সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন মধ্যযুগেই হয়েছে ।

লিখেছেন লিখেছেন বিদ্রোহী রণক্লান্ত ২৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০৩:১৭:০৯ রাত



হেফাজতে ইসলামের ৫ মে’র ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে সরকার সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবেলা করার ঘোষণা দিয়েছে। একইসঙ্গে সরকার সমর্থক নারী সংগঠনগুলো ২৭ এপ্রিল হেফাজতের ১৩ দফার বিরুদ্ধে সমাবেশে ডাকলেও আজ তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর আগে কিছু ইসলামী সংগঠন হেফাজতের বিরুদ্ধে সমাবেশ করে আল্লামা শফীর ফাঁসির দাবি জানিয়েছে। তো সরকার কেন হেফাজতের ঢাকা অবরোধকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে চায় কিংবা নারী সংগঠনসহ অন্যান্য সংগঠনগুলো কেন অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে- সে ব্যাপারে রেডিও তেহরান কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তুহিন মালিকের সঙ্গে। আমাদের সময় ডটকম এর পাঠকদের জন্য পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাতকারটি উপস্থাপন করা হল

# হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে সরকার। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুই দিক দিয়েই ব্যবস্থা নেয়া হবে। সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে পত্র-পত্রিকার খবরে আমরা দেখেছি। আপনি জানেন যে, এর আগেও হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ ও মহাসমাবেশের একদিন আগ থেকে সরকার সারা দেশের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এবার সরকার হেফাজতকে প্রতিহত করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পরিণতি কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

ড. তুহিন মালিক : আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে, হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক কিছু ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে সরকারের কাছে দাবি পেশ করেছিল এবং এ ব্যাপারে সরকারকে প্রায় এক মাস সময় দেয়ার পর তারা একটি স্মারকলিপি দেয়, তারপর লংমার্চে যায়। সরকার তখন হেফাজতের সেই লংমার্চকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছিল এবং জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সমস্ত জায়গায় বাধার সৃষ্টি করে সেই লংমার্চ ও সমাবেশকে বানচাল করার চেষ্টা করেছিল।

এরপর হেফাজত ঢাকা অবরোধের যে কর্মসূচি দিয়েছে সরকার তা বানচাল করতে কেবল প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপই নেয়নি বরং ধর্মবিরোধী কৌশল অবলম্বন করেছে। এখানে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে বিষয় তা হচ্ছে, সরকার হেফাজতের ১৩ দফাকে প্রচার মাধ্যমের দ্বারা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। আর সবচেয়ে বড় দুঃখজনক বিষয়টি হচ্ছে- হেফাজতের আন্দোলনকে দেশের নারী সমাজের মুখোমুখী করে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ইসলামের যে মূল ধারার সংস্কৃতি সেই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটা প্রতিপক্ষ হিসেবে সরকার নারী সমাজকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।

আরো একটি ভয়ঙ্কর বিষয় এখানে রয়েছে। আর তা হচ্ছে- গার্মেন্টে আমাদের যেসব মা- বোনেরা কাজ করছেন হেফাজতের আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য তাদেরকে দিয়ে আগামী ২৭ এপ্রিল একটা মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। আমরা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমেও জেনেছি, বিভিন্ন নারী সংগঠন, উন্নয়ন সংগঠন, এনজিও, গার্মেন্টের কর্মী ও ট্রেড ইউনিয়নসহ অন্যান্য ইউনিয়নগুলোকে সরকারী ব্যবস্থায় এর বিরুদ্ধে মাঠে নামানোর নির্দেশ দিয়েছে এবং ব্যবস্থা করছে। সরকার এটাকে এমনভাবে করছে যে, ধর্মকে নারীদের মুখোমুখি করে ফেলা হচ্ছে।

এর আগেও সরকার গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে যে খেলাটা খেলেছিল সেখানেও রাজনীতির খেলায় ধর্মকে প্রতিপক্ষ করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে। এখন আবার নারী সমাজকেও ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। সরকার একটা পর একটা ফ্রন্ট খুলেই যাচ্ছে। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক এবং ভয়ঙ্কর যে বিষয় সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে ধর্মীয় অনুভূতি রয়েছে সেই অনুভূতিকে রাজনৈতিকভাবে এবং নারী সমাজকে দিয়ে প্রতিহত ও মুখোমুখি করার চেষ্টা। এমনিতেই আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। একদিকে ধর্মকে রেখেছে অন্যদিকে রেখেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এরমধ্যে যদি আবার নারী সমাজকে সম্পৃক্ত করা হয় তাহলে রাষ্ট্রকে আরো বেশি খণ্ডন করা হবে। এভাবে খণ্ডিত করে ফেললে সেটা রাষ্ট্রের জন্য যেমন ভয়ঙ্কর হবে শাসকগোষ্ঠীর জন্য তার চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হবে।

আপনারা একটু খেয়াল করলে দেখবেন যে, হেফাজতের গত লংমার্চে সরকারের ভেতরের যে শক্তিগুলো ছিল, ১৪ দলের যে শরীক দলগুলো ছিল, তারমধ্যে বড় যে শরীক জাতীয় পার্টি- তারা কিন্তু হেফাজতের সম্পূর্ণ সমর্থন করেছে। শুধু তাই নয়, আপনি দেখেন সিলেটের মেয়র উনি কিন্তু হেফাজতের কর্মীদেরকে পানি পান করিয়েছেন। তাছাড়া ঢাকা থেকে শুরু করে প্রায় সবগুলো জেলাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীরা কিন্তু সহযোগিতা করেছেন। তারা ধর্মের ইস্যুতে রাজনীতির বাইরে চলে এসেছেন। তারা ইহকাল ও পরকালের কথা চিন্তা করে এমনটি করেছেন। তাছাড়া স্থানীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও কিন্তু তারা ধর্মীয় অনুভূতির বাইরে যেতে পারেননি। সেক্ষেত্রে সরকার যদি এবারও এই খেলাটা খেলতে চায় তাহলে সরকার কেবল দেশের মানুষের কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে না, নিজের দলের নেতাকর্মী থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আর যে ইস্যুতে হেফাজত তাদের ১৩ দফা দিয়েছে সেটা হেফাজতের সাম্প্রতিক কোন ইস্যু নয় এটা ট্রেডিশনাল ইসলামী রাজনীতির চৌদ্দশ'বছরের দাবির একটা সমন্বয় করা হয়েছে। এই দাবির বড় অংশ হচ্ছে যারা আল্লাহ এবং রাসূল (সা.)কে অবমাননা করেছেন তাদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার সম্পূর্ণ একটি আইন প্রণয়নের কথা বলেছেন। এখানে রাজনীতির কোন বিষয়, হরতাল কিংবা কোন আন্দোলন বা কর্মকাণ্ডের সুযোগ নেই।

# আমরা দেখলাম মহাজোটের শরীক দল বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন বলেছেন- হেফাজতের ১৩ দফা আমাদেরকে চৌদ্দশ বছর পিছিয়ে দেবে। কেউ কেউ বলেছেন- মধ্যযুগে নিয়ে যাবে।

এসব নেতা ইঙ্গিতে এমন একটি সময়ের কথা বলেছেন যখন মানবতার মুক্তির দূত মহানবী (স.) পৃথিবীর বুকে শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং বাংলাদেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ মুসলমান। চৌদ্দশ’ বছরে ফিরে যাওয়ার কথা বলে কি আসলে আবার ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা হচ্ছে না?

ড. তুহিন মালিক : অবশ্যই ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা হচ্ছে। আপনি সঠিকভাবেই বলেছেন, আসলে যদি মধ্যযুগের কথা বলা হয় তার মানে পাঁচশ’ থেকে ষোলশ' সাল পর্যন্ত ধরা হয়। যতরকম ভাল কাজ এবং সভ্যতার উতকর্ষ সাধন তার সবকিছুই কিন্তু মধ্যযুগেই হয়েছে। সেই মধ্যযুগে রাসূল (সা.) যখন এসেছিলেন তখন আইয়ামে জাহালিয়াতের যুগ ছিল। নারীদের জীবন্ত কবর দেয়া হত। সেই নারীকে মর্যাদা দিয়েছে তার সম্পত্তিসহ সমস্ত দিকে ইসলাম তাদেরকে অধিকার দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পারস্য থেকে শুরু করে, তুর্কি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং স্পেন পর্যন্ত কিন্তু মুসলমানদের শিক্ষা সংস্কৃতি এবং অন্যান্য ঐতিহ্য কিন্তু সম্প্রসারিত হয়েছিল। ফলে এই মধ্যযুগটা কিন্তু খুব আলোকোজ্জ্বল সময়। এখন যদি রাশেদ খান মেনন কিংবা ইনুর মত ‘বস্তাপচা নাস্তিক’রা এই ধরনের কথা বলে ইসলামকে অবমাননা করতে চায় সেক্ষেত্রে রাজনীতিতে তাদের মত পরজীবী উচ্ছিষ্ট যারা আছেন, যারা আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করছেন একসময় মধ্যযুগে যারা নরপিশাচে পরিণত হয়েছিল তাদের মত এদের ভাগ্যেও কিন্তু একইরকম পরিণতি নেমে আসবে। কারণ তারা যে কথাগুলো বলছে এটা কিন্তু রাজনীতির কথা না। তাদেরকে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে ইসলাম কোন রাজনীতির বিষয় না, ইসলাম কোন মতাদর্শ না, ইসলাম কোন ইজম না, এটা সমাজতান্ত্রিক কোন বিষয় না যে, ৯০ বছরের সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব যেমন পুঁজিবাদী বিশ্বের দ্বারা নিঃশেষ হয়ে যাবে। ইসলাম একটা ঐশী ধর্ম এটা মতবাদ না, এটাকে এমনি এমনি শেষ করা সম্ভব না। কোন একটি আদর্শকে পরাস্ত করা সম্ভব কিন্তু কোন ঐশী ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব না। ইনু এবং মেননরা এ কথাটা ভুলে গেছে। যদি তারা ইসলামের বিষয়টি ভাল মত মনে না রাখতে পারে বা অনুধাবন না করতে পারে তাহলে লংমার্চে যেটা ঘটেনি সেটা ঢাকা অবরোধে ঘটবে।

# হেফাজতের পক্ষ থেকে কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে যে, তাদের ১৩ দফা না মেনে সরকারে থাকা যাবে না। সরকার কৌশলী মারপ্যাঁচে তাদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে এমন অভিযোগ করে হেফাজতের নেতারা বলেছেন, ইসলাম রক্ষার এ আন্দোলনে প্রয়োজনে লাখো মুসলমান শাহাদাতবরণ করবে। তো লাখো মানুষের শাহাদাতের প্রশ্ন কেন আসছে? আসলেই কি বাংলাদেশে ইসলামকে এতটা বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে যে, এ প্রসঙ্গ আসছে?

ড. তুহিন মালিক : দেখুন! এটার কিন্তু একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষিত আছে। এটা শুধু এই সরকারের সময় না বিগত প্রায় ১০ বছর ধরে মূলত আপনি দেখেন ৯/১১ পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইসলামকে দোষী করে, ইসলামকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যায়িত করে যে একটি মতাদর্শ তৈরি হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া এটাকে যেভাবে করাল গ্রাসে নিমজ্জিত করেছে বাংলাদেশ কিন্তু এটার বাইরে কিছু নয়। তখন থেকে আমাদের দেশে শায়েখ আবদুর রহমান, বাংলা ভাইয়ের জন্ম হয়েছে। বিভিন্ন মাদ্রাসায় এতিম ছাত্রদের ওপর হামলা হয়েছে এবং তাদেরকে দেখানো হয়েছে যে, মাদ্রাসাগুলো হচ্ছে জঙ্গী উতপাদনের জায়গা। তাছাড়া যেভাবে শায়েখ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইকে ধরে ফাঁসি দেয়া হয়েছে তাতে মনে হয়েছে যে, ইসলামকে নিপাত করে বোধহয় একটা বড় ধরনের বিজয় চলে এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এই সরকার ক্ষমতায় এসে এটাকে কিন্তু ষোলকলা পূর্ণ করল। তারা এটা দেখানোর চেষ্টা করেছে যে, ইসলাম শুধু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত না এটা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল সেখানে মানবতা বিরোধী যে অপরাধ বা যুদ্ধকালীন যে অপরাধ সেটা ইসলামের লেবাসে করা হয়েছে অতএব ইসলামী ভাবধারার লোকেরা এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর এটা করতে গিয়ে সরকার ইসলামকে প্রতিপক্ষ করেছে, শান্তির বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেও প্রতিপক্ষ করেছে। আর এটা করাতে দেশের সাধারণ মানুষ যারা দাড়ি-টুপি নিয়ে রাস্তায় চলাচল করে তাদেরও জীবন ধারণ করাটা বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে।

আমরা দেখেছি গ্রাম-গঞ্জের অনেক মানুষ যখন ঢাকায় আসে তার আগে আমাদের কাছে ফোন করে বলে যে, আমরা দাড়ি টুপি নিয়ে ঢাকায় আসতে পারব কিনা? আর আসলেও বেঁচে থাকত পারব কিনা? এই যে একটা নিগ্রহ ভীতি হয়ে গেছে মুসলমানদের এটা কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হওয়ার পর যেভাবে দাড়ি টুপিওয়ালা মুসলমানদের দেখিয়ে দেখিয়ে ফাঁসি দেয়া হল এবং দাড়ি টুপিকে যেভাবে কটাক্ষ করা হল তারপর ব্লগাররা যেভাবে আল্লাহ ও আল্লাহর নবীকে অবমাননা করে ব্লগে যেসব কটুক্তি করেছে তাতে কিন্তু মুসলমানদের ইমেজ রক্ষা করা এবং মুসলমানদের সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকাটা ভয়াবহ হুমকির মধ্যে পড়েছে। তখনই কিন্তু হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনটা শুরু হয়েছে, তাদের আন্দোলনটা কিন্তু এমনি এমনি হয়নি ওই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছে। এ আন্দোলন ছাড়া মুসলমানদের অবস্থা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে গেলে হেফাজতে ইসলামের ওই দাবিগুলো নিয়ে সামনে আসতে হবে। হেফাজতের ১৩ দফার মূল স্প্রিড হচ্ছে- মুসলমানদের যে ইসলামি সংস্কৃতি এবং তাদের সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার যে অধিকার, ধর্ম নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার তা বাস্তবায়ন। এর মধ্যে নারী সমাজসহ অন্যান্য যেসব ট্রেডিশনাল দাবিগুলো রয়েছে সেগুলো ইসলামের মূল শিক্ষার বিষয়। এখন জেনা, অশ্লীলতা ও নারী পুরুষের অবাধে মেলামেশার কথা বলা হচ্ছে বা অনৈসলামিক বিষয়ের কথা হচ্ছে এটা তো হেফাজতে ইসলামের বিষয় না, এসব ট্রেডিশনাল ইসলামের বিষয় এবং কুরআনের বিষয়। ফলে ইসলামের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলছে, লাখো মানুষের শহীদ হওয়ার যে বিষয়টি তারা তুলছে তার প্রেক্ষাপট যে তৈরি হয়েছে সে কথা বলা যায়।

# হেফাজতে ইসলামের প্রথম মহাসমাবেশ শেষে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী এ সমাবেশের প্রশংসা করলেন এবং তাদের ১৩ দফা দাবি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার আশ্বাস দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারের একাধিক মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন- এই ১৩ দফার একটি দাবিও গ্রহণযোগ্য নয়। তো সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে প্রশংসা জানানো এবং আশ্বাস দেয়া পরে তা প্রত্যাখ্যান করা। সরকারের এমন দৃষ্টিভঙ্গীর কারণ কি বলে মনে করেন?

ড. তুহিন মালিক : দেখুন! সরকার দুটো পয়েন্টে হেফাজতের দাবি সম্পর্কে বলার চেষ্টা করেছে বলে আমার মনে হয়। প্রথম পয়েন্টটি হচ্ছে, সরকার বলছে এই দাবিগুলো আমাদের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- কেউ দাবি তুললেই যে আইন পাস করতে হবে এমন কথা নয়। মন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলেছেন তা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়। মন্ত্রীরা বলেছেন, তোমাদের এই দাবিগুলো যদি পাস করাতে হয় তাহলে তোমরা নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসে এই আইন পাস কর।

তবে সরকারের এই দুটো পয়েন্টের উত্তর একই রকম। তারা যদি বলে যে, এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সেক্ষেত্রে আমাদের প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বলেছিলেন যে, প্রয়োজনে তিনি শরীয়া আইনে তাদের বিচার করা হবে। তো শরীয়া আইন তো আমাদের রাষ্ট্রের কোন জায়গায় নেই, সংবিধানেও নেই। তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী নিজে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কথা বলেননি?

দ্বিতীয়ত হচ্ছে- প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাদের এ দাবি বাস্তবায়নের কোন সুযোগ নেই কেননা আমরা মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চালাচ্ছি। কিন্তু মদিনা সনদে ১৯টি প্রশাসনিক স্তর ছিল। তার মধ্যে দাওয়া বিভাগসহ আরো অন্যান্য বিষয় ছিল কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সেটা কোথায়? তাছাড়া মদিনা সনদে একটা উম্মাহর কথা বলা হয়েছিল কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তো একটা জাতির কথা বলা নেই একটা ধর্মের কথা বলা নেই। মদিনা সনদে ফৌজদারি কেসের ব্যাপারে রক্তমূল্য দিতে পারার বিধান ছিল। কিন্তু আমাদের আইন ব্যবস্থায় বা সংবিধানে সেটা নেই। তাহলে কি আমাদের প্রধানমন্ত্রী সংবিধান লঙ্ঘন করেননি?

আমাদের সংবিধান লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ শাস্তি এখন মৃত্যুদণ্ড। পঞ্চদশ সংশোধনীতে যোগ করা হয়েছে যদি কেউ সংবিধানের আস্থার বিপরীতে কোন কথা বলে তবে তা রাষ্ট্রদ্রোহীতা হবে এবং শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তাহলে প্রধানমন্ত্রী বা অন্যান্য মন্ত্রীরা যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন এবং সেটাকে আমলে না নেয়া হয় উল্টো ইসলামের ন্যায্য দাবিকে যদি বলা হয় ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক- এটাতো দ্বিমুখী আচরণ।

দ্বিতীয় বিষয়ে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীরা বলেছেন যে, তোমাদের দাবি পাস করতে হলে তোমাদেরকে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হবে। কিন্তু আপনারা দেখেন আইসিটি ট্রাইবুনালের বিচারে যখন কাদের মোল্লার ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন সাজা হল এবং রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার কোন সুযোগ আইনে ছিল না তখন গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের ভিত্তিতে আইনটাকে পরিবর্তন করে রাষ্ট্রকে আপিল করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি গণজাগরণ মঞ্চের জনগণের দাবির ভিত্তিতে আইনটা সংশোধন করেছি। তাহলে গণজাগরণ মঞ্চের ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোকের দাবি যদি জনগণের দাবি হয় তাহলে হেফাজতের সমাবেশের ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষের দাবি কেন জনগণের দাবি হবে না? এরা কি জনগণ না, এরা কি রাষ্ট্রের মালিক না, এরা কি রাষ্ট্রের নাগরিক না! এদের দাবিকে যদি বলা হয় মধ্যযুগের দাবি আর গণজাগরণ মঞ্চের দাবি যদি জনগণের দাবি হয়ে যায় তাহলে তো স্পষ্ট সরকার দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করছে।

# অরাজনৈতিক এ সংগঠনের আন্দোলনের ভবিষ্যত নিয়ে ক্ষমতাসীনরা প্রকাশ্যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেও তলে তলে তাদের আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাদের বিভিন্ন বক্তব্যে তা ফুটে উঠছে। হেফাজত অভিযোগ করছে, তাদের ১০ দফার ভুল ব্যাখ্যা করে সরকার কর্মজীবী নারীদেরকে আলেমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। তো সরকার আসলে হেফাজতকে সরকার আসলে ভয় পাচ্ছে কেন?

ড. তুহিন মালিক : সরকার এই কারণে ভয় পাচ্ছে দেখেন শেখ মুজিব থেকে শুরু করে তারা যতই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলুন আর যতই মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করুন না কেন একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখবেন শেখ মুজিবুর রহমান যখন ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন তখন শেষ কথাটা বলেছিলেন ‘এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’।

কমুনিস্টদের, বামদের অতিরিক্ত চাপের পরও কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ওআইসিতে জয়েন করেছিলেন। আর যেদিন তিনি ওআইসির সম্মেলনে গেছেন সেদিন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শেখ মুজিবের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছিল। কেউ চায়নি শেখ মুজিব ওআইসিতে যাক। তার দলের লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনি কেন ওআইসিতে যাচ্ছেন। তখন শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমি কারো মাখানো তামাক খাই না।‘ তার মানেটা কি? তার পক্ষেও কিন্তু ধর্মীয় রাজনীতির বাইরে আসা সম্ভব হয়নি। কারণ এখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। তাদের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হবে। এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও দেখেন নির্বাচনের আগে উনি মাথায় পট্টি বাঁধেন, হাতে তজবিহ নিয়ে ঘুরেন, হুজুর হয়ে যান। আর নির্বাচনের পরে তিনি তজবিহও ছুঁড়ে ফেলেন এবং টুপীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

আপনি তাদের নির্বাচনী স্লোগান দেখেন-‘নৌকার মালিক তুই আল্লাহ।’ আর যখন ভোট চলে যায় তখন ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ করেন। এটা তারা ভালমত বুঝে গেছে হেফাজতে ইসলামের যে সেন্টিমেন্ট এবং দাবি সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দাবি। এটাকে পাশ কাটিয়ে কিংবা এটার বিরুদ্ধচারণ করে তারা নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে পারবে না। এখন যদি হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধচারণ করে ধর্মের বিরুদ্ধচারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তাহলে কিন্তু এদেশের রাজনীতিতে তাদের কবর রচনা হবে। আর এ কথাটা তারা বুঝতে পেরেছে। আর বুঝতে পেরেছে বলেই তারা এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করতে চাচ্ছে যাতে সাপও মরল কিন্তু লাঠিও ভাঙল না। আর সেই কৌশলে হেফাজতকে হাতে রেখে যদি তাদের এই দাবিগুলোকে যদি পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায় তাহলে হয়ত তাদের মুখও রক্ষা হল এবং তাদের পেছনে যেসব শক্তি রয়েছে তাদেরকেও খুশী করা হল।

# আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আত হেফাজতের বিপক্ষে সমাবেশ করেছে এবং আল্লামা শফীর ফাঁসির দাবি করেছে। হেফাজত অভিযোগ করেছে, সরকারের পৃষ্টপোষকতায় তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে আহলে সুন্নাত। আপনার দৃষ্টিতে আহলে সুন্নাতের চলমান আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী বলে মনে হয় ।

ড. তুহিন মালিক : দেখুন! শুধু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আত নয় সব সময় একটা বাতিল শক্তি থাকে হকের বিরুদ্ধে। বর্তমানে যে বাতিল শক্তিগুলো আছে যেমন-কাদিয়ানী, মাইজ ভান্ডারী, মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ, দেওয়ানবাগী, সায়েদাবাদী; যারা ইসলামের মূল শিক্ষার বাইরে, যারা কুফরী ও শিরকের সঙ্গে যুক্ত সরকার এদেরকে হাতে নিয়েছে। আর এদের মাধ্যমে তারা ইসলামকে প্রতিহত করতে চায়।

বিগত চৌদ্দশ' বছর ধরে যারা ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ করেছে সরকারও তাদেরকে লুফে নিয়েছেন। এই যে আপনি আহলে সুন্নাত যাদেরকে বলেছেন-তারা মূলত মাইজ ভান্ডারী। ১৯২৬ সালে যিনি মাইজ ভান্ডারীর প্রতিষ্ঠা করেছেন, যিনি এর নেতা- ১৯৯১ সনে ১১ এপ্রিল তার প্রকাশিত একটা বই আছে যার নাম ‘বাইয়াতে সামথিং’। সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে যে, কেউ যদি জান্নাত পেতে চায় তাকে মুসলমান না হলেও চলবে, তাকে ভাল মানুষ হতে হবে। তো এই ধরনের ভ্রান্ত মতাদর্শী যারা আছেন এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে যারা সাংঘর্ষিক কাজ করে, সরকার তাদেরকে পকেটে রেখে কাজগুলো করার চেষ্টা করছে।

যুগে যুগে বিশ্বের সবদেশে সব আমলেই বাতিল শক্তি ছিল এবং বাতিলের লম্ফঝম্প ও চমকানি সব সময় ভাল হয়। তবে এই চমকানিতে কোন কাজ হবে না। কারণ চৌদ্দশ' বছর ধরে বাতিল শক্তি চেষ্টা করেও ইসলামকে ধ্বংস করতে পারেনি; এখনও পারবে না ইনশাআল্লাহ।

বিষয়: বিবিধ

১৫৯১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File