আজ দু'জনার দুটি পথ দু'টি দিকে গেছে বেঁকে........(৩৮) শেষ পর্ব...
লিখেছেন লিখেছেন অন্য চোখে ৩১ আগস্ট, ২০১৩, ০১:৪৬:৪৬ দুপুর
আগের পর্ব :......৩৭.Click this link
সুমাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে, পাত্র দুবাইতে থাকেন, পাত্র-পাত্রী দুজনই ছুটিতে দেশে এসেছে, ধূমধাম বিয়ের আয়োজন, দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেছে আর মাত্র ক'টা দিন বাকী
এদিকে শাকিল ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল, দেশে এসে দেখল পাত্র হিসেবে তার বাজারটা খুবই সংকুচিত, অনেকগুলো পাত্রী প্রাথমিক ভাবেই ঠিক করা ছিল, কিন্তু যখনই তারা শুনল আপাতত পাত্রী দেশেই থাকবে এবং ভবিষ্যতে যে নিতে পারবে সেই আশাও শাকিল দিচ্ছেনা তাই সবাই মুখ খুলে হা না কোনটাই বলছেনা, দেখি জানাব বলে ঝুলে আছে কিছু প্রস্তাব, শাকিল এমনিতে বিয়ের ব্যাপারে দূদল্যমনা ছিল, এখন সে নিশ্চিত হলো আপাতত সে বিয়ে করবেনা, পত্রিকা, টিভি টকশো, নামাজ, ঘুম এসব করে ছুটিটা কাটাবে, ঘরে নিষেধ করে দিয়েছে যেন আর পাত্রী না দেখা হয়, তবুও কিছু প্রস্তাব এসেছিল, সেগুলো বয়েস কম এটা সেটা বলে পাত্রী না দেখেই ভেটো দিয়ে বসল
সন্ধ্যার দিকে ভাবীর হাতের মাখানো মুড়ি চনাচুর এর সাথে চা নিয়ে বসেছিল পত্রিকা পড়ার জন্য, এমন সময় জোৎস্না আপুর ফোন, "শাকিল তুমি কি কাল সকালে ঠিক দশটায় আমাদের বাসায় আসতে পারবে? খুব দরকারী কথা ছিল।" হুম আসব বলে আর টুক টাক কথা বার্তা হল, কিন্তু তখনো শাকিল বুঝতে পারেনি কি নাটকিয় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে কাল
জোৎস্না আপুরা এখন আর সুমাইয়াদের ভাড়া বাসায় থাকেননা, খুব কাছেই নিজেরা জায়গা কিনে বিশাল রাজকীয় এক বাড়ী বানিয়েছেন, নিচের তলায় ভাড়া বাসা আর উপরে নিজেরাই থাকছেন, উপরের ফ্ল্যাটটা অর্ধেকে নিজেরা থাকছেন আর বাকী অর্ধেক ছাদটা ছাড়া বাকীটা ফাঁকা রেখেছেন, সেখানে বেতরে সোফা রেখছেন, বিকেলে চা পর্ব চলে অথবা মেহমান আসলে খোলামেলা পরিবেশে গল্পগুজবটা ভালই জমে, চারপাশে কাপড় শুকানোর দড়িও টানা হয়েছে, টবে টুক টাক ফুলের চারা, সব মিলিয়ে একটা শৈখিন গুছাগাছ সুন্দর ফ্যামিলির ছাপ বলা যায়
শাকিলকে অবশ্য ড্রয়িং রুমে বসতে বলল জোৎস্না আপু, বিশাল ফ্ল্যাট টিভি স্ক্রিণে কার্টুন চলছিল, রিমোটটা শাকিল এর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আপা গেল চা বানাতে, শাকিল কার্টুনই দেখতে লাগল, সেই ছোট বেলায় কার্টুন দেখার কি পাগল ছিল তা ভাবছিল বসে, বাসায় তখন তাদের টিভি ছিলনা, হাতো গোনা কিছু ফ্যামিলিতে টিভি ছিল, দুপুরে থান্ডার ক্যাডস নামক এক জনপ্রিয় কার্টুন দেখাতো, মিল্টনদের ঘরে হুক লাগিয়ে তারা নিজেরাই দেখতো, শাকিল আর তার সংগীরা তখন জানলার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করত, আজকের এই কার্টুন দেখে সেই সব স্মৃতিগুলো কিছুটা নাড়া দিয়ে উঠল
জোৎস্না আপু চা নিযে আসলেন, সংগে একটা নতুন টি শার্ট তবে প্যাকেট করা ছিলনা, সম্ভবত সেটা দীপ্তরই হবে সেটা শাকিল অনুমান করে ভেবে নিয়েছে, দীপ্ত সেই ছোট্ট খোকাটি আর নেই যেন, অনেক বড়সড় হয়ে গেছে, আজকালকার ছেলে মেযেরা আর খাট হয়না মনে হল শাকিলের, সবাই অল্প বয়েসে খুব স্মার্ট আর বড়সড় হয়ে যাচ্ছে খেয়াল করল
শাকিল এর দিকে চা আর বিস্কিট এর প্লেইটা এগিয়ে দিয়ে জোৎস্না আপু প্রশ্ন করল, "তুমি কি জান সুমাইয়া এখন দেশে?" কই নাতো! শাকিল জবাব দিল, তারপর জোৎস্না আপুর সাথে কথা বলে জানা গেল, সুমাইয়া তার সেট করা বিয়েটা নিজেই ভেংগে দিয়েছে, কারণ তার কাছে মনে হয়েছে সে শাকিল এর জন্য টান অনুভব করছে, যদি সম্ভব হয় তাহলে শাকিল এর সাথেই যেন আবার বিয়ের আয়োজন করা হয়, তাই আজ জোৎস্না আপু শাকিলকে বাসায় আসতে বলেছে
শাকিল কিছুটা অপ্রস্তুত আর পোলকিত অনুভব করল কথাটা শুনে, আর জোৎস্না আপুকে কিছুটা বুঝিয়েও বলেছে তারপ্রতি কি পরিমাণ অবহেলা করেছে সুমাইয়া, জোৎস্না আপু সব শুনে বলল মেয়েটা একটু চঞ্চল তবে খুবই ভাল, সে একটু পর আসবে এখানে আপু বলল, তোমার সাথে কথা বলবে, তোমরাই আজ কথা বলে আমাকে ফাইনাল ডিসিশান দেবে, বাকী কাজ আমার, এটা বলে আপু হাতের টি শার্টটা শাকিলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও এটা পড়তো, কেমন দেখায় দেখি বলে শাকিলকে একা করে দিল
শাকিল এর মাথাটা ঝিম হয়ে গেল, সে বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে, টি শার্টটা পাশেই রাখল, নিজের দিকে একটু খেয়াল করল, পুরনো একটা টি শার্ট পড়েছে আজ আর জিন্স প্যান্ট, তার মনে হল সুমাইয়ার জন্য আমাকে অন্যের কাপড় গাঁয়ে দিতে হবে? তার দরকার নেই, সে যেমনটা আছে তেমনই থাকবে, যে যাই মনে করুক, কাপড় চেন্জ করা হবেনা, শাকিল বসে কার্টুন দেখতে লাগল, সুমাইয়া আসার নাম গন্ধ নেই, সে ইচ্ছে করেই লেইট করছে নিশ্চয়, কারণ সে নিশ্চয় শুনেছে শাকিল এখন তার অপেক্ষায় বসে আছে, ওয়েটিং এ রেখে মজা পাচ্ছে খুব হয়তো
সুমাইয়া আসতে আসতে আর সকাল থাকলনা, সেটা দুপুরের কাটা ছুঁইছুঁই তাই জোৎস্না আপা বলল, তোমরা বসে গল্প কর আমি একবারে ভাতের আয়োজন করছি, এটা বলে আপা চলে গেলেন, এই প্রথম দেখা শাকিল আর সুমাইয়ার, শাকিল এর চোখ কার্টুন এর দিকে আর সুমাইযা আড়চোখে শাকিলকে পর্যবেক্ষণ করছিল, কারো মুখে কোন ভাষা নেই যেন, সুমাইয়া মুচকি মুচকি হাসছিল, সেটা দেখে শাকিলেরও হাসি পেল তবে অনেক কষ্টে সামলানো গেলো
"চল ছাদে যাই", সুমাইয়া নিরবতা ভাঙ্গালো, হুম চল বলে শাকিল উঠে দাঁড়াল, দুজনে ছাদে গিয়ে অনেক্ষণ চারপাশ দেখল, জায়গাটা খুব সুন্দর, আপাদের বিল্ডিংটার আশে পাশে পুরোটায় ফাঁকা জায়গা, সামনের দিকে প্রধান রাস্তা, পেছনের জায়গাগুলোতে এখনো হালচাষ করা হয়, আরও পেছনে সমুদ্র, ছাদ থেকে বেড়ী বাঁধটা যেন ছোট পাহাড়ের মতো দেখায়, শাকিল বাউন্ডারী ওয়ালটা ধরে দাঁড়াল, সুমাইয়া একা হেটে হেটে চারপাশ একবার ঘুরে শাকিলের খুব কাছেই এসে দাঁড়াল তবে ঠিক গা ঘেসে বলা যাবেনা, "এইযে দেখছ বিল্ডিংটা আমার এমন একটা বিল্ডিং চাই" সুমাইয়া বলল, দারুণ একা ব্যাপার হবে, শাকিল জবাব দিল, সবাইতো স্ত্রীকে গিফ্ট দেয়, আর তুমিতো সবার মতো না, তাই তুমি স্বামীকেই গিফ্ট দেবে এমন একটা চারতলা সুন্দর বাড়ী, ভাবতেই কেমন জানি ভাল লাগছে, " আহা তোমাকে কে বলেছে আমি এই কাজটা করব, আমি বলেছি, আমার হাসব্যান্ডকে এমন একটা গিফ্ট দিতে হবে আমাকে যদি সে আমাকে চাই।"
"চল আমরা হেটে সমুদ্রের দিকে যাই," বলল সুমাইয়া, এভাবে অপরিচিত কারো সাথে যাওয়া কি উচিত হবে? শাকিল জবাব দিল, সবাই বলবে মাওলানা সাহেবের মেয়ে বিদেশে থেকে ধর্ম কর্ম লোক লজ্জ্বা সব খেয়ে বসে আছে, অচেনা পুরুষ মানুষের হাত ধরে রাস্তায় হাটাছে, " বারে, আমার বয়েই গেছে, তোমার হাত ধরে আমি সমুদ্র দেখতে যাব, খেয়ে আমার আর কাজ নেই," এভাবেই কিছুক্ষণ চলল খুনসুটি, তারপর নিচ থেকে ডাক আসল, খাবার রেডি।
খেতে বসার আগে সুমাইয়া একটু ভেতরে গেল, জোহর এর নামাজটা আগে পড়বে বলে, শাকিল বসে রইল খাবার সামনে রেখে, জোৎস্না আপু এক ফাঁকে এসে জিজ্ঞিস করে গেল কি কথা হ'ল দুজনের, সব ঠিক আছেতো! শাকিল বলল, কিছুই বুঝা গেলনা, সেই আগের ঢেকিটাই, ধান ভেনেই গেল, আপা একটু হেসে ফাজিল বলে চলে গেল, ফাজিল শব্দটা কাকে বলল বুঝা গেলনা, শাকিল ধরে নিল সেটা সুমাইয়ারই প্রাপ্য
খাওয়া পর্ব সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে শাকিল বিদায় নিযে চলে আসল, যখন বিদায় নিচ্ছিল, সুমাইয়া কোন কথাই বললনা, মোবাইলটা উচিয়ে কি যেন দেখছিল, শাকিলের মনে হল তার ছবি তোলা হচ্ছে তাই ঠোটের কোনে একটু হাসি রেখে বিদায় নিল, বাসায় পৌঁছতেই জোৎস্না আপুর ফোন এল, "শোন সুমাইয়ার সাথে আমার কথা হল, আর তোমার নিশ্চয় অমত নেই, এখন বাকী যা করার আমি করছি, ওয়েট এন্ড সি।"
মধ্যরাতে শাকিল এর ফোন বাঁজতে লাগল অনবরত, ঘুম ঘুম চোখে হ্যালো বলতেই, জোৎস্না আপুর কন্ঠ ভেসে আসল, "শাকিল তুমি কি আসতে পারবে এখনই বাসায়, তোমার ভাইয়া স্ট্রোক করেছে, এতো রাতে কি করব না করব কিছু বুঝতে পারছিনা, ক্লিনিকে ফোন করেছি, তারা এ্যাম্বুলেন্স পাঠাচ্ছে, তুমি সম্ভব হলে একটু আসো।"
রাতে এবং পরের দিন দুপুর পর্যন্ত শাকিল জোৎস্না আপুর সাথেই ছিল, প্যাশেন্ট এর সাথে, অনেকগুলো টেষ্ট করা হল, ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঢাকায় পাঠানো গেলে ভাল হবে, সন্ধার পর জোৎস্না আপু ইমরোজ ভাইকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা, শাকিলকে বলে গেল তুমি চিন্তা করনা, তোমার ব্যাপারটা আমি দেখছি, তোমার ভাইয়ার জন্য একটু দোয়া কর।
সবকিছু ঠিকই ছিল তবুও কোথায় যেন একটু গোলমাল হয়ে গেল, এভাবে সহজ প্রাপ্তি শাকিল হয়তো প্রত্যাশা করেনি, তার কাছে হয়তো মনে হল, পাওয়ার তৃপ্তিটার চাইতে না পাওয়ার অতৃপ্তিটা আর একবা উপভোগ করা যাক, সারা রাত অস্থিরতা আর নির্ঘূম কাটিয়ে পরের দিন শাকিল টিকেট কনফার্ম করে এলো কাউকে কিছুই না জানিয়ে, তারও দুইদিন পর প্লেইন এর সিটে বসে সে সুমাইয়াকে ফোনে জানিয়ে দিল, "সরি আমি হয়তো সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে ভুল করছি, তবু্ও আমাকে বিদায় দাও, আমার এই ছাইপাশ জীবনটার সাথে তোমাকে আর জড়ালামনা, তার জন্য তুমি হয়তো একদিন আমাকে খুঁজবে ধন্যবাদটা দেবার জন্য, রাখছি এখন, বিমান ছাড়ছে, এনাউন্স হচ্ছে মোবাইল সুইচ অফ করার জন্য," শাকিল এক তরফা কথাগুলো বলে গেল, সুমাইয়া কি শেষ পর্যন্ত কথাগুলো শুনেছিল কিনা তা আর জানা হলনা।
সেবার সুমাইয়াকেও একা আসতে হল তার কর্মস্থলে, শাকিল সুমাইয়ার আর কখনো যোগাযোগ হয়নি, বছর চারেক পর তাদের ফেইসবুক কভার পেইজ চেন্জ ষ্ট্যাটাস দেখে কিছুটা ধারণা করা গেল হয়তো তারা খুঁজে পেয়েছে তাদের আপন ঠিকানা, ছবি দু'টো শেয়ার করা হল তাতে যদি পাঠক ও কিছুটা বুঝতে এবং তৃপ্তি অনুভব করে সেই প্রত্যাশায়......
বিষয়: বিবিধ
১৯৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন