হয়তো শূণ্যতা নয়তো পূর্ণতা
লিখেছেন লিখেছেন অন্য চোখে ১৩ আগস্ট, ২০১৩, ০১:১৪:২৮ দুপুর
দোয়াত কালির দামি কলমটা আমাকে দিয়ে আনুর মা দাদী বলেছিলেন এই নে তোর জন্য এনেছি, সাগরকে দেখাসনা, আমার ছেলে এনেছে দুবাই থেকে
আনুর মা আমার আপন দাদী ছিলেননা, দাদী শব্দের অর্থ বাবার মা হবে সেটা বুঝতে আমার অনেক কাল গেছে, ছোট বেলায় আমার কাছে দাদী শব্দটার মানে ছিল আনুর মা, ছোট বেলায় কখনো মনে প্রশ্ন জাগেনি আনুর মা কি করে আমার দাদী হবেন, তারও একটা কারন আছে, কারনটা হল, আনুর মা'র কোন প্রতিপক্ষ ছিলনা, আমার আপন দাদা দাদী কিংবা নানা নানী কাউকে দেখার সৌভাগ্য আমর হয়নি, তারা গত হয়েছেন আমি জন্মাবার আগেই, তার উপর আমাদের বেড়ে উঠা শহরে ভাড়া বাসায়, আমরা তেমন একটা গ্রামের বাড়ী যেতামনা, ওখানে যাওয়া হলে অন্তত দাদা দাদীর কিংবা নানা নানীর কবর দেখলেও মনে প্রশ্ন জাগতো আনুর মাকে কেন আমি দাদী ডাকি!
প্রসংগটা যখন চলেই আসল বলেই ফেলি, কেন আমাদের গ্রামের বড়ী যাওয়া হতনা! কারণটা হল, বাবার অভিমান, বাবা গ্রাম ছেড়েছেন দুইবার, প্রথমবার ছেড়েছেন এক কাপড়ে, একটা লুংগী আর একটা গামছা নিয়ে, কিন্তু সেবার ছিলনা কোন মান অভীমান আর ছিল আবার ফিরে আসার স্বপ্ন, দ্বিতীয়বর যখন ছাড়লেন সংগে মাকে নিয়ে আসলেন শহরে, তারপর অনেক কাল আর যাননি, আমাদেরও তেমন যেতে দিতেননা
বাবাকে না বলে আমি একবার ছোট খালার সাথে গ্রামে গিয়েছিলাম বেড়াতে, ফিরে আসার পর এক দারুণ তিক্ত অভিজ্ঞতা, এখনো মনে পড়লে খুব হাসি পায়, বাবা ছিলেন প্রচন্ড জেদী আর এক রোখা গোয়ার টাইপ এর, আমি যখন গ্রাম থেকে বেড়িয়ে আসলাম, অফিস থেকে ফিরেই বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, অনুমতি না নিযে কেন যাওয়া হল, উত্তর এর অপেক্ষা আর করেননি, চড়ের মাত্রা এতো তীব্র ছিল যে, মাথা ঝিম ধরে গেল, আর আমার অভ্যাস ছিল ছুতানাতায় কান্নাকাটি করার, ঘন্টাখানেক কেঁদে রাতের ভাত খাবনা বলতেই বাবার ঘোষণা, না খেলে আরো একটা দেবে, সেই ভয় আর খিধেও লেগেছিল খুব, খাওয়াটাই শ্রেয় মনে করে খেয়ে নিলাম
খেয়ে উঠে যখন জানতে পারলাম আমার শাস্থি এখনো শেষ হয়নি, সেটা চলমান থাকবে সপ্তাহ ব্যাপি সেই ভয়ে ঘুম কি আর আসে! মারধরের বেলায় বাবা কখনো কার্পণ্য করেননা, বাবা ঘোষণা করলেন, প্রতিদিন সকালে উঠে আমাকে একটা করে চড় মারা হবে এবং সেটা সপ্তাহ ব্যাপি চলমান থাকবে, প্রথমে ভেবেছিলাম ভয় দেখানোর জন্য বলেছে, কিন্তু না, এক দুই করে তিনদিন যখন পুণরাবৃত্তি হযে গেল, মা অনেক বুঝিযে নিবৃত্ত করলেন, আসলে বাবা খেপলে মা'ও ভয় পেতেন, আমার মা ছিলেন খুবই নম্র স্বভাবের, ঠিক বাবার উল্টো
আমরা যে আজ শহুরে জীবন যাপন করছি, সেটা বাবার ছোট বেলার এক প্রবল ইচ্ছের দরুণ হয়ে উঠা , যেটা আমরা আজ কল্পনা কিংবা সেই সাহস কোনটাই করার যোগ্যতা রাখিনা, দাদা যখন মারা যান, বাবা তখন প্রাইমারী ছেড়ে হাই স্কুলে যাবার সময়, জেঠাকে বলেছিলেন আমার কৃষিকাজ ভাল লাগেনা আমি আরো পড়তে চাই, জেঠাও বাবাকে খুব পছন্দ করতেন, বললেন আপত্তি নেই, কিন্তু খরচ চালাবো কি করে? আমার কাছে তো সামর্থ নেই, বাবা বলেছিলেন আমার খরচ আমি চালিয়ে নেব যে করেই হোক, কিন্তু আমি আরো পড়তে চাই
একটা গামছা আর লুংগি নিয়ে বাবা সেই যে বের হলেন, ফিরে আসলেন অনেক কাল পরে।লজিং থেকেছেন সেই ক্লাশ সিক্স থাকা কালীন, তারপর চলে আসলেন শহরে, ম্যাচে থেকেছেন, টিউশানি করেছেন, পার্ট টাইম জব করেছেন, টুকটাক লিখালিখিও করেছেন, যদিও লিখাপড়া খুব বেশী চালিয়ে যেতে পারেননি, চাকরী জীবনে প্রবেশ করেই আবার ফিরে এলেন গ্রামে
সবাই ভাবল পায়ে শিকল না দিলে বাবা আবার হারিয়ে যাবেন তাই শেকল নিয়ে আশা হল, মা হলেন সংগী, বাবারও মনে মনে একটা আকাংখা ছিল বাড়ীর কাছে স্কুল নেই, বাবা খুব কষ্ট আর প্রবল ইচ্ছে থাকার কারণে দূরের স্কুলে গিয়ে পড়েছেন। সামর্থ খুব একটা বেশী নেই কিন্তু তারুন্যের উদ্যমতা ছিল, গ্রামকে আলোকিত করার স্বপ্ন ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছিলেন, সাহস করে নেমে পড়লেন একটা প্রাইমারী স্কুল হবে বাড়ীর খুব কাছেই
ঘরের চেয়ার টেবিল যা ছিল সব বরাদ্দ হল স্কুল এর জন্য কাজ এগিয়ে চলছিল কিন্তু বেশীদূর এগুনো গেলনা, একটা পক্ষ দাঁড়িয়ে গেল বাবার বিরুদ্ধে, স্কুল ঘর শেষ হয়েও হলনা, বাবা গ্রাম ছাড়লেন, তার কিছুদিন পর মা'কেও এসে নিয়ে গেলেন, সেই যে গ্রাম ছাড়া আর খুব একটা যাওয়া হয়নি আর
আমার জন্ম আনুর মা দাদীর হাতে, তাই হয়তো আমাকে একটু বেশীই পছন্দ করতেন, কথায় কথায় বকাঝোক যেমন করতেন, আবার আদরও করতেন, কিছু কিছু কঠোর মানুষ আছে যারা আদর করলেও বুঝা যায়না আদর করেছে, আমার বাবা যেমন আনুর মা দাদীও তেমন, ছোট বেলায় ভেবেছি তারা দু'জনই নির্দয় ধাচের, কিন্তু বড় হয়ে অনুভব করলাম যারা আমাকে অতি মাত্রাই পছন্দ করতেন সেখানে এই নাম দুটো।
আনুর মা দাদী শব্দটা একটু দীর্ঘ, যেসব শব্দ উচ্চারণ করতে বাঁধাগ্রস্থ হয় সেসব শব্দ লংলাষ্টিং করেনা, হারিয়ে যায়, সেই সূত্র মোতাবেক আনুর মা দাদী হয়ে গেল আনুম্মাদাদী, চাইলে শুধু দাদী ডাকা যেত তবে আনুর মা নামেই এলাকায় এক নামে চিনে আর ডাকে, আমি যখন কথা বলতে শিখছিলাম তখন থেকেই হয়তো বাবা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন দাদী ডাকতে, মাঝখান থেকে আনুর মা ও ঢুকে গেছে আর হয়ে গেছে আনুম্মা দাদী
প্রতি বছর স্কুলের বার্ষীক পরীক্ষা শেষে সাগর চলে যেত নানুর বাড়ী কিংবা দাদুর বাড়ী, আমার খুব মন খারাপ হতো, আমার নানু আর দাদুর বাড়ী পাশাপাশি হওয়াতে যাওয়া হ’তনা, দাদী সেটা বুঝতে পারতেন, আমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন দাদী নিজের বাড়িতে, প্রায়ই দুই কিলোমিটার হেঁটে যেতাম আমরা, ছোট ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি, বড় হয়ে অবাক হয়ে ভাবতাম বিষয়টা
