স্মৃতির পাতায় গেঁথে রাখা দিনগুলি (পর্ব-১)
লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ১৪ মার্চ, ২০১৫, ০৭:৩৬:১৯ সন্ধ্যা
ভূমিকা:
আমি ছিলাম সমাজের এক হত দরিদ্র পরিবারের অজ্ঞ র্মূখ সন্তান। পারিবারিক দরিদ্রতা, সামাজিক, পারিপার্শ্বিকতা, সর্বোপরি বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার বেড়াজালে পরে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে আল-কুরআন ও ইসলাম সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞানার্জন করা সম্ভব হয়নি। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ুয়া একজন ছাত্র উল্লেখিত বিষয় সম্পর্কে যতটুকু পর্যন্ত ধারণা রাখেন, আমারও তাই ছিলো। খুব ছোট কালে বাবা আমাকে গ্রামের মক্তবে ভর্তি করে দেন কুরআন শিখার জন্যে এবং অন্য দিকে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ভর্তি করে দেন। সকালে মক্তবের পড়া শেষ করে স্কুলের সময় চলে যেতাম স্কুলে। এক সময় আমার কায়দা পড়া অবস্থায় গ্রামের মক্তবটি বন্ধ হয়ে গেল। কারণ কিছুদিন পরই শুরু হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। তারপর দেশের পট পরিবর্তন গ্রামের মক্তব বন্ধ। সেই থেকে আর আরবী পড়া হয়নি এবং কুরআন শিখাও হয়নি। তবে পবিত্র কুরআনের প্রতি আমার অন্তঃকরণে মমত্ববোধ ও সুগভীর একটা টান সকল সময়ই অনুভব হতো। একটু বয়স হলো প্রাইমারী থেকে নিম্ন মাধ্যমিকে উঠলাম। বয়স হয়েছে নামাজ পড়তে হবে, স্কুলে মওলানা এহসান স্যাঁরের তাগিদ খুবই দৃঢ় হলো। যেমনিভাবে প্রাইমারীতে সোনা মৌলভী স্যাঁরের তাগিদ ছিলো। নামাজে অনুপস্থিত থাকলে টিফিনের পরে সোনা মৌলভী স্যাঁরের ক্লাশের সময় তাঁর করা শাসন, টেবিলের নিচে মাথা, আর পিঠের উপর মুষ্টি আর ঘুষি। কারণ নামাজের সুরা মুখস্ত নাই। স্কুলের এমন কোন ছাত্র ছিলো না যে, অপরাধ করে সোনা মৌলভী স্যাঁরের হাত থেকে বেঁচে যেত। বাবা আমাকে কিছু সুরা মুখস্থ শিখালেন। তারপর বাংলা উচ্চারণসহ নামাজ শিক্ষা বই বাজার থেকে কিনে দিলেন। আমি সেই বই থেকে বাংলায় অল্প ক’একটি সুরা মুখস্থ করে নামাযটা কোন রকমে পড়তে শিখেছি। দারিদ্রতার করাল গ্রাসে পড়ালিখা বন্ধ হয়ে গেল। মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়া-লেখার যবনিকা টেনে কিশোর বয়সেই নেমে পড়লাম পেট বাঁচানোর কঠিন সংগ্রামে।
সারাদিন পরের বাড়ীতে মজুরী দিতে গিয়ে শরীর অনেক ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। রাত্রে বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই এমন ঘুম আসতো, যা সহজে ভাঙ্গতো না। এমনিভাবে দিন চলতে থাকলো। একদিন গভীর রাত্রে গালের উপর কুসুম গরম পানির ফোঁটা পড়ার অনুভূতিতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে জেগে দেখতে পেলাম, বাবা আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করে বলছেন :
“হে আল্লাহ! আমার বাচ্চাগুলোকে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছি। আমার যা জায়গা জমি ছিলো সব তো বিক্রি করে খেয়েছি, এখন তারা যে দুনিয়ায় বেঁচে থাকবে তাদের খাওয়া পরার মত কোন ধন-সম্পদ রাখতে পারলাম না। তাদেরকে অভাবের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছি, তুমি তাদেরকে কিনারায় চাপিয়ে নাও! তাদের জন্যে হালাল পথে রুজী রোজগারের পথ করে দাও! তাদের বাঁচার মত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দাও!”
আমি অনেক বড় হওয়ার পড়েও বাবা আমাকে তার সাথে বিছানায় নিয়েই ঘুমাতেন, তাই দেখেছি গভীর রাতে বাবা প্রতিরাতেই তাহাজ্জুদ পড়ে অনেক অনুনয় বিনয়সহকারে আল্লাহর কাছে আমাদের দুই ভাইয়ের রুজী-রোজগারের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য কান্নাকাটি করতেন।
একদিনের এক নিদর্শনপূর্ণ স্বপ্ন:
অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে একদিন আমার পরিশ্রমের নৌকা খানা বগুড়ার মাঝিড়া ক্যাণ্টনমেণ্টের উল্লাস সিনেমা হলের গেইটে এসে থামলো। সেই সিনেমা হলে দুই/আড়াই শত টাকা মাসিক বেতনে গেইট কিপারের চাকুরী নিলাম। সিনেমা হলে চাকুরী করছি আর আল্লাহর কাছে একটা হালাল পথের কর্মসংস্থানের জন্যে অনেক কাকুতি মিনতি করছি। আমি নামাজ শিক্ষা বই থেকে বাংলায় যে দুই / চারটি সুরা মুখস্ত শিখতে পেরেছি সেগুলি দিয়েই নামাজ কালাম পড়তাম। কখনও কখনও নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্তই পড়েছি। আবার কখনও কখনও অনিয়মিত হতো। এমনি সময়ে এক রাতে স্বপ্নের মধ্যেই বেশ কিছু সুরার আয়াত মুখস্থ করে ফেললাম। পরের দিন থেকে ঐ আয়াতগুলি নামাজের মধ্যেও পাঠ করা শুরু করলাম।
স্বপ্নের ভিতর সুরা মুখস্থ হওয়ার ঘটনাটি ঘটার অল্প কিছুদিন পরেই একদিন এক গভীর রাতে স্বপ্নে দেখছি, পাঁ থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা পোষাক পরিহিত সুন্দর সুশ্রী চেহারার এক বুজুর্গ ব্যক্তির সাথে আমার দেখা হলো। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সাথে অবস্থান করলাম এবং বিভিন্ন কথাবার্তা বললাম, তিনিও বললেন। তাঁর সাথে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ আমার অন্তঃকরণ পরিতৃপ্ত ও প্রশান্তিতে ভরে গিয়েছিলো। তাঁর সাহচার্য্য আমার খুব’ই আনন্দদায়ক অনুভব মনে হচ্ছিল। তিনি যখন আমার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হলেন, তখন তিনি তাঁর দুই হাত বাড়িয়ে আমার মাথা ধরে তাঁর পবিত্র মুখের দিকে টেনে নিলেন। তারপর তাঁর পবিত্র ঠোঁট দু’টি আমার কপালের ঠিক মধ্যখানে লাগিয়ে চুমু দিলেন। চুমু দেয়া শেষ করে তিনি আমার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। চলে যাওয়ার সময় আমাকে তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য বললেনঃ এ ধরণের কিছু একটা ইঙ্গিত করে গেলেন। তাঁর চলে যাওয়ার সাথে সাথেই ফজরের আযান শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিন্তু আমার সমস্ত শরীর ও অন্তঃকরণে স্বপ্নের সেই ছাপগুলো রয়েই গেলো। হৃদয়পটে এক গভীর প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে। জাগ্রত হওয়ার পরে আমার অন্তঃকরণে তাঁর পরিচয়ের উপলব্ধি অনুভূত হলো। কিছু সময় পূর্বে দেখা সপ্নের কথাগুলি নিয়ে চিন্তা করলাম। তারপর পাক পবিত্র হয়ে মসজিদে গেলাম ফজরের জামায়াতে শরীক হতে। নামাজে আজ অন্যান্য দিনের মত লাগছে না। সবকিছুই আজ খুব’ই ভাল লাগছে। নামাজে অন্যান্য দিনের চেয়ে অত্যন্ত প্রফুল¬তা ও অত্যাধিক প্রসন্নতা অনুভূত হচ্ছে। আজ যেন নামাজে দয়াময় আল্লাহর ইবাদতে প্রশান্তিময় এক পরিতৃপ্তি অন্যদিনের চেয়ে আজ বেশী ভাল লাগছে। এভাবেই ফজরের নামাজ শেষ হলো, মুসল্লিগণ মসজিদ থেকে বের হয়ে যার যার বাড়ীতে যাচ্ছে। কিন্তু আমার মনটা আজ মসজিদ থেকে বের হতে চাচ্ছে না। সকলেই একে একে মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি একাই মসজিদে বসে বসে বিভিন্ন তাজ্বীহ তাহ্লীল পড়ছি। এমনি সময়ে রাতের দেখা স্বপ্নগুলোর কথা আবার মনে পড়তে লাগলো। রাত্রে যা যা দেখেছি সব কিছুই মনে হতে লাগলো। আর ঠিক ঐ সময়ে আমার অন্তঃকরণে হজ্বে যাওয়ার নিয়তের কথা জাগ্রত হলো। আমার তখন মনে হচ্ছিল কেউ একজন হয়তো আমার অন্তঃকরণে সেই পবিত্র হজ্ব করার ইচ্ছাটা হঠাৎ জাগিয়ে তুললো।
একদিকে হজ্বের কথা চিন্তা করছি, অপর দিকে আমার পারিবারিক দুরবস্থার কথাও চিন্তা করছি। ভাবছি নিজের পেটেই ঠিক মত চলছেনা, আবার হজ্ব করার ইচ্ছা, এটা কিভাবে সম্ভব? আমার অন্তঃকরণে কেমন কেমন যেন লাগছে। এসব কথা চিন্তা করতেই আবারও হজ্বের নিয়ত করার ইচ্ছা অন্তঃকরণে প্রবল হলো। এবার রাত্রের স্বপ্নের সাথে হজ্বের নিয়তের কথাটা মিলে গেল। তাই আর দেরী করলাম না, আল্লাহর দরবারে দুইহাত তুলে দোয়া করে বললাম: “হে আমার প্রতিপালক! আপনার পক্ষ থেকে আমার অন্তঃকরণে হজ্ব করার যে ইচ্ছা বা নিয়ত জাগ্রত করে দিয়েছেন, সেই অনুভূতি নিয়েই আমি হজ্বের নিয়ত করছি, আপনি আমার নিয়তকে বাস্তবায়নের তাওফীক দান করুন!” এইভাবে কথাগুলো বলার সাথে সাথেই মনে হচ্ছিলো দয়াময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমার সবগুলো প্রার্থনাই কবুল করছেন। আমার অন্তঃকরণের সাথে আসমানের দিকে একটি আলোকিত পথের যোগ সূত্র তৈরী হয়ে গেল। সেই আলোতে আমার অন্তঃকরণটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। শরীর মন সবকিছুই পাতলা মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো অন্তঃকরনের ভিতরটা পরিস্কার হয়ে গেল। (চলবে...)
বিষয়: সাহিত্য
১৪৮৬ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ
চমৎকার একটি সিরিজ শুরু করেছেন। আশা করছি সবগুলোই পড়ব......ইনশাআল্লাহ!
প্রথম পর্বটি বেশ ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ।
জাযাকাল্লাহু খাইর! বই এর জন্য শুভকামনা রইলো!
মন্তব্য করতে লগইন করুন