকে ভর্ৎসনায় ভরপুর। শুধু একবারই তিনি কোনো সচেতন চেষ্টা ছাড়া, স্বাচ্ছন্দে লিখতে পেরেছিলেন। সেই রাতটা ছিল ১৯১২ সালের ২২-২৩ সেপ্টেম্বর রাত; ২২ তারিখের রাত ১০টা থেকে ২৩ তারিখ সকাল ৬টা পর্যন্ত একটানা আট ঘণ্টায় তিনি লিখে ফেলেছিলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘রায়’ এবং এটি লেখার মধ্য দিয়েই নিজের লেখনীশক্তি তিনি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন -- কাফকা কাফকা হয়ে উঠেছিলেন। পরদিন তিনি ডায়েরিতে লিখলেন: ‘একমাত্র এভাবেই সম্ভব লেখালেখি, একমাত্র এরকম প্রাঞ্জলভাবেই, শরীর ও আত্মা এরকম সম্পূর্ণ খুলে দেওয়ার মাধ্যমেই।’ তাঁর এই প্রথম সাহিত্যিক সাফল্য আসে ফেলিসের সঙ্গে পরিচয়ের মাত্র এক মাসের মধ্যে। তিনি ম্যাক্স ব্রডকে বলেন, গল্পের শেষ লাইনটি লেখার সময় -- অর্থাৎ ‘সে সময় সেতুটার উপর দিয়ে পার হচ্ছে রীতিমতো অফুরন্ত স্রোতে যানবাহন’ -- এই বাক্যের শেষ শব্দটি ‘Verkher’ (অর্থাৎ traffic বা যানবাহন) লেখার সময় তিনি ভেবেছিলেন ‘শক্তিশালী এক বীর্যপাতের’ কথা। ‘Verkher’ শব্দের জার্মান অর্থ একই সঙ্গে ‘যানবাহন’ ও ‘বীর্যপাত’ বা ‘যৌনমিলন’। এখানে শব্দটি ‘যানবাহন’ অর্থে ব্যবহৃত হলেও, কাফকা যেহেতু ব্রডকে এরকম কথা লিখেছেন, তাঁর মানে কি এই যে তাঁর যৌনকামনা, ফেলিস তা জাগ্রত করার পর, তাঁর লেখালেখির মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছিল?

সফল সার্থক লেখার অনুভূতি কাফকার জন্য শুধু ওরকম চূড়ান্ত আনন্দের কিছু ছিল, কেবল তা-ই নয়; সার্থক কোনোকিছু লেখার মধ্যে দিয়ে তিনি তার জীবনের দুঃখ-কষ্ট থেকেও দূরে সরতে চাইতেন। প্রায়ই দেখা যেত কষ্টের কোনো ঘটনার পরেই কাফকার সৃজনীশক্তি জেগে উঠত। ফেলিসের সঙ্গে বাগ্দান ভেঙে যাওয়ার পরে, ফেলিসের বান্ধবী গ্রেটে ব্লখের সঙ্গে গোপনে প্রেম করবার শাস্তিস্বরূপ বন্ধুদের সঙ্গে হোটেলে ‘বিচারপর্বে’ (tribunal) বসার পরেই, তিনি লিখলেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস বিচার ও মারাত্মক গল্প ‘দণ্ড উপনিবেশে’ দুটি কাহিনিই ন্যায়বিচারের মেটাফর (রূপক)। দুর্গ উপন্যাসটিও তেমন, এটি তিনি শুরু করেন মিলেনার সঙ্গে বিচ্ছেদ হবে হবে এমন সময়ে। লেখার মাধ্যমে জীবনের উচ্চতর দৃষ্টিকোণ অর্জন করে কাফকা তাঁর অর্থহীন আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মগ্লানি থেকে কিছুটা হলেও বাঁচবার পথ খুঁজে পেতেন। ১৯২২ সালে তিনি লিখলেন, লেখালেখির সান্ত¡না এটাই যে এর মাধ্যমে ‘খুনিদের লাইন’ থেকে তিনি বেরিয়ে যেতে পারেন, আর সৃষ্টি করতে পারেন ‘আরো উচ্চতর ধরনের এক দেখার চোখ, উচ্চতর, ধারালোতর নয়; আর সেটা যত বেশি উঁচু হয়, খুনিদের লাইন থেকে (আমার অস্তিত্ব) তত দূরে সরে যায়; সেটা যত তার নিজের গতির আইন মেনে চলে, ততই তার পথ হয়ে ওঠে আরো অগণনীয়, আনন্দময় ও ঊর্ধ্বগামী।’

একই সঙ্গে কাফকা ভাবতেন যে, লেখালেখি তাঁর কাছে নিজের ‘মনশ্চিকিৎসা’র চেয়ে অনেক বেশি কিছু। লেখালেখির মধ্য দিয়ে ‘নবযুগের’ সূচনা হয় বলে ভাবতেন তিনি। ১৯১৬ সালে কাফকা তাঁর প্রকাশকের কাছে স্বীকার করলেন, ‘দণ্ড উপনিবেশে’ গল্পটি আসলেই বেদনাদায়ক একটি গল্প; ব্যাপারটা তিনি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে: ‘আমাদের ইতিহাসের এই যুগ, বিশেষ করে আমার এই সময়টি, সত্যিই অনেক বেদনাদায়ক।’ পরের দিকে এসে তিনি তাঁর লেখালেখিকে বললেন ‘ধাঁধায় ভরা এক মিশন’।

এক গ্রাম্য ডাক্তার-এর মতো লেখা লিখে আমি এখনো খুব বেশি হলে ক্ষণস্থায়ী একধরনের তৃপ্তি পেতে পারি, এ ক্ষেত্রে ধরে নিচ্ছি যে ওরকম আরো লেখা আমার পক্ষে সম্ভব (যদিও খুবই অসম্ভব ঠেকছে ব্যাপারটা); কিন্তু সুখ পেতে পারি কেবল তখনই যখন আমার পক্ষে সম্ভব হবে পৃথিবীকে তার শুদ্ধ, সত্য ও পরিবর্তনের-অতীত রূপে তুলে ধরা।

এ কথার কী অর্থ (…’raise the world into the pure, the true, the unchangeable’) তা বোঝা দুরূহ; তবে এটুকু পরিষ্কার যে লেখালেখি তাঁর কাছে ব্যক্তিগত কোনো প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কিছু ছিল। তিনি পৃথিবীর মূল সত্য, আদি ও অপরিবর্তনীয় মূল রূপটিকে তা শুভ হোক আর অশুভ হোক, কিছু যায়-আসে না; অন্তত তাঁর কাছে সত্য রূপ বলে মনে হলেই হলো তাঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চাইছিলেন। তিনি যখন একই প্রসঙ্গে বলেন, লেখালেখি তাঁর কাছে ‘প্রার্থনা’র মতো, তখন হঠাৎই বিভ্রম বোধ হয় যে (যেমনটা কাফকার লেখার ধর্মীয় ব্যাখ্যাদাতারা বলেন), সত্যিই কি কাফকা নিজেকে ‘পয়গম্বর’ বলে মনে করতেন?

আগেই বলেছি, কাফকার সাহিত্যকর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়েছে অগুনতি রকমের। কোনো কাফকা-ব্যাখ্যারই গভীরে যাওয়ার জায়গা এটি নয়; অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য ওই ছোঁয়াটুকুই যথেষ্ট। তার পরও যতগুলো কাফকা-ব্যাখ্যা হয়েছে (বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাফকা ব্যাখ্যার মোট ১৯ রকমের মূলধারা আছে), যেমন অস্তিত্ববাদী ব্যাখ্যা, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণবাদী ব্যাখ্যা (তিনি ডায়েরিতে লেখেন যে, ‘রায়’ গল্পটি লেখার সময়ে তাঁর মাথায় ‘ফ্রয়েডের চিন্তা, স্বাভাবিকভাবেই’ এসেছিল), মার্ক্সিস্ট ব্যাখ্যা, মেটাফিজিক্যাল ব্যাখ্যা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যাখ্যা, অ্যাবসার্ড সাহিত্যিক ব্যাখ্যা, এক্সপ্রেশনিস্ট ব্যাখ্যা, সামাজিক ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক ব্যাখ্যা, ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা, দার্শনিক ব্যাখ্যা, নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, আত্মজৈবনিক ব্যাখ্যা, আইনি ব্যাখ্যা, ইত্যাদি ইত্যাদি, এর মধ্যে আজও অন্যতম জোরালো ব্যাখ্যা হিসেবে, মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার সূত্রের নিরিখে কাফকা-ব্যাখ্যা এবং অস্তিত্ববাদী দর্শনের আলোকে কাফকা ব্যাখ্যার পাশাপাশি টিকে আছে কাফকা-সাহিত্যের ধর্মীয় ব্যাখ্যা। মৃত্যুর পরে যেহেতু ম্যাক্স ব্রডের হাত ধরেই কাফকার বিশ্বসাহিত্যে প্রবেশ এবং ব্রড যেহেতু বিশ্বাস করতেন কাফকার লেখাকে দেখতে হবে ‘ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে ব্যক্তিমানুষের ঈশ্বরকে খোঁজার আধ্যাত্মিক এক নিরন্তর সংগ্রাম হিসেবে’, আর সেই সঙ্গে কাফকার প্রথম ইংরেজি অনুবাদক উইলা ও এডুইন ম্ইুরও যেহেতু সেই বিশ্বাস মাথায় রেখেই কাফকা-অনুবাদ করেন, কাফকার ধর্মীয় ব্যাখ্যাটি তাই রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে ‘কাল্ট’-এর আকার ধারণ করে। আমরা এখানে কাফকার সৃষ্টিকর্মের আজও এই সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যাটি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করব।

ধেয়ান নামের গল্পসংকলনে আছে কাফকার অন্যতম বিখ্যাত স্কেচ ‘গাছ’। পুরো লেখাটি এ রকম:

যেহেতু আমরা হচ্ছি তুষারে গাছের গুঁড়িগুলোর মতো। আপাত-চোখে ওগুলো কী সুন্দর, তুষারের উপরে, পড়ে আছে মাটিতে; আর হালকা একটা ধাক্কাতেই আমরা ওদের সরাতে পারব মনে হয়। না, আপনি তা পারবেন না, কারণ ওরা শক্ত করে মাটিতে গাঁথা। কিন্তু দেখুন, সেটাও স্রেফ আপাত-অর্থেই।

এই লেখার কী মানে হয়? নিট্শের মতোই কাফকা এখানে বলছেন, ‘পৃথিবীর আর কোনো নিরাপদ ভিত্তি নেই, ভিত্তি সরে গেছে।’ তুষারের মধ্যে বড় হওয়া গাছগুলো দেখে মনে হচ্ছে ওরা দাঁড়িয়ে আছে শক্তপোক্তভাবে, কিন্তু ওদের ধাক্কা দিয়ে সরানো সম্ভব। তবে আমরা সরাতে চাইলেই গাছগুলো থেকে বাধা আসছে, মনে হচ্ছে আমাদের চেয়ে ওদের শিকড় আরো গভীরে পোক্ত। কিন্তু ওদের এই মাটির গভীরের শিকড় একটা ‘ইল্যুশন’ বা অলীক কল্পনা মাত্র। দেখতে যাকে সবচেয়ে পোক্ত ভিত্তির মনে হয়, তার ভিত্তি আসলে অত পোক্ত আদৌ নয়। নিট্শের ক্ষেত্রে এই হালকা ভিত্তির কারণ: ইউরোপে ‘ঈশ্বর মারা গেছেন।’ সেটা এ কারণে শুধু নয় যে, মানুষের ধর্মবিশ্বাস ধসে গেছে; বরং এ কারণেও যে মানুষ চাইছে, বিদ্রোহীর মতো, তাদের নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ ঈশ্বরের হাত থেকে কেড়ে নিজেদের হাতে নিয়ে নিতে। ইউরোপে ঈশ্বর-অস্বীকারের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী তার আগের সেই স্পষ্ট দিগন্তরেখা, স্পষ্ট অর্থ এবং দৃঢ় ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছে। যুদ্ধ, নির্যাতন, ক্ষুধা, নিগ্রহ ও নির্বিচার অবিচারের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়ে গেছে যে, আর কোনো সূত্র নেই, শরণ নেই, কিসের বরাতে জীবনকে দেখব তার আর কোনো বিধিমালা নেই, মানুষ আর পারছে না পৃথিবীকে অন্ধকার পথের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ঠেকাতে; কোনো অভিভাবক নেই, কর্তা নেই, যিনি কিনা আমাদের জন্য তা ঠেকাবেন।

কাফকা বারবার ওরকম এক পরিস্থিতির ছবি এঁকেছেন যেখানে আমাদের অভিভাবক, আমাদের কর্তা, আরো আরো দূরে সরে গেছেন, অনতিক্রম্য দূরে, যেন নির্বাসনে। সে জন্যই কাফকার শ্রেষ্ঠতম একটি লেখা ‘সম্রাটের কাছ থেকে একটি বার্তা’য় (এ বইয়ের এক গ্রাম্য ডাক্তার গল্পসংকলনে আছে) আমরা দেখি সম্রাট তাঁর বার্তাবাহককে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন তাঁর মৃত্যুশয্যা থেকে, কিন্তু সেই ‘অপরাজেয়’, ‘শক্তিশালী’ বাহক নানা গোলকধাঁধার চক্করে পড়ে আমাদের কাছে মৃত সম্রাটের বার্তাটি আর পৌঁছাতেই পারল না। ‘কিন্তু’, গল্পটি এভাবে শেষ হচ্ছে, ‘তুমি বসে থাকো তোমার জানালায়, আর যখন সন্ধ্যা নামে, তুমি স্বপ্নে কল্পনা করে নাও ঐ বার্তার’। ঈশ্বর যদি সত্যিই মারা গিয়েও থাকেন আমরা তবু ঐ ঐশ্বরিক বার্তার আশায় বসে থাকি; কিন্তু যখন কোনো বার্তা, কোনো সাহায্যই আসে না, যখন ধুম করে চাকরি হারিয়ে একটা পরিবার রাস্তায় ভিক্ষার জন্য বসে যায়, বা যখন বিনা বিচারে পুলিশ আমাদের কারাগারে ঢুকিয়ে দেয়, তখন আমরা মনে মনে কল্পনা করে নেই সে বার্তার, খোদার থেকে পাব এমন কোনো সান্তনার।

কাফকার উপন্যাসগুলোতে আমাদের যিনি বাঁচাবেন তাঁর এই অনুপস্থিতি অধিকাংশ সময়েই ধর্মীয় রূপকল্পে তুলে ধরা হয়েছে। আমেরিকা উপন্যাসে নিউ ইয়র্ক শহরের গির্জা দেখা যাচ্ছে কুয়াশার মধ্যে ডুবে আছে, কিন্তু পোলান্ডারের গ্রামের বাড়িতে কোনো গির্জাই নেই, বিল্ডিংটার আধুনিকায়নের কাজে ওটা পরিত্যক্ত করে রাখা হয়েছে। বিচার উপন্যাসের ক্যাথেড্রালটি বিশাল, অন্ধকারাচ্ছন্ন, প্রায় ফাঁকা; জোসেফ কে.র কাছে ওটা মূলত একটা ‘ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন’। কবরে রাখা যিশুর একটা ছবি, জোসেফ কে. টর্চলাইটের আলোয় ছবিটা টুকরো-টুকরোভাবে দেখতে পাচ্ছে, একবারে পুরোটা কখনো নয়, তারপর একসময় সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল, কারণ ওটা ইদানীংকালের আঁকা একটা ছবি মাত্র। ক্যাথেড্রালের এই অন্ধকার দেখে আমাদের মনে পড়ে নিট্শের পাগলের সেই সর্বনাশা কথা: ‘চার্চগুলো এখন আর খোদার কবর ও মনুমেন্ট ছাড়া আর কী?’ কাফকার শেষ উপন্যাস দুর্গতে আমরা দেখি কীভাবে তিনি কে.র নিজের শহরের চার্চের সঙ্গে এই দুর্গের তুলনা দিচ্ছেন। দুর্গটি দেখতে দুর্গের মতো লাগছে না। তাহলে দুর্গের চেহারা নিয়ে কে.-র যে প্রত্যাশা, তা মিটবে কীভাবে? দুর্গে তো অভিভাবকেরা থাকেন, তাঁদের থাকার জায়গার চেহারাই যদি অমন হয়, তাহলে তাদের নিজেদের চেহারা কেমন হতে পারে? তাহলে এই হচ্ছে গ্রামের মানুষের কর্তার ছবি? আর দুর্গটা যদিও গ্রামের পেছনে অনেক উঁচুতে, কিন্তু ওটা দেখতে তো গ্রামের থেকে আলাদা কোনো কিছু লাগছে না। কাফকা কি এখানে ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে আজকাল মানুষ যে কর্তৃত্বের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে (অর্থাৎ খোদা), তা আসলে তাদের নিজেদের কল্পনা দিয়েই গড়া কোনোকিছু?

বারবার কাফকার লেখার এই ‘চার্চ’ তাঁর সময়ের প্রাগের চিত্রকেই তুলে ধরে, তাঁর ইহুদি পরিবারকে নয়। কাফকার জন্মস্থানের কয়েক গজের মধ্যেই চারটি বিশাল বিশাল চার্চ, পুরো প্রাগ ভরে আছে বিশালায়তন সব চার্চে। খ্রিষ্টধর্ম তাঁর কাছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা হিসেবে একদম তাঁর চোখের সামনেই ছিল সব সময়। তবে তাঁর লেখায় যে চার্চগুলো আছে, তাদের কী ব্যাখ্যা, তা বলা দুরূহ। ‘রায়’ গল্পে গেয়র্গের বন্ধু থাকে রাশিয়ার পিটার্সবার্গে, অর্থাৎ পিটারের শহরে, আমাদের মনে আসে সেন্ট পিটার ও রোমের কথা। তারপর গল্পের সেই বিধ্বংসী দৃশ্য: কিয়েভ শহরের এক যাজক মানুষের অনেক বড় এক ভিড়ের সামনে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তার হাতের তালু কেটে একটা ক্রুশচিহ্ন আঁকলেন। কেন? আর গেয়র্গের বাবা যখন গেয়র্গকে মৃত্যুদ- দিলেন, গেয়র্গ যখন সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নামছে, তখন ঠিকে-ঝি চিৎকার করে উঠল: ‘যিশু’; ব্রিজটা থেকে ঝুলন্ত গেয়র্গকে নিশ্চয় ঝুলন্ত ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মতোই দেখতে লাগছিল। ‘রূপান্তর’ গল্পে পোকা হয়ে যাওয়া গ্রেগরের দিকে তাঁর অভিভাবক পিতা আপেল ছুড়ে মারলেন, সে তখন ‘ঐ জায়গাতেই যেন পেরেকে গেঁথে গেল’ আবার সেই ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছবি মনে আসে আমাদের। ‘দণ্ড উপনিবেশে’ গল্পে শাস্তিপ্রাপ্ত আসামির আলোকপ্রাপ্তি ঘটে ‘ষষ্ঠতম ঘণ্টায়।’ ‘এক গ্রাম্য ডাক্তার’ গল্পের অসুস্থ ছেলেটিকে জানালা থেকে তাকিয়ে দেখে দুটি ঘোড়া; আস্তাবলে যিশুর জন্মের উল্টো ছবি যেন। ‘এক অনশন-শিল্পী’ গল্পে অনশন-শিল্পী খায় না ‘৪০ দিন’। ঠিক ৪০ দিনই কেন? যিশুর জনহীন-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো, উপোস করা সেই ৪০ দিনের কথাই কি মনে আসে না এটি পড়লে?

বাইবেলের এসব পরোক্ষ-উল্লেখ বিভ্রান্তিকরই ঠেকে, মনে হয় কাফকা খ্রিষ্টধর্মের মূল্যবোধগুলো নিয়ে ক্রিটিক করছেন। নিট্শের পাঠক হিসেবে কাফকা নিঃসন্দেহে ধর্ম নিয়ে নিট্শের সমালোচনাগুলো (বিশেষ করে খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে করা যেগুলো) জানতেন। নিট্্শে অস্বীকার করেছিলেন যে খ্রিষ্টধর্মের নৈতিক বিষয় ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে আসমানি কোনো ব্যাপার আছে। নিট্শের হিসেবে নৈতিকতা বিষয়টি ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, কোনো অবিনশ্বর-একক নৈতিকতা বলে কিছু নেই, আর ধর্মীয় নৈতিকতার এত জয়গান এজন্য না যে ওগুলোর মধ্যে আহামরি কোনো উৎকর্ষতা আছে, বরং এজন্য যে, যারা ওগুলো মেনে চলে তারা পৃথিবীতে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত মানুষ হয়। নিট্শে আরো বলেন, ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মের যাজক জাতীয় লোকেরা মূলত অসুস্থ, প্রাণহীন, খোঁড়া মানুষ আর তারা তাদের ততোধিক দুর্বল শিষ্যদের ওপর খবরদারি চালায় তাদের কৌশলে, মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়ে। এই আলোকে দেখলে কাফকার ‘রায়’ গল্পের নিজেকে আহত করা সেই যাজক হয়ে ওঠে নিট্শের The Genealogy of Morals-এর অসুস্থ যাজকেরই একটি ছবি, যে যাজকের ক্ষমতার কেন্দ্রে আছে তার শিষ্যদের অসুস্থতার বোঝা বহনের গল্প। আমরা দেখি, ‘রূপান্তর’ গল্পের স্বার্থপর পরিবারটি যখন গ্রেগরের মৃত্যুর খবর পায়, তারা তাদের বুকে, স্বস্তিতে, ক্রুশচিহ্ন আঁকে। আমেরিকা উপন্যাসে কাজের মেয়ে ইয়োহান্না ব্রামার কার্লকে যৌনভাবে ব্যবহার করার পরে একটা কাঠের ক্রুশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করে। ‘এক গ্রাম্য ডাক্তার’ গল্পের ডাক্তার এটা ভেবে ব্যথিত যে তার রোগীরা তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস তাদের অপদার্থ যাজককে বাদ দিয়ে এখন এই বুড়ো ডাক্তারের ওপর অর্পণ করেছে:

তাদের আগের সেই ধর্মবিশ্বাস তারা হারিয়ে ফেলেছে; যাজক বসে আছে বাড়িতে আর তার বেদিতে পরার পোশাক এক এক করে ছিঁড়ে ফেলছে; কিন্তু ডাক্তারের কাছ থেকে তাদের আশা যে তিনি তার শল্যচিকিৎসকের নাজুক হাত দিয়ে সব অসম্ভবকে সম্ভব করে দেবেন।

কাফকার লেখায় উপরের এসব খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে যোগাযোগের উদাহরণের পাশাপাশি ইহুদিধর্ম ও জায়োনিজমের যোগাযোগের বিষয়টা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। দুই ধর্মের তাত্ত্বিকেরাই যার যার মতো করে অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরেছেন কাফকার গল্প, উপন্যাস, ডায়েরি, চিঠি ঘেঁটে। জায়োনিস্ট আন্দোলনের মতো একটি বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি কাবালার (Kabbalah; ইহুদিদের গূঢ় রহস্যময় ধর্মীয় গুপ্তবিদ্যা) দৃষ্টিকোণ থেকেও কাফকাকে দেখা হয়েছে। বিচার উপন্যাসের দৃশ্যকল্পগুলো , যেমন এর বিচারকেরা, দ্বার রক্ষকেরা, এর ঘোঁরানো-প্যাঁচানো সিঁড়িগুলো, বলা হয়েছে কাবালার অনেক সূত্র ও মন্ত্রের সঙ্গে মিলে যায়; যদিও কাফকা বিচার উপন্যাস লেখার সময়ে কাবালা বিষয়ে কতটুকু জানতেন তা নিয়ে বিরাট সন্দেহ আছে। কাফকার ধর্মীয় ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এখানে খ্যাতিমান দার্শনিক ওয়াল্টার বেন্জামিন ও ধর্মতাত্ত্বিক গেরশোম শোলেম (বর্তমানে যাকে কাবালা-বিদ্যা ও আধুনিক জার্মান-ইহুদি চিন্তার অন্যতম বড় স্তম্ভ হিসেবে দেখা হচ্ছে)-এর মধ্যকার বিতর্কের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। বেন্জামিন খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন ম্যাক্স ব্রড ও অন্যদের খাড়া করা ‘অনায়াসলব্ধ’ ধর্মীয় ব্যাখ্যা পড়ে (তিনি ব্রডের লেখা কাফকা জীবনীগ্রন্থটি অন্যদের পড়তেই মানা করেছিলেন; তাঁর হিসেবে এতই ফালতু ওই বই); তাঁর ভাষ্যমতে, কাফকার কল্পনাগুলো পৃথিবীতে ধর্মের উদ্ভব ঘটারও আগের সময়কার বিষয়, কাফকার চিন্তার সঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের চিন্তার যোগাযোগ আছে, কাফকার এই ‘প্রাচীনতা’ (যদিও তিনি ‘আধুনিকতাবাদী’ বা মডার্নিস্ট লেখকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ) ধর্ম ঘটবার আগের ঘটনা। আর শোলেম উত্তরে বলেছিলেন, যা-ই বলা হোক না কেন, কাফকা ঐশ্বরিক বার্তার আলোকেই তাঁর পৃথিবীর ছবিটি এঁকেছিলেন, কিন্তু সেই বার্তার তিনি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে যেতে পারেননি, কারণ তিনি বার্তাটির ঠিকভাবে পাঠোদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শোলেমের মতে, কাফকা ‘নেগেটিভ’ বা ‘নেতিবাচক’ ধর্মতত্ত্বের বার্তাবাহক, ইতিবাচক ধর্মীয় বিশ্বাসের নয়।

যা-ই হোক, আপনি যতই কাফকা পড়বেন, বিশেষ করে তাঁর ডায়েরি, ততই আপনার কাছে পরিষ্কার হবে যে, কাফকার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মানুরাগী কারো খুশি হওয়ার কিছু নেই। আপনি ধাঁধায় পড়ে যাবেন এটা ভেবে যে, কাফকা কি ঈশ্বরের প্রশংসা করছেন, নাকি ঈশ্বরের সমালোচনা করছেন, নাকি ঈশ্বরের বাণী যে মানুষেরা বহন করে তাদের ব্যাপারে সন্দেহ-অবিশ্বাস-সংশয় প্রকাশ করছেন? আর সেই সঙ্গে কাফকার ঈশ্বর কি খ্রিষ্টান ঈশ্বর, নাকি ইহুদি ঈশ্বর, নাকি অন্য কোনো ধর্মের ঈশ্বর? কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতিই তিনি মিত্রতা দেখাননি– এটুকু পরিষ্কার। যতজন ধর্মবেত্তা ও দার্শনিক কাফকার মন কেড়েছিলেন, তাঁর মধ্যে একমাত্র সোরেন কির্য়েকেগার্ডের (১৮১৩-১৮৫৫) সঙ্গেই ছিল তাঁর কিছুটা বিশেষ এক সম্পর্ক।

