আল কোরআনের সম্মোহনী শক্তি ও আমাদের বিচারক সমাজ -(৯ এবং ১০) শেষ পর্ব।
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে আহমাদ ২৩ অক্টোবর, ২০১৪, ০১:৩৫:১৯ দুপুর
হযরত উমর (রাঃ) এর আমলে ইরাক থেকে এক ব্যক্তি তাঁর নিকট এসে বলল – ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আমি এমন একটি বিষয় নিয়ে আপনার দরবারে হাযির হয়েছি - যার না আছে আগা, না আছে গোড়া।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তা আবার কী? সে বলল, আমাদের দেশে মিথ্যা সাক্ষ্যদানের হার বেড়েই চলছে। উমর (রাঃ) অবাক বিস্ময়ে বললেন, কী বল, এই জিনিস আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।’ সে বলল, হাঁ।
খলীফা বললেন, “তুমি নিশ্চিত থাক, আল্লাহর শপথ! ইসলামী রাষ্ট্রে কাউকে বিনা বিচারে আটক করা যায় না।’ মূলত ইসলামে উপযুক্ত বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন সরকার কোন নাগরিককে শাস্তি দিতে পারে না, আর না পারে তাকে বন্দী করে স্বাধীনতা থেকে দুরে রাখতে। কুরআনে স্পষ্ট নির্দেশ হল-
তরজমা – তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য় পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে তা করবে। সূরা নিসা – ৫৮।
বিচারের বিবরণ শুনানী ও রায়দানের সুষ্ঠ নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করেন খলীফা হযরত উমর (রাঃ)। এক পত্রে হযরত উমর (রাঃ) বিচারের শুনানী ও রায় প্রদানে বিচারপতিদের করণীয় সম্পর্কে লিখেন।
“বিচারক শান্ত মেজাজে ও গভীর মনোযোগ সহকারে মামলার বিবরণ শ্রবণ করবেন। যেন রায় প্রদানের সময় তিনি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হন। বাদী-বিবাদীকে তাঁর ডানে বামে না বসিয়ে সম্মুখে বসাবেন এবং কোন পক্ষের সাথে পক্ষপাতমূলক আচরণ করা থেকে বিরত থাকবেন। তিনি সাক্ষীদের সাথে এমন আচরণ করবেন না যেন
তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যথার্থ সাক্ষ্য প্রদানে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং মামলার পক্ষদ্বয়ের কারো সাথেই অনুরূপ আচরণ করবেন না।
তিনি কর্কশভাষী, নিষ্ঠুর বা উতপীড়ক হবেন না।
তিনি আদালতে প্রবেশ করে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষকেই সালাম দিবেন।
তিনি প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে, কোন পক্ষ কতৃক প্রভাবিত বা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে অথবা অপরের আকাঙ্ক্ষা মোতাবেক মামলার রায় প্রদান করবেন না।
বিচারক রায় ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত একান্তভাবেই তা গোপন রাখবেন।
বিচারকার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ ব্যতীত আদালতের অন্য সকল কাজ হতে বিরত থাকবেন।
বিচারক ক্রোধান্বিত অবস্থায়, ক্ষুধার্ত অবস্থায়, রাগান্বিত অবস্থায়, ঘুমের আবেশ জড়িত অবস্থায়, তীব্র শীত কিংবা প্রচন্ড গরম অনুভূত হওয়া অবস্থায়, ব্যক্তিগত কিংবা অন্য কোন কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় বিচারকার্য পরিচালনা করবেন না।
অর্থাত যতক্ষণ তিনি শান্তমনে নিবিষ্ঠচিত্তে বিচারকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি বিচারকার্য় পরিচালনা করবেন এবং বিরক্তি বা শ্রান্তিবোধ হলে বিচারকার্য় মূলতবী করবেন।
বিচারক কারো নিকট থেকে উপহারাদি গ্রহণ করবেন না। বাদী বিবাদীর আহারের দাওয়াত কবুল করবেন না। একনিষ্ঠভাবে শরীয়তের অনুসরণ করবেন।”
ফারুকে আযম বিচারপতিদের জন্য যে কথা গুলো বলেছিলেন - তা আজকের বাস্তবতায় বিবেচনা করুন।
সাজানো ট্রাইবুনালের প্রতিটি বিচার কার্য পরিচালনা, সাক্ষী গ্রহন প্রক্রিয়া,সাক্ষী প্রশিক্ষণের নামে রিহার্সেল দেয়া,আবার সাক্ষী আদালতে হাজির হতে না চাইলে তাকে ওপারে পাঠিয়ে দেয়া, রায় প্রদানের পদ্ধতি ইত্যাদি বিবেচনা করুন।
বিতর্কিত ট্রাইব্রুনালে একজন বিচারপতি ছাড়া বাকি সবাই মুসলমান। তারা সবাই মুসলমান ঘরের সন্তান। মুসলমান হিসাবে তারা সমাজে পরিচিত। মুসলমান হিসাবে সুযোগ পেলেই সরকারী বা প্রধানমন্ত্রীর এতিম ফান্ডের পয়সায় হজ্জে আসেন। নিজেদেরকে মুসলামান হিসাবে সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহন করেন।
জামায়াত নেতৃত্বের প্রতিটি বিচার শুনানীতে যে সমস্ত অন্যায়, ইচ্ছাকৃত রায়কে প্রভাবিত করা, বিচারপতিদের পক্ষপাতমূলক আচরণ, সর্বশেষ রায় দিতে গিয়ে একজনের অপরাধ অন্যজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া। এগুলো সবই আমাদের সম্মানীত মহান বিচারপতিরা করেছেন। দুনিয়ার আদালতের বিচারপতি হয়ে তারা যে কাজটি করেছেন - আমি নিশ্চিত পরকালীন আদালতে তারা সবাই আসামী হবেন। আর সেই আদালতের বিচারক হবেন আমার আপনার সবার মালিক আহকামুল হাকিমীন মহান আল্লাহ। সেদিন তাদের অবস্থা দেখার জন্য আমাদের সাবাইকে দাওয়াত দিতে হবে না। বরং আমরা সবাই সেখানে হাজির থাকবো।
তাই বলছিলাম, আল কোরআনের পাঠক হওয়া আর সেই পাঠককে আল কোরআনের অনুসারী হওয়া সম্পুর্ণ ভিন্ন বিষয়। মেষ চালক খাত্তাবের ছেলে আল কোরআন শুনে হলেন ফারুকে আযম। আবু জেহেল বা ওতবাদের ইতিহাস কয়জন জানে। কিভাবে জানে।
আল কোরআনের পাঠক সংখ্যা আমার দেশে কম নয়। বরং যারা স্যেকুলার রাজনীতি করেন তারাও কুরআন পড়েন। শ্রদ্ধা করেন। নির্বাচন সামনে আসলে ই তারা ইসলামকে ব্যবহার করেন। বরং বুঝে শুনে এই মুনাফিকি করেন, হয়তো হাতে গুনা কয়েকজন। কিন্তু অসংখ্য মানুষ আছেন যারা ব্যক্তি জীবনে ধর্মকর্ম করেন। অথচ তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে মানব রচিত মতবাদের একনিষ্ঠ উম্মত। এই প্রকারের মানুষের সংখ্যাই বেশী। তারা আল কোরআনকে মহব্বত করেন ঠিকই। কিন্তু সমাজের এই বিরাট অংশ আল কোরআনের রাজনীতি অর্থনীতিকে মনে করেন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। আমার প্রিয় বাংলাদেশে এই ভূল ব্যাখ্যাটা একদিনে তৈরী হয়নি। যুগ যুগ ধরে চলে আসা আল কোরআন সম্পর্কে ভুল ধারণাই এর কারণ।
নবীর ওয়ারিস যারা - যাদেরকে জনগণ ইসলামের রক্ষক মনে করে তারা প্রায় সবাই নিজেদের স্বার্থের খেদমত করেছেন বা করছেন। আল কোরাআনের সামাজিক বাস্তবায়নে জনগনকে টার্গেট করেন নি। এখনো সামাজের বিরাট অংশের আলেম ওলামারা নিজেদের ইসলাম নিয়ে ব্যস্ত। এবং আল কোরআনকে নিজেদের হালূয়া রুটি কামানোর মাধ্যম বানিয়ে রেখেছেন।বাস্তবতা এমনই।
এই উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামী আল কোরআন বিম্বিত সমাজের প্রথম ধারণা পেশ করে। অবশ্য এর আগে আরো অনেক মুজতাহীদরা করেছেন। কিন্তু সেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক কোন উদ্দোগ ছিল না। বিশ্ব নেতা বিশ্ব নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুসৃত নীতিমালা ও পরিকল্পিত কর্মসূচী নিয়ে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র ব্যবস্থার আহবান জানায় প্রথমম জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের অপরাধের জায়গা এখানে।
জামায়াত মজলূম মহা গ্রন্থ আল কোরআনকে সমাজের প্রতিটি দিক ও বিভাগে কর্যকর করার কথা বলে। নিজেরা মেনে চলে এবং সে অনুযায়ী সমাজটাকে সাজাতে চায়।মানব রচিত মতবাদের জন্য এর চেয়ে বড় শত্রু আর কিছু হতে পারে না।
আল কোরআনের সামাজিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক নির্দেশনাগুলো শুধু মাত্র পড়ার জন্য নয়। বরং তা বাস্তবায়নের জন্য। এই বোধ,বিশ্বাস হল জামায়াতের সবচেয়ে বড় শক্তি। হযরত বিলাল ইবনে রাবাহ (রাঃ) বা সুমাইয়া (রাঃ) অথবা আম্মারের (রাঃ) মত সমাজের সবচেয় অনগ্রসর মানুষগুলো মক্কার স্যেকুলার শক্তির মোকাবেলা করেছিল আল কোরআনের মোজেজায় বা এই শক্তির বলে।
প্রচন্ড শক্তি ও ক্ষমতাধররা যেমন ইতিহাসের আস্তাকুড়ে হারিয়ে গেছে - ইনশাআল্লাহ আজ ও ঐ একই মোজেজায় বর্তমান সময়ের বিলাল বা আবুজরদের অনুসারীরা ইতিহাস রচণা করবেই। এই প্রত্যয় এবং বিশ্বাস আছে আমার। তাই আগামীর সোবহে সাদিক আমাদের জন্য অপেক্ষা ক
সমাপ্ত -
তথ্যসুত্র -
১) তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন।
২) তাফহীমুল কোরআন।
৩) শহীদে মেহরাব হযরত ওমর ইবুনুল খাত্তাব।
৪) আইন বিষয়ক জাতীয় মাসিক এবং অন্যান্য।
বিষয়: বিবিধ
১৯৩৮ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"কোরআনের তেলাওয়াত আছে আগের মতই,
রাবেয়ার মত সেই প্রেম নেই........।"
শুধু তেলাওয়াতে সীমাবদ্ধ না রেখে- কোরআন কারীম কে জীবনে-রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে আবির্ভূত হতে হবে মুসলিমদের কে,এখনি।
ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহ রইল ।
কোরআনের তেলাওয়াত আছে আগের মতই রাবেয়ার মত সেই প্রেম নেই।
সুন্দর পোস্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আমাদের এই ভুবনে আপনাকে স্বাগত,আহলান ও সাহলান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন