শপথের মর্যাদা-(১ম পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:৩৩:৪৮ রাত

১। ভূমিকাঃ

সুমহান সৃষ্টিকর্তা ও পরম প্রতিপালক সমস্ত মানবজাতিকে সৃষ্টি করে তাঁর এ দুনিয়ার জমিনে পাঠিয়েছেন তাঁরই খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে। আর এ ব্যাপারে সুমহান আল্লাহর বাণীঃ

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي الأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاء فَسَوَّاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ *

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُواْ أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاء وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لاَ تَعْلَمُونَ * البقرة 29-30

“এ পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে, সমস্ত কিছুই তিনি (পরম সৃষ্টিকর্তা) তোমাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর সপ্ত আকাশ সুবিন্যস্ত করেন এবং তিনি সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী। এবং (তোমরা সকলেই সেই সময়ের কথা স্বরণ কর) যখন তোমার প্রভূ (আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা) ফেরেশতাগণকে বললেনঃ নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফা (বা প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো।”(সূরা: বাকারা: ২৯-৩০)।

আর সেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তিনি সর্বপ্রথম মানবজাতির পিতা হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সৃষ্টি করেন। অতঃপর আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পৃষ্ঠদেশ থেকে সমস্ত মানবজাতির রূহ সৃষ্টি করে একটি সংরক্ষিত স্থানে (রূহ জগতে) একত্রে রেখে সকলের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন, দুনিয়াতে এসে তাঁর গোলাম বা বান্দাহ হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করার। সেদিন আমরা সকলেই সে বিষয়ে আল্লাহর নিকট অঙ্গীকারও করেছি। আর সে ব্যাপারেই আল্লাহ সকলকে স্মরণ করে দিয়ে বলছেনঃ

“(হে মানবজাতি! তোমরা সেই সময়ের কথা স্মরণ কর) যখন তোমার প্রতিপালক বানী আদমের পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বংশধরকে বের করলেন এবং তাদেরকেই (অর্থাৎ সমস্ত মানব রূহকেই) তাদের (পরস্পরকে পরস্পরের) উপর- সাক্ষী করে জিজ্ঞেস করলেন আমি কী তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা (সমস্ত রূহই) সমস্বরে উত্তর দিলো: হ্যাঁ! আমরা (এ ব্যাপারে পরস্পরের) সাক্ষী থাকলাম। (আর এই স্বীকৃতি ও সাক্ষী বানানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে) যাতে তোমরা কিয়ামতের দিন (দুনিয়ার কৃতকর্মের হিসাব দেয়ার সময়) বলতে না পারো-আমরা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অনবহিত ছিলাম।” (সূরা: আ’রাফ: ১৭২)

এ ছাড়া দুনিয়াতে এসেও আল্লাহর খলিফা হিসেবে বিভিন্ন দায়িত্ব্ পালন করতে গিয়ে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে শপথ গ্রহণ করছি। কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থে অন্ধ হয়ে সেই শপথ ভঙ্গ করে যেমনিভাবে আমাদের অপর একজন ভাইকে ক্ষতিগ্রস্থ করছি, তেমনিভাবে নিজেও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে অকল্যাণ ভোগ করছি। এমন কী আমরা দুনিয়ায় আসার পূর্বে আমাদের পরম সৃষ্টিকর্তার কাছে যে অঙ্গীকার করে দুনিয়ায় এসেছি, সেই কথা ভুলে গিয়ে আল্লাহর বিরুদ্ধেও কাজ করছি। ফলে আমরা মানব জাতি পরস্পর পরস্পরের দ্বারা কল্যাণ লাভের পরিবর্তে সর্বদাই অকল্যাণ ভোগ করছি। অথচ মহান আল্লাহ বলছেনঃ

“যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণœ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের জন্যে আছে মন্দ আবাস।” (সূরা: আর রা’দ : ২৫)

আজ আমরা পবিত্র আল-কুরআন ও হাদীসের আলোকে শপথের গুরুত্ব ও তার মর্যাদা সম্পর্কে সামান্য কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করবো, ইনশা আল্লাহ। যাতে এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা সকলেই আমাদের শপথ বিষয়ে ভুল ত্রুটিগুলো সংশোধন করে কৃত অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করে পরস্পর পরস্পরের কল্যাণকামী ভাই-বোনে পরিণত হয়ে সকলেই দুনিয়া ও আখেরাতে মহাকল্যাণ লাভে সক্ষম হতে পারি। ওয়া-মা তাওফিকী ইল্লা-বিল্লাহ।

২। শপথের সাধারণ সংজ্ঞাঃ

সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে যে মৌখিক বা লিখিত চুক্তি বা অঙ্গীকার করা হয়, তা-ই শপথ।

আরবী أيمان শব্দটি يمين শব্দের جمع (বহুবচন)। অর্থ কসম বা শপথ। তবে يمين শব্দের মূল অর্থ ডান হাত। এটি কসম অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার কারণ হলো, তখনকার লোকজন শপথ করার সময় একে অপরের হাত ধরত। শরীয়তের পরিভাষা তথা কসম বলা হয়, আল্লাহ তাআলার নাম কিংবা সিফাত উল্লেখ করে শপথকৃত বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করা।

৩। শপথের প্রকারভেদ :

শপথ দুই প্রকার যথাঃ

(ক) আল্লাহ তাআলার কোন সৃষ্টি নিয়ে শপথ করা যেমন: কাবা শরীফ, নবী, আমানত, জীবন, প্রতিমা অথবা আউলিয়া। এ প্রকার শপথ হারাম ও র্শিক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীঃ

“শুনে রেখ; আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে বাপ-দাদার নামে শপথ করতে নিষেধ করেছেন। তোমাদের কেউ শপথ করলে আল্লাহ্র নামেই করবে অথবা নীরবতা অবলম্বন করবে।” (বুখারীঃ ৬১৫৫)

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেনঃ

“যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহ্র নামে কসম করল সে র্শিক করল।” (আবু দাউদ : ২৮২৯)

এ ধরনের হারাম কসম ভঙ্গ করলে কোন কাফফারা নেই। কেননা গাইরুল্লাহ্র নামে শপথ করা র্শিক। আর তা ভঙ্গ করা তাওহীদ। এ কারণেই যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহ্র নামে শপথ করে তার তওবা করা উচিৎ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি লাত ও উয্যার শপথ করল তার বলা উচিৎ -

“আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই”

তাছাড়া আল্লাহ তাআলার নাম ও সিফাতসমূহের সম্মান রক্ষার্থে তার নামে কসম করে ভঙ্গ করলে কাফফারা দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে অন্য কোন বস্তু তার সমকক্ষ নয়।

(খ) আল্লাহ তাআলার নাম ও সিফাতের শপথ করা। এটি চার প্রকার যথাঃ

(১) শপথের ইচ্ছা ব্যতীত এমনিতেই ( না, আল্লাহর কসম) (হ্যাঁ, আল্লাহর কসম) মুখে উচ্চারণ করা। এ প্রকারের কসম নিরর্থক। এর কারণে কোন কিছু লাযিম হয় না। তবে আল্লাহ্র মহত্ত্বের প্রতি লক্ষ্য করে এ থেকেও পরহেয করা উচিৎ। ইরশাদ হচ্ছে :

“আল্লাহ তাআলা তোমাদের কসমগুলোর মধ্যে অর্থহীন কসমের জন্যে পাকড়াও করবেন না। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে ঐ কসমসমূহের জন্যে পাকড়াও করবেন, যেগুলোকে তোমরা (ভবিষ্যত বিষয়ের প্রতি) দৃঢ় কর, (অর্থাৎ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন বিষয়ে কাউকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকো সে সকল বিষয়ের জন্যে ধরবেন)। (সুরা মায়েদাহ :৮৯)

(২) অতীতকালীন কোন বিষয়ের ব্যাপারে সত্য মনে করে কসম করা। পরে দেখা গেল বিষয়টি উল্টো। এটি নিরর্থক।

(৩) অতীতের কোন বিষয়ে জেনে শুনে মিথ্যা কসম করা। এটি সম্পূর্ণ হারাম। এটিকে يمين غموس (কৃত্রিম শপথ) বলা হয়। এ ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। এটি কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। “আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমার রা. বলেন : এক ব্যক্তি নবী করীম সা. এর দরবারে এসে জিজ্ঞেস করলেন: কবীরা গুনাহসমূহ কি কি ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম কবীরা গুনাহের বর্ণনা করতে গিয়ে يمين غموس -কে তার মধ্যে শামিল করেছেন। লোকটি يمين غموس সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বললেনঃ এটি হচ্ছে মিথ্যা কসম করে অপর মুসলিমের সম্পদ দখল করা। এ কসমের কোন কাফফারা নেই। এটি এমন অপরাধ যা তওবা ব্যতীত শুধুমাত্র কাফফারার মাধ্যমে মিটে যায় না। যে ব্যক্তি এমন করবে, তাকে তওবা করতে হবে।

(৪) ভবিষ্যতের কোন সম্ভাব্য বিষয়ে ইচ্ছকৃতভাবে শপথ করা। একে يمين منعقدة বলা হয়। এ ধরণের শপথের ক্ষেত্রেই কাফফারা তিনটি শর্ত সাপেক্ষে ওয়াজিব হয়, যথাঃ

(ক) শপথকারী মুসলমান, বালেগ ও বিবেকসম্পন্ন হওয়া।

(খ) নিজ ইচ্ছায় কসম করা।

(গ) ইচ্ছা করে কসম ভঙ্গ করা।

উল্লেখিত তিনটি শর্ত পাওয়া গেলে কাফফারা ওয়াজিব হবে।

কসমের কাফফারা নিম্নরূপ : (তিনটির যে কোন একটি)

(১) দশজন মিসকীনকে খানা খাওয়ানো। প্রত্যেককে অর্ধ সা (এক সা = ২ কেজি ৬০০ গ্রাম) চাউল ইত্যাদি দেয়া।

(২) দশজন মিসকীনকে, সালাত আদায় করতে পারে এতটুকু পোশাক দেয়া।

(৩) ত্রুটিমুক্ত একজন মুমিন দাস মুক্ত করে দেয়া। (চলবে...)

বিষয়: সাহিত্য

১৭৪৭ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

340011
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ১০:১৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ১২:২৬
281455
মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে লিখেছেন : আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।
340016
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ১০:৩২
শান্তিপ্রিয় লিখেছেন : সুন্দর লিখেছেন। ভালো লাগলো। ধন্যবাদ আপনাকে।
০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ১২:২৭
281456
মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে লিখেছেন : আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।
341424
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুর ০২:২৫
প্যারিস থেকে আমি লিখেছেন : আপনার লেখাটা পড়ে খুব ভালো লেগেছে।
২১ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০২:৫০
291045
মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে লিখেছেন : প্রিয় ভাই,
সালাম,
বিভিন্ন কারণে ব্লগে অনেকদিন থেকে অনুপস্থিত ছিলাম, বিধায় সময়মত আপনার মন্তব্যর জবাব দিতে পারিনি, এ জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
লিখাটি আপনার ভাল লেগেছে জেনে আমারো ভাল লাগলো। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File