বাবার কাছে খোলা চিঠি

লিখেছেন লিখেছেন অন্য চোখে ২৩ মার্চ, ২০১৪, ০৯:২৯:০২ সকাল

কৃষক কৃষি শব্দ গুলোর প্রতি একটা আত্মিক টান অনুভব করি, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, রোদ বৃষ্টি ঝড় বন্যার সাথে নিয়ত পাঞ্জা লড়াই, মাতব্বর এর কাছ থেকে সুদে বা দাদনের টাকা, নকল সার, অতি ফসল বা বিনা ফসল এর অভিশাপ আমাকে নিয়ত কুড়ে কুড়ে খায়, এই যে প্রতিদিন কত কিছু খাচ্ছি নষ্ট করছি ভোগ উপভোগ সবই করছি, কিন্তু কৃষক আর কৃষি না থাকলে কি হবে আমাদের অপিস আদালত,মাস শেষে মাইনে এসবের, যদি খেতে না পাই।

কি জানি হয়তো কৃষকের ছেলে নই বলে এতো মায়া কান্না, অভাব আর দুর্যোগগুলো যখন সইতে হতো তখন হয়তো বলতাম হে আল্লাহ কি অপরাধ ছিল আমার, কেন তুমি কৃষকের ঘরে পাঠালে, এতো অভাব, এতো দুর্যোগ, এতো অত্যাচার, এতো অবিচার সব কেন আমাদের সইতে হবে।


একটা লুংগি আর একটা গামছা পাল্টে দিল সব হিসেব নিকেশ, গন্তব্য অজানা, স্কুলের প্রতি একটা টান অনুভব করেছিল সেই টানেই ঘর ছাড়া, পড়তে চাইলে কে যোগাবে খরচ! তবুও হাল ছাড়া হয়নি, শূন্য হাত, একটা লুংগি আর একটা গামছা, সেটাই সম্বল, পেটে ক্ষিধে চোখে স্বপ্ন সেটাই সম্বল।

সেইসব গল্প শোনা হয়নি কোনদিন, বিক্ষিপ্ত কিছু শব্দ কিছু ঘটনা কানে এসেছে থেকে থেকে, প্রাইমারী স্কুলেই লজিং মাষ্টার তার উপর এক ব্যাচ সিনিয়র এক আদু ভাই, লুংগি গামছা এর পর যার প্রতি আমার একটা বিশেষ টান অনুভব হয় তা হল সেই আদু ভাই, তাকে পড়ানোর জন্যই তো লজিংটা পাওয়া গেল।


তারপর শব্দ ছেদ, জানা হয়নি আর, লজিং ছেড়ে কি করে চলে আসা হল শহরে! হাই স্কুল পাঠ শহরেই, টুকটাক কবিতা, সাহিত্য চর্চা করতেন বলে অনেকে পছন্দ করতেন, আর পেয়ে গেলেন দুই ব্যাচ সিনিয়র ভিন ধর্মের এক পরম বন্ধু যে কিনা দুই কিলোমিটার সাইকেল চলিয়ে এসে অংক বুঝিয়ে দিয়ে যেতেন, তারপর খুব একটা বেশী এগুতে পেরেছেন তা নয়, হাই স্কুল শেষে চাকরী, এটা করে ওটা ছাড়ে, শেকড়টা একটু শক্ত করার স্বপ্ন, আর কতো ভাসা যায়।

স্কুলের প্রতি টানটা ভেতর থেকেই ছিল, তাই আবার গ্রামে ফেরা, সকলে দেখতে আসল, কোথায় ছিলি তুই, কেমন ছিলি? একেবারে যে শহুরে হযে গেলি দেখছি! না শহুরে হতে গ্রামে আসা হয়নি, একটা স্কুল দেবেন সেই স্বপ্ন নিয়েই আসা, টাকা পয়সা এবারও নেই, সেই যে লুংগি গামছা অভিযান, সেই অনুপ্রেণাই ভরসা, স্কুল এর খুটি আর গাড়া গেলনা, প্রতিবাদ আসল, প্রতিরোধ করা গেলনা, আবার গ্রাম ছাড়া, এক বুক অভিমান।


সমাজকে কিছু দিতে পেরেছেন তা না, সংসারটাই যুদ্ধ ক্ষেত্র, মাস শেষে ঘর ভাড়া, দোকানে বাকির খাতা, এটা সেটা কত কি! ছেলে মেযে লেখা পড়া করছে বটে তবে কেমন হচ্ছে সেই লেখাপড়া সেটা মনের চোখে দেখলেও বাইরের চোখে প্রকাশ করার সাহস আর হয়ে উঠেনা, সেই ছোট বেলার দুঃসাহসে আজ অনেক ভাটা, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ কেন হলো তার সমাধান যদি প্রইভেট টিচার এর উপর বর্তায় তাহলে নতুন একটা দুশ্চিন্তার পথ খোল হবে, খোদার অশেষ রহমত, ছেলে মেয়েরা কেউ ডাক্তার ইজ্ঞিনিয়ার হয়নি তবে সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের দেয়াল ছোবার মতো ভাগ্যটা হয়েছে।

সবকিছু গুছিয়ে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তোলার যখন সময় হলো আবার দূর্যোগ, যার জন্য টিকে থাকে একটা পরিবার, যাকে নিয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে শত সহস্র মাইল পাড়ি দেবার সেই বন্ধুটা হারিয়ে গেল, ছেলে মেয়েরা চাকরী করছে আজ, আল্লাহর রহমতে অভাব শব্দটা আর ভয়াল হয়ে এসে ধরা দেয়না, সন্তানদের জন্য শহরে সেমিপাকা একটা স্বপ্নের বাড়িও করে দেয়া গেল, শুধু একটাই দুঃখ যাকে নিয়ে এই সংগ্রামী পথ চলা, তরী ভেড়ানোর একটু আগেই তাকে বিদায় দিত হল।


বয়েস হয়েছে এখন, কোন কালে বা বয়সে কোথাও আড্ডা দেবার মতো সময় সুযোগ মানসিকতা এসব ছিলনা, এখনো নেই, নিয়মিত মসজিদ, বই পড়া, খবরের কাগজ, টিভি সংবাদ, গরীব আত্মীয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের নিজের হাত খরচ থেকে যা পারেন সাহায্য এসব করেই সময় যাচ্ছে চলে, মাস শেষে ব্যাস্ততা একটু বেড়ে যায়, আসে পাশের ঘরগুলো থেকে কারেন্ট বিল যোগাড় করে সব একসাথে গিয়ে দিযে আসবেন, তখন খুব ব্যাস্ত আর মাথা টিক থাকেনা, টুকটাক চিল্লাপাল্লাও চলে, অমুক সাহেব এখনো বিলের টাকা দেইনি, উনার জন্য আমি যেতে পারছিনা বিল পরিশোধ করার জন্য, ওদিকে আগামীকাল হরতাল, তারপর একটা দিন বাকি, সেদিন খুব ভীড় হবে, দিতে না পারলে জরিমানা গুনতে হবে ইত্যাদি। কত করে বলা হয়, যিনি দেবেননা তারটা থাক, বাকীগুলো দিযে আসেন, সেটাও শুনবেননা, ঘরেই চিল্লাচিল্লি করবেন, ইত্যাদি।

আসলে খুব বদমেজাজি ছিলেন, এখন অবশ্য তেমনটা আর নেই, উল্টো ছেলে মেয়েদের ভয় পান, নিজের পরিশ্রমের ঘরবাড়ী, চালচুলো সব ছেলেদের হাতে, সবার বিয়ে হয়ে গেছে, মেয়েদের ডেকে এনে বলে দিযেছেন, তোমরা নাইয়র এসে যতদিন ইচ্ছে থেকে যাবে, কিন্তু তোমাদের অনুরোধ আমার এই ছোট্ট জায়াগাটাতে দাবী করবেনা, এই ছোট্ট জায়গাটাতে ছেলেরা থাক, এটা ভাগ করার কিছু নেই, ভাগ করলে কারো কুলাবেনা, শুধু শুধু ঝগড়া আর নষ্ট করা হবে, তোমাদের ভাইদের প্রতি এই সেক্রিফাইসটুকু তোমরা করবে।


মানুষ একা আসে আবার কি করে একা হয়ে যায় ভাবতে অবাক লাগে, ঘরে ল্যান্ড ফোন আছে, মোবাইল ইউস খুব ভাল না জানলেও ইউস করছেন, নিজ থেকে একে ওকে ফোন করে খবর নিচ্ছেন, কারো জন্য নামাজে দোয়া করছেন, দেশটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছেন, আর অপেক্ষা করছেন হয়তো অন্তিম যাত্রার।

বাবার কথা বলছিলাম, খুব কান্না পাচ্ছে লিখার শেষ দিকে, আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা, আপনার জন্য এমন করে কখনো কাঁদিনি, আজ রাতে কাঁদলাম, আপনার জন্য কিছুই করতে পারলামনা, আপনি শুধু যুদ্ধ করেই গেলেন, আর যুদ্ধ শেষে হারালেন মাকে, আমি জানি, আপনি খুব একা...............


ইতি আপনার পাগলা ছেলেটা।

বিষয়: Contest_father

১৩৭২ বার পঠিত, ২৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

196490
২৩ মার্চ ২০১৪ সকাল ০৯:৪৫
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম, জাজাকাল্লাহুল খাইরান, অনেক সুন্দর পোস্ট
২৩ মার্চ ২০১৪ রাত ১১:৪১
146883
অন্য চোখে লিখেছেন : ওয়াইলাকুম আসসালাম, শুকরিয়া, ধন্যবাদ জানবেন
196510
২৩ মার্চ ২০১৪ সকাল ১০:১১
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : সশ্রদ্ধ সালাম আপনার সংগ্রামী বাবাকে। আল্লাহ উনাকে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন। আমিন।
২৩ মার্চ ২০১৪ রাত ১১:৪২
146884
অন্য চোখে লিখেছেন : আমীন, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
২৬ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:২০
161805
ব্যতিক্রম বলছি লিখেছেন : Click this link
196515
২৩ মার্চ ২০১৪ সকাল ১০:৫২
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : সেদিন গিয়েছিলাম আপনাদের বাসায়, যখন আপনি দেশে এসেছিলেন, কত সহজে কেমন করে একজন বৃদ্ধ মানুষ আমাকে এতটা আপন করে নিয়েছে -আমি তো ‍অবাক হয়েছিলাম। এই সেই কত কথা। নরুল ইসলাম জিহাদী ছিলেন ওনার বন্ধু, আমাদের বাড়ির নাম নরুল ইসলাম জিহাদীর বাড়ি বলার পর- সেই পুরানো দিনের কত গল্প শুরু করে দিলেন। নজরুল সেই কথাটি বলবো-‘বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি, যাহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের ন্যায় প্রদীপ্ত যৌবন’
২৩ মার্চ ২০১৪ রাত ১১:৪৩
146885
অন্য চোখে লিখেছেন : বাবার এই গুণটা পেলামনা, পেলে ভাল হত, ধন্যবাদ রইল
196517
২৩ মার্চ ২০১৪ সকাল ১০:৫৩
শুভ্র আহমেদ লিখেছেন : ভালো লাগল
২৩ মার্চ ২০১৪ রাত ১১:৪৩
146886
অন্য চোখে লিখেছেন : ধন্যবাদ জানবেন ভাইযান
২৬ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:২০
161804
ব্যতিক্রম বলছি লিখেছেন : Click this link
196636
২৩ মার্চ ২০১৪ বিকাল ০৪:২৫
প্যারিস থেকে আমি লিখেছেন : আপনার লেখাটা পড়ে খুব ভালো লেগেছে।
২৩ মার্চ ২০১৪ রাত ১১:৪৩
146888
অন্য চোখে লিখেছেন : ধন্যবাদ জানবেন, প্যারিস থেকে আপনি
196692
২৩ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:০৫
ইকুইকবাল লিখেছেন : পাগলা ছেলেটা খুবই ভালা
২৩ মার্চ ২০১৪ রাত ১১:৪৩
146889
অন্য চোখে লিখেছেন : Rolling on the Floor Rolling on the Floor Rolling on the Floor Rolling on the Floor Rolling on the Floor
196772
২৩ মার্চ ২০১৪ রাত ০৯:৪১
আবু তাহের মিয়াজী লিখেছেন :
আমরা যারা দুর প্রবাসে আছি প্রতিদিন নামায আদায় করে মহান আল্লাহ তা'য়ালার দরবারে দু'হাত তুলে আমাদের এদুয়া-এই পড়া উছিত "রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছাগিরা"।

লেখাটা পড়ে খুব ভালো লেগেছে।
২৩ মার্চ ২০১৪ রাত ১১:৪৫
146890
অন্য চোখে লিখেছেন : "রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছাগিরা"। (ধন্যবাদ জানবেন)
২৬ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:২০
161803
ব্যতিক্রম বলছি লিখেছেন : Click this link
196838
২৩ মার্চ ২০১৪ রাত ১১:৪৭
আরোহী রায়হান প্রিয়ন্তি লিখেছেন : পড়তে পড়তে মনটা সিক্ত হয়ে উঠলো। সালাম ও দোয়া রইলো আপনার বাবার জন্য। আপনার জন্য অনেক শুভকামনা।
২৪ মার্চ ২০১৪ রাত ১২:৪৪
146920
অন্য চোখে লিখেছেন : শুকরিয়া, ধন্যবাদ জানবেন Good Luck
২৬ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:২০
161802
ব্যতিক্রম বলছি লিখেছেন : Click this link
196906
২৪ মার্চ ২০১৪ রাত ০৪:৫৩
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : বাবাকে নিয়ে লেখা প্রতিটা শব্দ শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় পূর্ণ। ভালো থাক আমাদের বাবারা। আল্লাহ তাদের অবদানের উত্তম প্রতিদান দিন।
২৫ মার্চ ২০১৪ রাত ০২:০৬
147306
অন্য চোখে লিখেছেন : আমীন, অনেক অনেক ধন্যবাদ রইল
১০
197220
২৪ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:১৯
সিটিজি৪বিডি লিখেছেন : আমিও বাবা-মার জন্য প্রবাসে কাঁদি। ভালো লাগলো। এবার পুরস্কারটা উমামার কাছে যাবেই যাবে ইনশাআল্লাহ।
২৫ মার্চ ২০১৪ রাত ০২:০৭
147307
অন্য চোখে লিখেছেন : Surprised Surprised হঠাৎ মনে হল লিখি, লিখে ফেললাম
১১
213569
২৬ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:১৯
১২
226785
২৭ মে ২০১৪ রাত ১২:৫২
নূর আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা লিখেছেন : আল্লাহ আপনার বাবাকে নেক হায়াত দিন। আমীন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File