স্মৃতির পাতায় গেঁথে রাখা দিনগুলি-(পর্ব-4)
লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ১৮ মার্চ, ২০১৫, ০৬:১৭:১৬ সন্ধ্যা
প্রাক প্রশিক্ষনের সময় স্বরনীয় ঘটনাগুলি:
ঈদের ছুটি শেষে শুরু হলো মাঠের প্রশিক্ষন। আমাদের বেশীর ভাগ সিনিয়র ষ্টাফই ছিলো পাকিস্তান আমলের সৈনিক। তাদের কড়া শাসন আর কঠোর প্রশিক্ষণ ভুলার মত নয়। বর্তমানের মত তখন এত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ সরঞ্জামাদি না থাকলেও মাঠ প্রশিক্ষণের ক্ষিপ্রতা থাকতো প্রচুর পরিমাণ। প্রশিক্ষকগণের সকলের হাতে হাতে বিভিন্ন প্রকার শাসন সামগ্রী থাকতো। প্রশিক্ষণের সময় কোন রিক্রুট কোন প্রকার ভুল করলে সেই শাসন সামগ্রী ব্যবহার করা হতো তাদের শরীরে। মাঠে যখন প্রশিক্ষণ নিতাম তখন স্টাফদেরকে মনে করতাম সবাই জল্লাদ। তাদের অন্তরে মনে হয় কোন দয়া-মায়া বা মমত্ববোধ নেই। কিন্তু সেই ধারনা কিছুদিন পরেই পাল্টে গেল। আমরা যখন কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রায় ৪/৫ সপ্তাহ অতিক্রম করলাম তখন আমাদের উপর থেকে কঠোরতা আস্তে আস্তে কমতে থাকলো। তখন ষ্টাফগনের সাথে আমাদের গভীর এক সুসর্ম্পক গরে উঠলো।
এভাবেই আমাদের প্রশিক্ষণ পিরিয়ডে যতই দিন যাচ্ছে আস্তে আস্তে আমাদের সব কিছুই সহ্য হচ্ছে। সেনাবাহিনীতে যেমনি আছে প্রশিক্ষণের ক্ষিপ্রতা, তেমনি আছে শৃঙ্খলার কঠোরতা। সেখানে মাঠ প্রশিক্ষণে যুদ্ধের কলা-কৌশল থেকে ব্যক্তিগত আচার-আচরণ এবং নীতি নৈতিকতাও শিক্ষা দেয়া হয়। মেসের টেবিলে বসে খানা খাওয়া থেকে শুরু করে, টয়লেট ব্যবহার পর্যন্ত সব কিছুই সুন্দরভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আর শুধু তাত্ত্বিক শিক্ষা দিয়েই ছেড়ে দেয়া হয় না, বাস্তবে তা প্রয়োগও করা হয়। আর সে বিষয়ে তার ছোট একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। একদিন আমাদের সাথের এক রিক্রুট গোসল করে তার একটি সরকারী টাওয়াল রোদ্রে শুকাতে দিয়ে প্রশিক্ষণ মাঠে গিয়েছিলো। দুপুরে ক্লাশ থেকে ফিরে এসে টাওয়ালটা আর পেলো না। তাই সে তার প্ল¬াটুন ষ্টাফকে রিপোর্ট করলো যে, তার টাওয়াল পাওয়া যাচ্ছে না। সেটা ছিলো সরকারী টাওয়াল। মাঝে মাঝে সরকারী জিনিস পত্র পরিদর্শনের মাধ্যমে হিসাব নেয়া হয়। কারো কাছে জিনিস কম বা বেশী থাকলে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। সেই শাস্তির ভয়ে ছেলেটি তার প্লাটুন ষ্টাফকে টাওয়াল হাড়ানোর রিপোর্ট দেয়। এই রিপোর্ট পাওয়ার পর প্লাটুন ষ্টাফ আমাদের প্লাটুনের সকলকে ফলিন করে জিজ্ঞাসা করলেন, কেউ সে টাওয়াল নিয়েছে কিনা? জিজ্ঞাসা করার কারণ আমরা প্রায় সাড়ে তিনশত রিক্রুট সাড়ে তিনশত মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়ে যার যার পরিবারে লালিত পালিত হয়েছি। কে কোন পরিবার থেকে এসেছি এবং কার কেমন স্বভাব চরিত্র? সে কথা তো কারো জানা নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি যে কোন পরিবার থেকেই আসুক না কেন এখানে গরু-ছাগল, ভেড়া-মহিষ, বাঘ-বকরি সকলেই এক ঘাটে পানি খাওয়ার মত অবস্থা। কেউ কারো উপরে অত্যাচার করতে পারবে না। তাই প্লাটুন ষ্টাফ যখন সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন কেউ টাওয়াল পেয়েছে বলে স্বীকার করলো না। তখন প্লাটুন ষ্টাফ সবাইকে সময় দিয়ে বললো সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়, টাওয়ালাটা যে নিয়েছো এর মধ্যে যার জিনিস তাকে ফেরত দিবে। আর যদি টাওয়াল পাওয়া না যায়, তাহলে সবাইকে ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে।
সন্ধ্যা হয়ে রাতের প্রায় সাত আটটা বাজলো, টাওয়াল পাওয়া গেল না। তাই আমাদের প্লাটুন ষ্টাফ অন্য প্লাটুনের কঠোর স্বভাবের কয়েকজন ষ্টাফকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসলেন। প্লাটুন এলাকায় সব লাইট নিভিয়ে দেয়া হলো। এবার সমস্ত ষ্টাফ মিলে আমাদের তেত্রিশজন রিক্রুটকে দৈর্ঘ্য প্রায় দশ ফুট এবং প্রস্থে তিন ফুট একটি পানি ভর্তি চৌবাচ্চায় রাত্রে নামিয়ে দিলো। চৌবাচ্চায় তেত্রিশজনের জায়গা সংকুলান হচ্ছিল না, তবুও ষ্টাফগণ বলছেন সকলকেই চৌবাচ্চায় নামতেই হবে। আর যে ছেলেটি চৌবাচ্চায় নামতে গরিমশি বা দেরী করছে রাইফেলের শিলিংসহ বিভিন্ন প্রকার শাসন সামগ্রী তার পিঠের উপর ব্যবহার হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে আমরা সকলেই চৌবাচ্চায় নামলাম। যখন চৌবাচ্চায় সকলেই গাদাগাদি করে নামলা তখন আবার আমাদেরকে সেই চৌবাচ্চা থেকে উঠানো হলো।
কিছুক্ষণ চৌবাচ্চার বাহিরে মাটির মধ্যে আমাদেরকে গড়ানো হলো। যখন শরীরের কাপড়ের পানি শুকিয়ে গেল, তখন পুনরায় আমাদের সবাইকে সেই চৌবাচ্চায় নামালো। এইভাবে কিছুক্ষণ পর আবার উঠালো। আবারও সেই পূর্বের মত অবস্থা। এ ভাবে যতক্ষন পর্যন্ত চৌবাচ্চার পানি না শুকিয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদেরকে ছাড়েনি। যখন চৌবাচ্চার পানি শুকিয়ে গেছে এখন অন্য আর এক ব্যবস্থা। ছোট্ট একটি পরিত্যক্ত টয়লেট দাঁড়ালে দুই থেকে তিন জনের বেশী লোকের জায়গা সংকুলান হয় না। কিন্তু সেই ছোট একটি টয়লেটে আমাদের তেত্রিশ জনকে ঢুকানো হলো তাহলে এবার বুঝে দেখুন আমাদের অবস্থা কেমন হতে পারে?
এভাবেই রাত প্রায় দুই আড়াইটা পর্যন্ত আমাদের উপর ব্লাক নাইট অপারেশন চলছিলো। আর এ মহা অভিযান থেকে টাওয়ালের মালিকটিও বাদ পরেনি। তিনিও আমাদের সকলের সাথেই শরীক ছিলেন। অনেকের কাছে এ ব্যাপারটা অন্য রকম লাগবে। যে যার জিনিস হারিয়ে গেল সে কেন সাজা ভোগ করবেন? এ ব্যাপারটা নিশ্চয়ই অমানবিক। আর সামান্য একটি টাওয়াল হারিয়ে যাওয়ায় এতগুলো ছেলেকে এতকঠিন শাস্তি দেয়াটা আরো বড় অন্যায় এবং অমানবিক। তাই বলছি ঘটনার দিন আমার কাছেও তেমনি মনে হলেও সেই অভিযানে একজন সৈনিকের জন্য মহাশিক্ষা নিহিত ছিলো। যেটা পরবর্তীতে আর্মির বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষকতার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে স্বীয় কোরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আরো অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজই যখন প্রশিক্ষকতা করেছি তখন সেই মর্মটি বুঝতে পেরেছি।
সেই হারিয়ে যাওয়া টাওয়াল খুঁজে বের করার জন্য ব্লাক নাইট অপারেশনটার মধ্যে দুইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহাশিক্ষার তাৎপর্য হচ্ছে: “যে ছেলেটির টাওয়াল হারিয়ে গেল,তার জন্য শিক্ষা ছিলো,যে ব্যক্তি সামান্য একটি টাওয়াল সামলে রাখতে পারলো না,সে কিভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা তথা জাতীয় সম্পদ শত্রুর কবল থেকে সামলিয়ে রাখবে? দ্বিতীয় শিক্ষাটি সকলের জন্যেএটাই ছিলো যে, যে ব্যক্তি সামান্য একটি টাওয়ালের লোভ সামলাতে পারে না,সে ব্যক্তি নিজের স্বার্থের জন্যে একদিন দেশ ও জাতির সাথে বেঈমানী করে দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব অন্যের নিকট বিক্রি করতেও দ্বিধা করবে না। আর তারই নৈতিক শিক্ষা নিহিত ছিলো আমাদের সেই হারানো টাওয়াল খোঁজা ব্লাক নাইট অপারেশনে।
শুধুমাত্র আমাদের প্লাটুন’ই নয়,আমাদের পুরো ৭ম ব্যাসের সবগুলি প্লাটুনের ছেলেই ঐ এক টাওয়াল হারানোর জন্যে ব্লাক নাইট অপারেশনে পড়েছিলো। পরবর্তীতে শুনতে পেয়েছি যে ঐ একটি টাওয়াল হারিয়ে গিয়েছিলো আমাদের পূর্ববর্তী ৩য় ব্যাসের একজন রিক্রুট। সেই টাওয়ালটাই ঘুরে ঘুরে ৩য়,৪র্থ, ৫ম ব্যাচ থেকে ৬ষ্ঠ ব্যাস হয়ে আমাদের ৭ম ব্যাস পর্যন্ত ব্লাক নাইট অপারেশনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে। এবং সেই ধারাবাহিকতা আমাদের পরবর্তী ব্যাসগুলিতেও চলছিলো। এর একটি মাত্র কারণ,যে রিক্রুটকে সরকারী পোষাক পরিচ্ছদ বা অন্যান্য অনুসাঙ্গিক দ্রব্য সামগ্রী দেয়া হয়, সেগুলি মাঝে মাঝে পরিদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে,যা চাকুরীর শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে। তাই একজন রিক্রুটের একটি টাওয়াল হারানো যাওয়াতে সে অন্য একজনের একটা নিয়ে পুরণ করেছিলো তা না করলে পরিদর্শনের সময় ধরা পড়লে, তাকে শাস্তি পেতে হবে অথবা অর্থদন্ড হতে পারে। সেই কারণেই এই অবস্থা। তবে এখন আর ঐ রকম রিসিপশনও নেই,খানা-দানাও নেই এবং সাজা-শাস্তিও নেই,কাল প্রবাহে সব কিছুই পরিবর্তন ও উন্নত হয়েছে। তবে বর্তমান সৈনিকদের জন্য আমার উপরের কথাগুলো রূপকথার গল্পের মতই মনে হবে। (চলবে...)
বিষয়: সাহিত্য
১১০০ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মুসলিমরা যদি আজ ইসলামের স্বার্থে এরকম আদর্শ প্রশিক্ষিত ট্রেইনার মুসলিম হতো?
খুবি ভালো লাগলো! পরের পর্বের অপেক্ষায়..।
সেনা বাহিনীর ট্রেনিং সময়টা অনেক কঠিন তবে এতটা কঠিন জানা ছিল না ।
আপনার ঘটনা গুলো জেনে অনেক ভাল লাগছে ।আগামী পর্বের অপেক্ষায় ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন