তাসাউফ এমন একটি প্রস্তরময় মরুভূমি, যেখানে পরিভ্রমণকারী সাধারণত নিজের গন্তব্য স্থান সম্পর্কে কিছুই জানে না।
লিখেছেন লিখেছেন কুয়েত থেকে ০১ মার্চ, ২০১৬, ০৪:১৮:০১ বিকাল
ইলমে তাওহীদ এবং কালামশাস্ত্র নিঃসন্দেহে জ্ঞানকে প্রখর করে, কিন্তু অন্তরের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। আল্লাহর অবশ্যম্ভাবী সত্তা (ওয়াজিবুল ওয়াজুদ)
এবং তাঁর চিরন্তনত্বের সপক্ষে ডজন প্রমাণ পেশ করা হয় কিন্তু শিক্ষার্থীদের অন্তর সেই মহান স্রষ্টার মহিমা-গৌরবের অনুভূতি থেকে শূন্য রয়ে যায়। যে মহান সত্তা তাকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন, ভাল ও খারাপ কাজের অনুভূতি দান করেছেন –তাঁর জন্য সে নিজের অন্তরে আকর্ষণ ও ভালবাসা অথবা ভয়-ভীতির কোন উত্তাপ অনুভব করে না।
আকাইদ শিক্ষার পদ্ধতি কি এরূপ হওয়া উচিত ছিল? আকাইদ শাস্ত্রের এই স্থবিরতার ফলে লোকেরা তাসাউফের দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়। এখানে তারা নিজেদের যে পিপাসা নিবারণ করতে পারেনি, তাসাউফের কাছে তা নিবারণ করার চেষ্টা করে।
কিন্তু তাসাউফ এমন একটি উপত্যকা যেখানে পদঙ্খলনের আশংকাই অধিক। এখানে পথ খুব কমই পাওয়া যায়, বরং পা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাসাউফ এমন একটি প্রস্তরময় মরুভূমি, যেখানে পরিভ্রমণকারী সাধারণত নিজের গন্তব্য স্থান সম্পর্কে কিছুই জানে না।
তাসাউফ যে আল্লাহ প্রেমের কিছুটা উত্তাপ সৃষ্টি করে তাতে সন্দেহ নেই। তা অন্তরকে বিশ্ব স্রষ্টার সাথে কিছুটা সংযুক্ত করে বটে, কিন্তু এই পথে পা পিছলে যাওয়ার এত বেশি আশংকা রয়েছে যে, তা চিন্তা করলে শরীর শিউরে উঠে।
আকাইদের যে আলোচনা আজ পর্যন্ত শুষ্ক, নিরানন্দ এবং নিরেট দার্শনিক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে কিছুটা উষ্ণতা ও জীবনীশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আমি চেষ্টা করেছি। এজন্য আমি কিতাব ও সুন্নাতকে চলার পথের আলোকবর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করেছি।
দুই. যে অবস্তা ও পরিবেশের মধ্যে আকাইন শাস্ত্রের ক্রমবিকাশ ঘটেছে তা এই শাস্ত্রের মেজাজ-প্রকৃতির উপর গভীর এবং খারাপ প্রভাব বিস্তার করেছে। রাজনৈতিক সংঘাত এবং ফেরকাগত বিরোধ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রচলিত বিতর্কে শত্রুতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, অপবাদ ও সমালোচনার এমন ধ্বংসাত্মক বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে যে, কয়েক শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আজ পর্যন্ত আমরা সেই তিক্ত ফল ভোগ করছি।
প্রচণ্ড বিরোধ ও সংঘাতময় পরিবেশে প্রকৃত সত্যের সন্ধানে ব্যাপৃত হওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। এ অবস্থার যদি প্রকৃত সত্যে উপনীত হওয়া সম্ভবও হয় তাহলে তাকে উদার মনে গ্রহণ করে নেয়াটা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এরূপ ধারণা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয় যে, যদি আমরা মনে করি যে, কোন বিতর্ক অনুষ্ঠানে একত্র হয়ে আকাইদের মূলনীতিসমূহ নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেখানে শব্দের মারপ্যাঁচ, ফেরকাগত স্বার্থে কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা এবং বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করার প্রবণতা প্রবল থাকে, যেখানে হাতে থাকে এরিস্টটলীয় দর্শনের তীর এবং সেই তীরের আঘাতে নিজের প্রতিপক্ষকে জনসমক্ষে অপদস্থ করার মনোভাব কার্যকর থাকে, সেখানে এরূপ জটিল বিষয়ের সমাধান বের করা মোটেই সম্ভব নয়।
আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তীদের ক্ষমা করুন, এ ধরনের বিতর্কে তাঁরা আগ্রহের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন এবং তাকে আরো মারমুখী করে তোলেন। অথচ এ সময় মুসলিম রাষ্ট্রশক্তিই দুনিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছিল।
এভাবে তাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েন এবং আল্লাহর পথে জিহানের পরিবর্তে বিতর্কের এ ভয়ংকর ময়ধানে পরস্পর মল্লাযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ফলে তাঁরা শত্রুদের প্রতি দৃষ্টি রাখার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকেন।
তাঁরা অতীত হয়ে গেলেও এই বিতর্কযুদ্ধ আজ সশরীরে বিরাজমান। তাঁদের অবিনশ্বর দেহ বিলীন হয়ে গেছে, কিন্তু তাঁদের পারস্পরিক ঝগড়া এখনো বেঁচে আছে। আর তা মুসলিম মিল্লাতের ঐক্যের পথে বিরাট প্রতিবন্ধক এবং তার অস্তিত্বের জন্য স্থায়ী বিপদে পরিণত হয়ে আছে।
ইসলামী বিশ্ব জঙ্গী খ্রিষ্ট জগতের সামনে শেষ পর্যন্ত মাথা হেট করে দিয়েছে এ মর্মান্তিক চিত্রও আমরা দেখেছি। ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারীদের চিন্তাগত বিরোধের ফলেই ঘটেছে এই পরাজয়।
কিন্তু এতদসত্ত্বেও আজ পর্যন্ত এই পুঁতিগন্ধময় ঐতিহাসিক বিতর্কের ঝড় চলছেই। দুঃখের বিষয়, আজ যারা ইসলামের খেদমতের দাবিদার –তাদের কোন কোন দল নেই ঝগড়াকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
আমি বুঝতে পারছি না –মুসলিম মিল্লাতের মত অন্য কোন মিল্লাতে আজ চিন্তার ঐক্য ও আবেগের একাত্মতার এত বেশি প্রয়োজন আছে কি? অতএব কোন ব্যাপারে বিরোধ দেখা দিলে তাকে মিল্লাতের চিন্তাশীল ও মননশীল ব্যক্তিদের গণ্ডী থেকে বের করে এনে জাতীয় পর্যায়ে দাঁড় করানোটা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুসলিম উম্মাতের সাথে প্রকাশ্য দুশমনিরই নামান্তর বলা যায়। বাকযুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে উস্তাদ আহমাদ ইজ্জাত পাশা বলেনঃ
এটা এমন কোন ঝগড়া ছিল না যা বৈঠকে আলোচনা, তর্কশাস্ত্রের পরিধি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের সীমা অতিক্রম করতে পারে। কিন্তু আমরা এই অর্থহীন বিতর্কের মধ্যে মহামহিম আল্লাহর নামকেও ঢুকিয়ে দিয়েছি।
অতএব আমাদের মধ্যকার প্রতিটি দল প্রতিপক্ষকে কাফের বলে ফতোয়া দেয়ার চেষ্টায় রত হল। এভাবে এই প্রাথমিক বিরোধ মাযহাবী যুদ্ধের রূপ নেয়, যার লেলিহানশিখা নির্বাপিত হচ্ছে না। জাহমিয়া ও মুতাযিলাদের মধ্যকার বিরোধ মূলত এখান থেকে শুরু হয় যে, একদল বললঃ বান্দা নিজেই তার কাজের স্রষ্টা।
তারা কর্তার পরিবর্তে স্রষ্টা শব্দের ব্যবহার করে। তারা বলেঃ বান্দা তার ইচ্ছার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন। এই আকীদা সঠিকই হোক অথবা ভ্রান্তই হোক তা ইলমী বাহাসের বিষয়বস্তু হতে পারে।
এতে উভয় দলের সর্বাধিক এতটুকু অধিকার অবশ্যই ছিল যে, একদল অপর দলের মত প্রত্যাখ্যান করতে পারত, তার সমালোচনা করতে পারত এবং তার ভ্রান্তি ও অজ্ঞতা তুলে ধরতে পারত। কিন্তু ব্যাপারটা এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকল না।
কাদরিয়া সম্পদ্রায় বললঃ আমাদের আকীদাকে স্বীকার না করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা যদি আখেরাতে কাউকে শাস্তি দেন তাহলে তিনি জুলুমই করবেন।
অপর দল বললঃ তোমরা আল্লাহর ইচ্ছার ব্যাপকতা এবং তাঁর কুদরতের সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করছ। এটা কুফরীরই শামিল। প্রাথমিক পর্যায়ে এ দরনের মতবিরোধ চলছিল।
অতঃপর কালের প্রবাহে তার ক্ষেত্র বিস্তর হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তা থেকে অদ্ভূত ও অযৌক্তিক মতবাদের জন্ম হতে থাকে। মতবিরোধ এবং বিতর্ক এতটা আকর্ষণ সৃষ্টি করে যে, আকাইদের মধ্যে অনেক হাস্যকর ও যুক্তিহীন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
সুতরাং মুতাযিলা সম্প্রদায় এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মধ্যে এও একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে পড়েছে যে, যাদুর তাৎপর্য কি? মেঘ কিভাবে সৃষ্টি হয়? এই হাস্যস্পদ কথার কি কোন আগামাথা আছে?
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং অপরাপর সাহাবীর মধ্যে খিলাফতের প্রসঙ্গ নিয়ে যে মতবিরোধ হয়েছিল, আজও মুসলমানরা তাতে জড়িত হয়ে নিজেদের ঐক্যকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে।
এই উম্মাত ছাড়া জমিনের বুকে আর কোন উম্মাত আছে কি, যারা নিজেদের বিস্মৃত অতীতের ইতিহাসের মর্মান্তিক বিবাদকে এভাবে চোষণ করে? আবার এ ব্যাপারটিকে আমরা কোন আকীদার বিষয়বস্তুর মধ্যে ঢুকাচ্ছি?
এটাকে আমরা কেন অন্যাণ্য ঐতিহাসিক ঘটনার মত শুধু ঐতিহাসিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছি না? কেন লোকেরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে?
আমরা যদি কারো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেই যে, অমুক ব্যক্তি ভুল করেছে এবং অমুক ব্যক্তি ঠিক করেছে তাহলে আমাদের এই ফয়সালার সাথে আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমানের কি সম্পর্ক আছে?
অথচ আল্লাহ তাআলার পরিস্কার বাণী রয়েছেঃ
তারা ছিল একটি দল যা অতীত হয়ে গেছে। তারা যা কিছু অর্জন করেছে তা তাদের জন্য; আর তোমরা যা কিছু অর্জন করবে তার ফল তোমরাই ভোগ করবে।
তারা কি করছিল তা তোমাদের কাছে জিজ্ঞেস করা হবে না। -(সূরা আল-বাকারাঃ ১৩৪-১৪১)
আজ যখন আমরা আমাদের দ্বীনী পুস্তিকাসমূহে নামসর্বস্ব সালাফী এবং অ-সালাফীদের বাকবিতণ্ডার প্রতি লক্ষ্য করি তখন দেখতে পাই, তাদের মুখে নিজেদের ভাইদের জন্য কুফরী ও ফাসেকীর শব্দ এমনভাবে উচ্চারিত হচ্ছে যেন পায়ের আঘাতে খেলার বল অহরহ ডিগবাজি খাচ্ছে।
এই অবসন্ন জাতির দুর্বল শরীরে ধ্বংসাত্মক ব্যাধি নিজের বাসা বানিয়ে নিয়েছে এবং তা অভিজ্ঞ ডাক্তার এবং একনিষ্ঠ ও নিঃস্বার্থপ্রাণ পথপ্রদর্শকের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।
এই অনর্থক মতবিরোধ উম্মাতের মন-মানসিকতায় বদ্ধমূল হয়ে গেছে এবং তাদের জীবনে এর প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আরো দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই মতবিরোধের যে ভাল দিক রয়েছে তাতে তারা হাতও লাগায়নি, কিন্তু ক্ষতিকর দিকটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে।
যদিও আমাদের পূর্ববর্তী আলেমদের মধ্যে এই মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে যে, আমলছাড়া ঈমানের অস্তিত্ব সম্ভব কি না? আমলে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য উপাদান, না আনুসঙ্গিক বিষয়?
তবুও সাধারণ মুসলমানদের কাছে একথাই গৃহীত হল যে, ঈমানের জন্য আমল জরুরী নয়,আমল ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়, শুধু তার রং এবং পালিশ। এভাবে মিল্লাতে ইসলামিয়া এই মতবিরোধকে নিজেদের কর্মবিমুখতার সপক্ষে বাহানা হিসাবে দাঁড় করেছে।
বিষয়: বিবিধ
১৫০০ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খুব সুন্দর লিখেছেন। জাযাকাল্লাহু খাইর।
আমিন
মন্তব্য করতে লগইন করুন