এবং ফরহাদ মজহারের দূরদৃষ্টি এবং শাহ আব্দুল হান্নান চাচার ক্ষীণ দৃষ্টি

লিখেছেন লিখেছেন ঈগল ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৪:২৩:০৩ বিকাল

শাহ আব্দুল হান্নান সাহেব জামাআতের একজন থিংক ট্যাংকার হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে ফরহাদ মজহার কমমিউনিজম চিন্তাধারার একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। পেশওয়ারের ঘটনা নিয়ে দুইজনেই লিখেছেন। দেখুন, ইসলামপন্থি বলে পরিচিত আব্দুল হান্নানের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও পাকিস্থান সম্পর্কে ভুলব্যাখ্যা এবং হালের কথিত ইসলামপন্থি বলে পরিচিত পাওয়া ফরহাদ মজহারের দূরদৃষ্টি। (কলাম দুটি যারা পড়েন নি তাদের জন্য)

ন্যায়যুদ্ধের নীতি

লেখক ফরহাদ মজহার

22 December 2014, Monday


পেশোয়ারে একটি মিলিটারি স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানদের হামলা আমাকে স্তম্ভিত ও শোকার্ত করেছে। এই বিষয়েই আজ কয়েকটি কথা বলব।

২০১০ সালের ১৮ অক্টোবর মার্কিন ড্রোন হামলায় ১০ বছরের বালক নাসিমুল্লার বুকে প্রাণঘাতী লোহার টুকরা শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা মৃত নাসিমুল্লার ছবিটি ইন্টারনেটে দেখেছিলাম। সেটা এখনও গেঁথে আছে। উত্তর ওয়াজারিস্তানের ফাতিমা। তার বয়সও ৮ থেকে ১০-এর বেশি হবে না। একুশে মে ২০১০ সালে ড্রোন হামলায় নিহত তার ছবিও মনে আছে। মনে আছে অনেকের ছবি। যাদের ইন্টারনেটের বদৌলতে দেখেছি। দেখছি।যারা মার্কিন ড্রোন হামলায় হতাহতের পরিসংখ্যান জানেন না, তারা ইন্টারনেটে The Bureau of Investigative Journalism-এ ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। তাদের একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি।২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে পাকিস্তানে সিআইএ পরিচালিত ড্রোন হামলা হয়েছে ৪০৫টি, তার মধ্যে ওবামার সময়ে হয়েছে ৩৫৪টি। হত্যা করা হয়েছে ২ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৮৮৮ জন মানুষ। এদের মধ্যে বেসামরিক লোক হচ্ছে ৪১৬ থেকে ৯৫৯ জন। শিশুদের সংখ্যা ১৬৮ থেকে ২০৪ জন। আর শিশুসহ আহতের সংখ্যা ১ হাজার ১৩৩ থেকে ১ হাজার ৭০৬ জন।সন্ত্রাস দমনের নামে একটি জনগোষ্ঠীর ওপর যখন সামরিক হামলা চলে, কিংবা ড্রোন বিমানে মৃত্যুর পরোয়ানা পাঠানো হয় তখন বেসামরিক মানুষগুলো নিহত হলেও সেটা অফিসিয়াল গণনায় আসে না। সেটা কোলেটারাল ডেমেজ। গণমাধ্যমও তা আড়াল করে। এই ধরনের হামলায় কতজন শিশু মরল তাদের নাম, ঠিকানা, চেহারা, ছবি তো দূরে থাকুক সংখ্যা হিসেবেও তারা গণ্য হয় না। এর নামই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ।

