মাওলানা আবুল কালাম আযাদের ফাঁস লেগেছে ইসলামি জিজ্ঞাসার গলায়

লিখেছেন লিখেছেন সালাম আজাদী ২২ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৮:১২:০৯ সকাল



এখন আর সন্দেহ নাই মাওলানা আবুল কালাম আযাদকে বাংলাদেশে ফাঁস নিতে হবে। কারণ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার প্রথম শর্ত হলো তাঁকে হাজিরা দিতে হবে স্বশরীরে, প্রার্থনা করতে হবে আপীলের, আত্মসমার্পন করতে হবে ট্রাইবুনালের কাছে। যার কোনটা ও মাওলানা আযাদকে দিয়ে করানো যাবেনা। কারণ তিনি ধরা দেয়ার জন্য পালান নি। পালায়েছেন একটা সিদ্ধান্তের কারণে। সে সিদ্ধান্ত হতে পারে তার কোন কল্যানকামীর পরামর্শে, অথবা তার নিজের ইচ্ছায় কিংবা সরকারের কোন যোগসাজসে। তাছাড়া ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে এবং আপীলের পক্ষে দাঁড়াবার প্রয়োজন আপীল বিভাগ মনে করবে বলে আমার মনে হয় না।

এই ফাঁসির রায় প্রদানের বেশ আগে থেকেই বাংলাদেশের যে কোন ব্যক্তি রায়ের মেইন বিষয় বুঝে যাওয়ার কথা। এমন কি বিচারপতি যে রায় লিখেছেন, এবং পড়ে শুনিয়েছেন তা একজন মূর্খ লোকেও আগে বুঝে গিয়েছিল। বিশেষ করে মাওলানা আজাদ যেভাবে পালালেন তাতে বেশ কিছু ধাতব মন্তব্য ব্লগারদের বিভিন্ন লেখায় আমরা পড়েছি, কিছু বায়বীয় কারণ ও আমরা লিখিত দেখেছি। কয়েক বছর ধরে যে মাওলানা সাহেব সরকারের ক্লোজ সার্কিটের আওতায় ছিলেন, ওয়ারেন্ট ইস্যুর একদিন আগেও যিনি বাসায় ছিলেন বলে তার বাড়ীর আসে পাশে থাকা সরকারি বিভিন্ন বাহিনী বলেছে। সেই দীর্ঘদেহী, রংগীন দাড়ির মাওলানা সাহেব কিভাবে বাড়ি থেকে পালায়ে গেলেন তা রীতিমত সপ্তাশ্চর্যের একটি বলে একবিংশ শতাব্দিতে গণ্য হতে পারে।

পালায়ে যাওয়ার পর তার বড় ছেলে ও শ্যলক কে ধরে ভীষণ প্রহার করে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। উদ্দেশ্য মাওলানা সাহেব কোথায় গিয়েছেন তার সন্ধান লাভ করা। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককেও সেই লিংক্সএ ধরে রিম্যান্ডে নেয়ার খবর ও আমরা জানি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে জানতে পারলাম না মাওলানা কোথায় গেলেন, কিভাবে গেলেন, কেন গেলেন, কার সাহায্যে গেলেন তার কোন হদিস। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা সমূহ, কিংবা সরকারের সহযোগী অন্যান্য রাস্ট্র ও সংস্থা সমূহ এত বোকা ও দূর্বলতার পরিচয় দিলেন কেন -সেও এক গবেষণার বিষয় হতে পারে।

মাওলানা সাহেব দৃশ্যত পালায়েছেন। কোথায়, কিভাবে, কখন, কার মাধ্যমে তা যেমন অনুক্ত রয়ে গেল, তেমন অজানা থাকলো তিনি কোথায় আছেন। আমার জানামতে আজাদ সাহেবের কোন নিজস্ব বিমান ছিলোনা, হেলিকপ্টার বা চার্টার বিমান কিছুই না। আমাদের সীমান্ত পাহারায় বাংলাদেশী ফোর্স তত শক্তিশালী না হলেও, বি এস এফ এর নয়ন বা চক্ষু বা দৃষ্টি ভেদ করে এত বড় হুজুর তো দূরের কথা আমাদের কিশোরী বোন ফেলানী্র ও সীমানা ক্রস করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা থেকে ভোমরা, বেনাপোল, রাজশাহি, সিলেট, লালমনির হাট, আগরতোলা, রংপুর দিনাজপুর, চিটাগাং, হিল্ট্রাক্স বা যে কোন সীমান্ত দিয়ে পালাতে গেলে পুলিশ কে ফাঁকি দেয়া যায় হয়ত টাকায়; ট্রাফিকের চোখ বন্ধ করা যায় বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়ায়; এন এস আই, ডী জি এফ কে কেনা যদিও সম্ভব হয়; কিন্তু আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, যুবলীগ, উলামালীগ ইত্যাদির চোখকে তিনি কিভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারলেন তা স্বপ্নেও ভাবতে পারছিনা। এখন শুনছি তিনি পাকিস্তানে আছেন। তাকে পাকিস্তানে যেতে ভারত সাহায্য করলো তাহলে, না হলে তিনি ওখানে গেলেন কি করে?

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির সাথে মাওলানা সাহেবের সম্পৃক্ততা নিয়ে কারো সন্দেহ নাই। তার মত একজন তুখোড় বক্তা, ইসলামি পন্ডিত, এবং ব্রিলিয়ান্ট মানুষকে দিয়ে জামায়াত অতীতে অনেক উপকৃত হয়েছে তা অস্বীকার করলে বিরাট জুলুম হবে। যে সব বক্তা ইসলামি রাজনীতিকে ৭৫ উত্তর বাংলাদেশে প্রতিস্থাপন করেছেন, তিনি হলেন তাদের একদম প্রথম সারিতে। সেই উপকারী বন্ধুটির কিভাবে ফাঁসির অর্ডার হলো তা জামাআত শিবির, জামায়াতের আইনজীবি প্যানেলের সমস্ত সদস্য, তাকে ভালোবাসে এমন হাজারো নারী পুরুষ নিরব দর্শকের মত চেয়ে চেয়ে দেখলো। তার পরিবারের সদস্যরাও এগিয়ে এলোনা এই মানুষটাকে ফাঁসির অর্ডার থেকে রক্ষা করার জন্য। বাংলাদেশের মিছিল মিটিং এ জামায়াত শিবির যেসব ছবি দেখায়ে তাদের বিচার প্রহসন নিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে, সে সবের মধ্যে মাওলানা আযাদের ছবি তো নেইই, তার কথা একবার ভুল করেও তারা উচ্চারণ করেনি। এটা আমার কাছে মনে হয়েছে ইসলামের ইতিহাসে যেন নতুন ঘটলো। এতবড় একজন আলিম কে হত্যাকারী, ধর্ষক এবং মানব সভ্যতা বিরোধী প্রমানিত করে ফাঁসির অর্ডার দেয়া হল, আর গোটা মুসলিম মিল্লাত চুপ হয়ে গে্ল, এ দেখে আমি দারুন ভাবে সন্দেহে পড়ে গেছি।

১৯৭১ সালে তিনি রাজাকার ছিলেন কিনা তা আমার জানার কথা নয়। তবে তিনি টিভি প্রোগ্রামে জনপ্রিয়তা লাভের পরেই রাজাকার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন গণমাধ্যমে। তিনি জামায়াতে ইসলামির রুকন ছিলেন, বড় ধরণের দ্বায়িত্ব ও তার ছিলো। বাংলাদেশ মাসজিদ মিশনের সেক্রেটারি হিসেবে অনেকদিন দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। অবশ্য তিনি একাধিকবার জামায়াতের রুকনিয়াত হারিয়েছেন বলেও শুনেছি। পরে অনেক বছর যাবৎ তিনি আন্তঃধর্ম ডায়ালগের প্রধান হিসেবে কাজ করতেন, এবং এর জন্য সারা বিশ্বের বিভিন্ন আন্তঃধর্ম সংস্থা সমূহের আস্থাভাজন হিসেবে গণ্য হয়েছেন। ফলে জামায়াতে ইসলামি বলয় থেকে তিনি যেমন সটকে পড়েছিলেন, তেমন ভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি থেকেও কিছুটা ডীটাচড ছিলেন। তবে তিনি আমেরিকার খুব বিশ্বস্ত হয়ে উঠছিলেন বলে একাধিক জামায়াতি আলেমের মুখে শুনেছি। এই সমস্ত কারণে তিনি দেশের ভেতর থেকে কারও ব্যক্তিগত সাহায্য না পেলেও, জানে বেঁচে থাকার জন্য হয়ত বাংলাদেশ অথবা অন্য কোন সরকারের বড় ধরণের সাহায্য পেয়ে থাকবেন।

মাওলানা আজাদ এর বিচার প্রক্রিয়া যে অবিশ্বাষ্য দ্রুততায় শেষ করা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে আশ্চর্যজনক। গত বছরের নভেম্বর থেকে বিচার কাজ শুরু করে আজ ২১শে জানুয়ারী তার বিচারের রায় পড়ে শুনানো হলো। বিচারক, প্রসিকিউটার টীম, ও ডিফেন্সের ‘স্টেইট কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত’ আইনজীবির কাজের ধরণ দেখলে বোঝা গেছে এই ট্রাইবুনালের আর সব আসামী থেকে তিনি সম্পূর্ণ আলাদা এবং অন্যসব কেইস থেকে তার কেইস ভিন্ন। আজকের বিচারের রায়টা পত্র পত্রিকায় পড়ে আমার সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠেছে। ১৯৮৯ সালে আমি তখন কিং সাঊদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে সময় ইরাণের কয়েকজন তথাকথিত সন্ত্রাসীর শীরোচ্ছেদ অনুষ্ঠান রিয়াদে জাতীয় মসজিদের সামনে দেখেছিলাম। এদেরকে যখন শীরচ্ছেদ করা হয় সবাই ছিলো উপবিষ্ট। কেও জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টা টুকুও করছেনা দেখে আমি খুব সনদিগ্ধ হয়ে পড়লাম। পাশের একজন কে কারণ জিজ্ঞেস করলে জানলাম ওদের শরীরে এমন ইঞ্জেকশান করা হয়েছে যাতে তারা একদম চলৎশক্তি রহিত। মাওলানা আবুল কালামের ফাঁসি রায়ের কার্যক্রমটা ঠিক ওই রকম মনে হয়েছে। তিনি যেন সবাইকে বলেই দিচ্ছেন আমি ফাঁসিতে যাচ্ছি আপনারা কিছু বলবেন না। অথবা কেও যেন বলছে, “আমরা তাকে ফাঁসি দিচ্ছি, তাকে নিয়ে আপনারা কিছু বলবেন না, তার পক্ষে সাক্ষী দিবেন না, তার জন্য আইনজীবি আনবেন না, এমন কি তার জন্য নির্ধারিত ডীফেন্স ল’ইয়ার কেও কোন ব্যক্তি সাহায্য করবেন না”। এ এক বিশাল ধাঁধাঁ, জীবনেও এর ভেদ আমি বুঝব বলে মনে হচ্ছেনা।

যাকগে ঐসব কথা, বিচার হয়েছে, রায় ও দেয়া হয়েছে সম্পূর্ণ রূপে বিচারকগণ যা বুঝেছেন তার উপর ভিত্তি করে। কাজেই তা নিয়ে আমার কোন কথা নেই। কিংবা কথা থাকাও উচিৎ নয়। জীবনে আইন কানূন বুঝিনি, কোর্ট পাড়ায় যাইনি, কিভাবে বিচারিক প্রক্রিয়া চলে তাও দেখার সুযোগ আমার ৪৫ বছরের জীবনে হয়নি। কাজেই তার বিচার বিষয়ে আমি বললে সেটাও হবে মারাত্মক অন্যায়। তবে মাওলানা আজাদের রায়ে জামায়াত কে একক ভাবে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে বর্ণনা করার অনুষংগ যেমন আমি বুঝলাম না, তার প্রসংগে রায় দিতে আলী আহসান মুজাহিদের নাম ও কেন আসলো সেটাও আবোধগম্য থেকেই গেল।

আমি ১৯৮৫ সালে যখন ইন্টারমেডিয়েটের ছাত্র, মাওলানা আজাদ কে প্রথম দেখি ঢাকার একটা ওয়াজ মাহফিলে। তার বক্তৃতা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে আমার কাছে তেমন সহজবোধ্য মনে হয়নি। কারণ তার দার্শনিক সুলভ আলোচনা ও অত্যন্ত উচ্চ মার্গের ভাষার ব্যবহার আমার পক্ষে বোঝা দুস্কর ছিলো বৈকি! পরে আরকানুল্লাহ হারুনীর উপস্থাপনায় একটা বেসরকারি টিভি তে তিনি যখন প্রশ্নোত্তর দেয়া শুরু করেন, তখন মানুষ বুঝলো আবুল কালাম আজাদ কাকে বলে। তার অনুষ্ঠান ছিলো বাংলাদেশের সব চেয়ে জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠানের একটা। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমের তিনি সঠিক ইসলামের যে রূপরেখা তুলে ধরতেন, তা ছিলো কয়েকটি বৈশিষ্ট্যে ভরপুর। তিনি সব সময় দলীল ভিত্তিক কথা বলতেন, ফলে অনেক বিষয়ে কোন মাযহাবী গন্ডিকে পাত্তা দিতেন না। এতে সঠিক ইসলামের দিকে মানুষের যাত্রা বাড়তে থাকে। তিনি খুব নির্ভিক ভাবেই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। অতএব শিরক বিদাআৎ, ইসলামি রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক সমান ভাবে চলে আসতো তার আলোচনায়। ফলে মিঠা ইসলামের ধ্বজাধারীরা, কবরপূজকেরা, বিদআতের প্রসারকামীরা এমনকি পীরপন্থীদের অনেকেই তার বিরোধী হয়ে যায়। যে ক’দিন দেশে ছিলাম তার বেশ কিছু অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ আমি পেয়েছি। দেখতাম তিনি বর্তমান বিশ্বের মতবাদ সমূহের কড়া সমালোচনা করতেন খুব ই উন্নত ভাষায় ও দার্শনিকতায়। তাতে বাংলাদেশে ইসলাম প্রসারে ভীত বুদ্ধিজীবিদের মারাত্মক চক্ষুশুলে পরিনত হন তিনি। এটিএন বাংলা থেকে তাকে তাড়ানোর প্রেক্ষাপট ও যুক্তি গুলো দেখলে ও শুনলে আমার কথার সত্যতা পাওয়া যাবে।

বিচারের রায় দেয়ার পরবর্তিদিন গুলো হবে দারুণ দারুণ চমক দেখার সময়। পত্র পত্রিকা জুড়ে ‘বাচ্চু রাজাকার’ নিয়ে লেখা হবে রগরগে হেডিং। তাকে খোঁজা হবে টয়লেট থেকে শুরু করে রাজভবন পর্যন্ত। ইন্টারপল থেকে শুরু করে এফবি আই বা সি আই এ কে নিয়োগ দেয়া হতে পারে তাকে বের করার জন্য। র’ আর মোসাদ হয়ত নির্লিপ্ত থাকতে পারে, কিন্তু তাদের কাছেও ধর্ণা দেয়া হতে পারে। যাই হোক না কেন, তার বিচারের রায় শোনার পর আমার মনে হয়েছে তাকে ফাঁসি দিলেও বাংলাদেশে মারাত্মক কিছু হবেনা। কেও মনে হয় উচ্চ বাচ্য করবেনা। ধরা পড়লে তাকে ফাঁসিতে ঝুলায়ে মেরে ফেললে হয়ত তার কবরেও জুতা মারা হতে পারে। কিন্তু তাকে পরানো ফাঁসির দড়িটা আমার মনে হচ্ছে ‘আপনার জিজ্ঞাসা’ নামক ইসলামি প্রোগ্রামকেই যেন পেঁচিয়ে মারতে যাচ্ছে।

বিষয়: বিবিধ

৫৪৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File