অভিজ্ঞতা জঘন্য; কেঁদেছি নিজের অক্ষমতায়। নিজের দেশ, জাতি ও জনগণের বিরুদ্ধে সীমাহীন এ অপকর্মের অনন্যোপায় সঙ্গী হয়ে!
লিখেছেন লিখেছেন কুয়েত থেকে ০৮ জানুয়ারি, ২০১৯, ০৯:৩৫:৩৭ রাত
একজন প্রিজাইডিং অফিসার এর আত্মকাহিনী
নির্বাচনের বাস্তব চিত্রঃ ২০১৮ এর কলঙ্কিত নির্বাচন ৭১ এ যুদ্ধ করে কি ভুল করেছিলাম!!
অভিজ্ঞতা জঘন্য; কেঁদেছি নিজের অক্ষমতায়। নিজের দেশ, জাতি ও জনগণের বিরুদ্ধে সীমাহীন এ অপকর্মের অনন্যোপায় সঙ্গী হয়ে!
আমি একজন প্রিজাইডিং অফিসার ছিলাম। আমার কিছুই করার ছিলনা। আমার কেন্দ্রে ভোটার ছিল ২৩৮৭ টা। ওরা রাতেই ১৫০০ ব্যালটে সীল মেরেছে। দিনে জোর করে আরো ৪০০ ব্যালট নিয়ে ও নিজেদের লোক দিয়ে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়েছে। শুধু এভাবেই ওরা ভোট নিয়ে নেয় ১৯০০; এই কেন্দ্রে ধানের শীষ পেয়েছে মাত্র ২৭ ভোট, তাতেই তাদের মাথা গরম। এই ২৭ জন কারা, এটাও তাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে!
বলছি আসল কথা; এসপি, ডিসি, নৌকার প্রার্থী এরা সকলে বসে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এভাবেই ভোট হবে। এতে কোন লুকোছাপা ছিলনা। ছিলনা কোন গোপনীয়তার ব্যাপারও। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্রশাসন ও উচ্চপর্যায়ের পুলিশ অফিসারদের প্রশ্রয়ে ও সম্মতিতে খুব নিরাপদে, উৎসাহ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট ডাকাতি করেছে, কিছুই করার ছিলনা অন্য কারো! তাদের সামনে আমরা সকলে ছিলাম নিস্তেজ ও অসহায়।
আমাকে ইউএনও, এসপি, ডিসি সবাই ফোনে কল দিয়েছে। একইভাবে অন্য কেন্দ্রে দায়িত্বরত আমাদের সহকর্মীদেরও কল দিয়ে বলে দেয়া হয়েছে, কি করা যাবে না এবং কাদের কথা শুনে কাজ করতে হবে।
বলা হয়েছিল, স্থানীয় নেতারা যেভাবে বলে ঠিক সেভাবেই সহযোগিতা করতে হবে। একই মিটিং-এ এসপি, ডিসি ও প্রার্থী বসে থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ফোনে কল দিয়ে বেশীর ভাগ ব্যালট রাতেই তাদের কর্মীদের দিয়ে দিতে বলেছিল। তা না করলে, আমাদের সমস্যা হবে বলে শাসিয়েছিল!
আমাদের এখানে সব কেন্দ্রে একই ঘটনা ঘটেছে। আমাকে জোরাজুরি করায় প্রথমে ৬০০ ব্যালট (৬ বান্ডিল) দেই। সীল শেষে আবার চাইতে আসে ব্যালট, আমি নিষেধ করায় ফোনের পর ফোন। পরে আরো ৬ বান্ডিল দেই। সেগুলো সীল মারার পর আবার আসে। এবারো দিতে চাই নাই বলে স্থানীয় আওয়ামী নেতা হুমকি দেয়। তার পর আরো ৩ বান্ডিল দেই, মোট ১৫০০ (পনের শ’)। এই সকল কর্মীদের নাকি এসপি, ডিসি বলে দিয়েছে, যে কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে, সে কেন্দ্রের দায়িত্বশীল গ্রুপ পুরস্কার পাবে। ওই নেতা রেগেমেগে চিৎকার করে বলে, আপনি আমাকে পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করতে চান?
এই সব কিছুই প্রশাসনের সহায়তায় হয়েছে। দুই দিনের অসহনীয় ও অসম্মানজনক ঘটনার ভেতর দিয়ে কষ্টকর বিপুল অভিজ্ঞতা আমাদের সকল সহকর্মীদের হয়েছে। এমন কি, আমাদের নারী কলিগদের একই ধরণের ঘটনার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে! সবাই একে অন্যের ঘটনা আমরা জানি। আজ আরো জেনেছি!
আমি মাঝখানে আওয়ামী লীগের পোলিং এজেন্টদের কয়েকজনকে সরিয়ে দিয়ে, ইয়াং ভোটারদের জোর দিয়ে বলেছি, তোমরা যাকে ইচ্ছে তাকে ভোট দাও, এদের কথা শুনবানা। তাতেও লাভ হয়েছে বলে মনে হয়নি।
আমাদের এক নারী সহকর্মীকে নৌকা প্রার্থী কেউ একজন ধমক দিয়েছিল। ঘটনাটি ডিসি’কে জানিয়ে প্রতিকার চাইলে তিনি বলেছেন, কোন হেল্প পাবেন না, বিপদ তৈরী করছেন কেন? প্রশাসন ও পুলিশের জুনিয়র কর্মকর্তারা আমাদের প্রতি সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকালেও তারাও ছিল অসহায়।
আমার সাথে থাকা পুলিশ সদস্যকে এসপি ও ওসি যে অর্ডার দিয়েছিল, তাতে সে হতবাক হয়েছিল! তার চোখের কোণে আমি দু’এক ফোঁটা জলও দেখেছি।
প্রশাসনে আমার নিকট আত্মীয় আছে। সে আমাকে আগে থেকেই সতর্ক করে বলেছে, নির্বাচন নিয়ে কোন ঝামেলা করোনা। এসপি, ডিসি, ওসি যা বলবে সে অনুযায়ী কাজ করো! সবাইকে ম্যানেজ করা হয়ে গেছে। এভাবেই হবে ভোট সারাদেশে।
আরো বহু ছোট, ছোট অভিজ্ঞতা আছে। সারাদেশে সবার হয়েছে এই অভিজ্ঞতা। *বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাটা ধ্বংস হয়ে যেতে দেখেছি, এর মৃত্যু ঘটেছে আমাদের হাতে, সকলের চোখের সামনে!
প্রশাসনে আমাদের মতো ছাপোষা মানুষদের উপরের পর্যায়ে কি ঘটেছে, শুনলে আৎকে উঠবেন। বিভিন্ন জেলায় এসপি, ডিসি সাহেব, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশের অফিসাররা একসাথে বসে, সবাই মিলে মিটিং করে প্ল্যান করেছেন। নিশ্ছিদ্র প্ল্যান করতে জেলায়, জেলায় ডিসিরা ডিনারের দাওয়াত দিয়ে ২/৩ বার মিটিং করেছে। জেলা পর্যায়ের সব অফিসারদের একই অর্ডার দেয়া হয়েছে। তারপর সব প্রিজাইডিং অফিসারদের ডাকা হয়েছে, তাদেরকে ব্যালট দিয়ে দিতে বলা হয়েছে আগের রাতেই। প্রশ্ন করেছিল কেউ, কেউ তাহলে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ভোট কি ভাবে চলবে! জবাবে বলা হলো, প্রত্যেক গ্রুপের নাস্তার জন্যে টাইম ওয়েস্ট করতে বলতে হবে। আসিস্টেন্ট প্রিজাইডিং অফিসাররা নাস্তা করবে, তাই ভোট কিছুক্ষণ স্থগিত থাকবে। তারপর পোলিং অফিসাররা নাস্তা করবে, তাই ভোট স্থগিত। আনসারররা নাস্তা করবে, তখন আবার ভোট স্থগিত। তারপরেও ভোটারের চাপ সৃষ্টি হলে নৌকার কর্মীরা নিজেদের মধ্যে মিছেমিছি মারামারি করবে, সে করণে বিজিবি ডাকা হবে, ওরা আসার পর এক/দেড় ঘন্টা ভোট স্থগিত রাখতে হবে। সবশেষে ভোট গুনে নৌকাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করে চলে আসতে হবে!
প্রিজাইডিং অফিসাররা যেন বিপদে না পরে তাই ডিসি বলে দিয়েছে, আপনি যদি আমার কথা শুনেন আমি রক্ত দিয়ে আপনাকে রক্ষা করবো, আর যদি আমার কথা না শুনেন তাহলে রক্ত নিতেও দ্বিধা করবো না।
গতকাল, জুনিয়ার অফিসারদের সাথে মিটিং করে ডিসি সাহেব সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন, তোমাদের হয়তো মন খারাপ হয়েছে আমার কাজে। বাট এটা না করলে বিএনপি ক্ষমতায় আসতো। দেশে খুনোখুনি হতো, লক্ষ লক্ষ লোক মারা যেত। দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হতো। ২০৪১ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন হোক, দেশ একটা পর্যায়ে আসুক, জনগণ কাকে ভোট দিতে হয় শিখুক, তারপর তারা ভোটাধিকার পাক। ভোটের অধিকার পাবার আগে ভোট বুঝতে হয়।
সব জেলাতেই একই অবস্থা। আমাদের এখানে সব প্রিজাইডিং অফিসারকে আলাদা, আলাদা করে ডেকে, খাম (টাকার) দিয়ে পৃথক ভাবে বলে দেয়া হয়নি। সকলকে ডেকে একসাথে বসিয়ে বলে দেয়া হয়েছে, যাতে ভুলে না যাই, সেজন্য আবার ফোন করেও বলে দেয়া হয়েছে রাতে।
এই ভোট নামের অপকর্মের বিচার কি এই বাংলাদেশে হবে কোন দিন। নাকি আল্লাহর পক্ষ থেকে গজব এসে পুরো দেশেকে এই জাতিকেই ধংস করেদে জানিনা। মহান আল্লাহ আমাদের হেহেফাজত করুন
বিষয়: বিবিধ
৮৮৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কিছু করার ছিল না চোখের সামনে দেখেছি দেশের ইজ্জত হরণ করা
এরকম পারফরম্যান্স ধরে রাখলে সামনের ১০ নির্বাচনে সাফল্য নিশ্চিত। এই নির্বাচনে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী, মিডিয়া, ব্যাংক, আদালত এরা সবাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একযোগে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন