সূরা হামীম আস সাজদার ৩৩ নং আয়াতের শিক্ষা এবং সময়ের আবুজর গেফারীরা
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে আহমাদ ২৫ মে, ২০১৩, ০৭:৫৩:১০ সন্ধ্যা
সূরা হামীম আস সাজদা ৩৩ নং আয়াতটি হল
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّـهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
তরজমা - ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা আর কার হতে পারে,যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, নেক আমল করলো আর ঘোষণা করলো,আমি একজন মুসলমান। সূরা হামীম আস সাজদাহ - ৩৩।
মাত্র একটি আয়াত। কয়েকটি শব্দের মধ্যেই রয়েছে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস।যে ইতিহাস থেকে পাথেও গ্রহণ করে সকল যুগের দ্বীনের দা'য়ীরা।আজ বাংলাদেশের বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলন সেই আবুজর গেফারী,বিলালের উত্তরসুরিরা নতুন ইতিহাস রচনা করেছে।
তাফসীর ফি যিলালিল কোরআনে,ও সফওয়াতুত তাফাসীরে এই আয়াতটির কয়েকটি শিক্ষা বর্ণনা করা হয়েছে।আধুনিক এই দুটি তাফসীর থেকে কয়েকটি বিষয় আলোচনা করছি।
এক) দাওয়াতকারীর দাওয়াত হবে আল্লাহর দিকে।তার সামনে কোনো প্রকার পার্থীব উদ্দেশ্য থাকবে না।
দুই) দাওয়াতদানকারীকে আমলে সালেহর সৌন্দর্যে সুশোভিত হতে হবে।
তিন) একজন মুসলমান সার্বক্ষণিক দা'য়ী ইলাল্লাহ হতে হবে।
চার) যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতে দা'য়ীর অবস্থান জানান দেবে।এই কাজটি আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়।
এই আয়াতের একটি ইতিহাস রয়েছে।
নাম আবুজর গেফারী। আরবের গেফারী গোত্রের, সরদারের বড় সন্তান। পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী। বিবাহিত ছিলেন।আবুজরের ছোট ভাই ছিলেন একজন নামকরা কবি।
কোরায়েশদের ব্যবসায়ী কাফেলা গেফারী গোত্রের সীমানা দিয়ে যাতায়াত করতো। কোরায়েশরা নিয়মিত তাদেরকে চাঁদা দিতে হত। মূলত গেফারী গোত্রের আয়ের উৎস ছিল এটাই।
রাসূল (সঃ) পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের গোপন আড়াই বছর পার হলে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত শুরু হয়। তখন আবুজর গেফারী, তার ভাই কবিকে (উনায়েছ) পাঠালেন মক্কায়।উদ্দেশ্য নতুন উত্থিত এই দাওয়াত এবং নবীর পরিচয় ইত্যাদির সঠিক খবরা খবর নেয়া।
বেশ কিছু দিন উনায়েছ মক্কায় অবস্থান করে ফিরে এসে বড় ভাইকে যে সমস্ত তথ্য দিলেন তাতে আবুজর ভয়ানক ক্ষেপে গেলেন।
তোমাকে কেন পাঠিয়েছিলাম?তুমি আমাকে শোনাচ্ছ মক্কার নেতারা কে কি বলল! এই খবরতো আমি এখানে বসেই পাই। আবুল হাকেম (আবুজাহল),ওতবা, আর মুগীরা এরা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহর অন্ধ রিরোধী। তুমি তোমার সহিত্য চর্চা নিয়ে ঘরেই অবস্থান কর। আমি নিজে মক্কায় যাবো এবং নিজেই তথ্য সংগ্রহ করবো, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা।
কিছুদিন পর আবুজর মক্কায় গেলেন এবং হারাম শরীফে অবস্থান করতে লাগলেন। পরিচিত, অপরিচিত কাউকেই তিনি কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না।এভাবে তার তিন দিন তিন রাত চলে গেল কাবার চত্তরে।
চতুর্থ দিন বালক আলী (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন।আপনি কার কাছে এসেছেন? কি উদ্দেশ্যে আপনার মক্কায় আগমন?
আবুজর বললেন আমি মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহর কাছে যেতে চাই?
তুমি কে?কোন বংশের ছেলে? তুমি কি আমাকে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহর কাছে নিয়ে যেতে পার।
বালক আলী চতুরদিকে তাকালেন এবং বললেন। আজ শেষ রাতে আমি আপনার কাছে আসবো। তবে আপনি আমার সাথে কোন কথা বলবেননা। শুধু আপনি আমাকে অনুসরণ করবেন। যদি কোন বিপদ দেখি তাহলে আমি পেশাব করার জন্য বসে পড়বো।যখনই আমাকে এরুপ দেখবেন, আমি বসে পড়েছি তখনই আপনি আমাকে আর অনুসরণ করবেন না।
কথামত বালক আলী (রাঃ) রাতের শেষ প্রহরে হারামে আসলেন এবং সাফা পাহাড়ের দিকে নিশ্চুপ চলতে থাকলেন। পিছনে আবুজর ও চলতে থাকলেন। এভাবেই আবুজর পৌছলেন বায়তুল আরকামে। যেখানে বিশ্বনেতা বিশ্বনবী (সাঃ) ইসলামী আন্দোলনের সাথীদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।বালক আলী (রাঃ) প্রথমে বায়তুল আরকামে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষন পর আবুজরকে অনুমতি দেয়া হল আবুজরকে।বিষয়টা আবুজরকে আন্দোলীত করলো।কেননা এই সাংস্কৃতির সাথে আরবরা পরিচিত ছিল না।
আবুজর ইসলাম গ্রহণ করলেন রাসূলের হাতে।বাইয়াত পড়ানো হল আবুজরকে।
আবুজর জিজ্ঞেস করলেন হে রাসূল (সঃ) আমরা কেন এই নির্জনে বসে আছি। কাবার চত্তরে কেন নয়? দারুন নদওয়াতে কেন বৈঠকাদি করছি না।আমরাতো সত্যের উপর রয়েছি।
চিন্তা করুন! বিষয়টা খুবই জটিল ছিল। দ্বীনের একজন নতুন সাথীকে কিভাবে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করা হবে।অথবা আবুজর বিষয়টা কিভাবে নিবেন।
রাসূল (সঃ) সিনিয়র সাথীদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন আবুজরকে পরিস্থিতির নাযুকতা বুঝানো হবে।
রাসূল (সঃ) সহ সবাই আবুজরকে মক্কার পরিস্থিতি অবহিত করলেন এবং সাবধান করলেন তোমার এই নতুন বাইয়াত (পরিবর্তন) মক্কার কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই। বরং তুমি তোমার গোত্রে গিয়ে দা'ওয়াতের কাজ কর।পরিস্থিতির উন্নতি হলে তোমাকে আবার মক্কায় ডাকা হবে।
আবুজর রাসূলকে (সঃ) জানালেন হে রাসূল এটা কি আপনার নির্দেশ না পরামর্শ। রাসূল (সঃ) বললেন না এটা আমার পরামর্শ। আবুজর সালাম দিয়ে সাফা পাহাড়ের বায়তুল আরকাম থেকে নেমে আসলেন। কাবার চত্তরে এসে দাড়িয়ে শরীরের সমস্ত আওয়াজ দিয়ে তিনি ঘোষনা দিলেন।
আমি মুসলিম।আমি মুসলিম।আবুজর কালেমায়ে শাহাদাতের ঘোষনা দিচ্ছেন আর কাবার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।মক্কার তখনকার পরিবেশে এই আওয়াজ ছিল খুবই অপরিচিত এবং তাদের জন্য ভংকর। গোটা আহলে তাগুতদের জন্য এটা ছিল একটি পরাজয়।যে আওয়াজ মিটিয়ে দেবার জন্য গোত্রে গোত্রে ট্রাইব্রনাল বানানো হল। নতুন মুসলমানদেরকে বিভিন্ন সাজা দেয়া হচ্ছিল। তখন প্রকাশ্যে এরকম আওয়াজ দেয়া সত্যি তাদের জন্য ছিল অকল্পনীয়।হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত সুযোগ সুবিধা,ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান কেমন করে সহ্য করা যায়।
ফলাফল যা হবার তাই হল। দারুন নদওয়া (এটা ছিল মক্কার তাগুতি চত্তর) থেকে তেড়ে আসে আবু জেহেল,ওতবা,শায়বা সহ সবাই। সবাই এক সাথে ঝাপিয়ে পড়ে আবুজরের উপর। কিল, ঘুষি,পাথর দিয়ে আঘাত সহ খাজুরের শুকনা ডাল দিয়ে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করা হয় দ্বীনের এই নতুন বীরকে।আঘাতের প্রচন্ডতায় আবুজর বেহুশ হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন।
পাশে ছিলেন রাসূল (সঃ) এর চাচা আব্বাস (রাঃ)।তখনও তিনি ইসলাম গ্রহন করেননি। কিন্তু তিনি মুসলমানদের শোভাকাংখী ছিলেন। আব্বাস (রাঃ) পারিবারিক দায়িত্ব ছিল যমযম থেকে পানি পান করানো।এই পদবীর নাম ছিল সেকায়া যমযম।
তিনি ভয় পেলেন, যদি গেফারীর এই ছেলেকে হত্যা করা হয় তাহলে কোরাইশদের সকল ব্যবসা বানিজ্য সব শেষ হয়ে যাবে। ব্যবসায়ী কাফেলা যাওয়া আসার সকল রাস্তার বন্ধ করে দিবে। গেফারীদের এই শক্তি আছে। তিনি আওয়াজ দিলেন কাকে আক্রমন করছো। সে গেফারীর সন্তান। তার রক্তের মূল্য তোমরা দিতে পারবে না। বুঝবা আগামী গ্রীষ্মে যখন ব্যবসা করতে যাবা। মক্কার এই সন্ত্রাসীরা যখন আব্বাসের হুমকি শুনতে পেল তখন আবুজরকে কিছুক্ষণের জন্য ছেড়ে দাড়ালো।
আবুজরকে আব্বাস (রাঃ) পানি পান করালেন। যম যমের পাশে এনে বুঝালেন। বাবারে তুমি যা বলছো তা বুঝে শুনে বলতেছ? দেখ বাবা তুমি তোমার গোত্রে চলে যাও।মক্কায় অবস্থান করলে এই যালেমরা তোমাকে মেরে ফেলবে।
সময়ের শার্দুল সাহাবী আবুজর কিছুটা শারিরীক শক্তি যোগাড় করে আবার তিনি আওয়াজ দিলেন
লা ইলাহা ইলল্লাহ। আমি মুসলিম।
ইতিহাসে আবুজরই প্রথম মক্কার চত্তরে ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে প্রকাশ্যে শ্লোগান দেন।
কোন ভাবে দাড়িয়ে আবার আবুজর কাবার চত্তরে ইসলামের পক্ষে শ্লোগান দিতে থাকেন আর নির্যাতিত হতে থাকেন।
তখনকার মুসলমান সবই দেখতে ছিল। কিন্তু তারা ছিল অসহায়। কেননা তখনকার সামাজিক (তাগুত) শক্তিগুলো মিলে অবস্থান নিয়েছিল রাসূল পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের বিপক্ষে।আহলে কুফর আর আহলে তাগুত সবাই তার সকল শক্তি ব্যয় করতো এই আন্দোলনের শেষ করার জন্য। তখনকার শক্তিমান সকল নাগরিক,সম্প্রদায় আর কবি সাহিত্যিকরা তাদের অবস্থান থেকে প্রচার প্রপাগান্ডা করছিল। যে করে ই হউক এই আন্দোলন ও আন্দোলনের সাথীদেরকে খতম করে দিতে।নতুবা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত সকল ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে।
সাহাবী আবুজরের এই অসীম সাহসীকতা মহান আল্লাহর এত পছন্দ হল। পরবর্তীতে আয়াত নাযিল করে জানিয়ে দিলেন যারাই এ রকম কঠিন পরিস্থিতে নিজেদের ঈমানের পরিচয় দিতে পারবে, তাদের চাইতে উত্তম ঈমানদার,মুসলমান আর কে হতে পারে!
যারা সকল প্রকার নির্যাতনের সামনে নিজেদের পরিচয়কে বড় করে প্রকাশ করার হিম্মত রাখে তারাই ইতিহাস রচনা করতে পারে।
যারা দুনিয়ার সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা পিছনে ফেলে ঈমানের ঘোষণায় বলিয়ান হন। তাদেরকেই সমকালীন সকল বাতিল, ভয়ে তটস্ত থাকতে হয়।নিয়োগ করে তার পেটুয়া বাহীনি।
নিজের পরিবার,সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি,বিদেশে বড় বড় চাকুরী ইত্যাদি যাদের জন্য বাধা হয় না। রবং অগ্রসর হয়ে প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিষ্ট রাষ্ট্রশক্তির চোখে চোখ রেখে হুংকার দিতে পারে তারাই এই আয়াতের আলোকে সবচেয়ে উত্তম মুসলমান হিসাবে গৃহিত হয়।
তারাই মুসলিম সমাজের সবচেয়ে মর্যাদার,সম্মানের হয়।
হাজার হাজার বছর পূর্বের আবুজর গেফারীরা আজ বাংলাদেশে মজলূম মানবতার পক্ষে দাড়িয়েছে।
দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে বড় ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির।এরই মধ্যে শিবির প্রমান দিয়েছে তারা শুধু ভাল ছাত্রই নয় বরং এ যুগের বিলাল ইবনে রাবাহ,আবুজর গিফারীর যোগ্য উত্তরসুরি।রিমান্ড৫৩ হউক আর ১০০ দিন হউক।বিলাল,আবুজররা প্রায় ৯০০ দিন শে'বে আবুতালিব উপত্যকায় রিমান্ড কাঠিয়েছিলেন হাসিমুখে।
মনে হচ্ছে সেই ইতিহাস ভাল করে জেনেছে আজকের বিলাল আর আবুজররা। তাই দানবের সকল হান্ডেড ফোরটি ফোর ফসকে যাচ্ছে।
সূরা হামীম আস সাজদার ৩৩ নং আয়াতের বাস্তব উদাহরন হল আজকের বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলন।
আলোচিত আয়াতের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করছে আমার দেশের আবুজর,বিলালরা।
বিষয়: বিবিধ
৩৩৬৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন