কপি পেষ্ট
লিখেছেন লিখেছেন অন্য চোখে ১৪ এপ্রিল, ২০১৪, ০২:১৫:৫৪ দুপুর
অন্নদাশঙ্করের ছড়া ঃ জব্দিবে কে শব্দীকে?
Posted by bangalnama on December 22, 2010
- লিখেছেন অরণ্য লাহিড়ী
“তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর ‘পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো!
তার বেলা?”
অন্নদাশঙ্কর রায় এই ছড়াটা লেখেন ১৯৪৭ সালে। ছড়াটিকে প্রায় প্রফেটিক বলা চলে, কারণ এটা লেখার পরেই দেশভাগ হয়। লোকমুখে প্রচলিত হতে হতে এটি পরে প্রবাদতুল্য হয়ে ওঠে। সলিল চৌধুরীর সুরে গানও হয়। এই তো সেদিন ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়েরের গোল্ডেন জুবিলী(২০০৯)তে, কয়েরের ছোটরা গেয়ে শোনালো। অন্নদাশঙ্করের নিজের যদিও ছড়াগান সম্বন্ধে কিছু বিরুপতা ছিল। ‘হিতে বিপরীতও হতে পারে’- এই ছিলো তাঁর সাবধান বাণী, সুরের যদি বেশী জটিলতা বা কারিকুরি থাকে তবে সুরের ভারে ছড়া হারিয়ে যেতে পারে।
তাঁর ‘সেতুবন্ধন’ (১৯৯৪) প্রবন্ধে দেশভাগ নিয়ে অন্নদাশঙ্কর লিখেছেনঃ–
“ভারতভাগ আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিলো না। কিন্তু বাংলাভাগ ছিলো আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। ঘটনাটা একবার ঘটে যাওয়ার পর তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য গতি ছিল না। বুদ্ধি দিয়ে মেনে নিলে কী হবে, অন্তর দিয়ে মেনে নিতে পারি নি। হৃদয়ে যে বেদনা ছিলো, সে বেদনা এখনও রয়েছে।”
এই বেদনা থেকে উৎসারিত হয়েছে বাংলা শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অনেক উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, গান, নাটক ও ফিল্ম। কিন্তু চারটি অব্যর্থ লাইনে এমন অনবদ্যভাবে দেশভাগের অযৌক্তিকতাকে মনের ভেতরে গেঁথে দিতে আর কিছু পেরেছে কি? ‘বুড়ো খোকা’ ও ‘ধেড়ে খোকা’দের এই ‘ভাঙ্গাভাঙ্গির হরির লুট’কে এরকম চমতকার একটা অল্টারনেটিভ পার্স্পেক্টিভে যে দেখা যায়, আর দেখলে যে দেশভাগের তথাকথিত রাজনৈতিক অনিবার্যতার তত্ত্ব খন্ডন করতে যে কোন পন্ডিতী কচকচির দরকার পড়ে না, তা ছোট বড় সব পাঠকের কাছেই অতি সহজে বোধগম্য হয়ে ওঠে। শুধু তাই না, পুরো ছড়াটার সহজ সরল শব্দগুলোর মধ্যে এমন একটা দুলকি চাল ও অন্ত্যমিল যে মনের মধ্যে তা স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়, কিছুতেই ভোলা যায় না।
অন্নদাশঙ্কর এক জায়গায় বলেছেন, “ছড়া একপ্রকার আর্টলেস আর্ট। শিশুরা সহজে পারে, বয়স্করা সহজে পারে না। মেয়েরা সহজে পারে, পুরুষেরা পারে না। অশিক্ষিতরা সহজে পারে, শিক্ষিতরা সহজে পারে না। মূর্খেতে বুঝিতে পারে, পন্ডিতে লাগে ধন্ধ।”
‘উড়কি ধানের মুড়কি’ থেকে দু’একটা উদাহরণ দেওয়া যাকঃ-
