স্মৃতির পাতায় গেঁথে রাখা দিনগুলি (পর্ব-৬)
লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ২২ মার্চ, ২০১৫, ০৬:৩৩:০০ সকাল
শপথ গ্রহণের প্রস্তুতি:(৬)
সুদীর্ঘ্য এগারো মাস ধরে আমরা প্রথমেই মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ এবং পরে পেশাভিত্তিক মৌলিক কারিগরী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলাম। অবশেষে উপস্থিত হলো সেই বহুকাঙ্খিত ও প্রত্যাশিত সময় কাল। যে সময়টির জন্যে একজন ক্যাডেট বা রিক্রুট প্রশিক্ষণ পিরিয়ডের অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানুষিক কষ্টের প্রত্যেক মুহূর্ত গুলি অত্যাধিক ধৈর্য আর পরম সহিষ্ণুতার মধ্যে অতিক্রম করতে থাকেন। এ প্রতিক্ষিত সময়কালে যদিও মানুষিক পরিশ্রমের চাপ কম থাকে, কিন্তু শারীরিক পরিশ্রমের চাপ পুরো প্রশিক্ষণ পিরিয়ডের চেয়েও সর্বাধিক। আর একজন ক্যাডেট বা রিক্রুটের জন্যে এ সময়কালে যদিও সর্বাধিক শারীরিক পরিশ্রম বা কষ্ট হয়ে থাকে, তবুও এক অনাবিল আনন্দ মিশ্রিত রোমাঞ্চকর প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি সবার অন্তঃকরণে অনুভব করেই সব কিছুই সহজে হজম করে ফেলেন। কারণ এরপর আর এমন কষ্ট থাকবে না। আর সেই বহু প্রতিক্ষিত ও কাঙ্খিত সময়কালটি হচ্ছে একজন মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট বা রিক্রুটের পাসিং আউট ।আমরা প্রায় এক মাসেরও বেশী সময়কাল ধরে শপথ গ্রহণ অনুশীলণ গ্রহণ করার পর আমাদের সামনে সেই বহু প্রতিক্ষিত ও কাঙ্খিত দিনটি উপস্থিত হলো।
আজ ০৪ মে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ। ইএমই সেণ্টার এণ্ড স্কুল এক নব সাজে সজ্জিত। সেণ্টারের ব্যবহৃত রাস্তাগুলো আকর্ষণীয় বিভিন্ন রং এর রঙিন পতাকা দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। রাস্তার দুই পার্শ্বে পতাকায় সজ্জিত খুটিগুলোতে শোভা বর্ধন করছে পবিত্র আল-কুরআন ও হাদীস থেকে চয়নকৃত উপদেশমূলক বাংলা অনুবাদের বাক্য সম্বলিত বিভিন্ন রং এর ব্যানার, প্লেকার্ড ও ফেষ্টুন। এছাড়াও রয়েছে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং বিভিন্ন প্রজ্ঞাবান মনিষীদের প্রত্যয়দীপ্ত উপদেশ মূলক বিভিন্ন বাক্যে খচিত ব্যানার ও ফেষ্টুন। কাঁচা প্রশিক্ষণ মাঠের পূর্বদিক সংলগ্ন রাস্তার সাথে ইট বিছানো গ্যালারী, সাথেই ভি.আই.পি মঞ্চটিকে রঙিন সামিয়ানা ও বিভিন্ন রংএর ব্যানার ও ফেষ্টুন দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ মাঠটিও বাদ পড়েনি, মাঠের চতুষ্পার্শ্বে বিভিন্ন প্রকারের রঙিন পতাকা ও পশ্চিম এবং উত্তর পার্শ্বটি রঙিন কানাত লাগিয়ে মাঠটিকে সুসজ্জিত করা হয়েছে। গ্যালারীগুলিতে বিভিন্ন প্রকারের বসার আসন পেতে দেয়া হয়েছে।
উদ্দেশ্য, আজ ইএমই কোরের ৭ম ব্যাচের রিক্রুটদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। সুদীর্ঘ্য প্রায় এগারোটি মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে আজ তারা দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে আল্লাহর নামে সুদৃঢ় শপথ নেবেন। নির্দিষ্ট সময়ে প্রশিক্ষণ মাঠের পূর্ব দিকের গ্যালারীর আসনগুলো দর্শনার্থী অতিথিগণের পদচারণায় ভরে গেল। দক্ষিণ পার্শ্বের অবতান এলাকাও দর্শনার্থীতে পরিপূর্ণ হলো। শপথ প্রার্থী ৭ম ব্যাচের রিক্রুটগণের মধ্যে যারা গ্রাউন্ডে পাসিং আউট প্যারেডে অংশগ্রহণ করবেন, তারা খুব রোমাঞ্চকর আনন্দে আনন্দিত। কিন্তু যারা বিভিন্ন কারণে (যেমন:প্রশিক্ষন চলাকালীন সময়ে পালিয়ে গিয়ে বা হাসপাতালে ভর্তি অথবা সেনা-শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দন্ডিত হয়ে চার সপ্তাহের অধিককাল প্রশিক্ষনে অনুপস্থিত থেকে) প্যারেডে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না বা যে কোন কারণে রিলিগেট (পরবর্তী ব্যাচে নামিয়ে দেয়া) হয়েছে, তাদের অন্তঃকরণে খুবই দুঃখ। তাদের মধ্যে অনেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কারণ এতদিন এক সাথে প্রশিক্ষন নিয়েও ব্যাচের সহপাঠিদের সাথে শপথ নিতে পরছেন না। যেমন এস.এস.সি পরীক্ষায় ফেল মারা অবস্থা।এর চেয়ে বড় দুঃখ আর আছে না কী?
আমরা শপথ প্রার্থীগণ পুরো প্রশিক্ষন পিরিয়ডে সকলেই একসাথে থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এতগুলো সমবয়সি ছেলে একসাথে চলতে গেলে মাঝে মাঝে সহপাঠীদের কারো কারো সাথে দু’চারদিন কথা কাটা-কাটি ও মন-মালিন্য হয়েছে। অনেকেই সেই অভিমানে কারো কারো সাথে কথা বলাও বন্ধ রেখেছিলো। কিন্তু আজ কারো মনে কোন হিংসা নেই, বিদ্বেষ নেই, নেই কোন অভিমানও। সকলের অন্তঃকরণ আজ উদারতার দুয়ার খুলে দিয়েছে। পরস্পর পরস্পরের প্রতি পবিত্রতার এক মহাবন্ধন এবং মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়েছে। সকলেই যেন পরস্পর পরস্পরের আত্মার আত্মীয়, পরম বন্ধু ও সহদোর ভাই, এ যেন সেই প্রিয় কবির কবিতার লাইন গুলির বাস্তব চিত্র :
“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনি পরে,
সকলের তরে সকলেই আমরা,
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে ॥”
তাই সকলেই স্ব স্ব ঈমানী অনুভূতিতে পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করছি, সাথে সাথেই নিজের আচার আচরণে অন্যকে দুঃখ দেয়ার জন্য তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কারণ আজকের পর থেকে সকলেই বাংলাদেশের প্রতিটি সেনাবনিবাসে ছড়িয়ে যাবে নিজের উপর অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব পালনের জন্যে। কারো কারো সাথে জীবনে আর দেখাও হবে না।
এক মহাবিচ্ছেদ বেদনা:
মানব জীবনে কোর্সমেট, ক্লাশমেট, রুমমেট বা অফিস কলিগ এই সম্পর্কগুলি কেমন হতে পারে? এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা, মমত্ববোধ, সহানুভূতি, আত্মত্যাগ ইত্যাদি প্রভাবগুলি অন্তঃকরণে কেমন প্রভাব ফেলে এবং তারা যখন পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে যান, তখন পরস্পরের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়? সেটা যারা ভূক্তভোগী তাদের সকলের অনুভূতিতে আজীবন বিদ্যমান আছে। আর তারা পরস্পর আপন ভাই এর চেয়েও আপন হয়ে যান। মায়ার পবিত্র বাঁধন ছিন্ন করতে সহজে কেউ আগ্রহী হন না। আজ আমাদের প্রত্যেকেরই ঐ একই অবস্থা। পরম আনন্দের ভিতরেও অন্তঃকরণের সেই দুঃখ ভরা অনুভূতিটা মাঝে মাঝে মর্মবিদারী মোছর দিয়ে উঠছে।
শপথপ্রার্থী রিক্রুটগণ খুব ভোরে উঠে পাক পবিত্র হয়ে যারা নামাজী তারা নামাজ আদায় করেছি। সকলেই আজ নূতন পোষাক পরিহিত। নূতন চার রং এর কম্বেট ইউনিফরম। কোমড়ে পড়া পলিশকরা টাইট বেল্ট। পাঁয়ে ওয়াটার পলিশ বুট। মাথায় পৃথিবীকে পাঁয়ের নিচে পদদলিত করে বিদ্যুত বেগে ধাবমান উর্ধ্বমুখী চলমান এক তেজী ঘোড়ার ব্যাজসহ কালো রং এর ব্যারেড ক্যাপ। হাতে ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ মাঠের উত্তর পার্শ্বে একটি ইট বিছানো রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাঠে ঢোকার জন্যে অপেক্ষা করছি। প্রশিক্ষকগণ পিতৃস্নেহে পরম যত্নে আমাদের পরিহিত পোষাক পরিচ্ছদগুলো টেনে-টুনে, ঠিক-ঠাক করে দিচ্ছেন। পড়নের পোষাকে ভুল ত্রুটিগুলি নিজ হাতে সুধরে দিচ্ছেন। প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে অনেক সময় বিভিন্ন রকম ভুল-ভ্রান্তি করেছি, প্রশিক্ষকগণ বিরক্ত হয়ে অনেক সময় বিভিন্ন প্রকার সাজা-শাস্তি দিয়ে শাসন ও সতর্ক করছেন। মাঝে মাঝে দু’চারটা চর থাপ্পরও দিয়েছেন সে জন্য তখন তাদের উপর মন খারাপও হয়েছিল। কিন্তু আজ সেগুলির কোন কিছুই মনে হচ্ছে না। আজ শুধুই মনে হচ্ছে, এই প্রশিক্ষকগণই আমাদের প্রশিক্ষণের জন্যে অনেক ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেছেন, নিরলস পরিশ্রম ও সর্বাধিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সবকিছু উজার করে শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আজ তাদের প্রতি আমরা প্রত্যেকই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। অনেকেই আবেগ আপ্লুত হয়ে প্রশিক্ষকগণকে জড়িয়ে ধরে হু হু শব্দ করে কেঁদে ফেলছি। সে এক অন্য রকম অনুভূতি কাউকে লিখে বুঝানো যাবে না। এটা শুধুমাত্র অন্তঃকরনের অন্তস্থলের অনুভূতির বিষয়। (চলবে...ইনশা-আল্লাহ)
বিষয়: সাহিত্য
১৪৪৮ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন