বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদী তৎপরতার গোড়ার কথা :
লিখেছেন লিখেছেন বিদ্রোহী রণক্লান্ত ২৭ মে, ২০১৩, ০৫:১৭:১৫ বিকাল
বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদী অপতৎপরতা : প্রতিরোধের উপায়
একটি কৈফিয়ত :
শুরুতেই একটি কথা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলা রাখা ভালো। এটি যেহেতু বিকৃত মস্তিষ্ক নাস্তিকদের অপতৎপরতা বিষয়ে প্রামাণিক প্রবন্ধ তাই এখানে নাস্তিকদের লেখার নানা উদ্ধৃতি থাকবে। নাস্তিকরা এমন কিছু কথা বলেছেন, এমন অরুচিকর কথা লিখেছেন যা আসলে কোনো রুচিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে পড়া বা উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। বক্ষমাণ গ্রন্থকে প্রমাণসিদ্ধ করার স্বার্থে উদ্ধৃতি হিসেবে তাদের এমন অনেক অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য ও অশ্লীল শব্দ তুলে ধরতে হয়েছে। আশা করি সহৃদয় পাঠকগণ বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
নাস্তিক্যবাদ সম্পর্কে :
নাস্তিক্যবাদ (ইংরেজি ভাষায় : Atheism; অন্যান্য নাম : নিরীশ্বরবাদ, নাস্তিকতাবাদ) একটি দর্শনের নাম যাতে ঈশ্বর বা স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না এবং সম্পূর্ণ ভৌত ও প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়। আস্তিক্যবাদ বর্জনকেই নাস্তিক্যবাদ বলা যায়। নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস নয় বরং অবিশ্বাস এবং যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাস খণ্ডন নয় বরং বিশ্বাসের অনুপস্থিতিই এখানে মুখ্য। [বাংলা ইউকিপিডিয়া]
ইংরেজি ‘এইথিজম’ (Atheism) শব্দের অর্থ হল নাস্তিক্য বা নিরীশ্বরবাদ। এইথিজম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক ‘এথোস’ শব্দটি থেকে। শব্দটি সেই সকল মানুষকে নির্দেশ করে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি অন্ধবিশ্বাসকে যুক্তি দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে। দিনদিন মুক্ত চিন্তা, সংশয়বাদী চিন্তাধারা এবং ধর্মসমূহের সমালোচনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নাস্তিক্যবাদেরও প্রসার ঘটছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম কিছু মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ২.৩% মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে পরিচয় দেয় এবং ১১.৯% মানুষ কোন ধর্মেই বিশ্বাস করে না। জপানের ৬৪% থকে ৬৫% নাস্তিক অথবা ধর্মে অবিশ্বাসী। রাশিয়াতে এই সংখ্যা প্রায় ৪৮% এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নে ৬% (ইতালি) থেকে শুরু করে ৮৫% (সুইডেন) পর্যন্ত।
পশ্চিমের দেশগুলোতে নাস্তিকদের সাধারণভাবে ধর্মহীন বা পারলৌকিক বিষয়সমূহে অবিশ্বাসী হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের মত যেসব ধর্মে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় না, সেসব ধর্মালম্বীদেরকেও নাস্তিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিছু নাস্তিক ব্যক্তিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, হিন্দু ধর্মের দর্শন, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং প্রকৃতিবাদে বিশ্বাস করে।
নাস্তিকরা কোনো বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী নয় এবং তারা বিশেষ কোনো আচার অনুষ্ঠানও পালন করে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ, যে কোনো মতাদর্শের সমর্থক হতে পারে, নাস্তিকদের মিল শুধুমাত্র এক জায়গায়ই, তা হলো, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অবিশ্বাস করা। [বাংলা মুক্ত বিশ্বকোষ ইউকিপিডিয়া]
বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদী তৎপরতার গোড়ার কথা :
ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশে নাস্তিকের সংখ্যা বরাবরই কম ছিল। এরা সংখ্যায় কম হলেও এদের প্রচার ও বুদ্ধিবৃত্তির বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপরীতে অবস্থান নেবার দুঃসাহস দেখাতে পারছে। মূলত গেল শতাব্দীর শুরুভাগে রাশিয়ার কমিউনিজমে বিশ্বাসীরা এ দেশে নাস্তিকতার প্রসার ঘটিয়েছে। সারাবিশ্বে সমাজতন্ত্রের জয়জয়কারের সঙ্গে হাত ধরে সেক্যুলারিজম আর সেক্যুলারিজমের গর্ভ থেকেই নাস্তিক্যবাদ বা এইথিজমের উদ্ভব ও আগমন। সমাজতন্ত্রের যৌবনে এরা প্রধানত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তাদের মতবাদ প্রচার করতে শুরু করে।
সমস্যা জর্জরিত সদ্য স্বাধীন অভাবী বাংলাদেশে এরা সহজেই তাদের সাম্যের মুখরোচক শ্লোগানে তরুণ সমাজকে মুগ্ধ করে। সমাজতন্ত্রের পতনের পর এরা পরিবর্তিত বাস্তবতায় নিজেদের ভোল পাল্টাতে থাকলেও সাবেকি ধর্মবিদ্বেষ তথা ইসলামবিদ্বেষের ধারা ঠিকই বজায় রাখে। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যর্থ হওয়ায় এরা সেটাকে ধর্মের বিরোধিতায় কাজে লাগায়। সিংহভাগ ঈমানদার নারী-পুরুষের আত্মোৎসর্গের বদৌলতে পাওয়া অত্যাচারী ও অবিবেচক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয়কে এরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবে চালাবার অপকৌশল গ্রহণ করে।
প্রকাশ্যে নাস্তিক্যবাদের প্রচার :
স্বাধীন হবার অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদের প্রকাশ্য রূপ দেখা দেয়। ১৯৭৩ সালে তরুণ কবি দাউদ হায়দার একটি কবিতায় অত্যন্ত নোংরা ভাষায় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিশুখ্রিস্ট ও গৌতমবুদ্ধকে নিয়ে ন্যাক্কারজনক কবিতা লেখেন। যে কয়টি লাইনের জন্য তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তা ছিল এমন :
‘অদ্ভুত আলখেল্লা পরিহিত মিথ্যুক বুদ্ধ
বুধি বৃক্ষতলে যিশু ভন্ড শয়তান,
মোহাম্মদ আরেক বদমাশ
চোখে মুখে রাজনীতির ছাপ।’
সংবাদের সাহিত্যপাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ। সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে পুরো মুসলিম জাহান। বাংলাদেশ সরকার তখন চায় নি আন্তর্জাতিকভাবে মুসলিম সরকারদের সাহায্য হারাতে। ১৯৭৩ সালে বাধ্য হয়ে সরকার তাকে গ্রেফতার করে। কবিকে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেয়া হয়। ১৯৭৪ এর ২০ মে সন্ধ্যায় তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ’৭৪-এর ২১মে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নির্দেশে সুকৌশলে কলকাতাগামী একটি ফ্লাইটে তাকে তুলে দেয়া হয়। ওই ফ্লাইটে সে ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। তাঁর কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ (ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু’জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ।) কবির ভাষায়, ‘আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।’
’৭৬-এ দাউদ হায়দার তার পাসপোর্ট নবায়নের জন্য কলকাতাস্থ বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে জমা দিলে তা আটক করা হয়। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে তিনি আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেন। তার পাসপোর্ট ফেরতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এরশাদ সরকারও।
কলকাতা ছিল তার কাছে একদম অচেনা বিদেশে যেখানে কাউকেই চিনতেন না। তিনি দমদম এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমে কাঁদছিলেন। কলকাতায় তিনি প্রথম গৌরকিশোর ঘোষের কাছে আশ্রয় পান। তিনি সেখানে এক মাসের মতো ছিলেন। তিনি সেখানে লেখালেখি শুরু করেন। কলকাতার কঠিন বাস্তবতার মাঝে তিনি দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৭৬ সালে তিনি ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়নের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। ভারত থেকেও তাকে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়।
পাসপোর্ট ছাড়া অন্য আরেকটি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসে সমস্যা দেখা দেয়। ভারত সরকার দায়িত্ব নিতে চায় না নির্বাসিত কবির। তিনি অন্য কোনো দেশেও যেতে পারেন না পাসপোর্টের অভাবে। এমতাবস্থায় তার পাশে এসে দাঁড়ান কবিবন্ধু নোবেল বিজয়ী জার্মান কবি গুন্টার গ্রাস। তিনি জার্মান সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত কবিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ২২ শে জুলাই ১৯৮৭ এর কোনো এক ভোরে জার্মানির বার্লিনে গিয়ে পৌঁছান দাউদ হায়দার। জাতিসংঘের বিশেষ ‘ট্রাভেল ডকুমেন্টস’ নিয়ে এখন ঘুরছেন দেশান্তরে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
তিনি প্রায় ৩০টির মতো বই লিখেছেন জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানিজ ও স্প্যানিশ ভাষায়। এছাড়া সাপ্তাহিক ২০০০ এ প্রকাশিত হওয়া তার আত্মজৈবনিক লেখা ‘সুতানটি সমামাচার” ২০০৭ সালে ধর্মীয় মুল্যবোধে আঘাত দেয়ার অভিযোগে সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
প্রয়াত ড. আহমদ শরীফ
বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদকে প্রকাশ্যে বলে বেড়াবার বিষয় হিসেবে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন চট্টগ্রামের প্রয়াত জ্ঞানপাপী ড. আহমদ শরীফ। সারা জীবন তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে নাস্তিক্যবাদ প্রচার করেন। মারা যাবার আগে তিনি নিজের দেহখানি মেডিকেলে চিকিৎসা সেবার জন্য দান (?) করে যান। মহৎ শিরোনামে মূলত একজন নাস্তিককে আল্লাহর সৃষ্ট মাটি তার পেটে ধারণে অস্বীকার জানায়। সারা জীবনের পাপের ফসল স্বরূপ আল্লাহ তাঁকে মাটির ঘরেও জায়গা পাওয়া থেকে বঞ্চিত রাখেন।
তাঁর জন্ম ১৯২১ খৃস্টাব্দে ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার সূচক্রদণ্ডী গ্রামে। পিতার নাম আব্দুল আজিজ ও মাতার নাম মিরাজ খাতুন। তাঁর পিতা আব্দুল আজিজ ছিলেন চট্টগ্রামের প্রধানতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট স্কুলের একজন করণিক। এ মুসলিম পরিবারের অন্দর মহলে শিক্ষার আলো ঢুকিয়েছিল উনিশ শতকেই। তাঁর ষষ্ঠ পূর্ব্বপুরুষ কাদের রজা সন্তানের জন্য কাজী দৌলতের সতী ময়না লোরচন্দ্রানী পুঁথিটি নিজ হাতে নকল করেছিলেন। তাঁর পিতামহ আইন উদ্দিন (১৮৪০-১৯৩৭) ছিলেন সরকারি জজ কোর্টের নকল নবিস। চট্টগ্রামের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম এন্ট্রাস পাস করা এবং বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি বলে খ্যাত আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ ছিলেন তাঁর কাকা ও পিতৃপ্রতিম। জন্মের পর থেকে আহমদ শরীফ সাহিত্যবিশারদ ও তাঁর স্ত্রীর কাছে পুত্র স্নেহে লালিত-পালিত হয়েছেন। ফলত অনেকের কাছেই তিনি সাহিত্য বিশারদের সন্তান হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৭ নভেম্বর সালেহা মাহমুদের সঙ্গে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর মৃত্যু ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯। [বাংলা ইউকিপিডিয়া]
আহমদ শরীফ ১৯৩৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল হতে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪০ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ হতে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক পাস করেন। পরবর্তীকালে ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ২য় বিভাগে ৪র্থ স্থান অধিকার করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে সৈয়দ সুলতান তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর লিখিত পুস্তকের সংখ্যা শতাধিক। তাঁর প্রথম সম্পাদিত গ্রন্থ লায়লী মজনু ১৯৫৭ খৃস্টাব্দে প্রকাশ করেন। ১৯৫৯ খৃস্টাব্দে মৌলিক গ্রন্থ বিচিত চিন্তা প্রকাশ করেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থের মধ্যে স্বদেশ অন্বেষা, মধ্যযুগের সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, বাংলার সুফি সাহিত্য, বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা, বাংলার বিপ্লবী পটভূমি, এ শতকে আমাদের জীবনধারার রূপ রেখা, নির্বাচিত প্রবন্ধ, প্রত্যয় ও প্রত্যাশা এবং বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। [প্রাগুক্ত]
ইউকিপিডিয়ায় তাঁর জীবনী আলোচনায় ‘ধর্মবিরোধিতা’ নামে একটি স্বতন্ত্র উপশিরোনাম লিখিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ‘তিনি জন্মসূত্রে মুসলমান হলেও স্বঘোষিত নাস্তিক। কুসংস্কার, ক্ষুধা, রোগ শোকে জর্জরিত, ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন অবহেলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দ্রোহী পুরুষ ড. আহমদ শরীফকে ধর্মান্ধরা শাস্ত্র ও প্রথা বিরোধিতার কারণে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে এক অসিয়তনামার মাধ্যমে তার মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান করার কথা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। সে অসিয়তনামায় লেখা ছিল, ‘চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণ প্রতীক, কাজেই গোটা অঙ্গ কবরের কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাইতো বাঞ্ছনীয়’। তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের জন্য দান করে দেয়া হয়।’
নাস্তিকরা সংখ্যায় কম আর বিগত শতাব্দীর বাম সংগঠনগুলো রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ বা কোণঠাসা হলেও তাদের শিক্ষায় দীক্ষিত এবং তাদের মতবাদে পরিপুষ্ট লোকেরাই বর্তমান বাংলাদেশের সিংহভাগ মিডিয়ার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর্ণধার। কিছু ব্যতিক্রম বাদে নাস্তিক্যবাদীরাই এ দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবী। ফলে তাদের শতধা বিভক্ত সংগঠনগুলোর কর্মসূচিতে সমর্থকের সংখ্যা হাস্যকর হলেও দেশের কর্তা ও পরিচালকদের প্রতি তাদের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। সতীর্থ মিডিয়াগুলো বরাবর তাদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মহাগুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করে। ইসলামপন্থীদের অবহেলা ও অনুপস্থিতির সুযোগে আজকের বাংলাদেশে যত ধারার মিডিয়া আছে সবগুলোয়ই তাদের প্রভাব ও দাপট ধ্রুব সত্য। তাদের পরিচালিত মিডিয়াগুলোর প্রতাপ এতোটাই বেশি যে এর বিপরীত দাঁড়ানো অনেক অনেক কঠিন ব্যাপার।
বর্তমান প্রজন্মের নাস্তিক্যবাদীদের গুরু :
আহমদ শরীফের পর তার ভাবশিষ্য গণধিকৃত ও দেশান্তরিত সস্তা লেখিকা তসলিমা নাসরিন এবং তার মতো আরেক জ্ঞানপাপী ড. হুমায়ুন আজাদ বর্তমান প্রজন্মের নাস্তিকতায় পথিকৃতের ভূমিকা রাখেন। ইউকিপিডিয়ায় তাঁর ধর্ম পরিচয়ে লেখা আছে, ‘স্বঘোষিত নাস্তিক’। সেখানে তাঁর বিশ্বাস ও দর্শন উপশিরোনামে বলা হয়েছে, ‘হুমায়ুন আজাদ ছিলেন স্বঘোষিত নাস্তিক। তাঁর অন্যতম প্রণোদনা ছিল প্রথা-বিরোধিতা। কবিতা, উপন্যাস ও রচনা সর্বত্রই তিনি প্রথাবিরোধী ও সমালোচনামুখর। তিনি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকেই মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ গড়ার পক্ষে অনুকূল বলে মনে করতেন। [প্রাগুক্ত]
হুমায়ুন আজাদ রাড়িখালের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৬২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ১৯৬৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। মেধাবী ছাত্র আজাদ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৭৬ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ। তাঁর স্ত্রী লতিফা কোহিনুর। তাঁর দুই কন্যা মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং একমাত্র পুত্র অনন্য আজাদ। হুমায়ুন আজাদ ১১ আগস্ট ২০০৪ সালে জার্মানির মিউনিখ শহরে মৃত্যুবরণ করেন। [প্রাগুক্ত]
১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধের বই নারী। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে বইটি নিষিদ্ধ করে। অবশ্য ৪ বছর পর ২০০০ সালে বইটি আবার পুনর্মূদ্রিত হয়। তাঁর লিখিত ‘আমার অবিশ্বাস’ (১৯৯৭), ‘ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য’ (২০০৪), ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’ (১৯৯২) ‘১০,০০০, এবং আরো একটি ধর্ষণ’ (২০০৩), এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (২০০৪) প্রভৃতি বইতে চরম ধর্মবিদ্বেষ ও জ্ঞানপাপের পরিচয় দিয়ে ধর্মবিশ্বাস বিশেষত ইসলামের বিরুদ্ধে মুক্ত কৃপাণ হাতে হামলা চালিয়েছেন। তাঁর লিখিত অনেকগুলো বই থেকে কেবল চরম ইসলামবিদ্বেষী, অরুচিকর ও পাঠকনিন্দিত উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ নিয়ে একটি স্বতন্ত্র আলোচনা উপস্থাপন করছি। এ থেকেই যে কোনো পাঠক লেখকের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও ইসলামবিদ্বেষ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবেন আশা করি।
হুমায়ুন আজাদের পাক সার জমিন সাদ বাদ :
বিখ্যাত হুমায়ুন আজাদের কুখ্যাত পাক সার জমিন সাদ বাদ বেশ কবার শুরু করেছি। অতি কষ্টেও দশম পৃষ্ঠা পেরোতে পারি নি। সম্ভবত চতুর্থবারের মতো এবার শেষ করার পণ নিয়ে শুরু করি। এবারও বুঝি রণে ভঙ্গ দিতে হয়। একদিনে ৩৮ পৃষ্ঠা পড়া হয়। বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রত্যেক শব্দ-হরফের অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ হেন ব্যবহার নেই যা তিনি এখানে আনেন নি। জানি না শিল্পিত বর্ণনায় এমন অশিল্পীসুলভ উপন্যাস দ্বিতীয়টি রচনা করেছেন কিনা। অন্ধ বিদ্বেষ, নির্জলা মিথ্যা আর কল্পনার অপব্যবহার কী ও কেমন তা জানতে এরচে আদর্শ কোনো বই হয় না। সংবাদপত্রের মতো উপন্যাসও সমাজের দর্পণ। সে অর্থে আলোচ্য উপন্যাস প্রয়োজনীয় পাশ নাম্বারও পায় না। লেখক জোর করে যেসব চরিত্র ও চিত্র উপস্থাপন করেছেন তার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের মুসলিমপ্রধান সমাজে একটিও দেখানো সম্ভব নয়। অথচ বিবেকের মাথা খেয়ে লেখক এমনই সব চরিত্র বাংলাদেশের ইসলাম ও ডানপন্থী বৃহত্তম দল দুটির ওপর চাপিয়েছেন। ইসলামবিদ্বেষের সঙ্গে সঙ্গে লেখক যে বাংলাদেশের একটি বড় দলের দালালির এজেন্ডাও রাখতেন, তা এ উপন্যাসেই প্রথম টের পেলাম।
প্রতিভা থাকলেই তা পূজনীয় নয়। সুন্দর প্রতিভার যিনি অসুন্দর প্রয়োগ ঘটান, তিনি স্রষ্টার অকৃতজ্ঞ বান্দাই শুধু নন; আত্মোম্ভরি প্রচণ্ড জ্ঞানী শয়তানেরও দাস। এতদিন ইসলামবিদ্বেষী জানা সত্ত্বেও লেখকের প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করতাম, এখন জানলাম তিনি শুধু জ্ঞানী নন; জ্ঞানপাপী। এমনকি জ্ঞানপাপীই শুধু নন, বিবেকপ্রতিবন্ধীও। যে কোনো জাতি-ধর্মের লেখক কিংবা বিদগ্ধ পাঠক এমন বিকারগ্রস্ত বাস্তবতাবিবর্জিত আরোপিত চরিত্রের উপন্যাসের নিন্দা না করে পারবেন না। এদেশের তথাকথিত কিছু প্রগতিশীল লেখক এর পক্ষে কীভাবে সাফাই গান তাও গবেষণাসাপেক্ষ ব্যাপার। তবে নিজেকে প্রগতিশীলদের কাতারে দেখাতেই যে তারা এমন আবর্জনার গুণ গেয়ে থাকেন, তা গবেষণা ছাড়াই বলা যায়।
লেখক প্রতিটি পৃষ্ঠায় একাধিক প্যারায় বিভিন্ন মানুষ ও দলের চরিত্র হননের প্রয়াস পেয়েছেন। কোনোটাই সবার সামনে উপস্থাপনযোগ্য নয়। যে কোনো দৃষ্টান্ত দিলেই পাঠকমাত্র ঘেন্নায় নাকে হাত দিতে বাধ্য হবেন। তথাপি একটি প্যারা উল্লেখ করে সামান্য বিশ্লেষণ না করলে কেউ অযথা নিন্দা বা বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ আনতে পারেন। তাই বাধ্য হয়েই একটি উদ্ধৃতি পেশ করছি : ‘জিহাদি হাফিজুদ্দিনটা একটু বেতমিজ, মুখে চমৎকার চাপদাড়ি, স্বাস্থ্যটাও ভালো; একাই দু-তিনটি দোকান ভাঙতে পারে, কয়েকটিতে আগুন লাগাতে পারে, গুলি চালাতে পারে, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’ ব‘লে ছুরি ঢুকোতে পারে; ফিরে এসে একটির পর একটি এক্সএক্সএক্স দেখতে পারে, সবই ইন্ডিয়ান, বড়ো দুধ আর বড়ো মাজা ওর পছন্দ, চাকরানিটাকে ডেকে এনে ঘণ্টাখানেক ধ’রে অরাল-অ্যানাল-ভ্যাজাইনাল করতে পারে, তারপর উঠে গিয়েই মধুর স্বরে ওয়াজ করতে পারে, ফতোয়া দিতে পারে।’
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ইসলামের শাশ্বত শান্তির সুমহান বাণী প্রচার করে বেড়ানো ওয়ায়েজদেরকে লেখক (১) জিহাদি ও জঙ্গি (২) ধর্ষক ও লম্পট এবং (৩) ভণ্ড ও চরিত্রহীন বানাতে চেয়েছেন। যে কিনা মুখে দাড়ি রেখে মানুষের বাড়ি বাড়ি খেয়ে মোটা-তাজা হয়ে সংখ্যালঘুদের দোকানপাট ভাঙে, তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে, আল্লাহর নাম নিয়ে মানুষ খুন করে, তারপর ব্লু-ফিল্ম দেখে, ইন্ডিয়ান বারবণিতাদের দেখে কাজের মেয়ের সঙ্গে নানাভাবে বিকৃত যৌনাচার চালায়। আর এতসব অপকর্ম করে তিনি মধুর সুরে ওয়াজ করেন আর ফতোয়া দেন! পাঠক বলুন, এমন মারাত্মকসব বিপরীতমুখী চরিত্রের একজন ব্যক্তিও কি দেখাতে পারবেন?
কী বিপদের কথা, এত বড় বড় সব পণ্ডিত লেখকরা যখন ইসলামের হক-বাতিল নানা ফেরকাকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, তখন তাদের মূর্খও বলতে পারি না। হতে পারে তারা সজ্ঞানে সবগুলো ইসলামের সপক্ষশক্তির চরিত্র হনন করে কেল্লা ফতে করতে চান। নিচের উদ্ধৃতি খেয়াল করুন। কিভাবে তিনি ইরানের কট্টর শিয়া আর আফগানের কট্টর সুন্নিদের এক কাতারে এনেছেন। বাংলাদেশের জামাতে ইসলামসহ সব ইসলামিদের একসঙ্গে ভজঘট পাকিয়েছেন :
‘জিহাদিদের একটি মহান গুণ হচ্ছে তারা মালাউন মেয়ে পছন্দ করে। আমিও করি, ওদের একটু খেলাতে পারলে ওরা উর্বশীদের মতো নাচে; আমার জিহাদিরা অবশ্য নাচটাচ পছন্দ করে না, ওরা ঢুকতে বেরোতে পারলেই শুকরিয়া আদায় করে। এতে প্রধান প্রতিভা তালেবান মোঃ হাফিজুদ্দিন, ও হয়তো ফেরেশতাদের কাছে থেকে কোনো হালুয়া লাভ করে; তবে মোঃ কেরামত আলি, মোঃ মোস্তফা, মোঃ আকবর আলিও কম যায় না, এটা আমি পছন্দই করি, জিহাদে কোনো কম যাওয়া-যাওয়ি নেই, তাতে জোশ কমে যায়। ওরা যখন একেকটি মালাউন মেয়ের ওপর চড়ে, তখন ওরা মনে করে ওরা একেকটি নাছারা নগর ধ্বংস করছে, যার নির্দেশ রয়েছে। আমি আশ্চর্য হই, ওরা রুহুল্লা খোমেনির কিছুই পড়ে নি, কিন্তু চিন্তা ও কর্মে তাঁকেও ছাড়িয়ে গেছে।’
না হলো না। আরও একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে হয় : ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম আমাকে উদ্দীপ্ত করে, আমি প্রচণ্ড উত্তেজনা বোধ করি, ওই উত্তেজনা দেহের বিশেষাঙ্গের উত্তেজনার থেকে অনেক বেশি তীব্র, অনেক বেশি প্রচণ্ড; আমি দেখতে পাই আমি বেঁচে উঠছি, আমি বেহেশতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠি। মওলানা মওদুদি, ইমাম গাজালি, আয়াতুল্লা খোমেনির বই, আর কোরান-হাদিছ, নেয়ামুল কোরআন, মুকছেদুল মমেনিন, বেহেস্তের জেওর প’ড়ে আমি বুঝতে পারি এতোকাল আমি ভুল পথে ছিলাম, দোজগের রাস্তায় ছিলাম, এখন আমি ঠিক পথে এসেছি; এখানে সব সময়ই খোয়াব, সব সময়ই উত্তেজনা; পৃথিবীতে মুছলমান আর ইছলাম ছাড়া আর কিছু থাকবে না, এ-বিশ্বাস আমাকে মাতাল ক’রে তোলে- নাউজুবিল্লা, ‘মাতাল’ শব্দটি ঠিক হয় নি, আল্লা আমাকে মাফ করবেন; এ-সময়ই আমি একটি চমৎকার জীবন পাই। জামাঈ জিহাদে ইছলামে যোগ দেয়ার পর প্রায় সবই পাই, বেহেশত তো পাবোই। যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আমি জামাঈ জিহাদে ইছলাম-এর ‘মদিনাতুন্নবি’ অঞ্চলের নেতা হয়ে উঠি, আমার খুব চেষ্টা করতে হয় না; আমার প্রধান নেতারা বুঝতে পারেন যে-তিরিশটি মাদ্রাছার তালেব এলেম নিয়ে এ-আঞ্চলিক সংঘটি গঠিত, ওই সব হাফেজিয়া ফোরকানিয়া কওমি কামিল দাখিল সাধারণ মাদ্রাছার তালেবানদের মাথায় ঘিলু নেই, যেমন তাদের মাথাও নেই, তাদের মগজ অন্য জায়গায়; তাই যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আমি নেতা হয়ে উঠি, যা আমি কখনো হই নি।’
এ পর্যায়ে এসে আমি উপন্যাসের বাকি পৃষ্ঠাগুলোয়ও নজর বুলাই। আরও কত নোংরা বর্ণনা। অশ্লীল রচনা। লেখক প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় দিয়েছেন ইসলামপন্থী আর লেখকের ভাষায় জিহাদিদের ধর্ষণ ও নারীলিপ্সার কল্পিত দিগম্বর বর্ণনা। ইসলামের অনুসারীদের নানা চরিত্রহীনতা, নষ্টামী ও ভণ্ডামির চতুর উপস্থাপনা। শিল্পিত ভাষায় এবং অশ্লীল বয়ানে যে এমন সাহিত্য তৈরি হতে পারে তা এ উপন্যাস না পড়লে পাঠকের বিশ্বাস হত না। লেখক তার একাধিক বক্তব্যে নিজেকে শুধু নাস্তিক হিসেবেই প্রমাণ করেন নি, কুফরির শর্তগুলোও পূরণ করেছেন।
বইমেলা থেকে ফেরার পথে অজ্ঞাত পরিচয়ধারীদের হামলায় তিনি প্রচণ্ড আহত হন। পরবর্তীতে তিনি বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রহস্যজনকভাবে মারা যান। তার মৃত্যুর পর এমন একজন ধর্মবিদ্বেষী আল্লাহদ্রোহীর জানাযা পড়াতে অস্বীকার করায় মসজিদের ইমামকে সমালোচনার শিকার হতে হয়। যে ইমাম তথা দীনদারদের সমালোচনা আর কলঙ্কিত করা ছিল মৃত লোকটির জীবনের প্রধানকর্ম তার জানাযা পড়াতে বাধ্য করা হয় তেমনি এক ইমামকে। নাস্তিক আর প্রগতিশীলদের স্ববিরোধ আর ভণ্ডামির এও এক নজির। আরে বাবা, এতই যদি তুমি ইসলামকে ঘৃণা করো, কুরআন আর আল্লাহকে অস্বীকার করো তবে কেন তোমাকে মৃত্যুর পর ইসলামের নিয়মে দাফন করা হবে? তোমাকে তো মাটিতে পুঁতে রেখে আসা উচিত।
এমন দেশ-ধর্ম ও বিবেকবিরোধী লেখার জন্য লেখকের মরণোত্তর ফাঁসি দেওয়া উচিত। আর আখিরাতে তাদের অবস্থা কী হবে সে তো বলাইবাহুল্য। যারা এখনো তার আদর্শের ধারক ও প্রচারক হয়ে বেঁচে আছেন, তাদেরকে সময়ের আগে সোজা হয়ে যাবার, সুপথে ফিরে শান্তির জীবন লাভের আহ্বান জানাই। মরার পর যখন আত্মীয়-পরিজন-সুহৃদরা আপনার জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ আর বেহেশত কামনা করবে, তার আগেই হেদায়েতের পথ ধরুন। পৃথিবীর জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি আল্লাহর দেয়া অবিনশ্বর জ্ঞানেরও স্বাদ নিন। নিজেকে জানুন এবং আল্লাহকে চিনুন।
নাস্তিক্যবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমাবেশ :
নাস্তিক্যবাদী তৎপরতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যাক। বাংলাদেশে সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দলের কিছু নেতার ফাঁসির দাবিতে রাজধানী শাহবাগ চত্বরে বাম ও নাস্তিকদের নেতৃত্বে কথিত গণজাগরণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। একদল দলনিরপেক্ষ তরুণের হাতে শাহবাগ চত্বরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনের সূচনা। গোড়ায় তাদের দাবিগুলোও ছিল অরাজনৈতিক। আয়োজকরা যদিও রাজনীতিকদের বক্তব্য না দেবার যুক্তি দেখিয়ে বলবেন, শুরুর মতো শেষ পর্যন্ত আন্দোলন তার নিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রেখেছে। তবে বাস্তবতা হলো, পরবর্তীতে ক্রমেই এ আন্দোলন দলীয় লোকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সরকার নিজেই এই আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পত্রিকায় তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে দেশের বাম অধ্যুষিত ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়াগুলো এ আন্দোলন থেকে তাদের আদি স্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে দাবির তালিকায় একে একে যোগ হয় নানা অগণতান্ত্রিক, ইসলামবিদ্বেষী ও দেশবিরোধী ধারা।
দাবি হতে পারত অপরাধীদের ফাঁসি চাই যদি সত্যিই তারা দোষী হয়ে থাকেন। অথচ এখন কথিত সব রাজাকারেরই ফাঁসি দাবি করা হচ্ছে। তাতেও সমস্যা ছিল না যদি প্রকৃতই সবাই রাজাকার হতেন। এখন রাজাকার বলতেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে একটি সম্প্রদায় কিংবা নির্বিচারভাবে টুপি-দাড়িওয়ালাদের দিকে। আরও ভয়ঙ্কর প্রবণতা হলো, বামদের মতলবি শ্লোগানে গলা না মেলালেই তাকে বলা হচ্ছে রাজাকার! স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াও রাজাকার! বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে নির্ভয় ও অকুণ্ঠ প্রতিবাদকারী মুক্তিযুদ্ধের অনন্য বীর কাদের সিদ্দিকীও রাজাকার! বলি, আন্দোলনের ফলে যদি একশ রাজাকারের যোগ্য শাস্তি হয় আর ফাঁসি হয় মাত্র একজন নির্দোষ ব্যক্তির তবে কি লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে না? আইনশাস্ত্রের ভাষায় তো দশজন অপরাধীর শাস্তির চেয়ে একজন নিরপরাধীকে বাঁচানো উত্তম।
সন্দেহ নেই নিরপেক্ষ পটভূমিতে দাঁড়িয়ে যে কোনো অপরাধীর ন্যায্য ও প্রাপ্য শাস্তি দাবি করা একটি প্রশংসনীয় কাজ। এ কাজে আর সবার মতো আমারও সমর্থন প্রশ্নাতীত। কিন্তু তাই বলে কি এ আন্দোলনের প্রতি সমর্থনকে দেশের প্রতি ভালোবাসার অপরিহার্য শর্ত মনে করা যায়? কোনো কারণে এ আন্দোলনে সমর্থন না করতে পারলে কি তার দেশপ্রেম মিথ্যে হয়ে যাবে? সাধারণ মানুষ আড়ালের অনেক খবর জানেন না। মিডিয়ার কারসাজি আর পুতুলখেলা অনেকেই বুঝতে পারেন না। কিন্তু যিনি অন্তরালের খবর রাখেন, মিডিয়ার ভেতরের অবস্থা যার নখদর্পনে তিনি তো ভিন্নমত দিতেই পারেন। এমতাবস্থায় দেশপ্রেমিক হিসেবে তার দায়িত্ব নয় কি অন্যদেরও প্রতারিত হওয়া থেকে সাবধান করা? অন্যের স্বার্থ হাসিলের গুটি হওয়া থেকে সতর্ক করা?
একটি শান্তিপূর্ণ গণজমায়েতে কেন ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে দাঁড়ানো আমার দেশ ও নয়াদিগন্ত পোড়ানো হবে? কেন ভিন্নমত প্রকাশ করায় গণমাধ্যমকে হুমকি দেয়া হবে? দলীয় ব্যক্তির অপরাধে কেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হবে? ভিন্নমত পোষণ করলেই কেন তার নাগরিকত্ব বাতিলের দানবীয় হুমকি প্রদান করা হবে? কেন শাহবাগে অনুষ্ঠিত ইসলাম ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের খবর তুলে ধরায় একটি দৈনিকের সম্পাদকের শাস্তি, কারাদণ্ড ও মৃত্যু কামনা করা হবে? কেন রাজাকারের শাস্তি চাওয়ার নামে টুপি-দাড়িসহ সব ইসলামী পোশাককে হেয় করা হবে। ইসলাম চর্চাকারীদের চরিত্র হনন করা হবে? একটি ভালো কাজের ছুতোয় কি দশটি মন্দ কাজকে প্রশ্রয় দেয়া যায়? আজ যারা দেশপ্রেমে গদগদ হয়ে পথে নেমেছেন ফেলানীর লাশ যখন তিনদিন পর্যন্ত ভারতের কাঁটাতারে ঝুলেছিল তখন তারা কোথায় ছিলেন? পদ্মাসেতু, শেয়ারবাজার আর হলমার্কের কুমির-দস্যুদের অপরাধ দেখে তাদের দেশপ্রেম কেন জেগে উঠল না? ব্রাক হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক ধর্ষিতা হয়ে খুন হলে কেন তারা জাগলেন না? প্রতিদিন কত অসহায় নারী ধর্ষিতা ও খুন হচ্ছেন তাদের নির্যাতনে জড়িতদের বিচার চেয়ে কেন তারা পথে নামেন নি? মসজিদের মাইকে আযানের সুরে যারা রোগীদের কষ্টের কথা বলেন, তারা কেন বারডেম ও পিজি হাসপাতালের পাশে মাসের পর মাস এত চিৎকার-চেচামেচিতে রোগীদের কষ্ট অনুধাবন করেন না? মিডিয়া এদের পেছনে হাওয়া দিতে থাকায় অসহায় রোগী কিংবা হাসপাতাল দুটির চিকিৎসকরা এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সাহস পাচ্ছেন না।
নিরপরাধ মানুষকে যারা হত্যা করেছে, নিরীহ মা-বোনকে যে নরপশুরা ধর্ষণ করেছে তাদের মৃত্যুদণ্ড দাবি তো কুরআনেরই দাবি। কিন্তু এদের ফাঁসির দাবির সঙ্গে কণ্ঠ মেলাবার পর শাহবাগে আর যা হচ্ছে একজন মুসলিম হিসেবে তার ক’টি কাজ আমরা সমর্থন করতে পারি? নাচ-গান, নারী-পুরুষের খোলামেলা ঘেঁষাঘেঁষি, মঞ্চে তরুণীদের উদ্বাহু নৃত্য কিংবা গলা ফাটানো গান ও শ্লোগান, মানুষের চেহারা বিকৃতি, প্রাণীর ছবি অঙ্কন ইত্যাদি- সবগুলোই ইসলামের দৃষ্টিতে চরম গর্হিত কাজ। কোনো মুসলিম এসব সমর্থন করতে পারেন না। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তির দাবি প্রতিটি মুসলিমেরই করা উচিত। কিন্তু এসবের কোনোটার সঙ্গে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী কেউ জড়িত হতে পারেন না। আন্দোলন থেকে যে কর্মসূচিগুলো ঘোষিত হচ্ছে তার মধ্যেও তো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কোনো ছাপ নেই। বিজাতীয় মোম প্রজ্বলন আর মৌনব্রত রীতি চর্চা কেন আমাদের প্রতিবাদের ভাষা হবে?! জাহানারা ইমামের প্রতিকৃতি স্থাপন আর তার সামনে খ্রিস্টীয় পদ্ধতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে কোন দুঃখে?!
শাহবাগের আন্দোলন তার কুমারিত্ব হারিয়েছে। অবশ্য আন্দোলনের অনেক অগ্নিকন্যা তাদের মূল্যবান সে জিনিসটি হারিয়েছেন অনেক আগেই। বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে আড্ডা আর ঘনিষ্ট হবার এমন সুযোগ রাজধানীর কোন জুটিই বা লুফে নিতে চাইবে না। অদূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাঁকা হলও অনেকের জন্য সুবর্ণ সুযোগ বয়ে এনেছে। আর সরকারের প্রত্যক্ষ সাহায্য-সহযোগিতা এবং বামদলগুলোর নেতৃত্বও এ আন্দোলনের সতীত্ব হরণ করেছে। প্রকাশ্যে সাপের মতো করে মানুষ হত্যাকারী সন্ত্রাসীদের মঞ্চে অবস্থানও একে কলঙ্কিত করেছে। কাদিয়ানী ও রাজাকার নুরুল ইসলাম আজ দল বদলেছেন বলে তিনি হয়ে গেছেন স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোক! হায় পরিহাস, রাজাকার নুরুল ইসলামও এখন ফাঁসির দাবির মঞ্চে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন! বলি, বন্ধুরা আমাকে ক্ষমা করো। সম্ভব হলে আমার প্রশ্নগুলোর সত্যনিষ্ঠ উত্তর তালাশ করো।
সময় হয়েছে শাহবাগ তথা নাস্তিক্যবাদীদের সীমালঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার। শাহবাগে যা হচ্ছে তার ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করার। ইতোমধ্যে অবশ্য সে আওয়াজ ধীরে ধীরে বিভিন্ন দিক থেকে উঠতেও শুরু করেছে। পত্রিকার ভাষ্য মতে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠকেও শাহবাগ উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারে থাকা প্রতাপশালী বাম নেতৃত্বের প্রভাবে তা হয়ে উঠছে না। এখনই যদি শুভ বোধসম্পন্ন লোকেরা এর ইতি-নেতি নিয়ে আওয়াজ না তোলেন তবে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে। এ দেশের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব হুমকির পড়বে। বিপক্ষ মত দমন আর একদলীয় লেজুড়বৃত্তির ফ্যাসিবাদী মনোভাব প্রতিষ্ঠা পাবে। আজ আপনারা যদি কথা না বলেন, তবে কালকে এরা মুক্তিযোদ্ধা কোটার মতো শাহবাগ কোটা বরাদ্দের দাবি তুলবে সরকারি পদে। ইমাম সাহবেগণ যদি এর বিরুদ্ধে মুসল্লীদের সজাগ না করেন তবে এ দেশে ইসলাম বিপন্ন হয়ে পড়বে। আপনার মিম্বারের বিরুদ্ধেও শ্লোগান উঠবে। আজ এরা ত- তে তুই রাজাকার বলতে বলতে ই- তে তুই ইসলাম তুই রাজাকারও বলে বসেছে!
দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষ যখন এই নাস্তিক ব্লগারদের ঘৃষ্টতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসার অপরিহার্য শর্ত পূরণে দগ্ধ হৃদয়ে পথে নেমে এদের শাস্তি দাবি করেন, তখন বাংলাদেশের নাস্তিক্যবাদপ্রভাবিত মিডিয়াগুলো এটাকে একটি দলের পক্ষের দালালি আন্দোলন বলে নির্জলা মিথ্যা প্রচারণা চালাতে থাকে। উপরন্তু মিডিয়াগুলো শাহবাগ ও নাস্তিকদের পক্ষে নির্লজ্জ মিথ্যাচার ও হলুদ সাংবাদিকতা চালিয়ে যায়।
আজ কয়েকদিন মনটা বড়ই ভারাক্রান্ত। কেবলই মিডিয়ার হলুদ সাংবাদিকতার বলি হচ্ছে আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যারা শহীদ হলেন আর যারা গুলি চালিয়েছেন- উভয় পক্ষ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসেন। সমমনা দুই দল মানুষ কেন একজন আরেকজনকে হত্যা করতে উদ্যত হবে?! হলো শুধু নির্লজ্জ, বিবেক ও প্রকৃত দেশপ্রেমহীন মিডিয়াগুলোর কারণে। দলকানারা ছাড়া শাহবাগের আন্দোলন সমর্থন বা প্রত্যাখ্যানকারী উভয় শ্রেণীর কেউই রাসূলকে অসম্মানকারীর সমর্থক হতে পারেন না। হলেন কেবল মিডিয়ার চাতুরির শিকার হয়ে। একশ্রেণীর মিডিয়া নবীর সঙ্গে বেয়াদবি করার প্রতিবাদকে বানাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর ষড়যন্ত্র, আরেক শ্রেণীর মিডিয়া শাহবাগের আন্দোলনকে বলছে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র। উভয়পক্ষ কিছু বাগাড়ম্বর করেছেন নিজেদের স্বার্থে। অথচ তারা দেশের প্রতি তাকান নি।
শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে আমাদের মাথাব্যথার কিছু ছিল না, যদি না সেখানে রাসূলকে কটাক্ষকারী কেউ আহ্বায়ক সংগঠক হতেন। আমার রাসূলকে গালি দেবেন আর উহ পর্যন্ত করতে দেবেন না, তা তো হয় না। রাজনীতিবিদদের বলি, আপনাদের গদি আপনাদেরই থাকুক, আমাদের ফিরিয়ে দিন শুধু ঈমানের যিন্দেগী আর ইসলামের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের অধিকার। আমরা রাসূলের ভালোবাসার জায়গায় কোনো আপস করতে পারি না।
নাস্তিক্যবাদীদের ভণ্ডামি :
সত্য কথা বললেই যদি হাজী সাহেবের মুখ খারাপ বলা হয় তাহলে তারা আবার কিভাবে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী দাবি করেন? তারা কীভাবে পরমত সহিষ্ণুতার পাঠ দেন? বিপক্ষ মত সহ্য করার কথা বলেন? কীভাবে তারা অন্যদের উগ্রবাদী আর মৌলবাদী বলেন? খোদ তারাই কি প্রতিক্রিয়াশীল অশুভ শক্তি নন? তারা আজ তাদের পুরনো যত আদর্শিক শত্রু রয়েছে, সবাইকে এই আন্দোলনের মাধ্যমে ঘায়েল করতে চাইছে। কাউকে এর বিপক্ষে কোনো যৌক্তিক প্রশ্নও তুলতে দিচ্ছে না। গণদাবির চেয়ে গোষ্ঠী ও শ্রেণীগত দাবিই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। এই হলো নাস্তিকদের প্রকৃত সততা।
নাস্তিকরা তাদের রাজনৈতিক গুরুর বিরুদ্ধে বললে স্বাধীন মত প্রকাশের কথা বলেন না, অথচ শত কোটি মানুষের প্রিয়তম ব্যক্তিত্ব, সর্বাধিক ভালোবাসার পাত্র মানবতার মুক্তির দূত নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্বোধ কিংবা বিবেকহীন সমালোচনা করা হলে, তাঁর বিরুদ্ধে অশালীন কটূক্তি করা হলে দোহাই দেয়া হয় এই মত প্রকাশের স্বাধীনতার! নেতার সমালোচনা করায় তৎক্ষণাত চাকরি হারায়, দিন না পেরোতেই জেলে বন্দি করা হয় অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমালোচনা এবং ইসলামকে তীব্র কটাক্ষকারী উন্মাদ ব্লগারদের রাষ্ট্র দেয় নিরাপক্তার জন্য গানম্যান! নাস্তিকদের ভণ্ডামি আর দ্বিমুখী নীতির দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীরা ইন্টারনেট ব্লগগুলোয় যে ভাষা ও ভঙ্গি প্রচার করে বেড়ান, তা তাদের অন্তরালের জীবনের মতোই ঘৃণ্য। অকল্পনীয় অশ্লীল এবং অসহনীয় মিথ্যায় ভরা। অথচ এ দেশের বাম-নাস্তিক অধ্যুষিত মিডিয়াগুলো বরাবর তাদেরই পক্ষ নিয়ে এসেছে। এও এক দ্বিচারিতা। আবার এদের ভণ্ডামি আর মুখোশ উন্মোচনের উদ্যোগ নেয়ায় বামনিয়ন্ত্রিত সরকারও এমন উদ্যোগ নেয় যা শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভণ্ডামির অন্যতম। ইসলামপন্থী মিডিয়ায় নাস্তিক ব্লগারদের ইসলাম ও রাসূল অবমাননার সংবাদ প্রকাশ হলে যখন সারা দেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে তখন তাদের বিরুদ্ধে নামকাওয়াস্তে ব্যবস্থা নিয়ে এসব প্রচার বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া হয়! আর ‘উস্কানি’ ও ‘ধর্মাবননা’র অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় অন্যায় মানুষের সামনে তুলে ধরা মাহমুদুর রহমানকে। রাসূলকে কটুক্তি করা অপরাধ নয়; কটুক্তির সংবাদ প্রচার করা অপরাধ। কী বিচিত্র মুসলিম দেশ! হায় সেলুকাস!
ইন্টারনেটে নাস্তিক্যবাদী প্রচারণার আধিপত্য :
তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে মত প্রকাশের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে ওঠা ব্লগকে একশ্রেণীর যুবক ইসলামের বিরুদ্ধে কুত্সা রটনার ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক যুবগোষ্ঠী মহান আল্লাহ, পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআন, মহানুভব নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ঈদ, সালাত, সিয়াম ও হজ সম্পর্কে কদর্য ভাষায় বিষোদ্গার করে মুসলমানদের ঈমান ও আকীদায় আঘাত হানছে। তাদের কুৎসিত ও অশ্লীল লেখা পড়লে যে কোনো মুসলমানের স্থির থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি বিবেকবান অমুসলিমদেরও গা শিউরে ওঠার কথা। ব্লগে ইসলামী বিধান, রীতি-নীতিকে কটাক্ষ করা হচ্ছে প্রকাশের অযোগ্য ভাষায়। নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক কাহিনী ও মতামত লেখা হচ্ছে অবলীলায়। ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মিরপুরে খুন হওয়া শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা আহমেদ রাজিব হায়দার ওরফে থাবা বাবা।
নিহত ধর্মদ্রোহী নাস্তিক ব্লগার রাজিব :
ইসলাম বিদ্বেষী কুখ্যাত ব্লগার রাজিব আততায়ীর হাতে খুন হয়েছে। সে শুধু একজন স্বঘোষিত নাস্তিক, ধর্মদ্রোহী মুরতাদই ছিল না, যথারীতি একজন লম্পট ও নারীলোলুপ নেশাকারীও ছিল। পত্রিকান্তরে সেসব খবর বেরিয়েছে। রাজিব খুন হওয়ার পর থেকেই এর জন্য বাংলাদেশের একটি ইসলামী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হয়েছে। অথচ পুলিশি তদন্তে প্রথমেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তার স্ত্রী ও প্রেমিকাকে। অকুস্থলে তার ল্যাপটপে নারীর চুল পাওয়া গেছে বলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাবে রাজিব নামের এ আলোচিত ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার সম্পর্কে জেনে অবাক হয়ে গেলাম। সে যা লিখেছে তা মুসলিম বা অমুসলিম তো দূরের কথা কোনো ভদ্র মানুষের ভাষা হতে পারে না। সে কোথাও কোথাও নিজের এবং নিজ সতীর্থদের পীর ড. হুমায়ুন আজাদকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওসব লিখে সে নিজেকে ইসলাম থেকে ছিন্ন করে নিয়েছে।
রাজিব ‘নুরানী চাপা’ নামের একটি ব্লগে নিয়মিত লেখালেখি করত। সেখানে ‘মোহাম্মকের (মোহাম্মদ+আহাম্মক) সফেদ লুঙ্গি, ঈদ মোবারক আর ঈদের জামাতের হিস্টরি, ঢিলা ও কুলুখ, সিজদা, হেরা গুহা, ইফতারি ও খুর্মা খেজুর, সিয়াম সাধনার ইতিবৃত্ত, লাড়াইয়া দে, মদ ও মোহাম্মক, আজল’ ইত্যাদি শিরোনামে বেশ কিছু বিতর্কিত ব্লগ লিখেছেন।
ফেসবুকে ইসলামকে কটাক্ষ করে রাজিবের কিছু মন্তব্য :
সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেসবুক ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর Ahmed Rajib Haider ফেসবুক এ জয়েন করে। তার ফেসবুক আইডি-https://www.facebook.com/rha.rajib। ২০১০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে সে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ১০ হাজার মানুষ হত্যার প্রামাণ্য অভিযোগ মাথায় নিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর হত্যা বার্ষিকীতে মুসলমানদের ধর্মীয় উত্সব পালন কতটা মানবিক?’ (সম্ভবত এদিন মুসলমানদের ঈদের দিন ছিল)।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে লিখেছেন, ‘সবাই তারেক-কোকো আর হাসিনা-খালেদার বিদেশে টাকা পাচারের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় করে ফেলছে... এদিকে প্রতি বছর সবার চোখের সামনে দিয়ে কয়েক লাখ হাজী যে মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা সৌদি আরবে ঢেলে দিয়ে আসছে সেটা কেউ টু শব্দটা করে না...!!’
২০১১ সালে নিজ ফেসবুক স্ট্যাটাসে মুসলমানদের নিয়ে কটাক্ষ করে লিখেছেন, “মুসলিমদের ‘টেররিস্ট’ আখ্যা দেয়া অন্যায়, তাদের জন্য উপযুক্ত নাম হলো ‘সিরিয়াল কিলার’!”
আবার ২৮ অক্টোবর ২০১২ তারিখে আরেক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমরা ঈশ্বর নামক কারও জারজ না... আমাদের বাবা-মায়েরা নিজেদের দৈহিক মিলনের মাধ্যমে আমাদের জন্ম দিয়েছে! আমার স্রষ্টা আমার জেনেটিক বাবা-মা, আমি তাদের সৃষ্টি। আবার আমি আমার সন্তানদের স্রষ্টা...তারা আমার সৃষ্টি!!! আর এই পুরো প্রকৃয়াটিতে বাবা-মায়ের বাইরে যদি কাউকে ধন্যবাদ দিতে হয়, সে হলো ধাত্রী অথবা ডাক্তার ও নার্স!’
আরও কিছু ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগার :
রাজিবের পাশাপাশি আরও যেসব ব্লগার শাহবাগের আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় ইসলামবিদ্বেষী লেখালেখি চালিয়ে আসছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো ডা. ইমরান এইচ সরকার, অমি রহমান পিয়াল, আরিফ জেবতিক, নিজেকে নাস্তিক দাবিকারী আসিফ মহিউদ্দিন, ইসলামবিদ্বেষী একটি রাজনৈতিক দলের কট্টরপন্থী ব্লগার ইব্রাহিম খলিল (সবাক) প্রমুখ। [নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ]
এছাড়া ইংল্যান্ড প্রবাসী ওই রাজনৈতিক দলের এক ব্লগার আরিফুর রহমানকে দেখা যায় নানা আপত্তিকর মন্তব্য করতে। তাদের মধ্যে আসিফ মহিউদ্দিন সামনের সারিতে থেকে শাহবাগের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আসিফ মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে নিজেকে নাস্তিক দাবি করলেও তার যত মাথাব্যথা ইসলাম ধর্ম নিয়ে। তবে কখনও কখনও সমন্বয়ের অংশ হিসেবে অন্য একটি ধর্মেরও সমালোচনা করে থাকে সে। একটি বিশেষ ধর্মের অনুসারী হলেও সে মুসলিম নাম ধারণ করে ইসলামকে বিতর্কিত করতে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে বলেও সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোয় অভিযোগ করা হয়। নিচে বর্তমানে সক্রিয় কয়েকজন বাম ও রাম ঘরানার রাজনীতির সমর্থক নাস্তিক ব্লগারের কটাক্ষপূর্ণ এরকম কিছু মন্তব্য তুলে ধরা হলো :
কুরআনের আয়াত ও ইসলাম নিয়ে আসিফ মহিউদ্দিনের কটাক্ষ : আসিফ মহিউদ্দিন একজন স্বঘোষিত নাস্তিক। সে কমিউনিজমে বিশ্বাসী। শাহবাগে প্রথম সমাবেশে সে একটি মিছিলে নেতৃত্ব দেয়। একটি ছবিতে দেখা যায় এ ধরনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ইসলামবিদ্বেষী বৃহৎ দলের বুদ্ধিজীবী ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ওইদিন তাকে পিঠ চাপড়ে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
আসিফ মহিউদ্দিন (গত ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১১:০০) ব্লগে একটি পোস্ট লিখেছেন। সেখানে ইসলাম ও কুরআনকে কটাক্ষ করে তার লেখা হলো : ‘বিসমিল্লহির রহমানির রাহিম। আউজুবিল্লা হিমিনাশ শাইতানির নাস্তিকানির নাজিম।’
গত বছরের ৫ মে পবিত্র কুরআন শরীফকে মহাপবিত্র ‘আহাম্মকোপিডিয়া’ লেখার মতোও ধৃষ্টতা দেখায় এ ব্লগার। তবে পরে তীব্র প্রতিবাদের মুখে এ পোস্টটি সে তার ফেসবুক থেকে সরিয়ে ফেলে (এর স্ক্রিন শট এখনও আছে)।
আসিফ মহিউদ্দিন তার ফেসবুক ওয়ালে পৃথিবীর সর্বযুগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে লিখেন, ‘মুহাম্মদ নিজেকে আইডল বা নিজেকেই ঈশ্বর না বলে একটি কল্পিত ঈশ্বরকে উপস্থাপন করেছেন। মানুষ যেন ব্যক্তিপূজায় আসক্ত না হয়, তাকেই যেন মানুষ ঈশ্বর বানিয়ে পূজা করতে শুরু না করে, সে ব্যাপারে তিনি কঠোর ছিলেন। তাই তার সমস্ত রচনাই তিনি আল্লার নামে চালিয়ে দিয়েছেন, এর রচয়িতা হিসেবে আল্লাকে সৃষ্টি করেছেন!’
আরেক পোস্টে এই কুলাঙ্গার লিখেছেন, ‘ধর্মান্ধ মুসলিমদের উত্তেজনার শেষ নেই। তাদের সকল আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে কে মুহাম্মদের ছবি আঁকলো, কে ধর্মের সমালোচনা করলো। অথচ এতে মুহাম্মদ/আল্লার কখনই কিছু যাবে আসবে না। ব্যাপারটা এমন নয় যে, মুহাম্মদের ছবি আঁকা হলে স্বর্গে মুহাম্মদ সাহেব কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে আত্মহত্যা করছেন! আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে, তার উম্মতরা ঠিকই তাকে একজন পীরে পরিণত করেছে।’
ফেসবুকে বিশ্বনবীর একটি কাল্পনিক ছবিকে দেখিয়ে তিনি লিখেছেন, এই ছবিটা মুহাম্মদের উন্মাদ উম্মতদের উদ্দেশ্যে একটা জবাব হতে পারে।’
ইসলামের বিধান পর্দা বা বোরকা নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বোরখা পরাটা সমর্থন করি না, বোরখা হিজাব মূলত আরবির বর্বর সমাজের প্রতীক। একটা সমাজে অত্যধিক বোরখার প্রাদুর্ভাব থাকা মানে হচ্ছে সেই সমাজের পুরুষগুলো সব এক একটা ধর্ষক, সেই ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সকল নারীকে একটা জেলখানা নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। এইসব অজুহাতে নারীকে যুগ যুগ ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে, কখনও ঘরের ভেতরে, আবার কখনও বোরখা নামক চলমান জেলখানার ভেতরে।’
ইসলামকে শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য দান নিয়েও কটাক্ষ করে তিনি লিখেছেন, ‘ধার্মিকদের মাথায় স্বার্থচিন্তা থাকে যে, এই উপকারে সে পরকালে হুর পাবে। এমনকি তারা কোন দরিদ্র, দুস্থ, পঙ্গু মানুষকে দেখলেও বেশিরভাগ সময়ই স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই ভাবে। আর যদি ওই পঙ্গু লোকটির কথা ভাবেও, তাতেও তাদের মাথায় থাকে স্বর্গে হুরী সঙ্গমের অশ্লীল চিন্তা।’
তার মতে, ‘জনগণের সুখ ও অর্থনৈতিক সাম্যের জন্য সর্বপ্রথম যা করতে হবে, তা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উচ্ছেদ।’ তবে ইসলাম ধর্ম নিয়ে এমন অবমাননামূলক ও উসকানিমূলক পোস্ট লেখায় তৌহিদী জনতার প্রচণ্ড আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত আসিফ মহিউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের কয়েকজনকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। তবে পাশাপাশি যেভাবে এদের মুখোশ উন্মোচনকারী মিডিয়ার সমালোচনা ও হুমকি দেয়া হচ্ছে তাতে তাদের শাস্তি নিশ্চিত হওয়া নিয়ে আমাদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে ।
বলা দরকার, কারো মনে বিশ্বাস না জন্মালে তিনি বিশ্বাস নাও করতে পারে। ধর্ম তাকে জবরদস্তি করতে বলে নি। কিন্তু কেউ চাইলেই বাকস্বাধীনতার নামে বিভৎস ও বিকৃত ভাষায় কোটি কোটি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কেন্দ্রে আঘাত করতে পারে না। সকল ধর্ম এমনকি তথাকথিত ধর্মনিরেপক্ষবাদও নাকি তাই বলে। আমাদের সংবিধান ও সরকারের ভাষ্যও তাই। সুতরাং কেউ যদি দেশে অশান্তি সৃষ্টিকারী কিছু ব্লগারের পক্ষে দাঁড়ান তবে তারাও তো সমান অপরাধী।
এদিকে আরিফুর রহমান (হুঙ্কারসহ নানা নামে লেখে) লিখেছেন, ‘আমি মনে করি আল্লা বিষয়টা মুহাম্মদের একটা বুজরুকি। ছিটগ্রস্ত মুহাম্মদ তার হ্যালুসিনেশনের সময় মনে করতো জিব্রাইল আইছে, তাই আল্লার কাল্পনিক কাহিনী বানিয়ে ধর্ম তৈরি করেছে। নাম দিয়েছে ইজলাম। এই হলো আল্লা বিষয়ে আসল কাহিনী।’
হিজাব নিয়ে আরিফ লিখেছেন, ‘হিজাব হলো ছৌদি নোংরামির চূড়ান্ত... কুত্তাদের কালো কাপড়ের কালচার। একে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়াটাই একটা বড় রকমের গুনাহ...!! হিজাবের বিরুদ্ধে পোস্টতো আসবই। ইসলামী পুরুষতন্ত্রের ছাগুরা।’
ইব্রাহিম খলিল নামের এক প্রতারক সবাক নামে লিখেছেন, ‘মির্জা সাথীর প্রোফাইট পিকচার সুন্দর। নিজের অজান্তেই লুল ফালাইতে ইচ্ছা কর্তাছে...’ আলআওয়াম আল আনয়াম (আওয়ামী লীগ চতুষ্পদ জানোয়ারের ন্যায়)। সুরা গো. আ, আয়াত-৪২০।’
ধর্ম নিয়ে সবাক লিখেছে, ‘শুয়রের বাচ্চারা বানাইছে একখান বালের ধর্ম। বৌ... (এতটা অশ্লীল শব্দ যে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না) কিছু কথা কইছে, আর... ফালানোর পর কিছু কথা বলে। দুইটাই শালাগো ধর্তব্য হইছে। বিশ্বাস হালকা কইরা স্বার্থবন্দী কথাগুলান যাচাই কইরা আবার ধার্মিকরাই বাহির কইরলো বিরাট ক্যারফা। তারপর ধর্মের গোয়া বাইর হইছে লস্করই-তাইয়্যিবাল, বাল কায়েদা, বালকাতুল জিহাদ, সোগাবুত হাহরীর। ধর্মরেও... ধর্মের সোগা দিয়া পয়দা হওয়া বর্বরগুলানরেও... ।’
শুধু তাই নয়, এ নাস্তিকদের অনেকের ফেসবুকে ইসলামকে নিয়ে নানা কটূক্তিকর স্ট্যাটাস বেশ দেখা যাচ্ছে। ঠিক এমনি আশরাফুল ইসলাম রাতুল নামে এক নাস্তিক কিছুদিন আগে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছে, ‘সাহস থাকলে একবার শাহাবাগ আয় রাজাকারের চুদারা, তোদের মুহাম্মদ (স.) আর নিজামী বাপকে একে অন্যের পোদের ভেতর ঢুকাবো।’ (নাউজুবিল্লাহ) [সৌজন্যে : দৈনিক আমার দেশ ও নয়া দিগন্ত, ১৮ ও ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সংখ্যা]
এসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে রীতিমত তোলপাড় হয়। উসকানিমূলক ও চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ এসব মন্তব্যের প্রতিবাদ ও ইসলাম ধর্মের নানা দিক নিয়ে যথাসাধ্য পোস্ট দিয়ে যান ইসলামপন্থী ব্লগাররা। তারা নাস্তিকদের দেয়া নানা যুক্তি খণ্ডনের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে ফেসবুক ব্যবহারকারী ও ব্লগারদের এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে ইসলামপ্রিয় মুসলিমদের সতর্ক থাকার আহ্বানও জানানো হয়।
প্রথম আলো না প্রথম কালো?
চূড়ান্ত সফলতার পর ব্যর্থতার পথে যাত্রা- এই জগতের নিয়ম। নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা ও দেশপ্রেমের সাইনবোর্ড লাগিয়ে প্রথম আলো বাংলাদেশের শীর্ষ ও সফলতম পত্রিকার খেতাব অর্জন করেছে। চূড়ান্ত ব্যর্থতা ছাড়া অর্জনের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই এর। অথচ তাদের ভাওতাবাজী শ্লোগানগুলোর অসারতা সম্পর্কে ইসলামপন্থী বা ডানরা শুধু নয়; এ দেশের বাম ও স্বগোত্রীয় ধর্মবিদ্বেষী শ্রেণী পর্যন্ত কখনো সন্দেহ পোষণ করে নি। জাতীয় সংসদেও প্রথম আলো নামের প্রথম কালোর বিরুদ্ধে দীর্ঘ সমালোচনা হয়েছে। জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পাদকের সম্পৃক্ততা, একটি দেশের প্রতি তার গোপন এজেন্ডা এবং দুই নেত্রীকে মাইনাসের চেষ্টা নিয়েও বহু কথা হয়েছে মিডিয়াপাড়ায় ‘মিশনারিনির্ভর পত্রিকা খ্যাত’ এ দৈনিকের বিরুদ্ধে। স্থানীয় সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ধ্বংস করে ধর্ষণের রাজধানীর লকব পাওয়া পাশের দেশের অশ্লীল ও পৌত্তলিক সংস্কৃতি প্রচলন ও উৎসাহিতকরণে এর অবদান অনস্বীকার্য।
সর্বদা শান্তি ও প্রগতির কথা বললেও বিস্ময়করভাবে পত্রিকাটি জন্মলগ্ন থেকে লেগে আছে শান্তি ও প্রগতির ধর্ম ইসলাম ও তার অনুসারীদের পেছনে। ইসলামবিদ্বেষীদের মহিমান্বিতকরণ এবং ইসলাম ও মুসলমানের চরিত্র হননে ধারাবাহিকতা ও আপোসহীনতায় প্রথম আলোর অবস্থান সবার ওপরে। একদিকে ইসলামের বিপক্ষশক্তির শতজনের সমাবেশকে হাজারো-লাখো জনতার মহাসমাবেশ হিসেবে তুলে ধরা অন্যদিকে লক্ষাধিক ইসলামপ্রেমীর স্বতস্ফূর্ত সমাবেশকে অনতিদীর্ঘ ও অগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন কিংবা একেবারেই তুলে না ধরা এর পলিসি।
প্রথম আলো যে সবচে খারাপ কাজটি করে সবার অগোচরে তা হলো কোনো কোনো অন্যায়ের ব্যাপারে এবং ইসলাম ও মুসলমানের জন্য ইতিবাচক কিংবা উৎসাহবর্ধক সংবাদ বিষয়ে বোবা শয়তানের ভূমিকা গ্রহণ করে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। বিউটি পার্লার হিসেবে পারসোনার অনেক নামডাক রয়েছে। রাজধানী জুড়ে অনেক শাখা রয়েছে পারসোনার। শুক্রবার ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১ পারসোনার বনানী শাখা থেকে একটি লুকানো ক্যামেরা উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে পারসোনা কর্তৃপক্ষ এবং এক আইনজীবী মহিলা গ্রাহকের সঙ্গে তুমুল হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে হৈ চৈ পড়ে যায়। প্রত্যেক মিডিয়ায় খবরটি ফলাও করে প্রচার হয়। কিন্তু পারসোনার মালিক ব্যক্তিগতভাবে প্রথম আলো সম্পাদকের বন্ধু হওয়ায় পত্রিকাটি লাগাতার এ বিষয়ে নিরবতা পালন করে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের সাইটে একটি ছবি প্রচারিত হয়। তাতে দেখা যায় পারসোনার মালিক কানিজ আলমাসের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় করমর্দন করছেন মতিউর রহমান। এ ঘটনায় সেকুলার পাঠকরাও প্রথম আলোর ভূমিকায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হন।
প্রথম আলো সাংবাদিকের কুরআন অবমাননা :
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক কলামিস্ট ও গল্পকার আনিসুল হক। তিনি একটি বই লিখেছেন ‘ছহি রাজাকারনামা’ নামে। কুরআনের আয়াত নিয়ে এ ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক রচনা বাংলা ভাষায় নজিরবিহীন। বাংলা সাহিত্যের সেরা কবি-সাহিত্যিকরা শত শত বছর ধরে পবিত্র কুরআনের প্রশংসা করে বহু কবিতা-গান রচনা করেছেন, এখনো করছে এবং ভবিষ্যতেও করবেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবি নবীন চন্দ্র সেনকে নিয়ে লেখা ‘নবীনচন্দ্র’ কবিতায় নিজেকে ‘কোরআনের কবি’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। নজরুল কোরআনের আমপারা অংশের কাব্যানুবাদ করেছেন। গানে ও কবিতায় পবিত্র কোরআনের সূরা ফাতেহার অনুবাদ করেছেন গোলাম মোস্তফা, সুফিয়া কামাল, ফররুখ আহমদ, মতিউর রহমান মল্লিকসহ বাংলাদেশের প্রথম সারির অনেক কবি-সাহিত্যিক।
বাংলা সাহিত্যের এক সময়ের জনপ্রিয় কবি ও চিন্তাবিদ শেখ ফজলুল করিম পবিত্র কুরআন নিয়ে রচনা করেছেন সুদীর্ঘ অনবদ্য কবিতা ‘কোর-আন’। এ কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘বিশ্ব-মানব মঙ্গল-সেতু আমাদের ফোরকান’ এবং ‘বিশ্ব মানব মুক্তির হেতু আমাদের কোরআন’। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন কুরআনের গদ্য অনুবাদ করেছেন। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কুরআনের কয়েকটি সূরার অনুবাদ করেছেন কবিতায়। অন্য ধর্মাবলম্বী হলেও এদের বিরুদ্ধে কখনও কুরআন বিকৃতির অভিযোগ ওঠে নি। সচেতন মহল বিস্ময় প্রকাশ করেছে, বাংলাদেশের একজন মুসলমান লেখক ও সাংবাদিক হয়ে আনিসুল হক কীভাবে এ ধরনের ভয়াবহ বিকৃত রচনা লেখা লিখতে পারলেন?
তার একটি ব্যঙ্গাত্মক রচনায় পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াতকে সম্পূর্ণ বিদ্রূপাত্মক ভাষায় লেখা হয়। লেখাটি নিয়ে ফেসবুক, ব্লগসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন সাইট এবং সচেতনমহলে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত সচলায়তন ব্লগে আনিসুল হকের ‘ছহি রাজাকারনামা’ লেখাটি প্রকাশ পায়। সচেতন ব্লগার ও ফেসবুক ব্যবহারকারীরা সঙ্গে সঙ্গে লেখাটি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই ক্ষোভ ধীরে ধীরে বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য আনিসুল হকের এ লেখাটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৯১ সালের ১২ এপ্রিল পূর্বাভাস পত্রিকায়। ১৯৯৩ সালে লেখাটি আনিসুল হকের ‘গদ্যকার্টুন’ বইতে স্থান পায়। ২০১০ সালে এই বইটি পুনরায় মুদ্রণ করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সন্দেশ। বইটিতে পর্দানসিন নারী ও দাড়ি-টুপিধারী আলেমদের নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন শিশির ভট্টাচার্য।
পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে—‘সমস্ত প্রশংসা জগতের প্রতিপালক আল্লাহর’। আনিসুল হক তার ‘সহি রাজাকারনামা’য় লিখেছেন, ‘সমস্ত প্রশংসা রাজাকারগণের’। সূরা ফাতেহার আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।’ আনিসুল হক ব্যঙ্গ ও বিকৃত করে লিখেছেন, ‘আর তোমরা রাজাকারের প্রশংসা করো, আর রাজাকারদের সাহায্য প্রার্থনা করো।’
পবিত্র কুরআনের সূরা দুহার ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে তোমাদের জন্য পরবর্তী যুগ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো।’ আনিসুল হক বিদ্রূপ করে লিখেছেন, ‘নিশ্চয়ই রাজাকারগণের জন্য অতীতের চাইতে ভবিষ্যেক উত্তম করিয়া সৃজন করা হইয়াছে।’
পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ৩ নং আয়াতে বলা হয়, ‘আর তোমরা ভয় কর যে, ইয়াতিম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পূর্ণ করতে পারবে না; তবে সেসব মেয়েদের মধ্য থেকে যাদের ভালো লাগে বিয়ে করে নাও দুই, তিন বা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে একজনকেই (বিবাহ কর), অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদের (বিবাহ কর)।’ আনিসুল হক এ আয়াতের বিপরীতে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘সেই ব্যক্তিই উত্তম রাজাকার, যে বিবাহ করিবে, একটি, দুইটি, তিনটি, চারটি, যেরূপ সে ইচ্ছে করে আর তাহার জন্য বৈধ করা হইয়াছে ডান হাতের অধিকারভুক্ত দাসীদের, আর তাহারা ভোগ করিতে পারিবে বাঙালিরমণীগণকে, অপিচ তাহাদের সহিত আদল করিবার দরকার হইবে না। স্মরণ রাখিও, মালেগণিমতগণের সহিত মিলিত হইবার পথে কোনোরূপ বাধা থাকিলো না।’
পবিত্র কুরআনের সূরা মুরসালাতের ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়, ‘আমি কি আগের লোকদের (অবিশ্বাসী জালেম) ধ্বংস করিনি?’ আনিসুল হক এ আয়াতের ব্যঙ্গ করে লিখলেন, ‘গ্যালিলিও নামের এক পাপিষ্ঠ অতীতে সত্য অস্বীকার করিয়াছিল এবং সে কি প্রাপ্ত হয় নাই চরম শাস্তি।’
পবিত্র কুরআনের সূরা নাবার ৩১-৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অপরদিকে পরহেজগার লোকদের জন্য রয়েছে চরম সাফল্য। (তা হচ্ছে) বাগবাগিচা, আঙ্গুর (ফলের সমারোহ), (আরো আছে) পূর্ণ যৌবনা সমবয়সী সুন্দরী তরুণী।’ আনিসুল হক এ আয়াতের বিকৃত করে লিখেছেন, ‘আর তাহাদের জন্য সুসংবাদ। তাহাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছে রাষ্ট্রের শীর্ষপদ আর অনন্ত যৌবনা নারী আর অনন্ত যৌবন তরুণ। কে আছে, যে উত্তম সন্দেশ, মসৃণ তলদেশ ও তৈলাক্ত গুহ্যদেশ পছন্দ করে না।’
এভাবেই কুরআনের আয়াতকে বিকৃত করে আনিসুল হক লিখেছেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রভু পাকিস্তানের প্রশংসা কর। নিশ্চয় তোমাদের প্রভু পাকিস্তানীরা ক্ষমতাশীল।’
আনিসুল হকের ‘ছহি রাজাকারনামা’ লেখাটির প্রতিটি বাক্যেই পবিত্র কুরআনের বাকভঙ্গি ও কুরআনের বাংলা অনুবাদের ক্লাসিক ভাষা ব্যবহার করে কুরআনের আয়াতকে ব্যঙ্গ ও বিকৃত করা হয়েছে। ২০১০ সালে ‘সন্দেশ’ থেকে প্রকাশিত আনিসুল হকের বইটিতে ‘ছহি রাজাকারনামা’ ছাড়াও ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’, ‘নমিনেশন ইন্টারভিউ গাইড’সহ কয়েকটি লেখায় ইসলামি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়েছে। [দৈনিক আমার দেশ, বৃহস্পতিবার ২৮/০৩/২০১৩]
প্রথম আলোর ফান ম্যাগাজিনে মহানবীকে নিয়ে কার্টুন :
১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে প্রকাশিত প্রথম আলোর কৌতুক ম্যাগাজিন আলপিনের ৪৩১তম সংখ্যায় স্থান পাওয়া একটি কার্টুন নিয়ে বাংলাদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। কার্টুনটিতে একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের সঙ্গে একজন বালকের সংলাপে বালকটি ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম নিয়ে একটি কৌতুক করে। ২০ বছর বয়সী কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানের আঁকা কার্টুনটির বিষয়বস্তু একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে বিড়াল হাতে এক বালকের আলাপচারিতা। কার্টুনটির লিখিত সংলাপই মূলত বিতর্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যখন বালকটিকে তার নাম জিজ্ঞাসা করা হয় তখন সে নামের আগে ‘মুহাম্মদ’ উল্লেখ করে না, যা বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মানার্থে ব্যবহৃত করে। অগ্রজ লোকটি ছেলেটিকে সকল নামের আগে এই শব্দ ব্যবহার করতে বলে। কার্টুনের শেষ অংশে যখন লোকটি জানতে চায় যে, বালকটির হাতে কী, তখন জবাবে সে বলে ‘মুহাম্মদ বিড়াল’।
দেশের ধর্মপ্রাণ কোটি কোটি মুসলিম এবং হাজার হাজার আলেম-উলামা কার্টুনটির তীব্র প্রতিবাদ জানান। আয়োজন করা হয় গণপ্রতিবাদের। যা ২০০৭ সালের শুরুতে চালু হওয়া বাংলাদেশের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নিষিদ্ধ ছিল। এর ধারাবাহিকতায় রাস্তায় সংঘাতের সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় নেতৃবর্গ সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। দাবি জানান প্রথম আলোর অনুমোদন কেড়ে নেয়ার। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আলপিনের ৪৩১তম সংখ্যাটির বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর সকল কপি বাজেয়াপ্ত করে। গ্রেপ্তার করা হয় কার্টুনটির রচয়িতা আরিফুর রহমানকে। পরবর্তীতে আলপিন ও মূল পত্রিকা প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান দৈনিকটিতে একটি লিখিত মন্তব্যে কার্টুনটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। এটি প্রকাশের জন্য তিনি অনুতাপ প্রকাশ করেন। ইসলামপন্থীদের প্রচণ্ড চাপের মুখে তৎকালীন বায়তুল মুকাররমের খতীব মাওলানা উবাইদুল হকের হাতে হাত রেখে প্রকাশ্যে তওবা করেন।
বাংলাদেশে যতগুলো ইসলামী পরিভাষা আজ ঠাট্টা-মশকরা ও অপপ্রচারের শিকার যেমন ফতোয়া, তালাক, হিল্লা বিয়ে, মৌলবাদ ইত্যাদি শব্দ সেসবের পেছনেও প্রধান ভূমিকা এই প্রথম আলোর। এ পত্রিকাই মূলত সবার আগে এসব শব্দকে নেতিবাচক হিসেবে প্রচার করে। আলেমদের যতটা হেয় এ পত্রিকা করেছে অবশিষ্ট সব পত্রিকা মিলেও তা পারে নি।
এই পত্রিকাটি টাকা দিয়ে কেনার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাদের অপসাংবাদিকতা সম্পর্কে সজাগ থাকতে কেবল অনলাইনে পড়ি। আজকাল অনলাইনেও তাদের এড্রেসে ক্লিক করতে রুচিতে বাধে। হেফাজতের লংমার্চ নিয়ে করা লিড নিউজে পত্রিকাটি বলেছে, ‘আল্লাহ, রাসুল ও ইসলামি অনুশাসনের বিরুদ্ধে কটূক্তিকারী কথিত নাস্তিক ব্লগারদের...’। ব্লগে ইসলাম অবমাননার বিষয়টি যেখানে সারাদেশের মানুষের কাছে দিবালোকের মত পরিষ্কার সেখানে প্রথম আলো কিভাবে ‘কথিত’ শব্দ লেখে?! খানিক বাদে বেলা ১১টায় খোদ প্রথম আলোই অনলাইনের চলতি আপডেটে ‘ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগে গ্রেপ্তার ৩’ শীর্ষক সংবাদে বলেছে, ‘উপকমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলামের ভাষ্য, গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহার করে ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য লিখতেন। তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও হার্ডডিস্ক থেকে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।’ প্রমাণিত যদি হয় তাহলে কথিত হয় কিভাবে?
বামদের আসল চরিত
এই বামরাই তো গ্রেফতারকৃত স্বঘোষিত নাস্তিকদের মুক্তি চেয়েছেন বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে। এরাই আবার কিভাবে বিশাল জনগোষ্ঠীর মত প্রকাশের সমাবেশে প্রতিরোধের কথা বলেন?! আসলে অনেক আগে থেকেই স্ববিরোধিতা ও স্বার্থপরতা এদের স্বভাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এরা নিজেদের স্বার্থের জন্য হেন কাজ নেই করে না। হেন কথা নেই বলে না। নিজেদের সুবিধার জন্য এরা টুপি পরে সামাজিক কাজের অংশ হিসেবে বছরে দুয়েকবার মসজিদে যায়। কখনো গণ্যমান্য রাজনীতিবিদ কেউ মারা গেলে তার জানাজায় অংশ নেয়। এই মেনন-ইনু-শাহরিয়ার কবির গংরাই পেটু-পূজারী খাজাদের দখলে থাকা ফাউন্ডেশনে গিয়ে মিলাদুন্নবীসহ নানা হালুয়া-রুটির প্রোগ্রামে হাজির হয়ে ভাগ বসায়।
কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ যথার্থই লিখেছেন, ‘যাঁরা আগে মার্ক্সীয় তত্ত্ব আওড়াতেন, তাঁরা এখন আম-ছালাতত্ত্বের প্রবক্তা হয়েছেন। মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ ও মাও সে তুংয়ের চিন্তাধারা বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হয়েছে। গত ৪২ বছরে বুড়ো মার্ক্সের উম্মতরা—তাঁরা মস্কো তরিকার হোন বা বেইজিং তরিকার হোন—সব বেসামরিক ও সামরিক শাসকের স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে এখন তাঁরা প্রায় বিলুপ্ত এক প্রজাতি। কোনো ব্যক্তির কাছে একটি ছালার যে কদর, বড় শাসক দলগুলোর কাছে বামদের সে দামও নেই। শাসক দলগুলোর কাছে বঙ্গীয় বামরা ছেঁড়া ছালার চেয়ে বেশি কিছু নন।’ [দৈনিক প্রথম আলো, ০৯/০৪/১৩]
বামরা ফতোয়ার বিরুদ্ধে কত আন্দোলনই না করে ব্যর্থ হলো। অথচ এরাই দুদিন পরপর নিত্যনতুন ফতোয়া জারি করে। বামদের সাম্প্রতিক ফতোয়া হলো, আস্তিক-নাস্তিক নির্ধারণ করবেন আল্লাহ। এই ‘হুজুর’রা আবার কে? এই শিক্ষিত অর্বাচীনদের কে বুঝাবে নাস্তিক ফতোয়া দেবার দায়িত্ব আল্লাহর নয়। আল্লাহ যে বিধান ও আইন দিয়েছেন, তার আলোকে আল্লাহর বিধান বিষয়ে পারদর্শী আল্লাহর বান্দা তথা আলেম-উলামাই এ বিষয়ে ফতোয়া দেবেন।
এরাই প্রধানমন্ত্রীকে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নারীনীতি পাশ, সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস বিলুপ্তি এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজনে বাধ্য করে তাঁর ও তাঁর দলের মহা সর্বনাশ করেছে। এরাই সিংহভাগ মুসলমানের রক্তে কেনা মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ছেড়েছে। এরাই বেপথু শাহবাগীদের নেতা ইমরানকে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণের সাহস দিয়েছে। এরাই আজ একটি স্বাধীন দেশের নাগরিককে দুই শিবিরে বিভক্ত করে দেশের নিরাপত্তা, শান্তি ও অগ্রগতিকে প্রশ্ন ও শঙ্কার মুখে ঠেলে দিয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এই বামেরা প্রতিটি সরকারের আমলে তাদের ভোল পাল্টে বড় বড় সব সুযোগ বাগিয়ে নিয়েছে। আজ সারা দেশের আস্তিককূল এই নাস্তিকপ্রধান বামদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। সমগ্র পৃথিবীর শান্তির মহান দূত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননার প্রতিবাদে লংমার্চের পর শাপলা চত্বরে ঐতিহাসিক যে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো, তাতে বামদের তৈরি করা পরিবহন ধর্মঘট, প্রতিরোধের ঘোষণা এবং গুটিকয় শাহবাগির বৃথা আস্ফালন বালির বাঁধের মতো ভেসে গিয়েছে।
শত বাধাবিপত্তি ডিঙ্গিয়ে পঞ্চাশ ষাট মাইল পথ হেঁটে হেফাজতের সমাবেশে যোগ দিয়ে প্রায় ত্রিশ লাখের মতো মানুষ জানিয়ে দিয়েছেন এ দেশে বামদের ঠাঁই নেই। এদেশে রাসূল প্রেমিক লাখ লাখ মুসলিম ঘুমিয়ে নেই। প্রয়োজনে তাঁরা রক্ত দিতে জানেন। পারেন যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতেও। ৬ মার্চের (২০১৩) সমাবেশে মানুষ যে আপ্যায়ন, পরহিতৈষণা ও স্বার্থত্যাগের অসংখ্য নজির পেশ করেছেন তা এ দেশের ইতিহাসে বিরল। তার দেখা মেলে কেবল মক্কা-মদীনার পবিত্র ভূমিতেই। এ বিশাল সমাবেশে আগত নবীপ্রেমিকরা সেদিন যদি থুতুও নিক্ষেপ করতেন তবে তাতেও শাহবাগের সরকারি নিরাপত্তায় থাকা নব্য দেশপ্রেমিকরা ভেসে যেত। উপস্থিত আশেকে রাসূলদের এক সিকিভাগ মূত্রত্যাগ করলে তাতে শাহবাগ বানের তোড়ে ভেসে যেত।
কিন্তু ইসলামের শান্তির শিক্ষায় দীক্ষিত লাখো মুসলিম সব রাজনীতিবিদকে হতাশ করে জানিয়ে দিয়েছে আমরা অশান্তি চাই না। শান্তিই আমাদের প্রধান অন্বেষা। তাই তারা পরিস্থিতি অনুকূল থাকলেও তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ানো স্বঘোষিত শত্রুদের দিকে পা বাড়ায় নি। অথচ এরপরও হেফাজতের শান্তিপ্রিয় হরতালের বিরুদ্ধে এই বেয়াদব শাহবাগিরা লাঠি হাতে রাজপথে নেমেছে। গণতন্ত্রের কবর রচনা করে ক্ষমতাসীন দলের গুন্ডা-পাণ্ডারাও বাংলার সবুজ ভূমিকে রক্তে লাল করেছে আলেম-তালেবে ইলমদের পবিত্র রক্তে। এর পেছনেও প্রধান ভূমিকা রেখেছে এই সুবিধবাদী বামেরা। হেফাজতের কর্মসূচির অপব্যাখ্যা করে এরাই রাজপথে নামিয়ে দিয়েছে তাদের নারীকর্মীদের।
সময় এসেছে এই কুলাঙ্গার বামগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। সময় হয়েছে দল-মত নির্বিশেষে সকল তাওহিদী জনতার প্রিয়তম ব্যক্তিত্ব রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মান রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার। আল্লাহর আইনকে যারা বুঝে না বুঝে বর্বর ও মধ্যযুগীয় বলে আখ্যায়িত করে আজই তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
নাস্তিক্যবাদী অপতৎপরতা মোকাবেলায় করণীয়
উদ্বেগের বিষয় হলো এমন ধর্মহীনের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে। এক রাজিব লোকান্তরে কিন্তু বহু রাজিব অনলাইনে। নাস্তিকদের ওপর হামলা এর কোনো সুষ্ঠু সমাধান নয়। প্রয়োজন তাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করা। মিডিয়াযুদ্ধে নেমে তাদের পরাস্ত করা। এত দিন যারা ফেসবুক ব্লগকে অবহেলা করেছেন, সময় হয়েছে তাঁদের নড়েচড়ে বসার। সময় হয়েছে জাতির কাণ্ডারিদের মিডিয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করে মিডিয়া প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসার।
অবশ্য শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে হবে না। এদের ভাষা ও বক্তব্য এতটাই নোংরা যে এসবের জবাব দেয়াটাও কোন ভদ্র মানুষের রুচিতে আসে না। সুতরাং রাজনৈতিকভাবেও এদের মোকাবেলা করতে হবে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকারকে বাধ্য করতে হবে এদের আইনের আওতায় আনতে। ব্লগগুলোয় আমি কিছুদিন এদের সঙ্গে কথা বলেছি। এদের নোংরামি এতটাই জঘন্য যে আপনি এদের সঙ্গে কথা বলার রুচি হারিয়ে ফেলবেন। আমাদের জোটবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে এদের মোকাবেলা করতে হবে। আর এদের অনলাইনের কুকীর্তি অফলাইনে জনসাধারণের সামনে আনতে হবে। তখনই এদেরকে যথাযথভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। মোদ্দাকথা কুকুরের মাথায় হাত বুলালে কোনোই লাভ হবে না। কখনো ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুরে’র ব্যবস্থাও করতে হবে।
আমার ফেসবুক বন্ধু মাওলানা আবদুল হক ঠিকই বলেছেন, আবহমান বাংলা আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ। ৯০ শতাংশ মুসলিম-অধ্যুষিত হলেও এ দেশে অন্য সব সংখ্যালঘু ধর্মগোষ্ঠী সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করে। ধর্মের দিক থেকে এখানে কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়। সকল ধর্মেরই দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে, কমবেশি নিজস্ব সংস্কৃতিও আছে। কেবল একটি ধর্ম- হ্যাঁ, ধর্মই -এর বাইরে। এ ধর্মের নাম নাস্তিক্য। বাংলাদেশে নাস্তিক্যের কোনো ভিত্তি নেই, ঐতিহ্য নেই, সংস্কৃতি নেই। ভুঁইফোঁড়ও নয়, বরং এটা একটা আমদানিকৃত উপদ্রব।
নাস্তিকতা সেই একমাত্র অধর্মের ধর্ম, যা কোনো নীতিবোধে বিশ্বাস করে না। ফলে, আইনের চোখ ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হলে একজন নাস্তিকের খুন বা ধর্ষণ না-করবার কোনো কারণ নেই। অতএব নাস্তিক আর অমানুষ সমার্থক শব্দ। কিন্তু মানুষের মুখোশ পরে থাকে বলে এ অমানুষদের আমরা প্রায়ই চিনতে ভুল করি। মানুষের সমাজে মানুষের সঙ্গে মিশে থাকার প্রয়োজনেই অমানুষ নাস্তিকদেরকে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়। ছদ্মবেশ অপরিহার্য। এরা বাস করে গা ঢেকে, আত্মপরিচয় লুকিয়ে। কাপুরুষের মতো মাঝেমধ্যে লোকদেখানো সালাত আদায় করে। মরলে জানাযায়ও অংশ নেয়। তাই নাস্তিক মানেই ভণ্ড। কারণ সে খোলাখুলি কখনোই বলতে পারে না যে, সে নাস্তিক।
তবে আশার কথা, ষোল কোটি মানুষের মধ্যে নাস্তিকের সংখ্যা আঙুলে গোনা যাবে, এত কম। অন্যদিকে শঙ্কার কথা হল, কম হলেও এরা কখনোই বসে নেই। মানুষের বিশ্বস্ত সমাজে সারাক্ষণই এরা সিঁদ কাটছে ইঁদুরের মতো। এদের নির্বিরাম তৎপরতায় বাংলাদেশে এখন অনেক ইঁদুরের গর্ত। দেশের স্বাধীনতার ভিত্তিভূমির সুরক্ষার প্রয়োজনে এই ইঁদুরগুলিকে তাড়িয়ে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কাজেই বাংলাদেশের বিশ্বাসী জনগণের সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় আন্দোলন হলো ‘নাস্তিক খেদাও আন্দোলন’, সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ শ্লোগান হলো : ‘নাস্তিকমুক্ত বাংলাদেশ চাই!
দরকার ইসলামের সপক্ষে একাধিক মিডিয়া :
বাংলাদেশে যখনই ইসলামের ওপর আন্তর্জাতিক বা স্থানীয় কোনো বিপদ বা আগ্রাসন এসেছে, তখনই নতুন করে ইসলামপন্থীদের নিজস্ব মিডিয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করেন সবাই। সবগুলো মিডিয়া যখন একযোগে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানায়, নির্লজ্জ হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে ইসলামের স্বপক্ষের লোকদের খলনায়ক আর প্রকৃত খলনায়কদের নায়ক বানায়, তখনই সবাই নিজেদের মিডিয়ার শূন্যতা বোধ করেন। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে না হতেই এই বাস্তবতা ও অভাবের কথা ভুলে যান। দিনদিন যেখানে আধুনিক মিডিয়ার শাখা-প্রশাখা ডালপালা মেলছে, সেখানে বাংলাদেশে প্রকৃত ইসলামপ্রেমী একটি জাতীয় দৈনিকও নেই। এই নাস্তিক ও তাদের দোসরদের মোকাবেলায় এখনই অনতিবিলম্বে দরকার একাধিক জাতীয় দৈনিক এবং একাধিক মিডিয়া।
নাস্তিকদের প্রতিরোধের উপায় :
এখন থেকেই এই আন্দোলনের নতুন রূপ দেয়া দরকার। ইসলামী ঘরানার অনেক ভাইয়ের ফেসবুক আইডি আছে। নামে বেনামে কিছু likepage তৈরি করে সেগুলোকে কেন্দ্র করে সকলকে জমায়েত করতে হবে। এই পেজগুলোয় সাধারণ মানুষের প্রবেশের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সারাদেশের মেধাবী ছেলেদের দিয়ে এডমিন প্যানেল তৈরি করতে হবে।
আঠারোর্ধ্ব বয়সী মুসলিমকে মার্জিত অনলাইনার হতে উৎসাহিত করতে হবে। পেজগুলোয় ধর্মীয় বিষয়ের চেয়ে সামাজিক বিষয় বেশি পোস্ট দিতে হবে। সাধারণ ব্রাউজারদের সামনে নাস্তিকদের ভণ্ডামি ও আসল মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে। অনেকের কাছে এই প্রস্তাবগুলো অবান্তর মনে হতে পারে। তাদের বলব, কয়েকদিন নিয়মিত সাধারণ অনলাইনার হয়ে এই পরিবেশগুলো ঘুরে দেখুন। অতপর আপনিও আমার সঙ্গে একমত হয়ে বলবেন এসব করা উচিত। অসম্ভব মনে হলেও কিছু করার নেই। ভুলে যাবেন না আরব বসন্তের সিরিয়া, লিবিয়া, মিসর এমনকি তথাকথিত শাহবাগের আন্দোলনের ডাকও কিন্তু অনলাইনেই দেয়া হয়েছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, প্রথম কাজ হবে নাস্তিকদের কুকীর্তি জাতির সামনে প্রকাশ করা, দ্বিতীয় কাজ তালিকা করে ওই সব কুলাঙ্গারের ব্লগ বাতিলের জন্য সরকারকে আল্টিমেটাম দেওয়া, তৃতীয় কাজ ইসলামী ব্লগ তৈরি করা এবং চতুর্থ কাজ আগামী তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে সতর্কতার সঙ্গে ওই খারাপ ব্লগগুলো থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করা।
এ ক্ষেত্রে সবচে বেশি মনোযোগ দিতে হবে শিক্ষকতা ও মিডিয়ার প্রতি। কারণ, এ দুই পেশায় যুক্ত হয়েই বামধারার লোকেরা তাদের শিক্ষা ও চিন্তা-চেতনা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ইসলামবিরোধী নাস্তিক্যবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত ও আচ্ছন্ন করেছেন। মেধাবী ইসলামপ্রিয় শিক্ষানুরাগী লোকদের আজ ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এ দুই পেশায়। আমরা যত দেরি করব, তত বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে। অতিসত্ত্বর আমাদের এদিকে মনোযোগী হতে হবে।
ওরা ইসলামের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না :
আমাদের সাহস হারাবার কিছু নেই। ইসলামের শত্রুরা যতই আদাপানি খেয়ে চেষ্টা করুক আমরা ঠিক থাকলে ইসলামের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। তাদের সব কৌশল বিফলে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَكَرُواْ وَمَكَرَ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ ٥٤ ﴾ [ال عمران: ٥٤]
‘আর তারা কুটকৌশল করেছে এবং আল্লাহ কৌশল করেছেন। আর আল্লাহ উত্তম কৌশলকারী।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৫৪}
ওদেরর ইসলাম নির্মূলের চেষ্টা কোনোদিন সফল হবে না। বরং ইসলাম তার আলোয় উদ্ভাসিত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يُرِيدُونَ أَن يُطۡفُِٔواْ نُورَ ٱللَّهِ بِأَفۡوَٰهِهِمۡ وَيَأۡبَى ٱللَّهُ إِلَّآ أَن يُتِمَّ نُورَهُۥ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡكَٰفِرُونَ ٣٢ هُوَ ٱلَّذِيٓ أَرۡسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلۡهُدَىٰ وَدِينِ ٱلۡحَقِّ لِيُظۡهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡمُشۡرِكُونَ ٣٣ ﴾ [التوبة: ٣٢، ٣٣]
‘তারা আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায় তাদের মুখের (ফুঁক) দ্বারা, কিন্তু আল্লাহ তো তাঁর নূর পরিপূর্ণ করা ছাড়া অন্য কিছু চান না, যদিও কাফিররা অপছন্দ করে। তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি একে সকল দীনের ওপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা অপছন্দ করে।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ৩২-৩৩}
আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يُرِيدُونَ لِيُطۡفُِٔواْ نُورَ ٱللَّهِ بِأَفۡوَٰهِهِمۡ وَٱللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡكَٰفِرُونَ ٨ ﴾ [الصف: ٨]
‘তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরকে পূর্ণতাদানকারী। যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।’ {সূরা আস-সফ, আয়াত : ৮}
আমাদের কাজ হবে সর্বোচ্চ চেষ্টা ব্যয় করা এবং সম্ভাব্য সব কৌশল প্রয়োগ করা। নিচে উল্লেখিত আল্লাহর বাণী থেকেই আমরা নিজেদের কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে পারি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٢٥ ﴾ [النحل: ١٢٥]
‘তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সঙ্গে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত : ১২৫}
ইসলামের শত্রুদের নির্মূলে চেষ্টা যদি সর্বোচ্চ হয় তবে আল্লাহ আমাদের বিজয়ী করবেনই। প্রয়োজনে তিনি ফেরেশতা দিয়ে আমাদের সাহায্য করবেন। নিচের আয়াতগুলোয় লক্ষ্য করুন। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
﴿ وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم مِّن قُوَّةٖ وَمِن رِّبَاطِ ٱلۡخَيۡلِ تُرۡهِبُونَ بِهِۦ عَدُوَّ ٱللَّهِ وَعَدُوَّكُمۡ وَءَاخَرِينَ مِن دُونِهِمۡ لَا تَعۡلَمُونَهُمُ ٱللَّهُ يَعۡلَمُهُمۡۚ وَمَا تُنفِقُواْ مِن شَيۡءٖ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ يُوَفَّ إِلَيۡكُمۡ وَأَنتُمۡ لَا تُظۡلَمُونَ ٦٠ ۞وَإِن جَنَحُواْ لِلسَّلۡمِ فَٱجۡنَحۡ لَهَا وَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٦١ وَإِن يُرِيدُوٓاْ أَن يَخۡدَعُوكَ فَإِنَّ حَسۡبَكَ ٱللَّهُۚ هُوَ ٱلَّذِيٓ أَيَّدَكَ بِنَصۡرِهِۦ وَبِٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٦٢ ﴾ [الانفال: ٦٠، ٦٢]
‘আর তাদের মুকাবিলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ব বাহিনী প্রস্তুত কর, তা দ্বারা তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে এবং এরা ছাড়া অন্যদেরকেও, যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে জানেন। আর তোমরা যা আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর, তা তোমাদেরকে পরিপূর্ণ দেয়া হবে, আর তোমাদেরকে যুলম করা হবে না। আর যদি তারা সন্ধির প্রতি ঝুঁকে পড়ে, তাহলে তুমিও তার প্রতি ঝুঁকে পড়, আর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কর, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। আর যদি তারা তোমাকে ধোঁকা দিতে চায়, তাহলে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনিই তোমাকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা। {সূরা আল-আনফাল, আয়াত : ৬০-৬২}
আমাদের কাজ নাস্তিকদের সাধ্যমত সুপথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করা। আমরা সুপথ দেখানোর পরও যদি ফিরে না আসে তবে আল্লাহ তাদের সম্পর্কে তো বলেই দিয়েছেন। তিনিই তাদের বিচারের ভার নিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّنِ ٱفۡتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَ وَهُوَ يُدۡعَىٰٓ إِلَى ٱلۡإِسۡلَٰمِۚ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٧ ﴾ [الصف: ٧]
‘সেই ব্যক্তির চেয়ে অধিক যালিম আর কে? যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করে, অথচ তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা হয়। আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।’ {সূরা আস-সফ, আয়াত : ৭}
আরেক আয়াতে অবাধ্যাচারীদের সতর্ক করে আল্লাহ বলেন,
﴿ وَلَا يَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ سَبَقُوٓاْۚ إِنَّهُمۡ لَا يُعۡجِزُونَ ٥٩ ﴾ [الانفال: ٥٩]
‘আর কাফিররা যেন কখনও মনে না করে যে, তারা (আযাবের) নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে, নিশ্চয় তারা (আল্লাহকে আযাব প্রদানে) অক্ষম করতে পারে না।’ {সূরা আল-আনফাল, আয়াত : ৫৯}
অন্য আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
﴿ وَمَنۡ أَعۡرَضَ عَن ذِكۡرِي فَإِنَّ لَهُۥ مَعِيشَةٗ ضَنكٗا وَنَحۡشُرُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ أَعۡمَىٰ ١٢٤ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرۡتَنِيٓ أَعۡمَىٰ وَقَدۡ كُنتُ بَصِيرٗا ١٢٥ قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتۡكَ ءَايَٰتُنَا فَنَسِيتَهَاۖ وَكَذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمَ تُنسَىٰ ١٢٦ وَكَذَٰلِكَ نَجۡزِي مَنۡ أَسۡرَفَ وَلَمۡ يُؤۡمِنۢ بَِٔاَيَٰتِ رَبِّهِۦۚ وَلَعَذَابُ ٱلۡأٓخِرَةِ أَشَدُّ وَأَبۡقَىٰٓ ١٢٧ أَفَلَمۡ يَهۡدِ لَهُمۡ كَمۡ أَهۡلَكۡنَا قَبۡلَهُم مِّنَ ٱلۡقُرُونِ يَمۡشُونَ فِي مَسَٰكِنِهِمۡۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّأُوْلِي ٱلنُّهَىٰ ١٢٨ وَلَوۡلَا كَلِمَةٞ سَبَقَتۡ مِن رَّبِّكَ لَكَانَ لِزَامٗا وَأَجَلٞ مُّسَمّٗى ١٢٩ ﴾ [طه: ١٢٤، ١٢٩]
‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, ‘হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন? তিনি বলবেন, ‘এমনিভাবেই তোমার কাছে আমার নিদর্শনাবলী এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল’। আর এভাবেই আমি প্রতিফল দান করি তাকে, যে বাড়াবাড়ি করে এবং তার রবের নিদর্শনাবলীতে ঈমান আনে না। আর আখিরাতের আযাব তো অবশ্যই কঠোরতর ও অধিকতর স্থায়ী। এটি কি তাদেরকে সৎপথ প্রদর্শন করল না যে, আমি তাদের পূর্বে কত মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছি, যাদের বাসভূমিতে তারা বিচরণ করে? নিশ্চয় এর মধ্যে রয়েছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য নিদর্শন। আর যদি তোমার রবের পক্ষ থেকে পূর্ব সিদ্ধান্ত ও একটি কাল নির্ধারিত হয়ে না থাকত, তবে আশু শাস্তি অবশ্যম্ভাবী হত।’ {সূরা ত্ব-হা, আয়াত : ১২৪-১২৯}
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা :
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে প্রাণাধিক ভালোবাসা আমাদের ঈমানের শর্ত। আল্লাহ ও রাসূলকে যারা কটাক্ষ করে তাদের যদি বুঝিয়ে ফেরানো সম্ভব না হয় তবে তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُواْ عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمۡ أَوۡلِيَآءَ تُلۡقُونَ إِلَيۡهِم بِٱلۡمَوَدَّةِ وَقَدۡ كَفَرُواْ بِمَا جَآءَكُم مِّنَ ٱلۡحَقِّ يُخۡرِجُونَ ٱلرَّسُولَ وَإِيَّاكُمۡ أَن تُؤۡمِنُواْ بِٱللَّهِ رَبِّكُمۡ إِن كُنتُمۡ خَرَجۡتُمۡ جِهَٰدٗا فِي سَبِيلِي وَٱبۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِيۚ تُسِرُّونَ إِلَيۡهِم بِٱلۡمَوَدَّةِ وَأَنَا۠ أَعۡلَمُ بِمَآ أَخۡفَيۡتُمۡ وَمَآ أَعۡلَنتُمۡۚ وَمَن يَفۡعَلۡهُ مِنكُمۡ فَقَدۡ ضَلَّ سَوَآءَ ٱلسَّبِيلِ ١ ﴾ [الممتحنة: ١]
‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করো না, অথচ তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে তা তারা অস্বীকার করেছে এবং রাসূলকে ও তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে এজন্য যে, তোমরা তোমাদের রব আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছ। তোমরা যদি আমার পথে সংগ্রামে ও আমার সন্তুষ্টির সন্ধানে বের হও (তবে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।) তোমরা গোপনে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রকাশ কর অথচ তোমরা যা গোপন কর এবং যা প্রকাশ কর তা আমি জানি। তোমাদের মধ্যে যে এমন করবে সে সরল পথ হতে বিচ্যুত হবে।’ {সূরা আল-মুমতাহিনা, আয়াত : ১}
অমুসলিমদের সঙ্গে আমরা সুন্দরভাবে সৎ প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করতে ধর্মীয়ভাবে বাধ্য। তবে যারা ধর্মবিদ্বেষী তাদেরকে কখনো বন্ধু হিসেবে গ্রহণের সুযোগ নেই। আমাদের বন্ধুতা-মিত্রতা হবে কেবল ঈমানদারদের সঙ্গে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা বলেন,
﴿ إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَهُمۡ رَٰكِعُونَ ٥٥ ﴾ [المائدة: ٥٥]
‘তোমাদের বন্ধু কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে বিনীত হয়ে।’ {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৫৫}
হাদীসে এসেছে, আনাস রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ»
‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে অধিক প্রিয় না হই। [বুখারী : ১৫; মুসলিম : ৬৯]
অন্য হাদীসে এসেছে, জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ أَحْسَنَ الحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ، وَأَحْسَنَ الهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ»
‘সর্বোত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহর বাণী এবং সর্বোত্তম চরিত্র হচ্ছে মুহাম্মদের চরিত্র।’ [বুখারী : ৬০৯৮; মুসলিম : ৮৬৭]
উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের মুসলিম ও মু’মিন হিসেবে পরিচয় দিতে চাইলে সর্বপ্রথম আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসতে হবে। শুধু তাই নয় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও ঘটবে। একটা উদাহরণ দিলে বুঝে আসবে, তা হলো, আমার পিতা-মাতাকে কেউ গালি দেয় সে সময় আমি যতটুকু রাগ করি তার চেয়েও শতগুণ বেশি রাগ আসবে যখন কেউ আমার আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে কেউ কোনো কটুক্তি করবে। তবেই আমার ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হব।
আমরা এই নাস্তিকদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করব ?
অতএব কুলাঙ্গার নাস্তিকদের সঙ্গে আমাদের কোনো ধরনের ভালোবাসা ও মিত্রতা রাখা যাবে না। আমরা তখনই পূর্ণ মুমিন হতে পারব যখন আমাদের সম্পর্কের মাপকাঠি হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসবে সে আমার বন্ধু, যে বাসবে না সে আমার পরম মিত্র হতে পারে না। কারণ, মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,
﴿لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوۡ كَانُوٓاْ ءَابَآءَهُمۡ أَوۡ أَبۡنَآءَهُمۡ أَوۡ إِخۡوَٰنَهُمۡ أَوۡ عَشِيرَتَهُمۡۚ أُوْلَٰٓئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡإِيمَٰنَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٖ مِّنۡهُۖ وَيُدۡخِلُهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَاۚ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُۚ أُوْلَٰٓئِكَ حِزۡبُ ٱللَّهِۚ أَلَآ إِنَّ حِزۡبَ ٱللَّهِ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٢٢ ﴾ [المجادلة: ٢٢]
‘আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী এমন কোনো জাতিকে পাবে না যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারীদেরকে ভালোবাসে, হোন এই বিরুদ্ধাচারী তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা তাদের গোত্রীয় কেউ। এদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতসমূহে যার নিচে দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এরা হল আল্লাহর দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম।’ {সূরা মুজাদালা, আয়াত : ২২}
এদের বন্ধুরূপে গ্রহণের সমালোচনায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ تَرَىٰ كَثِيرٗا مِّنۡهُمۡ يَتَوَلَّوۡنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْۚ لَبِئۡسَ مَا قَدَّمَتۡ لَهُمۡ أَنفُسُهُمۡ أَن سَخِطَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِمۡ وَفِي ٱلۡعَذَابِ هُمۡ خَٰلِدُونَ ٨٠ وَلَوۡ كَانُواْ يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلنَّبِيِّ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيۡهِ مَا ٱتَّخَذُوهُمۡ أَوۡلِيَآءَ وَلَٰكِنَّ كَثِيرٗا مِّنۡهُمۡ فَٰسِقُونَ ٨١ ﴾ [المائدة: ٨٠، ٨١]
‘তাদের অনেককে তুমি কাফেরদের সঙ্গে মিত্রতা করতে দেখবে, কত নিকৃষ্ট তাদের কৃতকর্ম। যে কারণে আল্লাহ তাদের ওপর রাগান্বিত হয়েছেন, তাদের শাস্তি ভোগ স্থায়ী হবে। তারা আল্লাহ, নাবী ও তাঁর ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ঈমান আনলে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না। কিন্তু তাদের অনেক ফাসেক।’ {সুরা মায়িদাহ, আয়াত : ৮০-৮১}
হাদীসে কুদসীতে এসেছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ اللَّهَ قَالَ: مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالحَرْبِ
‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোনো বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা করল আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম। [বুখারী : ৬৫০২]
এই নাস্তিকরা এত বড় অপরাধী যে এদের জন্য এমনকি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা বা রহমতের দু‘আ করা যাবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,
﴿ مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَن يَسۡتَغۡفِرُواْ لِلۡمُشۡرِكِينَ وَلَوۡ كَانُوٓاْ أُوْلِي قُرۡبَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُمۡ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَحِيمِ ١١٣ ﴾ [التوبة: ١١٣]
‘নবী ও মু’মিনদের জন্য আত্মীয় স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা সংগত নয় যখন তা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নিশ্চিতই তারা জাহান্নামী।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ১১৩}
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, যারা আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধআচারণ করবে তাদের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ তথা ভালোবাসা ও মিত্রতা রাখা যাবে না। এমনকি স্বঘোষিত নাস্তিক হিসেবে মৃত্যু বরণকারীদের জন্য ক্ষমা ও রহমতের দু‘আ করা যাবে না।
অবশেষে প্রার্থনা, আল্লাহ এই দেশ ও জাতিকে রক্ষা করুন। এ দেশে ইসলাম ও মুসলমানের ইজ্জত-আব্রু হেফাযত করুন। আল্লাহ নাস্তিকদের সুমতি এবং আস্তিকদের মজবুতি (ঈমানে দৃঢ়তা) দান করুন। ইসলামের স্বপক্ষের লোকদের শক্তি বৃদ্ধি করুন এবং মিডিয়ার অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
http://www.islamhouse.com
বিষয়: বিবিধ
২৯৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন