.....আয়না
লিখেছেন লিখেছেন বাকপ্রবাস ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ০৫:২৭:০১ বিকাল
আয়না কিনেছি একটা। মিরু'র জন্য। আরতো মাত্র ছয়মাস। ছুটিতে দেশে নিয়ে যাব। আয়নার দুইপাশে দুইরকম দেখায়। একপাশে নরমাল আর অন্যপাশে বড় দেখায়। মুখে বর্ণ উঠলে সেটা নকের খোঁচায় গালতে কিংবা ছোট কোন দাগ দেখা দিলে সেটা ভাল করে দেখার জন্য বোধয় এই ব্যবস্থা। আয়নার এই পাশটা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। আমার মন অন্যপাশটা ঘিরে। মিরু যখন আয়নায় চোখ রাখবে তখন সে অন্য মনস্ক হয়ে পড়বে। তার চেহেরাটা ধীরে ঝাপসা হয়ে আসবে। কপালে যে টিপ লাগাতে চেয়েছিল সেটা ভুলে যাবে। ঝাপসা হয়ে আসা ছবিটা আবার পরিষ্কার হতে শুরু করবে। কিন্তু তার নিজের চেহেরাটা আর দেখতে পাবেনা। সে পরিষ্কার দেখতে পাবে আমায় সেই আয়নায়। এখনো মিরু'কে বলা হয়নি আয়নার কথাটা। বলব কিনা ভাবছি।
মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের বিয়ে করতে নেই, যারা ৩/৬ মাসের ছুটিতে গিয়ে বিয়ে করে আবার চলে আসে। এ ভীষণ অন্যায়, প্রতারণা বা জুলুম। এসব কথা এভাবে বলিনি বা ভাবিনি কোন দিন। কিন্তু আয়নাটা কেনার পর মন আর সইছেনা। ইচ্ছে করছে এখনই গিয়ে দিয়ে আসি। ছয়টা মাস রেখে দিতে হবে নিজের কাছে। এতো তাড়াতাড়ি কেনইবা কিনলাম। আরো পরে কিনলেই পারতাম। মনযে এখন অস্থির হয়ে গেল। ইচ্ছে করছে ছুটি নিয়ে চলে যাই। সেটা কী করে সম্ভব! এখন কি ছুটি দেবে? মাত্র ছয় মাস হলো ছুটি কাটিয়ে আসলাম। বছর পুরলে এক মাসের ছুটি। গতবার বিয়ে উপলক্ষ্যে সেটা তিন মাস এক্সটেনশান করা গেছে। এখন ছুটি চাওয়া মানে চাকরী থেকে বিদায় করে একেবারেই ছুটি দিয়ে দিবে।
মোহাম্মদ আর ইসলাম দাত কেলিয়ে হাসছে। উফফ কী জঘন্য হাসিটা। আর সবকিছু সহ্য করা যায় কিন্তু এই হাসিটা সহ্য হয়না আমার। পুরো কৃত্রিম হাসি। মানুষের কৃত্রিম আচরণগুলো দেখলে আমার মাথা গুলিয়ে যায়। ইচ্ছে করে কষে থাপ্পর মেরে বলি স্বাভাবিক আচরণ কর। দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় মাইকেল কী যেন জিজ্ঞাস করেছিল, সেটার জবাব দিয়ে হাসা শুরু। মাইকেল নেমে গেছে কিন্তুু আর ইসলাম হাসি থামায়না, কেলাতে কেলাতে এসে বসল তার আসনে। আমার এখন ছুটি চাইতে হলে আর ইসলামকে ফেইস করতে হবে, তাকে রাজি করাতে পারলেই মাইকেলের কোন আপত্তি নাই। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। ছয়মাস অপেক্ষা করা চলে কিন্তু আর ইসলাম এর দাত কেলানো হাসির মুখোমুখো হওয়া সম্ভবনা, দাত কেলাতে কেলাতে বলবে এপ্লিকেশান রেখে যাও আমি দেখছি। দেখছি মানে আর দেখবেনা যতক্ষণনা পর্যন্ত তার পিছুপিছু ঘুরেঘুরে প্রকাশ না করছি যে, তুই হলি পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষমতাধর ব্যাক্তি। পুতিন বা ট্রাম্প তোর কাছে কিছুইনা, তুই হলি ওভার ট্রাম্প।
তেইশটা মিস্ড কল। কাজে ব্যাস্থ ছিলাম খেয়াল করা হয়নি। তাছাড়া যোহরের নামাজের সময় সাইলেন্ট করা ছিল সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। মিরু'র একটা স্বভাব। যখন তার কথা বলতে মন চাইবে তখন আমার যত কাজই থাকুক, সেটা ফেলে কথা বলতে হবে। না'হলে মোবাইল অফ করে রাখবে কথা বলবেনা আর। অনেক গালগল্প হাবিজাবি বলে তারপর মান ভাঙ্গাতে হবে।
- হুম বল
- কি বলব?
