মিশরে কেন এই গণহত্যা ? কারন,ফলাফল ও ইন্তিফাদা।

লিখেছেন লিখেছেন ইবনে আহমাদ ১৫ আগস্ট, ২০১৩, ০৭:০৮:৫৫ সন্ধ্যা

মিশরের রাজনীতি নিয়ে আমার আগ্রহ অনেক পুরাতন।এর কারন কি হতে পারে, হয়তো বলতে পারবো না। তবে একটা কারন এটা হতে পারে, দীর্ঘ দিন থেকে মিশরীয় ইখওয়ানের ভাইদের সাথে চাকুরি করা। আমার সৌভাগ্য হল, আমি আমার ১৮ বছরের প্রবাস জীবনে সরাসরি বস কখনো ইখওয়ানের কর্মী,শোভাকাংখী,সূধি ছাড়া পাই নাই।এই দীর্ঘ চাকুরী জীবনে সরাসরি উপরের বস যারা ছিলেন তারা সবাই যে কোন ভাবেই ইখওয়ানের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। সহকর্মী হিসাবে অসংখ্য মিশরীদের সাথে কাজ করেছি। অনেক ইলমানী(ধর্মনিরপেক্ষ +নাস্তিক) লিবরালীদের (মধ্যমপন্থী + দুনিয়া পুজারী) সাথে কাজ করেছি। আবার সহপাঠি (আলগাছিমে) তিনজন মিশরী পেয়েছিলাম। যারা নিজেদেরকে খুবই কড়া আহলে হাদীস বা সালাফি বলে পরিচয় দিত। যদিও আমার সাথে সম্পর্ক ভালই ছিল।

মিশরকে বলা হয় আবুল আরব।আর ইয়ামানকে বলা হয় উম্মুল আরব।এ নিয়ে আবার ইখতেলাফ রয়েছে। কেননা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য বলতে যে কয়টি রাষ্ট্রকে বুঝানো হয় তার মধ্যে অনেকেই মিশরকে জায়গা দিতে চান না। তাদেরকে আফ্রিকা মহাদেশের স্থান দেন। যাই হউক এগুলো নিয়ে সহকর্মীদের মাঝে ঝগড়া হয়।আরবদের ঝগড়া দেখতে খুবই সুন্দর এবং উপভোগ্য। যাক-

মিশর গত কালের (১৪.০৮.২০১৩) গনহত্যার বিচার হবে কি? হবে কী হবে না - তা আগামী দিনই বলবে। তবে কেন এই গনহত্যা -

কয়েকটি কারন হতে পারে -

এক) মধ্য প্রাচ্যে একটি শুদ্ধ ইসলামী সরকার হলে আশে পাশের ফ্যাসিষ্ট বয়স্ক রাজড়াদের ই বেশী ক্ষতি। কেননা তাতে তাদের নিজেদের ক্ষমতা হারানোর ভয়।

দুই) মধ্য প্রাচ্যের শক্তিশালী এই দেশটিতে যদি ইখওয়ান ক্ষমতায় তাদের টার্ম পুরো করতে পারে, তাহলে ইসরাইলের এবং তাদের ভুত্যু আমেরিকার জন্য সমস্যা। কেননা গণমানুষের ভোট নিয়ে সরকার হলে, নিলর্জ দালালী করা লাগে না। বরং মেরুদন্ড সোজা করে দেশ পরিচালনা করা যায়। যা মুরসী করতেন।

তিন) মধ্য প্রাচ্যের মধ্যে শক্তিশালী আর্মী এবং গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুটোই পাশ্চাত্যের জন্য চরম হুমকি। ইতিপূর্বে ইরাকের,লিবিয়ার এবং সিরিয়ার আর্মীকে শেষ করা হয়েছে। বাকি শুধু মিশরের আর্মী। তাদেরকে মোবারক সরকার আমেরিকার বেতন ভুক্ত চাকরে পরিণত করেছিল। এই গণহত্যার মাধ্যমে মিশরের আর্মীকে একেবারে খতম করা হল।পেশাদারিত্ব আর নৈতিক জায়গাটা শেষ করা হল। দেশের সেবক আর্মীকে দেশের মানুষের হত্যাকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা গেল।এটা নগদ লাভ পাশ্চাত্যের এবং ইসরাইলের।

চার) নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডঃ মুরসীর কয়েকটি সিদ্ধান্ত যা যুগান্তকারী ছিল।এগুলোই একমাত্র কারন নয় তবে অবশ্যই বড় কারন সমুহের মধ্যে কয়েকটি।

প্রথমটি ছিল মোবারক সরকার কতৃক মিশরের গ্যস সম্পদ পানির দামে ইসরাইলের কাছে বিক্রি করা। এই কাজটি করতেন মোবারকের বড় সন্তান আলা মোবারক এবং কিছু আর্মী অফিসার তাদের ব্যক্তিগত কোম্পানী দ্বারা। অথচ মিশরের জনগন গ্যসের জন্য হাহাকার করত প্রতিনিয়ত।

২য়টি ছিল গাজার মজলুম মানুষের জন্য রাফা ও সিনাই গেইট খুলে দেয়া।বছরের পর বছর ইসরাইল সীমানা প্রচীর দিয়ে পৃথিবীর সামনে উন্মুক্ত কারাগারে বন্ধী করে রেখেছিল ফিলিস্তিনীদের।সামান্য খাদ্য পানীয় পাঠাতে পারেনি তুর্কি সহ বিশ্ব বিবেক।কিন্তু স্বাধীন চেতা প্রেসিডেন্ট এই পদক্ষেপ নিতে একটু ও দেরী করেননি।ইসরাইল ও তার প্রভু আমেরিকা কিছুই করতে পারেনি।

৩য় টি ছিল মোবারক আমলে মিশর গম আমদানী করতো আমেরিকা থেকে দেশটির মোট চাহিদার ৮০% ভাগ। মোবারক ও আর্মীর এলিট শ্রেনীর ব্যক্তিগত কোম্পানীগুলোর ছিল এই ব্যবসার মালিকানা। প্রেসিডেন্ট মুরসি ক্ষমতায় এসেই তিনি মিশরের সাধারন কৃষকদেরকে সাবসিডি দিয়ে গম উৎপাদনে উৎসাহিত করেন।মিশরের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের পয়সা যা এতদিন ভুর্তুকির নাম করে অপচয় করা হত। মাত্র ৭ মাসের মাথায় গম আমদানীর পরিনাম নেমে আসে ৩০% ভাগে। এতে যেমন দেশীয় বেনীয়ারা প্রমাদ গুনে। তেমনী আমেরিকার ফড়িয়াদের মাথায় হাত পড়ে।

চার) সুয়েজ খাল নিয়ে গনতান্ত্রিক সরকার প্রধানের গনতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। সুয়েজ খাল দিয়ে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের জাহাজ যাতায়াত করতে পারতো। কিন্তু একমাত্র ইরানকে সে সুযোগ থেকে বছরের পর বছর বাদ রাখা হয়েছিল। এর কারন হল আমেরিকার এবং ইসরাইলের স্বার্থ। কিন্তু প্রেসিডেন্টের বলিষ্ট সিদ্ধান্তে ইরান সুয়েজ খালের উপর দিয়ে জাহাজ চলাচলের সুযোগ পায়।এই বিষয়টা শুধু মাত্র ইসরাইল বা আমেরিকাকে নয় বরং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়টি দেশকে ও চরম ভাবে আতংকগ্রস্থ করে।বরাবরের মত রাজারা পিছনের দরজা দিয়ে মিশরের আর্মীকে উৎসাহিত করে ক্ষমতা দখলের। এতে অর্থ প্রদান ও করা হয়।যা পত্রিকায় এসেছে।

পাঁচ) যে কয়দিন ডঃ মুরসী ক্ষমতায় ছিলেন তাতে সর্ব মহলে তার ব্যক্তিগত একটি ইমেইজ তৈরী করতে পেরেছিলেন। এতে আশে পাশের দেশগুলোর বুড়ো, অথর্ব, অযোগ্য,মেরুদন্ডহীন গনবিচ্ছিন্ন শাসকদের জন্য মহা চিন্তার কারন হয়েছিল।

যেমন - ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা,ব্যক্তি জীবনে চরম সততা,রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের বাহিরে গনমানুষের সাথে নীবিড় সম্পর্ক,মুসলিম উম্মার সম্পর্কে নিজের অবস্থান পরিস্কার করা,ব্যক্তি জীবনে সত্যিকার মুসলিম পরিচয়মূলক আনুষ্ঠানিকতা,যে কোন সমস্যায় মিশরের আসল মালিকদের কাছে জবাবদীহিতা করা ইত্যাদি পদক্ষেপ সমস্যা তৈরী করে আশেপাশের দেশগুলো অবার্চীন শাসকদের জন্য।

ছয়) সর্বপরি দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক মিডিয়াতে বছরের সেরা আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়া। মিশরকে তার মুল চেতনা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পিত প্রচেষ্টা চালানো।শাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আর জবাদীহিতার দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা।মিশরের নারী সমাজকে ইসলামের বিধিবিধান মেনেই অগ্রসর করা নীতিমালা পেশ।শিল্প বান্ধব মেগা প্রজেক্টের উদ্দোগ গ্রহন করা।পৃথিবীর নিগৃহীত মুসলিম - অমুসলিমদের জন্য জাতি সংঘে নীতি নির্ধারণী ভাষন।আফ্রিকান ইঊনিয়নকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য চেষ্টা চালানো। এবং ও আই সির ভুমিকা নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করা এবং তাকে সত্যিকার একটি মুসলিম স্বার্থ বান্ধব হিসাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। আলবেনীয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষনা দান। মিশরের বিভিন্ন প্রদেশে গভর্নর নিয়োগে সৎ ও যোগ্যতার প্রধান্য দেয়া ইত্যাদি ছিল বিশ্ব মোড়ল ও তাদের স্থানীয় পোষ্যদের গাত্রদাহের মুল কারণ।

কেউ কেউ বলেন যে, প্রেসিডেন্ট এই সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার ক্ষেত্রে একটু ধীর গতি হলে ভাল হত। আমি ও চিন্তা করেছি। কিন্তু আসলে যত ধীর গতিতেই মুরসী অগ্রসর হতেন তার পর ও এই ম্যনমেইড ডিজাষ্টার থেকে রক্ষা পেতেন না।

আমি মোটেই একমত নই যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে ইখওয়ান বা তার সরকার। বহু বছরের কায়েমী স্বার্থবাদীদেরকে নিয়ে নতুন ধারার কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র পরিচালনা করা মোটেই সহজ ছিলনা। প্রেসিডেন্ট যতই আন্তরিক ছিলেন একটি গনতান্ত্রিক আবহ তৈরী করতে। মুরসী ও তার সাথীরা যতই নিরলস ছিলেন আরব সবুজ বিপ্লবের বাস্তবায়নে।কিন্তু এটা বাস্তুবতা ছিল তারা চিন্তা চেতনায় সম্পুর্ণ বিপরীত একটি মাথাভারী দুর্নিতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত ফ্যাসিষ্ট প্রসাসন নিয়ে চলতে হয়েছে।পদে পদে কোরআনের হাফেজ প্রেসিডেন্টকে বাধাপ্রাপ্ত হতে হয়েছে।

মিশরে আজ যে অবস্থা তৈরী করা হয়েছে, হয়তো মিশর আবার অন্ধকার যুগে প্রবেশ করলো। লাভ ক্ষতির হিসাবে ইখওয়ানের ক্ষতির পাল্লা বর্তমান সময়ে হয়তো বেশী।সেটা মানবিক দৃষ্টিতে। কিন্তু আমার বিশ্বাস নৈতিক দৃষ্টিতে এবং আগামীর ইতিহাস হবে ইখওয়ানের। মিশরের জনগন তার অধিকার প্রতিষ্টায় আরো হয়তো রক্ত মুল্য দিতে হবে। কিন্তু ইনশাআল্লাহ শেষ হাসি হাসবে আজকের মুজলুমরাই।

একটু আগে দেখলাম মিশরের সরকার নিয়ন্ত্রিত বেশ কিছু ই ম্যগাজিনে। শুরু হয়েছে নতুন খেলা। প্রচার প্রোপাগান্ডার রুপ একই রুপ -

শাপলা চত্তরে রাতের আধারে গণহত্যা করার পর বলা হল হেফাজত আর জামায়াত কোরআন পুড়িয়েছে। মসজিদের আগুন দিয়েছে। আমাদের তথ্য মন্তনালয়ের একটি এ্যাড দেখলাম গতকাল মাহফুজ সাহেবের টিভিতে। দেখানো হচ্ছে মাথায় টুপি পরা,গায়ে পান্জাবী পরা লোকেরা মসজিদ মন্দিরে আগুন দিচ্ছে। দেখে দেখে হাসছিলাম। পাশে বসা হোম মিনিষ্টার মন্তব্য করলো - বাংলাদেশে লেডি হিটলারের শাসনে হিটলারেরই তথ্য মন্ত্রীর আমদানী করা হয়েছে।তাই মাথায় টুপি পরে মসজিদে আগুন দিচ্ছে।এটা বিশ্বাস করতে হবে। আর না করলে তো যুদ্ধাপরাধি,স্বাধীনতার চেতনা বিরুধী। একই রকম প্রচারণা দেখছি মিশরেও।

বলা হচ্ছে ইখওয়ানের কর্মীরা মসজিদে আগুন লাগিয়েছে।

নেটে প্রচার করা হচ্ছে - ইখওয়ানের কর্মীরা আল আদওইয়া স্কায়ারে নাকি সেনাবাহীনির সাথে যুদ্ধ করার জন্য বাঙ্কার করেছিল।

বলা হচ্ছে ইখওয়ান নাকি টর্চার সেল খুলে মুরসী বিরুধীদেরকে নির্যাতন করতেছিল।

গতকাল সরকারী প্রেসনোট করা হয়েছে - মিশরের ইতিহাসে নিকৃষ্ট গণহত্যার জন্য দায়ী নাকি? প্রেসিডেন্ট মুরসী এবং জেল বন্ধী ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ।সামরিক আদালতে তাদেরকে ফাসির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফেরউনের দেশে হয়তো এটা অসম্ভব নয়।

আল বারাদি কেন নিজেকে গুটিয়ে নিলেন সেটার ও একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সেটা হল তাকে দেয়া নভেল পুরস্কার নাকি ফেরত নেয়া হবে এই ভয়ে তিনি আর্মী সরকারের পক্ষ ত্যাগ করেছেন।

গত কালের গণহত্যাকে জায়েজ করার জন্য এরকম হাজারো মিথ্যার ফানুস উড়াচ্ছে মিশরের বামপন্থী,ফিরউনপন্থী মিডিয়া ও সুশীল সমাজ।

যা আমার দেশেও একই প্রজাতির তথ্য মন্ত্রী ও অধিকাংশ মিডিয়া। এদেরও পরিচয় তারা বামপন্থী এবং রামপন্থী।

টার্গেট একই,প্রচারণার ধরণ ভাষা এবং টার্গেটকৃতদেরকে আক্রমন করার পদ্ধতিও একই।

সর্বশেষ - বর্তমান সময়ের বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের আধ্যাত্বিক নেতা শাইখ ইঊছুফ আল কারজাভী ঘোষনা করেছেন আগামী কাল চুড়ান্ত আঘাত করা হবে। মিশরের জনগনকে আহব্বান করেছেন ইন্তিফাদার। যে ইন্তিফাদার আহব্বান করেছিলেন শাইখ ইয়াছিন ফিলিস্তিনে।

আমরা সবাই দোয়া করতে পারি। এবং অনাগত ইন্তিফাদার (বিপ্লব) জন্য নিজেদেরকে তৈরী করতে পারি।

একটি আশংকা দিয়ে শেষ করছি যা আমার এক প্রাজ্ঞ বন্ধু করেছেন।বাংলাদেশে শাপলা চত্তরে যা ঘটেছিল তা আজ আমারা মিশরে দেখলাম। একই ঘটনা হতে পারে তুর্কিতে আবার হতে পারে তিউনিসিয়ায় আবার হতে পারে আলজাজিরায়।

তাই মুসলমান যারা তাদেরকে চুড়ান্ত ইন্তিফাদার (আন্দোলনের) প্রস্তুত নেয়া সময়ের দাবী।ঈমানের দাবীও সেটা। আল্লাহ সবাইকে তৌফিক দান করুন। আমীন

ডঃ আনোয়ার ইব্রাহিম এর কলামটা পড়ুন যা আজকের নয়াদিগন্তে ছাপা হয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/welcome/post/12066#.UgzJRqz-aho

বিষয়: বিবিধ

১৬০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File