হযরত ওমরের (রাঃ) ইসলাম গ্রহন ও সাময়িক প্রসঙ্গ (ধারাবাহিক)
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে আহমাদ ২৯ আগস্ট, ২০১৩, ০২:৪৮:৫৮ দুপুর
চার) (গত সংখ্যার পর)
সাইয়েদুশ শুহাদা -আমীর হামযা (রা) ইসলাম গ্রহন করেন নবুয়তের ৬ষ্ঠ বছর। হযরত হামযার ইসলাম গ্রহন, রাসূল (সঃ) পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনে বিরাট মাইল ফলক সূচনা করে।
ইসলামের এই বাতাল (রনাঙ্গনের বীর) আমীর হামযার ইসলাম গ্রহন - মুসলমানরা যথেষ্ট শক্তি ও সম্মান অনুভব করে।তেমনী এই ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনার মাত্র তিন দিন পর ইতিহাসের 'ফারুকে আযম' হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) ইসলামর গ্রহন করেন। এটা ছিল আরো বেশী যুগান্তকারী,তখনকার পরিবেশ পরিবর্তনকারী,মজলুম,নির্যাতীত আন্দোলন ও সাথীদের জন্য ছিল আল্লাহ কতৃক বিশেষ রহমত।যা তখনকার আন্দোলনের গোটা পরিবেশ এবং প্রতিটি সদস্যকে আন্দোলিত করেছিল।পক্ষ বিপক্ষ সবাইকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। প্রকাশ্যে মক্কার রাজপথে মুসলামানরা নিজেদের জানান দিয়ে চলাফিরা করা শুরু করেন। আন্দোলনের বিগত (নবুয়তের প্রথম ৫টি বছর) বছরগুলোতে কেউ যা তা চিন্তা করতে পারেননি।গোটা পরিবেশ ই পরিবর্তন হয়ে গেল।হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহনের প্রভাব মক্কার সব মহলকে আন্দোলন সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করার সুযোগ করে দেয়।
এজন্য হযরত ওমরের (রাঃ) ইসলাম গ্রহন ছিল সকল ক্ষেত্রে একটি বড় রহমত। অবশ্য সে রহমত ছিল মহান আল্লাহ কতৃক নির্বাচিত।
যেই রহমতের জন্য দোয়া করেছিলেন স্বয়ং এই আন্দোলনের প্রধান,বিশ্বনেতা মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
রাসূলের ভাষা ছিল এমন,
'হে আল্লাহ দুটি ওমর থেকে একজনকে দিয়ে ইসলামকে সাহায্য কর।' হাদীসের ভাষাটা হল 'আমরাঈন'।
একজন ছিলেন ওমর ইবনে হিশাম।যিনি পরবর্তীতে আবুজেহেল হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন।
যার সম্পর্কে রাসূল (সঃ) নিজে বলেছেন, আমার সময়ের ফিরাউন মুসার (আঃ) ফিরাউন থেকে কঠিন ও নির্মম।হাদীসের ভাষা হল - 'আশাদ্দু ফিরউনি মিন ফিরউনি মুসা'।
আরেকজন ছিলেন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব।যিনি পরবর্তীতে ফারুকে আযম' হন।
যার সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেন,আমার পরে আর কোন নবী বা রাসূল আসবেন না।নবী রাসূল আসার কোন সম্ভাবনা থাকতো তাহলে ওমর নবী হয়ে যেতেন। হাদীসের পরিভাষা হল - 'লা কানা ওমর'।
পাঁচ)
আমীর হামজা ইসলাম গ্রহন করে মক্কার তৎকালীন সবচেয়ে প্রভাবশালী তাগুত নেতা আবু জাহিলকে দারুন নদওয়াতে গিয়ে জানান দিয়েছিলেন। মক্কার জমীনে এই প্রথম কেউ প্রকাশ্যে মহা সত্যের ঘোষণা দিতে সাহস দেখালো। তাও দারুন নদওয়ার (মক্কার গনপরিষদ) তাগুত শক্তির সামনে।
এটা ছিল তখনকার মুসলমানদের জন্য অচিন্তনীয় বিষয়।এজন্য আমীর হামযার ইসলাম গ্রহন অন্য সাধারণের মত ছিল না।এটা ছিল তখনকার সময় ইসলামী আন্দোলন ও তার কর্মীদের জন্য উজ্জীবিত হওয়ার মত একটি ঘটনা।হয়েছিল ও তাই।
তখন পর্যন্ত সমাজের নাম করা,সম্মানীত পরিবারের সদস্যরা ইসলাম গ্রহন করলেও (সংখ্যায় খু্বই কম) মক্কার আন্দোলনী পরিবেশে তেমন কোন পরিবর্তন হয় নাই।
নবুয়তের ৬ষ্ঠ বছরে হযরত আমীর হামযার ইসলাম গ্রহনের পর মাত্র তিন দিন পরই আরেকটি মহা কান্ড ঘটে।তখনকার মক্কার ইসলাম বিরুধী সমাজ ব্যবস্থাকে প্রচন্ড ভাবে ধাক্কা দেয়। যা ছিল মক্কার তাগুত শক্তির সম্পুর্ণ ধারনা ও তাদের পরিকল্পনার বাহিরে। হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহনের খবরে আবু জেহেল সহ মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা কয়েকদিন দারুন নদওয়াতে আসে নাই।হযরত ওমর তো আবু জেহেলের বাড়িতে গিয়ে নিজেই নিজের মহা সত্য গ্রহনের খবর দিয়ে এসেছিলেন। এই সাহস একমাত্র খাত্তাবের বেটাই দেখাতে পেরেছিলেন।
এতদিন পর্যন্ত আন্দোলনের সাথীদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে।কিন্তু কোথাও কেউ চ্যলেন্জ করার হিম্মত করে নি। এমনকি কেউ প্রকাশ্যে ঘোষণা দেবার ও চিন্তা করেননি। সেই শক্তি ও সামর্থ বা পরিবেশ ছিল না।
ছয়)
হযরত ওমর নিজে শুধু মহা সত্যের ঘোষণা দেননি।বরং তিনি তখনকার সময় সবচেয়ে উত্তম গণমাধ্যম ব্যবহার করেছিলেন। মক্কাতে এক ব্যক্তি ছিল, যার নাম জামীল বিন মুয়াম্মার জামহী। সে যে কোন গরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রচার করে বেড়াতো মক্কার প্রতিটি মহল্লায়।এ বিষয়ে সে খুবই পারদর্শী ছিল।হযরত ওমর তাকে নিয়োগ দিলেন। এবং বলে দিলেন কোথায় কোথায় গিয়ে সে প্রচার করবে।
হযরত ওমর (রাঃ) বললেন - 'ওহে জামীল,তুমি কি জান,আমি ইসলাম গ্রহন করেছি এবং মুহাম্মদ (সাঃ) দলে অন্তর্ভক্ত হয়ে গিয়েছি'।
জামীল - হযরত ওমরের কথা জবাব না দিয়ে নিজের চাদরটা ঘাড়ে করে সোজা মসজিদুল হারামের দারজায় গিয়ে পৌছলো।তার পর গগনবিদারী কন্ঠে ঘোষণা করতে শুরু করলো - 'ওহে কোরায়েশ জনতা শোনো। খাত্তাবের ছেলে ওমর (রাঃ) সাবী (ধর্মত্যাগী) হয়ে গেছে।
হযরত ওমরও তার পিছু পিছু এসে পৌছলেন এবং চিৎকার করে বললেন, জামীল ভুল বলছে। আমি সাবী নয়,মুসলমান হয়েছি। আমি ঘোষনা করছি,আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা'বুধ নেই,এবং মুহাম্মদ (সাঃ) তার বান্দা ও রাসূল।
চিন্তা করুন বিগত ৫টি বছর যে দাওয়াতে কথা মুখে উচ্ছারণ করা যেত না। সেই দাওয়াতের ঘোষনা দেয়া হচ্চে আজ সবার সামনে। হযরত ওমর এই কারনে ই ফারুকে আযম।
হযরত ওমর ইসলাম গ্রহন করার পর প্রথম মানব ইতিহাসে সম্মিলিত ভাবে মিছিল করা হয় মক্কার চত্তরে। যা আমাদের সামনের আলোচনায় আসবে ইনশাআল্রাহ।
অনুকরণ,অনুসরন, মানার ক্ষেত্রে মুসলমানরা কোন পর্যায়। এটা আগে আলোচনা করিছ।
সাত)
মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) সমানভাবে আদৃত এবং সমাদৃত। একই সাথে ফারুকে আযম হযরত ওমর (রাঃ) আলোচিত,গ্রহনীয়,অনুকরণীয়,অনুসরণীয়।
পৃথিবীর ইতিহসে অসংখ্য ওমর আছেন। কিন্তু ওমর বলতে - ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) কেই বুঝানো হয়। ওমর (রাঃ) চরিত্র মানব ইতিহাসের এক অপরিহার্য অংশ।
মানব ইতিহাসের এই অপরিহার্য চরিত্র অনুসরন বা অনুকরণের ক্ষেত্রে মুসলমানদের চাইতে অমুসলিম সমাজ অনেকটা অগ্রসর। মুসলামানরা হযরত ওমরকে চর্চা করে আবেগ,অনুভুতি আর নিজেদের জীবনের শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রে।
কিন্তু এর বিপরীত হল অমুসলিম সমাজ। তারা হযরত ওমর (রাঃ) এর গোটা জীবনকেই অনুসরন করে।হযরত ওমরের শাসন আমলের সকল যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলো তারা গ্রহন করেছে। নাগরিক এবং রাষ্ট্রের মাঝখানে যে সেতুবন্ধন তৈরী করার নীতিমালা হযরত ওমর (রাঃ) শাসন ব্যবস্থায় পাওয়া যায়। তা পৃথিবীর অমুসলিম দেশগুলোতে বর্তমানে পাওয়া যায়।
আট)
পৃথিবীর সব নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় হযরত ওমর (রাঃ) কে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও মুসলিম বিশ্ব পিছিয়ে আছে। তারা ওমরকে পড়ে ঠিকই। কিন্তু সেটা চর্চা করার জন্য নয় বরং আবেগে মোহিত হবার জন্য।আমাদের মধ্যে ধর্মীয় আবেগটা বেশী কাজ করে।
আমার এই মন্তব্য হয়তো কিছু ক্ষেত্রে প্রান্তিক হতে পারে। তবে তা মোটেই বেশী কথন নয়। একটি উদাহরন দেয়া যাক -
হযরত ওমর (রাঃ) খলিফা। খলিফার প্রাত্যহিক দায়িত্ব ছিল নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে গণমানুষের অবস্থা জানা।এটা কোন চমক বা সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য জাতীর সাথে মোনাফিকি বা ষ্টান্ডবাজী নয়। বরং রাষ্ট্রের প্রধানের দায়িত্ববোধ থেকে এই কাজ করতেন। খিলাফত শাসন ব্যবস্থায় মূখ্য হল দেশের জনগন। জনগনের সকল নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করাই হল ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় ফরজ। একজন ঈমানদার শাসক সে সালাত আদায়কে যেমন ফরজ মনে করেন। ঠিক তেমন তার রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করাকে ফরজ মনে করতে হবে।তাহলেই তিনি মুসলিম শাসক।
হযরত ওমর (রাঃ) এই চেতনারই প্রকাশ পায় আলোচিত এই ঘটনায়।ঘটনাটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ এভাবে -
একদিন খলিফা মদিনার বাহিরে একটি গ্রাম্য এলাকায় সফরে গেলেন। অবশ্য খলিফা- সফরে যেতেন তবে বর্তমান সময়ের মত করে পাইক পেয়াদা নিয়ে নয়। বরং একান্ত তিনি নিজে একা বের হতেন।
গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাটচ্ছেন আর সাক্ষাত হওয়া সবার অবস্থা জেনে নিচ্ছেন। এমন সময় দেখেন একজন আশতিপর বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে খলিফার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। খলিফা দেরী না করে বৃদ্ধের কাছে চলে আসলেন।বৃদ্ধকে কাছে নিয়ে বসলেন।
জিজ্ঞেস করলেন আপনার মাথায় বোঝা কিসের? কেন আপনি এই বয়সে ভারী বোঝা টানছেন? আপনার সন্তানরাই বা কোথায়? তারা কি আপনার দেখাশোনা করে না।
বৃদ্ধ হযরত ওমরকে চিনতেন। তিনি বললেন খলিফা - আমার ছেলেরা আমাকে আর দেখা শুনা করে না।ওরা তাদের পরিবার নিয়ে আমার থেকে দুরে বসবাস করে। আমার নিজের আহার নিজেই যোগাড় করতে হয়। খলিফা বৃদ্ধের বাড়ীর ঠিকানা জেনে নিলেন। এবং বললেন - আগামী কাল আপনি মদিনায় আমাদের বায়তুলমালের প্রধানের কাছে (কেন্দ্রিয় বংকের গভর্নর - অথবা অর্থ মন্ত্রনালয় ভাবতে পারেন) যাবেন। বৃদ্ধের সাথে আরো কিছুক্ষন সময় কাঠিয়ে খলিফা বিদায় নিলেন।
খলিফা মদিনায় এসে রাষ্ট্রীয় ডিগ্রি জারি করলেন, এখন থেকে বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদেরকে ভাতা দেয়া হবে।একটি বর্ননায় এও পাওয়া যায় যারা ইবনুস সাবিল বা রাস্তা যাদের ঠিকানা, তারাও এই আইনের আওয়তায় পড়বে।ঘোষনা করে দেয়া হল। লিষ্ট তৈরীর দায়িত্ব দেয়া হল সংলিষ্টদেরকে।
আগামী পর্বে গত সংখ্যার লিংক
http://www.bdtomorrow.net/blog/blogdetail/detail/1876/IBNAHMED/26103
বিষয়: বিবিধ
৩১৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন