কাল কি হবে কেউ জানে না!

লিখেছেন লিখেছেন বিদ্রোহী রণক্লান্ত ০৪ মে, ২০১৩, ০৪:৩২:০৩ রাত

৬ এপ্রিলের লংমার্চে রাজধানীর এক এমপি ও তার লোকজন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তৌহিদী জনতাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছিলেন বলে শুনেছিল জয়নাল আবেদীন। সে কালামপুর বাজারে গ্যারেজে কাজ করে। বাড়ি বরিশাল। ৫ মে অবরোধে সেও ঢাকা আসবে আলেম, ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও তৌহিদী জনতার সাথী হয়ে। তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র নেই। তবে সে তার মেসের ১৮ জন তরুণকে নিয়ে গড়ে তুলেছে হেফাজতে ইসলাম সুরক্ষা কমিটি। সাইকেলের চেইন, হকি স্টিক, লোহার পাত ও বাঁশের লাঠি তাদের সম্বল। বাস, পিকআপ বা ভ্যানগাড়ি যে বাহনেই তারা আসুক না কেন এসব সরঞ্জাম তাদের সাথে থাকবে বলে জানিয়েছে জয়নাল। এমন প্র¯ুÍতি মাওয়া, শ্রীনগর, ভুলতা, রূপগঞ্জ, পাগলা, শ্যামপুর, গাজীপুর, সাভার, কালিয়াকৈরসহ বৃহত্তর ঢাকা জেলার প্রায় সকল জায়গার তৌহিদী যুব-তরুণের। ৫ তারিখ নিরীহ মুসল্লীদের দিকে কেউ হাত বাড়ালে খবর আছে।

টঙ্গী চেরাগ আলীর পেছনে ভাড়া বাসায় থাকে রফিকুল ইসলাম। পেশায় তৈরি পোশাক শ্রমিক। কারখানার পাশের মসজিদে সে নিয়মিত নামাজ পড়ে। মসজিদে মুসল্লীদের মুখে সে শুনেছে, নাস্তিক-মুরতাদরা না কি দেশের আলেম, ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও ইসলামী জনতাকে শায়েস্তা করার জন্য শাহবাগে লাঠি মিছিল করেছে। তারা বলে, মৌলবাদী গোষ্ঠীকে তারা চিরতরে নির্মূল করে ফেলবে। কয়েক হাজার নাস্তিক-মুরতাদকে না কি বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে, বাংলাদেশে আলেম, ইমাম, পীর-বুযুর্গ ও তৌহিদী জনতার নেতাদের হত্যা এবং গুম করার জন্য আগামী কিছু দিনের মধ্যে দেশের সংগ্রামী আলেম ও বিপ্লবী পীর-মাশায়েখের অনেককেই খতম করার কাজে নামবে এই হাজার হাজার এজেন্ট। কথাটি শোনামাত্রই রকিবুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশপ্রেমিক ইসলামী জনতার প্রাণের চেয়েও প্রিয় ইমাম, আলেম, পীর-মাশায়েখ ও ধর্মীয় নেতাদের কিছু হলে সে ঘরে বসে থাকবে না। সঙ্গী, সহকর্মী, বন্ধু ও আত্মীয় যুবকদের নিয়ে সে আলেমদের হেফাজতে ময়দানে নামবে। কারণ, সে আধুনিক শিক্ষিত হলেও তার দাদা আলেম ছিলেন। বাবাও মাদ্রাসায় পড়া লোক। বিদেশী এজেন্ট, নাস্তিক, মুরতাদদের কবর না দিয়ে ঘরে ফিরবে না। ৫ তারিখের অবরোধ শত বাধা উপেক্ষা করে হলেও সে তার সাথীদের নিয়ে আবদুল্লাহপুর টঙ্গীব্রীজ পয়েন্টে জড়ো হবে। জায়নামাজ ও তসবিহ নিয়ে হেফাজতে ইসলামের কর্মী সমর্থকরা যখন অবরোধে অংশ নেবেন, তখন রকিবুলরা তাদের নিরাপত্তার জন্য ছায়ার মত থাকবে। কোন সমস্যা দেখা দিলে দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটা প্রয়োজনে চাপাতি ও রামদা নিয়ে সন্ত্রাসীদের রুখে দেবে। র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবিকে ভয় পান না- এ কথা জানতে চাইলে রকিবুল বলেন, ইসলাম ও দেশরক্ষার জন্য হেফাজতের কাজে পুলিশ র‌্যাব বাধা দেয় না। যদি সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় তাহলেই আমরা প্রতিহত করব। পুলিশ ও র‌্যাব তখন আমাদের সাহায্য করবে। তা ছাড়া আমাদের কাছে তো কোন বেআইনি অস্ত্র নেই। আমাদের হাতে থাকবে ঈমানী আন্দোলনে আত্মরক্ষার সুন্নতী লাঠি। খুব দরকার হলে দেশীয় অস্ত্রপাতি, বিভিন্ন দোকান ও বাড়িঘর থেকে চলে আসবে। অবশ্য বড় বড় আলেমদের হত্যার যে কথা শোনা যাচ্ছে, তার কোন আভাস পেলে দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ যত ধরনের ব্যবস্থা দরকার সবই করবে। ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুড়’ নিয়েই মানুষ প্রস্তুত থাকবে। যারা নামাজ-বন্দেগী বেশী করে না, তারাও তখন অস্ত্রপাতি হাতে নাস্তিকদের রুখে দাঁড়াবে।

