ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও বর্তমান সময়ের দাবী।
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে আহমাদ ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৫:৫৩:১৮ বিকাল
এক)
বাংলা ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠীর কাছে ইসলামী আন্দোলন একটি অতি পরিচিত পরিভাষা।মাত্র কিছু দিন পূর্বে ও এই পরিভাষাটির খুব একটা পরিচিতি ছিল না।আলেম সমাজ, দেশের বুদ্ধিজীবি বা শিক্ষিত মানুষের কাছে ইসলামী আন্দোলন শব্দটি অপরিচিত ছিল।কারন বেশ কয়েকটি।
প্রথম কারন - উপমাহদেশে ইসলামের আগমন হয়েছিল প্রথমত মুসলিম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। ২য় পর্যায়ে পীর আউলিয়া। তারপরের ধাপ ছিল কিছুটা বিকৃত ও কিছুটা সঠিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা।
ভারতে হাজার বছর বা সাড়ে আটশত বছরের মুসলিম শাসনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে – ইসলামকে - জীবন ব্যবস্থা হিসাবে কখনো উপস্থাপন করা হয়নি।বরং ইসলামকে ধর্ম হিসাবে ই গনমানুষের কাছে পেশ করা হয়েছে।
ইসলাম একটি সহজ মানব সভাবজাত জীবন ব্যবস্থা,ইসলাম একটি দর্শন,সভ্যতা,ইসলাম মানুষের জীবনের সকল দিক ও বিভাগের আনুগত্যের নাম। এই উপস্থাপনাটা কখনো হয়নি। যা হয়েছে তার সাথে ছিল নানান বিকৃতি।
২য় কারন - মুসলিম শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন যারা করেছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন আক্ষরিক অর্থে বাদশাহ। পৃথিবীর সব শ্রেণীর রাজা বাদশাদের চরিত্র প্রায় কাছাকাছি। গনমানুষের মতামতের শাসন ব্যবস্থা বলতে যা বুঝায় তার অনুপস্থিতি ছিল - আজও আছে। এটা মুসলিম বাদশা বলুন আর অন্য আধুনিক বাদশাদের কথা বলূন। জীবন যাত্রার উন্নতি, দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির সাথে সুশাসনের সম্পর্ক রয়েছে। তবে এটাই সব নয়। দেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরনে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কখনো কল্যানকর হয়নি। বাদশাহী তন্ত্রের সাথে ইসলামের সম্পর্ক নেই। যদি তার নুন্যতম সম্পর্ক থাকতো তাহলে ইরাকের নাযাফে সেদিন কারবালা হত না। ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও তার ৭৫ নিরিহ সাথী জীবন দিতে হত না।
উপমহাদেশের মুসলিম শাসন ব্যবস্থার গলদ ছিল এই জায়গায়। তারা কখনো পূর্ণঙ্গ ইসলামকে প্রেজেন্ট করতে পারেননি। তাই যে দিল্লিতে সাড়ে আটশত বছর ক্ষমতায় ছিলো, মুসলিম বাদশারা সেই দিল্লিতেই মুসলিম সংখ্যা ছিল সংখ্যালুঘু।
৩য় কারন - আমাদের আলেম সামাজের অবস্থা ছিল আরো করুণ। ইসলাম একটি আন্দোলন। একটি বিপ্লব। এই বোধও ছিল না। এই বিচ্যূতি ঘটেছিল তখন থেকে যখন ইসলাম খেলাফত থেকে রাজতন্ত্রের দিকে যাত্রা করে। ইসলাম যেখানে ব্যক্তির চাইতে সামষ্টিক সিদ্ধান্তকে উৎসাহিত করতো। সেই জায়গায় মাত্র কয়েকজন ব্যক্তির ইচ্ছাই হয়ে গেল সব। তাই দেখা যায় আমাদের আলেম ওলামা (সব নয়) মোহাম্মদ (সাঃ)কে একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবে মেনে নিয়ে সন্তষ্ট থাকতে। রাসূল (সাঃ) কে নেতা বলতে ও নারাজ ছিলেন এই কিছু দিন আগেও। রাসূলের আদর্শ মানতে হবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে এই বক্তব্য দেয়ার ওয়াজ মাহফিল হত না। ধর্মী নেতৃত্ব কখনো মোহাম্মদ (সাঃ)কে আমাদের বাস্তব জীবনের আদর্শ মানতে হবে এই দাবীও করেন নি। একজন মানুষের জন্য সকল ক্ষেত্রে নেতা,অনুসরণ,আনুগত্য করার জন্য সবচেয়ে সহজাত,স্বাভাবিকতা ছিল মোহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনে।
দুই)
আমার মতে এই তিনটি কারন। আরো কারন আছে। কিন্তু দৃষ্টিভংগীর জায়গায় এই তিনটি ই যথেষ্ট। একজন মুসলমান অথচ তিনি নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ অথবা জাতীয়তাবাদী হিসাবে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন।চর্চিত জীবন বোধ একজন অমুসলিমের চাইতে বরং আরো ভয়ানক।ভয়ানক বা আতঙ্ক হল সাধারণ বিশ্বাসী মানুষের জন্য।
এই শ্রেনীর মানুষগুলো নিজেদের জন্য যত না ভয়ানক তার চাইতে বেশী ক্ষতির কারন হল সাধারণ জনগনের জন্য। স্যেকুলার,জাতীয়তাবাদি অথবা সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব তারা আনুষ্ঠানিক ইসলাম পালন করেন। আনুষ্ঠানিক ইসলাম মানতে তাদের কোন সমস্যা হয় না। বরং এই আনুষ্ঠানিকতা তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে সাহায্য করে। মিডিয়ায় প্রচারিত তাহাজ্জুদ পড়ুয়া আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক জীবনে কঠিন স্যেকুলার। তিনি সমাজের নাস্তিক মুরতাদদের নির্ভরযোগ্য অবিভাবক। কমরেড ইনু বা মেনন সাহেবদের জন্য প্রয়োজন হয়েছে কমরেড হাজী সাব হতে। বিশ্ব বেয়াহায়া নামের সাবেক রাষ্ট্রপতি তো মাহন ! আলহাজ।
ব্যক্তি জীবনের আনুষ্ঠানিকতায় তারা জনগণকে ধোকা,প্রতারণা করতে চরম কৌশলী – কিন্তু ফলাফলের বিচারে এমন দ্বিচারণ (মুনাফিকী) বিশিষ্ট মুসলমানদের জন্য পরকালীন মুক্তির কোন গ্যারান্টি নেই। কোরআনুল করীম এই শ্রেণীর মুসলমানদের জায়গা কোথায় হবে তা বলা হয়েছে। সাধারণ অমুসলিম, বিশ্বাসী নয় তাদের জন্য যে জাহান্নাম তার চাইতে আরো অধ:পতিত ও নিকৃষ্ট জাহান্নামের ব্যবস্থা করে রেখেছেন মহান আল্লাহ সুবহানুহু তা’য়ালা।
একজন নেতা পাচঁওয়াক্ত সালাত আদায়ের সাথে সাথে তাহাজ্জুদ পড়েন আবার তিনিই গজে চড়ে মা দুর্গা আসার কারনে জমীতে ফলণ বেশী হয় বিশ্বাস করেন এবং বলেন।এই শংকর বিশ্বাসীকে কখনো ঈমানদার বলা যায় না।এটা ইসলামী আকিদার বিষয়। কারো ফতওয়া নয়।
তিন)
বাংলাদেশে বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলনের সফলতা এই জায়গায়। একটা বিরাট জনগোষ্ঠীকে তৈরী করতে পেরেছে। যারা পূর্ণাঙ্গ ইসলাম মানছে। সচেতন ভাবে ইসলামকে অনুসরণ করতে চায়।বিশ্ব নেতা বিশ্ব নবী (সাঃ) কে তাদের আদর্শ নেতা মানে। তাদের চর্চিত জীবনবোধে কোন মুনাফিকী নেই।
দেশের বিরাট একটি অংশের চিন্তার ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি করতে পেরেছে। সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলন যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশের যুব সমাজে ইসলামী আন্দোলন একটি মডেল তৈরী করতে পেরেছে।
আজ থেকে কয়েক দশক আগে ইসলামী সাহিত্যের যে দৈণ দশা ছিল – আজ সেটা নেই। ইসলামকে কয়েকটি আনুষ্ঠানিক কর্মকান্ড থেকে বের করে একজন মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে উপস্থাপিত করার কৃতিত্ব হল বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলনের।
আজকের বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের অবস্থা- ব্যাপ্তি – আবেদন – গ্রহণযোগ্যতা এগুলো সবই ঐ আসল কারন।আজ যে চরম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের লক্ষ বস্তু হয়েছে ঐ একই কারনে।ফরমায়েসী আদালত বা ক্যাংগারো আদালতের মাননীয় বিচারক অথবা ফাঁসি ফাঁসির রায়ের খেলা – এগুলো সবই ঐ একই কারন। কারণটা হল - যে কোন ভাবে ইসলামী আন্দোলনকে রুখতে হবে।
কোরআনের পরিভাষায় - যা সূরা আল ক্বাসাসের ৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে।
وَنُمَكِّنَ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَنُرِيَ فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَجُنُودَهُمَا مِنْهُم مَّا كَانُوا يَحْذَرُونَ
তরজমা - এবং তাদেরকে দেশের ক্ষমতায় আসীন করার এবং ফেরাউন, হামান ও তাদের সৈন্য-বাহিনীকে তা দেখিয়ে দেয়ার, যা তারা সেই দূর্বল দলের তরফ থেকে আশংকা করত। সূরা আল ক্কাসাস আয়াত - ৬।
যুগের ফেরাউন, আবু জাহেলদের ভয় ছিল - মুসা (আঃ) বা মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুসারীদেরকে গণমানুষের সাথে কাজ করার সুযোগ করে দিলে নিজেদের ক্ষমতা তাসের ঘরের মত উবে যাবে।অতীতের তাগুত শক্তিগুলো যেভাবে নিজেদের ব্যাপারে ভয় করতো ঠিক একই ভয় আজকের তাগুতদের।
মহান আল্লাহ ওয়াদা করেছেন - তারা যার ভয় করে - ঠিক সেই ভয়ের জায়গায় তাদেরকে একত্রিত করবোই।
স্যেকুলার,জাতীয়তাবদী,সমাজতান্ত্রিক নেতৃত্ব চরম দুর্নিতিবাজ আর দেউলিয়াপনার শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে।এই শ্রেনীর জাগতিক মতবাদের কিছু দেবার নেই। বিগত ৪৩ বছর তা প্রমান হয়েছে।তাই সম্মিলীত টার্গেট হল বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলন।
চার)
বাংলাদেশের গণমানুষের কাছে পরিচিত,আলোচিত,গ্রহণযোগ্য আলেম ওলামা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবাইকে এক কাতারে বিবেচনা করা হবে জাতির জন্য আত্মঘাতি বিষয়। আগামীর বাংলাদেশের জন্য উচিত হবে সবাইকে চিন্তা ভাবনা করা।
আমরা যারা নিজেদেরকে মুসলমান হিসাবে বিবেচনা করি। পরিচিতি দেই। আমাদেরকে ভাবতে হবে আমরা খন্ডিত ইসলাম গ্রহণ করবো - না পূর্ণাঙ্গ ইসলামে প্রবেশ করবো। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের নির্দেশনাবলী মানব কি না। কারন মুসলমান হিসাবে সবাই প্রত্যাশা করি পরকালীন মুক্তির। শুধু মাত্র কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নাযাতের ব্যবস্থা নেই। তাই যারা মানব রচিত মতবাদের ঈমানদার তারা হয়তো দুনিয়াতে কিছু সময়ের জন্য জনগনকে ধোঁকা দিতে পারেন। নিজেদের সাথে প্রতারণাও করতে পারেন।কিন্তু এটাই শেষ সফলতা নয়।
একজন ঈমানদারকে চিরস্থায়ী সফলতার জন্য অবশ্যই ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পক্ত হতে হবে। মুমীন হিসাবে গর্ব করার মত বিষয় হল ইসলামী আন্দোলন। ইসলামী আন্দোলন করা একজন মুমীনের জন্য ফরজ। দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করা প্রতিটি ঈমানদারের জন্য ঐচ্ছিক বিষয় নয়। বরং তা অত্যাবশ্যকীয়।
বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলন তথা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এই কাজটাই করে। তাই বর্তমান সময়ে এর প্রয়োজনীয়তা আগের যে কোন সময়ের চাইতে বেশী।
বিষয়: বিবিধ
১৮০৬ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কিন্তু আমাদের মধ্যে আসলেই ইসলাম নিয়ে কতটুক সচেতনতা আছে?
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
‘এই শংকর বিশ্বাসীকে কখনো ঈমানদার বলা যায় না।এটা ইসলামী আকিদার বিষয়।’ এই শঙ্কর বিশ্বাসীরা যতটা না অজ্ঞতার জন্য এসবই ভণ্ডামীতে লিপ্ত তার চায়তে বেশি দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিল, গদি হারানো এবং নিজেদের আর বাপদাদার ভ্যালু হারানোর ভয়ে করে বলে আমার মনে হয়।
এদেশের অর্ধেক মানুষ এখনো অশিক্ষিত, কিংবা তথাকথিত আলেম নামধারী কতৃক বিকৃত ইসলামে বিশ্বাসী। সো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আর ইসলামী ছাত্রশিবির যে ইসলামী আন্দোলনের সূচনা এই দেশে করেছে তা আরো বেশি গণ পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে। এদেশে কালেমার পতাকা একদিন উড়বেই।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর লেখাটির জন্য। স্টিকি করলে মন্দ নয়।
গন মানুষের ভাষায় কথা বলা বুঝার মত কৌশলী হতে হবে। ধন্যবাদ।
বরং রাসূল (সাঃ) নেতা অনুসরণ,অনুকরণ,আনুগত্য অর্থে। আর আমরা আরবীতে প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত সালাতে রাসূল (সাঃ)কে নেতা বলি। দোয়া করবেন সবাই যেন বর্ডার লাইন মানতে পারি।
পরিপুর্ণ জীবন ব্যবস্হা 'ইসলাম'কে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে সঠিক ভাবে বাস্তবায়নই খোদায়ী নির্দেশ!
সাময়িক স্বার্থ বা অসুবিধায় তা থেকে বিরত থাকা পুর্ণ মুমিনের আলামত নয়!
এর জন্যে 'ইসলামী আন্দোলন'এর বিকল্প নেই!অবশ্যই ইসলামী আন্দোদন ও দাওয়াত 'ফরজ' প্রতিটা মুসলিমের উপর!
সুন্দর সাবলীল উপস্হাপনা আমাদের নিজেদের বিভ্রান্তি উপশমে ভূমিকা রাখবে!
জাযাকুমুল্লাহু খাইরান হে শ্রদ্ধেয় দ্বীনী ভাই!!!
ইসলামী আন্দোলনের অনেক অর্জন। কিন্তু আমাদের জ্ঞানের গভীরতার বিশ্লেষনে বাস্তবতা এতই উপেক্ষিত যে, চরম দুর্যোগেও আমরা এটিকে ভূল হিসেবে ধরতে পারিনা। ধন্যবাদ আপনাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন