স্মৃতির পাতায় গেঁথে রাখা দিনগুলি-(পর্ব-৮}
লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ০৬ এপ্রিল, ২০১৫, ০৮:০৭:৫২ সকাল
বহু কাঙ্খিত পবিত্র শপথ গ্রহণ পর্ব: (৮)
এবার শুরু হলো সেই বহু প্রতীক্ষিত শরীরে শিহরণ জাগানো অপুর্ব এক রোমাঞ্চকর পর্ব। প্যারেড অধিনায়ক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু করার জন্যে ধর্মীয় শিক্ষককে মাঠে আহবান জানালেন। আদেশ পাওয়ার সাথে সাথেই ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা বাকী বিল্লাহ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় জড়ানো পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হাতে নিয়ে জলদি গতিতে মার্চ করে মাঠে প্রবেশ করলেন এবং মার্চ করে শপথ প্রার্থীগণের মুখোমুখি দুই সারির মধ্যবর্তী স্থানের সরু রাস্তায় একটা চেক মেরে থেমে গেলেন। সাথে সাথেই শুধুমাত্র বিগ ড্রামের তালে তালে ধীর গতিতে মার্চ করে দুই হাত দিয়ে পবিত্র আল-কুরআন শক্ত করে ধরে বাহু দুইটিকে সামনের দিকে প্রসারিত করে সেই সরু রাস্তা দিয়ে সামনে এগিয়ে চলছেন, আর তাকে অনুসরণ করছেন প্যারেড অধিনায়ক ২/ লেঃ ফারুক।
মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কুরআন দুই হাতে ধরে ধর্মীয় শিক্ষক বাকী বিল্লাহ সাহেব যখনি শপথ প্রার্থীর সারিদ্বয়ের মধ্যবর্তী সরু রাস্তা দিয়ে ধীর গতিতে মার্চ করে সামনে অগ্রসর হচ্ছেন, তখন যে দুই জন শপথ প্রার্থীর সামনে আসছেন তখনি মুখোমুখি দাড়ানো সেই দুইজন শপথ প্রার্থী একসাথে তাদের ডান হাত দিয়ে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কুরাআনকে স্পর্শ করে শপথ পূর্ণ করছেন। আর যখনি পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে স্পর্শ করছি তখনি সমস্ত শরীর শিহরিত হয়ে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেহ মনে বিদ্যুত শকের মত আন্দলিত করছিল। এভাবেই আমরা সকল মুসলিম শপথপ্রার্থী রিক্রুটগন শপথের প্রথম পর্ব শেষ করলাম। এরপর দ্বিতীয় পর্বের পালা। ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা বাকী বিল্লাহ সমস্ত মুসলিম শপথ প্রার্থীকে পবিত্র আল-কুরআন স্পর্শের মাধ্যমে প্রথম পর্ব শেষ করে দ্বিতীয় পর্বে চলে গেলেন।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ঘোষণা মঞ্চ থেকে মাইকে নির্ধারিত শপথ বাক্যগুলি একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা থেমে থেমে পাঠ করছেন, আর আমরা সকল শপথপ্রার্থীই তার বলা বাক্যগুলির পূর্ণরাবৃত্তি করে বলছি:-
“আমি (এখানে নিজের সৈনিক নং পদবী/পেশা নাম এবং পিতার নাম উল্লেখপূর্বক বলছি সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে স্ব-শ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে,আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সংবিধান এবং রাষ্ট্রপতির প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিবো। আমি আমার অপরিহার্য কর্তব্য মনে করিয়া আমার উপর ন্যস্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্তব্য, আমি, সততা ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিবো। এবং আমার প্রতি জ্বল স্থল ও আকাশ পথে যেখানে যাইবার আদেশ করা হইবে, সেখানেই যাইবো। আমার জীবন বিপন্ন করিয়াও আমার উপর নিয়োজিত সেনাবাহিনীর কর্তব্যরত যে কোন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ পালন ও মান্য করিবো। আমিন॥”
(এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, শপথ প্রার্থীগণের মধ্যে যারা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী থাকেন, তাদের জন্যেও স্ব স্ব ধর্মের ব্রাষ্মন পূরহিত ও ধর্ম যাজকগণও আমাদের মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষককের মতই স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়ে তাদের স্ব স্ব ধর্মের শপথ প্রার্থীগণ নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করিয়ে শপথ পূর্ণ করে থাকেন। এখানেই প্রতিয়মান হয় যে, আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ একটি উদার ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের দেশ। তাই এ দেশে যেমনিভাবে জঙ্গীবাদের স্থান নেই, তেমনিভাবেই ধর্ম হিংসুক ও ধর্মচোরা-বর্ণবাদী সন্ত্রাসী এবং নাস্তিকদেরও জায়গা নেই।)
আমরা মানব জাতি কেউ কারো শত্রু নই। আমরা সকল মানবজাতি এক আল্লাহর বান্দাহ। আমরা শুধুমাত্র নিজের বোধ বিশ্বাসের পার্থক্যকের কারণেই ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম প্রতিপালন করে থাকি। আমরা সকল মানুষই পরস্পর পরস্পরের আত্মার আত্মীয় পরম বন্ধু ও সহোদর ভাই। এ ব্যাপারেই সুমহান সৃষ্টিকর্তা ও দয়াময় প্রতিপালক বলছেন:
“হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী {হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আঃ)} হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী (ধর্মভীরু বা পরহজেগার)। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব কিছুর খবর রাখেন।” (সুরা হুজরাত: ১৩)
পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে শপথ বাক্য সমূহ পাঠ করার মাধ্যমে সকলেই আমরা এখন দেশ মাতৃকার এক একজন গর্বিত পূর্ণাঙ্গ সৈনিকে পদোন্নতি পেলাম। এই পর্বের অনুভূতিটা কার কাছে কেমন লেগেছিলো তা জানি না। তবে আমার কাছে যেমন লেগেছে সে সম্পর্কেই সামান্য উদাহরন দিচ্ছি। একজন মুসলিম ছেলে এবং একজন মুসলিম মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠিত হলে সেখানে প্রথমে উভয় পক্ষের স্বাক্ষীর উপস্থিতিতে বর কনের মধ্যে ইজাব-কবুল পর্ব আরম্ভ হয়। অতঃপর কাজী সাহেব বা কোন আলেম ওলামা সেই বিবাহের জন্য পবিত্র আল-কুরআন থেকে চয়নকৃত বাক্যাবলীর মাধ্যমে বিবাহের আক্দ পড়ান। তখন বরের নিকট সেই ইজাব-কবুলের সময় দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে বরের অন্তঃকরণে কনের প্রতি এমন এক দয়া-মায়া, ভালবাসা, মমত্ববোধ এবং দায়িত্বানুভূতি ঢেলে দেয়া হয়, (কনের ব্যাপারে কেমন হয়, জানা নেই) তখন যদি সেই বরের হৃদয় জাগ্রত থাকে, তাহলে তিনি সাথে সাথেই উপলব্ধি করতে পারেন।
ঠিক আমিও যখন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে শপথ বাক্যগুলি উচ্চারণ করছিলাম, তখন আমার গোটা শরীরে এক প্রচণ্ড শিহরণ জেগে উঠছিলো এবং অন্তঃকরণ রোমাঞ্চিত হয়েছিলো। এবং সেই সাথে দেশ, দেশের মাটি ও মানুষ তথা দেশের অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা, মমত্ববোধ এবং সুগভীর এক দায়িত্বানুভূতি দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আমার অন্তঃকরণে সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। তখন এটাও মনে হয়েছিলো যে, এ পবিত্র দায়িত্ব পালনের জন্যেই হয়তো আমার দায়মায় প্রতিপালক আমাকে সৃষ্টি করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যার জন্যে আমার চাকুরীতে আসার পূর্বের সেই পবিত্র স্বপ্নের নিদর্শনের কথা, তারপর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সবকিছুই মনে হলো। আর সাথে সাথে আমার সমস্ত শরীর শিহরণ ও রোমাঞ্চিত হচ্ছিলো। তখন দয়াময় আল্লাহর দরবারে অযস্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম এবং সাথে সাথেই এ পবিত্র দায়িত্ব পালনের জন্যে দয়াময় প্রতি পালকের নিকট তাওফীকও চাইলাম।(চলবে...ইনশা-আল্লাহ)
বিষয়: সাহিত্য
১৬৪৯ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে দুইবার পোষ্ট হয়ে গিয়েছে।
আপনার ধারাবাহিকটি পড়ে আমার অনেক ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন