পুলিশ শিবিরকর্মী সন্দেহে রাস্তায় পড়ে থাকা লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়।
লিখেছেন লিখেছেন তায়িফ ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০১:০৫:০৮ রাত
অভাব-অনটনের সংসার। রাত ফুরালেই খাবারের চিন্তা। ঘরে এক গাদা লোক । আছে স্ত্রী, শিশুকন্যা। অন্যদিকে অসুস্থ পিতা-মাতা। ৩ ভাই আর ২ বোনের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা।
জোড়াতালি দিয়েই ভাগ্যের সঙ্গে জীবনযুদ্ধে নেমেছিলেন আফজাল। কিন্তু তার সব স্বপ্নই যেন মিশে গেছে রাজনীতির কালো থাবায়। এই তো ঘটনার দিন সকালেও হাসিমুখে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি পরিবারের কাছ থেকে।
‘কাজে যাচ্ছি। আজ নাকি হরতাল। রাস্তায় বহুত ঝামেলা হতে পারে।’ স্ত্রীকে বলেই বেরিয়ে পড়েছিলেন কাজের উদ্দেশ্যে। ঠিক ঘরে ফেরার আগ মুর্হূতে চারদিকে শুরু হয় হৈচৈ। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। ঘটনার আঁচ বুঝতে পেরে গাড়ির গ্যারেজ বন্ধ করে গলি দিয়ে বেরুতেই গুলির আওয়াজ। হুমড়ি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন আফজাল হোসেন। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে আনার পথেই তার মৃত্যু হয়।
গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ দেওয়ানহাট এলাকায় পুলিশ ও জামায়াত-শিবিরকর্মীদের মধ্যে সংর্ঘষ ঘটে। এতে নিহত হয়েছেন আফজাল নামের গাড়ির গ্যারেজে কাজ করা ওই শ্রমিক।
নগরীর পাহাড়তলী এলাকার কর্নেলহাটে গিয়ে আফজালের নাম বলতেই আশপাশের লোকজন তার বাড়ি দেখিয়ে দেয়। সেখানে শ’ শ’ মানুষ ভিড়। স্থানীয় নাজির কমিশনারের বাড়ির পাশেই পরিবার নিয়ে থাকতেন আফজাল।
গতকাল হাসপাতাল থেকে তার লাশ ময়নাতদন্তের পর প্রথম নিয়ে যাওয়া হয় শহরের দেওয়ানহাট মোড়ে। স্থানীয় সরাইপাড়া মসজিদের শেষ বাড়িটি আফজালের নানার বাড়ি। ধারণা করা হয়, গতকাল গাড়ির গ্যারেজ বন্ধ করে নানার বাসায় যাওয়ার জন্যই তিনি রওনা হয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখা মেলে পরিবারের সব সদস্যর।
তারা জানান, পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে আফজালকে কাজ নিতে হয়েছে দেওয়ানহাটের ওই গাড়ির গ্যারেজে। প্রতিদিন অসংখ্য ছোট-বড় গাড়ি এখানে আসতো মেরামতের জন্য। আর তিনি মজুরির ভিত্তিতে কাজ করে বাড়ি ফিরতেন।
তার আয়ে চলতো পরিবারের ৯-১০ জন লোকের সংসার! আফজালের রয়েছে বয়সের তুলনায় ছোট ৩ ভাই। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
সেখানে বসেই ভাইয়ের জন্য কেঁদেছে তারা। জানতে চাইলে পারভেজ (১৫) বলে, ‘এক লোক এসে বলেছিল তোর ভাইকে কারা যেন মেরে রাস্তায় ফেলে রেখেছে। এরপর ছুটে এসে দেখি সত্যি। কিন্তু এসে আর ভাইকে পাইনি, তার লাশ পেয়েছি।’
ছোট দুই ভাই ফয়সাল আর ইয়াছিন। জিজ্ঞেস করতেই বলে, ‘অভাবের কারণে ভাই আমাদের পড়ালেখা করাতে পারতেন না। ভাল কোন বই কিনে দিতে পারেননি। এই নিয়ে তার মনে খুব দুঃখ ছিল।’
আফজালের পিতা আমীর আলী। প্যারালাইসিসে অসুস্থ। খাটে শুয়ে আছেন। ঠিকভাবে কথা বলতে পারছিলেন না। আকুতি জানাচ্ছিলেন, ‘বাপ আমারে ছেড়ে কোথায় গেলি। আয় ঘরে ফিরে আয়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তোর মেয়েটা কাঁদছে।’
মা বিবি আকতার বড় সন্তান ঘরে নেই- বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। বলেন, ‘ও আমার বড় ছেলে। অনেক দায়িত্ব ছিল ওর ঘাড়ে। ছোট ছোট ভাইবোনগুলোকে নিয়ে খালি চিন্তা করতো। নিজের বউ আর সন্তান তো আছেই। এখন সব শেষ।’
আফজালের ফুফাতো ভাই সৈয়দ বলেন, ‘ছোট দুই বোন রাবেয়া আর সায়রাকে নিয়ে গাড়ির শ্রমিক আফজালের টেনশন হতো বেশি। পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় তাদের বিয়ের টাকা জমানো নিয়ে টেনশন করতো। সামনে ২২শে ফেব্রুয়ারি পরিচিত এক বন্ধুর সঙ্গে এক বোনের বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। মৃত্যুর আগে সেই কাজটিও নিজের হাতে করে যেতে পারলো না সে।’
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঘটনার পরপরই আফজালকে রক্তাক্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় লোকজন। পরে সেখানে তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। ধারণা করা হয়, নেয়ার পথেই তিনি মারা গেছেন। তবে তার মৃত্যু নিয়ে জনমনে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্তে শক্ত কিছু তার বুকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন। এতেই ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান। স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, ঘটনার সময় পুলিশ দায়িত্ব এড়াতে নিরীহ আফজালকে ধরে ফেলে। এরপর শিবিরকর্মী সন্দেহে পিস্তলের বাট দিয়ে জোরে তার মাথায় আঘাত করতেই সে মাটিতে পড়ে যায়। পরে রাস্তায় পড়ে থাকা লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়।
অন্য একটি সূত্রের ধারণা, শিবিরকর্মীরা এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ ও লাঠি দিয়ে হামলা চালানোর সময় আফজালকে আঘাত করে। হয়তো সেই কারণেই তিনি মারা যেতে পারেন।
ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা ডবলমুরিং থানার ওসি মতিউর বলেন, ‘নিহত আফজালকে কে বা কারা মাথায় আঘাত করে হত্যা করেছে। এই ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এসআই রুহুল আমিনকে।’
source of news
বিষয়: বিবিধ
১২৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন