সূরা হুজরাতের ১৩ নং আয়াত এবং মানুষের আসল পরিচয়।

লিখেছেন লিখেছেন ইবনে আহমাদ ৩০ জুন, ২০১৩, ০২:৩৫:৩৬ দুপুর

মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বেশ জটিল করে সৃষ্টি করেছেন। এখনো বিজ্ঞান মানব দেহের সব কিছুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারে নাই।

আমরা মানুষ। এই পরিচয়টা সার্বজনীন।মানুষ হিসাবে মানুষের বেশ কিছু পরিচয় রয়েছে।

দুনিয়াতে বসবাসের জন্য এই মানুষ অনেক পরিচয় বহন করে থাকে।একই ব্যক্তি কিন্তু তার পরিচয় অনেক রকম হয়। আমরা সেভাবে পরিচিতও হই। যেমন, বাংলায় কথা বলি, তাই বাঙ্গালী। বাংলাদেশে জন্ম, তাই বাংলাদেশী।জাতিতে অবশ্যই আমি মুসলিম।

এভাবে আরো পরিচয় রয়েছে। কোরআনের সূরা হুজরাতে (৪৯) মানব সৃষ্টির ইতিহাস এবং মানুষের পরিচয় দেয়া হয়েছে ১৩ নং আয়াতে।

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّـهِ أَتْقَاكُمْ ۚ إِنَّ اللَّـهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ١٣

তরজমা - হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত (উত্তম) যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।এই কয়টি মাত্র শব্দের আয়াতে যে বিষয়গুলো পরিস্কার করা হয়েছে।।এবং চিন্তা করার মত বেশ কিছু বিষয় রয়েছে।

এক) গোটা পৃথিবীর সকল মানুষের প্রথম পরিচয় হল মানুষ। মানুষ হিসাবে সে সব সময়,সব অবস্থায় সমান। সম্মান,মর্যাদা,অধিকার সবই সমান।

দুই) এই মানুষের জন্মের আদি ও সবার সমান। একই প্রকৃয়ার মাধ্যমে সবাইকে দুনিয়ায় আসতে হয়েছে। মানুষের জন্মের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। জন্মের কারনে মানুষ কখনো দ্বায়ী নয়।

বর্তমান সময়ের যে সব মতবাদ, যা বস্তুতান্ত্রিক, তাদের দাবীকে চ্যলেন্জ করা হয়েছে এই আয়াতে।

ডারউইন বা হেগেল অথবা তাদের ভক্তকুল এখনো নিশ্চিত করতে পারেননি মানুষের সৃষ্টির আদি রুপ কি?

যা নিয়ে আমাদের সমাজের নব্য নাস্তিক বা আধা নাস্তিকরা মাতামাতি করেন তা তাদের জ্ঞানেরই প্রান্তসীমা। ডারউইনের দেশেই তার চিন্তাধারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বিবর্তনবাদ এখনো বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রমানিত নয়। বিষয়টা যদি ও বিজ্ঞান জগতের সবাই মেনে নিয়েছেন। তবু এই বঙ্গদ্বীপের কিছু হাইব্রিড তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ এটা মানতে চান না। বিচার বুদ্ধির সাহায্যে নয় বরং নিজেদের নিদারুন চৈতন্যের দৈনদশায়।

৩) মানুষের পরিচয়ের জন্য তাকে বিভিন্ন জাতী এবং গোত্রে ভাগ করা হয়েছে। এখানে মূল আরবী শব্দ দুটি হল শুয়ুব ও ক্বাবায়ীলা। শব্দ দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শুয়ুবের শাব্দিক অর্থ হল দলবদ্ধ কিছু লোক। আর ক্বাবায়ীল এর শাব্দিক অর্থ হল গোত্র। তাফসীর ইবনে কাসীর সহ সোর্স তাফসীরগুলোতে শুয়ুব বলা হয়েছে অনারবকে। ক্বাবায়ীল বলতে আরবকে বুঝানো হয়েছে। অনারবরা তাদের বংশ পরস্পরা বা বংশ তালিকা জানেনা। মুখস্ত ও রাখতে পারে না। বা নিজেরা তা রাখে না।যেমন আমাকে যদি বলূন আপনার দাদামহের পিতার নাম কি? আমি বলতে পারবো না। খুব বেশী হলে তিন পুরুষ পর্যন্ত বলা যাবে। কিন্তু তার পর আর বলা যাবে না। বলতে হলে আমাকে আমার পিতার সাহায্য নিতে হবে। অনারবের বংশ তালিকা মুখস্থ রাখার পারিবারিক সাংস্কৃতি নাই।

অপর দিকে গোত্র প্রধান জনগোষ্ঠী, বংশ পরস্পরা বা বংশ তালিকা মুখস্ত রাখা তাদের সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা এবং পারিবারিক মৌলিক রেওয়াজ। আরব বিশ্বের এত পরিবর্তন হবার পর এখনও তারা তাদের বাচ্ছাদেরকে বংশ তালিকা মুখস্ত করায়।আমার পরিচিত অনেক বন্ধুরা আছে যারা লেখাপড়া করেছে আমেরিকা,মালয়এশিয়াতে। কিন্তু এই আধুনিক ছেলেরাও বলতে পারে তাদের ১৪ পূরুষের নাম।কেউ তার পকেটে রাখে বংশ তালিকা।

মানুষের পরিচয়ের জন্য এই ভাগ।

আয়াতের এই অংশে জাতি বলতে একটা বৃহত মানুষের আবাসস্থল বুঝানো হয়েছে। যদিও আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জাতির যে উপদানের কথা বলা হয়েছে। অবশ্যই সেটা নয়।জাতির পরিচয়,উপাদান ইত্যাদির সাথে কোরআনে শুয়ূব শব্দের কোন সম্পর্ক নেই। জাতি বলতে কোরআনের পরিভাষা হল উম্মাহ।

৪) চতুর্থ যে বিষয়টি আলোচিত আয়াতে পরিস্কার করা হয়েছে তা হল মানুষের আসল মর্যাদার বিষয় টা কি? এক শব্দে বলা হয়েছে- তাকওয়া।যার বাংলা করা হয় পরহেজগারী। যদিও আরবীতে তাকওয়া শব্দের সবটুকুন অর্থ বুঝাতে শুধুমাত্র পরহেজগারী বা আল্লাহ ভীতি বললেই হয় না। বরং এর অর্থ আরো ব্যাপক।আমরা কেন কোরআনের পরিভাষাগুলোর বারোটা বাজিয়েছি তার একটা ইতিহাস আছে।

আমাদের সমাজে ইসলামের আগমন ঘটেছে যাদের মধ্যমে তাদের মুখের ভাষা ছিল ফার্সী। ফার্সী একটি সমৃদ্ধ ও প্রচীন ভাষা। কিন্তু সেটা আরবীর চাইতে মোটেই বনেদি ভাষা নয়।বরং আরবী ভাষাটা যেমন প্রাচীন তেমন তা জীবন্ত ও বৈচিত্রময়।আরবীর একটি শব্দের যে প্রতি শব্দ রয়েছে তা সাধারনত পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় পাওয়া দুস্কর।আরবী ভাষার যে রাজকীয় ভাব সেটা অন্য ভাষায় নেই বললে চলে।

তাকওয়া শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে আমাদের সমাজে। যে যত বেশী দুনিয়া বিমুখ তাকে তত বেশী পরহেজগার ভাবা হয়। আমাদের সমাজে যারা কাপড় চোপড়ের খবর রাখে না তাকে বলা হয় মানুষটা বড় পরহেজগার। এর রকম অনেক পিকুলিয়ার সব ব্যাখ্যা রয়েছে তাকওয়ার।

মূলত তাকওয়ার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা হল - ব্যক্তি তার জীবনের সকল ক্ষেত্রে মহান আল্লাহকে ভয় করার নীতিতে জীবন পরিচালনা করবে। তাকে ই মুত্তাকি বলা হবে। ভয় আর বিনয় এর মাঝখান থেকে একটি মানষিক ভিত্তির নাম হল তাকওয়া।জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাছ বিচার করে চলার নাম তাকওয়া।

৫) আয়াতটিকে সমাপ্ত করা হয়েছে, আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং সবকিছুর খবর রাখেন।

কি খবর রাখেন, কি বিষয়ে সর্বজ্ঞ এই দুটি শব্দ আলোচিত আয়াতের মূল শিক্ষা।

কি খবর রাখেন -

আমি আমার ব্যক্তি জীবনে যা করি না কেন সব কিছুর খবর রাখেন আমার মালিক আল্লাহ।

এই অনুভুতি যদি সার্বক্ষনিক আমার মধ্যে কাজ করে তাহলে আমাকে দিয়ে কোন খারাপ কাজ হওয়া সম্ভব নয়। জীবনের এক পল ও আমি আল্লাহর খবরের নিরিক্ষণ (রাডার) থেকে বাহিরে নয়।এই প্রকৃতির ঈমানদাররাই পৃথিবীর সবচেয়ে কল্যান মানুষ।

অধিকার পাওয়া এবং অধিকার বুঝিয়ে দেয়া সবই তখন সম্ভব যখন আমি মনে করবো আমাকে একজনের কাছে জাবাবদিহী করতে হবে। জীবনের সবচেয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়ের সঠিক ও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে হবে একদিন। এই চিন্তা,চেতনা আমাকে ভাল মানুষ,সৎ মানুষে পরিণত করে। মানুষের বিবেকের কাজ,দ্বায়টা হল এই জায়গায়। সমাগত পবিত্র রমাদান মাস আমাদেরকে এই শিক্ষাটা দিতেই আসে।

বছর ওয়ারী এই তাকওয়ার প্রশিক্ষন প্রোগ্রামে অংশ গ্রহন করার জন্য আমাদেরকে বেশ কিছু আগাম প্রস্তুতি নেয়া উচিত। যা আল্লাহ চহে তো আগামীতে আমার ব্লগ বাড়িতে পাবেন। আগাম আমন্ত্রন রইল। মাহে রামদানের শোভেচ্ছা।

বিষয়: বিবিধ

২৭২৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File