একটি জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা করতে চাইলে তাদের একটা খারাপ নাম দিতে হবে। সেই নামটা হচ্ছে জঙ্গি। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম হচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সেই জঙ্গিদের হত্যা করতে গিয়ে তাদের বেসামরিক নারী বা পুরুষ যদি মারা যায় সেটা বিবেচনায় নেয়া যাবে না। এমনকি শিশুরাও না। সেই যুদ্ধ কোনো নিয়ম-কানুন মেনে চলে না। প্রতিপক্ষ সেখানে নিছকই এনিমি কম্ব্যাটেন্ট, তার কোনো আইনি সত্তা নেই। তার অধিকার রক্ষার কোনো আন্তর্জাতিক আইন নেই। তারা যেহেতু আইনের বাইরে অতএব তাদের হত্যা আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলেও বিবেচিত হয় না। তারা সন্ত্রাসী। যে কোনো ছুতায় তাদের হত্যা করা যায়। কিন্তু তারা যখন পাল্টা আঘাত করে তখন আমাদের নীতি-নৈতিকতা, আবেগ, আইন, সামরিক বাহাদুরি, পাল্টা হত্যার তৃষ্ণা নিমিষে উথলে ওঠে। এই বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে আমরা বাস করছি।পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাকিস্তানি তালেবানদের দমন করার জন্য যার্ব-এ আযাব অপারেশন শুরু করেছে অনেক আগে। উর্দু ভাষা। তীক্ষè ও নিখুঁতভাবে হত্যার জন্য তরবারির আঘাত। এই অপারেশন শুরু করার পর থেকে ভাবছিলাম কত নাসিমুল্লাহ আর ফাতিমার লাশ কোথায় কিভাবে নিষ্পন্দ হয়ে পড়ে আছে কে জানে। কিভাবে সাধারণ মানুষ বোমার হামলা থেকে রক্ষা পাবে? মৃত্যু ছাড়া অনেকেরই অন্য কোনো গতি আছে কিনা সন্দেহ। আল জাজিরার একটি ভিডিওতে দেখলাম ওয়াজারিস্তানের সাধারণ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে আফগানিস্তানে ছুটছে। অর্থাৎ বোমা কে জঙ্গি আর কে জঙ্গি নয়, সেটা আইডেন্টিটি কার্ড দেখে দেখে মারে না। একটি এলাকায় বোমা বর্ষিত হয়, সেনাবাহিনী দাবি করে সেখানে জঙ্গিরা আছে। এতে বসতবাড়ি ও জনপদ বিধ্বস্ত হয়, মারা পড়ে নিরীহ বেসামরিক মানুষ। ফাতিমা ও নাসিমুল্লারা শহীদ হয়। উত্তর ওয়াজিরিস্তান একটি জঙ্গি উপদ্রুত এলাকা, অতএব এখানে বোমা নির্বিচারে মারার বিপক্ষে বিশেষ কোনো যুক্তি নেই। যদি একাত্তর সাল আমরা মনে রাখি তো এটাও মনে রাখতে হবে, আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশনের কথা বলছি।ওয়াজিরিস্তানে শিশুরা কে কোথায় কিভাবে মরছে কে তার খবর করবে? ইন্টারনেটে সেসব ছবি আসবে না। কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার সঠিক খবর পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে যুদ্ধনীতির অংশ হিসেবে উত্তর ওয়াজিরিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অপারেশনের সুসংবাদগুলো ছাপা হচ্ছিল গণমাধ্যমে ক্রমাগত।

অর্থাৎ কয়জন জঙ্গি কোথায় কিভাবে মরেছে, কিভাবে তাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলার বাহাদুরি দিয়ে হত্যা করা হল তার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। অপারেশন শুরু করার পর থেকে আজ অবধি কত বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে তার কোনো খবর গণমাধ্যমে আসেনি। শুধু কতজন তালেবানকে হত্যা করা হয়েছে সেই খবরই জানানো হচ্ছিল।যার্ব-এ আযাব অপারেশন শুরু হয়েছিল জুন মাসের ১৫ তারিখে। সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, পেশোয়ারের সামরিক স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানদের আক্রমণের আগে পর্যন্ত ১ হাজার ২৭০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ১৫ জুন ২০১৪ থেকে শুরু হওয়া অপারেশান যার্ব-এ-আযাব-এ পাকিস্তানি মিলিটারি ওয়াজিরিস্তানে ১ হাজার ২৭০ জনকে হত্যা করেছে। এই খবর আল জাজিরা থেকে জেনেছি। কিন্তু কত বেসামরিক মানুষ মারা গেছে জানা যায়নি। কতজন শিশু তারও কোনো পরিসংখ্যান নেই। পেশোয়ারে সামরিক স্কুলের হামলার পরই কেবল ওয়াজিরিস্তানের হত্যার সংখ্যাটা জানা গেল। ফেসবুকে মোতাসিম বিল্লাহ তিশাদ এই প্রসঙ্গে খুবই মর্মঘাতী মন্তব্য করেছেন, যা এখানে উদ্ধৃত করার তাগিদ সামলাতে পারছি না। তিনি লিখেছেন- মুদ্রার একদিক থেকে যদি দেখি তাহলে পেশোয়ারের মিলিটারি স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানদের হামলায় কমপক্ষে ১৩২ জন বাচ্চাসহ ১৪১ জন নিহত হয়েছে। এই খবর আমরা সঙ্গে সঙ্গেই জেনেছি। কিন্তু ১৫ জুন ২০১৪ থেকে অপারেশন যার্ব-এ আযাব ওয়াজিরিস্তানে ১ হাজার ২৭০ জন হত্যা করেছে, আর সেটা ঘটে আসছে ছয় মাস ধরে। অথচ এই পরের হত্যার খবরটা আমাদের কাছে পৌঁছাল একই সময়ে। আগে নয়। যখন অপারেশন চলছিল তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিভাবে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সাধারণ মানুষ হত্যা করছিল তার কোনো খবর আমরা জানি না। তার কোনো পরিসংখ্যানই ছিল না।

মোতাসিম বিল্লাহ তিশাদ প্রশ্ন করছেন, একটু কি কষ্ট হচ্ছে যে, কেন এই ১ হাজার ২৭০ জনের খবর আমাদের কাছে পৌঁছাতে, সেটা বন্ধের দাবি জানাতে এই ১৩২টি বাচ্চাকে মরতে হল? অর্থাৎ পেশোয়ারের সামরিক স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানদের এই হামলা না হলে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে কত মানুষ হত্যা করা হয়েছে তা আমরা জানতাম কিনা সন্দেহ।আমি নিশ্চিত খুব মানুষই আমরা পাব পেশোয়ারের স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানদের হামলাকে নৈতিক জায়গা থেকে মেনে নিতে সক্ষম হবেন। আমি নিজে স্তম্ভিত হয়েছি, মারাত্মক কষ্ট পেয়েছি ও শোকার্ত হয়েছি। মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহতদের জন্য যে কষ্ট পাই, কোনো অংশে এই ক্ষেত্রেও বেদনার মাত্রা কম নয়। কেউই এই ধরনের সফট টারগেটকে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করাকে নৈতিক জায়গা থেকে সমর্থন করবেন না।কিন্তু এটা ভুলে যাই যে, উত্তর ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী একটি যুদ্ধ চালাচ্ছে, এর শিকার শুধু তথাকথিত জঙ্গিরা নয়। বেসামরিক জনগণও। তাদের মধ্যে শিশু ও বাচ্চারাও আছে। পেশোয়ারে স্কুলের বাচ্চাদের চেয়ে তারা ভিন্ন কিছু নয়। কিন্তু তাদের খবর আমরা জানি না। অন্যদিকে জঙ্গিদের হত্যা করার জন্য জঙ্গি এলাকায় ড্রোন হামলা কিংবা বিমান হামলাকে আমরা নৈতিক জায়গা থেকেই তো আবার জায়েজ মনে করি। ওয়াজিরিস্তানে সাধারণ মানুষসহ শিশুরাও মরছে, তার জন্য আমাদের কোনো নৈতিক সংবেদনা নেই। আফটার অল তারা জঙ্গি এবং তাদের বাচ্চারাও জঙ্গিদেরই বাচ্চা। জঙ্গির বাচ্চা জঙ্গি হয়, তাদের তো মরতেই হবে।

তাই না?যদি আসলেই আমরা সত্যিকারের উদার কিংবা নৈতিকতার জায়গা থেকে পেশোয়ারের মিলিটারি স্কুলের হামলাকে নিন্দা করতে চাই, তাহলে অবশ্যই উভয়কেই আমাদের নিন্দা করা কর্তব্য হয়ে ওঠে। ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান ও বিমানহামলার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু পেশোয়ারের মিলিটারি স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানদের হামলাকে আমরা নৈতিক অবস্থান বলতে পারি না। সেটা হবে নৈতিকতার আড়ালে ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানের পক্ষে জনমত তৈরির ভলান্টিয়ার হওয়া।কিন্তু তারপরও তর্ক থেকে যায়। কারণ, নৈতিকতার কথা যদি বলি তাহলে সেটা কার নৈতিকতা? কোন পক্ষের? দ্বিতীয়ত আমরা একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির বিচার করছি। এই পরিস্থিতিতে নৈতিকতার মানদণ্ড তো একপক্ষীয় হলে হবে না। যুদ্ধাবস্থায় একপক্ষকে নৈতিকতার বয়ান মেনে চলার কথা বলা, আর অন্যপক্ষ তা লঙ্ঘন করলে সেই ক্ষেত্রে নীরব থাকা কোনো নীতি হতে পারে না। নৈতিকতা জরুরি, যুদ্ধাবস্থাতেও। কিন্তু কোনো পক্ষকে দায়মুক্তি দিয়ে নয়। জঙ্গি দমনের নামে ওয়াজিরিস্তানে হত্যাযজ্ঞ চালানোর লাইসেন্স দেয়া কোনো কাজের কথা হতে পারে না।

যারা পেশোয়ারের মিলিটারি স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানদের হামলার নিন্দা করছেন, আমি তাদের অবশ্যই নৈতিক দিক থেকে সমর্থন করি। কিন্তু তারা যখন ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাভিযান সম্পর্কে নীরব থাকেন তখন বিস্মিত ও মর্মাহত হই। কারণ এই নীরবতা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জঙ্গি দমন নীতির নামে নির্বিচারে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সমর্থন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সমর্থন। সব নীতি-নৈতিকতা ভঙ্গ করে হত্যাযজ্ঞ চালানোর শামিল। একে মেনে নেয়া যায় না।বলাবাহুল্য, তেহরিখে তালেবান পাকিস্তানের অফিসিয়াল মুখপাত্র মুহাম্মদ খুরাসানী পেশোয়ারে স্কুলে হামলার পক্ষে তাদের যুক্তি দিয়েছেন। এটা ছিল একটি মিলিটারি স্কুল। খোরাসানীর দাবি তালেবানরা সেখানে উপস্থিত আর্মি অফিসার এবং তাদের যুবক ছেলেদের হত্যা করে। এই যুবক ছেলেরাই ভবিষ্যতে তাদের পিতার পদে আসীন হয়ে, পাকিস্তানে সীমান্তবর্তী অসহায় গোত্র (ঋঅঞঅ এলাকার) এবং দেশজুড়ে পারিচালিত সেনা অভিযানে অংশ নিত। এ জন্যই তাদের গড়ে তোলা হচ্ছিল। আর্মি অফিসারদের ১৮ ও ২৫ বছরের যুবকদের ছবি দিয়ে তারা ক্যাপশন দিয়ে বলেছেন, আর্মি অফিসারদের ১৮ এবং ২৫ বছরের সন্তানরা মাসুম শিশু...!! কিন্তু সোয়াত ওয়াজিরিস্তানের মাসুম বাচ্চারা তবে সন্ত্রাসী কেন...?? তিনি এটাও জানিয়েছেন, এই অপারেশনে একজন কর্নেল, গোয়েন্দা সংস্থার কয়েক ডজন অফিসার, ২শরও বেশি সামরিক অফিসার এবং তাদের যুবক ছেলেরা নিহত হয়েছে।তিনি প্রশ্ন করেছেন, পাকিস্তানের নাপাক সৈন্যরা বিগত ৬ বছর ধরে, পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী গোত্রগুলোর ওপর যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে কত নিরপরাধ, অসহায় গরিব মুসলমান শহীদ করেছে, তার হিসাব কি কেউ রেখেছে?

পাকিস্তানি সেনারা মুজাহিদদের বাপ-ভাইদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে শহীদ করে দেয়। এটা অহরহই ঘটছে। তারা মেরে ফেলার পর লাশগুলোও ফেরত দেয় না। অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে ফেলে দেয়। চলতি বছরেই শুধু ৬শরও বেশি নিরপরাধ মানুষকে গুপ্তভাবে শহীদ করেছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এই নারকীয়তার প্রতিবাদ কেউ করে না। শুধু ২০১৪ সালেই ৬শরও বেশি নিরপরাধ মানুষ শহীদ হয়েছে। এই মজলুম শহীদদের অপরাধ কী ছিল তা কি কেউ কোনো দিন জানার চেষ্টা করেছিল? রাহে রাস্ত, রাহে নাজাত, শের দিল, যরবে আযব ও খায়বরসহ আরও বিভিন্ন নামে অসংখ্য অভিযান চালানো হয়েছে। প্রশ্ন : কত হাজার মুসলিমকে শহীদ এবং কত লাখ মুসলমানকে ঘরছাড়া করা হয়েছে তার হিসাব কি কেউ রেখেছে?এরপর খুরাসানী বলেছেন, বেলুচিস্তান থেকে কাবায়েল পর্যন্ত ৫০ হাজারের চেয়েও বেশি নিখোঁজ মানুষের স্বজনরা আর কতদিন আর্তনাদ করে বেড়াবে? এই স্বজনহারা মানুষদের ব্যথা পাক জেনারেলরা তখনই বুঝবে, যখন তারাও তাদের স্বজনকে হারাবে।তেহরিকে তালেবান পাকিস্তান সরকার এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে, এই ধরনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ না চালাতে বারবারই নিষেধ করছিল।

সরকারকে নিখোঁজদের লাশ হস্তান্তর করতে বলেছে, কিন্তু কোনো পক্ষই এসব আবেদনে কান দেয়নি। অতএব, তেহরিকে তালেবান পাকিস্তান, সরকার এবং সেনাদের দ্বারা পরিচালিত পাশবিক হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে, বাধ্য হয়েই চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। অর্থাৎ পেশোয়ারের কড়া সামরিক নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় সামরিক স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানরা বাধ্য হয়ে এই হামলা চালিয়েছে। তালেবানের দাবি, আমরা সামরিক বাহিনী পরিচালিত স্কুল অ্যান্ড কলেজকে টার্গেট করেছি। আমরা শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের ওপরই হামলা করেছি।তেহরিকে তালিবানের দাবি হচ্ছে :১. তালেবানের বিরুদ্ধে অপারেশনের নাম দিয়ে ঋঅঞঅ এলাকার মুসলিমদের সন্তান হত্যা করা এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে।২. গোপন এজেন্সিগুলোর হাতে বন্দি মুজাহিদদের নিরপরাধ নিকট আত্মীয়-স্বজনদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করে, তাদের হত্যা করার প্রক্রিয়া এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে।৩. মুজাহিদদের পরিবারভুক্ত নারীরা, যাদের নিরাপত্তা বাহিনী বন্দি করে রেখেছে তাদের এই মুহূর্তে ছেড়ে দিতে হবে।মিলিটারি স্কুলে হামলার পক্ষে তেহরিকে তালেবান পাকিস্তানের মুহাম্মদ খুরাসানির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য কিনা সেই বিচার আমি পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিতে চাই। মন্দ দিয়ে মন্দ কাজকে জায়েজ করা যায় কিনা অনেকে সঙ্গত কারণে এই তর্ক তুলছেন। সেটা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয়। কিন্তু একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে তাকে বিমূর্ত নৈতিক তর্কে পর্যবসিত করার কোনো সুযোগ নেই।আমার নিজের কথা আমি বলেছি।

পেশোয়ারের ঘটনায় আমি স্তম্ভিত ও শোকার্ত হয়েছি। অন্যদের শুধু এতটুকুই মনে করিয়ে দিতে চাই, উত্তর ওয়াজিরিস্তানের বাচ্চারাও বাচ্চা। পেশোয়ার হামলার পর যদিও প্রাপ্তবয়স্ক ছাড়া কোনো আহত বা নিহত শিশুর ছবি ইন্টারনেটে আমার চোখে পড়েনি তবুও উভয় ক্ষেত্রেই আমি মনে করি- শিশু, কিশোর কিংবা নিরপরাধ যুবক বা নিরস্ত্র বেসামরিক ব্যক্তির ওপর হামলা কোন যুদ্ধনীতির মধ্যে পড়ে না। প্রতিপক্ষ কোনো নৈতিক কিংবা আন্তর্জাতিক বিধি-বিধানই মানে না, এই বাস্তবতাও নিরস্ত্র মানুষ হামলাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করে না। সেটা ন্যায়যুদ্ধের পক্ষে কোনো বৈধ যুক্তি হতে পারে না। তারপরও বলি, বাস্তবতার জটিলতা সম্পর্কে আমাদের আরওঅনেক বেশি সতর্ক থাকা জরুরি। কিন্তু সেটা নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রেখে নয়। পেশোয়ারের হামলার নিন্দা করার মধ্য দিয়েই ন্যায়যুদ্ধের পক্ষে আমরা দাঁড়াতে পারি। অন্যভাবে নয়।

( যুগান্তর )

উগ্রবাদ দমন করতে হবে

লেখক, শাহ আব্দুল হান্নান

22 December 2014, Monday


২০১৪ সালের সবচেয়ে শোকাবহ ঘটনা হলো ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পেশোয়ারের একটি স্কুলে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের বা তালেবানের হামলা, যার ফলে স্কুলের ১৩২ জন ছাত্রছাত্রীসহ ১৪১ জন নিহত হয়েছে। এসব ছাত্রছাত্রীর বেশির ভাগের বয়স দশ থেকে পনেরো বছর।

এ ঘটনাকে পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলসহ বিশ্বের সব নেতৃবৃন্দ নিন্দা করেছেন। এদের মধ্যে ওবামা ও মোদিও রয়েছেন। পাকিস্তানে সর্বদলীয় সভা হয়েছে, যাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে সাত দিনের মধ্যে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা। এ কমিটিতে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিও থাকবেন। এ কমিটির রিপোর্ট মোতাবেক পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। পাকিস্তানে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। অন্য দিকে ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ তাদের চার মাসব্যাপী আন্দোলন তুলে নিয়েছে। ইমরান খান বলেছেন, এ সময়ের মূল সমস্যা হলো সন্ত্রাসবাদ। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামি সারা দেশে গায়েবানা জানাজা করেছে।

তালেবান এ ঘটনা কেন ঘটাল? তারা কী চায়? তারা ইসলামি শরিয়ার প্রয়োগ চায়। পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়নের পর থেকেই ইসলামি রাষ্ট্র। ১৯৭৩ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের শাসনের কথা বলা হয়েছে। কুরান ও সুন্নাহ মোতাবেক আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। সেখানে জাকাত আইন রয়েছে। সাক্ষ্য আইনে ইসলামি সাম্যের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চুরি, ডাকাতি, হত্যাÑ এসব ক্ষেত্রে কুরআনের বিধান হদুদ আইন জারি করা হয়েছে।

তারপর তারা আর কী চায়? যদি এসব বিধান ভালোভাবে কার্যকরী না হয়ে থাকে, তাহলে তারা রাজনৈতিক দল করে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসতে পারে এবং তাদের ইচ্ছামতো পরিবর্তন শান্তিপূর্ণভাবে করতে পারে, অযথা রক্তপাত না করে।

রাসূল সা: সে সময়ে যে সিস্টেম বা যে ব্যবস্থা কায়েম ছিল তার ভেতরেই কাজ করেন। তিনি মক্কায় দাওয়াতের মাধ্যমে কাজ করেন, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নয়। কারণ বাস্তবতার দাবি ছিল শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করা। এ কারণেই মুসলিম বিশ্বের মূল স্রোতের ইসলামি দলগুলো মধ্যপন্থী। তারা গণতান্ত্রিক পথে তথা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সম্মতিতে পরিবর্তন চায়।

হিজরতের পর মদিনায় গিয়ে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে মদিনার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ইহুদিদের সাথে চুক্তি করেন। সেই চুক্তির মাধ্যমেই ঐক্য সৃষ্টি হয় এবং রাষ্ট্র স্থাপিত হয়। রাসূলের ইন্তেকালের পর খিলাফতে রাশেদার সবাই নির্বাচিত হন। তৃতীয় খলিফা নির্বাচনের সময় জনমত যাচাই করা হয়। জনমত যাচাইয়ে দেখা যায়, হজরত উসমান রা:-এর সমর্থন বেশি। তিনি খলিফা হন। জনমত যাচাই কেবল মদিনায় হয়। দেশব্যাপী নির্বাচন তখন বাস্তব ছিল না। এখনকার পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই দেশের সবার মতামত নিতে হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সিস্টেমের ভেতরে কাজ করতে হবে। যতটুকু সম্ভব ততটুকুই করতে হবে। বাকিটুকু ভবিষ্যতের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

কিছু মানুষ মুসলিম বিশ্বে শক্তির জোরে পরিবর্তন করতে চায়, রক্তপাত ঘটায়, আত্মঘাতী হামলা করে। এদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তালেবান ছাড়াও, নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম, উত্তর ইরাকের খিলাফতের দাবিদার গোষ্ঠী এবং আরো কিছু গোষ্ঠী এ ধরনের রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে গোটা মুসলিম উম্মাহকে দাঁড়াতে হবে। শ্রেষ্ঠ আলেমদের দায়িত্ব হচ্ছে এদের বোঝানো। প্রয়োজনে তাদেরকে শক্তির মাধ্যমেই মোকাবেলা করতে হবে এবং তাদেরকে নিরস্ত্র ও আটক করতে হবে। যেভাবেই হোক তাদেরকে দমন করতে হবে। এই পরিস্থিতির সুযোগে কিছু মহল মূল ধারার ইসলামি দলগুলোকে, ইসলামকে অভিযুক্ত করতে পারে। তা করা অন্যায় হবে।

সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

( নয়া দিগন্ত )

বিষয়: বিবিধ

১৪৬৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

296686
২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৭
মাজহার১৩ লিখেছেন : জামায়াতীদের এই সরল সমীকরনের কারনে তাঁদের দুরাবস্থা। তাদেরকে নিষিদ্ধ করা উচিত।
আফগানিস্তানে প্রতি ৭ টি শিশুর মধ্যে ১টি পংগু।
296704
২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:০০
গ্যাঞ্জাম খানের খোলা চিঠি লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
296750
২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১১:০৫
কাউয়া লিখেছেন : এর কারন শাহ আব্দুল হান্নান একজন দলবাজ বুদ্ধিজীবি।
297376
২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১২:২৩
বুঝিনা লিখেছেন : সবার বিশ্লেষন ক্ষমতা একরকম নয়, তবে ফরহাদ মাজহারের এই বিশ্লেষন সরল সমীকরনের বাইরে, বর্তমান দুনিয়ার জন্য প্রনিধানযোগ্য

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File