কাঁচপুর থেকে যাত্রাবাড়ি ও বুড়িগঙ্গা প্রথম ও দ্বিতীয় সেতু এলাকায় দেখা গেছে অবরোধে অংশগ্রহণকারী মুসল্লীদের অভ্যর্থনা জানানোর সাজ সাজ প্রস্তুতি। ঘন ঘন পুলিশী টহল, গোয়েন্দাদের আনাগোনা ও রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের যাতায়াতে এসব এলাকার মসজিদ-মাদরাসা কর্তৃপক্ষ একটু বিব্রত। কিন্তু লংমার্চের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে মাদরাসা মসজিদগুলোয় এবার লোকজন অপেক্ষাকৃত কম উঠেছেন। এবার বেশির ভাগ লোক আশ্রয় নিচ্ছেন বাড়ি-ঘর, কল-কারখানা ও স্কুল-কলেজে। চিহ্নিত গু-া পা-া ও চিহ্নিত এমপিদের পালিত কিছু ক্যাডার ছাড়া সাধারণ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই বরং হেফাজতের লোকদের এবার আশ্রয় দিচ্ছে, তাদের আপ্যায়ন করছে বেশী। বিএনপি ও অন্যান্য দলের লোকদের তো কথাই নেই। ধর্মীয় আবেগ ও অরাজনৈতিক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম এখন বাংলাদেশের গণমানুষের প্রাণের সংগঠন। কি সমাবেশ, কি লংমার্চ, কি অবরোধ সবখানেই সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। উচ্ছ্বসিত আশাবাদ। মানুষ যেন বলতে চাইছে, ৪২ বছরের ব্যর্থ রাজনীতির ধ্বংসস্তুপে জন্ম নেয়া সবুজ কিশলয় হেফাজতে ইসলাম। বহু আলোচিত, চির কাক্সিক্ষত তৃতীয় শক্তি। বাংলাদেশের তৌহিদী জনতার মূলধারার অবধারিত উত্থান। ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। অনিবার্য প্রেসার গ্রুপ হেফাজতে ইসলাম। হেফাজত আসছে, রাজপথ কাঁপছে। হেফাজত নেতৃবৃন্দের ঝটিকা সফর ও তড়িৎ প্রবাহের মত শত কর্মসূচির মধ্যদিয়ে কেটে গেল একটি মাস। বাংলার মুসলমানের অবিসংবাদিত আধ্যাত্মিক নেতা নবতিপর শিক্ষাগুরু শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমাদ শফী মাত্র তিন বছর আগে ময়দানে নেমেছিলেন হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচী নিয়ে। নাস্তিক-মুরতাদ ও ধর্মদ্রোহী নেতৃত্ব যখন বাংলাদেশের প্রজন্মকে ধর্মবিদ্বেষী, ধর্মবিমুখ বানাতে উদ্যোগী হয়। শাসক ও তার দোসর শক্তি যখন সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি এবং জনজীবনকে পরিপূর্ণ ‘নিধর্মীকরণ’ প্রক্রিয়ার আওতায় আনতে শুরু করে, ঠিক তখনই আল্লামা আহমাদ শফীর সংবেদনশীল অন্তর ক্রন্দনশীল হয়। তিনি বলেন, ৯৩ বছর হয়ে গেল। আর বাঁচার শখ নেই। যখন ইসলাম ধর্মই আক্রান্ত তখন তো এ দেশে আর বাঁচার অর্থও হয় না। আল্লাহর রাসূল (সা.) কে এমন জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করা হয় যে মাটিতে, সেখানে আমি বেঁচে থাকি কী করে? সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ আবার না বসানো পর্যন্ত আমি শান্ত হব না। ঘরে ফিরে যাব না। নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি এবং নবী (স.) এর প্রতি কটূক্তির জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান না হওয়া পর্যন্ত আমার ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই, খাওয়া নেই। দুনিয়ার কোন ভয়ভীতি, প্রলোভন আমাকে নিবৃত্ত করতে পারবে না। আমি এ আন্দোলনের ময়দানে শহীদী মৃত্যু চাই। ৫ তারিখ প্রয়োজনে জীবন দেব, কিন্তু অবরোধ ব্যর্থ হতে দেব না। এই অজাতশত্রু প্রায় শতায়ু বৃদ্ধের আহবানে জেগে উঠে বাংলাদেশ। সাড়া পড়ে যায় টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া জুড়ে। ইসলামী চেতনা, দেশপ্রেম, অপশাসন, অপরাজনীতি প্রতিরোধের সহজাত প্রেরণা ঢেউ খেলে যায় রূপসা থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বাংলার মানুষের মনে-মননে। তাদের ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ- বাংলার জমিনে নাস্তিক-মুরতাদদের ঠাঁই নেই। প্রিয়নবী (সা.) এর শত্রুদের ক্ষমা নেই।

আল্লামা শাহ আহমাদ শফী খুব ভেবে চিন্তে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান ধীরলয়ে, শান্তিপূর্ণ সহনশীলতায়। অহিংস শীতল আগুন লাভার মত বিস্তৃত হয় ৫৬ হাজারের বুকজুড়ে ১৫ কোটির প্রাণে প্রাণে। এই শান্তিময় দ্রোহ ও ভালবাসাপূর্ণ দহনে অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ এখন তৌহিদী গণজাগরণের অতুল লীলাভূমি। এমন নিবিড় তৃণস্পর্শী অকল্পনীয় জনঅভ্যুত্থান কখনো দেখেনি কেউ। যাদের চোখ নেই, যারা অন্ধ, যারা মোহময় নীতিহীনতার মধু চোষণে মগ্ন, কেবল তাদের চোখেই ধরা পড়ছে না এ অভূতপূর্ব মহাজাগরণ। তবে এ কোন বিস্ময়কর বিষয় নয়। তারা যদি দেখেও না দেখেন বা বোঝেও না বোঝেন, তাহলে জনজোয়ারের প্রচ- ঝাপটায়, স্রোতের তোড়ে অস্তিত্ব প্রকম্পিত হওয়ার মুহূর্তে তারাও বুঝবেন ও দেখবেন এ মহাজাগরণের রূপ ও স্বরূপ। কিন্তু তখন হয়ত আর নিজেদের গুছানোর সময় থাকবে না। অনুতাপ, অনুশোচনা বা সংশোধনের সুযোগও থাকবে না। অসংখ্য মহাসমাবেশ, পথসভা, মিটিং মিছিল, খতম, দোয়া, পরামর্শ ও ত্যাগ-তিতিক্ষাপূর্ণ কর্মসূচির পথ বেয়ে ৫ মে ঢাকা অবরোধ। নানা বাধা-বিপত্তি, হুমকি ও হামলার চোখরাঙানি এড়িয়ে বৃহস্পতি ও শুক্রবারেই ঢাকার চারপাশে লক্ষ লক্ষ তৌহিদী জনতা নিজ নিজ অবস্থানে পৌঁছে গেছেন। শনিবার বাধা, হামলা ও প্রতিরোধ যতই দৃঢ় হোক কাফেলার কোন ক্ষতি হবে না। ধর্মীয় আবেগ ও দেশরক্ষার পবিত্র অনুভব রয়ে-যাওয়া কাফেলাগুলোকেও টেনে নিয়ে আসবে রাজধানীর ৮টি অবরোধ পয়েন্টে। আল্লামা আহমাদ শফীর নির্দেশে অবরোধ শুরু হবে, তার নির্দেশেই এর স্থিতি, গতি, দৈর্ঘ সমাপ্তি বা পরিণতি নির্ধারিত হবে। হেফাজত নেতৃবৃন্দ পরামর্শ দেবেন, আর আমীর আহমাদ শফী দেবেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। গত ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রামের মিটিংয়ে তিনি বলেছেন, ৫ তারিখের পরে কী হবে তা আমিও জানি না। সকল পরামর্শের পরেও শেষ সিদ্ধান্তের জন্য আমি আল্লাহর দিকে চেয়ে আছি। অহর্নিশ ডুবে আছি তার ধ্যান-খেয়াল ও জিকিরে। আল্লাহর হাবিবের (সা.) শানে বেয়াদবির শাস্তি ও ইসলামী শরীয়ার আলোকে রচিত ১৩ দফা দাবি আদায়ে ময়দানে নেমেছি। জানি না, আল্লাহ কোন পর্যন্ত নেবেন। তবে জীবন দেব কিন্তু পিছপা হব না। আল্লাহ আমার অন্তরে, ৫ তারিখ যে বিষয় ঢেলে দেবেন, সেটাই হবে ভবিষ্যৎ কর্মসূচী। দেশ, জাতি ও ইসলামী জাগরণের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ। আমরা উসিলা মাত্র। তবে এ কথা সত্য যে, শানে রেসালতের এ সংগ্রাম কখনই শেষ হবে না। যতদিন ইসলাম থাকবে ততদিন হেফাজতে ইসলামও থাকবে। যতদিন বাংলাদেশে ইসলামী জীবনব্যবস্থা কায়েম না হবে, ততদিন আলেম সমাজ ময়দানেই থাকবেন। তৌহিদী জনতার এ জাগরণের ধ্বংস নেই, ক্ষয় নেই, লয় নেই। আল্লাহ বাংলাদেশের তৌহিদী জনতাকে কবুল করুন।

http://www.dailyinqilab.com/details_news.php?id=106253&&%20page_id=%205

বিষয়: বিবিধ

১৩৫০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File