পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাত আদায়ের পর প্রচলিত মুনাজাত করা না করার ব্যাপারে আমাদের দেশের লোকদের সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত দেখা যায়।আমরা কোন মতটি গ্রহন করবো..?

লিখেছেন লিখেছেন কুয়েত থেকে ০২ জানুয়ারি, ২০১৭, ০৯:২৩:৫৩ রাত

আমাদের দেশে বলতে গেলে ভারতীয় উপমহাদেশে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর দুয়া-মুনাজাতের প্রচলন দেখা যায়। এ বিষয়ে সেঠিক কোনটি তা আলোচনা করছি।পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাত শেষে দুয়া কবুল হওয়ার কথা বহু সহীহ হাদীস থেকেই প্রমাণিত।

তাহলে এ নিয়ে বিতর্ক কেন? আসলে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পর দুয়া নিয়ে বিতর্ক নয়, বিতর্ক হল এর পদ্ধতি নিয়ে। যে পদ্ধতিতে দুয়া করা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা তাঁর সাহাবায়ে কেরামগন এভাবে দুয়া করেছিলেন কিনা..? দুয়া-মুনাজাত নিয়ে যার মধ্যে নিম্নোক্ত সবকটি শর্ত বিদ্যমান

(১) পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের পর দুয়া করা।

(২) যে দুয়া-মুনাজাত জামাআতের সঙ্গে করা হয়।

(৩) প্রতিদিন প্রতি ফরজ সালাত শেষে দুয়া-মুনাজাত করা।

এ শর্তাবলী বিশিষ্ট দুয়া-মুনাজাত কতটুকু সুন্নাহ সম্মত কিনা সেটাই মূল আলোচ্য বিষয়।

পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাত আদায়ের পর প্রচলিত মুনাজাত করা না করার ব্যাপারে আমাদের দেশের লোকদের সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত দেখা যায়।

১। যারা ফরজ নামাজের ছালাম ফিরানোর পর বসে বসে কিছুক্ষণ যিকর-আযকার আদায় করেন, যা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

২। যারা ছালাম ফিরানোর পর যিকির-আযকার না করে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যান সুন্নাত নামায আদায়ের জন্য।

৩। যারা ছালাম ফিরানোর পর সর্বদা ইমাম সাহেবের সঙ্গে একত্রে মুনাজাত করেন। এবং মুনাজাত শেষ হওয়ার পর সুন্নাত নামায আদায় করেন।

আর এ তিন ধরনের লোকদেরই এ সকল আমলের সমর্থনে কোনো না কোনো দলীল প্রমাণ রয়েছে। হোক তা শুদ্ধ বা অশুদ্ধ - স্পষ্ট বা অস্পষ্ট।

প্রথম পক্ষের দলীল-প্রমাণ স্পষ্ট তাহল বুখারী ও মুসলিমসহ বহু হাদীসের কিতাবে সালাতের পর যিকির-আযকার অধ্যায়ে বিভিন্ন যিকিরের কথা সহীহ সনদে বর্ণিত আছে, যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবায়ে কেরাম আমল করেছেন। অনেক ইমাম ও উলামায়ে কেরাম এ যিকির-আযকার সম্পর্কে স্বতন্ত্র পুস্তক সংকলন করেছেন।

আর দ্বিতীয় দলের প্রমাণ হল এই হাদীস

عن عائشة رضى الله عنها قالت كان النبي صلى الله عليه وسلم إذا سلم لم يقعد إلا مقدار ما يقول اللهم أنت السلام ومنك السلام تباركت يا ذالجلال والإكرام.") أخرجه ابن ماجة والنسائي والترمذي وقال حديث حسن صحيح وهو كما قال، صححه الألباني في صحيح ابن ماجه رقم الحديث 761(

আয়েশা (রাঃ)থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ছালাম ফিরাতেন তখন আল্লাহুম্মা আনতাচ্ছালাম ওয়ামিনকাচ্ছালাম তাবারাকতা ইয়া জালজালালি ওয়াল ইকরাম পড়তে যতটুকু সময় লাগে তার চেয়ে বেশি সময় বসতেন না। (তিরমিজী, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ)

তারা এ হাদীস দ্বারা বুঝে নিয়েছেন যে, এ যিকিরটুকু আদায় করতে যতটুকু সময় লাগে এর চেয়ে বেশি বসা ঠিক নয়। তাই তাড়াতাড়ি সুন্নাত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে যেতে হবে। আসলে এ হাদীস দ্বারা তারা যা বুঝেছেন তা সঠিক নয়।

হাদীসটির ব্যাখ্যা হল, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু ইমাম ছিলেন তাই তিনি ছালাম ফিরানোর পর এতটুকু সময় মাত্র কেবলামুখী হয়ে বসতেন এরপর তিনি মুসল্লীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন। আর তিনি যে প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর মুসল্লীদের দিকে মুখ করে বসতেন তা বহু সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (মজমু আল ফাতাওয়া : ইমাম ইবনু তাইমিয়া)

এ হাদীস দ্বারা কখনো প্রমাণিত হয় না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছালাম ফিরিয়ে এ দুয়াটুকু পড়ে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যেতেন সুন্নাত সালাত আদায়ের জন্য। ফরজ সালাত আদায়ের পর যিকির, তাছবীহ, তাহলীল বর্জন করে তাড়াতাড়ি সুন্নাত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া মোটেও সুন্নাত নয়। বরং সুন্নাত হল সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যিকির, দুয়া, তাছবীহ, তাহলীল সাধ্যমত আদায় করে তারপর সুন্নাত আদায় করা।

তৃতীয় দল যারা ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে (জামাআতের সঙ্গে) মুনাজাত করেন তাদের দলীল হল ওই সকল হাদীস যাতে সালাত শেষে দুয়া কবুলের কথা বলা হয়েছে এবং দুয়া করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ সকল হাদীস ছাড়া তাদের এ কাজের সমর্থনে হাদীস থেকে সরাসরি কোনো প্রমাণ নেই। এমন কোনো হাদীস তারা পেশ করতে পারবেন না যাতে দেখা যাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক সালাত জামাআতের সঙ্গে আদায় শেষে সকলকে নিয়ে সর্বদা হাত তুলে মুনাজাত করেছেন।

তারা যে সকল হাদীস প্রমাণ হিসেবে পেশ করতে চান তার শিরোনাম হল

الدعاء عقيب الصلوات، الدعاء دبر الصلوات

তারা মনে করে নিয়েছেন আকীবাস সালাত ও দুবুরাস সালাত অর্থ ছালাম ফিরানোর পর। আসলে তা নয়। এর অর্থ হল সালাতের শেষ অংশে। এ সকল হাদীসে সালাতের শেষ অংশে অর্থাৎ শেষ বৈঠকে দরূদ পাঠ করার পর ছালাম ফিরানোর পূর্বে দুয়া করার কথা বলা হয়েছে। পরিভাষায় যা দুয়ায়ে মাছুরা হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। সালাত শেষে দুয়া কবুল সম্পর্কে যত হাদীস এসেছে তা সবগুলো দুয়া মাছুরা সম্পর্কে। যার সময় হল ছালাম ফিরানোর পূর্বে।

আর দুয়া মাছুরা শুধু একটা নয়, অনেক। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সালাতের শেষে দুয়া সংক্রান্ত এ সকল হাদীসে বাদাস সালাত বলা হয়নি। হাদীস গ্রন্থে এ সকল দুয়াকে

الأدعياء دبر الصلوات أو الدعاء عقيب الصلاة

(সালাত শেষের দুয়া) অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দুটো বিষয়; প্রথমটা হল সালাত শেষের দুয়া। দ্বিতীয়টা হল সালাত শেষের যিকির। প্রথমটির স্থান হল ছালাম ফিরানোর পূর্বে। আর দ্বিতীয়টির স্থান হল ছালাম ফিরানোর পর। ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) ইবনুল কায়্যিম (রহঃ)প্রমুখ উলামায়ে কেরামের মত এটা-ই।

এ মতটা কুরআন ও হাদীসের আলোকে বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। বান্দা যখন সালাতে থাকে তখন সে আল্লাহর নিকটে অবস্থান করে। দুয়া মুনাজাতের সময় তখনই। যখন সালাতের সমাপ্তি ঘোষিত হল তখন নয়। তখন সময় হল আল্লাহর যিকিরের, যেমন আল্লাহ বলেন

فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلَاةَ فَاذْكُرُوا اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِكُمْ.

যখন তোমরা সালাত শেষ করলে তখন দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে (সুরা আন নিসা : ১০২ )

এ সম্পর্কিত হাদীসগুলোর ভাষা এবং সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমলসমূহ গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টিই বুঝে আসে ছালাম ফিরানোর পরের সময়টা দুয়া করার সময় নয়, যিকির করার সময়।

তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরজ সালাতের পর কখনো কি দুয়া করেননি? হ্যা করেছেন। তবে তা সম্মিলিতভাবে নয়।

যেমন হাদীসে এসেছে :

عن البراء بن عازب قال : كنا إذا صلينا خلف رسول الله صلى الله عليه وسلم أحيانا نكون عن يمينه يقبل علينا بوجهه فسمعته يقول : رب قني عذابك بوم تبعث عبادك" (رواه البخاري)

আল-বারা ইবনু আযেব বলেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে সালাত আদায় করতাম, তিনি আমাদের দিকে মুখ করতেন, কখনো কখনো শুনতাম তিনি বলতেন, হে আল্লাহ ! আপনার শাস্তি থেকে আমাকে বাঁচান যেদিন আপনি আপনার বান্দাদের উঠাবেন। (বুখারী)

জামাআতের সঙ্গে তিনি মুসল্লীদের নিয়ে দুআ করেছেন, এমন কোনো বর্ণনা নেই। যা আছে তা তার বিপরীত। যেমন বর্ণিত হাদীসটির প্রতি লক্ষ্য করুন! সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবচন শব্দ ব্যবহার করেছেন। বলেছেন আমাকে বাঁচান...। সকলকে সঙ্গে নিয়ে দুআটি করলে বলতেন আমাদেরকে বাঁচান হতো।

আরেকটি হাদীসের প্রতি লক্ষ্য করুন :

قال النبي صلى الله عليه وسلم لمعاذ بن جبل " لا تدعن في دبركل صلاة أن تقول اللهم أعني على ذكرك وشكرك وحسن عبادتك. )رواه أبو داود و النسائي)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআজ বিন জাবালকে বলেছেন, তুমি অবশ্যই প্রত্যেক সালাতের পর বলবে, হে আল্লাহ! আপনার যিকির, আপনার শোকর, আপনার জন্য উত্তম ইবাদত করতে আমাকে সাহায্য করুন। (আবু দাউদ, নাসায়ী)

দেখুন!

প্রখ্যাত সাহাবী মুআজ বিন জাবাল (রাঃ) কওমের ইমাম ছিলেন। রাসূল(সাঃ) তাঁকে ইয়েমেনের গভর্ণর, শিক্ষক ও ইমাম হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সালাতে ইমামতি করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে এ দুয়াটি সকলকে নিয়ে করার নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা দেননি। তিনি তাঁকে একা একা দুআটি করার জন্য বলেছেন। হাদীসের ভাষাই তার প্রমাণ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছালাম ফিরনোর পর তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি) বলেছেন। তিনি যদি এটা সকলকে নিয়ে করতেন তাহলে নাস্তাগফিরুল্লাহ (আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি) বলতেন।

যারা ফরজ সালাত শেষে কোনো যিকির-আযকার না করে উঠে গেল তারা একটা সুন্নাত (মুস্তাহাব) ছেড়ে দিল। আবার যারা সালাত শেষে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করে উঠে গেল তারা একটা সুন্নাত বাদ দিয়ে সে স্থানে অন্য একটি বিদআত আমল করল।

তাই সারকথা হল, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের পর সব সময় জামাআতের সঙ্গে মুনাজাত করা একটি বিদআত। যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেন নি, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ করেছেন বলেও কোনো প্রমাণ নেই।

তবে যদি কেউ জামাতে সালাত আদায়ের পর একা একা দুয়া মুনাজাত করেন তা সুন্নাতের খেলাফ হবে না। এমনিভাবে ইমাম সাহেব যদি সকলকে নিয়ে বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে কোনো কোনো সময় দুয়া-মুনাজাত করেন তবে তা নাজায়েয হবে না।

ইমাম ইবনু তাইমিয়া, ইবনুল কায়্যিম, মুফতীয়ে আজম ফয়জুল্লাহ সহ অনেক আলেম-উলামা এ মত ব্যক্ত করেছেন

বিষয়: বিবিধ

২৫৩৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

381109
০২ জানুয়ারি ২০১৭ রাত ০৯:৩৯
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : আমাদের দেশের একটা বহুল প্রচলিত ভুল নিয়ে খুবই দরকারি একটা লেখা এটা |আমরা কেন জামাতে নামাজের পর সবাই মিলে দোয়া করার এই ভুলটা এখনো করছি সেটা একটা বড় রহস্য ! আমেরিকায় এই ভুলটা নামাজের পর করতে হয়না দেখে খুবই ভালো লাগে |
০৩ জানুয়ারি ২০১৭ বিকাল ০৫:২৪
315290
কুয়েত থেকে লিখেছেন : লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ পৃথিবীর বহুদেশে সঠিক জিনিসটাই আছে আমাদের দেশটা যেমন বেজালের সব কামের মধ্যই কয়েক রকমের বেজাল থাকবেই।
381115
০৩ জানুয়ারি ২০১৭ সন্ধ্যা ০৬:৩৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : সমস্যাটি হচ্ছে অনেকে এখন এই সম্মিলিত মুনাজাত কে বাধ্যতামূলক মনে করেন এবং সেটার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন।
381182
০৭ জানুয়ারি ২০১৭ সকাল ১০:৫৬
হতভাগা লিখেছেন : হজের সময়ে একবারের জন্যও ফরয নামাজের পর সন্মিলিত মোনাজাত হতে দেখিনি - না মক্কায় না মদিনায় ।

তাই নিজে নিজেই পড়ে নিতাম , এখনও তাই করি । নামাজ শেষে নিজেই দোয়া পড়ে সুন্নতের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ি ।

শোনা যায় যে সিজদার সময়ই দোয়া করার সময় । সূরা আলাক্ব এর একেবারে শেষ আয়াতে বলা আছে - সিজদা করুন,কাছে আসুন। ( ১৪ নং সিজদা)

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File