রোযা (সাওম) আত্মপরিশুদ্ধির এক উত্তম মাধ্যম-(৫ম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ০৯ জুলাই, ২০১৩, ১১:২৬:৩৮ সকাল
নারী সম্ভগ বা যৌন চাহিদাঃ
যৌন প্রবৃত্তি বা যৌন চাহিদা মানুষের এক মৌলিক প্রবৃত্তি। তাই মানুষের এই কাম প্রবৃত্তিকে মিটানোর জন্য আবহমান কাল থেকে সমাজে বেহায়াপনা অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা ইত্যাদির সয়লাব ঘটিয়ে সমাজে মানুষগুলো উলঙ্গপনা তথা পশুবৃত্তির বিস্তৃতি সাধন করছে। এতে মানব সভ্যতা ও শালীনতা যুগে যুগে মহাবিপর্যয়ের সন্মুখীন হয়েছে। দয়াময় প্রতিপালক এক্ষেত্রেও মানুষকে তার সীমা নির্ধারন করে দিয়েছেন। বৈধভাবে যৌন চাহিদা নিবারনের জন্য একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে বিবাহ বন্ধনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাই সুমহান আল্লাহ প্রত্যেকটি নর-নারীকে অবাধ তথা প্রকাশ্য অবৈধ যৌন মিলনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারী করে বলছেনঃ “তোমরা অবৈধ যৌন সংযোগের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরন।” (সূরা বনিইসরাঈলঃ ৩২)
নারী-পুরুষের মিলনের মাধ্যমে মানবজাতির বংশ বিস্তার লাভ করে। এরই মাধ্যমে পরিবার গঠন ও সমাজ সভ্যতা গঠিত হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে আল্লাহর বেঁধে দেয়া সীমা কোনক্রমেই লংঘন করা চলবে না। সে ব্যাপারেই মহান প্রতিপালক বলছেনঃ “যারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে, নিজেদের পত্নি অথবা অধিকারভূক্ত দাসীগণ ব্যতীত (বর্তমানে দাসী প্রথা বিলুপ্ত), এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। সুতরাং কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমা লংঘনকারী।” (সূরা মু’মিনুনঃ ৫-৭)
মানুষ বিভিন্ন মোহ, কামবৃত্তি ও অতি লোভের কারনে শয়তানের বশবর্তী হয়ে আল্লাহর দেয়া বিধানের সীমাতিক্রম করে যখনি অবৈধ যৌন সংযোগে লিপ্ত হয় তখনি সমাজে নেমে আসে বিভিন্ন রকম মারাত্মক বিপর্যয়। যার প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে গিয়েও পৌঁছায়। যখন এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন আল্লাহ তা’য়ালা এর শাস্তি স্বরূপ বিভিন্ন রোগ ব্যাধি নাযিল করে মানুষকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। আর আজকের দুনিয়ায় ছড়িয়ে পরা মরন ব্যাধি ‘এইডস’, ‘সীপলিস’ ও ‘গণোরিয়া’ ইত্যাদি বিভিন্ন যৌন রোগসমূহ হচ্ছে তার বাস্তব প্রমাণ।
মানবজাতি এহেন অবৈধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে না পরে এসব ব্যাপারে আল্লাহর বেঁধে দেয়া সীমার মধ্যে যেন থাকতেই অভ্যস্ত হয় এবং সীমা লংঘন করে সমাজে সভ্যতা বিবর্জিত কার্যকলাপ ঘটিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে, তারই মহাপ্রশিক্ষনের ব্যাবস্থা হিসেবে পবিত্র রমযানের রোযা প্রত্যেক বালেগ নর-নারীর উপর ফরয করা হয়েছে। সমাজ সভ্যতা বিধ্বংসী কর্মকান্ড থেকে মানুষকে বিরত রাখার প্রশিক্ষন দানের জন্য মহান আল্লাহ তা’য়ালা মাহে রমযানের দিবাভাগে বৈধ-অবৈধ (হালাল-হারাম) সকল প্রকার যৌন কামনা-বাসনা হতে দূরে থেকে আত্মসংযমশীল হওয়ার নির্দেশ জারি করেছেন। এ পবিত্র প্রশিক্ষনে বিবাহিতা স্বামী-স্ত্রীদেরকে যেমনিভাবে দিবাভাগে বৈধ যৌন মিলন থেকে নিষিদ্ধ করে আত্মসংযমশীল হতে বলা হয়েছে। তেমনিভাবে তাদের যৌন চাহিদা নিবারণের জন্য রাত্রীতে তাদেরকে মিলিত হতে বলা হয়েছে এবং মিলনের সময়ও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর বাণীঃ
“রোযার রজনীতে আপন স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের জন্যে আবরণ এবং তোমরাও তাদের জন্যে আবরণ। তোমরা আত্মপ্রতারণা করছিলে, আল্লাহ তা পরিজ্ঞাত আছেন, এ জন্য তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন এবং এক্ষণে তোমরা (রোযার রাতেও) তাদের সাথে সহবাস কর এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা অনুসন্ধান কর। এবং সকালে কালো সুতা হতে সাদা সুতা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত তোমরা খাও ও পান কর; অতঃপর রাত্রী সমাগম হওয়া পর্যন্ত তোমরা রোযা পূর্ণ কর। তোমরা মসজিদে ইতেকাফ করবার সময় তাদের (স্ত্রীদের) সাথে মিলন করো না। এটাই আল্লাহর সীমা, অতএব তোমরা (ইতেকাফের সময়) তাদের নিকটেও যাবে না। এভাবে আল্লাহ মানবমন্ডলীর জন্য তাঁর নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করেন, যেন তারা আল্লাহ ভীরু হয়।” (সূরা বাকারাঃ ১৮৭)
