স্মৃতির পাতায় গেঁথে রাখা দিনগুলি-(২য় পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ১৫ মার্চ, ২০১৫, ০৮:৪৯:৫৫ রাত
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ভর্তি:
উপরোক্ত স্বপ্নের ঘটনাটি ঘটার ২/৩ মাস পরেই সারা বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হলো। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্যে। ভর্তির বিজ্ঞপ্তিতে লিখা ছিলো, এক জিলার লোক অন্য জিলায় ভর্তি করা হবে না। আমার বাড়ী ছিলো রংপুর জিলায়। এ কারণে আমি বগুড়ায় ভর্তি হতে না পেরে, রংপুরে লোক নিয়োগের তারিখটা জেনে বগুড়া থেকে রংপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু বগুড়া থেকে রংপুরে যাবো,সে পথ খরচের কোন টাকা আমার হাতে ছিলো না। সে সময়ে বগুড়ায় আমার অনেক আপন আত্মীয়-স্বজন ছিলো। তাদের কাছে কিছু টাকা হাওলাত চাইলাম,কিন্তু পেলাম না। আমার ছোট ভাইটাও তখন আমার সাথে থেকে ক্যাণ্টনমেণ্টে দিন মজুরীর কাজ করতো। তার কাছে কিছু মজুরীর টাকা জমানো ছিলো। কোথাও টাকা না পেয়ে অবশেষে আমার ছোট ভাই’র কাছে চল্লিশ টাকা নিয়ে রংপুর গেলাম।
০৪ এপ্রিল ১৯৮১ ঈসায়ী সাল। রংপুর মাহিগঞ্জ থানা মাঠে সেনাবাহিনীতে ভর্তি ইচ্ছুক প্রার্থীরা জড়ো হয়েছে। আমরা তিন জন ছিলাম,আমার সাথের বাকী দুইজন রেজোয়ান চাচা,আর করিম চাচা। তারা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় তবুও চেষ্টা করবে ভর্তি হতে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রিক্রুটিং টিমের একজন সদস্য ম্যাগাফোনে ভর্তি প্রার্থীদেরকে লাইনে দাঁড়াতে বললেন। আমরা সকল প্রার্থী লাইনে দাঁড়ালাম। এবার রিক্রুটিং টিমের কর্মকর্তা মেজর মেজবাহ উদ্দিন সহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও সদস্যগণ লাইন থেকে মেপে মেপে লোক বাঁচাই করা শুরু করলো। আমার সাথে আসা করিম চাচার বয়স বেশী হওয়ার কারণে বাদ পড়লেন। রেজোয়ান চাচা মুক্তিযোদ্ধার কোটায় নির্বাচিত হলো। আমিও নির্বাচিত হলাম। মেডিক্যাল অফিসার আমাকে মেপে দেখলো আমি লম্বায় সামান্য কম,ঐ অবস্থায় তিনি আমাকে সাথে নিয়ে রিক্রুটিং অফিসারের কাছে হাজির করে বললোঃ যে ছেলেটি লম্বায় একটু কম হচ্ছে। তখন এক অফিসার তৎকালীন সময়ে ক্যাপ্টেন আবুল কালাম আযাদ (বাড়ী গাইবান্ধা)বললেন: যে,আমরাও মেপে দেখেছি যতটুকু কম হচ্ছে,সেটুকু ট্রেনিং করলে কভার হয়ে যাবে,তাই তাকে রেখে দিন। তারপর মেডিক্যাল অফিসার আমাকে উপযুক্ত হিসেবে ঘোষনা করে লিখিত পরীক্ষার জন্যে পাঠালেন।
লিখিত পরীক্ষায় আমাদের জন্যে যে প্রশ্ন গুলো নির্বাচিত করা হয়েছিল সেগুলো আমার জন্যে ছিলো খুব’ই সহজ। ফলে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর লিখলাম। লিখিত পরীক্ষার ফলাফল যথাসময়ে ঘোষনা করা হলো। আমি লিখিত পরীক্ষায় আল্লাহর ইচ্ছায় কৃতিত্বের সাথেই উর্ত্তিণ হলাম। তারপর মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার পর নির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে নিয়োগপত্র দেয়া হলো। আমিও নিয়োগপত্র পেলাম এবং মহান আল্লাহর নিকট কৃজ্ঞতা জানালাম। আমরা সেদিন যে কয়জন ভর্তি হলাম সবারই চাকুরীতে যোগদানের তারিখ ছিলো ৩০শে জুন ১৯৮১ঈসায়ী সাল। যোগদান করতে হবে রিক্রুটিং সদর দপ্তর,৩৪ পলাশী ব্যারাক আযিমপুর,ঢাকা।
চাকুরীতে যোগদানের সময় ঘনিয়ে এলো। অপেক্ষার পালা শেষ হলো। আনুসাঙ্গিক কাগজপত্র জোগার করে নিয়ে ঢাকায় গিয়ে রিক্রুটিং সদর দপ্তরে যথাসময়ে যোগদান করলাম। পরের দিন সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রিক্রুটিং সদর দপ্তর থেকে যার যার কোর ও রেজিমেন্ট অনুযায়ী ট্রেনিং সেন্টার থেকে প্রতিনিধি এসেছেন, সকলকে নিজ নিজ প্রতিনিধির কাছে বুঝিয়ে দেয়া হলো। আমি এবং আমার ইএমই কোরের যারা সদস্য আমরা আমাদের প্রতিনিধি দলের প্রধান কর্পোর্যামল আবুল হোসেন-এর সাথে ঢাকা কমলাপুর রেল ষ্টেশনে গেলাম এবং রাতে বাহাদুরাবাদ মেইল ৭ আপ ট্রেনে ইএমই সেন্টার এন্ড স্কুল সৈয়দপুর সেনানিবাস, নীলফামারীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগদান এবং স্বরণীয় অভ্যর্থনা:
আমরা ঢাকা কমলাপুর রেল ষ্টেশন থেকে সৈয়দপুর রেল ষ্টেশনে যখন পৌঁছেছি তখন পড়ন্ত বিকালের প্রায় শেষ প্রান্ত,সন্ধ্যার কাছাকাছি। ষ্টেশনে নিজস্ব মাল ছামানাসহ নামলাম,ষ্টেশনে নেমেই দেখলাম বহু সংখ্যক আর্মির পোষাক পরিহিত লোক প্লাটফর্মে টাকি মাছের পোনার মত থুকুর বুকুর করছে। যেমনি ভাবে মাছের পোনার মা মাছটি যখন যে দিকে যায়,আর তার পিছে পিছে পোনাগুলো ঝাক বেঁধে মা মাছটিকে অনুসরণ করে। ঠিক তেমিন ভাবে একজন আর্মির পোষাক পরা সিনিয়র বয়স্ক লোকটি যখন যেদিকে যাচ্ছেন,তার পিছনে পিছনে কম্বাট পোষাক পড়া আর্মির যুবকগুলিও ঝাঁক বেধে তাকে অনুসরণ করছেন। দেখতে খুব’ই ভাল লাগছিল। গোটা প্লাট ফরমের সিভিল লোকগুলিও দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর্মিগুলির চলা ফেরার তামাশা দেখছে। আমরাও সেদিকে তাকিয়ে তাদের তামাশা দেখছি। হঠাৎ আমাদেরকে নিয়ে আসা ষ্টাফ দুইজন আমাদেরকে প্লাটফরমে ফলিন করিয়ে হিসেব নিলেন। আর তখনি ফলিনের সামনে দাঁড়িয়েই আমাদের সাথের সিনিয়র ষ্টাফ বললেন: যে, যাদের পোষাক পড়া দেখচ্ছেন তারা ই,এম,ই কোরের ৫ম ব্যাচের নবীন সৈনিক। প্রশিক্ষন শেষে তাদের বিভিন্ন ইউনিটে বদলী হয়েছে,তাই তারা যার যার ইউনিটে চলে যাচ্ছে। এতক্ষণ আমরা তাদের তামাশা দেখেছি,যখন আমরা ফলিন হয়েছি,তখন তারাও আমাদের তামাশা দেখছে আর বিভিন্ন রকম কথা বার্তা বলে টিটকারী করছে। ফলিন শেষে আমাদের সাথের ষ্টাফ দুইজন আমাদেরকে সাথে নিয়ে প্লাট ফরমের বাহিরে অপেক্ষারত সেনা পরিবহণ বাস ও তিনটন ট্রাকে উঠালো।
বাস ও ট্রাকগুলো সময়মত আমাদেরকে নিয়ে ইএমই সেন্টার ও স্কুলে প্রবেশ করে একটি কাঁচা মাঠে গিয়ে থামলো। আমাদের বাস ও ট্রাক থেকে নামার আদেশ দেয়া হলো, আমরা যার যার মাল ছামানা নিয়ে যানবাহন থেকে মাঠে নেমে পূনরায় ফলিন হলাম। আমরা যখন মাঠে নেমে ফলিন হলাম তখন দেখলাম আমাদের সামনে অনেক ষ্টাফ দাঁড়িয়ে আছেন। ফলিনের কার্যক্রম শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সমস্ত ষ্টাফ আমাদেরকে বিভিন্ন দলে ভাগা-ভাগি করে নিলেন এরপর শুরু হলো রিসিপশন। সে এক করুন কাহিনী। ষ্টাফগণ যার যার দলকে বললেনঃ যার যার সাথে যে মাল ছামানা আছে সেগুলি একা একা মাথায় উঠাতে হবে। আমরা ষ্টাফগণকে তাদের আচার ব্যবহার দেখে প্রচুর ভয় পেলাম। আমরা খুব ভয়ে ভয়ে যার যার মাল ছামানা নিজে নিজে মাথায় উঠানোর চেষ্টা করছি। যাদের কাছে হালকা ট্রাংক ও অল্প মাল ছামানা ছিলো তারা কষ্ট করে নিজেই সব কিছু মাথায় তুলে নিলো। আর যাদের কাছে ভারী ট্রাংক ও মাল ছামানা বেশী ছিলো তাদের কষ্টের আর সীমা থাকলো না। নিজে নিজে চেষ্টা করছে কিন্তু উঠাতে পারছে না, কেউ কাউকে সাহায্য করতে যাবো সেটাও ষ্টাফগণ করতে দিচ্ছেন না। অনেক কষ্টের পর যখন তাদের বড় বড় ট্রাংক ও ভারী মাল ছামানাগুলো একা একা উঠাতে পারছে না। তখন ষ্টাফগণ নিজেই সেই মাল ছামানা গুলো রিক্রুটদের মাথায় তুলে তুলে দিচ্ছেন। আমরা সকলেই রিক্রুট নামে একটি নতুন সম্প্রদায়ে পদার্পণ করলাম। সাধারণ সৈনিকের বেলায় রিক্রুট আর অফিসারগনের বেলায় জি.সি. (জেন্টেলম্যান ক্যাটেড) সৈনিক জীবনের গোড়ার এই সম্প্রদায় যেন নতুন এক জগতের অজ্ঞ মূর্খ জাতি। সিভিল সমাজে যে যতবড়ই শিক্ষিত, বুদ্ধিমান আর বড় মাস্তান থাকুক না কেন। সামরিক সমাজে তারা এক অজ্ঞ, মূর্খ ও নির্বোধ জাতি। যাক আমরা সকলেই যখন যার যার মাল ছামানা নিজের মাথায় উঠালাম তখন ষ্টাফগণ আমাদেরকে আবারও ফলিন করে মাল ছামানাসহ দৌড় প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করলেন। কেউ মাথা থেকে কোন জিনিস নিচে নামাতে পারবে না। শুরু হলো প্রতিযোগিতা। নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেই লক্ষ্য বস্তুকে দৌড়ে গিয়ে যে আগে স্পর্শ করে নিজ স্থানে ফেরত আসতে পারবে, তার ছুটি, সে মাথার বোঝা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।
আমরা মাথায় মাল ছামানাসহ সকলেই সেই ভারী বোঝা বহন দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করলাম। ষ্টাফগণ আমাদের নতূন নতূন লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে দিচ্ছেন, আর আমরা মাথায় ট্রাংক ছুটকেস বিছানা বেডিং হাত ব্যাগ ইত্যাদি বহন করে দৌড়াচ্ছি। ট্রাংক ছুটকেসের ভিতরে ঘটি-বাটি, প্লেট-মগ, গ্লাস-জগ যার যা ছিলো, দৌড় প্রতিযোগিতার সময় সেগুলি এমন এক যন্ত্রসঙ্গীতের সূচনা করলো, সে কথা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। সেটা বুঝতে হলে বাস্তবে অংশ গ্রহণ না করে বুঝাই যেত না। এক এক জনের ট্রাংক সুটকেসের সুর এক এক প্রকারের। সেই মিষ্টি মধুর সুরের তালে তালে আমাদের ভারী বোঝা বহন দৌড় প্রতিযোগিতা চলছে। আর ষ্টাফগণ সারা মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে আমাদের ট্রাংক ছুটকেস থেকে বের হওয়া যন্ত্র সঙ্গীতের সুর-লহড়ী মনের সুখে উপভোগ করে করে খুব মজা নিচ্ছেন। যে ছেলেটি দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করছেন,তাদেরকে বাঁচাই করে করে আলাদা করছেন।
এভাবে সন্ধ্যা থেকে রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত রিসিপশন চললো। এক একজন আর ঠিকমত মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। সকলের পরনের পোশাক পরিচ্ছদ শরীরের ঘামের পানিতে ভিজে চুপষে গেছে। সকলেই আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। সকলেরই যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন ষ্টাফগণের পাষান অন্তঃকরণ গুলোতে একটু একটু দয়ার উদ্রেক হলো। আমাদের পাঁ চলছেনা হাত চলছেনা সমস্ত শরীরই প্রায় নিস্তেজ, ঐ অবস্থায় ষ্টাফগণ মাল-ছামানাসহ আমাদেরকে আবাসিক এলাকায় নিয়ে গেলেন। যেখানে নিয়ে গেলেন, সেখানে দেখতে পেলাম ছোট ছোট পুরাতন পরিত্যাক্ত কামরা। এক এক কামরায় পাঁচ জনের বেশী বসবাস করা সম্ভব নয়। ষ্টাফগণ সকলকে পাঁচজন করে জুটি বেঁধে এক এক কামরায় ঢুকিয়ে দিলেন। আমরা সেই জুটি বেঁধে বেঁধে কামরায় যার যার মাল ছামানা রাখলাম। সেই সন্ধ্যা থেকে রাত প্রায় সাড়ে দশটা এগারোটা এর মধ্যে এই প্রথমবার একটু সামান্য সুযোগ পেলাম একে অপরের সাথে কথা বলার ও পরিচিত হওয়ার। আমি যে কামরায় বসবাসের জন্য জায়গা পেলাম সেই কামরার বাকী চারজন হলেন মুহাম্মাদ গোলাম সারোয়ার (নোয়াখালী),মোহাম্মাদ ফুলমিয়া (কুমিল্লা),মুহাম্মাদ আবু বকর সিদ্দিক (ফরিদপুর) এবং মুহাম্মাদ মতিয়ার রহমান (দিনাজপুর)।
আমরা সকলেই যার যার কামরায় বিছানা লাগিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পর আদেশ হলো খানা ক্ষেতে যেতে হবে। তাই যার যার প্লেট বাটি ও মগ গ্লাস সাথে নিয়ে ফলিন হলাম। প্লাটুন ষ্টাফদেরকে ইতিমধ্যেই দায়িত্ব বন্টন করে দেয়া হয়েছে। আমরা দুই নম্বর প্লাটুনের রিক্রুট। আমাদের প্লাটুন সার্জেন্ট মুহাম্মাদ ফজলুল করিম (ঢাকা) এবং তার সহকারী ছিলেন করর্পোর্যািল মুহাম্মাদ গোফরান (বরিশাল) এবং ল্যান্স কর্পোর্যারল এস.এম. মোস্তফা (কুমিল্লা)। সময়মত আমাদের প্লাটুন ষ্টাফগণ আমাদেরকে খানা খাওয়ানোর জন্যে মেসে নিয়ে গেলেন। আমরা যার যার প্লেট বর্তন নিয়ে খানা খাওয়ার জন্যে লাইনে দাঁড়ালাম। এতোগুলো সমরযসি ছেলে এক সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি দেখতে খুব’ই ভালো লাগছে। এর আগে এতোগুলো সময়বয়সী ছেলে পাকিস্তান আমলে স্কুলে ২য়/৩য় শ্রেণীতে পড়ার সময় দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। (চলবে...)
বিষয়: সাহিত্য
১৮৭৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন