স্মৃতির পাতায় গেঁথে রাখা দিনগুলি-(র্পব-৫)
লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ১৯ মার্চ, ২০১৫, ০৮:৫৩:২৭ সকাল
প্রশিক্ষন গ্রহণকালীন সময়ের একটি মজার হাসির ঘটনা:
প্রশিক্ষণ পিরিয়ডে শুধুমাত্র কষ্টের ঘটনাই ঘটেনা। মাঝে মধ্যে মজার মজার হাসির ঘটনাও ঘটে। প্রশিক্ষণ পিরিয়ডে সবাই যখন আমরা ক্লাসে যেতাম, তখন আমাদের থাকার কামরাগুলো ফাঁকা থাকতো, চুরির ভয়ে সেই কামরাগুলি প্রহরা দেয়ার জন্যে প্রতিদিন দুইজন করে ডিউটি রাখা হতো। তাদের কাজ হচ্ছে কামরাগুলি পাহারা দেয়া, আর মেস থেকে প্লাটুনের সকলের জন্য দুপুরের খাবার এনে সকলকে বন্টন করে দেয়া। একদিন একটি মজার ঘটনা ঘটলো। আমাদের ৭ম ব্যাচের সবচেয়ে লম্বা ছেলে মোঃ ইখতিয়ার উদ্দিন (যশোর) যার উচ্চতা প্রায় সাত ফুটের মত এবং সব চেয়ে বেটে ছেলে মোঃ রমিজ উদ্দিন (কিশোরগঞ্জ) যার উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি। দুই জনেই আমাদের প্লাটুনে পড়েছে। একদিন তাদের উভয়ের ভাগে এক সাথে লাইন ডিউটি পড়লো। তারা মেস থেকে দুপুরের যে খাবার এনেছিলো সকলকে বণ্টন করে দিতে দিতে তাদের দুইজনের ভাগে কম পড়েছে। এই নিয়ে ইখতিয়ার ও রমিজের মধ্যে কথা কাটা-কাটি চলছিলো। এক পর্যায়ে এমন হলো, রমিজ ইখতিয়ারের নাকের কাছে নিজের হাত মুষ্টি বন্ধ করে নিয়ে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলছে : এক ঘুঁষিতে তোর নাক ফাটিয়ে দিবো।
কিন্তু রমিজ যে ইখতিয়ারের নাক ফাটিয়ে দিতে চাচ্ছে, তার ঐ কাজটা করতে হলে রমিজকে আগে উঁচু কোন স্থানে উঠে দাঁড়াতে হবে, তবেই সে ইখতিয়ারের নাকের সাক্ষাত পাবে। অথবা ইখতিয়ার যেখানে দাঁড়িয়ে আছে রমিজকে তার পাঁয়ের কাছে ৪/৫ টি ইট একটার উপর একটা এভাবে টাল দিয়ে সেই টালের উপর দাঁড়িয়ে তারপর ইখতিয়ারের নাকে ঘুষি মারতে হবে। রমিজ যতক্ষণ পর্যন্ত ইট এনে ইখতিয়ারের পাঁয়ের কাছে রাখবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কি ইখতিয়ার নির্বোধের মত ঘুঁষি খাওয়ার জন্যে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? এই ঘটনাটি যখন ঘটছে তখন আমরা সকলেই তাদের দুইজনের সেই ঘুঁষি মারার মজার ঘটনা চেয়ে চেয়ে দেখছি, আর হাসতে হাসতে পেট ফুলাচ্ছি। হাসার কারণ হচ্ছে যে, রমিজ যে ইখতিয়ারের নাকে ঘুঁষি দিতে যাচ্ছিল, ইখতিয়ার যদি তাকে দুই হাত দিয়ে গলাটা ধরে উপরে তুলে নেয় তাহলেই রমিজের সমস্ত শক্তি শেষ। সে আবার ঘুঁষি মারার শক্তি পাবে কোথায়? যাক পরে আমরা আমাদের প্লেট থেকে সকলে মিলে একটু একটু করে ডাল সবজি ইখতিয়ার ও রমিজকে দেই এবং তাদের দুইজনের ঝগড়া বন্ধ করে তাদের ঝগড়া-বিবাদ মিঠিয়ে দেই। এই রকম টুক-টাক হাসির কান্ডও প্রশিক্ষণ পিরিয়ডে অনেক ঘটে থাকে।
প্রাক প্রশিক্ষণে মানবিক তদারকি ও প্রশিক্ষণে ভারসাম্যতা:
সৈনিকদের প্রাক প্রশিক্ষণ শুধুমাত্র কঠোরতার মাধ্যমেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। সেখানে কঠোরতার পাশাপাশি রয়েছে মাতৃ ও পিতৃস্নেহের তদারকী। কোন রিক্রুটের খানা দানা কম হয় কিনা? বা কাউকে স্বজন প্রীতি করে খানা বেশী দেয়া হয় কিনা? সেগুলি তদারকীর জন্যে প্রত্যেকদিন খানা বণ্টনের সময় দুইজন করে ষ্টাফ নিয়োজিত থাকেন। এছাড়াও দায়িত্বশীল উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণও মাঝে মাঝে খাবার সময় দেখাশুনা করে থাকেন। এমনি একদিনের ঘটনা, আমরা সকলেই মাগরিবের নমাজ পরে রাতের খাবারের জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের মাননীয় সেণ্টার কমান্ড্যান্ট কর্ণেল শামসুজ্জামান সাহেবও ছদ্মবেশে চাদর মুড়ি দিয়ে প্লেট হাতে নিয়ে আমাদের সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য, যারা খাবার বণ্টন করছেন, তারা কারো উপর অবিচার বা কোন প্রকার যুলুম এবং কারো প্রতি স্বজনপ্রীতি করে কিনা ? সেটাই স্বচোখে দেখার জন্যে কমান্ড্যাণ্ট সাহেব আমাদের সাথে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। যখন বাবুর্চির কাছে খানা নেয়ার সিরিয়াল এলো তখন সেণ্টার কমাণ্ড্যাণ্ট কর্ণেল শামসুজ্জামান সাহেবও এমনভাবে ছদ্মবেশে বাবুর্চির কাছে খানা নিয়েছেন যে, বাবুর্চি আক্কেল আলী তাকে চিনতেই পারলেন না। আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে লম্বা ছেলে ইখতিয়ার উদ্দিনের জন্যে সেণ্টার কমাণ্ড্যাণ্ট সাহেব সেইদিন থেকেই আমাদের চেয়ে দ্বীগুণ খানা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। আর সেটা তার জন্য প্রয়োজনও ছিলো। কারণ সে আমাদের সকলের চেয়ে অনেক দীর্ঘ্যদেহী ব্যক্তি ছিলো।
প্রাক প্রশিক্ষণের কঠোরতার মধ্যেও আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ এভাবেই আমাদের সবকিছুর প্রতি কড়া নজর রাখছিলেন। প্রাক প্রশিক্ষণের কষ্ট অনেকেরই সহ্য হচ্ছিলো না। তাই আমাদের ব্যাচের অনেক ছেলেই পালিয়ে বাড়ীতে চলে যেত। আবার তাদেরকে পুলিশ ধরে এনে সেণ্টারে দিয়ে যেত। সেণ্টারে আসার পর কেউ কেউ পুনরায় চাকুরীতে যোগদান করতো আবার কেউ কেউ স্থায়ীভাবে অব্যহতি নিয়ে বাড়ীতে চলে যেত। এভাবেই যারা প্রশিক্ষণের কষ্ট সহ্য করে দেশ মাতৃকার গর্বিত সৈনিক হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার আশা-পোষণ করতেন তারা প্রশিক্ষণের সকল কষ্টকে অন্তঃকরনের এক অনাবিল আনন্দে হাসিমূখে সহ্য করে নিতেন। প্রশিক্ষকগণ যেদিন বেশী কঠিন কঠিন প্রশিক্ষণ দিতেন সেদিন সকলের মন মেজাজ খারাপ থাকতো। তাই সেদিন প্রশিক্ষকগণ প্রশিক্ষণের ভারসাম্যতা ঠিক রাখার জন্যে ক্লাশ শেষে সকলকে একত্র করে বসিয়ে কৌতুক বা জোক ক্লাশের ব্যবস্থা রাখতেন যাতে করে সাময়িক একটু হাসি-তামাশার মাধ্যমে কিছুক্ষণ পূর্বে পাওয়া প্রশিক্ষণের কষ্টের কথা সবাই ভুলে যেতে পারে। কৌতুক অভিনেতাগণের মধ্যে প্রথম স্থানে ছিলো আমার রুমমেট গোলাম সারওয়ার (নোয়াখালী)। তার কৌতুক, অভিনয় দেখে আমাদের সবার হাসতে হাসতে পেট ফেঁটে যাওয়ার উপক্রম হতো, ষ্টাফগনও সেই কৌতুকের মজা নিতেন। এভাবেই সুখে-দুঃখে হাসি-কান্নার মধ্য দিয়ে আমরা মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল অতিক্রম করলাম। (চলবে...)
বিষয়: সাহিত্য
১২২৪ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ ভাইয়া ।
এটা কিন্তু ভালোববাসার নিশান!! আমিওও যদি পারতাম টে....
মন্তব্য করতে লগইন করুন