- ফোন করেছিলে কেন?
- তার আগে বল হান্নাহ আজ কী জামা পরে এসেছে? (ম্যানেজার মাইকেল এর কন্যা, নতুন জয়েন্ট করেছে বাবার অপিষে)
- হান্নাহতো আজ জামা পরেনি
- জামা পরেনি মানে? উদোম গায়ে এসেছে?
- উদোম গায়ে ঠিক না, সেমিজ পরে চলে এসেছে, মনে হয় ঘুম থেকে উঠতে লেইট করেছে, তাড়াহুড়া করে আসতে গিয়ে সেমিজ পরার পর জামা পরতে ভুলে গেছে।
- তাইতো বলি আমার ফোন ধরনা কেন? হান্নাহকে দেখা হচ্ছে বসে বসে। ভাল হান্নাহকে দেখ, আমি রাখছি।
- আরে ধ্যুর, কাজে ব্যাস্ত ছিলাম আর মোবাইল সাইলেন্ট ছিল তায় খেয়াল করা হয়নি। এবার বল জরুরী কিছু?
- হুম জরুরী
- কী?
- ছুটি চাই। দুই দিনের জন্য। বাবা অসুস্থ্য দেখতে যাব।
- ভাল কথা, মা'কে বলে চলে যাও, ঘুরে আসো।
- পারবনা, তুমি বলে দাও মা'কে। আমি বলতে পারবনা।
- আজব ব্যাপার, সামান্য একটা বিষয়, মা'কে বলবে দুইদিনে চলে আসবো, বাবাকে দেখতি যাচ্ছি। সামান্য এই কথাটাও আমাকে এখন থেকে বলে দিতে হবে? মা'কি তোমাকে যেতে দেবেনা? কখনো কী ধরে রেখেছে তুমি যখন যেতে চাও?
- এতো কথা বুঝিনা, তুমি ছুটি নিয়ে দাও, নিয়ে আমাকে ফোন করে বল। আমার লজ্বা লাগে ছুটি চাইতে।
- আমার সাথে ঝগড়া করতে লজ্বা করেনা?
- না করেনা, আমি ফোন রাখছি, তুমি তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে আমাকে জানাও। বাই।
সন্ধ্যে সাতটা। অপিষ থেকে বাসায় এসে কাপড় চেন্জ করে, হাতমুখ ধুয়ে কফি বানালাম এক মগ। কফি বানানো খুব সহজ। সুপার মার্কেট থেকে মিনি প্যাক কিনে রেখেছি। প্যাকেটে লেখা আছে, ঝিনো কফি, জার্মানী তার নিচে বড় করে লেখা থ্রি ইন ওয়ান, তারপর পিরিজ ও কাপের ছবি, কাপের ভেতর কফি আর পিরিজে কিছু আস্ত কফি ছিটিয়ে রেখেছে। তার নিচে লেখা হাই কোয়ালিটি কফি ব্ল্যান্ড। সব শেষে ছোট করে লেখা এন. ডব্লিউ. ১৫ জি.।
কফির সাথে টোষ্ট বিস্কিট খাচ্ছি। বাংলাদেশ থেকে বিস্কিট, চনাচুর সব এক্সপোর্ট হয়। প্রাণ এর টোষ্ট বিস্কিট আমার খুব পছন্দের। একবার প্রাণেরটা না পেয়ে কেরেলা মেইড রাস্ক কিনেছিলাম। খাওয়া যায়না, খুব বাজে। আমরা যেটা টোষ্ট বলছি ওরা সেটা রাস্ক বলছে প্যাকেটে দেখলাম ছবি একই রকম তায় কিনে পরখ করে দেখলাম। সেটাই প্রথম এবং শেষ কেনা। কফিতে চুমুক দিতেই ঋতুর মিস্ড কল। আমার ছোট বোন ঋতু। বিয়ে করার পূর্ব পর্যন্ত আমার অগোছানো জীবনটা গুছিয়ে রাখার দায়িত্বটা যার হাতে ছিল। আলনা, খাট গোছানো, গোছাতে গোছাতে বকাঝকা ইত্যাদি। "রুম থেকে বের হন, আামার গোছানো শেষ হলে তারপর আসবেন,'' এমন টাইপ কড়া কথাবার্তা বলতো। তারপর আমার কাপড় ধুইয়ে দেয়া, আয়রন করা ওসবের ভারও ঋতু বহণ করত। আমি টুকটাক হাত খরচ দিতাম বিনিময়ে।
ঘনঘন মিস্ডকল আসছে। নিশ্চয় জরুরী কোন ব্যাপার আছে। কল ব্যাক করলাম।
- ভাইয়া তোমাকে দেশে আসতে হবে, খুব জরুরী
- কেন কী হয়েছে?
- ভাবি এক্সিডেন্ট করেছে সন্ধ্যায় ওনার বাবার বাড়ি যাবার পথে।
- এখন কী অবস্থায়? কোথায় আছে?
- হাসপাতালে, তোমাকে আসতেই হবে ভাইয়া, যে করেই হোক কালকের ফ্লাইট ধরার চেষ্টা কর।
- আচ্ছা
আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। কিছুই চিন্তা করতে পারছিনা। বেশী খারাপ কিছু হয়নিতো? ওরা কী আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছে? এসব ভাবতে ভাবতে দৌঁড়ে গেলাম ট্রাভেল এজেন্সিতে। টিকেট পাওয়া গেছে প্রাইজটা যদিও একটু বেশী। আগামীকাল সকাল নয়টায় ফ্লাইট। ভোর ছয়টায় পৌঁছতে হবে এয়ারপোর্টে। তার আগে চাই এক্সিট পার্মিট। মধ্যপ্রাচ্যে এ এক ঝামেলা। স্পন্সর থেকে এক্সিট পার্মিট না নিলে দেশ ত্যাগ করা যায়না। সেবেষ্টানকে ফোন দিলাম। স্পন্সরের কাজগুলো করার জন্য একজন অফিসার নিয়োগ থাকে, তাকে মন্দুপ বলা হয়। সেবষ্টান ফোন ধরছেনা, কারণ এখন অপিষ আওয়ার নয়। তাকে যে করেই হোক পেতে হবে, অনলাইনে এক্সিট পার্মিট নেয়া যায়, সেটা সে ঘরে বসেই করতে পারবে, কিংবা অপিষে এসে মাত্র পাঁচ মিনিটের কাজ। আমার কথায় সে আসবেনা, মোহাম্মদ আর ইসলামের দ্বারস্থ হতে হল অবশেষে। আর ইসলাম বললে তাকে আসতেই হবে।
প্ল্যানের সিটটা জানলার পাশেই পেলাম। এলাউন্স করছে সবার মোবাইল সুইচ অফ করার জন্য। দরজার দুই পাশে দুইজন ক্রু অঙ্গভঙ্গি দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে সিট ব্যাল্ট লাগাতে হবে, যদি কোন সমস্যা বা এক্সিডেন্ট হবার উপক্রম হয় তাহলে কী কী করতে হবে সেসব দেখিয়ে দিচ্ছে। আমার মাথা কাজ করছেনা। হঠাৎ মনে পড়ল আয়না ফেলে এসেছি। সেটা আনা হয়নি তাড়াহুড়া করে।
বিষয়: বিবিধ
৬০২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন