স্মৃতির পাতায় গেঁথে রাখা দিনগুলি-(পর্ব-৩)
লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ১৭ মার্চ, ২০১৫, ০৭:২৯:৪৫ সন্ধ্যা
অচেনা পরিবেশে ব্যাকুল মন:
আজ ইএমই সেন্টার এন্ড স্কুলের রিক্রুট মেসের রাস্তায় দাঁড়িয়ে এতগুলো সমবয়সী ছেলেকে এক সাথে দেখে পূর্বের সেই মিছিলে যোগ দেয়ার কথাগুলোই মনের কোণে উঁকি দিলো। সেটা ছিলো সোরগোল ও কোলাহলপূর্ণ সমাবেশ। কিন্তু এখানে সেই কোলাহল বা সোরগোল নেই। ষ্টাফগণ কড়া প্রহরায় বারবার লাইনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পায়চারী করছেন আর সতর্ক নির্দেশ দিয়ে বলছেনঃ কেউ একটি টু শব্দও করবে না। শব্দ করলেই খানা দানা বাদ, সাথেই পানির হাউজ রয়েছে, সেখানে নামিয়ে দেয়া হবে। আমরা ভয়ে ভয়ে কেউ কোন শব্দ করছি না। খানা নেয়ার সিরিয়াল আসলে বাবুর্চিদের কাছে খানা নিয়ে মাটির টেবিলে বসে খানা দানা খেয়ে পুনরায় লাইনে দাঁড়ালাম। ষ্টাফগণ যার যার প্লাটুনকে সাথে নিয়ে যার যার কামরায় পৌঁছে দিলেন। আমরা যার যার কামরায় গিয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। ফজরের আযানের সময় শুনতে পেলাম কেউ আমাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিচ্ছেন। হ্যা! সত্যি তাই, লাইন ডিউটিম্যান আমাদের কামরায় কামরায় গিয়ে সকলকে জাগিয়ে দিচ্ছেন ফজরের নামাজে শরীক হওয়ার জন্য। ঘুম পুরো হয় নাই, এক প্রকার কাঁচা ঘুম চোখে রেখেই সবাই উঠে হাত মুখ ধুয়ে যারা নামাজী তারা নামাজ পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে নাস্তা খাওয়ার জন্যে রিক্রুট মেসে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম।
সকালের নাস্তা খাওয়ার সময় ষ্টাফগণ আমাদেরকে আদেশ শোনালেন, নাস্তা খাওয়ার শেষে সকলেই নাপিতের কাছে গিয়ে মাথার চুল কেটে নিবে। আমরা একটা করে তেলে ভাঁজা পুুরি আর এক গ্লাস করে চা, নাস্তা খাওয়া শেষ করে নাপিত সোপে গিয়ে চুল কাটার জন্যে লাইনে দাঁড়ালাম। প্রায় ১২/১৪ জন নাপিত মেশিন দিয়ে মাথার চাঁদিটুকু বাদ রেখে তার নীচে খুর দিয়ে কামিয়ে দিচ্ছে। এই চিত্র দেখে কেউ কেউ হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলছে, আর বলছে ,চাকুরী করবো না, এই চাকুরীর দরকার নাই এটা কেমন চাকুরী? কিন্তু আমি মনে মনে বললাম জীবনে যে কষ্ট পেয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। মাথা পুরোপুরি ন্যাড়া করলেও আমার কোন আপত্তি নাই। আমার বাবার প্রতিরাতের দোয়া কবুল করে আল্ল¬াহ আমাকে একটা সৎ ও হালাল পথে রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমার শত কষ্ট হলেও এ চাকুরী ছেড়ে যাবো না। কষ্টের জন্যে মৃত্যু হলে হউক, তবুও এ পবিত্র চাকুরী ছেড়ে যাবো না।
চুলকাটা শেষ হলো, আমরা সবাই গোসল করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলাম। এরই মধ্যে দুপুরের খাবার সময় হলো। সকলেই দুপুরের খাবারের জন্যে পুর্বেরমত মেসে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। সবাইকে গণে গণে তিনটি করে তাওয়ায় ভাজা রুটি ভাঁজ করে করে হাতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং প্লে¬টে ডাল সব্জি। আমরা রুটি আর ডাল সব্জি নিয়ে সেই মাটি দিয়ে বানানো টেবিলে বসে খানা খাওয়া শুরু করলাম। রুটিগুলো খুলে দেখলাম অনেক দিনের পুরাতন আটার রুটি, যার মধ্যে প্রচুর ভূঁষি এবং ছোট ছোট কালো কালো হাতিপোকা মিশানো। রুটিগুলো দেখলে মনে হবে যেন কালো জিড়া মিশিয়ে আটা গোলানো হয়েছে। চিত্রটা কালোজিরা মিশানো নিমকির মত।
আমরা সেই রুটি থেকে পোকাগুলো বেঁচে বেঁচে কোন রকমে তিনটা করে রুটি খেয়ে কামরায় চলে আসলাম। এই সব খানা দানা দেখে দুই একজন খুব’ই কান্নাকাটি করছে। কারণ তারা অনেকেই বড় বড় ধনী ঘরের ছেলে সন্তান, অনেকেই রুটিও কোনদিন খায়নি। কিন্তু আমার কোন দুঃখ নেই। এর চেয়েও কঠিন কঠিন দুঃখের দিন অতিক্রম করে এসেছি। পেটে ভাত ছিলো না। তিন চার দিন পর্যন্ত ভাতের মুখ দেখতে পাইনি। এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) চাল জোগার হলে তাতে বেশী করে পানি ঢেলে দিয়ে রান্না করে ভাতের মারসহ সেগুলি বাবা-মা আর আমরা দুই ভাই, মোট চার জনে ভাগা-ভাগি করে খেয়ে দিন কাটিয়েছি। কতদিন যে না খেয়ে অনাহারে থেকেছি এবং কতদিন যে মাত্র এক বেলা খেয়ে দিন রাত অতিবাহিত হয়েছে, তার কোন নির্দিষ্ট হিসাব নাই। তাই আমার কোন দুঃখ নাই। যাই দিক তাই খেয়ে থাকতে পারবো ইনশা-আল্লাহ আমরা যেদিন ইএমই সেন্টার এন্ড স্কুলে যোগদান করেছি, তার একদিন অথবা দুইদিন পরেই রোজা শুরু হলো। সেই সময়ে রোজার মাসে আমাদের প্রশিক্ষণ বন্ধ থাকলো। আমরা মাঠে কোন প্রশিক্ষণ নেয়া ছাড়াই একমাস অতিবাহিত করলাম। রোজা শেষে ঈদের সময় ঘনিয়ে আসলো। আমরা যারা রংপুর দিনাজপুর বা এর আস পাশের ছেলে ছিলাম। আমাদেরকে ঈদ করার জন্যে ঈদের ছুটি দেয়া হলো।(চলবে...)
বিষয়: সাহিত্য
১১৯৪ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এখন সম্ভবত রেশন এর অনেক উন্নতি হয়েছে।
মাটির টেবিলের কথা বলেছেন, সেটি কি রকম?
মন্তব্য করতে লগইন করুন