বিজয়ের মাস - দাস মনোবৃত্তিই হল পরাধীনতা।
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে আহমাদ ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০২:০৭:৩৫ দুপুর
এক)
ডিসেম্বর মাস। সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের গর্বের মাস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের জন্য অবশ্যই অহংকারের। এটা আমাদের জাতির সেরা অর্জন।
পৃথিবীতে এমন কোন জাতি পাওয়া যাবে না – যারা নিজেদের জাতীয়/বিজয় দিবস নিয়ে বিতর্ক করে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারটাই অন্যরকম! মেজর আব্দুল জলীল - আসম আব্দুর রব সহ অনেকে আছেন যাঁরা ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস মানতে নারাজ। তাঁরা প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলেছেন। আমার দেশের বিজয় দিবস আমরা পালন করি সম্মানের সাথে। অথচ ভারত পালন করে তাদের হাজার বছরের বদলা নেবার দিন হিসাবে। কোথায় যেন গরমিল মনে হয়।
কেন এত বিতর্ক।? কেন এত মত - পথ।? কেন এত চেতনা কামড়াকামড়ি।?
প্রশ্ন হল ৭১ সালে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে কোন চেতনা ঠিক করা হয়েছিল?
বিভক্ত জাতি দিয়ে কোন দেশ সামনে অগ্রসর হতে পারেনি। আমরা বিগত ৪৩ বছর সেই চেষ্টা করেছি।
নতুন প্রজন্ম এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদেরকে স্পষ্ট বলতে হবে “৭১ এর চেতনার নামে আগামী প্রজন্মকে নাস্তিক বানাতে দেব না”। অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম মাওলানা ভাসানীর মত করে হুংকার দিয়ে দাড়াঁতে হবে - বলতে হবে চেতনার ব্যবসায়ীরা “খামোশ”।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেমন ব্যবসা বানিজ্য হয়েছে- ঠিক তেমনি ৭১ এর চেতনা নিয়েও চলছে নানান মিথ্যার বেসাতি। ক্ষমতার যাবার সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে জাতির এই আবেগকে। সর্বোপরি ফ্যাসিষ্ট শাসনের বর্ম হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ৭১ এর মহান চেতনাকে। তাই সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সামনে নিয়ে আসতে হবে।
দুই)
মুক্তিযোদ্ধা চার প্রকার।
প্রথম দুই প্রকার হল যারা সত্যিকার দেশ প্রেম নিয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। এই সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশী। তাঁদের চেতনা ছিল দেশের বৃহত জনগোষ্ঠীর মৌলিক বোধবিশ্বাসের সাথে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের অবস্থান। তাঁরা যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য, কিছু নগদ পাবার জন্য নয়। যুদ্ধের পরে বা আগে কখনোই তাঁরা কিছু পাবার জন্য সার্টিফিকেট ব্যবসা করেননি। যুদ্ধ করেছেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে- এটাই ছিল তাঁদের আসল পাওনা। এই শ্রেণীর নাম না জানা মহান মুক্তিযোদ্ধারা কখনো তাঁদের চেতনার ডুগডুগি বাজিয়ে জাতিকে ত্যক্ত-বিরক্ত করেননি।
এই দুই প্রকৃতির মুক্তিযোদ্ধাদের এক প্রকার হল যারা সংগঠকের পর্যায়ে - দেশে এবং দেশের বাহিরে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছেন। তাঁদের অবদান অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ।
আরেক প্রকার যারা রণাঙ্গনে যোদ্ধা ছিলেন
এই প্রকৃতির মুক্তিযোদ্ধারা কিছু হবার জন্য নয়, আবার কিছু পাবার জন্য ও নয়। যুদ্ধের পর তারা তাদের আপন পেশায় ফিরে গেছেন। এই প্রকৃতির মুক্তি সেনারা দেশের ভিতর থেকেই হানাদার মোকাবেলা করেছেন। কিছু সময়ের জন্য দেশের বাহিরে গেলেও আবার তারা ফেরত এসেছেন এই মাটিতে।
তারা রণাঙ্গনের মু্ক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জানতেন। নিজেরা দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস চেতনার ফেরীওয়ালাদের কার কি ভুমিকা। এই শ্রেণীর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরাও কখনো তাদের চেতনার বর্ণনা দিয়ে জাতিকে বেহুঁশ করার চেষ্টা করেননি।
৩য় প্রকারের মধ্যে আছেন যারা দীর্ঘমেয়াদে দেশত্যাগ করেননি, বরং হানাদারদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে দেশের মধ্যে থেকেই এদিক-সেদিক করেছেন, বাহ্যতঃ পাকিস্তান সরকারের সমর্থক হয়ে নিরীহ নাগরিক হিসেবে বসবাস করেছেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জান-মালের ঝুঁকি নিয়েছেন, আপনজনদের মতই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন! এঁরা হানাদারদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন, এঁদের কেউ কেউ ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিও পেয়েছেন! যুদ্ধের সংজ্ঞায় এঁরা যোদ্ধা হিসেবে গণণাযোগ্য কি না সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে! কিন্তু এঁদের সহযোগিতা ও অংশগ্রহন না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় কতটা বিলম্বিত হতে পারতো সেটি এক বিরাট প্রশ্ন!
৪র্থ প্রকারের মধ্যে আছেন যারা সুবিধাবাদী বহুরূপী মুক্তিযোদ্ধা। এদের কিছুসংখ্যক কলিকাতার হোটেল মুক্তিযোদ্ধা বা ওপারের মুক্তিযোদ্ধা। এরা কল্পনায় সেই ৭১ সালে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। স্বাধীনতার নয় মাস তারা ৫৬ হাজার বর্গমাইলের কোন অংশে পা রাখেননি। অথচ বিজয়ের পর এরাই হয়েছেন এদেশের মালিক মুখতার। আর কিছুসংখ্যক দেশে থেকেই পাকিস্তান সরকারের সেবা করেছেন মধ্য-ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং বিজয়ের পূর্বক্ষণে পোশাক পাল্টিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়মিছিলে যোগ দিয়ে শ্লোগান ধরেছেন। এরা তড়িঘড়ি একখানা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে মোটেও দেরী করেননি! অনেক প্রত্যক্ষদর্শী প্রবীণদের কাছে শুনেছি- ১৯৭২সালে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নাকি মুড়ি-মুড়কির চেয়েও সহজলভ্য ছিল।
তিন)
ওপারের নকল মুক্তিযুদ্ধারা দেশ স্বাধীন হবার পর তাদের অবস্থানকে শক্ত করতে নানান চেতনার নাম দিয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি চেতনার ফেরী করেছেন এবং করছেন। মাত্র গুটিকয়েক সুবিধাবাদী মানুষ তখন কলিকাতার হোটেলে বসে কি দর্শন চর্চা করেছেন তার সাথে দেশের সত্যিকার রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধের কোন সম্পর্ক ছিল না। এই শ্রেণীর শিক্ষিত(!) ওপারের মুক্তিযোদ্ধারা সব সময়ই আমাদের মহান অর্জনকে বিতর্কিত করেছেন, কলঙ্কিত করেছেন মহান বিজয়কে। আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলছি - প্রমান দেন - যারা ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, সমাজতন্ত্রের কথা বলেন তাদের কে কোন রনাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধা? যুদ্ধে তাদের অবদান হল - বিবি বাচ্চা নিয়ে মহা সুখে কলিকাতায় বসে চেতনার বড়ি গিলেছেন। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় - দালালীর ট্রেনিং নেয়াই ছিল তাদের আসল কাজ।
এই শ্রেণীর টাউটরাই পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নিয়ে ব্যবসা করেছে। ওপারের নকল মুক্তিযোদ্ধারাই বর্তমান আওয়ামী চেতনার ফেরী করেন। পক্ষ বিপক্ষ বলে এরাই গাছের উপরের ও তলারটা খেয়ে যাচ্ছে। জাতীয় আবেগের এই জায়গায় তারা সঠিক ভাবেই চুলকাতে পেরেছে। এরাই অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে ৭১ এর মূল চেতনার বিপরীত নাস্তিক্যবাদী চেতনার মার্কেটিং করেছে। বর্তমান সময়ে তারা সফল বলা যায়।
ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজতন্ত্র, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, ৭১ এর চেতনা ইত্যাদি চটকদার শ্রোগান দিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে। আজ যদি ফ্যাসিষ্ট হিটলার বা মুসোলিনি জীবিত থাকতো তাহলে তাদেরকে হয়তো প্রশিক্ষণ নিতে আসতে হত বাংলাদেশে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ই হল এদের সকল প্রকার ফ্যাসিষ্ট আচরণের মূল পুঁজি। দৃশ্যমান শুধুমাত্র পতাকা ছাড়া আমার দেশের আর কিছু কি স্বাধীন আছে? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা ভারতের দালালী করার জন্য ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ করেছি।
চার)
ভারতের সেবাদাস হওয়ার ঐতিহাসিক যু্ক্তি রয়েছে আওয়ামীলীগের জন্য। এটা দল হিসাবে। ব্যক্তি শেখ হাসিনার নিজের একটা আলাদা দায় আছে। এটাকে স্বাভাবিক ই মনে করতো জনগণ। ইতিপূর্বে ভারত বান্ধব দল হিসাবে যে পরিচিতি ছিল আওয়ামীলীগের বর্তমান সময়ে আওয়ামীলীগ নিজেদেরকে ভারতের সেবাদাস ও মেরুদন্ডহীন দলে পরিণত করেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সিকিমের লেন্দুপ দর্জীর চাইতে বেশী আনুগত্য দেখাচ্ছেন তথাকথিত ৭১ এর চেতনার ভ্যানগার্ডরা।
বিএনপির অবস্থা আরো খারাপ। এরা না ঘরকা না ঘটকা। না পারছে বলতে না পারছে সইতে। ভারতের দালালীর দৌড়ে আওয়ামীলীগের সাথে কুল কিনারা করতে পারছে না।
বামপন্থীরা সব সময়ই অন্যের ঘাড়ে বন্ধুক রেখে চলে। দেশ স্বাধীন হবার পর নাস্তিকদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ও স্বর্ণযুগ বলা যায় বর্তমান সময়। তাই বামপন্থীদের ভারত প্রেম সবচেয়ে বেশী। বামপন্থী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা মোটেই পিছনে নয়। ৪৭ সালের পর যারা কলিকাতা থেকে এসেছিলেন তারা এখন জাতিকে সবক দিচ্ছেন আমাদেরকে রবীন্দ্র বাংলা চর্চা করতে (অধ্যাপক আনিছুজ্জমান)।
আমাদের মিডিয়াতে শেওলা পড়া সাংবাদিকরা, তারা প্রতিজ্ঞা করেছেন প্রিয় দেশটাকে ভারতের অঙ্গ রাজ্য করার। আমাদের সুশীল সমাজ প্রায় সবাই এখন সাউথ ব্লকের আজ্ঞাবাহী সেবাদাস। দিল্লীতে কখন সেমিনার হবে এবং বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রের তকমা লাগানোর পেপার তৈরীতে ব্যস্ত। আর জাতির রাহবাররা (পথপ্রদর্শক) জেলবন্দী ও ফাঁসির আসামী। তারা অসহায় নীরব দর্শক।
বিজয়ের এই মাসে নতুন প্রজন্মের জিজ্ঞাসা হল - আমরা কবে স্বাধীন ছিলাম? মরহুম মেজর আব্দুল জলীল সাহেবের ভাষায় – “অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা”। ১৯৭২ সালে জাতি যখন প্রথম বিজয় দিবস পালন করছিল - তখন এই মহান মুক্তিযোদ্ধা ও সবচেয়ে বৃহত সেক্টর কমান্ডার ছিলেন শেখ মুজিবের বন্দীশালায়। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো বলতেন - দাস মনবৃত্তিই হল পরাধীনতা।
বিজয়ের মাসে আমাদের আশে পাশে দেখছি এমন দাসদেরই ছড়াছড়ি।
বিষয়: রাজনীতি
১৫৪৪ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আসলেই আমারা দাস মনবৃত্তি নিয়ে স্বাধিনতার দাবি করছি। এইদেশে এখনও বৃটিশ আমলের আইনে আদালত দন্ড দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি রাস্তায় কিভাবে মানুষ হাটবে সেটাও ঠিক করছে পুলিশ! এমন মেরুদন্ডহিন জাতি কি আসলেই স্বাধিন।
আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রকৃত দেশপ্রেম থেকে স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করা মহান ব্যক্তিরা স্বাধারণ ভাবে আজ লজ্জা পায় তথা কথিত চেতনার ফেরীওয়ালাদের দাপট দেখে!
আপনার ৪র্থ প্রকারের বদমাইশ স্বার্থপর(যদিও মুক্তিযোদ্ধার সাথে এমন শব্দ-বিবেকে বাধে) মুক্তিযোদ্ধারা আজকের যাবতীয় অনিষ্টের মুল!
মন্তব্য করতে লগইন করুন