১৯১৩ সালে কাফকা প্রথম কির্য়েকেগার্ড পড়েন। তিনি দেখতে পান যে ফেলিস বাউয়ারের সঙ্গে তাঁর বাগ্দান ভেঙে যাওয়ার ঘটনার (যার মূল উৎস ছিল বিয়ে করলে সাহিত্যচর্চায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে এমন একটা ভীতি) সঙ্গে ধর্মের টানে কির্য়েকেগার্ডের রেজিনা ওলসেন-এর সঙ্গে বাগ্দান ভেঙে যাওয়ার ঘটনার মিল আছে। ১৯১৭-১৮ সালে তিনি নতুন করে কির্য়েকেগার্ড পড়া শুরু করেন, ব্রডকে লেখা চিঠিতে বিস্তারিত লিখতে থাকেন কির্য়েকেগার্ড প্রসঙ্গে। কাফকা বিশেষভাবে মুগ্ধ হন কির্য়েকেগার্ডের Fear & Trembling বইয়ের পিতা-পুত্রের কাহিনি — হজরত ইবরাহিম ও তাঁর ছেলে ইসমাইলের কুরবানির কাহিনি– পড়ে। ছেলেকে কুরবানি দিতে রাজি হওয়ার মধ্যে দিয়ে ইবরাহিম সামাজিক নৈতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে (অর্থাৎ পুত্রহত্যা করতে রাজি হয়ে) তাঁর পিতৃসুলভ নৈতিকতাবোধ ছাড়িয়ে গিয়ে, খোদার সেবায় সবকিছু উৎসর্গ করতে সম্মত হয়েছিলেন। অর্থাৎ ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রত্যয় খুব ভালোভাবেই সামাজিক নৈতিকতার বিপক্ষেও দাঁড়িয়ে যেতে পারে– এমনটাই বলেছিলেন কির্য়েকেগার্ড। কাফকা বললেন অন্য কথা। ইবরাহিম-ইসমাইলের ঘটনায় তাঁর মনে হলো ধর্মবিশ্বাস আসলে ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত একটি বিষয়, যার নির্ণয় শুধু খোদাই করতে পারেন; এখানে সামাজিক নৈতিকতার আগে - ঐ কুরবানির ঘটনায়– বিবেচনা করতে হবে ব্যক্তির সিদ্ধান্তকে। কাফকার আরো মনে হলো, যে মানুষ তার চরিত্র দৃঢ় রাখতে পারে, তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অটুট রাখতে পারে (যদিও বাবা-মা ও শিক্ষকেরা সব সময়ে চেষ্টা করেন এটা খর্ব করতে), সেই মানুষের প্রতি শয়তান ও ফেরেশতা, দুই-ই আকৃষ্ট হয়, এর ফলে তার পক্ষে পরম ভালো কাজ ও চরম খারাপ কাজ– দুটোই করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে।

কির্য়েকেগার্ড এভাবেই কাফকাকে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলো মানবসমাজের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখার চশমাটা ধার দিলেন, ধর্মীয় কাঠামোর আয়তনে জীবনকে দেখার স্পৃহা জাগালেন। কাফকা বুঝতে পারলেন, লেখালেখি শুধু নিজের জন্য নয়, শুধু নিজের সৃজনীক্ষুধা মেটাবার জন্য নয়, বরং এর মাধ্যমে বৃহত্তর মানবসমাজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব, অর্থাৎ লেখালেখির কোনো উচ্চতর লক্ষ্যও থাকতে পারে। এভাবেই উচ্চতর লক্ষ্যে পৌঁছানোর তাড়না থেকেই Ñ কাফকার লেখালেখি তাঁর অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল, কাফকা তাঁর অস্তিত্বের একটা ন্যায্যতা খুঁজে পেলেন এর মধ্যে দিয়ে। তাঁর লেখার প্রয়োজনটা হয়ে উঠল অস্তিত্ববিষয়ক বা অস্তিত্ববাদী, বা ধার্মিক প্রয়োজন। বিচার উপন্যাস লেখার সময় তিনি ডায়েরিতে লিখলেন:

দু বছর আগে যেমনটা ছিলাম [অর্থাৎ ‘রায়’ গল্প লেখার সময়ে] আজ আর আমি আমার লেখার মধ্যে সেরকম সুরক্ষিত অবস্থায় নেই…তার পরও আমি জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছি; আমার রোজকার শূন্য, পাগলাটে, ব্যাচেলরের মতো জীবনের একটা ন্যায্যতা খুঁজে পেয়েছি।

শেষ দিকের কাফকা শুধু তাঁর নিজের জীবনের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি ও একটি কারণ বা ন্যায্যতা খুঁজে ফেরেননি, তিনি সেটি, পয়গম্বরদের মতোই, আমাদের সবারটার জন্যও হন্যে হয়ে খুঁজেছেন। তিনি তখন নিজেকে দেখেছেন তাঁর সময়ের আধ্যাত্মিক অবস্থার প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে। ১৯১৮-র ২৫ ফেব্রুয়ারির নোটবুকে আমরা তাকে এক রহস্যময় আধ্যাত্মিক মিশনের সঙ্গে লড়াইরত দেখি:

আমি যদ্দুর জানি, জীবনের জন্য দরকারি এমন কিছুই আমি সঙ্গে আনিনি, শুধু এনেছি মানুষের চিরকালীন ও সর্বজনীন দুর্বলতাগুলো। এভাবেই…খুব শক্তিশালীভাবেই আামি আত্মস্থ করে নিয়েছি আমার সময়ের নেতিবাচক দিকগুলো…। কির্য়েকেগার্ডকে যেভাবে খ্রিষ্টধর্ম– মানতেই হবে ওই ধর্ম এখন আলগা হয়ে পড়েছে, ব্যর্থ হচ্ছে– জীবনে হাতে ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে, আমাকে তা নেয়নি; কিংবা জায়োনিস্টরা যেভাবে ইহুদিদের প্রার্থনার শালের প্রান্ত– ওটাও এখন আমাদের থেকে পালিয়ে যাচ্ছে– ধরতে পেরেছে, আমি তা পারিনি। আমিই শেষ কিংবা আমিই শুরু।

কাফকা যখন বলেন, তিনি হয় শেষ, না হয় তিনি শুরু, অর্থাৎ তাঁর মধ্যেই আছে একটা সমাপ্তি বা একটা আরম্ভ, তিনি পুরোপুরি ভুল বলেন না। তিনি অর্ধেক ঠিক কথা বলেন। একভাবে দেখলে তিনি সমাপ্তি তো বটেই: তাঁর পথ ধরে আর বেশি দূর যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়; যে ভয়ংকর পৃথিবী তিনি তাঁর মাথার মধ্যে বয়ে চলেছিলেন, তার সামান্য অংশ মাথায় আনলেও সাধারণ মানুষ স্ট্রোকে বা দুর্ঘটনায় মারা যাবে (এ প্রসঙ্গে কাফকার মৃত্যুতে মিলেনা য়েসেন্স্কার শোকবার্তাটি আবার পড়ুন)। কিন্তু থিমের দিক দিয়ে দেখলে, তিনি শুরু। তাঁর বিশাল ও মহান থিম--এর পূর্বপুরুষ নিট্শে ও কির্য়েকেগার্ডে লুকানো থাকলেও, কথাসাহিত্যে কাফকার আগে কেউ তা ভাষা দেয়নি-- হচ্ছে এ পৃথিবীতে বাস করার শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক টেনশন। আমাদের সময়ের আধুনিকতা, উদারনৈতিক চিন্তাচেতনা এবং তথাকথিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ফাঁকিটা ও ফাঁকটা কাফকা ধরতে পেরেছিলেন। সেজন্যই হয়তো কাফকার লেখা ভর্তি পুরোনো প্রথা ও পুরোনো বিশ্বাসে: পিতা, পিতার শাসন, আদালত, বিচার, দুর্গ, সম্রাট, অবিনশ্বর আইন ইত্যাদি। তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘চীনের মহাপ্রাচীর’ -এ যূথবদ্ধ, একত্রিত এক জাতির কথা বলার সময়, সেই জাতির একজন হতে পারার ‘মহান’ ব্যাপারটির কথা জানানোর সময়, কীভাবে কাফকা কাব্যিক হয়ে ওঠেন! আর ‘আইনের দরজায়’ গল্পে ভেতরে প্রবেশের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে থেকে লোকটা যখন ব্যর্থ এক জীবন কাটিয়ে মারা যাচ্ছে, তখন এই বোকা কিনা দেখে যে ‘আইনের দরজাপথ থেকে ভেসে আসছে অনির্বাণ একটা দীপ্তি।’

কাফকার মতো চালাক সম্ভবত আর কেউ ছিলেন না; তাঁর মতো স্বচ্ছতা নিয়ে বিশ্বব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থার ফাঁকগুলোও আর কেউ বোধ হয় ধরতে পারেননি। কাফকার রসবোধ (সেন্স অব হিউমার) নিয়ে চিন্তা করলেই মনে হয়, কীরকম গুরুতর সব পরিস্থিতিকে কীরকম কমিক বানিয়ে ছেড়েছেন তিনি। প্রাগের ‘ক্যাফে স্যাভয়’ তে তিনি যখন বন্ধুদের সামনে বিচার উপন্যাসের শুরুটা পড়ে শোনাচ্ছেন, তখন তিনি ও তাঁর বন্ধুরা হেসে কুটিকুটি। কেন? ওরকম ভয়ংকর এক ঘটনা দিয়ে যার শুরু এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে তার বিছানায় এক সকালে আগন্তুকেরা এসে গ্রেপ্তার করে বসল, বিনা কারণে তা পড়তে গিয়ে কাফকা ওরকম হাসছিলেন কেন? ‘গায়িকা জোসেফিন বা ইঁদুর-জাতি’ গল্পে (এ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত) সংগীতশিল্পী জোসেফিনকে নিয়ে কাফকা ওরকম মারাত্মক ব্যঙ্গ করেন কেন যে, জোসেফিন আসলে গান গায় না, সে অন্য ইঁদুরদের মতোই একটু কিচিরমিচির করে? জোসেফিন ভাবে সে তাঁর জাতির ত্রাণকর্তা, আর গল্পের কথক কিনা বলে, ‘হায় খোদা, জোসেফিন যেন কোনো দিন জানতে না পারে, আমরা যে তাকে শুনি সেটাই প্রমাণ করে যে সে সত্যিকারের কোনো গায়িকা নয়।’ এ কেমন কথা? গল্পে গল্পে কাফকার এই বক্রোক্তি, ঠাট্টা, শীতল রসিকতা কখনো কখনো আমাদের উঁচু লয়ের হাসিতে ফেটে পড়তেও বাধ্য করে ( ‘রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান’, ‘এক ছোটখাটো মহিলা’, ‘দি স্টোকার’, ‘প্রথম দুঃখ’, ‘এক অনশন-শিল্পী’, ‘গায়িকা জোসেফিন’)। কাফকার এই যে জার্মান ভঙ্গিতে রস বা হিউমার, যা কমেডিও নয়, বা চাতুর্যপূর্ণ রসিকতাও (রিঃ) নয়, আসলে জীবনের খুঁতগুলো খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়ে সেগুলো নিরাসক্তভাবে মেনে নেওয়ার তাঁর যে ভঙ্গি-- যেন তিনি বোঝেন যে কেবল তিনিই ওগুলো বোঝেন, কিন্তু আমরা বোকারা বুঝি না--তারই প্রকাশ। আজ বিশটি বছর ধরে কাফকা পড়ার পরে আমার এই দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, কাফকার রসবোধ যে বুঝবে, গল্পে গল্পে তাঁর বাঁকা উক্তি ও খোঁটা ও ব্যঙ্গগুলো যে ধরতে পারবে, সে-ই দাবি করতে পারবে, সে কাফকা বুঝেছে।

কাফকার সব প্রধান নায়কেরা দেখবেন একটা মতিবিভ্রমের মধ্যে আছে; পোকা গ্রেগর ভাবছে সে পোকা হয়ে গেছে তো কী হয়েছে, তাকে অফিসে যেতে হবে; জোসেফ কে. তাঁর বিচার হবে বলে সারা জীবন অপেক্ষা করছে; কে. দুর্গের লোকদের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য জীবনটা বরবাদ করে দিচ্ছে; সম্রাটের বার্তাবাহক দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছেই; গ্রাম্য ডাক্তার যতক্ষণে খেলাটা বুঝতে পেরেছেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে; আইনের দরজায় ঐ বুদ্ধু দাঁড়িয়েই আছে এই অপেক্ষায় যে দরজাটা কবে খুলবে; দণ্ড উপনিবেশে মৃত্যুদণ্ডের পুরোনো প্রথায় বিশ্বাসী লোকটি ভাবছে এই পর্যটক তার ভয়ংকর বিচারব্যবস্থার পক্ষে রায় দিয়ে সব আবার ঠিক করে দেবেন। এদের কারো বিভ্রম, কারো ঘোরই, যেন কাটছে না। এ বইয়ের মোট ৪৬-৪৭টি গল্প-ছোট গল্প-স্কেচের ২৪টিতেই আমরা ওরকম মতিবিভ্রমের (delusion) মধ্যে থাকা চরিত্রের খোঁজ পাই। আমরা অবাক হই, হাসি, ওদের জন্য আমাদের মায়া হয়।

মজার কথা হচ্ছে, কাফকার এ রকম কোনো মতিবিভ্রম বা অলীক বিশ্বাস ছিল না। তিনি পৃথিবীকে অতি, অতি স্পষ্ট করে দেখে ফেলেছিলেন, যেভাবে দেখলে নিজের আর কোনো বিভ্রম থাকে না, কেবল তখন অন্যের বিভ্রম নিয়ে ঠাট্টা করা যায়। কাফকা জেনে গিয়েছিলেন যে ক্ষমতাশালীরা টিকে থাকে বিভ্রম ছড়িয়ে, মিথ্যা বলে আর ভয় দেখিয়ে; আর ক্ষমতাহীনেরা বেঁচে থাকে ঐ ক্ষমতাশালীদের যে ক্ষমতা আছে তা কল্পনা করে নিয়ে। এরা দুই পক্ষই বড় বড় কথা বলে, ফাঁকা আওয়াজ ছাড়ে, কিন্তু ওদিকে এদের আন্ডারওয়্যারগুলো নোংরা, এদের প্রার্থনার পোশাকগুলো ধার করা, এদের বিচারালয়ে পর্নোগ্রাফি পড়ে থাকে সবার চোখের সামনে, এদের ন্যায়বিচারের মধ্যে মানুষ মেরে ফেলাও ন্যায়বিচারের লক্ষণ হিসেবে পড়ে। পার্থিব ক্ষমতাই শেষ কথা, বাকি সব দার্শনিকতা, ধর্ম, আন্দোলন -- সব ফাঁকা বুলি; কাফকা খুব ভালোভাবে সেটা বুঝেছিলেন। তাঁর ভাষায় এটাকেই তিনি বলেছিলেন, তিনি তাঁর সময়ের ‘নেতিবাচকতা’কে বুঝেছেন ও সেটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

যারা একবার কাফকা পড়েছেন তারা যে মুহূর্তে ধরে ফেলেন যে, কাফকা ‘বুঝেছিলেন’, কাফকা সত্যি জীবন, পৃথিবী, সমাজের সব খেলা ‘বুঝেছিলেন’, তখন তাঁর প্রতি মুগ্ধতা থেকেই তারা আর কখনো কাফকা ছাড়তে পারেন না। একসময় এই পাঠকেরা বুঝে যান যে, ‘কাফকায়েস্ক’ কথাটাও অর্থহীন, এ দুনিয়ার এত অনেক কিছুই ‘কাফকায়েস্ক’ যে, সেটার আর কোনো মানে থাকে না। বেকার যুবক যখন চাকরি পাওয়ার জন্য অফিসগুলোর বারান্দায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায় সেটাও ‘কাফকায়েস্ক’; অসুস্থ রোগী যখন বড় হাসপাতালের বিরাট আয়োজনের মধ্যে কোনো ডাক্তার খুঁজে পায় না, যিনি তার সমস্যাটা বুঝবেন, সেটাও ‘কাফকায়েস্ক’; টিভির পর্দায় ধুম করে যখন আমরা দেখি যে ক্ষমতাশালীরা কী সূক্ষ্ম কৌশলে সাধারণ মানুষের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে, সেটাও ‘কাফকায়েস্ক’, আর আদালতের দলিল-দস্তাবেজের মধ্যে আমরা যখন দেখি যে আমাদের ফাইলটা অসহায়ের মতো পড়ে আছে নিচের দিকে, সেটাও কাফকায়েস্ক; আর গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে মোবাইল ফোন বেজে উঠলে যে ভয় নিয়ে আমরা সেটা ধরি, আর শুনি ওপাশে, পৃথিবীর কোন প্রান্ত থেকে কে যেন বলে উঠছে ‘হ্যালো’, সেটাও ‘কাফকায়েস্ক’।

আমরা পছন্দ করি কি না-করি, কাফকা আমাদের এই আধুনিক সংস্কৃতির এক অমোচনীয় অংশ হয়ে গেছেন। নিরাপত্তাহীনতা আর আতঙ্কের যে বোধ কাফকা আমাদের মধ্যে জারিত করে গেছেন, আত্ম-উন্নয়নের লাখো বইয়ের কোনোটি পড়েই সেই বোধ আমাদের আর কাটে না। তাঁর ‘সেন্স অব হিউমার’ হাসির ছলে আমাদের দেখিয়ে দেয় যে আমরা কত ভুল, কত বোকা। আমাদের পাপবোধ, হতাশা, ন্যায়বোধ, আশা, পাপমোচন ও ভালোবাসা -- সবকিছুর মধ্যেই কত বড় আধ্যাত্মিকতার অভাব ও ফাঁকি। তাই কাফকার আধ্যাত্মিকতা আমাদের জন্য সান্ত¡না হয়ে আসে। তাঁর কল্পনাশক্তির অদ্ভুত লজিক একই সঙ্গে আমাদের বুদ্ধি ও আবেগকে মথিত করে। আমরা বুঝি যে তাঁর নিজের জীবনের সংকট ও সমস্যাগুলো আমাদেরটার থেকে আলাদা কিছু নয়। আমরা বুঝি যে আমাদের মানবসমাজের হৃদয়টি আছে কাফকার ঐ ছোট কয়টি বইয়ের মধ্যেই। তাই আমরা মুগ্ধ হই, আলব্যের কাম্যুর কথার সঙ্গে একমত হই যে, কাফকা বারবার পড়ার জিনিস। ‘আমরা কী?’ এত বড় প্রশ্নের উত্তর যেহেতু সহজ হওয়ার কথা নয়, তাই আমরা কাফকা বারবার পড়ি-- যুগে যুগে, দেশে দেশে।

অন্য শরীর মূল: ফ্রান্স কাফকা, জার্মান থেকে অনুবাদ: তীরন্দাজ

তীরন্দাজ এর ছবিলিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: সোম, ১৭/১২/২০০৭ - ৭:০৬অপরাহ্ন)

ক্যাটেগরি: উপন্যাস অনুবাদ

প্রথম পর্ব

সারা রাত এক অসুস্থ অস্থিরতায় কাটল। সকালে সে প্রকোপ থেকে জেগে দেখল, নিজের বিছানাতেই বিকট এক পোকায় পরিনত হয়ে গেছে গ্রেগর সামসা। ঢালের মতো মসৃন পিঠ। সে পিঠের উপর মাথাটি একটু উপরে তুলে দেখল, তার একটু ফুলে ওঠা পেটটি ধনুকের মতো খয়েরী রংএর বাঁকা বাঁকা রেখায় ভাগ করা। সে পেট এতোই মসৃণ যে, চাদরটিও সেখানে পিছলে যাচ্ছে বারবার। সরু সরু অনেকগুলো পা গজিয়েছে। সেগুলোর অনিয়ন্ত্রিত ইতস্তত: নড়াচড়াও দেখল চোখের সামনে ।

‘কি হল? আমার এ দশা কেন?’ ভাবল সে। সপ্ন বলেও মনে হচ্ছেনা! নিজের ছোটখাট ঘরটি তো পুরোনো চার দেয়ালের মাঝে আগের মতোই পরিচিত! চাকুরির খাতিরে শহরে শহরে ঘুরে বেড়ানো গ্রেগরের কাজ। নকাশাসহ কাপড়ের যে নমুনাগুলো খোলা হয়েছিল গতকাল, দেয়ালের পাশের টেবিলেই পড়ে আছে সেগুলো । পত্রিকা থেকে কাটা সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটি তার উপরেই ঝুলছে। ঋজু হয়ে বসা পশমের টুপি মাথায় এক মহিলা। গলায় পশমের মাফলার আর হাতে ও বাহুতে কালো পশমের ঢাকনি।

গ্রেগর জানলার দিকে তাকালো। মন বিকল করে দেয়া বিষন্ন একটি দিন, জানলার উপর আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ছাট। ‘এসব ফালতু ভাবনা বাদ দিয়ে আরেকটু ঘুমিয়েই নিই’ ভাবলো সে। কিন্তু তা কতোটা অসাধ্য, টের পেতে দেরী হলো না। ডানপাশে শুয়ে ঘুমোনো বহুদিনের অভ্যাস। কিন্তু শারীরের কাঠামোর কারনে সেদিকে ঘুরতেই পারল না। যতবারই সমস্ত শক্তি দিয়ে ডানদিকে কাৎ হওয়ার চেষ্টা করলো, ততবারই ফিরে আসতে হলো আগেরই চীৎ হওয়া অবস্থায়। একবার দু’বার নয়, প্রায় একশোবার চেষ্টা করলো সে। চোখ বন্ধ করলো প্রতিবারই, যাতে পায়ের অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া দেখতে না হয়। অবশেষ শরীরের ডানপাশে একটি অপরিচিত ভোঁতা যন্ত্রণা অনুভব করে হাল ছাড়তে বাধ্য হলো।

‘হায় খোদা! কি এক বাজে চাকুরী জীবন বেছে নিলাম! প্রতিদিনই ঘোরাঘুরি! আসলেই বাইরের কাজ অফিসে বসে কাজ করার চেয়ে অনেক বেশী কষ্টকর। ঘোরাঘুরির এই কষ্ট তো নি:শেষ করে দিলো আমাকে! ট্রেনের অনিয়িমত যোগাযোগ, প্রতিদিনের অখাদ্য খাবারদাবার, চারপাশের লোকেদের সাথে আত্মাহীন সম্পর্ক আর কতো সহ্য করা যায়! জাহান্নামে যাক সব!’ পেটের উপরের অংশে এক ধরণের চুলকানো অনুভব করলো সে। মাথা তুলে ভালো করে সে আংশটি দেখার জন্যে চীৎ থাকা অবস্থাতেই বিছানার প্রান্তের দিকে গড়িয়ে এলো। দেখলো সাদা সাদা ফুটকুড়িতে ছোট্ট একটি পেটের অংশ। পা দিয়ে সে জায়গাটি একবার স্পর্শ করেই অসহ্য শীতল এক শিহরণে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলো।

বিছানায় আবার আগের অবস্থায় ফিরে এলো। ‘প্রতিদিন এত সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা একটি মানুষকে গর্ধভ বানিয়ে দেয়া জন্যে যথেষ্ট’। প্রত্যেকেরই নিয়মিত ঘুম দরকার। আন্যান্য পরিচিত যারা ঘুরে বেড়ানোর চাকুরী করে, হারেমের মেয়েদের মতো আরামের জীবন তাদের। নিজে যখন প্রতি সকালের শেষে চুক্তিপত্র সই করার জন্যে হোটেলে হোটেলে দৌড়াই, এরা তখন নাস্তার টেবিলে বসেছে মাত্র। আমি যদি এমন করি তাহলে চাকুরীটি মূহুর্তেই খেয়ে নেবে বস। আর তাতে যে কি ভয়ানক অবস্থা হবে আমার, তা ভাল ভাবেই জানি। শুধুমাত্র বাবা-মায়ের মুখ চেয়েই টিকে আছি, নইলে অনেক আগেই ছেড়ে দিতাম সব! বসের সামনে গিয়ে সমস্ত জমানো ক্ষোভ ঝাড়তাম। তার উঁচু মহাসন থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনতাম তাকে। অসহ্য ব্যটার ওই চরিত্র! নিজেকে মহাসনের উপরে বসিয়ে কর্মচারীদের সাথে নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলে! কানে কম শোনে বলে আমাদেরকেই কাছে এগিয়ে যেতে হয় এই ব্যাটার কাছাকাছি। তবে হাল এখনও ছাড়িনি। বাবা-মার ধারগুলো শোধ করে দেবার মতো হাতে যথেষ্ট টাকা জমলেই হলো। আর হয়ত পাঁচ থেকে ছয় বছরের মতো লাগবে। তাখনই নেয়া হবে দরকারী পদক্ষেপ। আপাতত: আমাকে এখন বিছানা ছেড়ে উঠে পাঁচটার ট্রেন ধরতেই হবে‍’।

বাক্সের উপর টিক টিক করে চলছে এলার্ম ঘড়িটি। সে সেদিকে তাকালো। ‘হায় আল্লা’। সাড়ে ছ’টা থেকে পৌঁনে সাতটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির কাটা। সে কি এলার্ম শোনেনি? বিছানা থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, চারটায় এলার্ম দেয়া ছিল। নিশ্চয়ই বেজেও ছিল তখন । এই এলার্মের শব্দে তো ঘরবাড়ী অবধি কেঁপে ওঠে, এর মাঝে কি করে এতটা অঘোরে ঘুমোতে পারল সে? হয়তো এরাতের ঘুমের মাঝে অস্থিরতা থাকলেও গভীরতাও ছিল। কিন্তু এখন তার কি করনীয়? পরের ট্রেনটি ছাড়বে সাতটায়। সে ট্রেন ধরার আশায় এখন তাড়াতাড়ি করেও কোন ফল হবে না আর। নকশাগুলো পর্যন্ত বাক্সে গোছানো হয়নি। নিজেকেও খুব সুস্থ আর সচল বলেও মনে হচ্ছেনা। তাছাড়া ওটি ধরতে পারলেই যে বসের গালাগাল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, সে ভরসাও নেই আর। হারামজাদা পিয়ন সকাল পাঁচটায় তাকে ষ্টেশনে না পেয়ে এতক্ষনে নিশ্চয়ই রিপোর্ট করেছে বসের কাছে। মেরুদন্ডহীন এই পিয়নটিকে বসের এক নম্বর চামচা বলা যেতে পারে ! এখন যদি অসুস্থ বলে ছুটি নেয়, তাহলেও অবিশ্বাস ও সন্দেহ ঘুচবে না। গত পাঁচ বছরের চাকুরী জীবনে একবারও অসুস্থ হয়নি। এবার অসুস্থ বলে জানালে সাথে সাথেই অফিসের ডাক্তার পাঠাবে বস। অলস সন্তানের অজুহাতে বাবা-মাকে ধিক্কার দেবে আর ডাক্তারের বরাত দিয়ে সমস্ত অসুস্থতাকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। অসুস্থতা যে কি, এ ব্যাটা একেবারেই বুঝবে না। তার কাছে এ হচ্ছে কাজে ফাঁকি দেবার ফন্দি। এসব ভাবনার জাল বুনতে বুনতে ও গতরাতের লম্বা ঘুমের প্রভাবে কঠিন ঘোরের মাঝে পড়লো গ্রেগর। সেই সাথে নিজেকে ভীষন ক্ষুধাও পেলো তার।

এসব সিদ্ধান্তহীন নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিছানাও ছাড়েনি ততক্ষনে। ঠিক তক্ষুনি পৌঁনে সাতটার সংকেত বেজে উঠলো ঘড়িতে। বিছানার মাথার দিকের কাছেই দরজা। মায়ের সাবধানী টোকা আর মোলায়েম আওয়াজও শোনা গেল। ‘গ্রেগর, পৌনে সাতটা বাজে, কাজে যাবি না আজ’? উত্তর দিতে গিয়ে নিজের গলার আওয়াজ শুনে হতচকিত হলো গ্রেগর। মূল স্বরটি আগের মতো হলেও নীচ থেকে তীব্র যন্ত্রনাকাতর চিহি চিহি আওয়াজ এসে সে স্বরের সাথে মিশে যাচ্ছে বারবার। উচ্চারণের প্রথম মূহুর্তেই মূল স্বরকে এমনভাবে নষ্ট করছে যে, পুরো শব্দটাকেই অবোধ্য হয়ে যাচ্ছে। গ্রেগর মা কে পুরো আবস্থাটি বর্ননা করতে চাইলেও নিজের অসহায় অবস্থা বুঝে সংক্ষিপ্ত করলো উত্তর। ‘হ্যা, হ্যা মা, ধন্যবাদ। এক্ষুনি উঠছি’। হয়তো দরজাটি কাঠের, তাই তার গলার স্বরের এই অস্বাভাকিতা মায়ের কানে পৌঁছালো না। মা তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে দরজা থেকে বিদায় নিলেন। কিন্তু তাদের এই কথোপকথনে বাড়ীর অন্যান্য সদস্যরাও টের পেলো যে, গ্রেগর সময়মতো বেরিয়ে পড়তে পারে নি। সুতরাং পাশের আরেকটি দরজায় হালকা হাতে ধাক্কা দিলেন বাবা। ‘গ্রেগর, গ্রেগর, উঠছিস না কেন? কি হলো’? তারপর একটু থেমে আবার মৃদুস্বরে ডাকলেন, ‘গ্রেগর, গ্রেগর’। অন্য দরজায় তার বোন এসে ডাকলো,’গ্রেগর, তোর কি শরীর খারাপ’? দু’দিকেই উত্তর দিল গ্রেগর,’হ্যা, আমি তৈরী’। খুব সাবধানে কথা বললো, বিরতিগুলো লম্বা করলো একটু, যাতে তার আওয়াজের অস্বাভাকিত্ব যতোটা সম্ভব কম টের পাওয়া যায়। বাবা তার নাস্তার টেবিলে ফিরে গেলেন। কিন্তু তার বোন তখনো দরজায়। ফিসফিসিয়ে বললো, ‘গ্রেগর, দরজাটা খোল, দেখছি কি হলো’। কিন্তু তার তখনও দরজা খোলার মতো অবস্থা নেই। যাযাবর জীবনের সতর্কতায় বন্ধ ঘরেই ঘুমোতে অভ্যস্ত সে। তাতে স্বস্তি বোধই করলো গ্রেগর।

সর্বপ্রথম উদ্দেশ্য হলো শান্ত থাকা ও কোনরকম বিরক্তিকে পাত্তা না দিয়ে বিছানা ছাড়া। তারপর কাপড় পড়া। বেশ ক্ষিদে পেয়েছে তার, তাই নাস্তা সারাও বেশ জরুরী। সবশেষে ঠান্ডা মাথায় সামনের পদক্ষেপগুলো ভাবা। বিছানায় শুযে শুয়ে হাজার ভেবেও যে কোনরকম কার্যকরী সিদ্ধান্তে আসা যাবে না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। বিছানা ছাড়ার সময় এধরণের হালকা যন্ত্রনা নতুন কিছু নয়। অস্বাভাবিক কোন ভঙ্গীতে শোবার কারণেও হতে পারে। হয়তো তা নিতান্তই মনোগত। তবে আজকের ঘটনাটি কোন দিকে মোড় নিতে পারে ভেবে সামান্য উত্তেজিত সে। গলার স্বরের পরিবর্তন ঘোরাঘুরি ও সর্দি লাগার কারণেই হয়েছে, এব্যাপারে নি:সন্দেহ সে।

গা থেকে লেপটি নামানো একেবারেই সহজ, একটু নড়াচড়া করলেই খসে যাবে। কিন্তু বেশ চওড়া লেপ, তাই যেমন ভেবেছিল গ্রেগর, কাজটি তারচেয়ে কঠিন হয়ে দাড়ালো। উঠে বসার জন্যে হাতে ভর দেয়া দরকার, অথচ সেখানে রয়েছে হাতের বদলে অনেকগুলো শীর্ণ শীর্ণ পা। সে পা’গুলো আবার সারাক্ষনই ইতস্তত: নড়াচড়া করছে । সে নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণও তার ক্ষমতার বাইরে। একটি পা’কে সে সবার আগে সোজা করতে চাইল। অথচ সে পা’ই ভাজ হয়ে গেল বারবার। অন্য একটি পা’কে নিয়ন্ত্রণ কার সম্ভব হলেও বাকীগুলো স্বাধীনভাবে, এক অস্বাভাবিক বেদনাদায়ক উত্তেজনায় এদিক সেদিক নড়াচড়াতেই ব্যতিব্যাস্ত রইল। ‘না, আর কতোক্ষন এভাবে বিছানায় থাকা যায়!’, আপন মনেই বললো গ্রেগর।

প্রথমে সে তার শরীরের নীচের অংশটি নিয়ে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে অংশটিই তার চোখেই পড়েনি। সে আংশের চেহারা কেমন, সে ধারণাও এ অবধি হয়নি তার। চেষ্টা করতে গিয়ে একেই এখন তার কাছে সবচে’ ভারী ও নড়াচড়ার অযোগ্য বলে মনে হলো। উপায় না পেয়ে বন্য শক্তিতে দিয়ে নিজেকে সামনে ঠেলল সে। আর সেটাই ভুল হওয়ার কারণে বিছানার কোনে ধাক্কা লাগলো। জলন্ত এক যন্ত্রণায় অধীর হয়ে টের পেলো, তার শরীরের এই অংশই এমূহুর্তে সবচে’ বেশী স্পর্শকাতর। ব্যাথা পেয়ে এবার শরীরের উপরের অংশটি বিছানা থেকে নামানোর চেষ্টা করলো। সেজন্যে মাথাটি বিছানার প্রান্তের দিকে ঘুরিয়ে আনলো। এতে বেশী পরিশ্রম করতে হলোনা। যদিও তার শরীরের ব্যাপ্তি চওড়া ও ওজনে ভারী, তারপরেও তা ধীরে মাথার সাথে তাল মিলিয়ে ঘোরাতে সক্ষম হলো।কিন্তু মাথাকে আরেকটু বিছানার বাইরে এনেই আরো বেশী ঘুরতে ভয় পেলো সে। যদি বিছানা থেকে নীচে পড়ে, এবং কোন দৈবশক্তির বলে রক্ষা না পায়, তাহলে ভয়ংকর আঘাত লাগবে মাথায়। এর চাইতে বিছনায় পড়ে থাকাও গ্রহণযোগ্য মনে হলো তার।

ক্লান্ত নি:শ্বাসে আবারো আগের মতোই চীৎ হয়ে বিছানায় পড়ে রইল। আবারো দেখলো, তার পা গুলো কোন এক অজানা ক্রোধে পরস্পরের সাথে আরো বেশী যুদ্ধে মত্ত। পায়ের এই অরাজকতায় কোন রকম শৃঙ্খলা আনার উপায় সে খুঁজে বের করতে পারলো না। তারপরও কিছুতেই এভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে চাইল না। এতে যদি সাফল্যের নুন্যতম সম্ভাবনাও থাকে, তাহলে সবরকম কষ্টই মেনে নিতে নিজেকে তৈরী করলো সে। পাশাপাশি এটাও ভুললো না, তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের চেয়ে পরিকিল্পিত ও একমাত্র পরিকল্পিততম চেষ্টাই এঅবস্থায় সবচেয়ে জরুরী। যতোটা সম্ভব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জানলার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো । কিন্তু সেখানেও জমাট বেঁধে আছে সকালের ঘন কুয়াশা আর পাশের বাড়ীর ঘিন্জি দেয়াল। ঘড়ি সাতটা বাজার সংকেত দিল। ‘সাতটা বেজে গেল, এখনও এত কুয়াশা’? মনে মনে বললো সে। ক্লান্ত, ভারী নি:শ্বাস ফেলতে ফেলতে আরো কিছুক্ষন একই ভাবে পড়ে রইল সে। ভাবলো এই নি:স্তব্ধ নীরবতাই যেন তাকে তার পুরানো ও যথার্থ অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার পথে একমাত্র সহায়ক।

পরমূহুর্তেই ভাবল গ্রেগর,’সওয়া সাতটা বাজার আগে যে করেই হোক, বিছানা ছাড়তেই হবে। সাতটায় শুরু অফিস, যে কোন মূহুর্তেই কেউ না কেউ আমাকে খোঁজার জন্য এসে যেতে পারে’। দোলাতে দোলাতে নিজের শরীরকে আড়াআড়ি ভাবে একবারেই বিছানা থেকে নীচে ফেলার চেষ্টা করলো এবার। এভাবে যদি মাথাটি অনেকটা উঁচু করে নীচে পড়তে সক্ষম হয়, তাহলে ব্যাথা না ও পেতে পারে, এমনি আশা হল তার। পিঠ তো শক্ত বলেই মনে হচ্ছে। কার্পেটের উপর পড়লে বিপদজনক কিছু ঘটবে বলে মনে হয়না। যে বিকট আওয়াজ হবার সম্ভাবনা, এ নিয়েই ভাবনা হলো তার। হয়তো চার দেয়ালের আড়ালে সে আওয়াজ তেমন কোন ভাবনার কারণ ঘটাবে না। কিন্তু সাহস করে এই অসাধ্যই সাধন করতে হবে এখন!

নিজেকে প্রায় অর্ধেকটা বিছানা থেকে বের করে এনেছে গ্রেগর। শরীরের দোলুনি তখন যতোনা কষ্টকর, তারচেয়ে বেশী খেলার মতো মনে হলো তার কাছে। শুধুমাত্র পেছন দিকেই হেলে দুলে নড়তে হচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, কারো সাহায্য পেলে কতোই না সহজ হতে কাজটি। তার বাবা আর বাড়ীর আয়া, দু’জনই যথেষ্ট। পিঠের নীচে হাত দিয়ে দু’জনের শক্তিতে টেনে ওঠাতে পারতো, তারপর দু’জনেই মেঝেতে উবু হয়ে তাকে উল্টে দিলেই কাজ সারা। পা গুলোও হয়তো কাজে আসতো তখন। কিনতু এখন সে আশায় গুড়ে বালি! সবক’টি দরজাও বন্ধ। কাউকে সাহায্যের জন্যে ডাকলে কি ভাল হতো ? একথা ভেবে এই নিদারুন শোচনীয় অবস্থাতেও একটি মৃদু হাসি চেপে রাখতে পারলো না।

দুলতে দুলতে একসময় ভারসাম্য বজায় রাখাই অসাধ্য হয়ে দাঁড়ালো। চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার সঠিক সময় এবার! ঘড়ির কাটা তখন সাতটা বিশের ঘরে। ঠিক তক্ষুনি কলিং বেল বেজে উঠলো সদর দরজায়। ‘নিশ্চয়ই অফিসের কেউ একজন’, মনে মনে বললো সে। নিজের পা গুলোর দিকে তাকিয়ে হিম হয়ে গেলো তার ভেতরটা। সেগুলো আরো উত্তেজিত হয়ে আরো দ্রুত এদিক সেদিক নাড়াচাড়া করছে। এক মূহুর্তের জন্যে যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো চারদিক। ‘দরজা খুলবে না কেউ’, কোন এক নিরর্থক বিশ্বাসের উপর ভরসা রেখে ভাবলো সে। কিন্তু পরমূহুর্তেই বাড়ীর আয়ার জোরালো পায়ের আওয়াজ ও দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। সৌজন্য বিনিময়ের প্রথম শব্দটি শুনেই টের পেলো গ্রেগর, এ তাদের অফিসেরই আইনসঙ্গত প্রতিনিধি। এমনি এক সংস্থায় কর্মরত ভেবে নিজের প্রতিই ক্ষোভ হলো তার। সামান্যতেই এত সন্দেহ কেন? সবাই কি অলস আর অকর্মন্য? আজ সকালের পুরো সময়টুকু অফিসের কাজে ব্যবহার করতে না পেরে সে নিজেই আত্মসমালোচনায় জ্বলছে। অথচ বিছানা ছেড়ে উঠার ক্ষমতাও তার নেই। ঘটনা কি জানা এত জরুরী হলে একজন শিক্ষানবিসকে পাঠালেই তো চলতো। এই উকিল ব্যটার নিজে এখানে আসার কি দরকার ছিল? তাদের নিজেদের ভেতরে সন্দেহ, সেজন্যেই এই উকিলেরই উপস্থিতি, এই সহজ সহজ সরল পরিবারের সদস্যদের তা প্রমান করার কোন প্রয়োজন ছিল কি? এসব ভাবতে ভাবতে উত্তেজিত গ্রেগর একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হলো। সমস্ত শক্তি দিয়ে হেলতে দুলতে বিছানা থেকে মেঝের উপর পড়লো। একটা ভোতা আওয়াজ হলেও তেমন বিকট মনে হলোনা। হয়তো মেঝের কার্পেটই সে আওয়াজ কমিয়ে দিয়েছে। হয়তো তার পিঠ শক্ত হলেও স্থিতিস্থাপকতার প্রভাব ছিল। কিন্তু মাথাটি তেমন সাবধানে রাখা গেল না। ব্যাথা পেলো বেশ ও রাগে ও যন্ত্রণায় মাথা কার্পেটে ঘসলো।

‘ও ঘরে মাটিতে ভারী কিছু একটা পড়েছে, আওয়াজ শুনলাম’, বললেন উকিল সাহেব বা’ পাশের ঘর থেকে। ‘এই উকিল হারামী একদিন এ অবস্থায় পড়লে ভালই হতো’, ভাবল গ্রেগর। ‘এ শাস্তি আমার বদলে তারই প্রাপ্য’। হয়তো তার ভাবনার যথাযথ উত্তর দেবার জন্যেই জদ্রলোক পাশের ঘরে জুতোয় মচমচ আওয়াজ তুলে স্থির ভাবে ভাবে এদিক সেদিক পা ফেললেন। ডান পাশের ঘর থেকে তার বোন ফিসফিসিয়ে উঠলো,’গ্রগর, তোমার অফিসের লোক এসেছেন’! ‘জানি’ বিড়বিড়িয়ে বললো গ্রেগর। কিন্তু বোন যে শুনতে পারবে, এতটা উঁচুতেও নিজের স্বরকে তোলার সাহস পেলো না।

‘গ্রেগর’ বা’ পাশের ঘর থেকে ডাকলেন বাবা। ‘তোর অফিসের লোক এসেছেন। জানতে চাইছেন, আজ সকালের ট্রেনে ট্যুরে বেরোসনি কেন। আমরা তাকে কি উত্তর দেব, জানিনা। তাছাড়া উনি তোর সাথে সামনাসামনি কথা বলতে চাইছেন। দরজাটা খোল বাবা! ঘর আগোছালো ভেবে লজ্জা করিস না’। ‘সুপ্রভাত মিষ্টার সামসা’, বললেন উকিল বাবার কথার মাঝই নরম স্বরে। ‘ওর শরীরটা হয়তো ভাল যাচ্ছেনা’, মা বললেন উকিলকে, বাবা তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ‘ওর শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা, বিশ্বাস করুন উকিল সাহেব। তা না হলে গ্রেগর সময়মত ট্রেনে না উঠার মতো ছেলে না। ওর মাথায় তো সারাক্ষণ শুধু কাজ আর কাজ! বিকেলে বাইরে যায় না বলে আমি নিজেই মাঝে মাঝে রাগ করি। এইতো, গত আট দিন শহরে ছিল, প্রতিটি সন্ধ্যায় বাড়ীতেই কাটিয়েছে। সারাক্ষন বাড়ীতে বসে পত্রিকা পড়েছে আর ট্যুরের পরিকল্পনা নিয়েই ব্যাস্ত থেকেছে। এমনকি কাঠ খোদাই এর কাজেও মন বসাতে পারে নি। দুই, তিন সন্ধ্যায় কাজ করে একটি ছোট ফ্রেম শেষ করেছে মাত্র। তার ঘরেই ঝুলছে। দরজা খোলার সাথে সাথেই সেটা চোখে পড়বে আপনার। আপনি যে এসেছেন, তাতে আমি খুব খুশী হয়েছি উকিল সাহেব। আমাদের কথায় গ্রেগর কিছুতেই দরজা খুলতো না। যদিও তার অনেক গোয়ার্তুমি রয়েছে, তারপরও আজ সকালের ঘটনায় নিশ্চয়ই অনুতপ্ত।‘ ‘আমি এক্ষুনি আসছি’ অনেকটা ভেবে ভেবে আস্তে আস্তে বললো গ্রেগর। কিন্তু কোন নড়াচড়া করলো না, যাতে সবার প্রতিটি কথা পরিস্কার শুনতে পারে। ‘আপনার কথাই ঠিক, মিসেস সামসা। অন্য কোন ভাবনা আমার মাথাতেও আসছে না’ বললেন উকিল সাহেব। ‘তেমন গুরুতর কিছু হয়েছে বলে মনে হচ্ছেনা। এ কথাও মানতে হবে যে, আমাদের মতো কর্মজীবি মানুষদের ভালোমন্দ যা ই হোক না কেন, দ্বায়িত্বের কারণে অনেক সময়েই ছোটখাট অসুস্থতাকে ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে যেতে হয়’। ‘উকিল সাহেব কি এখন ঘরে ঢুকতে পারবেন”?, অধৈর্যে বাবা আরো কয়েকবার টোকা দিলেন দরজায়। ‘না’, উত্তর দিল গ্রেগর। বা’দিকের ঘরে এক বেদনাদায়ক নীরবতা এসে ভর করলো, পাশাপাশি ডানদিকের ঘরে শোনা গেল বোনের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।

সবার সাথে বোনের তো বসার ঘরেই থাকার কথা? মনে হচ্ছে, ঘুম থেকে জেগেছে মাত্র। পোষাক আসাকও হয়তো ঠিকমতো পড়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু কাঁদছে কেন সে? গ্রেগর সময়মতো জাগতে পারে নি, উকিল সাহেবকে ঘরে ঢুকতে দিতে পারে নি, এটা ঠিক। কিন্তু তাতে কাঁদার কি আছে? তার চাকুরী গেলে, বস বাবার উপর পুরানো দেনা কথা তুলে চাপ সৃষ্টি করবে, সেজন্যে ভয় পাচ্ছে সবাই? কিন্তু এই ভয়ের কোন কারণ থাকতে পারে না। সে এখনো সবার পাশাপাশি। সে তো সর্বক্ষন এই পরিবারে মঙ্গলের জন্যেই যা সম্ভব করে এসেছে। সামনেও করে যাবে। কিন্তু এই মুহুর্তে যে অবস্থায় কার্পেটের উপর পড়ে সে, তা চোখে পড়লে পরিবারের কেউই কিছুতেই উকিল সাহেবকে এ ঘরে ঢোকানোর দাবী করতে যেত না। অভদ্রতা হচ্ছে, এই অজুহাতে কিছু করা ঠিক হবে না। পরে সুবিধামতো উত্তর খুঁজে বের করে নিলেই হবে। আপাতত: বিরক্ত না করে বোনকে ঠান্ডা মাথায় কাঁদতে দেয়াই ভালো। কিন্তু তারপরও গভীর অনিশ্চয়তা এসে ভর করলো তার মাথায়।

‘মি সামসা’, বেশ জোর আওয়াজে বললেন উকিল। ‘কি ব্যাপার? আপনি নিজেকে ঘরে বন্ধ করে রাখছেন। হ্য বা না বলে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। এতে নিজের বাবা মাকেও কঠিন দূর্ভাবনার মাঝে ফেলছেন। সেই সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এই অসামাজিক ব্যাবহারে আপনি আপনার কর্তব্যকেও অবহেলা করছেন। আপনার বাবা মা ও বসের পক্ষ থেকে আপনার এই ব্যাবহারের কারণ দর্শানোর দাবী করছি আমি। আপনাকে একজন শান্ত ও দ্বায়ীত্বশীল মানুষ হিসেবেই জানি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আপনি আপনার অদ্ভুত ব্যাবহারে আমাদের ধৈর্যশক্তির পরীক্ষা করতে চাইছেন। গতদিনের বিল কোন কারণে জমা করেন নি আপনি। এবিষয়ে আমাদের বস আজ সকালে আপনার অক্ষমতা ও ভুলের কথা তুলে নিজের ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছেন। আমি স্পষ্ট ভাবে তাঁকে বুঝিয়েছি যে, আপনি তাতে দায়ী নন। কিন্তু আজ এখানে এসে আপনার এই নিরর্থক গোয়ার্তুমি দেখে আপনার স্বপক্ষে একটি কথা বলারও ধৈর্যও হারিয়ে ফেলছি। আপনার এই ব্যাবহার একেবারেই ভদ্রোচিত নয়। সবার সামনে না বলে এসব কথা আপনাকে একান্তভাবেই বলার ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু যেহেতু অযথাই আপনি আমার মুল্যবান সময় নষ্ট করছেন, সেহেতু আপনার বাবা মাকে সে কথাগুলো না শোনানোর কোন কারণ দেখতে পাচ্ছি না। আপনার গত কয়েক মাসের কাজে একটুও সন্তুষ্ট নই। এটা ঠিক, বছরের এই সময়টি ব্যাবসার জন্য সুবিধাজনক নয়। কিন্তু ব্যাবসা একেবারেই বন্ধ থাকবে, বছরের এমন কোন সময় আছে বলে বিশ্বাস করি না। বুঝতে পারছেন জনাব সামসা, বছরের এমন একটি সময় কখনোই থাকতে পারে না’।

‘কিন্তু উকিল সাহেব’, উত্তেজিত গ্রেগর নিজের আবস্থাই ভুলে গেল। ‘এক্ষুনি, এই মূহুর্তেই দরজা খুলছি আমি। সামান্য অস্থিরতা, দুর্বলতার কারণে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি। এখনো বিছানাতেই। অনেকটা ভালো বোধ করছি। এইতো নামলাম বিছানা ছেড়ে। আরেকটু ধৈর্য ধরুন। যতোটা ভাল বলে ভেবেছিলাম ততটা ভাল বোধ করছি না। তারপরেও ঠিক হয়ে যাব। দেখুন, কি দুরবস্থায় পড়লাম হঠাৎ! গতকাল সন্ধ্যায়ও ভালো ছিলাম, বাবা মা ও জানেন। যদিও কিছু একটা অসুস্থতার আভাস পাচ্ছিলাম। হয়তো আগে থেকেই কিছু করা দরকার ছিল। কেন যে অফিসে জানালাম না! কিন্তু বাড়ীতে না শুয়ে থেকেও কাজের মাঝেও সুস্থ হয়ে ওঠা যায়! উকিল সাহেব, আপনাকে অনুরোধ করছি, আমার বাবা মা কে এসবের মাঝে জড়াবেন না। যেসব অভিযোগ আপনি আমার বিরুদ্ধে আনছেন, তার কোন কারনই নেই। এ নিয়ে কেউ আমাকে কখনোই কিছু বলে নি। আমি যে শেষ চুক্তিপত্রটি পাঠিয়েছি, তা হয়তো আপনার চোখেই পড়ে নি। আজই আটটার ট্রেনে বেরিয়ে পড়ছি আমি। কয়েক ঘন্টা বাড়তি বিশ্রামে এখন অনেকটাই তাজা বোধ করছি। অযথা আপনার মুল্যবান সময় নষ্ট করবেন না উকিল সাহেব। আমি নিজেই একটু পরে অফিসে আসছি। দয়া করে বসকে সব জানাকেন ও আমার তরফ থেকে সন্মান দেবেন’।

নিজের কথার অনেকটা গ্রেগর নিজেই বুঝতে পারলো না। বিছানার উপরে নিজের শরীরকে নড়ানো জন্যে যেসব অনুশীলন শুরু করেছিল, তারই সাহায্যে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বাক্সের দিকে। সেখানে ভর দিয়ে নিজেকে দাড়ঁ করানোর চেষ্টা করলো। নিজেকে লুকিয়ে রাখার কথা ভাবলো না। তাছাড়া উকিল সাহেবের সাথে কথাও বেশ জরুরী। যারা ডাকাডাকি করছে, তাকে এভাবে দেখার পর তাদের সামনাসামনি প্রতিক্রিয়া জানার খুব আগ্রহ হলো তার। যদি ভয় পায়, তা তাদের নিজেদের সমস্যা। যদি তাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে, তাহলেও উত্তেজিত হবার কোন কারণ নেই। একটু দ্রুত তৈরী হতে পারলে আটটার গাড়ী সহজেই ধরা সম্ভব। নিজেকে দাঁড় করানোর চেষ্টায় কয়েকবারই মসৃন বাক্সে পিছলে গেল শরীর। তারপরও একসময় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলো। শরীরের নীচের যতই ব্যাথা হলো না কেন, পাত্তা দিল না। এইভাবে একটা চেয়ারে হেলান দিতে পারলো। পা গুলো আকড়ে ধরলো চেয়ারের প্রান্ত। তাতে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন আসার পর উকিল সাহেবের বাকী কথা শোনার জন্যে কান পেতে রইল।

‘তার একটি কথাও কি বুঝতে পেরেছেন? আমাদেরকে কিন্তু বোকা বানানো হচ্ছে!, উত্তেজিত উকিল সাহেব বাবা-মার কাছে অনুযোগ জানালেন। ‘না, হতেই পারেনা’, কাঁদতে কাঁদতে বললেন মা। ‘ও সত্যিই খুব অসুস্থ, আর আমরা তাকে আরো বেশী যণ্ত্রনা দিচ্ছি। গ্রেটে, গ্রেটে”! চিৎকার করে মেয়েকে ডাকলেন মা। ‘মা’ অন্য ঘর থেকে উত্তর দিল মেয়ে। গ্রেগরের ঘর ভেদ করেই দু’জনের কথাবার্তা চললো। ‘এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যা। গ্রেগর খুব অসুস্থ। যাবি আর আসবি! তুই কি ওর গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিস’? ‘পশুর গলার আওয়াজ ছিল ওটা’, বললেন উকিল। মায়ের চিৎকারের চেয়ে অনেক শান্তভাবে ‘আনা, আনা’ বলে বসার ঘর ভেদ করে রান্নাঘরের দিকে ডাক দিলেন বাবা। ‘তাড়াতাড়ি একজন চাবিওয়ালা ডেকে আন’। বাবার কথার সাথে সাথে দু’জনই তাদের স্কার্টে ঘস ঘস শব্দ তুলে বসার ঘরে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। বোন পোষাক এত তাড়াতাড়ি কি করে পড়লো? সদর দরজা খোলার শব্দ শোনা গেলেও বন্ধ করা শব্দ পাওয়া গেলনা। হয়তে দরজা খোলা রেখেই ছুটেছে দু’জন। অতিমাত্রার অশুভ কোন ঘটনায় এটাই স্বাভাবিক।

এবার কিছুটা শান্ত হল গ্রেগর। বুঝতে পারলো, কথা বুঝতে পারলেও তার সমস্যার কিছুটা হলেও কাছাকাছি পৌঁছুতে পেরেছে ওরা। সে যে ভাল অবস্থায় নেই, অন্ততপক্ষে তা বোঝাতে পেরে অনেকটা স্বস্তি পেলো সে। এখন নিশ্চয়ই সবাই সাহায্যে এগিয়ে আসবে। যে আশা ও নিশ্চয়তার সাথে প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো নেয়া হলো, বেশ মনে ধরল তার। মানব সমাজ তাকে আবার নতুন করে গ্রহন করার জন্যে প্রস্তুত। ডাক্তার ও চাবিওয়ালার ভুমিকা সন্মণ্ধে বেশী ভাবনা করলো না সে। কিন্তু এ বিশ্বাস হলো যে, হলো তারা তাকে কার্যকরী কোন সাহায্য করতে পারবে। নিজের সমস্যা খুলে বলার জন্যে নিজেকে তৈরী করা দরকার। তাই একটু গলা খাকারি দিয়ে নিজের স্বর পরিস্কার করার চেষ্টা করলো। সে শব্দও যথাসম্ভব চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করলো। হয়তো তার নিজের কাছেই সে আওয়াজ মানুষের বলে মনে হল না। পাশের ঘরে তখন নি:স্তব্ধ নীরবতা। হয়তো উকিল সাহেবকে নিয়ে বাবা মা টেবিলে বসে ফিসফিস করে এ সমস্যা নিয়েই আলাপ করছেন। এমনও হতে পারে, সবাই তার দরজায় কান পেতে আছেন তার দরজায়।

গ্রেগর ধীরে ধীরে চেয়ারটি দরজার দিকে ঠেলে কাছাকাছি নিয়ে এল। তারপর ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো দরজার উপর। তার পায়ের জোড়ায় আঠালো এক পদার্থ তাকে দরজায় আটকে রাখায় সহায়ক হলো। কয়েক মূহুর্ত বিশ্রাম নিল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। চেষ্টা করলো মুখে কামড়ে দরজার চাবিটি ঘোরানোর। মুখে যে দাঁতই নেই, টের পেলো এবার। হতাশায় ভরে উঠল মন। পরমুহুর্তেই আশাহ্নিত হল এই ভেবে যে, দাঁত না থাকার কারণে মাড়ি হয়তো শক্ত হতে পারে। সে শক্ত মাড়ির চাপেই অবশেষে ঘোরাতে সক্ষম হলো চাবিটি। এত মনযোগী যে, মুখের ভেতর যে ক্ষত তৈরী হচ্ছে, টেরই পেলনা সে। এক বাদামী রং এর তরল পদার্থ মুখ থেকে বেরিয়ে এসে দরজার চাবি বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় মাটিতে পড়লো। ‘শুনতে পাচ্ছেন’? পাশের ঘর থেকে বললেন উকিল। ‘চাবি ঘোরাচ্ছে সে’। গ্রেগরকে কিছুটা সাহস জোগালো এই মন্তব্য। বাবা মা দুজনে মিলে উৎসাহ দিলে আরো ভাল হতো- ‘সাবাশ! গ্রেগর, সাবাশ! আরেকটু! আরেকটু’, ! তার প্রচেষ্টা নিয়েই আগ্রহী সবাই, এই বিশ্বাসে পুরো শক্তিতে চাবিটি যতোনা ঘোরানো সম্ভব হলো, তারচেয়ে কামড়েই ধরলো বেশী। এভাবেই যতটুকু ঘোরাতে পারলো, সে অবস্থায় স্থির রেখে শরীরের পুরো ওজনে তালাটি চেপে, আবার একটু ঘোরালো। অবশেষে তালা খোলার একটি জোরালো আওয়াজে সজাগ হলো ইন্দ্রিয়। ‘চাবিওয়ালার সাহায্যের ছাড়াই পেরেছি’! ভেবে মাথা রাখলো হাতলের উপর দরজাটি খোলার জন্যে।

দরজা খোলার চেষ্টায় নিয়ে এতই মনোযোগী গ্রেগর, চাবি ঘোরানোর পরপরই দরজার একটি পাল্লা যে খানিকটা খুলে গিয়েছিল, তা টেরই পায়নি। মাঝে সে নিজেই পাল্লাটির আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়ে ছিল। এখন সে পাল্লার সাথে নিজের শরীরকে তাল মিলিয়ে ঘোরানো ছাড়া আর কোন পথ রইল না। তাছাড়া বাইরের কারো ধাক্কায় সে নিজেই চীৎ হয়ে মাটিতে না পড়ে, সেদিকেও নজর রাখা দরকার।। নিজের প্রচেষ্টায় এতোই মনযোগী, অন্যরা কি করছে, সেদিকে নজরই ছিল না তার। সেই মুহুর্তে ‘ওফ’ বলে এক চিৎকার ঝড়ের মতো উকিল সাহেবের মুখ ফুড়ে বেরিয়ে এলো। দরজার সবচেয়ে কাছাকাছি থাকায় তিনিই সবার আগে গ্রেগরকে দেখতে পেলেন। বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের সামনে হাতটি ধরে ধীরে ধীরে সরে গেলেন পেছনের দিকে। মনে হলো কোন এক অদৃশ্য শক্তি কোন এক অজানা আকর্ষনে টানছে তাকে। মা সারারাতের এলোমেলো চুলে এতোক্ষন উকিল সাহেবকেই সঙ্গ দিচ্ছিলেন। জোর হাতে ভোতা দৃষ্টিতে বাবার দিকে একবার তাকিয়েই দুই পা এগুলেন গ্রেগরের দিকে। তারপর সবার মাঝখানে স্কার্টটি ছড়িয়ে এলিয়ে পড়লেন মাটিতে। মাথাটি অবশ হয়ে ঝুলে রইলো বুকের উপর। বাবা কোন এক অদৃশ্য শত্রুকে হাত তুলে গালাগাল করলেন। মনে হলো গ্রেগরকে ঠেলে আবার ঘরের ভেতরই পাঠিয়ে দিতে চাইছেন। বসার ঘরে থেকেই ভীক,অচেনা দৃষ্টিতে ইতস্তত: চোখ ফেললেন, তারপর দুই হাতে চোখ ঢেকে ভেঙ্গে পড়লেন কান্নায়। কান্নার দমকে তার প্রশস্ত বুক কেঁপে উঠলো বারবার।

গ্রেগর বসার ঘরে টোকার চেষ্টা করলো না, বরং দরজার পাল্লার ভেতরের দিকেই হেলান দিয়ে পড়ে রইল। তার অর্ধেক শরীর ও হেলানো মাথাটি পাল্লাটির প্রান্তে বেরিয়ে রইল। এই অবস্থাতেই সতর্ক, হতচকিত, ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সবার দিকে। ততক্ষনে বাইরের পৃথিবী অনেকটা আলোকিত হয়ে উঠেছে। রাস্তার উল্টোদিকের হাসপাতালের একটি অংশ, ধুসর কালো সীমাহীন দেয়ালের পরিধি ও তাতে একটার পর একটা সাজানো অগুনতি জানালা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। অঝোর ঝারায় ঝড়ছে বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটা আরো বেশী বড়, আরো বেশী জোরালো হয়ে মাটির বুকে আছড়ে পড়লো। বাবার জন্যে নাস্তার সময়টি প্রতিদিনের খাওয়াদাওয়ার সবচেয়ে পছন্দের সময়। এ সময়টায় তিনি টেবিলে বসে পত্রিকা ও বিভিন্ন বই পড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে অভ্যস্ত। আজ নাস্তার সব সরন্জাম স্তুপিকৃত হয়ে জমে থাকলো টেবিলে। উল্টোদিকের দেয়ালে গ্রেগরের একটি ছবি। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়ে তোলা। লেফটেনেন্টের পোষাকে তলোয়ার হাতে আত্মবিশ্বাসের হাসি। পোষাক ও চেহারায় নিজের প্রতি সন্মানের দাবী পরিস্ফুটিত। বসার ঘরের দরজা, বাইরের দরজা, দুটোই খোলা পড়ে রইল। এর ভেতর দিয়ে চোখে পড়ছে বাইরের বারান্দা ও নীচে নামার সিড়ির প্রথম অংশ।

একমাত্র গ্রেগরই নিজেকে শান্ত ও সংযত রাখতে পারলো। ‘এক্ষুনি কাপড় চোপড় পড়ে তৈরী হচ্ছি। কারো আপত্তি না থাকলে নমুনাগুলো বাক্সে ঢুকিয়ে এখনই বেরুচ্ছি। দেখুন উকিল সাহেব, আমি গোয়াড়ও নই, কর্মবিমুখও নই। জীবিকার জন্যে ঘুরে বেড়ানো সহজ নয়। কিন্তু টিকে থাকার জন্যে এটাই আমার একমাত্র পথ। অফিসে ফিরে যাচ্ছেন উকিল সাহেব? যান! যা দেখলেন, তাই সরাসরি জানাবেন। আপাতত: আমি একেবারেই কাজে করার যোগ্য নই। কিন্তু এ অবধি যতোটা সাফল্য আমার, তা ভাবার তো এটাই উপযুক্ত সময়। এই সমস্যার মোকাবিলা আমি ঠিকই করবো। তারপর আগের মতোই উদ্দীপনা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়বো নিজের কাজে। এটা ঠিক, বসের প্রতি আমার বিশাল দ্বায়িত্ব রয়েছে। অন্যদিকে বাবা মা ও বোনের জন্যেও আমার অনেক করণীয় রয়েছে। আপাতত: গর্তে পড়েছি, আবার বেরিয়েও আসবো। দেখতে পাচ্ছেন, আমার অবস্থা শোচনীয়। সে অবস্থাকে আরো কঠিন করে তুলবেন না। দয়া করে আমার দিকে নজর রাখুন। যারা শহর বন্দরে ঘোরে, তাদেরকে অপছন্দ করে সবাই। সবাই ভাবে, তাদের বিশাল আয় ও বিলাসবহুল জীবন। এই ভুল ধারণা দুর করার চেষ্টা কেউই করে না। কিন্তু উকিল সাহেব, আপনি নিশ্চয়ই অনেক কিছু অন্যদের চেয়ে সুক্ষভাবে দেখার ক্ষমতা রাখেন। গোপনেই বলছি, আমাদের বসের চেয়েও বোঝার ক্ষমতা আপনার বেশী। ওনি মালিক হিসেবে খুব সহজেই অনেক কর্মচারীর বিপক্ষে মতামত প্রদান করতে পারেন। আপনি ভাল করেই জানেন, ট্যুরের জন্যে প্রায় সারাটি বছরবি শহরের বাইরে থাকি। আর সে কারণেই অতি সহজেই যে কোন ধরণের পরনিন্দা, পরচর্চা ও বানোয়াট অভিযোগের শিকার হতে হয় আমাদেরকে। ঘুরে বেড়াই বলে এসব রটণা খবর সময়মতো জানতে পারি না, তাই উত্তরও দেয়া হয়না সবসময়। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে যখন বাড়ী ফিরি, তখন অকারণেই এর তাড়নায় জর্জরিত হতে হয়। চলে যাচ্ছেন উকিল সাহেব? সামান্য হলেও যে আমার কথা বুঝতে পেরেছেন, সে কথা অন্তত স্বীকার করে যান’!

কিন্তু গ্রেগরের বক্তব্যের শুরুতেই উল্টোদিকে ঘুরে গেলেন উকিল সাহেব। তারপর আবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে কম্পিত ঠেঁটে চোখ ফিরিয়ে ওর দিকেই তাকালেন। যতক্ষন কথা বলছিল সে, ততক্ষন এক মূহুর্তও স্থির হয়ে দাঁড়ালেন না। বরং খুব আস্তে আস্তে, মনে হলো কোন এক বিশাল বাধা যেন তাকে অতিক্রম করতে হচ্ছে, সেভাবেই গ্রেগরের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর আচমকা, বসার ঘরের দরজার বাইরে এমনভাবে পা ফেললেন, মনে হলো তার জুতোর তলায় আগুন লাগিয়েছে কেউ। সেখান থেকে বারান্দা পেরিয়ে যেভাবে দু’হাত সামনে বাড়িয়ে যেভাবে এগিয়ে গেলেন সিড়ির দিকে, মনে হলো ওখানেই তার জন্যে অপেক্ষা করছে এক অলৌকিক মুক্তি।

উকিল সাহেবকে এভাবে যেতে দেয়া কিছুতেই যে ঠিক হচ্ছে না, তা বুঝলো গ্রেগর। তার কর্মজীবনে বিপদের শঙ্কা এতে নি:সন্দেহেই আরো বেশী বাড়বে। বাবা মায়ের তো এতোকিছু ভাবার অবকাশ নেই। বহু বছরের অভিজ্ঞতায় তারা ধরেই নিয়েছেন, গ্রেগরের এই চাকুরি তার সারা জীবনের জন্যেই স্থায়ী। তাছাড়া এ মূহুর্তে তাদের সবরকম চিন্তাশক্তির সীমার বাইরের এই সমস্যা নিয়েই ভাবনা সবচেয়ে বেশী। কিন্তু গ্রেগরের বিশ্বাস তখনও নষ্ট হয়নি। উকিল সাহেবকে এক্ষুনি থামাতে ও বোঝাতে হবে! টেনে আনতে হবে স্বপক্ষে! গ্রেগর ও তার পরিবারের ভবিষ্যত তো এরই উপর পুরো নির্ভর করেছে! বোনটি থাকলে ভাল হতো! সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতি। অনেক কেঁদেছে, যখন গ্রেগর মেঝের উপর চীৎ হয়ে পড়ে ছিল। নারীলিপ্সু এই উকিলকে একমাত্র বোনই থামাতে পারতো। বাইরের দরজা বন্ধ করে বসার ঘরে উকিল সাহেবেকে বসিয়ে, ভাল করে বুঝিয়ে মনের ভয় দুর করতে পারতো। কিন্তু এখন সে ও নেই! যা কিছু করার নিজেকেই করতে হবে। তার বক্তব্য উকিল কতটুকু বুঝলেন বা না বুঝলেন, তার নিজের চলার কতটুকু ক্ষমতা আছে বা নেই, এসব না ভেবেই সে দরজার পাল্লা থেকে সরে এলো। তাঁর দিকে এগিয়ে যাবার জন্যে দুই পাল্লার ফাঁকে নিজেকে ঢুকিয়ে দিল। উকিল তখনো হাস্যকর মূর্তিতে বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে। ছোট্ট এক চিৎকারে নিজের ছোট ছোট পায়ের উপর ভর করে মেঝেতে পড়লো গ্রেগর। পড়ার পরেই প্রথমবারের মতো শারিরীক আরাম টের পেল। পা মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই ফিরে পেল গ্রেগর সেগুলো নিযন্ত্রণের ক্ষমতা। আরো খুশী হলো, যখন দেখল, যেখানে যেতে চাইছে, পা তাকে সেখানেই নিয়ে যেতে সক্ষম। সমস্ত যন্ত্রণার সমাধান আর দূরে নয়, মূহুর্তেই এই বিশ্বাসই জাগলো মনে। হেলেদুলে হাঁটার নতুন অভ্যাসে বেশীদুর এগুতেও পারে নি, মা তখনো তার কাছাকাছিই অসাঢ় হয়ে পড়ে আছেন। ঠিক সেই মূহুর্তেই তিনি উপরের দিকে হাত তুলে লাফিয়ে উঠেই চিৎকার করে উঠলেন, ‘সাহায্য কর কেউ, খোদার দোহাই লাগে, সাহায্য কর কেউ’। মাথাটি নীচের দিকে, গ্রেগরের দিকে ফেরানো, মনে হলো ভাল করে দেখতে চাইছেন ওকে। কিন্তু নিজের অজান্তেই সরে গেলেন পেছনের দিকে, পেছনে নাস্তার টেবিলটি দেখতে পেলেন না । কাছাকাছি এসেই কোন এক অচেনা আচ্ছন্নতায় বসে পড়লেন টেবিলের উপর। টেরও পেলেন না যে, নাস্তার সব সরন্জাম, কফির কাপ, বড় জগ ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। ঢক ঢক করে সে জগ থেকে কফি বেরিয়ে ভিজিয়ে দিল কার্পেট।

‘মা, মা’, বলে আস্তে আস্তে উপরে তাঁর দিকে তাকালো গ্রেগর। ঊকিলের কথা ভুলেই গেল এবার। ঢক ঢক করে কফি ছড়াচ্ছে মেঝেতে, সেদিকেও চোখ রেখে চোয়াল উচিয়ে শুন্যে কামড় দিল বারবার। এ দেখে মা আবার নতুন ভাবে চিৎকার করে উঠলেন। ভয়ে টেবিল ছেড়ে পালিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন বাবার বুকের উপর। বাবামায়ের দিক থেকে নজর সরিয়ে বারান্দার দিকে তাকালো গ্রেগর। । উকিল তখন সিড়িতে। রেলিংএর উপর থুতনী রেখে শেষবারের জন্যে একবার পেছন ফিরে তাকালেন। গ্রেগর তার শেষ ক্ষমতা নিয়ে চেষ্টা করলো তার কাছে পৌঁছানোর। উকিল সাহেব হয়তো তা টের পেয়ে থাকতে পারেন, এক লাফে বেশ কয়েকটা সিড়ি পার হয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ী ছেড়ে। ‘হুহ্’ আওয়াজে তাঁর বিকট চিৎকার সিড়িঘরে প্রতিধ্বনিত হলো। বাবা এতক্ষন চুপচাপই ছিলেন। কিন্তু উকিলের এ ধরণের বিদায়ে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। তিনি উকিল সাহেবকে থামানোর কোন চেষ্টা না করে গ্রেগরের প্রচেষ্টায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন। তাড়াহুড়োয় উকিল তার টুপি ও লাঠি সোফায় ফেলে গিয়েছিলেন। বাবা ডান হাতে সে লাঠি ও বাঁ হাতে টেবিলের উপর থেকে একটি পত্রিকা নিয়ে এগিয়ে এলেন । লাঠি নাড়িয়ে নাড়িয়ে তিনি গ্রেগরকে আবার তার ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করলেন। গ্রেগরের কোন অনুরোধ কাজে এলোনা, কোন কাকুতি মিনতি শুনলেন না তিনি। সে যতোই মাথা কাৎ করে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, তিনি ততোই আরো তাকে বেশী শক্তিতে পায়ে ঠেল ঘরের ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন। মা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না। এই শীতের সময়েও জানালা পুরোটা খুলে মাথা অনেকটা বাইরে নিয়ে দুই হাতে মুখ ঢাকলেন। গলি ও সিড়িঘরের মাঝ বেয়ে দমকা বাতাস জানালার পর্দাগুলো এলোমেলো উড়াতে শুরু করলো। টেবিল থেকে পত্রিকার পাতাগুলো সর সর করে আওয়াজ করলো, কিছু কিছু ছড়িয়ে পড়লো মাটিতে। উম্মত্তের মতো হিস হিস আওয়াজ করে তাকে ধাক্কা দিতে থাকলেন বাবা। চেষ্টা করেও দ্রুত চলতে পারলো না গ্রেগর, কারণ পেছন দিকে চলার কোন অনুশীলন তখনো সে করেনি। নিজেকে যদি ঘরে দিকে ঘোরাতে পারতো, তাহলে তাড়াতাড়িই পৌঁছে যেত সেখানে। কিন্তু অস্থির বাবার সামনে সে সময়সাপেক্ষ প্রচেষ্টা শুরু করার সাহস পেল না। যো কোন মুহুর্তে তাঁর লাঠির মারাত্মক আঘাত তার পিঠে বা মাথায় পড়তে পারে, এই চিন্তাতেই আধমরা হয়ে রইল। একসময় ভয়ে কাঠ হয়ে টের পেলো গ্রেগর, পেছনে চলায় দিক নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব হচ্ছেনা তার। তাই কাতর চোখে কাৎ হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে যতো দ্রুত পারে ঘোরার চেষ্টা করলো এবার। যদিও প্রচেষ্টা একেবারেই ধীরগাতির, তারপরও বাবা তার এই সদিচ্ছা টের পেলেন। চাপ সৃষ্টি না করে লাঠিরখোঁচায় তাকে আস্তে আস্তে ঘুরতে সাহায্য করলেন। বাবার এই হিস হিস আওয়াজ কানে অসহ্য লাগলো। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটু বেশী ঘুরে গিয়েছিল। তাই আবার উল্টোদিকে ঘুরে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজা যতোটা খোলা, গ্রেগরের শরীর তা থেকে আরো বেশী চওড়া। কিন্তু বাবা এতোই উত্তেজিত যে, দরজার আরেকটি পাল্লা খোলার চেষ্টাও করলেন না। তার মাথায় উম্মত্ব চিন্তা যতো দ্রুত সম্ভব গ্রেগরকে চেখের সামনে থেকে দুর করা। এই ফাঁকটুকু ভেদ করে ঘরে ঢোকার জন্যে কিছুটা সোজা হওয়া ও সেজন্যে যতটুকু সময় ও প্রস্তুতি দরকার, বাবা তাকে ততটুকু দিতেও রাজী নন। বরং উম্মত্ত চিৎকারে তিনি গ্রেগরকে ধাক্কা দিলেন বারবার । তার এই চিৎকার গ্রেগরের কাছে নিজের বাবার গলার আওয়াজের বলে মনে হলোনা, তাই সেও প্রাণপনে দরজার দিকেই ঝাপিয়ে পড়লো। তার শরীর একপাশে কাত হয়ে গেলো, একটি দিক ক্ষতবিক্ষিত হলো অনেকটা। সাদা দরজায় নোংরা দাগ পড়ল। একসময় দরজার ফাঁকে আটকে গেল সে, নিজের শক্তিতে এগুনোর ক্ষমতাও রইল না। একপাশের পা গুলো শুন্যে কাঁপতে থাকলো, অন্যদিকের গুলো ব্যাথা যন্ত্রণায় মেঝেতে দুমড়ে রইল। একসময় মুক্তির ধাক্কা দিলেন বাবা। সে প্রায় উড়ে রক্তাক্ত শরীরে তার ঘরের ভেতর গিয়ে পড়লো। লাঠির ধাক্কায় দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। তারপর অবশেষে নীরব, নি:স্তব্ধ চারপাশ।

২য় পর্ব

গভীর, ঘন সন্ধ্যায় গ্রেগর তার গভীর ঘুম থেকে জাগলো। কোন ব্যঘাত না ঘটলেও হয়তো সে আরো বেশীক্ষন ঘুমোতে পারতো না। মনে হলো একটা অচকিত পায়ের আওয়াজ ও বসার ঘরের দরজার শব্দই তার ঘুম ভাঙ্গার কারণ। রাস্তার আলো তার ঘরের আসবাপত্রের গায়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। কিন্তু নীচে, যেখানে গ্রেগর লুটিয়ে আছে, সেখানে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। ধীরে ধীরে উঠল সে। শুড়গুলোর ব্যবহার আবিস্কার করার চেষ্টা করলো। সেগুলো ডানে বায়ে ও সামনে স্পর্শ করে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল কৌতুহলে। শরীরের বাঁ’দিকের পুরোটাই একটা লম্বা ক্ষতের মতো । দু’টো পায়ে খুড়িয়ে হাটতে হচ্ছে। একটি পা সকালের ঘটনায় পুরোপুরি ক্ষতবিক্ষত। সেই অবশ পা’টিকে টেনে টেনেই নিতে হলো। তারপরও শুধুমাত্র একটিই পা অবশ, ভেবে বেশ অবাক লাগলো তার।

দরজার কাছাকাছি পৌঁছেই মনে হলো, কোন এক খাবারের গন্ধই তাকে টেনেছে এনেছে। সত্যি সত্যিই একটা দুধের বাটি সেখানে। সাদা রুটির ছোট ছোট টুকরো ভাসছে সে দুধের উপর। সকালের চেয়েও অনেক বেশী ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর গ্রেগর, আনন্দে হাসতে ইচ্ছে হলো তার। মাথা নুইয়ে প্রায় চোখ অবধি ডুবিয়ে দিল দুধে। কিন্তু সাথে সাথেই বিরক্ত হয়ে মুখ উঠিয়ে নিল সে। কিন্তু এ বিরক্তি এ কারনে নয় যে, বা’ দিকের যন্ত্রণায় শরীরের পেশীশিক্ততে টেনে দুধ খেতে অসুবিধা হচ্ছে তার। দুধ খুবই পছন্দের খাবার, সেটা জেনেই হয়তো বোন বাটিটি রেখেছে ওখানে। কিন্তু তেতো মুখে সে খাবার একেবারেই রুচিতে ধরলোনা তার। বেজার মুখে বাটিটি রেখে ঘরের মাঝে ফিরে এলো সে।

দরজার ফাঁক দিয়ে বসার ঘরে বাতি জ্বলতে দেখতে পেল গ্রেগর। সাধারনত: এসময়ে ওঘরে বসে বাবা মা ও বোনকে বিকেলের পত্রিকা থেকে কোন খবর জোর গলায় পড়ে শোনাতেন, আজ সেরকম কোন শব্দই শোনা গেল না। এটা যে তাদের প্রতি সন্ধ্যার রুটিন, তা তার বোন কয়েকবারই বলেছে, এমনকি লিখেও জানিয়েছে। হয়তো এ চর্চা কোন কারণে ক’দিন যাবৎ করাই হয়না। কিন্তু বাড়ীতে লোক থাকা সত্বেও চারপাশের এত বেশী নি:স্তদ্ধতা অস্বাভাবিক মনে হলো তার। অথচ ‘কি এক নিবিড়, নির্ঝন্জাট জীবন এই পরিবারের’! সে নিজেই তো তার বাবা মা ও বোনের জন্যে এমন এক সুন্দর বাড়ীতে এই সাজানো জীবনের কারিগর। অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে নিজে, জীবনের এই করুন, অসহায় পরিস্থিতি, তারপরও একথা ভেবে খুব গর্বিত হলো সে। কিন্তু প্রাচুর্য ও শান্তির এই জীবনের এমনি ভয়াল পরিসমাপ্তি ঘটবে? এই ভাবনায় ডুবে নিজেকে ফিরে পাবার চেষ্টায় অস্থির গ্রেগর তার ঘরের মাঝেই এদিক সেদিক চলাফেরা শুরু করলো।

পুরো সন্ধ্যায় প্রথমবার একটি দরজা ও পরেরবার আরেকটি দরজা অল্প ফাঁক করে একবার খুলেই দ্রুত বন্ধ করে দেয়া হলো। কেউ হয়তো এঘরে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু সাহস হয়নি। গ্রেগর বসার ঘরের দরজার সামনে অগেক্ষায় রইল, যাতে কেউ আসতে চাইলেই তাকে ভেতরে ডেকে আনতে পারে। কিন্তু তার সমস্ত অধীর অপেক্ষাই নিস্ফল হলো। দরজা বন্ধ ছিল সকালে, সবাই এই ঘরে ঢোকার জন্যে উদগ্রীব! এখন এক এক করে দু’টো দরজাই খোলা, অথচ কেউই আসতে চাইছে না। চাবিও বাইরে থেকে আটকানো!

গভীর রাতে বসার ঘরের আলো নেভানো হলো। বোঝা গেল, বাবা মা আর বোন জেগেই ছিল এতক্ষন। তারা যে পা টিপে টিপে নিজেদের ঘরে ফিরছে, সে মৃদু পায়ের আওয়াজও শোনা গেল। অর্থাৎ কাল সকাল অবধি কারো আসার সম্ভাবনা আর নেই। এতক্ষনে গ্রেগর তার সামনের জীবনকে নতুন করে সাজানোর পথ খোঁজার অবসর পেলো । এই উঁচু একটি ঘরে লম্বা হয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে এখন তার ভয় হচ্ছে খুব। অথচ গত পাঁচটি বছর ধরে তার এই ঘরেই বাস। স্বতস্ফুর্তভাবেই একটি সোফার নীচে স্থান খুঁজে পেল সে। পিঠ একটু ঠেকছে উপরে, মাথাও পুরোটা তুলতে পারছে না। তারপরও এই জায়গাটিই তার কাছে সবচেয়ে বেশী নির্ভরযেগ্য বলে মনে হলো। একটু হতাশ হলো এই ভেবে যে, তার চওড়া শরীর সোফার পরিসরে পুরোটা ঢাকলো না।

পুরো রাত সে আধোঘুমে ওখানেই কাটালো। মাঝে মাঝে জেগে উঠলো ক্ষুধায়, কখনো দুর্ভাবনায় কখনো বা নতুন কোন আশার হাতছনিতে। প্রতিবারই একই সিদ্ধান্তে উপনিত হলো যে, যেভাবেই হোক, নিজে শান্ত থেকে পরিবারকে সবরকম যন্ত্রণা থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। আজ সকালে যে পরিস্থিতি তৈরী করতে বাধ্য হয়েছে, এর পূনরাবৃত্তি যাতে আর না হয়।

পরদিন ভোর। বাইরে তখনও কিছুটা অন্ধকার। তখনই গতরাতের সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা প্রমাণের সুযোগ পেলো গ্রেগর। বোন ঘরের দরজাটি একটু ফাঁক করে ভেতরের দিকে তাকালো। চেহারায় টান টান উত্তেজনার ছাপ । প্রথমে গ্রেগরকে সে দেখতে পেলনা। হায় খোদা! কোথায় সে! উড়ে গেল কি? পরমূহুর্তেই সোফার নীচে চোখ গেল তার। গ্রেগরকে দেখে এত বেশী ভয় পেলো যে, সে ভয় সামলাতে না পেরে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। পরমূহুর্তেই নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পেলো সে। তাই সাথে সাথেই আবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। কিন্তু এমন সাবধানে ঢুকলো যে, যেন অপরিচিত কেউ বা মরণাপন্ন কোন রোগীর এ ঘরে বাস। গ্রেগর তার মাথা সোফার প্রান্তে এনে বোনকে দেখলো। দুধটুকু খায়নি সে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ক্ষিদে নেই। এটা কি বুঝতে পারবে সে? বুঝে কি এমন কোন খাবার দেবে, যাতে রুচি হতে পারে? নিজের আত্মসন্মানবোধের বিচারে বোনকে এ নিয়ে কিছু বলার চেয়ে ক্ষিদেয় মরে যাওয়াই নিজের কাছে বেশী গ্রহনযোগ্য। কিন্তু ভেতরে অদম্য ইচ্ছে হলো, সোফার নীচ থেকে বেরিয়ে বোনের পায়ে পড়ে পছন্দসই কিছু খাবার দিতে অনুরোধ করার। তার এই ভাবনার যেন তাল মিলিয়েই বোন অবাক চোখে বাটিটির দিকে তাকাল। সামান্য দুধ পড়ে আছে চারপাশে, কিন্তু প্রায় আগের মতোই ভরা। একটি ন্যাকড়ায় ধরে ওটাকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল সে। কি হাতে নিয়ে আবার ফিরে আসে বোন, এ নিয়ে নানা ভাবনার ছক কাটলো গ্রেগর। কিন্তু কোন কুলকিনারা পেল না। একটু পরে একটি পুরোনো কাগজে উপর সাজিয়ে নতুন কিছু খাবার নিয়ে এল বোন। হয়তো গ্রেগরের রচি পরীক্ষাই করাই তার উদ্দেশ্য। একটুকরো আধপঁচা সবজী, গত রাতের খাবারের উচ্ছিষ্ট হাড়গোড়, যার গায়ে ঠান্ডা ঝোল শক্ত হয়ে লেগে। কয়েক টুকরো কিসমিস আর কাজুবাদাম, এক টুকরো পনির, যা দু’দিন আগে গ্রেগরই অখাদ্য বলে খেতে চায়নি। সেই সাথে আনলো এক এক টুকরো করে শুকনো রুটি, মাখন লাগানো রুটি ও নোনতা রুটি। আর গ্রেগরের প্রতি দয়া করেই হয়তো, খাবারগুলো রেখেই সে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। হয়তো ভাবলো গ্রেগর তার উপিস্থতিতে খেতে অস্বস্তি বোধ করতে পারে। বাইরে থেকে তালা বন্ধ করলো, যাতে তার কোনরকম সংকোচ না হয়। খাবারের কাছে যাবার সময় দূর্বলতায় সবগুলো পা কেঁপে উঠলো তার। কিন্তু শরীরের অন্যান্য স্থানে যে সব ক্ষত তৈরী হয়েছিল, সেখানে কোন ব্যথা টের পেল না। গ্রেগর অবাক হলো খুব। এক মাসেরও বেশী আগে ছুরির খোঁচায় আঙ্গুল কেটেছিল সামান্য। গত পরশু অবধিও টের পেয়েছে সে যন্ত্রণা। এখন সে যন্ত্রণা আর নেই।‘আমার অনুভুতি কি ভোতা হয়ে গেল’? ভাবতে ভাবতেই লোভীর মতো পনিরে মুখ দিল সে। এই পনিরের টুকরোটিই সমস্ত খাবারের মাঝে সবচেয়ে সুস্বাদু মনে হলো তার। খাবার আনন্দে চোখে জল এলো । পনির, সবজী ও ঝোলের পুরোটাই সে খেয়ে ফেললো, অথচ তাজা খাবার খাওয়ার কোন রুচিই তার হলোনা, এমনকি সেগুলোর গন্ধও তার সহ্য হলোনা। পছন্দের খাবারগুলো তাজা খাবার থেকে দুরে সরিয়ে এনে দ্রুত খাওয়া শেষ করে আলস্যে একই জায়গায় পড়ে রইল সে। বোন ধীরে ধীরে চাবি ঘুরিয়ে ভেতরে আসার ইঙ্গিত দেওয়ায় চমকে উঠলো গ্রেগর। টলতে টলতে হলেও তাড়াতাড়ি আবার সোফার তলায় জায়গা নিল সে। যেটুকু সামান্য সময় বোন ঘরে ছিল, সে সময় সোফার নিচে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার। অতিরিক্ত খাবারে শরীর কিছুটা ফেঁপে ওঠায় সোফার নীচের সংকীর্ন জায়গায় নি:শ্বাস নেয়া সহজ ছিল না। এই শ্বাসকষ্টের মাঝে বড় বড় চোখে দেখলো সে, শুধুমাত্র ইতস্তত: ছড়ানো খাবারই নয়, যে খাবার গ্রেগর ছোঁয় নি, সেগুলোও ঝাট দিয়ে দ্রুত একটি বালতিতে পুরলো বোন। তারপর একটি ঢাকনায় বালতিটি ঢেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বোন চলে যাবার পরমূহুর্তেই সোফার নীচ থেকে বেরিয়ে এল গেগর। নিজের শরীর টান টান ও প্রসারিত করলো।

এভাবেই গ্রেগরকে প্রতিদিন তার খাবার দেয়া হলো। সকালে একবার, যখন বাবা মা ও আয়া ঘুমে। আরেকবার সবার দুপুরের খাবারের পর, যখন বাবা মা আগের মতোই ঘুমে। আয়াকে পাঠিয়ে দেয়া হতো কোন এক কাজের আজুহাতে বাড়ীর বাইরে। সে ক্ষিদের কষ্টে ভোগে, তা নিশ্চয়ই চাননি বাবা ও মা। সে খেতে পাচ্ছে, এটুকু জেনেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো ওদের। তাছাড়া গ্রেগরের কাছাকাছি আসার সাহস হয়তো ওদের ছিলনা। এমনও হতে পারে বোনও তা চাইতো না। তাতে তাদের এই অসহনীয় কষ্ট আরো বেশী বেড়েই যেতো।

কি অজুহাত দাঁড় করিয়ে সেদিন সকালে ডাক্তার ও চাবিওয়ালাকে বাড়ী থেকে বিদায় করা হলো, তা আজ অবধি জানতে পারে নি গ্রেগর। তার কথাই তো বোঝেনা কেউ। অন্যদের কথা যে সে বুঝতে পারে, তা কারোরই মনে আসেনি। এমনকি বোনের মনেও আসে নি। সেকারণে প্রতিবারই যখন সে এ ঘরে আসতো, গ্রেগরকে কখনো তার দীর্ঘশ্বাস ও কখনো সখনো ‘হায় খোদা’ জাতীয় বিলাপ শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। তার এ অবস্থায় পুরো মেনে নেবে সে, সে আশা করা করার প্রশ্নই আসে না। তারপরও কিছুটা অভ্যস্ত হবার পর সে একটা দু’টো ভাল মন্তব্যও করলো। গ্রেগর পরিস্কার করে পুরো খাবার খেয়ে নিলে বলতো,’আজ দেখি ভালই খেয়েছে’! উল্টোটা হলে বলতো, ‘আজ সবই রয়ে গেল’!

বাইরের জীবনের কোন খবরই পেতো না সে। তাই মাঝে মাঝে পাশের ঘরে কান পাততো গ্রেগর। সে ঘরে কোন আওয়াজ শুনলেই, দরজায় ছুটে যেত । নিজেকে দরজার সাথে সেটিয়ে কথা শোনার চেষ্টা করতো। প্রথম দিকে তাকে নিয়ে কোন কথাই হতো না। এ অবস্থায় কি করণীয়, এ নিয়েই আলোচনা চললো প্রথম দু’ দিন। দু’বেলা খাবারের মাঝামাঝি সময়েও একই বিষয়। কমপক্ষে পরিবারের দু’জন সদস্য সবসময়েই বাড়ীতে থাকতো। একা থাকার সাহস হতোনা কারো। আর পুরো বাড়ী খালি রাখার প্রশ্নই আসে না। বাড়ীর আয়া পুরো ঘটনা সম্পর্কে কতটা অবহিত, তা জানা যায়নি। তবে প্রথম দিনই সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে মা কে অনুরোধ করলো তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে। এতে তার কি বিরাট উপকার হলো, পনেরো মিনিট পর কাঁদতে কাঁদতে তা জানিয়ে বারবার ধন্যবাদ জানালো। তারপর কেউ কোন অনুরোধ করার আগেই সমস্ত ঘটনা গোপন রাখার কঠিন শপথ জানিয়ে বিদায় নিলো।

আয়া বিদায় নেবার পর মায়ের সাথে রান্নাবান্নার দায়িত্ব পড়লো বোনের হাতে। সে রান্নাবান্না করা তেমন কঠিন হলোনা, কারন খাওয়ার রুচি ছিলনা করোরই। প্রায়ই একজন আরেকজনকে আরেকটু খেতে অনুরোধ করতো। ‘ধন্যবাদ, যথেষ্ট খেয়েছি’, এধরণের উত্তর ছাড়া অন্য কোন উত্তর শোনা যেত না কখনোই। মাঝে মাঝেই বোন বাবাকে জিজ্ঞেস করতো, তার একটা বিয়ার চাই কি না। নিজেই এনে দিতে চাইতো। তারপরও বাবার কোন উত্তর না পেলে বাড়ীর কেয়ার টেকার কে দোকানে পাঠানোর কথা বলতো, যাতে বাবার কোন অস্বস্তি না হয় । একসময় বাবার দৃঢ় অসম্মতির পর এ আলোচনার সমাপ্তি ঘটতো।

প্রথম ক’দিনের মাঝেই বাবা তাদের তাদের আর্থিক অবস্থা ও সম্ভাবনার কথা মাকে ও একই সাথে বোনকেও তুলে ধরলেন। সুযোগ পেলেই তার ছোট বাক্স নিয়ে টেবিলে বসতেন। তার পাঁচ বছর আগের ব্যাবসায়িক বিপর্যয় থেকে এই বাক্সটিই বাঁচাতে পেরেছিলেন। এতে ছিল কিছু বিভিন্ন রশিদপত্র ও প্রমানের নথি। বাক্সের জটিল তালা খোলা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বের করা ও আবার তালা বন্ধ করার আওয়াজ পাওয়া যেত। বাবার এই কর্মপ্রবাহ ছিল গ্রেগরের জন্যে তার বন্দীজীবনের সর্বপ্রথম আনন্দের খোরাক। তার ধারণা ছিল, বাবা তার নিজের ব্যবসা থেকে কিছুই বাঁচাতে পারেন নি। বাবাও তার এই ধারণার বিপক্ষে কখনোই কিছু বলেন নি। সে নিজ থেকে এর চেয়ে বেশী জানতে চায়নি। তার একমাত্র চিন্তা ছিল তখন, বাবার এ ব্যাবসায়িক বিপর্যয়ে পুরো পরিবার যে নিদারুন হতাশায় ডুবে ছিল, তা যথাসম্ভব ভুলিয়ে দেওয়া। নিজের ভেতরে কোন এক বিশেষ দহনের জ্বালায় চাকুরীতে যোগ দিয়েছিল সে। তাই সাধারণ শিক্ষানবীস থেকে খুব তাড়াতাড়িই এক যাযাবর দালাল হয়ে গেল। ভালো আয় করার সুযোগ ও দালালীর নগদ টাকাপয়সা হাতে আসতে থাকলো। ব্যাবসার খুব সুবিধাজনক সময় ছিল তখন । পরবর্তী সময়ে কখনোই এতোটা প্রাচুর্য ও জৌলুস ফিরে আসেনি। তারপরও গ্রেগর যতোটা আয় করতো, তার তার পুরো পরিবারের ভরণপোষনের জন্যে যথেষ্টই ছিল। পুরো পরিবারের ভরণপোষণের দ্বায়িত্ব তার হাতেই, একদিকে যেমন গ্রেগরের, অন্যদিকে তেমনি তার পরিবারের জন্যেও তা অভ্যাসে পরিনত হল। অন্যরা যেমন আনন্দের সাথে নিত, তেমনি গ্রেগরও দিয়েই আনন্দ পেত। কিন্তু এই দেয়ানেয়ার মাঝেও আন্তরিকতার অভাব ছিল স্পষ্ট। মনের দিক থেকে একমাত্র বোনটিই তার কাছাকাছি রইল। বোনের গান বাজনার প্রতি উৎসাহ। ভালো বেহালা বাজাতে পারে। যদিও ভীষন ব্যয়বহুল, তারপরও পরিকল্পনা ছিল সামনের বছর ওকে সঙ্গীত কলেজে পাঠানোর। প্রতিবারই অল্প সময়ের জল্যে যখন শহরে থাকতো গ্রেগর, বোনের সাথে নানা আলোচনায় সঙ্গীত কলেজের কথাই উঠতো বারবার। তখনও সে পরিকল্পনা ছিল এক সপ্নের মতোই। এর বাস্তবায়নের চিন্তা তখনও অনেক দুরে। বাবা মা এ বিষয়ে কোন কথাই শুনতে চাইতেন না। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল গ্রেগর। বড়দিনে সেকথা বাবা মা কে জানাতে মনে মনে তৈরীও হচ্ছিল।

দরজায় লেপ্টে কান পেতে থাকার সময় এসব চিন্তা ভাবনাই তার মাথায় খেলা করতো। যদিও জানতো, এই বর্তমান অবস্থায় এসব ভাবনা কল্পনার বিলাস মাত্র। মাঝে মাঝে স্বাভাবিক ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে শ্রবনশক্তি কাজ করতো না, তখন নিজের অজান্তেই মাথা খুঁটতো দরজায়। নিজেকে সামলে নিত সাথে সাথেই, কারন এ দুর্বল শব্দটিও সবার মনযোগ আকর্ষন করতো। চুপচাপ হয়ে যেত সবাই। কিছুক্ষন পর বাবার মুখে শোনা যেত,’ না জানি আবার সে কি করছে’? কিছুটা বিরতির পর আবার শুরু হতো অসমাপ্ত আলোচনা।

অনেক কিছুই জানতে পারলো গ্রেগর। বাবা একই কথার পূণরাবৃত্তি করতেন। এর একটি কারন, এসব বিষয় নিয়ে তিনি অনেক দিন যাবৎ না ভেবেই অভ্যস্ত। আরেকটি কারণ, মা সহজে সব বুঝে উঠতে পারতেন না বলেই বারবার বলতে হতো। নানা বিপর্যয়ের পরও পুরোনো সময়ের কিছু টাকাপয়সা জমা ছিল বাবার, যা সুদেআসলে বেশ ফেঁপে উঠেছে। সামান্য নিজের জন্যে রেখে পুরো টাকাপয়সা পতিমাসে বাবার হাতে তুলে দিত গ্রেগর। সে টাকার পুরোটা খরচ না হওয়াতে জমে জমে বেশ বড় একটা অঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গ্রেগর দরজার আড়ালে বসে এই আশাতীত সাবাধানতা ও মিতব্যায়িতার কথা শুনে পরিতৃপ্ত হয়ে মাথা নাড়লো। আসলে এ টাকায় তার বসের কাছে বাবার যা দেনা, সবই শোধ করা যেত। তাতে এই যাযাবরের কাজটি ছাড়াও সহজ হতো তার জন্যে। তারপরও এখন বাবা যা করেছেন, তা নি:সন্দেহে আরো বেশী জরুরী।

কিন্তু এই জমা টাকার সুদে পুরো পরিবারের খরচ চালানো অসম্ভব। হয়তো দু’বছর চালানো যাবে, এর বেশী নয়। সাধারণ বিচারে এই টাকাটি খরচ না করে কোন বিপদ আপদের জন্যেই জমা রাখারই কথা। সংসারের চালানোর জন্যে কারো উপার্জন দরকার। যদিও বাবা শারিরীকভাবে সুস্থ, তারপরও তার বয়েস হয়েছে যথেষ্ট। গত পাঁচ বছরে কোন চাকুরী করেন নি, তাই নিজের উপর বেশী আস্থা থাকার কথাও নয়। গত পাঁচটি বছরই ছিল তার ব্যার্থ ও পরিশ্রান্ত জীবনের প্রথম ছুটি। এখন বেশ মোটা হয়েছেন ও চলাফেরায়ও জড়তা এসেছে। বৃদ্ধা মা কাজ করবেন? তিনি তো হাঁপানীর রোগী। ঘরের ভেতর সামান্য চলাফেলার পরই হাঁপাতে থাকেন। শ্বাঁসকষ্টের কারণে জানালা খুলে সোফায় এলিয়ে পড়েন। বোন আয় করবে? তার তো মাত্র সতেরো বছর বয়েস। এ পর্যন্ত জীবনে যতটুকু শিখেছে, তা হচ্ছে, ভাল কাপড়চোপড় পড়া, বেশী বেলা করে ঘুমোনো, মাঝে মাঝে সাংসারিক অলোচনায় মতামত দেয়া ও বেহালা বাজানো। যখনই পাশের টাকাপয়সা সংক্রান্ত কোন কথাবার্তা হতো, চামড়ায় মোড়া শীতল সোফায় গা এলিয়ে দিত গ্রেগর। এসব আলোচনা শুনে লজ্জায় ও নিজের অক্ষমতায় গা ঘেমে উঠতো তার।

প্রায়ই সারারাত ঘুম হতোনা তার। সোফার নীচে শুয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা উপরের চামড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে খুব পরিশ্রম করে সোফাটি জানালার কাছে টেনে নিয়ে যেত। সোফার উপর ভর করে এলিয়ে থাকতো জানালায়। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটো, তারপরও হয়তো জানালার কাছে পুরোনো কোন স্মৃতি জড়ানো ছিল। একটু দুরের জিনিসও সময়ের সাথে সাথে আবছা হয়ে উঠলো তার চোখের সামনে। রাস্তার উল্টো দিকের হাসপাতাল, যা প্রতিদিনই চোখের সামনে পড়ায় বিরক্ত হতো আগে। এখন সেটা আর দেখতেই পেত না। শহরের ভেতরে শার্লোটেনস্ট্রীটে তাদের বাড়ী। তা যদি জানা না থাকতো, তাহলে মনে হতো, এমনি এক খোলা প্রান্তরে বাড়ী ওদের, যেখানে ধুসর আকাশ আর ধুসর মাটি এক হয়ে আছে। দু’বার তার বোন সোফাটি জানালার সামনে দেখার পর, প্রতিবারই ঘর পরিস্কার করে সোফাটি নিজেই সেখানে ঠেলে নিয়ে যেত। জানালার একটি পাল্লাও খুলে রাখতো।

গ্রেগর যদি গ্রেটেকে তার কথা বোঝাতে ও ধন্যবাদ জানাতে পারতো, তাহলে তার সাহায্য নেয়াও অনেকটা সহজ হতো তার জন্যে। কিন্তু তা না করতে পেরে নিজের অক্ষমতায় নিজেই কষ্ট পেতো সে। বোনও চেষ্টা করতো এই বেদনাদায়ক পরিস্থিতি যতোটা সম্ভব সহনীয় করার। হয়তো সময়ের প্রবাহের সাথে সাথে তাতে কিছুটা সক্ষমও হয়েছে। এসবের পাশাপাশি গ্রেগরেরও এর মাঝে অনেক বিষয় আরো বেশী ষ্পষ্ট দাগ কাটলো। গ্রেটের জন্যে ঘরটিই যেন ভয়ংকর! ঢোকার পরপরই বোন দ্রুত তার কাজগুলো সেরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করার জন্যে ব্যাস্ত হয়ে পড়তো। খুব চেষ্টা করতো, যাতে গ্রেগরের সামনাসামনি পড়তে না হয়। জানলার কাছে গিয়েই তড়িঘড়ি আওয়াজ করে খুলতো সেটি। বাইরে বেশ ঠান্ডা থাকলেও এমন ভাবে জানালার কাছে গিয়ে বুক ভরে নি:শ্বাস নিত, যেন শ্বাসকষ্ট ভুগছে সে। বোনের এই অস্থিরতা ও ধুম ধারাক্কা ভাব দিনে দু’বার আতঙ্কিত করতো ওকে। সে সময়টিতে ভয়ে সোফার নীচে কাঁপতে থাকতো।

তার রূপান্তরের এক মাস পেরিয়ে গেছে প্রায়। এতদিনে অবশ্যই গ্রেগরের চেহারা বোনের গা’সওয়া হয়ে যাবার কথা। একদিন বাঁধাধরা সময়ে একটু আগেই ঘরে ঢুকলো বোন। গ্রগর খুব বিষন্ন মনে জানলার এলিয়ে তাকিয়েছিল বাইরে, বোন ঘরে আসায় চমকে উঠলো খুব। এক্ষুনি তো জানালা খুলতে চাইবে সে, আর নিজে সোফা সহ সেখানে জানলায় যাবার পথ বন্ধ করে! কিন্তু বোন ঘরে ঢুকে সাথে সাথেই বেরিয়ে গেল। দরজার তালা আটকে দিল। গ্রেগরের চমকানোর ভঙ্গী দেখে মনে হতে পারে যে, সে তার বোনকে কামড়ে দিতে চেয়েছিল। গ্রেগর ভয়ে সাথে সাথেই সোফার তলায় গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। কিন্তু সেদিন গ্রেগরকে দুপুর অবধি ওর জন্যে অপেক্ষা করতে হলো। দপুরে আগের চেয়ে অনেক বেশী অস্থির দেখা গেলো বোনকে। এতে বুঝতে শিখলো গ্রেগর, তার এই চেহারা বোনের জন্যে আজ অবধি সহনীয় নয় ও খুব দ্রুত যে সহনীয় হবে, সে আশাও করা যেতে পারে না। এ ঘটনার মনে হলো, সোফার বাইরে তার শরীরের যে অতি ছোট অংশ চোখে পড়ে, সেটুকুও তার বেরিয়ে যাবার কারণ হতে পরে। তাই একদিন প্রায় চার ঘন্টার পরিশ্রমে সোফার উপর একটি চাদর এমন ভাবে বিছাতে সক্ষম হলো, যাতে সে নিজে সোফার নীচে পুরোপুরি আড়ালে পড়ে এবং বোন উবু হয়েও তাকে দেখতে না পায়। এভাবে নিজেকে ঢাকার দরকার নেই, এটা ভাবলে তো বোন সে চাদর নিজেই সরিয়ে দিত। এমনভাবে অন্ধকারে পড়ে থাকা কারো জন্যোই আনন্দের নয়। কিন্তু বোন চাদরটি যেভাবে ছিল, সেভাবেই রেখে দিল। বরং একবার গ্রেগর চাদরটি সামান্য নাড়িয়ে এক পলক বাইরে তাকিয়ে বোনের চেহারায় কৃতজ্ঞতা ছাপই দেখতে পেলো।

প্রথম দুই সপ্তাহ বাবা মা একবারও এঘরে ঢোকেন নি। হয়তো তাদের সে মানসিক শক্তি তৈরী হয়নি ততদিনে। মেয়েকে তার কাজের খুব প্রশংসা করতেন, যদিও এর আগে অকর্মন্য বলেই গালাগালে অভ্যস্ত ছিলেন। মেয়ে ভেতরে ঢুকলে দু’জনেই গ্রেগরের ঘরের দরজার সামনে অপেক্ষা করতেন। কাজ শেষ করে ঘরের বাইরে আসার সাথে সাথেই মেয়ের কাছে বিস্তারিত জানতে চাইতেন, ঘরটি কেমন অবস্থায়, গ্রেগর খেয়েছে কি না, তার ব্যবহার কেমন ছিল, তার সুস্থ হওয়ার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে কি না, এসব। অন্যান্যদের তুলনায়, মা ই সবার আগে তাকে দেখতে আসতে চাইলেন। কিন্তু খুব আঘাত পেতে পারেন এ ভেবে বাবা ও বোন, দুজনেই জোর আপত্তি জানালো । খুব মনযোগ নিয়ে এ আলোচনা শোনার পর গ্রেগর নিজেও মনে মনে এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালো। ক’দিন পরেও মাকে জোর করেই আটকে রাখতে হলো। ‘আমাকে যেতে তোমরা গ্রেগরের কাছে, আমার অভাগা সন্তানের কাছে। তোমরা কি টের পাওনা, আমাকে এখন খুব দরকার ওর’, বলে চিৎকার করলেন মা। তখন গ্রেগরের মনে হলো, মার যত্নেই হয়তো বেশী ভাল হতো ওর, ওকে বোনের চেয়ে আরো বেশী বুঝতে পারতেন হয়তো। বোন তো এখনো একটা শিশুর মতোই ও শিশুসুলভ চপলতার কারণেই এমন একটি গুরু দ্বায়িত্ব মাথায় নিয়েছে।]

মা কে দেখার ইচ্ছে পূরণ হলো বেশ তাড়াতাড়িই। বাবা মায়ের কথা ভেবেই গ্রেগর দিনে জানালার কাছে যেতে চাইতো না। ছোট্ট একটি ঘরের মেঝেতে নাড়াচড়াও তেমন বেশী হতো না, রাতে চুপচাপ শুয়ে থাকাও অসহ্য, খাবারও বিস্বাদ। নিজের অজান্তেই নতুন এক অভ্যাস তৈরী হলো তার। এদিক সেদিক দেয়াল বেয়ে বেয়ে কড়িকাঠে ওঠা। নীচে শোওয়ার চেয়ে কড়িকাঠে ঝুলতে ভাল লাগতো। ভাল নি:শ্বাস নেয়া যেত, হালকা এক তরঙ্গ বয়ে যেত শরীরে। আনন্দে আত্মভোলা হয়ে একদিন নীচে পড়ে নিজেই অবাক হলো। তার শরীরের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা আগের চেয়ে অন্যরকম, এত উঁচু থেকে পড়েও কোন ব্যাথা পেলো না। নিজের জন্যে নতুন এক আনন্দের উপকরণ খুঁজে পেয়েছে গ্রেগর, তা বোনের চোখ এড়ালো না। তার শরীরের আঠালো পদার্থের দাগ দেখা গেল সর্বত্রই। হামাগুড়ি দিতে গ্রেগরের যাতে আরো বেশী জায়গা হয়, সেজন্যে বোন চাইল ঘরের কিছু আসবাব, টেবিল ও বাক্সটি সরিয়ে দিতে। একা কাজটি করার মতো শক্তি না থাকারই কথা, বাবার সাহায্য চাইতেও ভরসা হলোনা। আগের আয়াকে ছাড়িয়ে দেবার পর প্রায় ষোল বছর বয়েসের নতুন একটা মেয়ে রান্নার কাজের দ্বায়িত্বে। তবে তার কাছে সাহায্যের আশা বৃথা। এই শর্তেই সে কাজ নিয়েছে, যাতে রান্নাঘরের দরজা সারাক্ষন বন্ধ রাখতে পারে। কারো বিশেষ সংকেতেই কেবল খুলবে। সুতরাং বাবার অনুপস্থিতির সুযোগে মায়ের সাহায্য ছাড়া বোনের কোন উপায় রইল না। মেয়ের ডাক শুনে আনন্দ ও উত্তেজনায় মা এলেন, কিন্তু দরজার সামনে এসেই চুপ হয়ে গেলেন। বোন প্রথমে ঘরে ঢুকে দেখল, সব ঠিক আছে কি না, তারপর মা কে ঢুকতে দিল। খুব দ্রুত গ্রেগর তার এলোমেলো চাদরে ভাজের আরো গভীরে স্থান নিল। মা এসেছেন, তাতেই এত আনন্দিত সে, চাদরের ফাঁকে মা কে একবার দেখার সুযোগটিও নিল না। ‘চল মা, ওকে দেখা যাচ্ছে না’, হাত ধরে মা কে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল বোন। সে শুনতে পেল, দু’জন রোগা মেয়েলোকের ভারী বাক্স ঠেলে ঠেলে জায়গা থেকে সরানো চেষ্টা। বেশী পরিশ্রম বোনই করছে, মা তাকে সাবধান করছিলেন বারবার, যাতে কোন ব্যথা না পায়। অনেক সময় লাগলো। পনেরো মিনিট পর ওটা আগের জায়গাতেই রাখার পরামর্শ দিলেন মা। প্রথমত: বেশ ভারী, দ্বিতীয়ত: বাবারও ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। এভাবে ঘরের মাঝখানে বাক্সটি গ্রেগরের চলাফেরার জন্যেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া বাক্সটি এঘর থেকে সরানো গ্রেগরের আদৌ পছন্দ হচ্ছে কি না, সে সম্পর্কেও তিনি নিশ্চিত নন তখনও। এটা সরানোর পর খালি দেয়াল শেল হয়ে বিঁধছে তার নিজের বুকেই, একই অনুভুতি গ্রেগরেরও হতে পারে। সে তো ঘরের আসবাব এভাবেই দেখে অভ্যস্ত। বাকী কথাগুলো তিনি ফিসফিসিয়ে এমনভাবে বললেন, যাতে গ্রেগর কিছুতেই শুনতে না পারে। ‘ এগুলো সরালে কি মন খারাপ করবে না গ্রেগর? ভাববে না, যে আমরা তার সুস্থতার আশা পুরোপুরি ছেড়ে, ওর দিকে কোন নজর না রেখে পাষানের মতো একা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি? আমার মনে হয়, ঘরটি আগের মতো রাখাই ভাল, যাতে সে তার পরিচিত পরিবেশ খুঁজে পায়। এর ফলে নিজের মাঝে ফিরে এসে সে মাঝখানের কঠিন সময় সহজে ভুলে যেতে পারবে’।

মায়ের এ কথা শুনে গ্রেগর মনে হলো, মানুষের মতো ব্যবহার না পেয়ে ও পরিবারের মাঝখানে গত দু’মাসের একঘেয়ে বদ্ধ জীবন তার বোধশক্তিকে প্রায় ভোতাই করে দিয়েছে। তার কথা বলার ক্ষমতা থাকলে সে নিজেও এগুলো সরিয়ে নিতেই বলতো। আসবাবে সাজানো উষ্ণ এই ঘরকে নরকে পরিণত করে স্বাধীনভাবে এদিক ওদিক লাফিয়ে বেড়ানো চায় কি সে? যে একসময় সে মানুষ ছিল, তা কি, এত দ্রুত, এত সহজেই ভুলে যাওয়া যায়? হয়তো ভুলেই যেত, যদি না মায়ের কথা আবার এসব না দিত তাকে। কোনকিছুই সরানো যাবে না আর, সবই থাকবে। সাজানো এই ঘরের প্রভাবকে অস্বীকার করা একেবারেই ঠিক হবে না। তাতে যদি তার চলাফেরার অসুবিধাও হয়, লাভ ছাড়া কোন ক্ষতি নেই তাতে।

কিন্তু বোনের মতামত অন্যরকম হওয়াতে দু:খ হলো তার। গ্রেগরের প্রতিদিনের জীবনে তার অবদানের কারণে বাবা মায়ের সাথে গ্রেগর সম্পর্কিত আলোচনায় বিশেষজ্ঞের ভুমিকা নিতে অভ্যস্ত বোন। সেজন্যেই মায়ের পরামর্শ তার কাছে খুব গ্রহনযোগ্য হলো না। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ীই শুধুমাত্র টেবিল আর বাক্স নয়, সোফাটি বাদে, বাকী অন্যান্য সব আসবাবই তার সরানোর ইচ্ছে। শুধুমাত্র শিশুসুলভ জেদ বা গত কয়েকদিনের পরিশ্রমে অর্জিত আত্মবিশ্বাস নয়, সে সত্যিসত্যিই দেখেছে, গ্রেগরের চলাফেরার জন্যে আরো জায়গা দরকার। গ্রেগরের কাছে এই আসবাপত্রের কোন ব্যাবহারই নেই। হয়তো এটা বোনের অল্প বয়েসের জেদ ও প্রতি সুযোগেই আত্মসন্তুষ্টির পথ খোঁজা। গ্রেগরকে আরো অসহায় অবস্থায় নিয়ে তাকে নিজের উপর আরো বেশী নির্ভরশীল করানো। কারণও রয়েছে। এমনি এক ঘর, যে ঘরের খালি চার দেয়ালের মাঝে গ্রেগরের বাস, সে ঘরে একমাত্র গ্রেটে ছাড়া আর কার ঢোকার সাহস হয়েছে?

তাই মায়ের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বোন নিজের সিদ্ধান্তেই অটল রইল। মাকেও এই উত্তেজনার মাঝে বেশ বিচলিত মনে হলো। আর কোন কথা না বলে মেয়েকে বাক্সটি সরাতে শারিরীক সাহায্য করলেন। বাক্সটি যাক, কিন্তু টেবিল থাকবে এঘরেই! তাই ঠেলে বাক্সটি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরপরই গ্রেগর সোফার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তার উদ্দেশ্য সাবধানে ও যথাসম্ভব সতর্কতায় এ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করা। বাইরে গ্রেটের বাক্স আঁকড়ে ঠেলাঠেলির শব্দ, একচুলও নড়াতে পারছে না, এরই মাঝে মা আবার ঢুকলেন ঘরে। গ্রেগরের চেহারা দেখে অভ্যস্ত নন তিনি, অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। ভয় পেয়ে গ্রেগর দ্রুত পেছনে হেঁটেই চাদরে নীচে পালালো। পেছনের টানে সামনের দিকে একটু নড়ে উঠলো চাদরটি। এটাই তাঁকে সতর্ক করার জন্যে যথেষ্ট ছিল। থমকে এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে তিনি গ্রেটের কাছে ফিরে গেলেন আবার।

এত কিছু ঘটার পরও গ্রেগর এই বলে নিজেকে স্বান্তনা দিল যে, কয়েকটি আসবাব ছড়ানো ছাড়া খারাপ কিছু আর কি ঘটলো? কিন্তু পরমূহুর্তেই স্বীকার করতে বাধ্য হলো, দুজনের বারবার এই আসাযাওয়া, ডাকাডাকি, টানাটানির আওয়াজ চতুর্দিক থেকে বিরাট এক অত্যাচার তার উপর। সে পা গুলো টেনে মাথা নীচু করে সমস্ত শরীরে মেঝের উপর লেপ্টে তার সহ্যসীমার শেষ প্রান্তে। তার ঘরটি পুরো খালি করলো ওরা, যা তার পছন্দের, সেগুলো সহ বাকী সবই। একটি বাক্স, যেখানে তার করাত ও আন্যান্য যন্ত্রপাতি ছিল, সেটা বের করে মেঝেতে প্রায় আটকে পড়া টেবিল বের করতে ব্যাস্ত দু’জনে। এই টেবিলে বসে সে ব্যবসাপ্রশাসন, কলেজ ও স্কুলে পড়াশোনার সময় তার বাড়ীর কাজ করেছে। তাদের উদ্দেশ্যের ভালমন্দের বিচারের সময় আর নেই। তাদের কথাও তার আর মনে রইল না। তাছাড়া শারিরীক পারিশ্রমে তারা এতই ক্লান্ত যে, শুধুমাত্র ভারী পায়ের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না আর।

ওরা দু’জন যখন পাশের ঘরে টেবিলে হেলান দিয়ে একটু বিশ্রামে, আড়াল থেকে বেরিয়ে এল গ্রেগর। চারবার দিক বদলে এদিক ওদিক দৌড়ালো। প্রথম একেবারেই বুঝতে পারছিল না, কোন আসবাবটি এ ঘরে রাখার চেষ্টা করবে। এর পরক্ষনেই খালি দেয়ালের গায়ে পশমি পোষাক পড়া মহিলার ছবিটির দিকে চোখ পড়লো তার। দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে ফ্রেমের কাঁচে চেপে ধরলো নিজেকে। উত্তেজনায় তপ্ত শরীরে কাঁচের শীতল স্পর্শে একটু আরাম হলো ওর। ছবিটি যেভাবে ঢেকে রাখছে সে, অন্তত:পক্ষে এটা সরাবে না কেউ! মাথাটি ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো ওদের ফিরে আসার অপেক্ষায়।

বেশীক্ষন বিশ্রাম নিল না ওরা। একটু পরেই ফিরে এল। গ্রেটে মা কে জড়িয়ে অনেকটা টেনে হিঁচড়েই আনছে। ‘এখন কি নেব’? বলেই এদিক সেদিক তাকালো সে। দেয়ালের উপর গ্রেগরে সাথে চোখাচোখি হলো। হয়তো মায়ের উপস্থিতির কারনেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো বোন। মায়ের চোখের দিকে তাকালো, যাতে মা এদিকে না তাকান। কম্পিত স্বরে কিছু না ভেবেই বললো মা কে, ‘চল, আরেকটু বিশ্রাম নিই ওঘরে’। গ্রেটের উদ্দেশ্য গ্রেগরের কাছে পরিস্কার। সে মাকে নিরাপদে রেখে এসে গ্রেগরকে দেয়াল থেকে তাড়াতে চাইছে। ঠিক আছে, আসুক আবার, সে ছবির উপর বসে, সরাতে দেবেনা কিছুতেই। বেশী বাড়াবাড়ি করলে লাফিয়ে পড়বে ওর মুখের উপর।

কিন্তু গ্রেটের কথায় ধরণ শান্ত না হয়ে আরো বেশী বিচলিত হলেন মা। একপাশে সরে গেলেন। ফুল তোলা কার্পেটের উপর এক বড় বাদামী দাগের উপর চোখ পড়লো। যেন এতক্ষনে টের পেলেন, এটা গ্রগরের কর্ম। দুই হাত তুলে কর্কশ আওয়াজে ‘হায় খোদা, হায় খোদা’ বলতে বলতে অবশের মতো বাক্সের উপর এলিয়ে পড়লেন। ‘গ্রেগর’! বলে মুঠে হাত উপরে তুলে তীব্র ও শাসনের ভঙ্গীতে গ্রেগরের দিকে তাকালো বোন। তার এই রূপান্তরের পর এই প্রথম কেউ সরাসরি কথা বললো তার সাথে। পাশের ঘরে ছুটে গেল বোন, হয়তো মায়ের জ্ঞান ফেরানো জন্যে কোন ঔষধ খুঁজতে চাইছে। ছবিটার কথা নাহয় পরেই ভাববে, আপাতত: বোনকে সাহায্য করা দরকার, ছবির উপর থেকে নেমে বোনের পেছনে পেছনে যেতে চাইল গ্রেগর। কিন্তু তার শরীরের আঠায় কাঁচে আটকে আছে তার শরীর। কোনক্রমে নিজেকে ছাড়িয়ে পাশের ঘরে ছুটলো, বোনকে কোন পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে, যা এ ধরণের পরিস্থিতিতে চিরদিনই করে এসেছে। বোন তখন অজস্র শিশি বোতলের মাঝে দরকারী শিশিটি খোঁজায় ব্যাস্ত। ঠিক তারই পেছনে হতবাক হয়ে দাঁড়ানো গ্রেগর। পেছনে ঘুরেই হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে ভীষন ভয় পেলো বোন। হাত থেকে একটি বোতল মাটিতে পড়ে চুরমার হয়ে গেল। ভাঙ্গা কাঁচের একটি টুকরো গ্রেগরের মুখে লোগে সেখানে ক্ষত তৈরী করলো। ছিটকে এক দুর্গন্ধজনক তরল পদার্থ ছড়ালো তার শরীরে। কিন্তু গ্রেটে থামলো না। যে ক’টি বোতল হাতে নেয়া যায় নিয়ে ছুটলো পাশের ঘরে মায়ের কাছে, মাঝের দরজাটি পায়ের ধাক্কায় বন্ধ করে দিল। গ্রেগরের এখন আর মায়ের কাছাকাছি হবার কোন উপায় নেই, তারই দোষে মা এখন হয়তো মৃত্যুমুখে। দরজা খুলে ওঘরে ঢুকে বোনকে তাড়াতে চাইল না সে। অপেক্ষায় থেকে থেকে, নিজের প্রতি দোষ আর ধিক্কারের গ্লানিতে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো গ্রেগর। ভেতরের অদম্য অস্থিরতায় ঘরের দেয়াল, আসবাবপত্র, উপরের ছাদ সবখানে দৌড়ে বেড়ালো। একসময় ঘরের চারপাশই যেন তার চোখের সামনে ঘুরতে শুরু করলো। তারপরই ঘরের বড় টেবিলের উপর স্থির হয়ে বসে পড়লো সে।

কিছুটা সময় এভাবেই কাটলো। গ্রেগর আচ্ছন্নের মতো পড়ে রইল সেখানে। চারিদিক চুপচাপ, হয়তো শুভ কোন ইঙ্গিত। তখনই কলিং বেলে আওয়াজ শোনা গেল। কাজের মেয়েটি রান্নাঘরে, গ্রেটেই দরজা খুলতে ছুটে গেল। বাবা ফিরে এসেছেন। ‘কি হয়েছে’? এটাই ছিল তার প্রথম কথা। গ্রেটের চেহারা দেখেই খারাপ কিছু অনুমান করতে পেরেছেন। ভোঁতা স্বরে উত্তর দিল গ্রেটে, মনে হলো বাবার বুকে মুখ গুজে, ’মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, তবে এখন ভালো আছে। গ্রেগর বেরিয়ে গেছে তার ঘর ছেড়ে’। ‘আমি প্রতিবারই বলেছি, আমার কথা শুনতে চাওনি কেউ’ বললেন বাবা। গ্রেগর পরিস্কার বুঝলো, বাবা গ্রেটের কথায় খারাপ কিছু ধারণা করেছেন ও ভেবেছেন, গ্রেগর আক্রমন করে কোন দূর্ঘটনা ঘটিয়েছে। তাঁকে বোঝানোর সময় ও সুযোগ গ্রেগরের নেই, শান্ত করাই সবচেয়ে বেশী জরুরী। তাই সে তার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দরজায় চেপে ধরলো নিজেকে। তার ধারণা, বাবা বারান্দা পেরিয়েই গ্রেগরের উদ্দেশ্য টের পাবেন। বুঝবেন, দরজা খুলে দেয়া হলে সে মূহুর্তেই ঘরে ফিরে অদৃশ্য হয়ে যেতে প্রস্তুত।

কিন্তু বাবার পুরো অবস্থার সুক্ষ বিশ্লেষনের মেজাজ ছিল না। ‘আহ’ বলে যেভাবে শব্দ করে ঘরে ঢুকলেন তিনি, মনে হতে পারে, তিনি একাধারে ক্ষুব্ধ ও সেইসাথে আনন্দিত। গ্রেগর তার মাথা দরজা থেকে তুলে বাবার দিকে তাকালো। বাবা তাকে এভাবে দেখবেন আশা করেন নি। আর গ্রেগর গত ক’দিন তার লাফালাফিতেই ব্যাস্ত থাকায় বাড়ীতে কি ঘটছে, সেদিকে নজন রাখতে পারেনি। পারলে টের পেত যে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে অনেকখানি। তারপরও তার বিশ্বাস হতে চাচ্ছিল না, এই কি সেই বাবা! এ কি একটি লোক, যাকে গ্রেগর প্রতিবার ট্যুর থেকে ফিরে শোবার পোষাকে ইজিচেয়ারে এলিয়ে থাকতে দেখতো। চেয়ার ছেড়ে ওঠার শক্তিও ছিল না। আনন্দের প্রকাশ শুধুমাত্র হাত তুলে জানাতে পারতেন। মাঝে মাঝে রবিবার ও বিশেষ বিশেষ দিনে বেড়াতে বেরুতেন। মা নিজেও ভালো চলতে পারতেন না, তারপরও বাবা মা ও গ্রগরের মাঝখানে ওভারকোটে ঢেকে লাঠিতে ভর করে একটু একটু এগোতেন। কোন কথা বলতে চাইলে থেমে পড়তেন ও অন্যরাও থামলেই শোনা যেত তার কথা। এখন ওনি দাড়িয়েছেন ঋজু ভঙ্গীতে, ব্যাঙ্কের পাহাদারের মতো সোনালী বোতামের নীল রং এর ইস্ত্রী করা পোষাকে। সার্টের উঁচু কলারের উপর তার শক্তিমদমত্ত দোভাঙ্গা থুতনী। ঘন বাদামী ভ্রুর নীচে চোখের দৃপ্ত ও সতর্ক দৃষ্টি। আগের উস্কোখুস্কো চুল আচড়ে অতি যত্নে সিথি কাটা হয়েছে। কোন এক ব্যাঙ্কের সোনালী মনোগ্রাম আঁকা টুপিটা পুরো ঘর ছাড়িয়ে বাক্সের উপর ছুড়ে দু’হাত পকেটে পুরে বিরক্ত মুখে এগিয়ে গেলেন গ্রেগরের দিকে। কি করবেন, তা হয়তো নিজেই জানতেন না, তাই একটি পা আস্বাভাবিক উঁচুতে তুললেন। তা জুতোর তলার বিরাট আকৃতি দেখে অবাক হলো গ্রেগর। তার নতুন জীবনের শুরুতেই বুঝতে পেরেছিল গ্রেগর, তার বাবা তার প্রতি কঠিন থাকাই জরুরী মনে করেন। সে বাবার সামনে থেকে দৌড়ে পালালো, বাবা যখন থামলেন, থামলো সে ও, তিনি আবার এগিয়ে এলে সে ও অন্যদিকে সরে গেল। কোন গুরুতর কিছু ঘটার আগে, কয়েকবার চললো ঘরের ভেতরে এই দৌড়াদৌড়ি। একসময় কিছুক্ষনের জন্যে থামলো গ্রেগর। যদি সে দেয়ালে বা কড়িকাঠের উপর ওঠে, বাবা তা বদমাইসী মনে করে আরো বেশী রেগে যেতে পারেন। তাছাড়া সময়ের সাথে সাথে তার ক্লান্তিও বাড়ছিল। বাবা যদি এক পা হাটেন, তাকে এদিক সেদিক নড়াচড়া করে অনেকবার পা ফেলতে হচ্ছিল। নি:শ্বাসে কষ্ট হচ্ছিল খুব, ছোটবেলা থেকে ভোগা ফুসফুসের দুর্বলতা মাথা চাড়া দিলো আবার। সে আরেকবার দৌড়ের জন্যে সমস্ত শক্তি সঞ্চয়ে করলো, ক্লান্তিতে চোখও খুলতে পারছে না, অন্যকোন উপায়ে নিজেকে বাঁচানোর পথও বের করতে পারছে না। ঠিক সে মূহুর্তে তার খুব কাছেই একটি অপেল মাটিতে পড়ে তার শরীল ঘেসে অন্যদিকে গড়িয়ে গেল। পরমূহুর্তেই আরেকটি এসে পড়লো, গ্রেগর থমকে গেল ভয়ে। দৌড়ে কোন লাভ হবে না বুঝলো, বাবা তাকে আপেলের বোমা মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপেলের থালাটি ছিল উঁচু খাবার টেবিলের পাশে ছোট্ট আরেকটি টেবিলে। সেখান থেকে সেগুলো পকেটে ভরেছেন বাবা এবং একটা পর একটা পুরো লক্ষস্থির না করে ওর দিকে ছুড়ছেন। ছোট ছোট লাল আপেল বিদ্যুতের মতো একটির সাথে আরেকটির ধাক্কায় ছড়িয়ে পড়ছে সারা মেঝেতে। একটি গ্রেগরের পিঠ পিছলে বেরিয়ে গেল আঘাত না করেই। পরেরটি এসে সরাসরি ওর পিঠে আঘাত করলো। জায়গা থেকে সরে গেলেই যেন এই হঠাৎ অবিশ্বাস্য ব্যাথার উপশম হবে ভেবে সরতে চাইলো গ্রেগর। কিন্তু মনে হলো, পেরেকে আটকে আছে মেঝেতে আর পুরোপুরি অবিন্যস্ত অন্ধকারে ডুবে। শুধুমাত্র শেষ মূহুর্তে এক পলকে মায়ের পেছনে বোনকে ওর ঘরে থেকে চিৎকার করে বের হতে দেখল। মায়ের পরনে শুধু লম্বা অন্তর্বাস। উপরের পোষাক জ্ঞান হারানোর পর নি:শ্বাসের সুবিধার জন্যে খুলে নিয়েছ বোন। লুটানো ঘাগড়ায় হোঁচট খেয়ে ছুটতে ছুটতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে গ্রেগরের জীবন ভিক্ষা চাইলেন মা। এরপর কি হলো, তা দেখার মতো শক্তি গ্রেগরের আর রইল না।

তৃতীয় পর্ব

গ্রগরের এই ক্ষত একমাসেরও বেশী রইল। আপেলটিও রইল সে ক্ষতস্থানের উপরেই ঘটনার সাক্ষী হয়ে, সরাতে সাহস পেল না কেউ। তা দেখে বাবারও হয়তো ভাবলেন, করুণ ও বিরক্তিকর চেহারা সত্বেও তার সাথে এই পরিবারের সদস্যদের শত্রুর মতো ব্যাবহার করা ঠিক হবে না। যেহেতু সে একসময় এই পরিবারেরই সদস্য ছিল, তার প্রতি কর্তব্য পালন উচিৎ। পছন্দ না হলেও সহ্য করে নিতে হবে। তবে কখনোই সহ্যের বাইরে কিছুই নয়।

এই ক্ষতের প্রভাবে গ্রেগর তার চলৎশক্তি খুব সম্ভবতো চারদিনের জন্যেই হারিয়ে ফেলেছ। আপাতত: ঘরের একপাশ থেকে ওপাশে যেতেই এক অর্থব বৃদ্ধের মতো বেশ কয়েক মিনিট সময় নেয়। দেয়াল বেয়ে উঠার কথা তো কল্পনাই করা যায় না। তার এই কঠিন অবস্থার বিনিময়ে তাকে যে সুযোগ হলো, তা নিয়ে মনে মনে সন্তুষ্টই হলো সে। প্রতি সন্ধ্যাতেই বসার ঘরের দরজাটি খুলে দেয়া হতো ও সেজন্যে তার দু’ঘন্টা আগে থেকেই অধীর অপেক্ষা করতো সে। পরিবারের সবাই টেবিলে বসে আলোচনায় বাতির আলোয়, আর সে অন্ধকারে আড়ালে থেকে দেখছে সবাইকে। আগের মতো লুকিয়ে লুকিয়ো শোনা নয়, বরং সবার অনুমতিসাপেক্ষেই।

তবে এ আলোচনা আগের মতো প্রানবত্ত রইল না। আগে সারাদিনের কাজের ক্লান্তি শেষে ছোট হোটেলে বিছানায় পড়ে এসব আলোচনার কথা ভেবে মন খারাপ করতো গ্রগর। এখনকার পরিবেশ সে তুলনায় একেবারেই শীতল। বাবা রাতের খাবারের পর ঘুমিয়ে পড়তেন সোফাতেই, মা ও বোনের আলাপ চলতো মৃদুস্বরে। বাতির নীচে উবু হয়ে সেলাইএর কাজ করতেন মা। কোন এক হাল ফ্যাসানের দোকানের জন্যে অন্তর্বাসের সুক্ষ কারুকার্য। আর বোন বিক্রতার কাজ নিয়েছে কোথাও। সেইসাথে বাড়ীতে সন্ধ্যাবেলায় ষ্টেনোগ্রাফি আর ফরাসী ভাষা শিখছে, যাতে ভবিষ্যতে ভালো কোন কাজ পেতে পারে। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন বাবা, কিন্তু ঘুমিয়ে যে পড়েছিলেন, কিছুতেই স্বীকার করতে চাইতেন না। মা কে বলতেন,’আর কতো সেলাই করবে আজ’! পরমূহুর্তেই মা আর বোনের ক্লান্ত মৃদু হাসির দৃষ্টিবিনিময়ের মাঝেই আবার ঘুমিয়ে পড়তেন।

কোন এক অর্থহীন জেদের বশে বাবা বাড়ীতেও তার কাজের পোষাক ছাড়তে চাইতেন না। ঘুমোনোর পড়ার পোষাক অযথাই আলনায় ঝুলছে, তিনি কাজের পোষাকেই তার সোফায় বসে ঝিমোতেন। মনে হতো তিনি যেন তার কাজের জন্যে সর্বদাই তৈবী ও প্রতিমূহুর্তেই তাঁর বস এর ডাকের অপেক্ষায় অছেন। এ কারণে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি মা ও বোনের বিশেষ সাবধানতার পরও সে পোষাক আর পরিস্কার রইল না। গ্রগর প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই চকচকে বোতামের নোংরা দাগে অপরিস্কার একটি পোষাক দেখতে পেত, যার আড়ালে এক বৃদ্ধ আরামদায়ক না হলেও গভীর ঘুমে নিমগ্ন।

রাত দশটার আওয়াজ হতেই মা খুব সাবধানে কথা বলে বাবাকে জাগানোর চেষ্টা করে নানাভাবে বিছানায় নেবার চেষ্টা করতেন। সকাল ছ’টায় তাঁর কাজে হাজির হতে হবে ও এক্ষেত্রে সোফার কষ্টদায়ক ঘুমের চেয়ে বিছানায় ভাল ঘুমোনো তার জন্যে খুবই জরুরী। কিন্তু অর্থহীন এই জেদ! যা বাবা নিজের বশে রাখতে পারেন নি, বরং নিজেই তার বশে। তিনি আরো অনেকক্ষন টেবিলে থাকতে চাইতেন, যদিও ঘুমিয়েই কাটাতেন বেশীভাগ সময়েই। সোফা থেকে বিছানায় নেয়াও এক মহা সমস্যা। মা ও বোনের বারবার পীড়েপিড়ির পর পনেরো মিনিট ধরে সোফায় বসেই ধীরে ধীরে মাথা ঝাকাতেন। চোখ বন্ধ থাকতো ও সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চাইতেন না। মা সার্টের আস্তিন ধরে টান দিয়ে ফিসফিসিয়ে নরম নরম কথা বলতেন, বোন তার নিজের কাজ রেখে সাহায্য করতে যেতো মাকে। কিন্তু বাবার এসবে কোন খেয়ালই থাকতো না। আরো বেশী যেন ডুবে যেতেন সোফায়। একসময় যখন দু’বাহু ধরে টানাটানি করা হতো, চোখ খুলতেন তিনি। একবার মায়ের দিকে, একবার বোনের দিকে তাকাতেন ও বলতেন, ’এটাই জীবন, এ ই আমার শেষ বয়েসের শান্তি’। তারপর দু’জনের কাঁধে ভর করে এমন কষ্টে দাঁড়াতেন, মনে হতো তার শরীরটাই যেন তার বড় এক বোঝা। দু’জনের সাহায্যে দরজা অবধি গিয়ে হাত নেড়ে একা একাই যেতেন তাঁর শোবার ঘরে। মা ফিরে আসতেন তাঁর সেলাইএর উপকরণ গোছনোর জন্যে আর বোন তার খাতাকলম। গুছিয়ে দু’জনেই ছুটতেন বাবার পেছনে, যাতে তাঁকে আরো কোন সাহায্য করা যায়।

এই কর্মব্যাস্ত ও ক্লান্তির চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছানো পরিবারের কার এত সময় গ্রগরের দিকে নিতান্ত প্রয়োজনের বাইরে বাড়তি নজর রাখার? সংসারের খরচপত্র যতটা সম্ভব কমানো হলো। কাজের মেয়েকেও বিদায় করা হলো। শুধুমাত্র ভারী কাজে সাহায্য করার জন্যে এক লম্বা, হাড্ডিসর্বস্ব, উসকো খুসকো সাদা চুলের মহিলাকে রাখা হলো। বাকী সব কাজ মা ই করতেন তাঁর সেলাইএর কাজের পাশাপাশি। এমনকি কিছু গহনাপত্র বিক্রি করা হলো, যা আগে মা ও বোন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খুব আমোদের সাথে পড়তো। প্রতি সন্ধ্যাবেলার আলাপ আলোচনায় গ্রেগর বিক্রির দামও জানতে পেল। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই আর্থিক দুরবস্থায় এই বড়ো ভাড়াটে বাড়ীটি পাল্টানো জরুরী হলেও করা সম্ভব হচ্ছেনা গ্রেগরের কারণেই। ওকে এক বাড়ী থেকে আরেক সরানো কিভাবে সম্ভব, তা ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে নি কেউ। কিন্তু একমাত্র তার প্রতি নজর রেখেই যে এটা করা হচ্ছেনা, এটাও ঠিক নয়। একটি বাক্সে কয়েকটি ছিদ্র রেখে সহজেই সরানো যায় তাকে। আসল কারণ হচ্ছে নিদারুন হতাশা ও এ থেকে সৃষ্ট দুর্ভাবনা। এই পরিবারটি এমন এক দুর্যোগে পড়েছে, যা আত্মীয় ও পরিচিতজনদের কখনোই হয়নি। পৃথিবী সবচেয়ে গরীব মানুষদের কাছ থেকে যা দাবী করতে পারে, তা প্রতিটিই পুরোপুরিভাবে পালন করা হচ্ছে। বাবা ছোট এক ব্যাংক কর্মচারীর জন্যে সকালের নাস্তা নিয়ে যেতেন। মা অপরিচিত মানুষের জন্যে পোষাক সেলাই করতেন। বোন ক্রেতাদের আদেশ পালন করার জন্যে ডেস্কের পেছনে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতো। এর বেশী করার শক্তি আর এই পরিবারের ছিলনা। গ্রেগরের পিঠের যন্ত্রনা শুরু হতো নুতন করে, যখন মা আর বোন বাবাকে বিছানায় রেখে আবার ফিরে আসতো বসার ঘরে। নিজেদের কাজ রেখে একজন আরেকজনকে ধরে গালে গাল লাগিয়ে বসে ডুবে থাকতো অন্ধকার বিমর্ষতায়। একসময় মা গ্রেটেকে গ্রেগরের ঘরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলতেন,’দরজাটি বন্ধ করে দে’। আবার অন্ধকারে গ্রেগর, আর ওদিকে মা আর মেয়ের অশ্রুতে মাখামাখি বা শুন্য দৃষ্টিতে টেবিলের দিকে চেয়ে থাকা।

দিনের বা রাতের বেশীরভাগ সময়ই প্রায় না ঘুমিয়েই কাটাতো গ্রেগর। মাঝে মাঝে ভাবতো, পরের বার দরজা খুললেই পরিবারের সমস্ত দ্বায়িত্ব আর আগের মতোই বহন করার জন্যে এগিয়ে যাবে। তার ভাবনার বিস্তারে বহুদিন আবার তার বস ও উকিল সাহেব, কলিগ ও এক শিক্ষানবিস, সবাই একে একে জায়গা নিল। সেই সাথে আরো অনেকে। তাদের পাহাড়াদার, অন্য এক অফিসের আরো দু’জন বন্ধু, মফস্বল শহরের হোটেলে রুম পরিস্কার করার মেয়েটি। একটা দু’টো আবছা ভালো লাগার স্মৃতি, এক হ্যাটের দোকানের ক্যাশের মেয়েটির কথা। ভালো লেগেছিল তার। সে কথা স্পষ্ট ভাবে বললেও বেশ দেরীতেই বলা হয়েছিল। তাদের সবার কথা তার মনে এলো, আরো অনেক পরিচিত, অপরিচিত ও ভুলে যাওয়া জনের সাথে মিলেমিশে। তবে তার ও তার পরিবারের সমস্যার কাছাকাছি ওরা নয় ও ওদেরকে চিন্তা থেকে দুরে সরাতে পারলেই খুশী হতো গ্রেগর। পরমূহুর্তেই আবার পরিবারকে নিয়ে ভাবার মেজাজ আর ওর থাকতো না। নিজের অবমূল্যায়নে ক্রোধ জমতো নিজের ভেতরে। তার খেতে কি ভাল লাগে বা না লাগে তা ভাল করে না জেনেই মাঝে মাঝে নিজেই খাবার ঘরে যাবার পরিকল্পনা করতো। গ্রেগরের ভাল লাগুক বা না লাগুক তা নিয়ে কোন ভাবনা না করেই বোন সকালে ও দুপুরে যে কোন খাবার পায়ে ঠেলে দ্রুত ঘরে ঢুকিয়ে দিত। সন্ধ্যায় সে খাবার খাওয়া হল কি না হল তা না দেখেই ঝাড় দিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যেত। যতো দ্রুত সম্ভব, ততো দ্রুত আর অবহেলায় একবারই সন্ধ্যায় পরিস্কার করতো ঘর। দেয়াল বেয়ে নোংরা দাগ জমলো, ধুলো ও আবর্জনা জমে থাকতো এদিক সেদিক। প্রথম দিকে অভিযোগ জানানোর উদ্দেশ্যে বোন ঘরে ঢোকার আগের মূহুর্তে এই বিশেষ স্থানগুলোতেই পড়ে থাকতো গ্রেগর। কিন্তু পরে টের পেলো, একসপ্তাহ পড়ে থাকলেও তা পরিস্কার করবে না বোন। সে হয়তে ময়লাগুলো এ ঘরে রাখারই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এ ঘর পরিস্কার করার একচ্ছত্র অধিকার একমাত্র যেন তারই হাতে। একবার মা খুব ভালো করে পরিস্কার করলেন। কয়েক বালতি পানিতেই তা ভাল করে করা সম্ভব হলো। তাতে অতিরিক্ত আদ্রতায় গ্রেগরের বেশ অসুবিধাই হলো। বিরক্তিতে পড়ে রইল সোফার উপর নিশ্চল হয়ে। কিন্তু তাতেও ক্ষমা পেলেন না মা। সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরের গ্রেগরের ঘরের পরিবর্তন টের পেয়ে ভীষন অপমানিত বোধ করে বসার ঘরে ছুটলো। মা বারবার হাত তুলে শান্ত করার চেষটা করলেও কান্নাকাটি শুরু করলো। বাবা সোফায় ভয় পেয়ে গেলেন। প্রথমে অবাক হয়ে বোকার মতো এদিক ওদিক তাকালেন। একদিকে মায়ের বিরুদ্ধে বাবার অভিযোগ, অন্যদিকে বোনের চিৎকার, মা যেন আর কোনদিন গ্রেগরের ঘরে হাত না দেন। বাবা উত্তেজনায় আর থাকতে পারলেন না বসার ঘরে, শোবার ঘরে ছুটলেন। বোন দমকে কেঁদে কেঁদে টেবিলে কিল ঘুষি দিতে থাকলো। গ্রেগরের রাগ হলো একথা ভেবে যে, দরজাটি বন্ধ করে তাকে এই দৃশ্য আর শোরগোল থেকে মুক্তি দেবার কথা কেউ একবারও ভাবলো না।

কিন্তু কাজের চাপে বিরক্ত ও ক্লান্ত বোন যদি আগের মতো গ্রেগরকে দেখাশোনা করতো, তাহলে মাকে কিছুতেই তাকে সাহায্য করতে হতো না। গ্রেগরকেও অবহেলা করা হতো না। একবার হাজির হলো কাজের মহিলাটি। এই বৃদ্ধা বিধবা তার দীর্ঘ জীবন ও শক্ত শারিরীক কাঠামোর জোরেই অনেক কঠিন সময় অতিক্রম করেছেন। গ্রেগরের প্রতিও তার সত্যিকারের কোন ভয় ও ঘৃণা হলো না। কোন কৌতুহলের বশে নয়, কোন এক আকস্মিকতায় ওর ঘরের দরজা খোলেই গ্রেগরকে দেখে ভীষন অবাক হয়ে যান। তারপরও তাকে তাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে না দেখে হাতে হাত বেঁধে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তারপর থেকে প্রতিদিনই তিনি সকালে ও সন্ধ্যায় দরজাটি সামান্য ফাঁক করে গ্রেগরকে দেখতে আসা শুরু করলেন। প্রথম দিকে তিনি ওকে নিজের কাছে যে ভাষায় ডাকতেন, তার নিজের কাছে তা হয়তো বন্ধুত্বসুলভ বলেই মনে হতো। ‘আয়, আয়, এদিকে আয় গুবরে পোকা’ বা ‘দেখ, দেখ, গুবরে পোকা দেখ’! এধরণের ডাকাডাকির উত্তরে কোন সাড়া দিত না গ্রেগর, বরং নিজের জায়গাতেই পড়ে থাকতো। এই মহিলাকে যদি তাকে অপ্রয়োজনীয় ব্যাবহারে বিরক্ত করার বদলে প্রতিদিন তার ঘর পরিস্কার আদেশ দেয়া হতো, তাহলে কতো ভাল হতো! একদিন ঝড়ো বৃষ্টির ছাট আছড়ে পড়ছিল জানালায়, হয়তো নতুন বছেরর আগমনী চিহ্ন। মহিলা এসে তাকে ডাকাডাকি শুরু করলন। এতো বিরক্ত হলো গ্রেগর যে, আক্রমনাত্বক ভঙ্গীতে ঘুরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মহিলাটির দিকে। মহিলাটি ভয় পেয়ে পালালেন না। বরং দরজার কাছে রাখা একটি চেয়ার দু’হাতে তুলে মুখ হা করে এমনভাবে দাঁড়ালেন যে, গ্রেগরের পিঠে চেয়ারটি মেরেই মুখটি বন্ধ করবেন। ‘না, এর বেশী আর এগোনো যাচ্ছে না বুঝি’? প্রশ্ন করলেন। গ্রেগর উল্টোদিকে ফেরার পর আবার চেয়ারটি দরজার কোনে ফেরৎ রাখলেন।

গ্রেগর খাওয়াদাওয়া ছেড়েই দিল প্রায়। মাঝে মাঝে অন্য কোন কারনে যদি ছড়ানো খাবারের পাশ দিয়ে যেত, ছোট কোন এক টুকরো খেলাচ্ছলে মুখে পুরে নিত। ঘন্টার পর ঘন্টা সে খাবার মুখেই রেখে একসময় বের করে ফেলে দিত বাইরে। একবার মনে হলো তার, ঘরের এই করুন চেহারাই তার অরুচির কারণ। কিন্তু ঘরের সবরকম পরিবর্তনও একসময় তার সহ্য হয়ে গেল। বাড়ীর যা যা অপ্রয়েজনীয়, সব এঘরে ফেলে রাখা সবার অভ্যাসে পরিণত হল। বাড়ীর কোন ঘর যদি কাউকে ভাড়া দেওয়া হয়, তাহলে এসব অপ্রয়োজনীয় বস্তুর সংখ্যা বাড়ারই কথা। যে তিনজনকে একটি ঘর ভাড়া দেয়া হলো, এদের সকবারই মুখভর্তি দাড়ি। গ্রেগর একবার দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছে। এদের সবাইকেই শুচিবাইগ্রস্থ বলে মনে হলো। এর প্রভাব সারা বাড়ীতে ও বিশেষ করে রান্নাঘরে পড়লো। অপ্রয়োজনীয় ও নোংরা তাদের একেবারেই অসহ্য। তাছাড়া তাদের নিজেদের আসবাবপত্রের বেশীরভাগই নিজেরাই এনেছেন। তাতে অনেক কিছুই বাড়তি হয়ে পড়লো, যা বিক্রি করা যায়না, কিন্তু ফেলে দেবার কথাও ভাবতে মন চায়না। এ সবই গ্রেগরের ঘরে এনে জমা করা হলো। এমনকি রান্নাঘরের ছাই ও ময়লার বাক্সও। যে কোন মূহুর্তে যা অপ্রয়োজনীয়, এনে গ্রেগরের ঘরেই ফেলতেন কাজের মহিলাটি । খুব দ্রুত সারা হতো এ কর্ম। কপাল ভাল যে গ্রেগর শুধু ফেলে দেয়া ময়লা আর হাতটুকুই দেখতে পেত। মহিলার হয়তো পরিকল্পনা ছিল ওগুলো কোন সময় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া বা একবারে ফেলে দেয়া।কিন্তু পরিনামে ময়লা সেখানেই পড়ে রইলো প্রথমবার ছুড়ে ফেলা জায়গাতেই। গ্রেগরের নড়াচড়ার ফলে কিছুটা সরলো বটে। অনেকটা বাধ্য হয়েই সরালো সে, কারন তার নিজের চালাফেরার পথও ছিলনা। একসময় এসবে তার আনন্দই হতো, যদিও এভাবে চলাফেরার পর সে কয়েক ঘন্টার জন্যে মৃতের মতো ক্লান্ত ও বিমর্ষ হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করতে পারতো না।

মাঝে মাঝে ভাড়াটিয়ারা বসার ঘরে রাতের খাবার খেতেন। তখন দরজাটি সে পুরো সন্ধ্যার জন্যে বন্ধই থাকতো। কিন্তু গ্রেগরের তাতে কোন আপত্তি রইলো না। এমনও সময় গিয়েছে, দরজা খোলা সত্বেও সে তার বাড়ীর লোকের অগোচরে অন্ধকার কোনেই পড়ে থাকতো। একদিন কাজের মহিলা দরজাটি একটু ফাঁক করে রেখেছিলেন। রাতের খাবারের জন্যে যখন ভাড়াটিয়ারা বসার ঘরে এসে বাতি জালালেন, খোলাই রইল সে দরজা। তারা এসে একই টেবিলে বসলেন, যেখানে আগে গ্রেগর ও তার বাবা মা বসে খাওয়াদাওয়া সারতেন। ন্যপকিন বিছিয়ে কাটাচামচ ও ছুড়ি হাতে নিয়ে বসতেই মা একপেয়ালা মাংশ ও বোন পেয়ালা বোঝাই আলুসেদ্ধ নিয়ে ঘরে ঢুকলো। গরম খাবার থেকে ধোঁযা বেরুচ্ছিল। তিনজনই এমনভাবে পেয়ালার উপর ঝুঁকে পড়লেন, মনে হলো খাবার আগে পরীক্ষা করে দেখতে চাইছেন। মাঝের জন সত্যি সত্যিই ছুড়ি দিয়ে একটি টুকরো কেটে পরীক্ষা করলেন, মাংশ কতোটা নরম, নাকি আরেকবার রান্নাঘরে পাঠাতে হবে। তাকেই তিনজনের মাঝে সবচেয়ে প্রভাবশালী মনে হলো। পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট মনে হলো তাকে। মা ও বোন উত্তেজনায় তাকিয়ে থেকে থেকে অবশেষে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

পরিবারের সবাই খাওয়াদাওয়া সারতো রান্নাঘরে। তারপরও বাবা রান্নাঘরে ঢোকার আগে এ ঘরেই ঢুকলেন। টুপি খুলে মাথা নীচু করে সম্ভাষন জানালেন সবাইকে টেবিলের চারপাশ ঘুরে। ভাড়াটিয়ারা উঠে দাঁড়িয়ে দাড়ির ফাঁকে কিছু একটা বললেন। বাবা চলে যাবার পর কোন তারা কথা কথা না বলে শুধু খেয়েই চললেন। খাবার সময়ে তাদের দাঁতের বিভিন্ন ধরণের বিচিত্র শব্দে অবাক হলো গ্রেগর। মনে হলো তারা গ্রগরকে বোঝাতে চাইছেন খাবার সময়ে দাঁতের প্রয়েজনীয়তা ও দাঁত না থাকলে অতি সুন্দর মাড়িও কোন কাজেই আসে না। ‘আমার রুচি আছে ঠিকই’, ভাবতে ভাবতে নিজেকেই বললো গ্রেগর। ‘তবে এসবের প্রতি নয়, ওরা যেভাবে খাচ্ছে, সেভাবে খেলে মারাই পড়বো’!

এই পুরো সময়ের মাঝে বোনের বেহালা বাজানো কোনদিন শুনেছে বলে মনে করতে পারছে না গ্রেগর, কিন্তু ঠিক সেই সন্ধ্যাতেই রান্নাঘর থেকে বেহালার আওয়াজ ভেসে এলো। ভাড়াটিয়ারা তাদের খাওয়াদাওয়া শেষ করেছেন, মাঝের জন একটি পত্রিকা বের করে বাকী দু’জনকে একটি করে পত্রিকার পাতা দিয়ে পড়া শুরু করেছেন। আরামে হেলান দিয়ে ধুমপান শুরু করেছেন মাত্র, বেহালায় বাজনা শুনেই সজাগ হয়ে উঠলেন। পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে একসাথে কান পাতলেন সবাই। হয়তো রান্নাঘর থেকেই শুনতে পেয়ে থাকবে কেউ। বাবা উচ্চস্বরে বললেন,’আপনাদের কারো কি অসুবিধা হচ্ছে এতে? তাহলে বাজনা সাথে সাথেই বন্ধ করে দেয়া যায়’। ‘বরং উল্টোটি’, বললেন মাঝের ভদ্রলোক। ‘ম্যাডাম আমাদের এখানে এসে এঘরে বাজালেই ভাল হতো। এঘরটি নিশ্চয়ই আরো বেশী আরামদায়ক’। ‘অবশ্যই’, বললেন বাবা, যেন তিনি নিজেই বাজাচ্ছেন বেহালা। ওরা আবার টেবিলে এসে বসলেন ও অপেক্ষা করলেন। পরমূহুর্তে বাবা এলেন স্বরলিপি রাখার স্ট্যান্ড, মা স্বরলিপির বই ও বোন বেহালা নিয়ে। বোন আস্তে আস্তে বাজনার জন্যে তৈরী হলো। বাবা মা আগে কখনও কাউকে ঘর ভাড়া দেননি, তাই ভদ্রতার আতিশয্যে সোফাতেও বসতে সাহস পেলেন না। বাবা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, ডান হাতটি সার্টের দুই বন্ধ বোতামের মাঝে ঢুকিয়ে। ভাড়াটেদের একজন মা কে সোফায় বসার অনুরোধ জানালে, সেখানে বসলেন তিনি। একটু দুরে, এক কোনায়, যেখানে ভদ্রলোক সোফাটি সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আগেই।

বোন বাজনা শুরু করলো। বা আর মা দু’পাশ থেকেই বাহালার তারে তার হাতের চলাচলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। গ্রগর বাজনার প্রতি আগ্রহে এগিয়ে মাথাটি বসার ঘরে ঢুকিয়ে দিল। অন্যদের প্রতি নজর রাখলো না ভেবে অবাক হলোনা একেবারেই। আগে তো নিজের চেহারা নিয়ে গর্ববোধ ছিল তার। এখন তো নিজেকে লুকিয়ে রাখাই শ্রেয়। পুরো ঘরভর্তি ধুলো, সামান্য নড়াচড়াতেই আরো বেশী ছড়িয়ে পড়ে, তাতে তার নিজের শরীরও ধুলোয় ঢাকা। সুতো, চুল, খাবারের অবশিষ্ট, সবই বইছে সে পিঠে ও শরীরের পাশে। এখন সেদিকে নজরই নেই, অথচ প্রথম দিকে শরীর উল্টে কার্পেট সব ময়লা ছড়িয়ে নিজেকে পরিস্কার করতো। এখন নিটোল পরিস্কার বৈঠকখানার মেঝেতে এগিয়ে যেতে তান কোন দ্বিধাই হচ্ছে না।

আসলে কেউই তার দিকে নজর দিল না। বাবা আর মা বাজনাতেই ডুবে ছিলেন। ভাড়াটিয়ারা পকেটে হাত রেখে বোনের পেছনে স্বরলিপির ষ্ট্যন্ডের কাছে গিয়ে এমন ভাবে দাঁড়ালেন, যাতে স্বরলিপি দেখতে পারেন। বোনের এতে অবশ্যই বিরক্ত হবার কথা। তারা নীচুস্বরে কথা বলতে বলতে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন ও বাবার চিন্তিত দৃষ্টির সামনে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। পরিস্কার বোঝা গেলো, যে সুন্দর ও মনোমুগ্ধ বাজনা শোনার আশা তারা করেছিলেন, তা না পেয়ে আশাহত ও বিরক্ত হয়েছেন। শুধুমাত্র ভদ্রতা বজায় রাখার জন্যেই তার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন না। যেভাবে নাকেমুখে উপরের দিকে চুরুটের ধোয়া ছাড়ছিলেন, তাতে তাদের চুড়ান্ত অসহিষ্ণুতাই প্রকাশ হলো। অথচ কত সুন্দর বাজাচ্ছিল বোন! মাথাটি একপাশে কাত করা, চোখের বিষাদময় দৃষ্টি নেচে বেড়াচ্ছিল স্বরলিপির ছত্রে ছত্রে। গ্রেগর আরেকটু সামনের দিকে এগিয়ে গেল, মাথাটি মেঝেতে নামিয়ে, হয়তো বোনের দৃষ্টিকে ধরার আশাতেই। আসলেই কি সে এক পশু, সঙ্গীতে যার এতোটা তৃষ্ণা? এটাই তার এতদিনের অজানা খোরাক, যা এতদিন খুঁজে এসেছে! তার স্থির সিদ্ধান্ত, বোনের আরো কাছাকাছি এগিয়ে যাওয়া, তার স্কার্টে টান দিয়ে তাকে বোঝানো, সে যেন বেহালা নিয়ে গ্রেগরের ঘরে আসে। তার বাজনার মুল্য গ্রেগরের কাছে যতো, এখানকার কারো কাছেই ততটা না। বোনকে তার ঘরের বাইরে বেরুতে আর কখনোই দেবে না, অন্ততপক্ষে: যতদিন সে বেঁচে থাকবে। এই ভয়ংকর চেহারা প্রথমবারের মতো কাজে আসবে তার। একই সাথে ঘরের প্রতিটি দরজা ও জানালায় সবরকম আক্রমণ প্রতিহত করবে । বোনকে থাকতে বাধ্য করতে হবে না, সে নিজেই থাকবে। সোফার উপর বসে ভাইএর দিকে কান পাতবে। তখন গ্রেগর বলতে পারবে, বোনকে সংগীত কলেজে পাঠানোর পুরো সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল। যদি নিজের এ সমস্যাটি না হতো, তাহলে কারো কথায় কোন পাত্তা না দিয়ে গত বড়দিনেই সবাইকে জানাতো। এবারের বড়দিন কি পেরিয়ে গেছে? একথা শুনে নিশ্চয়ই নরম হয়ে কাঁদতো বোন। গ্রেগর সোজা হয়ে আদর করে চুমু খেত বোনের গলায়। যতদিন ধরে দোকানে কাজে যাচ্ছে বোন, ততদিন ধরে কলার ও কোন ফিতে নেই তার গলায়।

‘মি: সামসা’, ডাকলেন মাঝের ভদ্রলোক ও আর কোন বাক্য ব্যয় না করে সামনের দিকে এগিয়ে আসা গ্রেগরের দিকে তর্জনী নির্দেশ করলেন। বেহালা থেমে গেল, ভদ্রলোক তার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাকিয়ে হেসে আবার গ্রেগরের দিকে তাকালেন। বাবা গ্রেগরকে না থামিয়ে ওদেরকে শান্ত করাই বেশী জরুরী মনে করলেন বলে মনে হলো। তারপরও ওদেরকে খুব বিব্রত বলে মনে হলোনা, বাজনার চেয়ে গ্রেগরই এখন ওদের কাছে বড় আকর্ষন। বাবা তাদের দিকে এগিয়ে দুই হাত তুলে তাদেরকে তাদের ঘরের দিকে পাঠানোর চেষ্টায় নিয়োজিত হলেন ও সে সাথে শরীর দিয়ে গ্রেগরকে তাদের দৃষ্টির আড়াল করতে চাইলেন। তাদেরকে এবার বেশ বিরক্ত মনে হলো। কিন্তু বিরক্তির কারণ কি? বাবার ব্যাবহার, নাকি এইমাত্র গ্রেগরের মতো প্রতিবেশীর কথা জানা? নিজেদের দাড়িতে অস্থির হাত বুলিয়ে তারা বাবার কাছে এসবের ব্যাখ্যা দাবী করলেন ও নিজেদের ঘরে ফেরৎ যেতে রাজী হলেন না। এরই মাঝে বোন তার সচেতনতা ফিরে পেয়েছে, যা হঠাৎ তার বাজনা বন্ধ হওয়ায় হারিয়ে ফেলেছিল। এতোক্ষন বেহালার ছড়ি আর তারেই ছিল তার শিথিল হাত, আর দৃষ্টি স্বরলিপির পাতায়, যেন একটু পরই বাজনা শুরু করবে আবার। মা বসেছিলেন তার ঘন ঘন নি:শ্বাস আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে সোফাতে। বোন উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের কোলের উপর বেহালাটি রেখে এঘর ছেড়ে পাশের ঘরের দিকে ছুটলো। বাবার চাপের মুখে ভাড়াটিয়ারাও সেদিকেই যেতে বাধ্য হচ্ছিল। তারা ঘরে ঢোকার আগেই গ্রেটে সে ঘরের বিছানা চাদর ছুড়ে ফেলল এদিক সেদিক। বাবার ভেতরেও কিছু একটা ভর করলো, যার প্রভাবে তিনি ভাড়াটিয়াদের তাদের প্রাপ্য সন্মান দিতেও ভুলে গেলেন। তাদের ঘরের দিকে গায়ের জোরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন বারবার। একসময় মাঝের জন দরজার কাঠে পা রেখে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। উপরের দিতে হাত তুলে মা ও বোনের দিকেও তাকালেন। ‘এই বাড়ীর পরিবারের সদস্যরা যে কদর্য পবিবেশে বাস করছেন, তার প্রতি সজাগ হয়ে বাড়িটি ছেড়ে দিলাম।‘ এটা বলে একদলা থুতু ফেললেন মেঝের উপর। ‘যে ক’দিন এখানে ছিলাম, তার জন্যে এক পয়সা ভাড়া তো দেবোই না, বরং প্রমাণ সাপেক্ষেই ক্ষতিপূরণ দাবী করার কথা চিন্তা করে দেখবো। বিশ্বাস করতে পারেন আমাকে, প্রমান করা বিন্দুমাত্রও কঠিন হবে না’। এটা বলেই তিনি থামলেন ও কোন প্রত্যাশায় এদিক ওদিক তাকালেন। সত্যিসত্যিই সাড়া দিলেন বাকী দু’জনও। ‘আমরাও এই মুহুর্তে বাড়িটি ছেড়ে দিলাম’। পরপরই মাঝের জন হাতল ধরে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

*********

বাবা টলতে টলতে সোফার কাছে এসে এলিয়ে পড়লেন সোফায়। মনে হলো, প্রতি সন্ধ্যার মতোই ঘুমোচ্ছেন সোফায়। কিন্তু তার মাথার অবাধ্য ঝাকুনি দেখে বোঝা গেল, জেগেই আছেন তিনি। গ্রেগর পুরো সময়টি সে জায়গাতেই পড়ে রইল, যেখানে ভাড়াটিয়ারা দেখতে পেয়েছিলেন তাকে। ব্যর্থ পরিকল্পনার হতাশা ও হয়তো অবিরাম উপোষের কারণেই নড়ার কোন ক্ষমতা ছিল না তার। মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসা পরবর্তী ঝড়ের অপেক্ষায় রইল সে। মায়ের কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলের ফাঁক গলে বেহালাটি তার কোল থেকে মেঝেতে পড়লো বিকট আওয়াজে। তাতেও আতঙ্কিত হলো না গ্রেগর।

‘প্রিয় বাবা ও মা’ মুষ্টিবদ্ধ হাতে টেবিলে ঘুষি মেরে জানালো বোন। ‘এভাবে আর চলতে পারে না। তোমাদের নিজেদের যদি তা মনে না হয়, আমার হচ্ছে। এই পশুকে আমি আর ভাই বলে ডাকতে চাইনা। সেজন্যে স্পষ্ট করে বলছি, একে বিদেয় করার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। একজন মানুষের পক্ষে একে সহ্য করা, এর দেখাশোনা করার যতটুকো সম্ভব, তা আমরা করেছি। মনে হয়না, নিজেদের প্রতি এরপর কোন অভিযোগ থাকতে পারে আমাদের’।

‘তার কথা পুরোপুরি ঠিক‍!’, বললেন বাবা। মায়ের নি:শ্বাসে কষ্ট হচ্ছিল তখনও। দম না পেয়ে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে অবিরাম কাশতে শুরু করলেন।

বোন মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে কপালে হাত রাখলো। বাবা হয়তো বোনের কথায় কোন এক সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে। ভাড়াটিয়াদের খাবার প্লেট পড়ে আছে টেবিলে তখনও। তারই মাঝে তার দারোয়ানের টুপিটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে গ্রেগরের দিকে তাকালেন।

‘একে বিদায় করতে হবে’ এবার বাবাকেই বললো বোন। কাশির দমকে মায়ের কিছু শোনার ক্ষমতা ছিল না। ‘স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি, এবার তোমাদের দু’জনকেই খুন করবে ও। যে রকম কঠিন পরিশ্রম করি আমরা, তারপর বাড়ীতে এসব ঝন্ঝাট আর সহ্য করা যায়না। অন্তপক্ষে আমি আর করতে পারছি না’। বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো বোন। তার চোখের অশ্ত্রু মায়ের মায়ের মুখমন্ডলে ঝরলো।

‘মা’! মেয়ের প্রতি সহানুভুতি ও একাত্মতায় অধীর হয়ে বললেন বাবা। ‘কিন্তু কি করতে পারি আমরা’?

বোন কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে কনুই ঝাঁকালো। মনে হলো কান্নার প্রভাবে তার আগের সেই নিশ্চিত ভাব অনেকটাই অবদমিত।

‘সে যদি আমাদেরকে বুঝতো’! অনেকটা প্রশ্নের মতোই বললেন বাবা। বাবার এ আশা নিতান্তই দূরাশা, কাঁদতে কাঁদতেই দু’হাত নাড়িয়ে তা জানালো বোন।

‘সে যদি আমাদেরকে বুঝতো’ আবারো বললেন বাবা। তারপর দু’চোখ বন্ধ করে যেন মেয়ের অবিশ্বাসের গভীরতাই টেনে নিলেন নিজের ভেতরে। ‘তাহলে হয়তো তার সাথে কোন এক সমঝোতায় আসা যেতো। কিন্তু এভাবে...’

‘একে দুর করতে হবে’, জোরে বললো বোন। ‘এটাই একমাত্র পথ বাবা। আমাদের ভুলতে হবে যে, এ গ্রেগর। আমরা যে এ পর্যন্ত তা করতে পারিনি, আমাদেরই দুর্ভাগ্য তা। এ কিভাবে গ্রেগর হতে পারে? যদি গ্রেগর হতো, এতদিনে নিজেই বুঝতে পারতো, মানুষের সাথে পশুর বসবাস কতোটা অসম্ভব ও নিজ থেকেই বিদেয় হতো। আমার কোন ভাই থাকতো না, কিন্তু তার স্মৃতিকে সন্মানে রাখতে পারতাম। কিন্তু এখন এই পশু আমাদেরকে সবসময় অনুসরণ করছে, ভাড়াটিয়াদের তাড়িয়েছে। আমাদেরকে রাস্তায় বের করে সে পুরো বাড়ীটিই নিজের দখলে নিতে চাইছে। দেখ বাবা! সে আবার শুরু করেছে’ বলেই গ্রেগরের অবোধ্য কোন এক কারণে চিৎকার করে সোফাটি রেখে মায়ের কাছ থেকে সরে বাবার পেছনে পালালো সে। মনে হলো গ্রেগরের সামনা সামনি হওয়ার পরিবর্তে সে মা কেও বলি দিতে তৈরী। মেয়ের ব্যাবহারে উৎকন্ঠিত বাবাও সোফা ছেড়ে দাঁড়ালেন ও ওর সামনে প্রতিরক্ষার জন্যে দু’হাত তুললেন।

কিন্তু তার বোনকে বা অন্য কাউকে ভয় দেখনোর মতো কিছু করেছে বলে গ্রগরের কিছুতেই মনে হলো না। সে তো শুধু তার ঘরে ফেরার জন্যে তার শরীরকে ঘোরাতে শুরু করেছিল। শক্তিহীনতার কারনে বিষয়টি খুব সহজ ছিলনা বলেই হয়তো চোখে পড়েছে সবার। বারবার মাথা তুলে আবার মাটিতে আঘাত করে ঘোরার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করতে হচ্ছিল তাকে। একটু থেমে এদিক সেদিক তাকালো সে। তার সদিচ্ছা সবাই বুঝতে পেরেছে বলে মনে হলো। হয়তো শুধুমাত্র মূহুর্তের এক আতঙ্ক কাজ করেছিল সবার ভেতর। এখন সবাই চুপ হয়ে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মা সোফায় পা’ দুটো ছড়িয়ে ফাঁক করে পড়ে আছেন, ক্লান্তিতে প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে চেখদুটো। বাবা ও বোন বসে আছে পাশাপাশি, বোন এক হাতে বাবা গলা জড়িয়ে।

‘এখন আবার ফেরার চেষ্টা করতে পারি’, ভাবলো গ্রেগর ও তার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হলো আবার। পরিশ্রমের কারণে সে তার ফোঁস ফোঁস নি:শ্বাসকে চেপে রাখতে পারছিল না। মাঝে মাঝে বিরতিও নিতে হচ্ছিল। তাছাড়া বাইরের চাপও ছিলনা। ঘোরা শেষ করে সোজা নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হতেই দুরত্ব মেপে অবাক হলো সে। বুঝতেই পারলোনা, তার এই দুর্বল শারিরীক অবস্থায় এতোটা দুরত্ব এতো অল্প সময়ে কি করে পার করলো। তার চিন্তা ছিল, কিভাবে দ্রূত এগিয়ে যেতে পারে। খেয়ালই করলো না যে, তার পরিবারের কোন কথা বা কোন ডাক তাকে বাঁধা দিল না। শুধুমাত্র দরজার কাছাকাছি এসে ঘাড়ে ব্যথা সত্বেও মাথাটি অর্ধেক ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকালো। বোনের উঠে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোন পরিবর্তন দেখলো না। তার সর্বশেষ দৃষ্টি গেলো মায়ের দিকে, মা সোফার উপরেই গভীর ঘুমে নিমগ্ন।

সে ঘরে ঢুকতেই দরজাটি বাইরে থেকে চেপে, বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দেয়া হলো। পেছনের হঠাৎ আওয়াজে গ্রেগর এত ভয় পেলো যে, তার কয়েকটা পা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভাঁজ হয়ে গেল। বোনই এতটা তাড়াহুড়ো করেছে। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়েছিল, পা টিপে টিপে এগিয়ে এসেছে, গ্রেগর শুনতে পায়নি। দরজায় চাবি লাগাতে লাগাতে বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললো, ’গেল অবশেষে’!

‘এবার’? নিজেকেই পশ্ন করে অন্ধকারে তাকালো গ্রেগর। একটু পরেই টের পেলো, তার চলার ক্ষমতা একেবারেই নি:শেষ। সে অবাক হলো না, বরং তার এই সরু, শীর্ন পায়ে যে এতদুর আসতে পেরেছে, সেটাই অস্বাভাবিক মনে হলো। কিছুটা ভালো বোধ করছিল নিজেকে। যদিও তার সারা শরীরেই ব্যথা, তারপরেও তার মনে হলো সে ব্যথা কমে কমে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। তার পিঠের উপরের পঁচা আপেল ও তার চারপাশের ধুলো আর পুঁজে ঢাকা ক্ষত প্রায় টেরই পাচ্ছিল না। নিজেকে এখান থেকে দুর করতে হবে, এই সিদ্ধান্ত, তার বোনের না যতোটা, নিজের কাছে আরো বেশী দৃঢ় মনে হলো। এই অবস্থায় এক শুন্যতা ও শান্তির মাঝে ডুবে রইল রাতের তৃতীয় প্রহর অবধি। রাত শেষ হওয়ার চিহ্ণ হিসেবে বাইরের আলোর আভাস অনুভবও করলো। তারপর তারা মাথা ঝুলে পড়লো একদিকে ও নাকের ভেতর দিয়ে তার সর্বশেষ নি:শ্বাসটি বেরিয়ে এলো।

পরদিন সকালে কাজের মহিলা এলেন। শক্তি ও তাড়াহুড়োয় সারা বাড়ী দরজাগুলো এমনভাবে খুললেন আর বন্ধ করলেন যে, কারো ঘুমানোর কোন সুযোগ রইল না। তাকে যে এ ব্যাপারে সাবধান হওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল, সেদিকে তার নজরই রইল না। প্রতিদিনের মতোই অল্প সময়ের জন্যে গ্রগরের ঘরে ঢুকে প্রথমে অস্বাভাবিক কিছুই টের পেলেন না। তিনি ভাবলেন, গ্রেগর ইচ্ছে করেই নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে বা কোন ভান ধরে আছে। তার হাতে যে ঝাড়ুটি ছিল, তার খোঁচায় চেষ্টা করলেন গ্রেগরকে দরজা থেকে সরানোর। কিন্তু তাতে সফল না হয়ে একটু রেগে গুতো দিলেন তার শরীরে। কোন রকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না করে যখন সরে গেলো গ্রেগরের শরীর, তখন সতর্ক হলেন তিনি। তারপর ঘটনাটি পুরো বুঝতে পেরে শিশ বাজাতে শুরু করলেন ও বেশীক্ষন না থেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। বাবা মায়ের শোবার ঘরের দরজা পুরো খুলে অন্ধকারে ঢুকে বললেন, ’মরেছে সে, দেখুন, দেখুন, মরে ভুত হয়ে গেছে’!

কাজের মহিলার তড়িৎ প্রবেশে হতচকিত সামসা দম্পতি কোনকিছু বোঝার আগেই সোজা হয়ে বিছানায় বসে পড়লেন। তারপর দ্রুত নিজেদের দিক থেকে বিছানা ছেড়ে নামলেন। মি: সামসা একটি চাদর জড়ালেন গায়ে আর মিসেস সামসা রাতের পোষাকেই ঢুকলেন গ্রেগরের ঘরে। এর মাঝে খুললো বসার ঘরের দরজাও, যেখানে গ্রেটে ভাড়াটিয়া আসার পর রাতে ঘুমোতো। পুরো পোষাকে তার ফ্যকাশে চেহারা দেখে মনে হলো, সারারাত ঘুমোতে পারে নি। ‘মৃত’? কাজের মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস সামসা, যদিও নিজেই তা পরীক্ষা করে বা না করেই বুঝতে পেরেছেন। ‘আমি তা ই মনে করছি’, বলেই তা প্রমান করার জন্যে ঝাড়ু দিয়ে ঠেলে গ্রেগরের লাশটি আরেকটু পাশে সরিয়ে দিলেন মহিলাটি। মিসেস সামসা এমন ভাবে এগুলেন যে, যেন তিনি ঝাড়ুর আঘাত ঠেকাতে চাইছেন, কিন্তু পরিনামে করলেন কিছুই। ‘এখন আমরা খোদাকে ধন্যবাদ জানাতে পারি’, বললেন মি: সামসা। বুকে ক্রশ আঁকলেন ও তিন মহিলাও তাকে অনুসরণ করলো। গ্রেটে এতক্ষন লাশের দিক থেকে একবারও দৃষ্টি ফেরায় নি। এবার বললো, ‘দেখ, দেখ, কতোটা শুকিয়ে গিয়েছিল সে। অনেকদিন ধরে তো কিছই খেতো না। প্রতিদিন যতোটা খাবার দেয়া হতো ঘরে, বেরও করা হতো ততটাই’! সত্যি সত্যিই গ্রেগরের শরীর ছিল পুরোপুরি শুকনো আর হালকা। তার পা’গুলো যে শরীরকে আর বহন করছে না, সেটাও চোখে পড়ল এতক্ষনে।

‘চল গ্রেটে, আমাদের ঘরে কিছুক্ষনের জন্যে যাই’, ম্লান হাসি হেসে বললেন মিসেস সামসা। গ্রেটে লাশের দিকে তাকাতে তাকাতে বাবা মায়ের পেছনে পেছনে শোবার ঘরে ঢুকলো। কাজের মহিলা দরজা বন্ধ করে জানালাটি খুলে দিলেন পুরেপুরি। মাচের্র শেষে সকালের বাতাসে তখন অনেকটাই ভেজা ভেজা ভাব।

নিজেদের ঘর থেকে তিনজন ভাড়াটিয়া সকালে নাস্তার জন্যে বসার ঘরে ঢুকলেন। সবাই মনে হয় তাদের কথা ভুলেই গেছে। ‘আমাদের নাস্তা কোথায়’? বিরক্ত হয়ে কাজের মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন মাঝের ভদ্রলোক। মহিলা মুখে আঙ্গুল রেখে ওদেরকে গ্রেগরের ঘরের দিকে ইশারা করলেন। তারা সেখানে ঢুকলেন ও এলোমেলো পোষাকে পকেটে হাত রেখে গ্রেগরের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। গ্রেগরের ঘর তখন ভোরের আলোয় আলোকিত।

তখনই শোবার ঘরের দরজা খুললো। ড্রেসিং গাউন গায়ে একহাতে স্ত্রী ও একহাতে মেয়েকে ধরে মি: সামসা বেরোলেন সে ঘর থেকে। কান্নাচ্ছন্ন মনে হলো ওদেরকে, গ্রেটের মুখ বাবার বাহুতে লুকোনো।

‘এই মূহুর্তেই এ বাড়ী ছাড়ুন আপনারা’ বললেন মি: সামসা স্ত্রী ও মেয়েকে দু’হাতে জড়িয়ে। ‘কি বোঝাতে চাইছেন আপনি’? প্রশ্ন করলেন মাঝের ভদ্রলোক একটু অবাক ও মিষ্টি হেসে। বাকী দুজন কোমরে হাত রেখে এমন ভাবে অবিরত ঘষছিলেন যে, মনে হচ্ছিল অবশ্যই জিতে যাবেন, এমনি এক বড় যুদ্ধের জন্যে মনে মনে তৈরী করছেন নিজেদের। ‘আমি যা বলেছি, তাই বুঝাতে চাইছি। বলে মি: সামসা দুই মহিলাকে নিয়ে সোজা ভাড়াটিয়াদের দিকে এগিয়ে গেলেন। মাঝের ভদ্রলোক তখন মাটির দিকে তাকিয়ে তার সমস্ত চিন্তাভাবনা নতুন করে সাজানোর চেষ্টায়। ‘ঠিক আছে, তাহলে যাচ্ছি আমরা’ বলে মি: সামনার দিকে তাকালেন তিনি। মনে হলো এই অকস্মাত অপমানে এই সিদ্ধান্তের পেছনে আরো একবার অনুমতির দরকার। মি: সামসা কঠিন চোখে করে মাথা নাড়লেন কয়েকবার। তাতে ভদ্রলোক লম্বা পা ফেলে ফেলে তাদের ঘরে ঢুকলেন। বাকী দু’জন চুপচাপ কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে পেছন পেছন গেলেন। মি: সামসা তাদের আগেই সে ঘরে ঢুকে তাদের তিনজনের একত্রিত হওয়াকে বাধাগ্রস্থ করলেন। তিনজন তাদের টুপি পড়লেন, রাখার জায়গা থেকে তাদের লাঠি হাতে নিলেন, সন্মানে একটু মাথা নীচু করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন। তারপরও কোন এক যুক্তিহীন সন্দেহের বশে দুই মহিলাকে নিয়ে মি: সামসা সিড়ির কাছে এগিয়ে গেলেন। রেলিংএ হেলান দিয়ে তিনজনই দেখলেন, তিন ভদ্রলোকই নেমে যাচ্ছেন নীচে, লম্বা সিড়িটি বেয়ে ধীরে ধীরে, কিন্তু একই গতিতে। সিড়িটা যেখানে বাঁক নিচ্ছে, সেখানে আদৃশ্য, পরমূহুর্তেই আবার দৃষ্টিসীমার ভেতরে। যতই দুরে সরছেন তারা, ততই কমছে সামসা পরিবারের আগ্রহ তাদের প্রতি। অবশেষে যখন একজন ফরিওয়ালা কশাই তার মাথায় বোঝা নিয়ে শক্তিশালী পদক্ষেপে উপরে ওঠা শুরু করলো, তখন মি: সামসা তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে সিড়ির ঘর ছেড়ে নিশ্চিত মনে নিজেদের ঘরে ফিরে গেলেন।

সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন কর্মস্থলে না গিয়ে আজকের দিনটি কিছুটা বাড়ীতে ও কিছুটা একসাথে বাইরে হাঁটাহাঁটি করে কাটাবেন। এই ছুটি শুধু তাদের প্রাপ্যই নয়, তাদের জীবনের জন্যেও অতি জরুরী। সেজন্যে তারা টেবিলে বসলেন ও তিনটি অনুপস্থিতির চিঠি লিখলেন তাদের কাজের জায়গায়। মি: সামসা লিখলেন তার ব্যাংকের পরিচালকদের কাছে, মিসেস সামসা লিখলেন যাদের কাছে কাপড় পাঠাবেন, তাদেরকে ও গ্রেটে লিখলো তার প্রিন্সিপ্যালের কাছে। এর মাঝে তার সকালের কাজ শেষে কাজের মহিলা বিদায় নিতে এলেন এ ঘরে। তিনজনই তার দিকে না তাকিয়েই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তারপরেও মহিলাটি দাঁড়িয়ে থাকায় তিনজনই বিরক্ত হয়ে তাকালেন। ‘কি হলো’? জানতে চাইলেন মি: সামসা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এমনভাবে হাসলেন মহিলা, মনে হলো সবাইকে বিরাট এক সুসংবাদ জানানোর আছে তার ও কারো বিশেষ অনুরোধেই তা জানাবেন। এদিক ওদিক দুলছে সোজা করে গাঁথা টুপির পালক, যা দেখে মি: সামসা সবসময়েই বিরক্ত। ‘ঠিক আছে, বলুন, কি বলতে চান আপনি’? এবার প্রশ্ন করলেন মিসেস সামসা। তার প্রতিই এই মহিলার সবচেয়ে বেশী সন্মান। ‘হ্যা’, বলেই মহিলা বলেই আনন্দের আতিশয্যে বিরতি নিতে বাধ্য হলেন। ‘পাশের ওঘরের ওই বস্তুটি কি ভাবে কোথায় ফেলতে হবে, তা নিয়ে আপনার ভাবনা করার আর দরকার পড়বে না। আমি সব ঠিকঠাক করে দিয়েছি’। মিসেস সামসা ও গ্রেটে তাদের চিঠির উপর এমনভাবে ঝুঁকে পড়লো, যেন আরো লিখতে চাইছে। মি: সামসা দেখলেন মহিলাটি আরো বিশদ বর্ননায় শুরু করতে চাইছেন। বাঁধা দেয়ার জন্যে তাই হাত তুলে ইশারা কললেন। বাঁধা পেয়ে বেশ অপমানিত বোধ করলেন মহিলা, কিন্তু ভাব দেখালেন এমন যে খুব তাড়াহুড়োর মাঝে আছেন। সবাইকে বিদায় বলে বিকট আওয়াজে দরজাটি বন্ধ করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন।

‘সন্ধ্যাবেলা কাজ থেকে বিদেয় করবো তাকে’। বললেন মি: সামসা, কিন্তু স্ত্রী ও মেয়ের কাছে কোন সাড়া পেলেন না। মনে হলোনা কাজের মহিলা তাদের এইমাত্র অর্জিত শান্তিতে কোন ব্যঘাত ঘটাতে পেরেছেন। দু’জনেই চেয়ার ছেড়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে জানালার সামনে দাঁড়ালেন। মি: সামসা সোফা থেকে মাথা ঘুরিয়ে তাদের দিকে কতোক্ষন নীরবে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ডেকে বললেন, ’এদিকে আস তোমরা। পুরোনো বিষয়কে রাখো এবার! আমার দিকেও একটু নজর দাও’! পরক্ষনেই তার দিকে এগিয়ে এলো দু’জনেই। তাকে আদর করে নিজেদের চিঠি শেষ করায় মনযোগী হলেন।

তারপর তিনজনই একসাথে বেরুলেন বাড়ীর বাইরে। গত কয়েক মাস ধরে তাদের এ সুযোগ হয়নি। একটি ট্রামে চড়ে শহরের খোলা প্রান্তে রওয়ানা হলেন একসাথে। যে কামরায় বসেছিলেন, রৌদ্রের উজ্জল আলো এসে পড়লো সে কামরায়। আরামে তাদের বসার সিটে হেলান দিয়ে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে জল্পনা কল্পনা করলেন। এ ভবিস্যত তাদের কাছে বেশ অলোকিত বলেই মনে হলো। এতোদিন এ নিয়ে কোন আলাপ করেন নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সামনের দিনগুলো অনেক সুন্দর ও বিশেষ করে ভবিষ্যত আরো অনেক বেশী সম্ভাবনাময়। পরিস্থিতি ভালো করা সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে এই বাড়িটি বদলানো। এই বাড়িটি খুঁজে বের করেছিল গ্রেগর, ওরা এটা ছেড়ে আরেকটা ছোট, কিন্তু ভাল এলাকায় আরেকটি বাড়ি খুজে বের করতে চান। এসব অলোচনায় ব্যাস্ত, মি: ও মিসেস সামসা তাদের ধীরে ধীরে আরো বেড়ে ওঠা মেয়ের দিকে পূর্ণ দৃষ্টাতে তাকালেন। গত কয়েক মাসের ঝক্কিঝামেলায় কিছুটা মলিন হয়েছে বটে গালের রং, কিন্তু তারপরেও একটি সুন্দরী ও সাস্থ্যবতী তরুনীর ছাপ পড়েছে চেহারায়। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, এখন একজন ভালো স্বামী ওর জন্যে খোঁজার সময় হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবেই যেন যাত্রার লক্ষে পৌঁছানোর পর মেয়েটিই সবার আগে তার যুবতী শরীরকে টানটান করে উঠে দাঁড়ালো।

বিষয়: বিবিধ

২৮১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File