১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এবার যাচ্ছেন পাকুড়।
চায়না কিম্বা পেরু না
সেইখানেই তো করুণা।
২
শ্রীমতী অনামিকা দে
কেমন মধুর নাচে সে।
সব কটি ভালো ভালো মে’
সকলের হয়ে গেছে বে’।
দুটি ছড়াই বিলিতি ক্লেরেহিউ গোত্রের। কিন্তু পোষাকটি বিলিতি হওয়া সত্ত্বেও, খাঁটি বাংলার ছড়া। জাত খুইয়ে পা ছড়িয়ে পংক্তিভোজে পাত পেড়ে বসে গেছে। পাঠক লক্ষ্য করবেন অন্ত্যমিল গুলো লঘু কৌতুকের সঙ্গে কত অনায়াসে ছোটাছুটি করছে, যেন বোতল থেকে তেল ঢালা হচ্ছে। অবশ্যই এক জাত শিল্পীর লক্ষণ।
ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন অন্নদাশঙ্করের ছড়া প্রসঙ্গে লিখেছিলেন –
“তাঁর ছড়াগুলো ছন্দ ও বলার ভঙ্গীতে হালকা, কিন্তু ভাবে ভারী। শিল্পগুণ বজায় রেখে তিনি তাঁর রচনার ছন্দ ও বলার ভঙ্গীকে যথাসম্ভব মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে গেছেন।”
ধরা যাক এই ছড়াটাঃ-
পারিবারিক
হাঁ গো হাঁ
পটলের মা
বর্গীরা পৌঁছালো বর্মা
আসতে কি পারে
গঙ্গার ধারে
এদিকে যে রয়েছেন শর্মা।
থাক হে থাক
পটলের বাপ
শুনেছি অমন কত বাক্
তুমি যদি না যাও
বেহালাটি বাজাও
আমি যাই, পটলাও যাক।
যেন মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে লেখা, অথচ কৌতুকটা পালিশ করা হিরের মত ঝকঝক করে উঠছে।
আমরা জানি অন্নদাশঙ্কর বামপন্থার ধার কাছ মাড়ান নি কোনদিন, বরং তিনি মুখ্যত গান্ধী, টলস্টয়, রোমা রোঁলার থেকেই তাঁর মূল্যবোধ গ্রহণ করেছেন। তাঁর সাহিত্য চেতনা দুটি মহান সাহিত্যপ্রভাবে লালিত। একটি সাহিত্যের তিন হাজার বছরের ধারা, অন্যটি ইউরোপীয় রেনেসাঁর পাঁচ শতাব্দীর জোয়ার। মূলতঃ তিনি নিজেকে বলতেন একজন আর্টিস্ট, একজন প্রেমিক। এই প্রসঙ্গে বিষ্ণু দে’র উদ্দেশ্যে লেখা তাঁর একটা ছড়া উদ্ধৃত করা যেতে পারেঃ-
বিষ্ণুকে
“তোমায় আমায় মিল নাই কথা ঠিক সে
মিল নাই পলিটিক্সে।
কিন্তু রয়েছে মিল তো একটি ব্যাপারে,
দুই জনেই তো ক্ষ্যাপা রে।
তোমার আমার দুজনেরই অভিলভিত
কোটি কোটি জন তৃষিত।
শখের লেখায় সুখীদের খুশি করতে
কে চায় লেখনী ধরতে!
তুমি চাও আর আমি চাই মহা জনতায়
অমিল তবুও আছে, হায়!
তুমি চাও তারা গান গেয়ে গেয়ে কাজ করে
সম সমাজের তাজ গড়ে।
আমি চাই তারা সৃষ্টির নব নব লীলায়
গান গায় আর আর হাত মিলায়ে
তুমি কবি যত কর্মীর, যত শ্রমিকের
আমি কবি যত প্রেমিকের। ”(১৯৪২)
কিন্তু অন্নদাশঙ্করের উপন্যাসে, প্রবন্ধে বারবার এসেছে কালচেতনা, দেশ ও জাতির সংকট, পৃথিবীব্যপী রাজনৈতিক টানাপোড়েনের শিকার মানুষ ও মানুষের ধর্ম নিয়ে মনস্বী জিজ্ঞাসা।
শতাব্দীর প্রহরী অন্নদাশঙ্কর দৃষ্টিপাত করেছেন কালের যাত্রাপথের উপর, তাঁর প্রায় সমস্ত রচনাই আলোকিত পাশ্চাত্য মানবিকতাবাদী মণীষায়, নৈর্বক্তিক বিশুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে। তাই তাঁর সমস্ত লেখায় যে চিন্তার স্বচ্ছতা তাতে পাঠকের কোন সংশয় থাকে না।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘চিঠির দর্পণে’ বই-এ, ১৯৫২ সালের একটি ভীষণ ইন্টারেস্টিং চিঠিতে, সুরজিত দাশগুপ্ত (লেখক, তথ্যচিত্র নির্মাতা) সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে লিখেছেনঃ-
“আর অন্নদাশঙ্কর রায় তো লেখার জন্যই চাকরি ছেড়েছেন। আপনাদের সঙ্গে তাঁর পথের মিল নেই, মতেরও – সুতরাং – নেই। কিন্তু আপনাদের সঙ্গে তাঁর উদ্দেশ্যের তফাৎটা কোথায় তা আজো আমি ভেবে ঠিক করতে পারি নি। তিনি বলেন না যে আপনাদের উপায়টা মিথ্যে, তাঁরটাই সত্যি, তিনি বরং উলটো কথাই বলেন, দুটো উপায়ই সত্য, যার যেটা ভাল লাগে। ভালো মনে হয়। আমার নিজের বিশ্বাস, তিনি গভীরভাবে জীবনকে উপলব্ধি করেছেন। আর্টকেও চিনেছেন। তাঁর সমস্ত মতামতই বিশুদ্ধ (এবং সেইজন্যই) উদার মানবিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত – একথা আজকে ক’জন সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে বলা যায় তাতে আমার সন্দেহ আছে। একদা তিনি পরিচয়ের লেখক ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে লেখা নেন না কেন?”
এর চেয়ে ভালভাবে অন্নদাশঙ্করের সাহিত্য চেতনাকে বোঝানো যায় না বলেই আমার বিশ্বাস। প্রসঙ্গত সুভাষ মুখোপাধ্যায় সেই সময় ‘পরিচয়’-এর সম্পাদক ছিলেন।
‘ছড়া লেখার অনুপ্রেরণা কোত্থেকে পেলেন?” এই প্রশ্নের উত্তরে অন্নদাশঙ্কর কয়েকটা চমৎকার কথা বলেছিলেন। “একটা লক্ষ্য ছিল আমার। জনসাধারণের কাছ থেকে আমি কত কিছু নিচ্ছি, কতকিছু পাচ্ছি। তার বদলে তাদের দেব কী? যারা আমাকে খাইয়ে পরিয়ে আরামের বাঁচিয়ে রেখেছে, তাদের শ্রমের ঋণ আমি শোধ করব কী উপায়ে? আমি তো চাষী বা কারিগর বা মজুর নই। এ ঋণ অর্থ দিয়ে শোধ করা যায় না। … কাব্যে বা উপন্যাসে বা প্রবন্ধে এ ঋণ আমি শোধ করতে পারি নি, পারবও না। … তাহলে আমি কী করবো?”
“ফলে তাদের উপযুক্ত করে কিছু দেওয়ার জন্য একবার জনসাহিত্যের মত আমি ছড়াকে নিলাম। এমন লেখা যা সেলার কনশাস না হয়ে পড়ে। যা পড়ার দরকার নেই, শুনলেই সবাই বোঝে, বুঝতে পারে। যাদের আমরা অশিক্ষিত, সাদামাটা ভাবি, তাদের কাছেই আমার অনেক শেখার আছে।”
এই ছড়াটার কথাই ধরা যাকঃ-
ভেলকি
চন্ডীচরণ দাস ছিল
পড়তে পড়তে হাসছিল।
হাসতে হাসতে হাঁস হল
হায় কী সর্বনাশ হল!
বিশ্বমোহন বল ছিল
ঘাসের ওপর চলছিল।
চলতে চলতে ঘাস হল
হায় কী সর্বনাশ হল!
নন্দগোপাল কর ছিল
ডুব দিয়ে মাছ ধরছিল।
ধরতে ধরতে মাছ হল
হায় কী সর্বনাশ হল!
বন্দে আলি খান ছিল
গাছের ডাল ভাঙ্গছিল।
ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে গাছ হল
হায় কী সর্বনাশ হল!
খাঁটি বাংলা ছড়ার রসে এটি সিক্ত। রবীন্দ্রনাথ ছেলেভুলানো ছড়ায় যেটা বলেছিলেন – “আমি ছড়াকে মেঘের সাথে তুলনা করিয়াছি। উভয়ই পরিবর্তনশীল, বিভিন্ন বর্ণে রঞ্জিত, বায়ুস্রোতে যথেচ্ছ ভাসমান। দেখিয়া মনে হয় নিরর্থক। ছড়াও কলাবিচার শাস্ত্রের বাহির, মেঘ-বিজ্ঞানও শাস্ত্রনিয়মের মধ্যে ভাল করিয়া ধরা দেয় নাই। অথচ জড়জগতে এবং মানবজগতে এই দুই উচ্ছৃঙ্খল অদ্ভুত পদার্থ চিরকাল মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিয়া আসিয়াছে। মেঘ বারিধারায় নামিয়া আসিয়া শিশু-শস্যকে প্রাণদান করিতেছে এবং ছড়াগুলি স্নেহরসে বিগলিত হইয়া কল্পনাবৃষ্টিতে শিশু-হৃদয়কে উর্বর করিয়া তুলিতেছে।”
আমাদের অতি-পরিচিত চারটি মানুষ নিতান্ত আটপৌরে কাজেই ব্যাস্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ ভেলকির ছোঁয়ায় তারা হাঁস, মাছ, গাছ ও ঘাস হয়ে গেলো। “হায় কী সর্বনাশ হল!” বলে আমাদের সম্ভবত খেদ, এও যেন ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আনাগোনার মতই নিরর্থক ও ভারহীন, আর সেই জন্যেই ছড়াটি এক মুহূর্তে মানুষের মুখে মুখে ফেরার যোগ্য হয়ে ওঠে।
ছড়ার আঙ্গিক কী হবে, এই প্রসঙ্গে ধীমান দাশগুপ্তকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে অন্নদাশঙ্কর কয়েকটা দামী কথা বলেছিলেন -
“আমার কাছে আদর্শ ছড়া ছিল ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে,’ ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো,’ ‘হাট্টিমাটিম টিম,’ এইসব। খাঁটি লোক সংস্কৃতি, মুখে মুখে যা ছড়িয়ে পড়ে, পুরুষানুক্রমে যা সঞ্চারিত হয়। একদিকে এই আর একদিকে হিউমারাস বা নন সেন্স কিছু। এই সব লোকছড়ায় কতদিনের অভিজ্ঞতা, ফোক উইসডম ধরা থাকে।”
“এমনিতে কবিতার মতো ছড়ার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, ছড়া বানাবার। ছড়া হয় আকস্মিক, ইররেগুলার। সেখানে আর্ট আছে, আর্টিফিসিয়ালিটির স্থান নেই। ছড়া হবে ইররেগুলার, হয়তো একটু আনইভেন, বাকপটুতা, কারিকুরি নয়।”
“ছড়ার কিন্তু একটাই ছন্দ, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ছড়ার ছন্দ, একটু দুলকি চালে চলে, শাস্ত্রসম্মত নামও একটা আছে তার। ছড়া ঐ ছন্দেই লেখা যায় শুধু। আমি ওতেই লিখেছি মূলত। হয়তো কোথাও কোথাও অন্যরকম করেছি। কিন্তু আসল ছন্দটা ওই। আর ছড়ার মিল দু সিলেবল হবেই। তিন সিলেবল হলে আরো ভালো হয়। আর শেষে কোনও যুক্তাক্ষর থাকবে না। এসব এখন অনেকে মানেন না, এক সিলেবল মিল দিয়ে ছেড়ে দেন, ক্রিয়াপদের সাথে ক্রিয়াপদের মিল, যত সব ফাঁকিবাজি।”
শোনা যাক, দু একটা ছড়া, তাহলেই কথাগুলো স্পষ্ট হবেঃ-
কেউ জানে কি
হা হা
সত্যভূষণ রাহা
যে কথাটা বললে তুমি
সত্য বটে তাহা!
চামচিকেরা ঝুলকালি খায়
কেউ জানে না আহা!
হো হো
ইন্দুভূষণ গোহো
এই কথাটা জানলে পরে
ভাঙ্গবে তোমার মোহ!
গাংচিলেরা নাসপাতি খায়
কেউ জানে না ওহো!
ব্যাঙের ছড়া
ব্যাঙ বললেন ব্যাঙাচ্চি
দাঁড়া তোদের ঠ্যাঙাচ্ছি।
তা শুনে কয় ব্যাঙাচ্চি,
আমরা কি স্যার, ভ্যাঙাচ্ছি?
সহজ সরল ছন্দ, সহজ সরল কথাগুলো দুলকি চালে চলছে, তাই আমাদের মন জয় করতে কোনও প্রয়াসেরই প্রয়োজন হচ্ছে না। অনায়াসে তা ঘটছে। আরো শুনুন –
বাতাসিয়া লুপ
ছটা কুড়ি
ট্রেন ছেড়েছে শিলিগুড়ি।
ডিং ডং
ছাড়িয়ে গেলো কার্সিয়ং
ঝুম ঝুম
এবার বুঝি এলো ঘুম।
টিং টং
ঘুম থেকে যায় দার্জিলিং
ইয়া ইয়া
এই কি সেই বাতাসিয়া?
চুপ চুপ
সামনে বাতাসিয়া লুপ
নমো নমো
বিশ্বমাঝে উচ্চতম।
খেলনা রেলগাড়ির ঢিমেতালে ছুটে চলা আর আনুষঙ্গিক শব্দপ্রবাহকে এতো মনোহর ভাবে এই ছড়াতে ধরা হয়েছে যে একবার শুনলেই মনে গেঁথে যায়।
অন্নদাশঙ্করের ছড়া নিয়ে যে কোন আলোচনায় তাঁর রাজনৈতিক ছড়ার কথা এসে পড়ে অনিবার্যভাবে। শুধু শ্লেষ বা বিদ্রুপই না, তাঁর রাজনৈতিক ছড়াগুলোতে এই ক্রান্তদর্শী কালের প্রহরীর স্বকালের সীমানা ছাড়িয়ে ভাবীকালে দৃষ্টি রাখার ক্ষমতা আমাদের অবাক করে দেয়।
পশ্চিমবাংলার আজকের “পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে” (আমার এক বন্ধু, ব্যবহার হয়ে হয়ে শুয়োরের মাংস হয়ে যাওয়া এই ফ্রেজটার নাম দিয়েছে “তিনটে পরি!”) ১৯৫০ সালে লেখা এই ছড়াটার কথা ধরা যাকঃ-
ভূষন্ডী
ভূষন্ডী কয়
শোন রে উল্লুক
এতদিন ছিল
মগের মুল্লুক
রচনাকাল ১৯৫০ না হয়ে ২০১০ হলেও বেমানান লাগতো কী? অথবা ধরুন, ১৯৫২ সালে লেখা এই ছড়াটাঃ-
ত্রিকালদর্শী
সামরাজ্য রামরাজ্য
দেখলি একে একে
বাকী থাকে কমরাজ্য
হয়তো যাবি দেখে।
বা, এটিঃ-
কেন এমন ভাগ্যি
কেন এমন ভাগ্যি হলো
সরষের তেল মাগগি হলো
কেউ জানে না মাখনের কী খবর!
টুইডেলডাম রাজা, তোমায়
ছি ছি ছি!
এখন থেকে রাজা হবেন
টুইডেলডী
কেন এমন ভাগ্যি হলো
শাক সবজি মাগগি হলো
কেউ দেখে নি মাছের এত দর।
সব চলে যায় রাজার পাতে
এঁটো কুড়োয় হাড় হাভাতে
কেউ জানে না কী আছে এর পর।
টুইডেলডী রাজা, আরে
রাম রাম বাম!
এখন আবার রাজা হবেন
টুইডেলডাম! (১৯৭৭)
এক কথায় বলতে হয়, জবাব নেই!
আমাদের সাহিত্যে সার্থক ছড়াকারের অভাব নেই। রবীন্দ্রনাথ ও সুকুমার রায়কে অগ্রণী পুরুষ হিসেবে রেখে, পরবর্তী কালে শঙ্খ ঘোষ, পূর্ণেন্দু পত্রী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ চৌধুরী, তুষার রায় ও আরো অনেকে অতি উৎকৃষ্ট ছড়া লিখেছেন, রাজনৈতিক ছড়াও কম লেখা হয়নি। কিন্তু অন্নদাশঙ্করের রাজনৈতিক ছড়ার জাতই আলাদা। দু’লাইন পড়লেই মনে গেঁথে যায়। স্যাটায়ার বা উইটের ছটায় চোখ ধাঁধায় না, শুধু একটু মুচকি হাসি হাসতে হয়।
অন্নদাশঙ্করের কথায়, “আমার ছড়া সমসাময়িক ঘটনাবলীর খাতেও বয়। চারিদিক থেকে তার জন্যে অনুরোধ আসে। ছড়াই হয়ে ওঠে আমার রাজনৈতিক ভাষ্য, যদিও আমি রাজনীতির বাইরের লোক। কৌতুকরসই আমার অবলম্বন। তার আড়ালে থাকে নিগুঢ় মর্মবেদনা।”
যেমন, দেশভাগের বেদনা নীচে উদ্ধৃত ছড়াটিতে যেভাবে ফুটেছে, তা আর কোথাও আমরা পাই না। মুচকি হাসির সাথে এতে মিশে আছে ক’ফোঁটা চোখের জলওঃ-
ফতেপুর সিক্রী
শেষটা আমি ঠিক করেছি
দেশটা করে বিক্রী
গন্ডা কয়েক গড়িয়ে দেবো
ফতেপুর সিক্রী
আয় রে বাঙাল, আয়রে
আয় রে কাঙাল, আয়রে
দেনার দায়ে জন্মভূমি
হলো তোদের ডিক্রী
নাকের বদলে নরুন পেলি
ফতেপুর সিক্রী।
এবারে শুনুন, এই ছড়াটা, যাকে এককথায় বলে আনবিটেবল্ঃ-
গিন্নী বলেন
যেখানে যা কিছু ঘটে অনিষ্টি
সকলের মূলে কমিউনিষ্টি।
মুর্শিদাবাদে হয় না বৃষ্টি
গোড়ায় কে তার? কমিউনিষ্টি।
পাবনায় ভেসে গিয়েছে সৃষ্টি
তলে তলে কেটা? কমিউনিষ্টি।
কোথা হতে এলো যত পাপিষ্ঠি
নিয়ে এলো প্লেগ কমিউনিষ্টি।
গেল সংস্কৃতি, গেল যে কৃষ্টি
ছেলেরা বললো কমিউনিষ্টি।
মেয়েরাও হতে পায় কী মিষ্টি।
সেধে গুলি খায় কমিউনিষ্টি।
যেদিকে পড়ে আমার দৃষ্টি
সেদিকেই দেখি কমিউনিষ্টি।
তাই বসে বসে করছি লিষ্টি
এ পাড়ার কে কে কমিউনিষ্টি। (১৯৪৯ )
আর এটা পড়ে যদি একটুখানি মুচকি হাসি হেসে থাকেন, তাহলে এবার যেটা পেশ করছি সেটা পড়ে যে মুজতবা আলি’র ভাষায় ‘কোমরে হাত দিয়ে ঠা ঠা করে’ হেসে উঠবেন, সেটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারিঃ-
কোন নেতার মৃত্যুকে
ভাই
স্বর্গে নরকে যেখানেই হোক ঠাঁই
দেখবে সেথায় মুসলমানও আছে
কিন্তু ওদের তাড়াবার পথ নাই। (১৯৫০)
এটাকেওঃ-
বাঁধা
“এ জীবন অতি অনিশ্চিত
তবুও নিশ্চিত
কী আছে বলহ?”
“কলহ!”
মূল্যবৃদ্ধির ফ্যাসাদ নিয়ে, এই দুটো ছড়া শোনা যাকঃ-
বাজার
বলো কী হে, বলরাম
কচু কেন এত দাম
ঢ্যাঁড়স এমন কেন মাগগি!
জানেন না গঙ্গায়
জাহাজ আসে না, হায়!
পাচ্ছেন, এই ঢের ভাগ্যি!
(১৯৫৫)
ঢ্যাঁড়স
ঢ্যাঁড়স বলেন রেগে
এ কেমন কথা!
সকলের দাম বাড়ে
আমার অন্যথা!
মুখ থেকে এই বাত
যেই বেরিয়েছে
হাটে গিয়ে দেখি, হায়
ঢ্যাঁড়সও বেড়েছে।
জরুরি অবস্থা বা অযোধ্যা কান্ডের মতো গ্লানিকর ঘটনার সময়ও তাঁর ছড়ার কলম থেমে থাকে নি। অন্নদাশঙ্কর ছিলেন মনেপ্রাণে সেকুলার আর মানুষের অধিকারে তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। তাই তিনি লিখলেনঃ-
চুনোপুঁটি
আমরা চুনোপুঁটি
হেতের হলে ভোঁতা
হেতের বলতে দুটি
পাত্তা পাবো কোথা?