আরাম আয়েশে থাকার উচ্চাভিলাসঃ
মানবজাতির মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই এ দুনিয়াতে আরাম আয়েশে থাকার জন্য বা বিলাসী জীবন যাপন করার জন্য সর্বদাই তৎপর। এ কারনে মানুষ এ ক্ষনস্থায়ী দুনিয়াতে সামান্য ক’দিনের জীবন-যাপনের জন্য গড়ে তুলছে সুউচ্চ অট্টালিকা, বিলাস বহুল রাজ প্রাসাদ, নামি-দামী নতুন মডেলের বিলাস বহুল শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। এ সকল করার উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে দুনিয়াতে ভোগ-বিলাসে থাকা যায়। আর অন্তঃকরনের এই সকল খায়েশকে মিটানোর জন্য বিলাসী উপকরণগুলোর অর্থ যোগান দিতে বৈধ-অবৈধ পথের বাচ-বিচার না করেই মানুষ এ সকল অর্থ উপার্জনের পিছনে মরিয়া হয়ে ছুটছে। এ ক্ষেত্রেও আল্লাহর বেঁধে দেয়া সীমা লংঘন করে অন্যের প্রাপ্য অধিকার হরণ করে প্রতিনিয়তই অবৈধ উপার্জন দ্বারা মানুষ ভোগ-বিলাসে মত্ত রয়েছে। অথচ এ সকল বস্তু সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলছেনঃ
“মানব মন্ডলীকে রমনীগণের সন্তান-সন্তুতির, পূঞ্জিকৃত স্বর্ণ ও রৌপ ভান্ডারের, সুশিক্ষিত অশ্বের (বর্তমান যামানার নামী-দামী শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত নিত্য-নতুন মডেলের গাড়ী) ও পালিত পশুর এবং শস্য ক্ষেত্রের প্রেমাকর্ষণী দ্বারা সুশোভিত করা হয়েছে। এটা পার্থিব জীবনের সম্পদ এবং আল্লাহর নিকটেই শ্রেষ্ঠতম অবস্থান।” (সূরা ইমরানঃ ১৪)
মহান আল্লাহ আরো বলছেনঃ “তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি তো তোমাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। আল্লাহর নিকটই রয়েছে মহা পুরস্কার।” (সূরা তাগাবুনঃ ১৫)
মহান আল্লাহ আরো বলছেনঃ “তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি এমন কিছু নয়, যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে দিবে; যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তারাই তাদের কর্মের জন্যে পাবে বহুগুন পুরস্কার। আর তারা প্রাসাদসমূহে নিরাপদে থাকবে।” (সূরা সাবাঃ ৩৭)
মানুষ এ দুনিয়াতে আল্লাহর সীমা লংঘন করে নিজেদের ভোগ-বিলাসের কামনা-বাসনা পূরন তথা বিভিন্ন বিলাসী উপকরণসমূহের চাহিদা মিটাতে গিয়ে নিরীহ ও অসহায় হত দরিদ্র মানুষের পেটের আহার, মাথা গোঁজার মত আশ্রয়স্থলের চালের টিন, শীত নিবারনের কম্বল এবং লজ্জা নিবারনের জন্য পড়নের এক চিলতে কাপড়ের লোভও সামলাতে পারছে না। আর এ সকল লোভের কারণে মানব সমাজে হানা-হানী, খুনো-খুনি, দলা-দলী, বিভিন্ন দল-উপদলের উপর নির্যাতন-নিষ্পেষন এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি লেগেই রয়েছে।
মানবজাতি যাতে আল্লাহর সীমাতিক্রম না করে এবং তাদের বিলাসী জীবনের খায়েশ থেকে আত্মসংযম করে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকেই বৈধ পথে আয় রোজগারের মাধ্যমে সাধারণ ও পবিত্র জীবন-যাপন করে এবং একজন হত দরিদ্র মানুষ কিভাবে ক্ষুদার জ্বালা সহ্য করে দিনানিপাত করে সেটা অনুভব করে একজন মানুষ যাতে মানব সমাজের ভক্ষক না হয়ে রক্ষক হতে পারে, তারই প্রশিক্ষন দানের জন্যে মহান আল্লাহ তা’য়ালা প্রতি ১১ মাস অন্তর মানবজাতির নিকট রমযান মাসকে উপস্থিত করেন। মানুষের যাবতীয় কুপ্রবৃত্তিগুলোকে দমন করতে বা অন্তঃকরণের যাবতীয় লোভ-লালসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মানব জীবনে রোযার গুরত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। (চলবে...)
বিষয়: সাহিত্য
২২৫০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন