রোযা (সাওম) আত্মপরিশুদ্ধির এক উত্তম মাধ্যম-(৩য় পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ০৫ জুলাই, ২০১৩, ১০:৫২:৪১ রাত

রোযার ফজিলতঃ

যেহেতু মানুষকে শয়তানের যাবতীয় কু-প্ররোচনা ও কু-মন্ত্রনা থেকে সহজেই মুক্ত থাকা সম্ভব নয়; তাই মানুষকে সেই মহাশত্রু শয়তানের আক্রমন থেকে আত্মরক্ষার জন্য মহান আল্লাহ তা’য়ালা রোযা’কে ঢাল হিসেবে নাযিল করেছেন। এ ব্যাপারে পবিত্র হাদীসে বর্ণিতঃ

“আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেছেন নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আইলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রোযা (মু’মিনের আত্মরক্ষার জন্য) ঢাল স্বরুপ।” (বুখারী)

অন্য একটি হাদীসের বর্ণনাঃ “হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে লোক একদিন আল্লাহর পথে রোযা রাখবে আল্লাহ তার মুখমন্ডলকে জাহান্নাম থেকে সত্তুর বছর দূরে সরিয়ে রাখবেন।” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ এবং মুসনাদে আহমদ)

“আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত; তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করলেন যে লোক রমযান মাসে ঈমান ও চেতনাসহকারে (ছওয়াবের নিয়তে) রোযা রাখবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হবে।” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ এবং মুসনাদে আহমদ)

“আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ (কিয়ামতের দিন) রোযা (রোযাদারের পক্ষে আল্লাহর নিকট সুপারিশ করে) বলবে ‘হে আমার রব! আমি এ ব্যক্তিকে দিনে খাবারসহ অন্যান্য কামনা-বাসনা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি। আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আর কুর’আন বলবে; আমি এ ব্যক্তিকে রাতের নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।” (বায়হাকী ও মিশকাত)

সুমহান আল্লাহর নিকট রোযা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যার ফলে তিনি নিজ হাতেই তার প্রতিদান দেয়ার ওয়াদা করেছেন। আর এ ব্যাপারে পবিত্র হাদীসের বর্ণনাঃ

“হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের ছওয়াব দশগুণ হতে সাতাশগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেনঃ রোযা এই সাধারন নিয়মের ব্যতিক্রম। কেননা উহা একান্তভাবে আমারই জন্য। অতএব আমিই উহার প্রতিদান দিবো। রোযা পালনে আমার বান্দাহ আমারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে স্বীয় কামনা-বাসনা ও নিজের পানাহার পরিত্যাগ করে থাকে। রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ, একটি ইফতারের সময় এবং অন্যটি তার প্রভূর সাথে সাক্ষাত লাভের সময়। নিশ্চয়ই জেনে রেখো রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট সুগন্ধি হতেও উত্তম।” (বুখারী ও মুসলিম)

অন্য একটি হাদীসের বর্ণনাঃ “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত; রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পবিত্র রমযান উপলক্ষ্যে (মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে) আমার উম্মতকে পাঁচটি জিনিস দান করা হয়েছে যা পূর্ববর্তী উম্মতকে দেয়া হয়নি। তা হচ্ছেঃ-

১। রোযাদারের মুখের ঘ্রাণ আমার নিকট মৃগনাভী (কস্তুরী) হতেও বেশী পছন্দনীয়।

২। সমুদ্রের মৎসগুলিও রোযদারের জন্য ইফতার পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে।

৩। রোযাদারের জন্য জান্নাতকে প্রতিদিন সজ্জিত করা হয় এবং আল্লাহ বলেনঃ বান্দাগণ দুনিয়ার ক্লেশ যাতনা দূরে নিক্ষেপ করে অতি শীঘ্রই তোমার কাছে আসছে।

৪। রমযানে দূবৃত্ত শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, যার দরুন সে ঐসব পাপ করাতে পারে না, যা অন্য মাসে করানো সম্ভব হয়।

৫। রমযানের শেষ রাতে রোযাদারের গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হয়। সাহাবাগণ আরোজ করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এ ক্ষমা কি শবে ক্কদরে হয়ে থাকে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ না! বরং নিয়ম হলো মজুর কাজ শেষ করবার পরই মজুরী পেয়ে থাকে।”
(বায়হাকী ও মসনাদে আহমদ)

অন্য একটি হাদীসের বর্ণনাঃ “সাহল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি দরজা আছে। কিয়ামতের দিন এটি দিয়ে শুধুমাত্র রোযাদারগণই প্রবেশ করতে পারবে। রোযাদার ছাড়া অন্য কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (কিয়ামতের দিন রোযাদারকে ডেকে) বলা হবে, রোযাদার কোথায়? তখন তারা উঠে দাড়াবে। তা ছাড়া আর অন্য কোন লোক সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। তাদের প্রবেশের পরই তা বন্ধ করে দেয়া হবে; যাতে ঐ দরজা দিয়ে অন্য কেউ প্রবেশ করতে না পারে।” (বুখারী)

যেহতেু রোযা একটি উচ্চতম ফজিলতের ইবাদত, তাই প্রত্যেক মু’মিন নর-নারীর’ই উচিত হবে এর পুরো-পুরী মর্যাদা ও হক আদায় করে এই পবিত্র ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা। নিজেকে পূত পবিত্র করে অন্তঃকরণকে পরিশুদ্ধ করে একাগ্রতার সহিত এ পবিত্র ইবাদতটিতে সর্বাত্মক অংশগ্রহন জরুরী। অপর দিকে আমরা সকলেই সতর্ক থাকবো যাতে করে আমাদের মহাশত্রু অভিশপ্ত শয়তান ইবলীস ও তার দল-বল যেন কোন প্রকারেই আমাদের অন্তঃকরণে কু-প্ররোচনা, কু-মন্ত্রনা সৃষ্টি করে আমাদেরকে মহাকল্যাণের পথ থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। সেদিকে খুবই সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টিও রাখতে হবে।

নিঃষ্ফল রোযাঃ

একজন প্রকৃত রোযাদার ব্যক্তি রোযার মাধ্যমে অন্তঃকরনকে সমস্ত প্রকার পাপাচার-অনাচার, লোভ-লালসা, গর্ব, অহংকার-অহমিকা, লাগামহীন উচ্চাভিলাস এবং সকল প্রকার সামাজিক অবক্ষয় থেকে মুক্ত রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট অত্যাধিক মর্যাদা লাভ করতে পারেন। আবার অপর দিকে আর একজন ব্যক্তি যদি রোযাকে অবহেলা, অবগ্যা, অযত্ন, অমনোযোগিতা এবং লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে রোযা পালন করে থাকেন, তাহলে সে রোযা তার কোন উপকারে আসবে না। বরং সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট কঠিন গুনাহগার হিসেবেও পরিগনিত হতে পারে। এ ব্যাপারে পবিত্র হাদীসের বর্ণনাঃ

“হযরত আবু হুরাযরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেছেন: নিশ্চয়ই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রোযা ঢাল স্বরূপ, সুতরাং রোযাদার অশ্লীল কথা বলবে না, জাহিলী আচরন করবে না। আর কোন ব্যক্তি যদি রোযাদারের সাথে মারামারী করতে চায় বা গালমন্দ করে, তাহলে সে যেন দু’বার বলে আমি রোযাদার। ঐ সত্যের কসম যার হাতে আমার প্রাণ অবশ্যই রোযাদারের মূখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মেসক আম্বরের চেয়েও উৎকৃষ্ট। সে খানা-পিনা এবং কামভাবকে আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে পরিত্যাগ করে থাকে। রোযা আমার জন্য এবং আমি নিজে তার প্রতিদান দিবো। আর নেক কাজের পুরস্কার দশগুন পর্যন্ত দেয়া হয়ে থাকে।”(বুখারী)

অন্য একটি হাদীসের বর্ণনাঃ“আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং তদানুযায়ী আমল করা পরিত্যাগ করতে পারলো না, তার খানা-পিনা পরিত্যাগ করা আল্লাহর নিকট কোন প্রয়োজন নেই।” (বুখারী)

অন্য একটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “এমন বহু রোযাদার রয়েছে যাদের রোযা রেখে শুধু ক্ষুৎ পিপাসার কষ্ট ভোগ ছাড়া আর কিছুই লাভ হয় না। ঠিক এমন অনেক নামাযী আছেন যাদের রাত জাগার কষ্ট ভোগ ছাড়া আর কিছুই লাভ হয় না।” (তিরমিযি) (চলবে...)

বিষয়: বিবিধ

১৭৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File