বাদল দিনের একাকিত্ব! (একটি নিরীক্ষাধর্মী গল্প)

লিখেছেন লিখেছেন এম এম ওবায়দুর রহমান ২৮ জুলাই, ২০১৩, ০১:০৪:২১ দুপুর



সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘলা আকাশ। হিমেল বাতাসও বইছে। অফিসের কোন কাজেই মন বসছে না জহিরের। সকাল থেকে সে কোন কাজেই হাত দেয়নি । অথচ তার ডেস্কে অনেক কাজ পড়ে আছে। যেকোন সময় বদরাগী ম্যানেজার স্যার তাকে ডেকে নিয়ে ঝাড়ি দিতে পারে। ভদ্রলোক বকা ঝকা করতে খুব পছন্দ করে। পান থেকে চুন খসার আগেই জহিরকে বিশ্রী ভাষায় বকা ঝকা করেন। ওনার আঞ্চলিক গালির সব গুলোর অর্থ অবশ্য কোন দিনই উদ্ধার করতে পারেনি জহির। তাই ম্যানেজার স্যারের গাল গুলি মুখস্ত করে রাখে সে। বেতন সীমিত বলেই একটা মোটা বাংলা ডিকশনারী কিনকে পারছে না জহির। কিনতে পারলে ভালো হত। স্যারের প্রতিটি গালের অর্থ খুঁজে দেখার চেষ্টা করা যেত। কি জানি এমনও হতে পারে স্যারের গাল গুলি তার স্বরচিত! ডিকশনারী খুঁজে দেখা যাবে এরকম কোন শব্দই নেই! তখন জহিরের মন খারাপ হবে। শুধু শুধু কত গুলো টাকা গেল এমন মনে হবে। কবিরা কবিতা সৃষ্টি করে, আর গালবাজরা গাল! জহির ভাবে স্যারকে একদিন সংসদ টিভি দেখতে বলবে। সেখানেও ভালো গালা-গাল চর্চা হয় আজকাল।

জহিরের বেতনের ২৫% সে একটা ব্যাংকে জমা রাখে। তার খুব বেশি দিন চাকুরি করার ইচ্ছে নেই। বেশি দিন চাকুরী করলে শরীর থেকে চাকর চাকর গন্ধ আসে! তার মা আমেনা বেগম এমনটাই বলতো। শেষের দিকে বাবাকে সহ্যই করতে পারতোনা। বাবা মেঝেতে মাদুর পেতে তার সঙ্গে ঘুমুতো। বিছানায় শোয়া মাত্রই বাবা ঘুমিয়ে পড়তো। গভীর ঘুমের ঘরে বাবা কারে যেন ভয় পেত। আঁতকে উঠতো। জহির বাবাকে জড়িয়ে ধরতো। বাবার জন্য তার বুকের মধ্যে কেমন যেন করতো। সেই বাবা একদিন তার পাশেই মরে গেল। সেদিন বাইরে খুব ঝড় বৃষ্টি ছিলো। টিনের চালে বৃষ্টির একঘেয়ে শব্দে কখন যে জহির ঘুমিয়ে গিয়ে ছিলো টের পায়নি। পাশে ঘুমিয়ে থাকা বাবা কখন যে মরে গেল সেটাও জানলো না জহির। মৃত্যু কত শীতল, কত নিঃশব্দ!

জহির অফিসের বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখতে চেষ্টা করলো। অন্যদিন বৃষ্টি তার খুব ভালো লাগে। ইচ্ছে করে বৃষ্টির সঙ্গে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে। আজকাল অনেকেই মোবাইল ফোনে গান শোনে। জহিরের মোবাইলটা অনেক পুরাতন। কয়েকবার নষ্ট হয়েছে। এটাতে গান শোনার অপশন নেই। জহির অনেক বার ভেবেছে ফোনটা পরিবর্তন করবে। কিন্তু পারেনি। অবশ্য এই ফোনটার একটা গল্প আছে। ভালোবাসার গল্প। সেই গল্পটা কাউকে বলা হয়নি।

অফিসের বারান্দা বেশ বড়। এল আকৃতির। হঠাৎ করেই জহিরের চোখ আটকে গেল। নুসরাত ম্যাডাম বৃষ্টি দেখছে। এই অফিসের তিনিই বড় ম্যাডাম। খুব মুডি সে। তারমত এমন সিরিয়াস একজন মানুষ বৃষ্টি দেখছে! জিনিসটা কেমন যেন মানাচ্ছে না। ম্যাডামের চশমায় বৃষ্টির পানি ছিটে এসে লাগছে। ঝাপসা হয়ে গেছে চশমার কাঁচ। সে দিকে তার অবশ্য খেয়াল নেই। সব সময় রাগী এই মানুষটাকে এখন লাগছে শিশুর মত। বৃষ্টির দেখি অসিম ক্ষমতা! জহির অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ম্যাডাম কাঁদছে। তার চোখের নিচে জলের ধারা। বৃষ্টির জলে সাথে চোখের জল মিশে যাচ্ছে। এতো ক্ষমতাবান মানুষের এমন সহজ দুঃখ থাকতে পারে! আশ্চর্য!

জহির অবাক হয়।

- এই ছেলে, এই তুমি বারান্দায় কি করো কাজ নেই! যাও ভেতরে যাও!

চিৎকার করে বলে নুসরাত ম্যাডাম। জহির পা বাড়ায়। তার মনের ভেতর অস্থির অস্থির লাগছে। কিছুই ভালো লাগছে না এখন। ইচ্ছে করছে দুরে কোথাও চলে যেতে। বহু দুরে।

সহকর্মী মলয় বাবু ডেস্কে এসে কৌতুকের স্বরে বললো, কি অবস্থা ভাই সকাল থেকে ছটফট করছেন কেন? শোনেন বিয়ে করে ফেলেন। বিয়ে করলে এই অস্থির ভাব কেটে যাবে!

বিশ্রী ভাবে হাসে মলয় বাবু। জহিরের ইচ্ছে হয় থাপ্পর দিয়ে বদের হাড্ডিটার দাঁত ফেলে দিতে। কিন্তু সে কিছুই বলেনা। এই বদটা সব সময় তার পিছে লেগে থাকে। সরকারী অফিস বলেই চাকুরিটা আছে জহিরের না হলে হয়ত মলয় বাবু তার চাকুরিটাই খেয়ে ফেলতো!

অফিসের পিয়ন বজলু এসে দাঁড়ালো।

ভাই আপনারে বড় ম্যাডাম তার চেম্বারে ডাকে। এখুনি যেতে বলেছে।

যান গিয়ে বকা খেয়ে আসুন। মলয় বাবু যোগ করে।

জহির উঠে দাঁড়ালো। এক কাপ চা খাওয়া দরকার। বিষণ্ণতা কাটাতে চায়ের মত ঔষুধ নেই। কিন্তু এখন এই সময় চা কে দিবে?

জহির ম্যাডামের দরজায় গিয়ে অনুমতি চাইলো। ম্যাডাম বললো আসুন জহির সাহেব।

চেয়ারে বসতেই পিয়ন বজলু দুই মগ কফি নিয়ে প্রবেশ করলো। জহির কিছুটা আশ্চর্য হলো। ম্যাডামের সামনে কফি খেতে তার সংকোচ হলো। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে উসখুস করতে লাগলো। বাইরে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। ম্যাডাম তার জানালার পর্দা সরিয়ে রাখছেন। বৃষ্টি এখানে বসেও তো দেখা যায়। কেন যে ম্যাডাম বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখে!

নুসরাত ম্যাডাম বললো, জহির সাহেব আপনার সম্যসা কোথায় আমাকে বলেনতো!

কেন ম্যাডাম?

একটা মেয়ে বৃষ্টি দেখছে আর কাঁদছে, এখানে মুগ্ধ হয়ে দেখার মত কি ঘটেছিলো বলেন তো? আমি দেখলাম আপনি গভীর মনোযোগ দিয়ে আমাকে দেখছেন। কোন নারীর অগোচরে তাকে দেখা যে অন্যায় এটা আপনি জানেন না?

জ্বি না।

কেন জানেন না?

আমাকে কেউ বলে দেয়নি। কোন বইতেও পাইনি!

জহির সহজ গলায় বললো। কেন যে এখন আর নুসরাত ম্যাডামকে ভয় পাচ্ছে না সে। ভয় জিনিসটা আসলেই অদ্ভূত! জহির কফিতে চুমুক দিলো। কফিটা দারুণ হয়েছে ম্যাডাম।

কফিটা শেষ করুন। আমি আপনাকে অনেক বকাঝকা করবো।

জ্বি আচ্ছা।

আপনি যেই বেতন পান তা দিয়ে প্রতি মাসে অন্তত একটা শার্ট কেনাতো কোন ব্যাপারই না কিন্ত গত এক বছর ধরে এই দুইটা শার্ট পড়ে অফিসে আসছেন। ব্যাপারটা হাস্যকর লাগে না? তারপর দুপুরে ক্যান্টিনে না খেয়ে ফুটপাতের দোকানে দাড়িয়ে সিংঙ্গারা খান। আপনার চাল চলন ভারী অদ্ভূত! আপনার জন্য অফিসারদের মান যায় যায় অবস্থা!

জহিরের কফি শেষ। খালি মগটা আস্তে করে রেখে সে ম্যাডামের দিকে তাকায়। তারপর বলে ম্যাডাম মানুষের এত দুঃখ কেন জানেন?

কেন?

প্রতিটি মানুষ চায়, তারমত করে সবাই চলুক, শুধু কি তাই মানুষরা চায় তাদের খেয়াল খুশি মত প্রকৃতি চলুক। আসলে মানুষরা ভয়ানক স্বার্থপর। প্রচন্ড আত্মপ্রেমী! তাদের মতের বাইরে যা চলে সবি অসহ্য পিড়াদায়ক!

নুসরাত ম্যাডাম তাকিয়ে থাকে জহিরে দিকে। কেন যেন হঠাৎ করেই নুসরাতের মনে হয় তাদের তিন বছরের সংসারটা ভেংঙ্গে যাওয়ার জন্য সেই দায়ী। নুসরাত সব সময় চায় মইন তার ইচ্ছেমত চলুক। আর চলবেই না কেন? মধ্যবৃত্ত মইনকে সেইতো প্রতিষ্ঠিত করে ছিলো সমাজে। জহিরের কথা শোনার পর মনে হচ্ছে আসলে মানুষরা জন্মগত ভাবেই স্বাধীন। তারা স্বাধীন ভাবেই বাঁচতে চায়। নিজের মত করে বাঁচতে চায়। মইন কোথায় আছে, এখন নুসরাত তা জানে না। জানার ইচ্ছে হয়নি কখনো। তীব্র ভালোবাসা তীব্র ঘৃণায় রূপ নিয়ে ছিলো।

জহির আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে বোকা ভেবেছিলাম। এটাও আমার ভুল। আসলে আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের মত করে পৃথিবী দেখি, নিজের বিবেচনাকেই গ্রাহ্য করি।

জহির মিটি মিটি করে হাসে। নুসরাত ম্যাডামের আজ হঠাৎ করেই মনে হয় ছেলেটা অসম্ভব জ্ঞানী!

আমি কি উঠবো?

না। আমার মা আমার জন্য ভূনা খিচুরী রান্না করে পাঠিয়েছে। আমি চাচ্ছি আজ আপনি আমার সঙ্গে বসে লাঞ্চ করেন, আমার খুব ভালো লাগবে।

নুসরাত হাসি মুখে জহিরের দিকে তাকালো। জহিরের বিষণ্ণতা কিছুটা কাটলো। সে খুশি গলায় বললো ম্যাডাম আমি খুব খুশি হয়েছি। বাদল দিন আমার খুব ভালো লাগে। যদিও এমন এক বাদল দিনে আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ বাবাকে হারিয়েছি।

নুসরাত জহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে জহির ছেলেটা আসলেই অদ্ভূত। জহির উঠে দাঁড়ালো। ম্যাডাম কিছু মনে করবেন না। আমি উঠছি।

কেন?

কেন যেন মনে হচ্ছে আজ দিনটা আমার জন্য ভয়াবহ খারাপ যাবে। আমি তার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি। জহির উঠে দাঁড়ালো।

০২.

চলবে.........

বিষয়: বিবিধ

২৮০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File