স্মৃতির পাতায় গেঁথে রাখা দিনগুলি-(পর্ব-৯)
লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ০৭ এপ্রিল, ২০১৫, ০২:৩৪:৪৫ দুপুর
পবিত্র আল -কুরআনের আলোকে শপথের তাৎপর্য:(৯)
আমরা শপথের পর থেকে বাংলাদেশের দায়িত্ববান গর্বিত সৈনিকের পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলাম। আর তার বিনিময়ে আমাদের জীবনকে আল্লাহর নিকট উৎসর্গ করলাম। উদ্দেশ্য, যে পবিত্র মাটিতে আল্লাহর প্রিয় বান্দা-বান্দীগণ বসবাস করছেন, তাদের কল্যাণ সাধনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আমাদের ভূখণ্ডে যেন কোন শত্রু ঢুকে ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকে কড়া প্রহরায় নিয়োজিত থাকতে হবে। আর যদি কোনক্রমে কোন শত্রু শান্তিপ্রিয় আল্লাহর বান্দা-বান্দীগণের যে কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তাহলে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্যে জীবন দিয়ে লড়াই করতে হবে। তার বিনিময়ে পাওয়া যাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত। এ যেন আমরা আল্লাহর কুরআনের ভাষায় সেই চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে নিজের যান-মাল আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দিলাম। যেমন দয়াময় প্রতিপালক বলছেন:
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ মুমিনদের নিকট থেকে তাদের প্রাণ ও তাদের ধন-সম্পদ সমূহকে এর বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন যে, তাদের জন্যে জান্নাত রয়েছে (অর্থাৎ) তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা-বান্দীগণের কল্যাণ সাধনের জন্যে তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, যাতে তারা (কখনও শত্রুকে) হত্যা করে এবং (কখনও শত্রুর আঘাতে) নিহত হয়ে যায়, এর দরুন (তাদেরকে জান্নাত প্রদানের) সত্য অঙ্গীকার করা হয়েছে তাওরাতে, ইনজীলে এবং কুরআনে; আর অঙ্গীকার পূর্নকারী আল্লাহ অপেক্ষা অধিক কে আছে? অতএব তোমরা আনন্দ করতে থাকো, তোমাদের এই ক্রয়-বিক্রয়ের উপর, যা তোমরা (আল্লাহকে স্বাক্ষী রেখে তারই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে সকলের সামনে প্রকাশ্যে শপথ নিয়ে কঠিন চুক্তি) সম্পাদন করেছো; আর এটাই হচ্ছে (একজন মুমিন সৈনিকের) বিরাট সফলতা।” (সুরা: তাওবা -১১১)
আমাদেরকে প্রাথমিক নির্বাচনী বা ভর্তি পরীক্ষা থেকে বিভিন্ন স্তরে স্তরে পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই বাচাই করে আজ শপথ গ্রহণ পর্ব পর্যন্ত পৌঁছানো হয়েছে। এ বিষয়টি আল কুর’আনের আলোকে বর্ণনা করলে ব্যাপারটি এমন দাঁড়ায়। যেমন সুমহান সৃষ্টিকর্তা ও দয়াময় প্রতিপালক বলছেন:
“তোমরাই মানবমণ্ডলীর (মহাকল্যাণ সাধনের) জন্যে (দেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্য থেকে বিভিন্ন স্তরে যাচাই বাচাই হয়ে) শ্রেষ্ঠত্বতম (মু’মিন সৈনিক) সম্প্রদায়রূপে নির্বাচিত হয়েছো; (তোমাদের দায়িত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে) তোমরা (মানব জাতিকে) ভাল কাজের আদেশ কর ও মন্দ কাজের নিষেধ কর এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর.... (সুরা : আল-ইমরান: ১১০)
আমাদের এই আত্মত্যাগের বর্ণনাটি যদি কবিদের ভাষায় বর্ণনা করা যায় তাহলে বলতে হয়ঃ-
“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে,
আসে নাই কেহ অবনী পরে;
সকলের তরে সকলেই আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।”
অন্য আর একজন স্বনাম ধন্য কবি এ বিষয়ের সংক্ষিপ্ত ভাবে বর্ণনা করে বলেছেনঃ-
“পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও
তার মত সুখ আছে কি কোথাও?
আপনার কথা ভূলিয়া যাও।”
ইসলামের আলোকে শপথ ভঙ্গকারীদের পরিণাম:
এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটু বলতে হয় যে, আমরা আমাদের মাতৃভূমি ও মানুষের সেবামূলক কাজে নিয়োজিত হয়ে স্থান-কাল-পাত্র তথা শ্রেণীভেদে বিভিন্ন পর্যায়ে আল্লাহর নামে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে শপথ গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা অনকেই অনেকভাবে সেই পবিত্র শপথ ভঙ্গ করে দেশ ও জনগণের সাথে বেঈমানী করি। নিজের সামান্য দুনিয়ার ব্যক্তি স্বার্থের লোভে দেশের মান মর্যাদা এমনকি দেশের অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব দেশের মহাশত্রুদের হাতে তুলে দিতে বা বিক্রি করতেও কুণ্ঠাবোধ করি না। যার প্রমাণ আমাদের দেশের দিকে তাকালেই পরিস্কার দেখা যাবে। আর এই সমস্ত ব্যক্তিরাই বিশ্বাস ঘাতক, বেঈমান, প্রতারক ও মুনাফিক। তারা যে কোন পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হোক না কেন। তারাই দেশ ও জাতির শত্রু। তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শত্রু, ফেরেশতাগণের শত্রু, সর্বোপরি তারা তাদের স্ব স্ব ধর্মেরও মহাশত্রু। কারণ তারা সকলেই তাদের স্ব স্ব ধর্মের উপর দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধনের শপথ গ্রহণ করে থাকেন।
আর এই মুনাফিকী করার একটাই কারণ। আর তা হচ্ছে এই যে, আমরা আমাদের স্ব স্ব ধর্মের দোহাই দিয়ে শপথগুলো করে থাকলেও আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই স্ব স্ব ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ। আর এই অজ্ঞতার কারণ হচ্ছে আমাদের যার যার কাছে যে ধর্মগ্রন্থ আছে, বা আমরা যে ব্যক্তি যে ধর্মগ্রন্থের অনুসারী, সেই ধর্মগ্রন্থগুলি ভালভাবে অধ্যায়ন করিনা। ফলে একদিকে যেমন স্বেচ্ছায়কৃত শপথগুলি যখন তখন ভঙ্গ করে সৃষ্টিকর্তার নিকট চরম অপরাধী হিসেবে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছি। অপরদিকে মানুষের নিকটও নিকৃষ্টতম প্রতারক হিসেবেও প্রমাণিত হচ্ছি। কারণ শপথ একটি মহা আমানত,একটি চুক্তি, একটি অঙ্গীকারও বটে। আমার জানা মতে কোন ধর্মেই শপথ ভঙ্গ করার বৈধতা দেয়া হয় নাই। প্রত্যেক ধর্মেই তাদের শপথ রক্ষার জন্য জোড় তাগিদ রয়েছে।
আমরা যারা দেশের মাটি ও মানব কল্যাণমূলক সেবার কাজে নিয়োজিত হয়ে শপথ গ্রহণ করে থাকি, এ ব্যাপারেই দয়াময় পরম দয়ালু সুমহান প্রতিপালক তাঁর পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের মাধ্যমে সকল মানব জাতিকেই বলছেন:
“তোমরা আল্লাহর (নামে কোন অঙ্গীকার করলে সেই) অঙ্গীকার পূর্ণ করো, যখন পরস্পর অঙ্গীকার কর এবং তোমরা আল্লাহকে তোমাদের যামিন করে শপথ দৃঢ় করবার পর তা ভঙ্গ করো না; তোমরা যা কর আল্লাহ তা জানেন।” (সুরা নাহল : ৯১)
সুমহান প্রতিপালক আরো বলছেন:
“(তোমরা) সে নারীর মত হয়ো না, যে তার সুতা মজবুত করে পাঁকাবার পর ওর পাঁক খুলে নষ্ট করে দেয়; (অর্থাৎ কোন বিষয়ে কারো সামনে ওয়াদা করে নিজ স্বার্থ হাসিলের পর মেয়েলী স্বভাবের কারণে সেই ওয়াদা অস্বীকার করে বা মিথ্যা বলে মানুষকে ধোঁকা দেয়) তোমাদের শপথগুলো তোমরা পরস্পরকে প্রবঞ্চনা করবার জন্যে ব্যবহার করে থাকো, যাতে একদল অন্যদল অপেক্ষা অধিক লাভবান হও; আল্লাহ তো এটা দ্বারা শুধু তোমাদের পরীক্ষা করেন; তোমাদেরকে যে বিষয়ে মতভেদ আছে , আল্লাহ কিয়ামতের দিন তা নিশ্চয়ই স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিবেন।” (সুরা নাহল: ৯২)
আর তাই দয়াময় সৃষ্টিকর্তা শপথ সম্পর্কে সকল মানব জাতিকে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন :
“পরস্পরকে প্রবঞ্চনা করবার জন্যে তোমরা তোমাদের শপথকে ব্যবহার করো না; করলে (তোমাদের) পাঁ স্থির হওয়ার পর পিছলিয়ে যাবে এবং আল্লাহর পথে বাঁধা দেয়ার কারণে তোমরা শাস্তির আশ্বাদ গ্রহণ করবে; তোমাদের জন্যে রয়েছে মহাশাস্তি।” (সুরা নাহল ৯৪)
দয়াময় আল্লাহ শপথ গ্রহণকারীদের নির্দেশ দিয়ে আরো বলছেন:
“তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করো না; আল্লাহর কাছে যা আছে শুধু তাই তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা জানতে। তোমাদের কাছে যা আছে তা নিঃশেষ হবে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে তা স্থায়ী; যারা ধৈর্য্য ধারণ করে আমি নিশ্চয়ই তাদরকে তারা যা করে তা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করবো। মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম করবে; তাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করবো এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করবো।” (সুরা নাহল : ৯৫-৯৭)
আর অঙ্গীকার ভঙ্গকারী বা অঙ্গীকার ভঙ্গকারিনীদের সম্পর্কে পবিত্র হাদীসের বর্ণনা :
“হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: মুনাফিকের আলামত তিনটি (আর তা হচ্ছে (১) সে কথা বললে মিথ্যা বলে (২) ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং (৩) তার কাছে আমানত রাখা হলে তা খিয়ানত করে। যদিও সে নামায পড়ে, রোযা রাখে এবং বলে যে, সে মুসলমান।” (বুখারী ও মুসলিম)
অন্য আরো একটি হাদীসের বর্ণনাঃ
“হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম বলেছেনঃ যে ব্যক্তির মধ্যে চারটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে, সে পুরো মুনাফিক রূপে বিবেচিত হবে। আর যার মধ্যে (এচারটির যে কোন) একটি আচরণ পাওয়া যাবে, সে তা পরিহার না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকীর একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে মনে করতে হবে। আর তা হলোঃ (১) তার কাছে কোন কিছু আমানত রাখা হলে সে তার খেয়ানত করে (২) সে কথা বললে মিথ্যা বলে (৩) সে ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং (৪) সে ঝগড়া করলে (প্রতিপক্ষকে অশালীন ভাষায়) গাল-মন্দ করে।” (বুখারী ও মুসলিম)
আমরা অনেকেই শপথ ভঙ্গ করে সীমালংঘন করে আল্লাহর নিকট অপরাধী হচ্ছি। তিনি যত বড় শক্তিশালী বা মহাশক্তিধর হন না কেন? তার শপথ ভঙ্গের শাস্তি যেমনিভাবে দুনিয়াতেও পাবেন, তার চেয়েও ভয়াবহ শাস্তি হবে আখেরাতে। তবে কেউ যদি সীমালংঘন করার পরেও সংশোধন হয় বা তার আমলকে সংশোধন করে নেয়, আল্লাহ সবুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। এ ব্যাপারেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলছেন:
“অনন্তর যে ব্যক্তি সীমালংঘন করার পর তাওবা করে নেয় এবং আমলকে সংশোধন করে নেয়, তবে আল্লাহ তার প্রতি (রহমতের) দৃষ্টি করবেন নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল অতি দয়ালু।” (সুরা মায়িদা : ৩৯) (চলবে...ইনশা-আল্লাহ)
বিষয়: সাহিত্য
১৪৪২ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কিন্তু সত্যিই যদি এই দেশের সেনাবাহিনির সবাই শপথ রক্ষা করে চলত সেই ক্ষেত্রে এই দেশ এর অবস্থা আরো ভাল হতো।
অনেক ধন্যবাদ চাচাজান বিষটা পরিস্কার করার জন্য ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন