স্মৃতির পাতায় গেঁথে রাখা দিনগুলি-(পর্ব-১০)
লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ২৬ এপ্রিল, ২০১৫, ০৯:১৮:৩৭ রাত
শ্রেষ্ঠ রিক্রুট ও দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ রিক্রুটকে প্রধান অতিথি মহোদয় কর্তৃক ক্রেষ্ট প্রদান: (পর্ব-১০)
শপথ গ্রহণ পর্ব শেষ হলো। শপথ গ্রহণের পূর্বে আমরা শপথ প্রার্থীরা ছিলাম রিক্রুট। এখন পবিত্র শপথ গ্রহণের পর আমরা সকলেই দেশ মাতৃকার দেশ প্রেমিক পূর্ণাঙ্গ সৈনিকে পদোন্নতি লাভ করলাম। এবার নতুন সৈনিক হিসেবে প্রধান অতিথিকে সশস্ত্র ছালাম জানাতে হবে। তবে যেখানে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছি নিয়মানুযায়ী সেখান থেকে ১৩ কদম সামনে গিয়ে সেখান থেকেই সালাম দিতে হবে। এটা শপথ গ্রহণ প্যারেডের একটি নির্ধারিত নিয়ম।
প্যারেড অধিনায়ক পুরো প্যারেডকে এক সাথে সামনে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমরা সকলেই হাতের অস্ত্র ঝুলিয়ে তিন সারিতে জলদিগতিতে দ্রুত মার্চ করে ১৩ কদম সামনে গিয়ে একটা চেক মেরে থেমে গেলাম। সকলের পায়ের আওয়াজ ছিলো মাত্র একটি শব্দ। আমাদের এই ড্রিলটা ছিল দৃষ্টি নন্দন এবং থামাটা ছিলো অত্যন্ত চমৎকার। এ দৃশ্য দেখে সমস্ত দর্শনার্থী মুহুর্মুহু তুমুল করতালীর মাধ্যমে আমাদেরকে অভিনন্দন জানালেন। এবার প্যারেড অধিনায়ক আদেশ দিলেন:
নতুন সৈনিক জেনারেল সালাম দিবে!
সশস্ত্র ছালাম.......!
আদেশ পাওয়ার সাথে সাথেই আমাদের যার শরীরে যতটুকু শক্তি ছিলো, সর্বশক্তি ও সর্বাধিক কৌশল প্রয়োগ করে মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয়কে সশস্ত্র ছালাম জানালাম। ছালাম জানাতে কেউ আজ ফাঁকি মারে নাই। সকলেই মনোযোগ সহকারে ছালাম প্রদান করেছেন। তবে অন্যান্য ছালামের চেয়ে এ ছালামে হাত-পাঁ ও অস্ত্রের আওয়াজগুলো ছিলো পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী। কারণ পূর্বের ছালামগুলো ছিলো রিক্রুটের ছালাম। আর এখনকার ছালামটা নবীন সৈনিকের প্রথম পদ মর্যাদা পাওয়া ছালাম। কাজেই হাত-পাঁ ও অস্ত্রের আওয়াজটা এখানে একটু বেশী হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রিয় পাঠক! আপনাদের বিচারে কি বলে?
এরপর শুরু হলো সেরা ও চৌকষ রিক্রটকে পুরস্কার প্রদান পর্ব। পূর্ণ সামরিক মৌলিক প্রশিক্ষন এবং পেশা ভিত্তিক মৌলিক প্রশিক্ষণে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় বিষয়ের পরীক্ষাগুলোতে যারা সর্বাধিক ফলাফল অর্জন করতে পারেন, তাদের মধ্য থেকে শীর্ষ দুইজন রিক্রুটকে বাছাই করে ট্রেনিং সেন্টারগুলোর পক্ষ থেকে ক্রেষ্ট প্রদান করে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়। আমরা এখন সেই পর্বে পৌঁছে গেলাম।
প্যারেড অধিনায়ক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শুরু করার জন্যে মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয়ের নিকট অনুমতি গ্রহণ করে অনুষ্ঠান শুরু করার জন্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে নির্দেশ প্রদান করলেন। প্যারেড অধিনায়কের নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথেই টেবিল বহনকারী চারজন সুসজ্জিত সৈনিক পুরস্কারসহ একটি সুসজ্জিত টবিল বহন করে যৌথভাবে জলদি গতিতে মার্চ করে প্রশিক্ষণ মাঠে প্রবেশ করলেন। টেবিল বহনকারী চার সৈনিকের যৌথ টেবিল ড্রিল দেখে দর্শনার্থীগণ সকলেই বিমুগ্ধ ও বিমোহিত। তাই তাদের অন্তঃকরণের মুগ্ধ অনুভূতিগুলো অত্যন্ত আনন্দের সাথে দুই হাতের মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে প্রকাশ করছেন। টেবিল বহনকারী চারজন সৈনিক দর্শনার্থীর মুহুর্মুহু করতালির শব্দ শুনে তাদের হাত ও পাঁগুলো যেন আরো অত্যাধিক শক্তিতে দ্রুতগতিতে উঠা নামা করছিলো। এরই মধ্যে তারা মাঠের মধ্যখানে প্যারেডের সামনে গিয়ে থামলেন এবং সেখানেই পুরস্কার সজ্জিত টেবিলটি রেখে মাননীয় প্রধান অতিথিকে সালাম জানিয়ে নিজ স্থানে ফিরে গেলেন।
এবার মাননীয় প্রধান অতিথি মেজর জেনারেল আর.এ.এম. গোলাম মোক্তাদির এবং মাননীয় সেন্টার কমান্ড্যান্ট কর্ণেল শামসুজ্জামান পুরস্কার বিতরণের জন্যে দুইজন সুসজ্জিত গাইড সহকারে পুরস্কার সজ্জিত টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। এমতাবস্থায় ঘোষনা মঞ্চ থেকে সম্মিলিত বিচারকমন্ডলীর পক্ষ থেকে ঘোষনা করা হলো :
৭ম ব্যাসের সমস্ত রিক্রুটদের মধ্য থেকে প্রাক প্রশিক্ষণে মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ এবং মৌলিক পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলোর মধ্যে উভয় বিষয়ে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করে সেরা ও চৌকষ রিক্রুট হিসেবে- ১ম স্থান অধিকার করেছেন:
১। রিক্রুট টিবিভি মুহাম্মাদ জালাল উদ্দিন আহমেদ (ফরিদপুর) এবং
২য় স্থান অধিকার করেছেন:
২। রিক্রুট টিবিভি মুহাম্মাদ এনামুল হক (গাইবান্ধা)।
এবার প্যারেড অধিনায়কের আদেশে পুরুস্কার বিজয়ী উভয়েই প্যারেড অধিনায়কের নির্দেশে ভূমিতে তাদের হাতের অস্ত্র রেখে প্যারেডের স্বস্থান থেকে বের হয়ে জলদি গতিতে মার্চ করে পুরস্কার গ্রহণের জন্যে প্রধান অতিথির নিকটে গিয়ে উপস্থিত হলেন। মাননীয় প্রধান অতিথি তাদের উভয়কেই পুরস্কার প্রদান করেন। পুরস্কার গ্রহণ করে সেরা চৌকষ রিক্রুটদ্বয় প্যারেডে ফিরে এসে স্ব স্ব স্থানে দাঁড়ালেন।
এরপর মাননীয় প্রধান অতিথি ও সেন্টার কমান্ড্যান্ট গাইডসহ মঞ্চে ফিরে গেলেন। এবার প্যারেড অধিনায়ক সেরা চৌকষ রিক্রুটদ্বয়কে ভূমি থেকে অস্ত্র উঠানোর নির্দেশ দিলেন। তারা উভয়ে ভূমি থেকে তাদের অস্ত্র তুলে নিয়ে প্যারেডে স্থান নিয়ে দাঁড়ালেন প্যারেড অধিনায়ক সম্পূর্ণ প্যারেডকে বিশ্রামে দাঁড় করালেন প্রধান অতিথির মূল্যবান ভাষণ শোনার জন্যে।
নিয়মানুযায়ী মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয় নতূন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যত পথ নির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করবেন। সেই পথ নির্দেশনাই হবে নবীন সৈনিকদের ভবিষ্যতের পথ চলার প্রধান পাথেও। প্রধান অতিথি পুরস্কার বিতরণ শেষে মঞ্চে এসে দাঁড়ালে পূর্বের টেবিল বহনকারী চারজন সৈনিক মাঠে প্রবেশ করে প্রধান অতিথিকে সালাম জানিয়ে মাঠ থেকে পুরস্কার সজ্জিত টেবিলটি তুলে নিয়ে চলে গেলেন। তারপর একজন সৈনিক একটি মঞ্চ টেবিল দুই হাতে কৌণিকভাবে ধরে জলদি গতিতে মার্চ করে ভি.আই.পি মঞ্চে টেবিলটি রেখে তাতে মাইক্রোফোনের সংযোগ লাগিয়ে প্রধান অতিথিকে সালাম জানিয়ে নিজ স্থানে ফিরে গেলেন। তার যাওয়া এবং আসার সময় সমস্ত দর্শনার্থী মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে তার দৃষ্টি নন্দন ড্রিলকে অভিনন্দন জানালেন।
পুরস্কার বিতরণী পর্ব শেষে সমস্ত প্যারেড যখন প্রধান অতিথির মূল্যবান ভাষণ শোনার জন্যে মাঠে দাঁড়িয়ে অধির আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করছি,তখন দেখতে পেলাম মাঠের দক্ষিণ দিক হতে পূর্ব থেকে প্রস্তুত, একজন মেডিক্যাল এ্যসিসট্যান্ট এবং দুইজন ষ্ট্রেচার বহনকারী সৈনিক, ষ্ট্রেচারসহ দৌড়ে আমাদের প্যারেড মাঠের দিকেই আসছেন। আমরা আড়চোখে দেখতে পেয়ে অনুমান করছি হয়তো কেউ প্যারেডে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পড়ে গিয়েছে। হ্যাঁ! অনুমান সত্যি হলো। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই একজন অপরজনকে ফিসফিস করে ইশারা ইঙ্গীতে খবর পৌছাছে যে, ৬ নম্বর প্লাটুনের একজন নতুন সৈনিক তন্দ্রা লেগে মাটিতে পড়ে গিয়েছে। এবং দাঁত লেগে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে। তাকে ষ্ট্রেচারে তুলে নিয়ে পার্শ্বেই অবস্থিত এম. আই. (মেডিক্যাল ইন্সপেকশন) রুমে নিয়ে যাচ্ছে। তার তন্দ্রা লেগে মাঠে পড়ে যাওয়ার মূল কারণটা ছিলো,পাসিং আউট প্র্যাকটিসের সময় প্রশিক্ষনার্থীর শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে ঘাম ঝড়তে থাকে, সে কারণে শরীরে লবন পানির প্রচুর ঘাটতি পড়ে। সেই পানির ঘাটতি পুরণ করার জন্যে এ সময়টাতে প্রচুর পরিমাণে স্যালাইন বা লবণ পানি পান করতে হয়। যারাই এ সময়টাতে লবন পানি পান করতে অবহেলা করেন,তারাই এ রকম প্যারড গুলিতে তন্দ্রা লেগে মাটিতে পড়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। তাই এ সময় প্রশিক্ষনার্থীগণের প্রচুর লবন পানি পান করা প্রয়োজন। যারা ভবিষ্যতে এই সকল প্যারেডে অংশ গ্রহণ করবেন এই বিষয়টা স্বরণ রাখলে অনেক উপকৃত হতে পারবেন ইনশা-আল্লাহ।
আমরা মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয়ের ভবিষ্যত দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ শোনার জন্যে সকলেই অপেক্ষা করছি। সেই অপেক্ষার পালা শেষ করে ঘোষণা মঞ্চ থেকে সম্মানিত ঘোষক ঘোষনা করলেন। আমি এখন ৭ম ব্যাসের নবীন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয় তথা ১১ পদাতিক ডিভিশনের জেনালের অফিসার কমান্ডিং (জি.ও.সি) ও এরিয়া কামন্ডার মেজর জেনারেল আর.এ.এম গোলাম মোক্তাদির-কে তার মুল্যবান ভাষণ প্রদান করার জন্যে সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি। ঘোষণাটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয় উপস্থিত সকল দর্শনার্থী-কে ছালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে সদ্য সমাপ্ত শপথ গ্রহণকারী নবীন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে তার মুল্যবান গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যত পথ নির্দেশনা এবং উপদেশমূলক ভাষণ প্রদান করলেন। আমরা সকলেই মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয়ের ভাষণের মূল্যবান কথাগুলো মনযোগ সহকারে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে শ্রবণ করলাম। ভাষণ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমরা সকলে প্রধান অতিথি মহোদয়ের সাথে একাত্মতা পোষণ করে আমাদের প্রাণ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের অখন্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সুদৃঢ় অঙ্গীকারের প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্যারেড অধিনায়কের নের্তৃত্বে সকলেই সমস্বরে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে দৃপ্ত কন্ঠে মর্মবিদারী ধ্বনি দিলামঃ-
“বাংলাদেশ.......................জিন্দাবাদ!
বাংলাদেশ........................জিন্দাবাদ!
বাংলাদেশ........................জিন্দাবাদ!”
শপথ গ্রহণ কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে নবীন সৈনিকগণের প্রশিক্ষণ মাঠ ত্যাগ:
দেখতে দেখতে আমরা শপথ গ্রহণ কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছিলাম। এখন আমরা জলদি গতিতে মার্চ করে মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয়কে বিদায়ী সালাম জানিয়ে প্রশিক্ষণ মাঠ ত্যাগ করবো। তাই এবার প্যারেড অধিনায়ক মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয়ের নিকট শপথ গ্রহণ কুঁচকাওয়াজ প্যারেড বিরতী করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন। মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয় প্যারেড বিরতী করার জন্যে তাঁর সদয় অনুমতি প্রদান করলেন। অনুমতি পাওয়ার পর প্যারেড অধিনায়ক সম্পূর্ণ প্যারেডকে ডানে ঘুরিয়ে প্যারেড অধিনায়ক,প্যারেড এ্যাডজুটেণ্ট,প্যারেড বি.এস.এম ও প্যারেড সি.এস.এম এবং প্লাটুন অধিনায়কগণ স্ব স্ব প্লাটুনের নির্ধারিত স্থানে স্থান নিলেন। এরপর ১নং প্লাটুন অধিনায়ক তার প্লাটুনকে জলদি গতিতে মার্চ করার নির্দেশ দিলেন। প্লাটুন অধিনায়কের আদেশ পাওয়ার সাথে সাথেই ১নং প্লাটুনের সামনের গাইড তিন জনসহ প্লাটুনের সম্পূর্ণ নবীন সৈনিকদের বাম পাঁ গুলি আকাশে চমকানো বিদ্যুত ঝলকের মত এক নিমিষেই দ্রুতগতিতে যমিন থেকে আকাশের দিকে উঠে পুনরায় যমিনে আঁচড়ে পড়লো।
আর সাথে সাথেই ব্যাণ্ড মাষ্টার সার্জেন্ট জর্জ মিয়ার ব্যাণ্ড ষ্টিকের সংকেতে পূর্ব থেকে প্রস্তুত হয়ে থাকা সৈনিক শাহ আলমের বিগ ড্রামটি ষ্টিকের আঘাত পেয়ে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে মর্মবিদারী শব্দ নিয়ে স্বশব্দে বেজে উঠলো,আর তার সাথে সাহায্যকারী সাইড ড্রামগুলি কড়-কড়ানী শব্দ করে বিগ ড্রামটকে সাহায্য করছিলো। আর ব্যাণ্ড প্লাটুনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র ও সুরেলা বিভিন্ন বাঁশীগুলো মিষ্টি মধুর সুরের ঝংকার তুলে গেয়ে চললো.........
“সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি
ও-আমার..... বাংলাদেশ, প্রিয় জন্মভূমি.........”
দেশ মাতৃকার দেশাত্মবোধক গানের সুরের মূর্ছনায় আর বিগড্রামের তালে তালে ৭ম ব্যাসের সদ্য শপথ গ্রহণকারী নবীন সৈনিকরা আজ বিমুগ্ধ ও বিমোহিত এবং চরম রোমাঞ্চিত। তাদের সকলেই প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে জলদি গতিতে মার্চ করার সময় তাদের হাত ও পাঁয়ের সেরা নৈপুন্যের কসরতগুলোই দর্শনার্থীগণকে প্রদর্শন করতে। দেখতে দেখতে এক থেকে এগারোটি প্লাটুন জলদি গতিতে মার্চ করে ভি.আই.পি মঞ্চের কাছাকাছি আসছে এবং মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয়কে শ্রোদ্ধা মিশ্রিত ডানে সালাম জানিয়ে ভি.আই.পি মঞ্চটি অতিক্রম করছে।
প্লাটুনগুলির সর্বশেষে ব্যাণ্ড মাষ্টার সার্জেণ্ট জজ মিয়ার ব্যাণ্ড ষ্টিকের সেরা নৈপুন্যের কসরতের মাধ্যমে ব্যাণ্ড প্লাটুনের সাথে অংশ গ্রহণকারী বাদকদল তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলির মাধ্যমে সুরের ঝংকার তুলে দেশাত্ববোধক গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মাননীয় প্রধান অতিথিকে সালাম জানিয়ে প্রশিক্ষণ মাঠ ত্যাগ করছেন, আর সমস্ত দর্শনার্থী তুমুল করতালির মাধ্যমে সকলকেই অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
এরই মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটলো একজন রিক্রুটের অত্যন্ত ক্লান্তিময় ও দুঃখ-কষ্টময় একটি জীবনের। যে একদিন ছিলো, সাধারণ সমাজের অবহেলিত, বাউন্ডুলে, আওয়ারা ও ভবঘুরে একটি ছেলে। তার পরিবর্তে আল্লাহর অসীম রহমতে ফিরে পেলো একটি সুশৃঙ্খল মহাসম্মান ও গৌরবময় নতুন জীবন। যে জীবন শুধুই ত্যাগের ও কঠোর অধ্যাবসায়ের। শত্রুপক্ষের একটিমাত্র বুলেটের নিকট নিজের জীবনটি সেচ্ছায় অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে সে হয়ে গেল পরপোকারী হিতাকাঙ্খি একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক। সাধারণ সমাজে এ দৃষ্টান্ত বিরল। শুধুমাত্র একজন দেশপ্রেমিক পেশাদার সৈনিকের বেলাতেই এ মহান দৃষ্টান্ত প্রযোজ্য। তাইতো এ পেশা প্রচুর আত্মত্যাগের, মহাসম্মানের ও অত্যন্ত গৌরবের। ভিন্ন ভিন্ন জেলা,উপজেলা, গ্রাম-গঞ্জের এবং এক একটি পরিবাবের ভিন্ন ভিন্ন মায়ের একটি করে সন্তান, যাদের আঞ্চলিক ভাষায়,আচার-অচরণে প্রচুর গড়মিল থাকলেও একই সাথে সহাবস্থানে হয়ে গেলো একে অপরের কল্যাণকামী পরস্পর ভাই ভাই। উপভোগ করার মত একটি বৈচিত্রময় জীবন।
শপথের পর নতুন জীবনে প্রবেশ করে নিত্য নতুন গুরত্বর্পূণ দায়িত্ব পালন:
শপথ গ্রহণের পর আমাদের সকলেরই বিভিন্ন ইউনিটে বদলীর আদেশ বের হলো। নির্দিষ্ট সময়ে আমার বদলীকৃত ইউনিটে গিয়ে নতুন কর্মস্থলে সৈনিক হিসেবে যোগদান করলাম। শুরু হলো আমার দেশপ্রেমিক সৈনিকের কর্মকাণ্ড। পদোন্নতির সাথে সাথে এখানে দায়িত্বের মাত্রাও বাড়তে থাকলো। চাকুরী জীবনে ই,এম,ই সেন্টার ও স্কুল সৈয়দপুর-সেনানিবাস, জিলাঃ নিলফামারী হতে মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে তৎকালীন বেস ওয়ার্কসপ (বর্তমানে ৯০১ সেন্ট্রাল ওয়ার্কসপ) ইএমই ঢাকা-তে বদলী গিয়ে কমান্ড্যাণ্ট কর্ণেল গোলাম সারওয়ার, ডিপুটি কমান্ড্যাণ্ট লে:কর্ণেল ওয়াজি উল্লাহ ও ডিপুটি কমান্ড্যাণ্ট লে:কর্ণেল মোঃ এনামুল হক (আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক জ্বালানী ও বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী-এর অধীনে নতুন সৈনিক হিসেবে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করি। এবং এখান থেকে পরবর্তী পদোন্নতির জন্য সমস্ত কোর্স-ক্যাডারের পরীক্ষাগুলি সম্পন্ন করি। অতঃপর সেখান থেকে > ১১১ ফিল্ড ওয়ার্কসপ কোম্পানী ইএমই কুমিল্লায় বদলী গিয়ে অধিনায়ক মেজর মোঃ শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ও পরবর্তীতে মেজর মোহাম্মাদ সুলতানুল ইসলাম-এর অধীনে কোম্পানী করণিক এবং ইউনিট প্রশিক্ষন শাখায় প্রশিক্ষক হিসেবে প্রায় তিন বছর দায়িত্ব পালনকালীন সময়েই মহান আল্লাহর রহমতে ল্যান্স কর্পোর্যাল পদে পদোন্নতি লাভ করি। এবং স্কুল অব ইনফেন্টারী এন্ড ট্যাকটিক্স (এস.আই.এন্ড টি) জালালাবাদ সেনানিবাস, সিলেট-এ ভারী মেশিনগান কোর্স-২৩ এ অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে উর্ত্তীণ হই। এবং পরবর্তী কর্পোর্যাল পদে পদোন্নতির জন্য ইউনিট ও সেন্টার পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষাসমূহে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সহিত উর্ত্তীণ হই।
অতঃপর > ২২৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী ওয়ার্কসপ সেকশন ই,এম,ই (২৪ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী) জাহাঙ্গীরাবাদ, বগুড়ায় বদলী গিয়ে এক বছর সাধারণ দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে > ১২৯ ফিল্ড ওয়াকশপ কোম্পানী ইএমই মাঝিড়া সেনানিবাস বগুড়ায় অধিনায়ক মেজর মোঃ জয়নাল আবেদীন-এর অধীনে অস্থায়ী সংযুক্ত হয়ে প্রায় ছয় মাস ইউনিট এনসিও অস্ত্র প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
অতঃপর > ইএমই সেন্টার ও স্কুল মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ শাখা সৈয়দপুর, নিলফামারীতে বদলী গিয়ে কমান্ড্যাণ্ট কর্ণেল মোঃ মাহবুবুর রহমান এবং প্রধান প্রশিক্ষক লেঃ কর্ণেল মোঃ শফিকুর রহমান ও কোম্পনী কমান্ডার মেজর মোঃ আবু রায়হান-এর অধীনে অস্ত্র প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে,স্কুল অব ফিজিক্যাল ট্রেনিং এন্ড স্পোর্টস (এ.এস.পি.টি.এস) রাজশাহী সেনানিবাসে ইউনিট ইন্সট্রাক্টর অব ফিজিক্যাল ট্রেনিং (ইউ.আই.পি.টি)-কোর্স-১৮ এ অংশগ্রহণ করি এবং সেখানেও কৃতিত্বের সহিত উর্ত্তীণ হই। এ কোর্সে থাকাকালীন সময়েই কর্পোর্যাসল পদে পদন্নোতি লাভ করি।
ইএমই সেন্টার এন্ড স্কুলে দায়িত্ব পালনের মেয়াদ শেষে অতঃপর > ১১৮ ফিল্ড ওয়ার্কসপ কোম্পানী ইএমই চট্টগ্রামে ইউনিটে বদলী গিয়ে অধিনায়ক মেজর মোঃ শামসুল আযম (যিনি ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারী’২০০৯ইং তারিখে পিলখানায় দেশদ্রোহী বেঈমান-বিশ্বাসঘাতকদের হাতে র্নিমমভাবে শহীদ হয়েছেনে) এবং পরবর্তীতে মেজর মোঃ আবু নাছির ভূঁইয়া-এর অধীনে ইউনিট এনসিও প্রশিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষন শাখায় এবং সেই সাথে ইউনিটের প্রশাসনিক শাখায় অত্যন্ত গুরত্বর্পুণ দায়িত্ব পালন করি।
অতঃপর > বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী ভাটিয়ারী,চট্টগ্রাম-এ কমান্ড্যাণ্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মাদ ইবরাহীম, বীর প্রতীক (বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান),এবং পি.টি.এস.ও ক্যাপ্টেন শাফায়াত হোসেন-এর অধীনে পিটি প্রশিক্ষক হিসেবে পিটি শাখায় দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে সাধারণ সৈনিকের সর্বশেষ পদবী সার্জেণ্ট পদে পদোন্নতি লাভ করি।
অতঃপর > ১৩৫ ফিল্ড ওয়ার্কসপ কোম্পানী ইএমই জাহাঙ্গীরাবাদ, বগুড়ায় বদলী গিয়ে অধিনায়ক মেজর মোঃ আবু নাছির ভুঁইয়া-এর অধীনে প্রশাসনিক শাখায় কোম্পানী সার্জেণ্ট মেজর এবং কোম্পানী কোয়ার্টার মাস্টার সার্জেণ্ট (সি.এস.এম / সি.কিউ.এম.এস) সেই সাথে ইউনিট প্রশিক্ষন শাখায় ইউনিট এনসিও প্রশিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত গুরত্বর্পুণ দায়িত্ব পালন করি।
অতঃপর > ১৩৯ ফিল্ড ওয়ার্কসপ কোম্পনী ইএমই সাভার, ঢাকায় বদলী গিয়ে অধীনায়ক মেজর মোঃ মিজানুর রহমান পরবর্তীতে মেজর মোঃ হাবিবুর রহমান-এবং পরবর্তীতে মেজর মোঃ বেলায়েত হোসেন-এর অধীনে প্রশাসনিক শাখায় কোম্পানী সার্জেণ্ট মেজর এবং কোম্পানী কোয়ার্টার মাস্টার সার্জেণ্ট (সি.কিউ.এম.এস / সি.এস.এম) এবং ইউনিট এনসিও প্রশিক্ষক হিসেবে ইউনিট প্রশিক্ষন শাখায় অত্যন্ত গুরত্বর্পুণ দায়িত্ব পালন করি।
অতঃপর > পুনরায় ই,এম,ই সেন্টার ও স্কুল মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ শাখায় বদলী গিয়ে অস্ত্র ও পিটি প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। এবং প্রধান প্রশিক্ষক লেঃ কর্ণেল মোঃ তাজুল ইসলাম ও জিএসও-২ (ট্রেনিং) মেজর মোঃ শওকত আলী-এর অধীনে মৌলিক সামরিক ও মৌলিক কারিগরী প্রশিক্ষণ, উভয় শাখার প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রন (Course Planning & Control) শাখায় এনসিও প্রশিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত গুরত্বর্পূণ দায়িত্ব পালন করি। এভাবেই বিভিন্ন ইউনিটে বিভিন্ন অধিনায়কের অধীনে থেকে তাদের পরম স্নেহে, মায়া-মমতায় ও পথ-নির্দেশনায় প্রাপ্ত পদমর্যায় বিভিন্ন ইউনিটে বিশেষ গুরুত্বর্প দায়িত্ব পালনের মাধ্যেমে আমার সৈনিক জীবনের দিনগুলি দুঃখ-কষ্ট ও হাসি-আনন্দের সাথে অতিক্রম করেছি। সেনাবাহিনীতে অত্যন্ত এক কর্মচঞ্চল ও নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সহিত প্রত্যেকটি মুর্হুত অতিবাহীত হচ্ছিলো। এখন হবে না, বা এখন করতে পারবো না এই কথাটি সেনা-বাহিনীতে অচল। বরং কোথা থেকে হবে, কেমনে হবে, আদেশ দাতা জানেন না। কিন্তু কাজটা হতেই হবে। আর হয়ও। একঘণ্টার বা এক নম্বরের একজন সিনিয়র তার নিম্নের কাউকে কোন নির্দেশ দিলে সে কাজে সফলতা বিফলতা যাই হউক,সেটা হুকুম দাতাই বুঝবেন। জুনিয়রের কাজ শুধু কোন রকম আরগুমেন্ট বা আপত্তি ছাড়াই সিনিয়রের সেই নির্দেশ পালন করা। আমাদের সেনাবাহিনীতে এমন একটি সামাজিক অবস্থা বিরাজ করে যে, এখানে চাইলেই একজন সৈনিক তার কর্মকান্ডের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যমে সত্যের পথে অতিসহজে জান্নাতের র্শীষস্থানে পৌঁছিতে পারে। আবার কেউ চাইলে শয়তান ইবলিসের পথ অনুসরণ করে অতি সহজেই জাহান্নামের তলানীতে গিয়েও পৌঁছিতে পারে। এটা তার কর্মকান্ডের উপরই র্নিভর করবে। (চলবে...ইনশা-আল্লাহ)
বিষয়: সাহিত্য
২৭৮২ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার সামরিক জিবন আরো একটু ডিটেইল জানার আগ্রহ রইল।
আপনার কাছে তেমনটা মনে হলেও এটি প্যারেড বাড্রিলের সৌন্দর্য। আমি যতটুকু এখানে উল্লেখ করেছি এর বাইরে এখানে সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর সুযোগ নেই।
সাথে থেকে আপনার উৎসাহপূর্ণ মন্তব্য আমার ব্লগটি সমৃদ্ধ হয়েছে।আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সাধারণ সমাজের অবহেলিত, বাউন্ডুলে, আওয়ারা ও ভবঘুরে একটি ছেলে। তার পরিবর্তে আল্লাহর অসীম রহমতে ফিরে পেলো একটি সুশৃঙ্খল মহাসম্মান ও গৌরবময় নতুন জীবন। যে জীবন শুধুই ত্যাগের ও কঠোর অধ্যাবসায়ের। শত্রুপক্ষের একটিমাত্র বুলেটের নিকট নিজের জীবনটি সেচ্ছায় অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে সে হয়ে গেল পরপোকারী হিতাকাঙ্খি একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক। সাধারণ সমাজে এ দৃষ্টান্ত বিরল। শুধুমাত্র একজন দেশপ্রেমিক পেশাদার সৈনিকের বেলাতেই এ মহান দৃষ্টান্ত প্রযোজ্য। তাইতো এ পেশা প্রচুর আত্মত্যাগের, মহাসম্মানের ও অত্যন্ত গৌরবের। ভিন্ন ভিন্ন জেলা,উপজেলা, গ্রাম-গঞ্জের এবং এক একটি পরিবাবের ভিন্ন ভিন্ন মায়ের একটি করে সন্তান, যাদের আঞ্চলিক ভাষায়,আচার-অচরণে প্রচুর গড়মিল থাকলেও একই সাথে সহাবস্থানে হয়ে গেলো একে অপরের কল্যাণকামী পরস্পর ভাই ভাই। উপভোগ করার মত একটি বৈচিত্রময় জীবন।
হৃদয়কে আলোড়িত করার মত একটি লিখা। জাজাকাল্লাহু খাইর।
জি, সৈনিক জীবনটা অন্যরকম একটা বৈচিত্রময় জীবন।
আপনার লিখাগুলিও হৃদয় ছুয়ে যায়।
সুন্দর ও উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ওয়া জাঝাক।
আগামী পর্বের অপেক্ষায় ।
অনেক ধন্যবাদ চাচাজান ।
সাংগঠিক কিছু কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে দেরী হয়ে যায়। ওকে মা! নেক্সট পর্বগুলি তারাতারি দেবার চেষ্টা করবো ইনশা-আল্লাহ।
আপনার উৎসাহব্যঞ্জক সুন্দর মন্ত্যবের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মা! জাঝাক আল্লাহ বি খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন