আদুরীরর মা কি জানতো এই শহরে মানুষের চেয়ে পশুর সংখ্যা অনেক বেশি? মানুষের মুখসে জানোয়ারে ছেয়ে গেছে ইট কাঠের এই নগরী?
লিখেছেন লিখেছেন এম এম ওবায়দুর রহমান ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৮:১৩:২০ রাত
ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত বারীধার ডিওএইচএস এর একটি ডাস্টবিন হইতে অর্ধমৃত্যু অবস্থায় উদ্ধার হওয়া ১১বছরের কন্যা শিশু আদরীকে নিয়ে সবর্ত্র আলোচনা চলছে।
মধ্যেবৃত্তদের কাছে অনেকটা স্বপ্নের মত এলাকা হচ্ছে গুলশান, বনাননী বারীধারা। এসব এলাকায় সমাজের উচ্চ শ্রেনীর লোকজন বাস করে। যারা শিক্ষায় আর অর্থে এলিট শ্রেনির।
ইতিপূর্বে ঐশীর ঘটনা সমাজের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। আমরা মধ্যেবৃত্তরা জানতে পারি। কি করে উচ্চবৃত্তদের পারিবারিক জীবন নিয়ম শৃঙ্খলা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আদুরীরর ঘটনা আরো বেশি নির্মম। ইট কাঠের এই নগর যে ক্রমেই মানুষকে পশুর চেয়ে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে তা আর বুঝতে বাকি নেই।
নওরীন জাহান নদী সমাজের তথাকথিত ভালো ঘরের মেয়ে। সে অভাবী নয়। স্বামী এবং দুই সন্তান নিয়ে ভদ্রতার মুখসে এই সমাজে বাস করে যাচ্ছিল।
ডাষ্টবিন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া আদুরীর ছবি যখন টিভি পর্দায় ভেসে উঠেছে, তখন অনেক মধ্যেবৃত্ত পরিবারের মত আমার পরিবারের স্বজনদের চোখে আমি জ্বল দেখেছি। কেন যেন মনে হচ্ছিল এই মানুষটাকে সোমালিয়ার মত কোন দুর্ভিক্ষ কবলিত এলাকা থেকে তুলে আনা হয়েছে। অথচ নির্মম সত্য হলো, সে একটি এলিট পরিবারের গৃহকর্মী! যেখানে কুকুরকেও তিন বেলা মাংস ভাত খাওয়ানো হয়, অথচ একজন গৃহকর্মীকে পুরো বছর জুড়ে একবেলা খাবার দেওয়া হয়েছে। তার অতটুকু শরীরের সমস্ত চামড়া জুড়ে আঘাতের চিহ্ন!
আমি জানিনা সে কেমন করে বেচে আছে?
হয়ত পরম করুনাময় আল্লাহ আমাদের দেখাতে চেয়েছে যে আমরা কতটা পশু হচ্ছি ধিরে ধিরে। ঝকঝকে তকতকে ভবন গুলোর ভেতরে নওরীন জাহানের মত এমন অসংক্ষ্য জানোয়ার বেড়ে উঠেছে। রঙিন পোশাকে হায়না গুলি শহরের সবর্ত্র চলছে।
অবহেলিত একটি অজঁপাড়া গায়ে আদুরী তার পরিবারের ষষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্ম নেয়। বাবা মা আদর করে নাম রাখেন আদুরী। আহা কি মমতা ভরা একটি নাম। মেয়েটির জন্মেও পর থেকেই অভাবী। আদুরীর বাবা মারা যাবার পর মা তাদের খাবার জোগাড় করতে পারছিলোনা। তখন ধনী প্রতিবেশি ৫০০ টাকা বেতন আর অনেক সুযোগ সুবিধার গল্পর ফাঁদ পেতে মেয়েটিকে ইট কাঠের এই নগরীতে নিয়ে আসা হয়।
আদুরীরর মা ভেবে ছিলো তারা বাপমরা মেয়েটা এবার হয়ত তিনবেলা পেট পুরে ভাত খেতে পারবে। গরীবের স্বপ্ন খুব বেশি না। তারা তিন বেলা ভাত আর মোটা কাপড় পেলেই খুশি। কিন্তু আদুরীর মা কি ভেবে ছিলো তার মেয়েকে এভাবে দিনের পর দিন মানুষ নামের হায়নারা খুচিয়ে খুচিয়ে তিলে তিলে হত্যা করবে? তার কলজে চিরা ধনকে জীবন্ত কংঙ্কাল বানিয়ে ডাষ্টবিনে ফেলে দিবে?
আদুরীরর মা কি জানতো এই শহরে মানুষের চেয়ে পশুর সংখ্যা অনেক বেশি? মানুষের মুখসে জানোয়ারে ছেয়ে গেছে ইট কাঠের এই নগরী?
কথায় কথায় বুদ্ধিজীবীরা বলে শিক্ষিত হলেই নাকি মানুষ সভ্য হয়ে যায়? লেখা পড়া করলেই নাকি মানুষ হওয়া যায়। শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। প্রতি বছর রের্কড সংখ্যক মানুষ পাশ করে বের হচ্ছে। কিন্তু তারা মানুষ না হয়ে ঐশী বা নওরীন হয়ে যাচ্ছে!
এর দায় কে নিবে?
এই নগর মানুষের আবেগ ভালোবাসা মমত্ব কেড়ে নিয়েছে। আজ প্রকাশ্য রাস্তায় মানুষ খুন হলেও কেউ এগিয়ে আসছে না। আ্যাকসিডেন্ট হলে দুঃভাগা যাত্রীর পকেট মারতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে জনতা!
কোথায় যাচ্ছি আমরা?
নওরীন জাহান ছোটবেলায় পরা ডায়নীর চরিত্রের চেয়েও ভয়ংঙ্কর। শুধু কি নওরীন? না। তার পুরো পরিবারই মানুষ রুপি জানোয়ার যারা ঠা-া মাথায় একটি শিশুকে দিনের পর দিন নানান কায়দায় নির্যাতন করেছে।
টিভির পর্দায় আদুররীর মাকে দেখলাম। সে বিস্মিত চোখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে যেন ঘোরের মধ্যে আছে। স্বপ্নের মধ্যো আছে। এই শহর তার কাছে ভারী অচেনা। আদুরীর মায়ের কাছে এই শহর ছিলো স্বর্গের মত। এখানে যারা বাস করে তারাতো ভদ্রলোক। পয়সা কড়ির টান নেই। মাঝরাতে বৃষ্টির পানিতে যাদের ঘুম ভাঙ্গেনা। শীতের তীব্রতায় যাদের খড় জ্বালিয়ে নির্ঘুম রাত পার করতে হয়না। পেটে পাথর বেধে অনাহারী সন্তানদের জন্য যাদের কাজ করতে হয়না।
কিন্তু এ কি দেখছে সে!!
আদুরীর মা নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে।
সে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলে, আমি ফাসি চাই! যারা আমার মেয়ের সাথে এমন জুলুম করেছে, তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।
দর্শকরাও আপ্লুত হয়। হ্যা আমরা আদুরীরর উপর যারা এমন অন্যায় আচরণ করেছে তাদের উপযুক্ত বিচার চাই। যাতে আর কোন আদুরীর জীবনে নরক নেমে না আসে।
আদুরীর মা হয়ত ভুলেই গেলো, যে এই নগরে বিচার কিনতে হয় টাকা দিয়ে। পুলিশ, উকিল মোক্তার সবাইকে টাকা দিয়ে কিনতে পারলেই কেবল বিচার চাওয়া যাবে। মহামান্য আদালতের দরজায় পৌছানোর প্রতি ধাপে পয়সা খরচ করতে হবে। পাচশত টাকা মাইনের এক চাকরের মায়ের কয়টা পয়সা আছে আচলের মুঠিতে?
আমরা যারা ফেসবুকে ঝড় তুলছি, পত্রিকায় কলাম লিখছি আমরাতো আদুরীরর মায়ের পাশে গিয়ে দাড়াচ্ছি না। আদুরীর শিয়রে একটা আপেল দিয়ে বলতে পারছি না, মা তোমার উপর যে অন্যায় হয়েছে তার জন্য আমিও দায়ী। আমরা এমন একটা সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি যেখানে তোমাকে ভাতের জন্য জিহবায় গরম ছ্যাকা খেতে হবেনা। মাগো আমাকে ক্ষমা করিস। এই সমাজ শুধু তোকে নয় মানবতাকেও ডাষ্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
এর দায় থেকে আমাকে কে মুক্ত করবে?
আদুরীর মা আমার, আমি বিশ্বাস করি এই সমাজে আরো অনেকেই তোর মত চার দেয়ালে পিচাশের হাতে বন্দি। রাষ্ট্র যতই বলুক মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দেশে উন্নয়নের জোয়ার বয়েছে। সবি মিথ্যা। সবি সাজানো যেকোন মুল্যে এই হায়নাদের প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় বসতে চায়।
তাই স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
আদুরীদের কোথাও কেউ নেই। প্রতিমাসেই গৃহকর্মী খুন ধর্ষন এর রগরগে খবর পড়ছি। তার কয়টার বিচার হয়েছে? পাঠক ভেবে দেখুন।
ভাবলেসহীন চোখে আদুরী তাকিয়ে আছে। তার চোখে কোন প্রশ্ন নেই। কোন অনুযোগ নেই। আদুরীকে দেখতে সমাজের রাষ্ট্রের বড় বড় হর্তা-কর্তারা যাচ্ছেন। টিভি ক্যামেরার সামনে নানান প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
কিন্তু কে জানে তাদের ঘরেও এমন আদুরী আছে কিনা? কয়েকদিন আগে তো দেখেছিলাম এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী এমন নির্যাতন করে ছিলো। এক বড় টিভি নায়িকার বাসায়ও এমন নির্যাতন হয়ে ছিলো। এরকমটা প্রতি নিয়তই হয়।
আদুরীর কংঙ্কালসাড় দেহটা মনে হচ্ছে এই দেশের গনতন্ত্রেরও প্রতিনিধিত্ব করছে। রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছে। সংবিধানে যাই লেখা থাকুক আমরা এখনো মানুষ কে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে শিখিনি। সকল মানুষকে সংবিধান একসমান চোখে দেখতে বললেও রাষ্ট্র তার ব্যাবস্থা করতে পারেনি।
হাজার হাজার গৃহকর্মী নির্যতীত হলেও আজ পযন্ত কোন নীতিমালা করা হয়নি। তাদের দেখভাল করার জন্য সরকার কোন একজন মানুষকেও দ্বায়িত্ব দেয়নি।
এই পরিস্তিতি মানা যায় না। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমি দাবী করছি দ্রুত গৃহকর্মীদের জন্য আইন করা হোক। তাদের অধিকার রক্ষায় সরকার আন্তরিক ভাবে এগিয়ে আসুক।
আদুরীর নির্যাতনকারীদের কঠিন বিচার করা হোক। তাকে ক্ষতি পূরণ দেওয়া হোক। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্যিকার মানুষ হবার তৌফিক দিন।
বিষয়: বিবিধ
২৭৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন