তাকদীর বা ভাগ্যলিপির উপর ঈমান-২য় পর্ব

লিখেছেন লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাগনে ২৬ মে, ২০১৩, ০৩:৪২:৫৫ দুপুর

ইসলামী বিধানমতে যারা তকদীরকে বিশ্বাস করে না, তাদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এই ব্যাপারে হাদীসের প্রমাণঃ “আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মতের মধ্যে দু’টি সম্প্রদায় এমন আছে যাদের সাথে ইসলামের কোনই সম্পর্ক নেই, এরা হলো ‘মুরজিয়া’‘কাদরিয়া।’ (তিরমিযি)।

অন্য একটি হাদীসের বর্ণনাঃ “উবাদা ইবনে সাবিত (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি মৃত্যুকালে তার পূত্রকে বলে যায়, হে বৎস ! তুমি কখনো ঈমানের স্বাধ পাবে না, যে যাবত না বিশ্বাস করবে যে, তুমি যা কিছু পেয়েছো তা তোমার হারাবার ছিল না এবং যা কিছু তোমার হারিয়েছে তা তোমার পাওয়ার ছিল না। কেননা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, সর্বপ্রথম আল্লাহ যা সৃষ্টি করেন তা হলো কলম। তিনি তাকে নির্দেশ দিলেন, লিখ! সে বল্লো হে আমার প্রতিপালক ! আমি কি লিখব? তিনি বললেন, তাকদীর লিখ। কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত যা কিছু হবে সবকিছুর পরিমাণ লিপিবদ্ধ করো। হে বৎস ! আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, যে ‌ব্যক্তি তাকদীরের বিপরীত বিশ্বাস নিয়ে মারা যাবে সে আমার দলভূক্ত নয়।’’ (তিরমিযী ও আবু দাউদ)।

মূলকথা তাকদীরকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘কাযা’‘কদর’ বাংলা অর্থ “সমাধান”“পরিমাণ’’। আর এই কাযা ও কদরকেই সংক্ষেপে বলা হয় তাকদীর।

তাকদীর বলা হয় কোন ঘটনা ঘটার পূর্বে সম্ভাব্য ঘটনা সম্পর্কে অনুমান করে স্থীর করা। এমন বহু ঘটনা আছে যার সম্পর্কে মানুষ পূর্ব হতেই অনুমান করে কর্মপন্থা ঠিক করে, ইহাকেই বলা হয় তাকদীর। তবে মানুষের জ্ঞান ত্রুটিমুক্ত নয় বলে কখনও তার এ আন্দাজ ও অনুমানের ব্যতিক্রম ঘটে। পক্ষান্তরে আল্লাহর জ্ঞান ত্রুটিমুক্ত ও পূর্নাঙ্গ বলে তাঁর তাকদীরে কোন ব্যতিক্রম ঘটে না। তবে তিনি যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন ব্যতিক্রম ঘটান সে কথা আলাদা। মোহাক্কেক আলেমদের অনেকেই তাকদীরের ব্যাখ্যা এরূপ দিয়েছেন যে, “মহান আল্লাহ সৃষ্টির বহু পূর্বে যাবতীয় সৃষ্ট বস্তু, তার আকৃতি-প্রকৃতি, রূপ-গুন, স্থিতিকালের পরিমাণ, স্থিতিকালীন অবস্থান, পরিবর্তন পরিবর্ধন, ধ্বংস লয়, পরিনাম ইত্যাদি নিরূপন করে রেখেছেন। সৃষ্টিকর্তার এই আগাম নিরূপণ নীতিতে দৃঢ় প্রত্যয় রাখাকেই বলা তাকদীরের উপর ঈমান স্থাপন করা।”

আল্লাহ তায়ালার ইলম (জ্ঞান) অনাদি। অর্থাৎ যা ঘটেছে, যা বর্তমানে ঘটছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে, সবই আল্লাহর নিকট বর্তমান। সুতরাং আল্লাহর এই অনাদি ইলমের তিত্তিতেই ভবিষ্যতে যা ঘটবে তা তিনি বিধিবদ্ধ করে রেখেছেন। এর অর্থ এই নয় যে, তিনি বিধিবদ্ধ (মোকাদ্দার) করে রেখেছেন বলে আমরা করি, বরং আমরা করব বলেই তিনি বিধিবদ্ধ করে রেখেছেন।

সুমহান প্রতিপালক বলছেনঃ “যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তবে তোমাদেরকে এক জাতি করতে পারতেন, কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন, তোমরা যা কর সে বিষয়ে অবশ্যই তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে।’’ (সুরাঃ নহল-৯৩)।

সুমহান প্রতিপালক আরো বলছেনঃ “মানুষের জন্যে তার সামনে ও পিছনে একের পর এক (ফেরেশতা) প্রহরী থাকে, ওরা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষনাবেক্ষন করে, নিশ্চই আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষন না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে, কোন সম্প্রদায়ের সম্পর্কে যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা রদ করবার কেউ নেই এবং তিনি ছাড়া তাদের অভিভাবক নেই।’’ (সুরাঃ রা’দ-১১)।

উপরোক্ত সুরাটির বর্ণনামতে দুইটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে আছে। এক দিকে মানবমন্ডলীকে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করতে আল্লাহ তাগিদও দিয়েছেন এবং পরবর্তী বাক্যাংশে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ যদি কোন জাতিকে অশুভ কিছুতে নিপতিত করেন, তা রদ করারও কেউ নেই। তাই বুঝা যাচ্ছে যে, মানুষ যতই প্রচেষ্টা করুক আল্লাহ তা’য়ালা যদি ইচ্ছা না করেন তাহলে কোন কিছুই ফলদায়ক হবেনা। আর মানুষের সৎ প্রচেষ্টার ইচ্ছাও যুগিয়ে থাকেন মহান আল্লাহ এ ব্যাপারেই তিনি বলছেনঃ “তোমরা ইচ্ছা করবেনা, যদি জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ ইচ্ছা না করেন।’’ (তাকভীর-২৯)।

দয়াময় আল্লাহ আরো বলছেনঃ “আল্লাহই হচ্ছেন মু’মিনদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার হতে আলোকের দিকে নিয়ে যান, আর যারা অবিশ্বাস করেছে, শয়তান তাদের পৃষ্ঠপোষক, সে তাদেরকে আলোক হতে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়, তারাই দোযখের অধিবাসী ও এর মধ্যে তারা চিরকাল অবস্থান করবে।’’ (বাকারা-২৫৭)।

সুরা আরাফের ১৭২ নং আয়াতে আল্লাহ বর্ণনা করেছেনঃ “যখন তোমার প্রতিপালক বানী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করলেন এবং তাদেরকেই তাদের উপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন? আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা (সমস্ত রূহ) সমস্বরে উত্তর করলো হ্যাঁ ! আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আমার রব বা প্রতিপালক।’’

এ আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে তাফসীর মা’আরেফুল কুরআনে এসেছে, হযরত খালেক, আবু দাউদ, তিরমিযী ও ইমাম আমদ (রঃ) মুসলিম ইবনে ইয়াসারের বরাতে উদ্ধৃত করেছেন যে, কিছু লোক হযরত ফারুকে আযম (রহঃ) এর নিকট এ আয়াতটির মর্ম জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট ঠিক এ আয়াতটির মর্ম জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তাঁর কাছে যে উত্তর আমি শুনেছি তা হলো এই যে, ’আল্লাহ তা’য়ালা আদম (আঃ) কে সৃষ্টির পর নিজের হাত যখন তাঁর পিঠে বুলিয়ে দিলেন, তখন তাঁর ঔরষে যত সৎ মানুষ জন্মবার ছিল তারা সব বেরিয়ে এলো। তখন তিনি বললেনঃ এদের আমি জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেছি এবং এরা (দুনিয়াতে) জান্নাতেরই কাজ করবে। পুনরায় দ্বিতীয়বার তাঁর পিঠে কুদরতের হাত বুলালেন, তখন যত পাপী-তাপী মানুষ তাঁর ঔরষে জন্মাবার কথা ছিল, তাদের বের করলেন এবং বললেনঃ এদের আমি দোযখের জন্য সৃষ্টি করেছি এবং এরা (দুনিয়াতে) দোযখে যাবার মতই কাজ করবে।”

সাহাবীগনের মধ্যে একজন নিবেদন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) প্রথমেই যখন জান্নাতী ও জাহান্নামী সাব্যস্ত করে দেওয়া হয়েছে, তখন আর আমল করা হয় কি উদ্দেশ্যে? হুজুর (সাঃ) বললেনঃ যখন আল্লাহ তা’য়ালা কাউকে জান্নাতের জন্যে সৃষ্টি করেন, তখন সে দুনিয়াতে জান্নাতবাসীর কাজই করতে শুরু করে। এমনকি তার মৃত্যুও এমন কাজের মধ্যে হয়, যা জান্নাতবাসীর কাজ। আর আল্লাহ যখন কাউকে জাহান্নামের জন্যে তৈরী করেন, তখন সে দুনিয়াতে জাহান্নামের কাজই করতে আরম্ভ করবে। এমন কি তার মৃত্যুও এমন কাজের মাধ্যমেই হয়, যা জাহান্নামের কাজ।” (সুত্রঃ মাসিক আল মদিনা মে ০৬, পৃষ্ঠা-৩১)। (চলবে......)

বিষয়: সাহিত্য

১৬৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File