কলম আর গলা
বৃথাই কথা বলা।
হেতের দাও শান
কোরো না খানখান
কে জানে সে কবে
তোমারও দিন হবে
তীক্ষ্ণ হোক ফলা
ধন্য হবে বলা।
জরুরী জারি গান
ইস্কাবনের বিবি রে
জরুরী তাঁর কেল্লা
বাইরে যে তার বাহার কত
কত রঙের জেল্লা রে, কত ব্রাশের জেল্লা!
- আহা বেশ বেশ বেশ!
বিশ্ববাসীরা বলে, ও যে
দুর্গাবতীর দুর্গ
আর কিছুদিন সবুর করো
হবে স্বর্গপুর গো, ভূ-ভারতের স্বর্গ!
- আহা বেশ বেশ বেশ!
সংশয়ীরা বলে, হবে
দ্বিতীয় ক্রেমলিন
নির্বিচারে বন্দীরা যার
অন্তরালে লীন হে, অন্তরে বিলীন!
- নাকি বেশ বেশ বেশ
ভাগ্যে হঠাৎ পড়ল ধ্বসে
মহৎ ত্রাসের কেল্লা
নয় পাঠানের নয়কো লোহার
ফাঁপা তাসের কেল্লা রে ফাঁকা তাসের কেল্লা!
- হা হা বেশ বেশ বেশ
অযোধ্যা কান্ড
অযোধ্যায় ফিরলেন রাম রাও
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরাও
এবার তোমরা যারা
মাস শেষে গদীহারা
ঘরে বসে হাত পা কামড়াও।
এবার যে ছড়াগুলো শোনাবো, সবই রাজনৈতিক গোত্রের। কিন্তু পাঠকদের যেটা লক্ষ্য করতে বলবো, তা হলো ২০ থেকে ৫০ বছর আগে লেখা ছড়াগুলো আজকের বাজারেও কেমন অব্যর্থভাবে প্রাসঙ্গিকঃ-
বুদ্ধি শুদ্ধি লোপ
বাধলে গৃহযুদ্ধ
চক্ষু করি রুদ্ধ
আমি যেন বুদ্ধ
বাধলে গৃহযুদ্ধ
কর্ণ করি রুদ্ধ
আমি যেন শুদ্ধ
শ্যামকুলিজম
বলছি সখি, শোন লো কুই
শ্যাম আর কুল রাখবো দুই।
বিপ্লবই আমার প্রিয়
সকলকরূপে বরণীয়
কিন্তু আমার আলম্বন
বিধানসভার নির্বাচন।
নির্বাচনের ফাঁকে ফাঁকে
শ্যামের বাঁশি আমায় ডাকে
গদী করি বিসর্জন
আসন করি বিবর্জন
কী হবে ছাই বিধানসভায়
মন্ত্রী হতে কেই বা লাফায়!
দিক ভেঙ্গে ওই সভা মন্দ
নয়তো আমি ডাকবো বন্ধ
আমার দাবি নির্বাচন
নইলে হবে বিপ্লাবন।
শ্রেণীযুদ্ধ
ঘোষ বোস মিত্তির
চট্টো ও বন্দ্যো
শ্রেণীতে শ্রেণীতে এঁরা
বাধালেন দ্বন্দ্ব।
শ্রেণীশত্রুরা কারা
কী মহান সত্য
মুখো আর গঙ্গো
দে আর দত্ত।
বাইরে ও ভিতরে
বাইরে কোঁচার পত্তন
ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন
রাম রাম হরে হরে!
বাইরে ভি আই পি
ভিতরে খোলা ছিপি
রাম রাম হরে হরে!
বাইরে ধলা টুপী
ভিতরে কালা রূপী
রাম রাম হরে হরে!
বাইরে হিল্লী দিল্লী
ভিতরে গ্রাম্য বিল্লী
রাম রাম হরে হরে!
শুনহ ভোটার ভাই
শুনহ ভোটার ভাই
সবার উপরে আমিই সত্য
আমার উপরে নাই।
আমাকেই যদি ভোট দাও আর
আমি যদি হই রাজা
তোমার ভাগ্যে নিত্য ভোগ্য
মৎস মাংস খাজা।
শুনবে আমার নাম?
আমি টুইডেলডাম।
শুনহ ভোটার ভাই
সবার উপরে আমিই সত্য
আমার উপরে নাই।
আমাকেই যদি ভোট দাও আর
আমি যদি হই রাজা
সাতখুন আমি মাপ করে দেব
তোমার হবে না সাজা।
নামটি আমার কী?
আমি টুইডেলডী।
হাটে হাঁড়ি
নাইকো এখন মারামারি
ভাবছি হাটে ভাঙ্গবো হাঁড়ি
নাইকো এখন ভোটাভুটি
কে খেয়েছে কত কোটি।
এই গোত্রের আরো অনেক অনেক ছড়া উদ্ধৃত করার লোভ প্রাণপণে সম্বরণ করেও, শেষ পাতে মধুরেণ কয়েকটা কৌতুক-সিক্ত ছড়া না শুনিয়ে পারলাম নাঃ-
আরে আরে
আরে আরে ছিছি!
চোদ্দ হাত কাঁকুড়
তার ষোলো হাত বীচি!
অসুবিধে
ভদ্রতার এক অসুবিধে
মুখে লাজ পেটে খিদে।
দুই ভাই
টোকাটুকি করে যে
গাড়ী ঘোড়া চড়ে সে
পড়ে শুনে করে পাস
দুঃখী সে বারো মাস।
অবাক দুগ্ধপান
খবরটা শুনে আমি মুগ্ধ
গণেশজী খেয়েছেন দুগ্ধ।
বিমোহিত হব শুনি যদি
ইঁদুরনী খেয়েছেন দধি।
নাক ডাকা
গিন্নি বলেন কর্তাকে,
তোমার কেন নাক ডাকে।
কর্তা বলেন রাম! রাম!
নাক ডাকলে শুনতাম।
লিমেরিক
এক যে ছিল মানুষ
নিত্য ওড়ায় ফানুষ
অবশেষে এক দিন
ব্যপার হলো সঙ্গীন -
ফানুষ ওড়ায় মানুষ।।
অন্নদাশঙ্করের ছড়া একটানে কাছা খুলে দেয় সব ভনিতার, সব মানুষ-বেশী ফানুষদের হাঁড়ি ভেঙ্গে দেয় হাটের মাঝখানে। পুরোটাই কিন্তু পরম কৌতুকে ভরা। বিদ্বেষের ছিঁটেফোঁটাও নেই তাতে, বরং আছে দেশজ আড্ডার মেজাযে খাঁটি বাঙালী বাওয়ালী ও খিল্লী। তাই তুষার রায়ের ভাষায় তাঁর সামনে হাঁটুটা মুড়ে, টুপিটা খুলতেই হয়, মাথা ঝাঁকিয়ে করতেই হয় একটা স্মার্ট কুর্নিশ।
অন্নদাশঙ্কর একটা ছড়ায় লিখেছিলেন, “জব্দিবে কে শব্দীকে?/শব্দ যে যায় সব দিকে।” এর চেয়ে সুন্দরভাবে তাঁর ছড়াগুলো আমাদের মানসলোকে যে অভিঘাত জাগায় তা প্রকাশ করা যায় না। তাঁর রাজনৈতিক মতবাদ ছিলো তাঁর নিজের ভাষায় “অহিংস নৈরাজ্যবাদ,” সে মতের সাথে আমরা একমত না হতে পারি, তাঁর এপিকধর্মী উপন্যাসকে আমরা অবজ্ঞা করতে পারি। এমনকি তাঁর অসংখ্য মুক্তমনা প্রবন্ধগুলোকেও এড়িয়ে যেতে পারি। কিন্তু তাঁর ছড়ার ছন্দবদ্ধ শব্দগুলোকে জব্দ করা যাবে না কিছুতেই। বছরের পর বছর ধরে তা রয়ে যাবে কালজয়ী হয়ে, আবৃত্তি হয়ে, গান হয়ে, সাধারণ মানুষের, যাদের জন্য তিনি ছড়া লিখেছেন, যে রকম ছড়া, ‘যা পড়ার দরকার নেই, শুনলেই সবাই বোঝে, বুঝতে পারে,’ তাদের মুখে মুখে।
তাই দুই বাংলার সমস্ত বাঙালীর তরফ থেকে, আসুন আমরা সবাই উঠে দাঁড়াই, হাততালি দি, কারণ এই অক্লান্ত ছড়াকারকে এক্ষুণি দেওয়া উচিত একটা উপযুক্ত স্ট্যান্ডিং ওভেশান!
লিঙ্ক : Click this link
বিষয়: বিবিধ
১৩৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন