মুহাদ্দিস আব্দুল মালেক চৌধুরির ইন্তেকাল ও জামায়াতে ইসলামির শক্তি
লিখেছেন লিখেছেন সালাম আজাদী ০৪ অক্টোবর, ২০১৬, ০৩:৪০:৫৮ দুপুর
সিলেট আলিয়ার প্রাক্তন মুহাদ্দিস হাজারো উলামায়ে কিরামের উস্তায আমার প্রিয় শিক্ষক জনাব আব্দুল মালেক সাহেব আজ ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজিঊন। আল্লাহুম্মা আজিরনা ফী মুসীবাতিনা ওয়াখলুফ লানা খায়রান মিনহা।
বাংলাদেশ জামাআতে ইসলামি কে যারা স্ব স্বএলাকায় এবং গোটা বাংলাদেশে জনপ্রিয় করেছেন তার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। এই সংগঠনের প্রথম দিককার দিকপাল দের অনেকের সাথেই আমার দেখা সাক্ষাত হয়েছে, এবং চেষ্টা করেছি তাদের খুব কাছ থেকে, নিজ চোখে দেখে ও তাদের কথা শুনে এই সংগঠন কে জানা ও বুঝার।
মাওলানা আব্দুল মালেক চৌধুরি কে জীবনে প্রথম দেখি ১৯৮৫ সালে, সিলেটে একটা শিক্ষা সফরে গেলে তিনি আমাদের অভ্যার্থনা জানান। খুব কম কথা তিনি বলতেন, হাসিমাখা মুখ ছিলো তা মজ্জাগত, এবং নেয়ার চেয়ে দিতেন বেশী। তার বেশ ভূষা, আচার আচরণ ও সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস হিসাবে কাজ করার কারণে আমার কাছে আল্লাহর খুব কাছের মানুষ হিসেবে খুব ভালো লেগে যায়।
১৯৯৬ সালে মগবাজারে তার সাথে দেখা হয়। তার সংগী ছিলেন সিলেটের অনেক নেতৃবৃন্দ। তখন আমি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাড। আমাকে দেখে ১১ বছর আগের ছাত্র বয়সে চোখে দেখা একজন লোককে তিনি চিনতে পারবেন এ আশা বাতুলতা। কিন্তু সালাম দিয়ে হাত মিলিয়ে পাশে দাঁড়ালে তিনি বললেনঃ আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। পরিচয় দিলাম, চিনলেন, বর্তমানের কাজ সম্পর্কে খবর নিলেন, মুহাদ্দিস গীরি করি বললেন স্মীতহাস্য উপহার দিলেন। সাতক্ষীরায় বাড়ি শুনে কাজি শামসুর রহমান কে কতটুকু চিনি তার পরিধী জানার চেষ্টা করলেন। বুঝলাম, আমি জামাআতের সাথে থেকে উপরে উঠলে তিনি খুশি হতেন।
২০০২ সালে লন্ডন শহরে আসি চাকুরি নিয়ে। জামেয়াতুল উম্মায় মাস্টারি পেশা। থাকার যায়গা পেলাম ক্যাম্পাসের এর ভেতর সুন্দর একটা রূমে। একা থাকতাম। কয়েকদিন পর দাওয়াতুল ইসলামের সেক্রেটারি জনাব বুরহান সাহেব জানালেন আমার রূমে আরকজন মেহমান থাকবেন, বার্মিংহামে ছিলেন, ওখান থেকে এসে তিনি দারুল উম্মায় থাকবেন জানিয়েছেন। মেহমানের নাম বলার সাথে সাথে পুলকিত হলাম এবং উনার মত আলেমে দ্বীনের সাথে দিনরাত কাটানোর আনন্দে আনন্দিত হলাম।
সেপ্টেম্বর এর শেষের দিকে তিনি এলেন। ব্যাগ ব্যাগেজ বলতে তেমন কিছু না। সামান্য জিনিষ পত্র। রূমে জায়নামাজ থাকা সত্বেও তার নিজস্ব কিছুটা ময়লাটে নামাজের বিছানা। নামাজ, কুরআন, দাওয়াতি কাজ, আঞ্জমানে খেদমাতে কুরআনের জন্য কালেকশান ও সারাদিন আল্লাহ নিয়ে ধ্যান করা এই রকম এক লোক দেখে খুব সৌভাগ্যবান মনে হত। উনি থাকা কালীন বহু ভাইদের বাসায় দাওয়াত হত, তিনি দাওয়াত নিতেন বিকেলে যাতে করে আমাকে সাথে নিতে পারতেন।
হাজী আব্দুল মুকিত সাহেব খুব রসিক মানুষ। তিনি আমাকে বললেনঃ আপনি আব্দুল মালিক চৌধুরী সাহেবের কি হন। আমি থতমত খেলাম। বললামঃ আত্মীয় না, তবে উনার কাছে কিছু শেখার চেষ্টা করছি। হাজী সাহেব বললেনঃ আজ আমার বাসায় উনার দাওয়াত। তিনি আপনাকেও দাওয়াত দিতে বললেন। আপনি নাকি তার আত্মীয়।
জামায়াতের দীর্ঘ ইতিহাসের সিলেট পার্ট আমার তেমন জানা ছিলোনা। বিশেষ করে ৭২-৭৫ সালে কিভাবে আলকুরআনের মাধ্যমে তিনি এই সংগঠন কে উজ্জীবিত করে রেখেছিলেন তার খবর শুনালেন। কারা কারা তখন কাজ করতেন তার একটা ধারণা দিলেন। খুব মজার তথ্য শুনিয়ে ছিলেন দেওয়ান মুহাম্মাদ আজরাফ কিভাবে ইসলামের দিকে এসেছিলেন। সিলেটের বর্তমান প্রজন্মের অবস্থা সামনে নিয়ে আসলেন। আনন্দিত হলাম। সব্যসাচি দায়ীইলাল্লাহ ছিলেন তিনি।
উনি আসার দ্বিতীয় রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল কিসের একটা শব্দে। উঠলাম এদিক ওদিক তাকালাম, আমার রূমের দরোযা খুলে বের হলাম, দেখলাম অন্ধকারের মধ্যে একজন মানুষের দুয়ার সময়ে কান্নার ধ্বনি। সে কি কান্না, আর নিজের জীবনের পাপের জন্য ক্ষমা চাওয়ার আকুল নিবেদন। যে দু সপ্তাহ ছিলেন আমার সাথে, প্রতিটি রাতের ঐ ক্ষণটাই ছিলো আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়।
জামাআতের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের সম্পর্কে তিনি কথা বলেছেন। নেগেটিভ কথা উনি জানতেন বলে মনে হয়নি কোনদিন। তিনি আমার একটা আলোচনা শুনেছিলেন দারুল উম্মাহ মসজিদে। তিনি ছিলেন প্রধান অতিথী। রাতে এসে পানি দিচ্ছি হাতে। তিনি জামা খুলে আমার কাছে দিলেন। আমি রেখেদিলাম। তিনি বললেনঃ সাতক্ষীরার কাজি শামসুর রহমানের কথা খুব মনে হচ্ছে এখন। কাল তাকে একটা ফোন দেব ভাবছি। আপনার আলোচনা শুনে তার মতই মনে হয়েছে।
লজ্জাপেলাম। তার মুখের ভাষায় বুঝলাম তিনি কিছু গল্প শুনাবেন। আমি বসলাম। তিনি মাফ্লার জড়ালেন গলায়।
“জানেন, যতবার এমপি ইলেকশান হত, আমীরে জামাআত জিজ্ঞেস করতেন এবারের নির্বাচনে কেন্দ্র থেকে এক টাকাও না নিয়ে কে নির্বাচন করতে পারবেন। আমি দেখতাম মাথায় জিন্নাহ ক্যাপ, আমার মত চেকনা, এবং শাদা শুভ্র দাড়ির এক মূর্তি দাঁড়িয়ে যেতেন। বলতেন আমি পারবো ইনশাআল্লাহ। আর সব ক’ বারেই তিনি বিপুল জয় নিয়ে এম পি হয়ে আসতেন আমাদের মাঝে। তিনি হলেন আপনাদের কাজী শামসুর রহমান।“
শেষে বললেনঃ আজাদী সাহেব, যত গুলো শুরার বৈঠক হয়, তার সর্বশেষ একটা বক্তব্য কাজী শামসুর রহমানের থাকতো। তিনি কাঁদতেন, কাঁদাতেন, সাহাবী (রা) গণের জীবেনর কাছে নিজদের টেনে নিয়ে যাবার প্রত্যয় নিয়ে আমরা স্ব স্ব জেলার দিকে রওনা হতাম।
মুহাদ্দিস সাহেব ২০০২ সালে আনজুমানের জন্য লন্ডন এসে ছিলেন। থাকার জন্য যায়গা বরাবরের মত হয়নি। তিনি খুব বড় একটা যায়গায় থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাড়া পাননি। তিনি কিছুটা অপাংক্তেয় হয়ে গিয়েছিলেন তার সতীর্থ অনেকের কাছে।
জামাআতে ইসলামিতে শক্তির উৎস সম্পর্কে তিনি যেসব তথ্য দিয়েছিলেন তার মধ্যে ১০০% তার মধ্যে দেখেছি। রাতের শেষভাগে তার ভেজা ভেজা জায়নামাজে দেখেছি। আর অন্তর থেকে বলা কথার মধ্যে দেখেছি। ঐ দৃশ্য গুলো আমি বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে দেখেছি, যারা ইন্তেকাল করেছেন কিংবা শহীদ হয়েছেন।
কয়েকটি বই লিখেছেন তিনি। ঈমানের ৭৭ টি শাখার লেখা বই টা আমার জানা মতে বাংলা ভাষায় বেশ সুন্দর লেখা।
আজ আমার এই প্রিয় মানুষটি নেই। কাল ৩/১০/২০১৬ সোমবার বিকেলে তিনি আমাদের ছেড়ে আল্লাহর কছে বিদায় নিয়ে গেলেন। ভাসিয়ে গেলেন শোকের সাগরে। দিলের এই গোঙানি, চোখের এই অশ্রু এবং হাজার মানুষের ভালোবাসায় ধন্য মুহাদ্দিস আব্দুল মালিক চৌধুরী। আল্লাহ তাকে জান্নাতের অনেক উঁচুতে তার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের সাথে স্থান করে দিন।
বিষয়: বিবিধ
১৫৬২ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বাস্তব স্মৃতিচারণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে অন্তর থেকে উদ্গত কথাগুলো হৃদয় ছুঁয়ে গেল। মহান দয়ালু এই দ্বিনি আলেমের সকল মহতী কার্যক্রম কবুল করে নিয়ে জান্নাতের উচ্চ মাকামের মেহমান করে নিন এটাই প্রার্থনা।
আল্লাহ পাক উনাদের ক্ষমা করে জান্নাতের সূউচ্ছ স্হান দান করুন ।
উনাদের দ্বীনের এই খেদমত আল্লাহ কবুল করুন।আমিন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন