সাহাবী গাছ নিয়ে সংশয়

লিখেছেন লিখেছেন সালাম আজাদী ২৫ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৮:০১:৫৯ রাত



Pistacia atlantica এক ধরণের গাছ, আরবীতে একে ‘আলবাতাম’ বলা হয়। মুরব্বিরা একে ‘শাজারাতুল হায়াত’ বা জীবন বৃক্ষ নামেও ডেকে থাকে আরব দেশগুলোতে। কারন আমাদের দেশের বট বৃক্ষের মত এই গাছ গুলো খুব দীর্ঘজীবী হয়ে থাকে। মরুভূমি এলাকায় এই গাছের আধিক্যও রয়েছে। তবে এর ই একটা গাছ নিয়ে আমাদের ব্লগ জগতে, ফেইস বুকে খুব বেশি লেখা লেখি হয়ে থাকে। একে বলা হচ্ছে সাহাবী গাছ।

জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে আলআযরাক্ব ও আলসাফাওয়ী শহর দ্বয়ের মাঝে আলবাক্বীয়াওয়িয়্যাহ নামক কন্টকাকীর্ণ স্থানে এই গাছটি অবস্থিত। আলমাফরিক শহর থেকে যায়গাটি ৯০ কি মি দূরে। গাছটির ছায়া ৫০ মিটার পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে যায়, মূল টার ব্যাস ৯০ মিটার, উচ্চতা ১১ মিটার এবং ২৮৩ বর্গ মিটার যায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি।

জর্দানের আলমাফরিকের প্রত্নতত্ববীদ ডঃ আব্দুল কাদির হাসান এই গাছটির বয়স ১৪৫০ বছর বলে উল্লেখ করে বলেছেন, এই রাস্তা দিয়েই আমাদের নবী (সা) ১২ বছর বয়সে সিরীয়ায় ব্যবসায়ের জন্য গিয়ে থাকবেন, এবং এই গাছটি ই হয়ে থাকবে সেই পবিত্র গাছ, যার ডাল পালা নুইয়ে পড়েছিলো মহানবীর (সা) সম্মানে। এবং আমাদের নবী (সা) তার নীচে ছায়া নিয়েছিলেন। আর তা দেখেই নাকি বাহীরা নামক পাদ্রী ধরে নিয়েছিলেন ইনিই হবেন যামানার শেষ নবী।

গল্পটা যে সত্যি তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই গাছের যায়গাটা কোনটি ছিলো, এ নিয়েই বেঁধেছে যত গোল।

ডঃ আব্দুল কাদির হাসানের সন্দর্ভটা বের হয় ২০০২ সনে।



সেখান থেকে বিষয়টা কানাঘুষা শুরু হয়। এবং ১৭/৯/২০০৯ এ আমূনে এই তথ্যটা প্রকাশিত হয়, ছড়িয়ে পড়ে অনলাইনে। সেখান থেকেই শুরু হয় অনলাইন এক্টিভিস্টদের হুড়মড়িয়ে পড়া, এবং ভেসে বেড়ায় ফেইসবুকের লাইকস, স্ট্যাটাস, এবং শেয়ারের স্রোতে। এটা দেখা দেয় টুইটারের প্রতি সেকন্ডের টুইটে, কিংবা বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কে। এর পরে কে আর শোনে কার কথা। সাহাবা গাছের বরকত যেন আর শেষ হচ্ছেনা।

আমি জর্ডানে ভ্রমন কালে এই গাছের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম ওখানের প্রত্নতত্ব বিষয়ের সাথে পরিচিত এক আলীমে দ্বীনের কাছে। তিনি আসহাবে কাহাফের মাসজিদের গবেষক এবং খাতীব। তিনি হেসে বললেন এগুলো সব ‘তাখমীন’ এসাম্পশান, তথা ধারণা প্রসুত।

২০০২ সালে ডঃ আব্দুল কাদিরের গবেষণা প্রকাশ হওয়ার পর অনেকেই এর প্রতিবাদ করেছেন। বিশেষ করে ইতিহাসবীদ ও গবেষক, জর্ডানের রয়্যাল জিওগ্রাফিক সেন্টারের গবেষণা উপদেষ্টা প্রফেসর ইবরাহীম মূসা আযযাকারতী এর বিপরীতে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন শেকড় সন্ধানি লেখক হানি আলআযীযী।তাদের যুক্তি গুলোর সার সংক্ষেপ হলোঃ



১। কোন অথেন্টিক ঐতিহাসিক বিশেষ করে ইবনে হিশাম ও তাবারী উল্লেখ করেননি এই গাছটি যে বাকুয়াওয়ীয়্যাহ তে ছিলো। কেও বলেন নি আমাদের নবী (সা) এই রাস্তা দিয়ে যেতে পারেন। আধুনিক প্রত্নতত্ববীদদের অনুমানের উপর ভিত্তি করে এতবড় একটা ঐতিহাসিক বিষয় প্রমান করা যায়না।



২। ইবনে বতূতা তার ‘রিহলাহ’তে উল্লেখ করেছেন তিনি সিরিয়ার বুসরা তে একটা মাসজিদ দেখেছেন, যেখানে আমাদের নবী (সা) সিরিয়ায় ব্যবসার জন্য যাওয়ার রাস্তায় থেমে ছিলেন। এখানেই বাহীরার সাথে তাঁর দেখা হয়েছিলো। তিনি উল্লেখ করেছেন এখানে সে সময় একটা গীর্যা ছিলো, এবং সেখানে তখনো ছিলো খৃষ্টান পাদ্রী সহ এই ধর্মের অনুসারিরা। আর এই বুসরার নাম বিভন্ন ভাবে সীরাতে এসেছে। কাজেই জর্ডানে মাফরাক্বে হবার সম্ভাবনার চেয়ে সিরিয়ার বুসরায় হবার নিশ্চয়তা বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

৩। ইতিহাসে বুসরা শহর হয়ে যে রাস্তাটা হাজ্জ রুট কিংবা ইয়েমেনের রুট হিসাবে পরিচিত, তার যাত্রা পথে বাকুয়াওয়ীয়্যাহর কোন উল্লেখই কেও করেনি। তাছাড়া বুসরা থেকে যে রুট হাজ্জের জন্য ব্যবহার হতো, তা ছিলো সরল ও সোজা। কেন মানুষ সেই সুন্দর রাস্তা ছেড়ে এই পাহাড়ীয় কন্টকাকীর্ণ পথ বেয়ে সিরীয়ায় যাবে, তার কোন সদুত্তর নেই। ফলে আব্দুল কাদির সাহেবের ধারণা সে সময়ের অবস্থা দ্বারা নিরূপিত হয়না।

৪। আযযাক্বারতি জর্ডানের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আরেকটি ফাইলে পাওয়া এই গাছটির প্রত্নতাত্বিক আরেকটি সামারির কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে স্পষ্টতঃ উল্লেখ আছে যে গাছটির মূল থেকে প্রাপ্ত পরীক্ষা অনুযায়ী এর বয়স ৫২০।কাজেই ডঃ আব্দুল কাদির কিভাবে ১৪৫০ বানালেন তা স্পস্ট নয়।

আযযাকারতির আর্টিকেল টা অনেক লম্বা, এবং ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক দলিলাদী ও বিভিন্ন অনুসন্ধান দিয়ে ঋদ্ধ। যাতে খুবই জোরালো ভাবে ডঃ আব্দুল কাদির সাহেবের প্রপঞ্চকে দূর্বল করে দেয়। যেহেতু ইবনে হিশাম ও তাবারী সহ অন্যান্য ইতিহাসবিদ দের লেখায় বুসরার কথা বারবার এসেছে, সেহেতু জর্ডানের মাফরাকের নিকটবর্তী এই যায়গাটাকে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে সাহাবী গাছের বাসস্থান রূপে চিহ্নিত করার কোন যৌক্তিকতা আছে বলে আমার মনে হয়না।

তাছাড়া সাহাবী বলতে কিন্তু জিন ও ইনসানের বাইরে যাওয়া যায়না। একজন কে সাহাবী হতে হলে তাকে আমাদের নবীকে ঈমানের অবস্থায় দেখতে হবে, ঈমানদার অবস্থায় যদি সে মৃত্যু বরণ করে তা হলে তাকেই সাহাবী বলা হবে। যদি এই গাছ কে আমরা সাহাবী গাছ বলি, তাহলে মক্কার অনেক পাথরকেও সাহাবী পাথর বলতে হয়। কারণ তারা তো আমাদের নবী (স) কে জোরে জোরে সালাম দিত। অন্যদিকে চাঁদকেও সাহাবী বলতে হয়, কারন আমাদের নবীর (স) আদেশে একদা সে দুই টুকরাও হয়ে গিয়েছিলো।



আসলে আমাদের মধ্যে বস্তুপূজার অনেক জিনিষ আজ অবলীলায় ঢুকে পড়েছে। তাই সাহাবী গাছ, সাহাবী শাপ, সাহাবী জিন ইত্যাদি নিয়ে আমরা এত ব্যস্ত যে, নিজেদের কে সাহাবীদের (রা) মতো রাসূল (স) প্রেমিক বানাতে সব সময় দেখা যায় অনীহা। আমি আজ সাইয়িদুনা উমাররের বাইয়াতুর রিদওয়ানের স্মৃতি বিধৌত গাছটাকে কেটে ফেলার মর্ম উপলব্ধি করি। এই গাছটির কথা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। একবার উমার (রা) দেখতে পেলেন কিছু মানুষ এই গাছের কাছে যেয়ে বরকত নিচ্ছে। তিনি মানুষের বস্তু পুজার এই উদগ্র বাসনা বুঝতে পারলেন। নির্দেশ দিলেন কেটে ফেলার। একবার এই উমার (রা) ‘হাজার আসওয়াদের’ মত জান্নাতি পাথরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ ‘ইয়া হাজার, ইন্নী আ’লামু আন্নাকা লা তানফা’উ ওয়ালা তাদুররু, লাওলা আন রায়াইতু রাসুলাল্লাহ ক্বাব্বালাক, মা ক্বাব্বালতুকা আবাদা’ হে পাথর, আমি জানি তুমি উপকার বা ক্ষতি কোনটাই করতে পারো না। রাসূল (সা) তোমাকে চুমা দিতে না দেখলে, আমিও তোমাকে কখনোই চুমা দিতাম না। আমি আশা করি এই ধরণের অনলাইনে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা যেন সংশয়িত না হই।



বিষয়: বিবিধ

৬৭৭৯ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

167447
২৫ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৪১
জেদ্দাবাসী লিখেছেন : বিষয়টি তথ্য দিয়ে পরিষ্কার করার জন্য আপনাকে আন্তরিক মোবারকবাদ। আমি কখনো লাইক দিইনাই, আমার কাছে বিষয়টি ভুঁয়া মনে হয়েছিলো তবে গাছটা দেখতে যথেষ্ট সুন্দর ।

মদিনার জ্বিন ওয়াদির ব্যপারে জানতে চাই, যদি আপনার জানা থাকে।
সচেতন মুলক পোষ্টের জন্য আবারও ধন্যবাদ।

যাজ্জাকাল্লাহ খায়ের



এটা মনে হয় সবচেয়ে বড় গাছ।
ছবি ফেসবুক থেকে


২৬ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৬:০৫
121605
অনুরণন লিখেছেন : ওয়াদি আল জ্বিন যায়গাটা একটা 'গ্রাভিটি হিল'।
সেখানে এক ধরনের অপটিক্যাল ইল্যুশন তৈরী হয়। কাছাকাছি একটা কনসেপ্ট এই ভিডিওটাতে পাবেন। http://www.youtube.com/watch?v=hCV2Ba5wrcs
167471
২৫ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০৯:১৫
সিকদারর লিখেছেন : নেটে আসলে কোন কিছু বিশ্বাস করা উচিৎ না । আপনার তথ্য বহুল পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ।
167508
২৫ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০৯:৫১
আলোকিত ভোর লিখেছেন : ধন্যবাদ Rose
167532
২৫ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:৩৭
গেরিলা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ পিলাচ
167552
২৫ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১১:০০
ইমরান ভাই লিখেছেন : some days ago i see one video from one of my college about this tree. on that time i was confused about now its clear to me.
Thank you Shaikh.

ZazakAllah Khairan..
167631
২৬ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০২:৩৯
তারাচাঁদ লিখেছেন : জ্বী শায়খ, আপনার পোস্টের অপেক্ষায় ছিলাম । এই ব্লগে, এ বিষয়ে ক্লারিফিকেশেনর যোগ্য মানুষ আপনিই । জাজাকাল্লাহু খাইরান কাছিরান ।
168200
২৬ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ১১:৪৫
জবলুল হক লিখেছেন : অতি মূল্যবান একটা লেখা। ভালো লাগলো পড়ে।ধন্যবাদ আপনাকে।
169386
২৯ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৬:২১
প্যারিস থেকে আমি লিখেছেন : চমৎকার একটি পোষ্টের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
169440
২৯ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:৩৪
আহমদ মুসা লিখেছেন : ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক ওয়েব সাইটে এই গাছটি নিয়ে ব্যপক আলোচনা ও হৈ চৈ দেখা যায়। অনেকে ঈমানী চেতনার! আতিসহ্যে হয়ে অনেক মন্তব্যেও করতে দেখা যায়। কিন্তু একটিবারও চিন্তা করে দেখার প্রয়োজনবোধ করে না এই গাছটির তথ্যবিত্তিক ইতিহাস কি? ড. আব্দুস সালাম আজাদী স্যারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি একটি তথ্যবিত্তিক লেখা উপহার দিয়ে বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য।
বছর দু'য়েক আগে মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের একটি লেখা থেকে মদিনায় ওয়াদিউল জিন্ন নামক স্থানের কিছু বৈশিষ্ট্য শুনেছিলাম। গত বছর পবিত্র ওমরাহ পালনের সুযোগ হলেও ইচ্ছা থাকা সত্বেও ওয়াদিউল জিন্ন এলাকাতে যাওয়ার সুযোগ হলো না। আমি বেশ কয়েকজন সৌদিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সেই স্থান সম্পর্কে কিছু জানে কিনা। তাদের মধ্যে এ বিষয়ে তেমন সঠিক জ্ঞান আছে বলে মনে হলো না। মদিনায় একজন সৌদি টেক্সি ড্রাইভার থেকে কিছুটা ভাসা ভাসা ধারণা পেলেও মনের তৃপ্তি মেটানোর মত কিছুই জানতে পারলাম না। সম্ভব হলে এ বিষয়ে কিছু লিখলে অনেকের মত আমিও জানতে পারবো নতুন কিছু।
১০
193033
১৬ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:১০
মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আসাদুল ইসলাম লিখেছেন : জাজাকাল্লাহু খাইরান।


১১
193040
১৬ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২০
বিডি রকার লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে .... Happy

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File