পুরোনো দুইতলা দালান বাড়ী, বাইরে পলেস্তরা কিছু কিছু ঝড়ে পড়ছিল, কারুকাজ করা ভবনটা দেখলে মনে হতো কোন এর রাজার বাড়ী হবে, হয়তো তাই ছিল, কোন এক রাজার বংশধর হবেন হয়তো দাদীর শ্বশুর পক্ষ, দাদীর ঘরটা নিচের তলায় একপাশে, বাড়ীতে আরো লোকজন থাকতো কিন্তু দাদী কখনো আমাকে পরিচয় করে দেননি, দাদী আমাকে বসিয়ে রেখে রান্নার আযোজন করতো, আমারা দুপুরে খেয়ে ঘুম দিতাম, তারপর বিকেলে চা-মুড়ি খেয়ে আবার পাযে হেঁটে চলে আসাতাম আমাদের বাসায়, দাদীর হাতে ছোট্ট একটা পুটুলি থাকতো প্রয়োজনীয সব জীনিসপত্র।
আমার তখন মনে প্রশ্ন জাগার কথা নয়, দাদী এতো সুন্দর কেন? বয়েস হয়েছে তবুও দাদীর দুধে আলতা রংটা যেন ম্লান হতে চায়না, যৌবন কালে কি রূপসী ছিলেন সেটা আর ভাবতে চাইনা, মনে প্রশ্নটা যেগেছিল আরো অনেক পরে, এমন একটা রাজ বাড়ীর মতো ঘর ফেলে কেন দাদী নিজের বাড়ীতে থাকেননা, কেন মানুষের বাসায় ঝি এর কাজ করবেন আর আমাদের বাসায় কেনইবা থাকবেন! দাদীর অবস্য থাকার জায়গার অভাব নেই, সবাইতো রাখতে চাই দাদীকে, দাদী অবশ্য আমাদের বাসায় থাকতে পছন্দ করতেন
দাদী শুধু রূপসী ছিলেন তা নয়, এমন গুণী মানুষ পাওয়া ভারী, মানুষের জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটা আয়োজন দাদীকে ছাড়া কেউ কল্পনাও করেনা, সাত সকালে দাদী বের হয়ে যেতেন, কখনো দুপুরে, কখনো বিকেলে বা রাত্রী ফিরে আসতেন বাসায়, কিংলা দু’চারদিন পরেও আসতেন, দাদী আসলে ঝি চাকরের কাজ করতেন ঠিক তা না, পরে বড় হয়ে বুঝলাম সেটা ছিলা দাদীর একটা সামাজিকতা বা সামাজিক দায়ব্ধতা থেকে, নিজ হাতে একা একটা বিয়ে বাড়ী সামলে নিতেন, ধাত্রীর কাজ করতেন, শিশু বা মহিলার মৃত্যু হলে গোসল এর দায়ীত্বটা দাদী নিজ থেকেই করতেন, সবাই খুশি মনে যা বখশিষ বা চালডাল দিতেন তা এনে জমা রাখতেন আমার মা এর কাছে
দাদীর একটা অভ্যাস ছিল তবে সেটাকে আমি বদভ্যাস বলতে নারাজ, সেটা হল দাদী বিড়ি খেতেন, আমাকে একটাকার নোট দিয়ে বলতেন গুণে আনবি, দশটা যেন হয়, টাকার দশটা, চার আনা হলে চারটা, আট আনা হলে আটটা আর টাকার দশটা, আমি গুণে গুণে হেটে আসতাম, ভুলে একটা কম পড়লে আবার যে দোকানে যেতে হবে তার চাইতে দাদী খুব বকাঝোকা করবেন সেটাকে ভয় পেতাম, দাদী শুধু আমাকে বকাঝোকা করার অধীকার রাখেন তা না, আমার বাবাকেও বকে দিতেন একটু ব্যাতিক্রম কিছু দেখলে, যাদের বাড়ীতে বকাঝোকার অধীকার নেই দাদী সেইসব বড়ীতে যেতেননা
একদিন শুনলাম দাদীর পাসপোর্ট হচ্ছে, সৌদিআরব যাবেন, দাদীর জীবনের শেষ ইচ্ছে আল্লাহর ঘর জিয়ারত করবেন, প্রবাসী এক বাংগালী তার ছোট্ট মেয়েটাকে স্কুলে যাওয়া আসার গার্জিয়ান হিসেবে দাদীকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছেন, স্কুলে যাওয়া আসার জন্য গাড়ী ড্রাইভার সবই আছে, দাদী শুধু মেয়েটাকে দেকে রাখবেন, আল্লাহর ঘর দেখার সৌভাগ্য দাদীর হয়েছিল তবে বেশীদিন সেখানে থাকলেননা, দাদীর নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে, দেশে যেমন সবার সাতে মিশে হেসে খেলে মিলে চলতেন সেখানেতো আর সেই পরিবেশ নেই, অর্থ,গাড়ী, বাড়ী সব আছে নেই শুধু দম ফেলার পরিবশে, একা একা লাগে খুব, কথা বলার লোক নেই, একটা দৃশ্য আমার খুব মনে পড়ে, দাদী এবং মা পালা করে একে অপরকে মাথার চুলে তেল মেখে দিতেন, আচড়ে দিতেন আর হাজার রকম সাংসারিক কথাবার্তা
দাদি বিদ্রোহ করলেন সৌদিআরবে, ওখানে থাকবেননা, অনেক বুঝানো হল দাদীকে, সেলারী বাড়ানো হবে, কোন কাজ করতে হবেনা, শুধু ছ্ট্টে মেয়েটাকে একটু দেখে রাখা, কোন কিছুতেই দাদীকে মানানো গেলনা, এক মাসের মধ্যে দাদীকে দেশে পাঠানোর ব্যাবস্থা না হলে আত্মহত্যা করবেন, এমন রাজসীক জীবন দাদীর ভাল লাগেনা, দাদী ফিরে আসলেন জীবনের শেষ ইচ্ছে পুরণ করে, আল্লাহর ঘর তওয়াফ করা হল, তারপর হঠাৎ করেই সুস্থ স্বাভাবিক দাদিটা এক রাতে ঘুমিয়ে আর সকালে উঠলেননা, তারও অনেক পর মাকে একবার জিজ্ঞেসা করেছিলাম যখন নিজের কাছে হিসেব মেলাতে পারছিলামনা, দাদী আসলে কে?
মা শুধু এটুকুন বলেছিলেন, দাদী আসলে রাজবৌই ছিলেন, দাদীর হাসবেন্ড তাদের ঘরের কাজের বুয়ার প্রেমে পড়ে বিয়ে করে ফেলেছিলেন, দাদী সেই অপমান, রাগ আর ক্ষোভে বাড়ী ছাড়লেন, থাকতেননা, নিজ বাড়ীতে, তাদের ছাড়াছাড়ি হয়নি, দাদীর পূর্ণ অধীকার ছিল শ্বশুর বাড়ীতে কিন্তু সেখানে দাদী থাকতেননা, পাড়ার যখন যার বাড়ীতে ই্চ্চে হতো থাকতেন, সবার দ্বার উন্মোক্ত ছিল দাদীর জন্য, তবে আমার মা এর সাথে পরিচয় হবার পর থেকে রাতে আমাদের বাসায় থাকতেন প্রায়ই, সেটা কোন দেনা পাওনার বিনিময়ে না, একটা আত্মীক সম্পর্ক হেয়ে গিয়েছিল দাদীর সাথে
আজ কেন জানিনা দাদীর কথা খুব মনে পড়ছে, মানুষের জীবনে পূর্ণতা বলতে কি বুঝায়! দাদীর জীবনে সবছিল আবার কিছুই ছিলনা, শেষ ইচ্ছে ছিল আল্লাহর ঘরটা একটু ছুয়ে দেখবে, সেই ইচ্ছেটা পূর্ণ হলো, বাবা রিটায়ার্ড হবার পর আমাকে যখন বলল, "দেখ হুমায়ূন, আমি যখন ঘর ছাড়ি তখন আমার সম্বল ছিল একটা গামছা আর লুংগী, আজ তুমি আমার একমাত্র পুত্র, তোমাকে শহরে মাথাগুঁজার একটা উপায় করে দিয়েছি অবশ্যই তার জন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া, আমি মনে করি পিতা হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি, আমার এখন শেষ ইচ্ছে, আমার রিটার্ডম্যান্ট বাবদ যা কিছু পাব তা দিয়ে বস্তিবাসী শিশুদের জন্য একটা স্কুল করব, আমি আশা করি তুমি এটাকে অযথা খরচ হিসেবে দেখবেনা, এবং আমাকে সাহায্য করবে, বুদ্ধি আর পরামর্শ দিয়ে............
বিষয়: বিবিধ
২১০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন