মনোরঞ্জনের সাংবাদিকতা ও একজন লাল মরিছ সম্পাদক
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে আহমাদ ০৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০৫:৪৭:৪৪ বিকাল
এক)
বাংলাদেশের জনগণ আজ দুই ভাগে বিভক্ত।সে ভাগের পরিচয় কলাম লেখক জনাব আলফাজ আনাম করেছেন এভাবে -
এক দিকে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ অপর দিকে ইসলাম ও ভূখণ্ডগত স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। যার নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশে নির্মূলের রাজনীতির প্রবক্তা কিছু বুদ্ধিজীবী ও ধর্মবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদ প্রচারের সাথে জড়িত কিছু তরুণ। আর অপর অংশে রয়েছে একেবারে সমাজের সাধারণ মানুষ, আলেম সমাজ এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।
দুই)
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আমরা এখন এক ধরনের মনোরঞ্জনের সাংবাদিকতার ধারা লক্ষ করছি। জাতিকে বিভাজনের কাজটিও ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারছে এসব গণমাধ্যম। বাংলাদেশে জনমত গঠন এমনকি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে কিভাবে গণমাধ্যম এজেন্ডা ঠিক করে দেয়, শাহবাগের আন্দোলন তার একটি বড় উদাহরণ। কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল এই সমাবেশের খবরটি শুধু গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেনি, প্রথম দিন থেকেই লাইভ সম্প্রচার করতে থাকে। একসাথে প্রায় ১০টি টেলিভিশন চ্যানেল এভাবে লাইভ সম্প্রচারে সাধারণ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে শাহবাগ।
তিন)
জামায়াত নেতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। এক দিনে মারা যায় ৬৬ জন। এর মধ্যে চিকিৎসা শেষে বিরোধীদলীয় নেতা ঢাকায় ফিরে সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দেন। বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাগের আন্দোলনকারীদের নষ্ট তরুণ এবং এই মঞ্চ ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানান।
চার)
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো শাহবাগের এই মঞ্চে শয্যাশায়ী হয়েছিল। পতিত বাম প্রভাবিত সরকারের মনোরঞ্জনের জন্যই তারা প্রচারযন্ত্রকে মাত্রাহীনভাবে ব্যবহার করেছে। গণমাধ্যমই এর আদুরে নাম দিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। কিন্তু এই গণজাগরণ ছিল আশ্রিত জাগরণ, যা সৃষ্টি করেছিল মিডিয়া।
সরকারের সমর্থনে ব্যবসায়ীদের চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে বিরিয়ানি-পোলাও খাইয়ে; পুলিশি নিরাপত্তায় কোনো গণজাগরণ সম্ভব নয়। এ জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি দরকার। শাহবাগের আন্দোলনকে যখনই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল এবং দেশের সামাজিক শক্তির উৎস আলেম সমাজ চ্যালেঞ্জ করেছে, তখনই ফানুসের মতো উড়ে গেছে।
পাঁচ)
প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের গণমাধ্যম কি এই রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়? অবশ্যই ওয়াকিবহাল। সমস্যা হচ্ছে মনস্তত্ত্ব।(নগদ নারায়ন তো রয়েছেই)
বাংলাদেশে সবচেয়ে অল্প সময়ে খ্যাতিমান রিপোর্টার হওয়ার সহজ উপায় হচ্ছে জামায়াত-শিবির বা ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল নিয়ে রিপোর্ট করা। কারণ এসব দল নিয়ে কোনো খবর বা মতামত প্রকাশে যাচাই-বাছাই বা সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যের দরকার হয় না। শুধু প্রয়োজন খানিকটা কল্পনাশক্তি ও মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখার ক্ষমতা।
কারণ জামায়াত-শিবির বা ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল নিয়ে কোনো স্টোরি করতে পারলে নির্ঘাত লিড বা সেকেন্ড লিড। ফলে রিপোর্টারের নাম চার দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তার কদরও বাড়ে। আজ এই সংবাদপত্র বা টেলিভিশন তো ছয় মাসের মধ্যে অন্য সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে চাকরি হচ্ছে। কদরের সাথে বেতনও বাড়ছে। এই সাংবাদিকেরা অন্তত এ কারণে জামায়াত-শিবিরের ওপর কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন এই দল না থাকলে বেতন বাড়া কিংবা বেশি বেতনে চাকরি বদলের প্রক্রিয়াটি থেমে যাবে।
ছয়)
এখন প্রতিদিন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের খবর থাকছে।
জামায়াত-শিবিরের ইটপাটকেল কিংবা ককটেল নিক্ষেপে পুলিশ আহত হচ্ছে। আবার পুলিশের গুলিতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা প্রাণ হারাচ্ছে বা আহত হচ্ছে। জামায়াত-শিবির যদি একপক্ষীয় তাণ্ডব চালায় তা হলে তাদের এত নেতাকর্মী আহত বা নিহত হচ্ছে কিভাবে? তা হলে তাণ্ডবের খবরের মধ্যে নিশ্চয়ই ফাঁক আছে।
কোনো সংবাদকর্মী বা সম্পাদক কী খোঁজ নিয়েছেন রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বা সিরাজগঞ্জে যেখানে সহিংসতা হচ্ছে কেন সেখানে বারবার একই ঘটনা ঘটছে। এর প্রধান কারণ পুলিশের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন মামলায় হাজার হাজার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এমন অনেক পরিবার আছে যে পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য মাসের পর মাস বাড়িতে থাকতে পারছে না। এর ওপর ঘুষ বাণিজ্য তো আছে। ফলে নারী ও শিশুরা পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দেখিনি। এ পর্যন্ত যেসব লোক মারা গেলে সেসব পরিবারে কী বিপর্যয় নেমে এসেছে তা নিয়ে কোনো মানবিক রিপোর্টও আমরা দেখছি না।
একটি দৈনিক পত্রিকায় সাতক্ষীরায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষের সময় একজন আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর ওপর করুণ মানবিক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে ১৪ জন মানুষ মারা গেছে। তাদের পরিবারে কী কান্না নেই। সেসব পরিবারের মৃত্যুর বেদনার খবর কোথায়। আজকে জনগণের প্রতিরোধে গাছ কাটা নিয়ে হাহাকারের সীমা নেই। কিন্তু রংপুরের পীরগঞ্জে ধানক্ষেতে পুলিশ যে কৃষককে হত্যা করেছে সে পরিবারে হাহাকারের খবর কোথায়?
সাত)
পুলিশের সাথে রাজনৈতিক কর্মীদের এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম ঘটছে তা নয়। শুধু ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের দিন দৈনিক সংবাদের খবর অনুযায়ী ১৫ ব্যক্তি মারা গেছে।
জামায়াতের সাথে সে সময় আওয়ামী লীগ এই নির্বাচন ঠেকানোর জন্য আন্দোলন করেছিল। এ দিন আওয়ামী লীগের হামলায় একজন আনসার সদস্য নিহত হয়। ১৯৯৩-১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় একাধিক পুলিশ সদস্য মারা গেছে। বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ফার্মগেটে এক পুলিশ সদস্যের হাতের আঙুল কামড়ে নিয়েছিলেন। এ নিয়ে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হয়েছিল।
আবার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম যেদিন লাঠিমিছিল নিয়ে হাইকোর্টে হাজির হয়েছিলেন সেদিন ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছিল; কিন্তু তা কি তাণ্ডব ছিল?
কিংবা ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর প্রধান বিচারপতির এজলাস ভাঙচুর যারা করেছিল তারা কী প্রতিবাদ জানিয়েছিল না তাণ্ডব চালিয়েছিল?
তখন কেন তাণ্ডব শব্দটি আবিষ্কার হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণেই কি শব্দটি হারিয়ে গিয়েছিল? আজকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে যে শব্দের ব্যবহার হচ্ছে তা মনোরঞ্জনের সাংবাদিকতার অংশ মাত্র।
আট)
কারণ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বড় অংশ শুধু আর্থিক কারণে নয় বিশ্বাস এবং নীতির দিক থেকে এখন সরকারের সাথে শয্যাশায়ী হয়েছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই গণমাধ্যমেই আবার পেশাদারিত্ব কিংবা বস্তুনিষ্ঠতার স্লেøাগান নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হচ্ছে। শাহবাগের আন্দোলনে গণধিকৃত পরিণতির মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমের এই মুখোশ খুলে গেছে।
হেফাজতে ইসলাম প্রধানের ভাষায় -
এক পক্ষ হল নাস্তিক,মুরতাদ,আর অন্য পক্ষ হল ঈমানদার মুসলিম।দেখুন তার নিজের ভাষায় -
https://www.facebook.comdigtal.bakshal
লেখাটি আমার নিজের নয়। বরং নয়া দিগন্তে প্রকাশিত কলামের সংকিপ্ত রুপ।
বিষয়: রাজনীতি
১২৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন