মানব রচিত মতবাদের উম্মতদের ৪৩ বছর।
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে আহমাদ ১২ জানুয়ারি, ২০১৫, ০১:৪১:২৩ দুপুর
এক)
বেশ কয়েকবছর আগের কথা।বাসায় বসে স্থানীয় টিভি (আরবী) দেখছি। ঈদ নিয়ে একটি সাক্ষাতকার। দেশের প্রধান ব্যক্তি,বেশ কয়েকজন পরিচিত আলেম ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন বিশ্ববাসীকে। প্রধান ব্যক্তির যে ভাষায় ঈদ শুভেচ্ছা জানালেন ঠিক একই ভাষায় ঐ আলেমগণ বললেন। বাংলা তরজমা করলে এমন দাড়ায় - “আমরা পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা জানাই আরব ও মুসলমানদেরকে।”আরবী শব্দটি হল - “উম্মাতাল আরাবিয়া ও উম্মাতাল মুসলিমা।”
নিজ ঘরে বসে ভাবছিলাম - তাহলে উম্মাহ বলতে এতদিন যা বুঝে এসেছি সেটা সঠিক নয়। যদি আরবী আর মূসলমান এক উম্মাহ না হয়, তাহলে আমি খাটি বাঙ্গালী হতে সমস্যা কোথায়? আমি এখানে আওয়ামী বাঙ্গালীর কথা বলছি।যারা বাংলাদেশের মুসলিম বাঙ্গালীকে রবিন্দ্র বাঙ্গালী বানাতে চায়। অথবা সাংস্কৃতির নামে মুশরীক বানাতে চায়।
এই একই প্রশ্ন করেছি - অনেক শাইখকে। জিজ্ঞেস করেছি এটা কেমন কথা। উম্মাতাল আরাবী ও উম্মাতাল ইসলামী? আমি বলার চেষ্টা করেছি - যদি এই ব্যাখ্যা সঠিক হয় -তাহলে কোরআনের এই আয়াতটির ব্যাখ্যা কি হবে - সূরা আম্বিয়া - ৯২ নং আয়াত।
إِنَّ هَـٰذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ ﴿٩٢
তরজমা - তারা সকলেই তোমাদের জাতি; একই জাতিতে তো বিশ্বাসী সবাই এবং আমিই তোমাদের পালনকর্তা, অতএব আমার বন্দেগী কর।
(আমি কয়েকটা তাফসীর দেখেছি। তার মধ্যে দুইটিতে করা হয়েছে উম্মাহর অর্থ ধর্ম।একটিতে করা হয়েছে জাতি।আবার একটিতে করা হয়ছে জাতি।)
উম্মাহ বলতে আমরা যা বুঝি তার ব্যাখ্যা করার জন্য এই লেখা নয়। বরং আমাদের সমাজে উম্মত - বাংলাতে যা বলি, তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন।
আরবীতে উম্মাহ বলতে জাতীকে বুঝানো হয়। মুসলিমরা একই উম্মাহর সদস্য। পৃথিবীতে প্রতি চার জনে একজন সেই উম্মার সদস্য।এ নিয়ে আছে বড় রকমের বিতর্ক।
কোরআনে বর্নিত উম্মাহ বলতে যা বুঝানো হয়েছে তার জন্য প্রয়োজন খেলাফত ব্যবস্থা। পৃথিবী থেকে খেলাফত ব্যবস্থার বিদায়ের পর উম্মাহ বলতে মুসলিম উম্মাহকে সামগ্রিক ভাবে বুঝানো হয়।
আরব ও আযমের মুসলমানরা নিজেদেরকে ই একই উম্মাহ বলেন না। এবং মানতে চান না।এর কারন অনেক। একটি হল - মুসলিম দেশ সমুহের রাষ্ট্র নায়কদের মানব রচিত মতবাদের মানসিক গোলামী। এই দাসত্ব শুধু রাজনৈতিক নয় বরং সাংস্কৃতি জীবনে অনেক বেশী। আর অর্থনৈতিক গোলামী তো আছে। নিজেদের অতীত ঐতিহ্য বা সাংস্কৃতি সেক্যুলার শাসকদের কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয়। উর্দ্দু এক কবি মধ্যপ্রাচ্য সফর করে গিয়ে লিখেছিলেন - হায় খোদা - এই সেই জাতি যার জন্ম হয়েছিল উম্মে ইসমাঈল থেকে। আর যার সমাপ্তি হয়েছে উম্মে কুলসুমে এসে। ( উম্মে ইসমাঈল হলেন বিবি হাজেরা। আর উম্মে কুলসুম হলেন মিশরীয় শিল্পী উম্মে কুলসুম)।
দুই)
প্রতিটি ঈমানদার কালেমা পড়ে মুসলমান হতে হয়। কালেমার দাবী হল -একজন মুসলমান তার জীবনের সকল দিক ও বিভাগে দাসত্ব করবে একমাত্র মহান আল্লাহর এবং আনুগত্য করবে বিশ্ব নেতা মোহাম্মদ (সাঃ) এর। কিছু সময়ের জন্য মুসলমান - আবার কিছু সময়ের জন্য সেক্যুলার। বা কিছু সময়ের জন্য জাতীয়তাবাদ। অথবা কিছু সময়ের জন্য সে কমিউনিষ্ট। যে মুসলমান - সে এরকম করতে পারে না। করলে সে মুসলমান থাকতে পারে না। মুসলমান কখনো মুনাফিক হতে পারে না। আচরণ বা চরিত্রে সবসময় মুসলমান থাকতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ বা জাতীয়তাবাদি মুসলমান হতে পারে না। বিষয়টা সম্পুর্ণ বিশ্বাসের বা আকিদার প্রশ্ন। কেননা মানুষের যা আকিদা তারই বহিপ্রকাশ ঘটে চরিত্রে।
বাংলাদেশে কয়প্রকার উম্মাত আছে? উম্মত বলতে অনুসরণ - অনুকরণ বুঝানো।
প্রথম প্রকার বাঙ্গালী উম্মত যা রবিন্দ্রপন্থী উম্মত আরো পরিস্কার করে বললে রামপন্থী উম্মত।
দ্বিতীয় প্রকার হল - সেক্যুলার উম্মত যার মধ্যে নাস্তিক আস্তিক মিলিয়ে আছে।
তৃতীয় প্রকার হল - জাতীয়তাবাদি উম্মত। এই শ্রেণী আরো ককটেল বা মিশ্র।
বাংলাদেশে সবাই জন্ম সুত্রে মুসলমান। এটাকে একটি পরিচিতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করার কোন শিক্ষা আমাদের পারিবারিক আবহে দেয়া হয়না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ৭১ পরবর্তী সময় সবাইকে বাঙ্গালী উম্মতে পরিণত করা হয়। তখন মুজিববাদ নামের এক আজিব আদর্শের কথা বলা হত। এর পর মুসলিম ফ্লেবার যুক্ত বাংলাদেশী জাতিয়াতবাদ। তারপর ৯ বছর বাঙ্গালী আর বাংলাদেশী যুক্ত সময়। ৯০ গণ আ্ন্দোলনের পর দেশ একবার বাঙ্গালী - একবার বাংলাদেশী - আবার মধ্য ভাগে দুই বছর হল বেশী বেশী পিওর বাঙ্গালী যুক্ত উৎকট প্রগতিশীলদের সময়। এভাবে ই চলেছে আমাদের জাতীয় জীবনের ৪৩টি বছর। এখন চলছে বামপন্থী রামপন্থী উম্মতদের স্বর্ণযুগ।
কিছুটা ভয় আর কিছুটা ইগো নিয়ে সংবিধানের ৫২টি ধারা সংযুক্ত/পরিবর্তন করা হয়েছে বাঙ্গালী উম্মতদের জন্য। যা কখনো পরিবর্তন যোগ্য নয়। যারা তা করবে তারা বর্তমান আইনে মুরতাদ হবে। তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। এতো গেল রাজনৈতিক উম্মতদের কথা।
তিন)
ধর্মীয় উম্মতদের আলোচনা করা প্রয়োজন। রাসূলের উম্মত হবার সম্মান যাদের হয়েছে তাদের সংখ্যা খুব বেশী নয়। ইসলাম বুঝে শুনে মানার আদর্শ। কয়জন আমরা তাতে আছি। বক্তৃতায় বা আলোচনায় বলে থাকি আমরা রাসূলের উম্মত। অনুসরণ,অনুকরণ,আনুগত্যে আমরা কয়জন রাসূলকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছি। আমাদের চরিত্রে মোহাম্মদ (সাঃ) কে কয়জন পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য করি। অথচ দেশের বৃহত জনগোষ্ঠী হল রাসূলের উম্মত। ব্যক্তি জীবনে রাসুলের উম্মত,রাজনৈতিক জীবনে সেক্যুলার বা জাতিয়াতাবাদ অথবা সমাজতন্ত্রের উম্মত। অর্থনৈতিক জীবনে পুজিবাদের উম্মত।সাংস্কৃতিক জীবনে রবিন্দ্র বা মুশরিকী উম্মত। এইতো হল আমাদের জীবন বোধ। আমাদের চরিত্রের এত বৈচিত্র হওয়ার কারনেই আজ এই দশা।
যে পুলিশ,র্যব,আর্মী,সিভিল কর্মকর্তা অথবা রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোরআনের তাফসীরকে জঙ্গী বলে - হাদীসের গ্রন্থকে জঙ্গী বলে,ইসলামী সাহিত্যকে জঙ্গী বই পত্র বলেন তারা ও রাসূলের উম্মত! তারা সংসদে দাবী করেন - মদিনার সনদে দেশ চালাচ্ছেন। আবার এই মহা প্রতারণা বা প্রতারকদের সমর্থন করছেন রাসূলের উম্মতরাই। আমাদের মিডিয়াতে যারা কাজ করেন তাদের ৯০ ভাগই মুসলিম ঘরের সন্তান। বাংলাদেশে যে কয়জন সিনিয়র সাংবাদিক আছেন তাদের মধ্যে কয়জন রাসূল (সাঃ)কে তাদের আদর্শ মানেন। মিডিয়াতে নতুন কিছু শব্দ আবিস্কার / চালূ করা হয়েছে, যেমন - ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার - ধর্ম ব্যক্তির উৎসব সবার - ৭১ এর চেতনায় ফিরে যেতে হবে - ৭১ এর চেতনা সেক্যুলার বা বঙ্গালী জাতিয়তা - অথবা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা ইত্যাদি শব্দের আড়ালে মূলত মানব রচিত মতবাদের উম্মতরা শিরকী চিন্তাধারা প্রচার করছে।ইতিমধ্যে ডিজুজ প্রজন্ম নামের রাসূলের উম্মতদের প্রিয় সন্তানরা এই প্রপাগান্ডার আক্রান্ত।
চিন্তার জগতে জাতিকে বিভক্ত করা হয়েছে। যাকে ইসলামী পরিভাষায় - মৌলিক আকিদা বলা হয়। আকিদা সঠিক না থাকার কারনে তাহাজ্জুদ পড়ুয়া প্রধামন্ত্রী বলতে পারেন - মা গজে চড়ে আসার কারনে শস্য বেশী হয়েছে।
আমি এই আকিদাকে বলে থাকি চেতনা বা বিশ্বাস। একজন মুসলমানের চেতনা বা বিশ্বাস তার কর্মে প্রতিফলিত হয়। তিনি যত বড় পন্ডিত বা নেতৃত্ব হন - তিনি রাসূলের উম্মত হিসাবে পরিচয় দিতে পারবেন না - যতক্ষণ তিনি তার জীবনের সামগ্রিক বিষয়ে রাসূলকে আদর্শ না মানবেন। এই দাবী কোন ব্যক্তির, কোন দলের নয়।। রাসূলের উম্মত হতে হলে তা মানতে হবে।
আজ জাতির সামনে এই কথা বলার কেউ নেই। যদি কেউ বলে তাহলে সাথে সাথে সব শিয়ালের এক আওয়াজের মত করে বলা হয় - চেতনা বা ৭১ মানেনা। অথবা বলা হয় রাজাকার।আলবদর ইত্যাদি। বাংলাদেশে যারা এই সঠিক ইসলামকে প্রেজেন্ট করতো - নিজেরা চর্চা করতো - তাদের সাহিত্যে,বক্তৃতায় গণমানুষের সামনে পেশ করতো। যারা সত্যিকার উম্মতে মোহাম্মদী (সাঃ) হিসাবে জাতিকে পথ দেখাতো। তারা আজ সবাই মানব রচিত মতবাদের উম্মতদের বড় দুশমন। সমাজের এই শ্রেণীর মানুষগুলোকে হত্যা করতে সকল আয়োজন। অথচ সংখ্যায় তারা খুব বেশী নয়। কেন মানব রচিত মতবাদের উম্মতরা সবাই এক জায়গায়। বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বকে শেষ করার জন্য সকল প্রকার সভ্যতা,আইন,আদালত,নিয়ম নীতি বাদ দিয়ে কোন কারনে এত চেষ্টা।অথচ আমাদের সমাজে আরো অগণিত মুসলমান আছেন - যারা নিজেদেরকে রাসূলের উম্মত হিসাবে দাবী করেন। একেবারে খাটি সুন্নি বা আশেকে রাসূল। মানব রচিত মতবাদের উম্মতরা আর কথিত রাসূলের উম্মতরা (আশেকীন) একজন আরেকজনের সহযোগী।আগুন আর পানি যেমন একজায়গায় করা যায় না - ঠিক তেমনী দুই উম্মত এক জায়গায় অবস্থান করা অসম্ভব।যখন লিখছি তখন টঙ্গির তুরাগ নদির পারে সব ধরনের উম্মতদের মিলন মেলার প্রথম পর্ব শেষ হল।
আরো কিছু লেখার ছিল। কিন্তু ........ আগামীতে এক সময় লিখবো ইনশাআল্লাহ।
বিষয়: বিবিধ
১৫৪৭ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই মুসলমানেরা ধর্মীয় আলোচনা শোনা এবং তাতে অংশগ্রহন করার চেয়ে নাচ-গানে মত্ত থাকে বেশী ।
এরা আলেমদেরকে আসতে বাধা দেয় , কিন্তু সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের দেখার জন্য হাজার হাজার টাকার টিকিট কেটে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
Click this link
উম্মাহ নিয়ে চিন্তা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই মুসলিমদের স্থানিয়ভাবে বিপদে ফেলে দিয়েছিল। যদিও গত শতাব্দির প্রথম দুই যুগ নামমাত্র খিলাফত চালু ছিল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উমাইয়া খিলাফতের পরেই মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। উপমহাদেশ কখনই একক খিলাফতের অধিনে আসেনি। যদিও সুরতান রা একটি নামমাত্র সনদ আব্বাসিয় খিলাফত থেকে আনাতেন। উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সময় আব্বাসিয় খিলাফত ও হালাকু খানের আক্রমন এর মুখে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। জাতিয়তাবাদ সবসময়ই ইসলামের বিরোধি কিন্তু জাতিয় বা নৃতাত্বিক পরিচয় ইসলাম অস্বিকার করে বলে আমি মনে করিনা। কিন্তু ইসলামের আদর্শ হচ্ছে কারো বংশিয় পরিচয় থেকে তার দ্বিনদারিই নেতৃত্ব এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপাবে।
একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায় লিবিয়াতে যখন সাইয়েদ আহমদ সেনেীসির নেতৃত্বে ইতালিয়ান উপনিবেশিক দের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল তখন তারা মিশরের বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদিদের কাছ থেকে পশ্চাত সহয়তা পাচ্ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারনে তুর্কি খিলাফতের সমর্থন করতে গিয়ে তারা বৃটিশ দের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। একি ভাবে ভারতে টিপু সুলতান যখন ইংরেজ দের প্রতিরোধ এর চেষ্টা করছিলেন তখন রুশ আক্রমন এর মুখে তুর্কি খিলাফত বাধ্য হয়েছিল ইংরেজ দের সাথে চুক্তি করতে। এতে ভারতে ইসলাম ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তুর্কি সাম্রাজ্য কিন্তু বেচে গিয়েছিল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন