এসো গান শিখি ( ১ম পর্ব )
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ১০ আগস্ট, ২০১৫, ০৮:২৮:১৮ সকাল
খালামণি : কেমন আছো তোমরা সবাই ?
সবাই (বাচ্চারা) : স্লামালেকুম খালামণি; আমরা ভাল আছি।
খালামণি : খুব ভাল; মিঠু-মন্টি কেমন আছো ? মন্টি কোথায়! দেখা যাচ্ছে না কেন !
https://www.youtube.com/watch?v=U8Pir2P_jko
https://www.youtube.com/watch?v=_V4xoaGHsXE&html5=1
মিঠু-মন্টি : খাঁলামনি, এই যে মন্টি ; স্লাঁমালেকুম । আঁমরা ভাল আছি । আঁপনাকে খুব সুন্দর লাঁগছে খাঁলামনি।
খালামনি : আচ্ছা, আর দুষ্টুমি নয় । আজকে আমরা সব পুরোন গানগুলো ঝালাই করব । দেখি কেমন মনে আছে তোমাদের; সবাই গাও আমার সাথে...১,২,৩ (ফিসফিসয়ে)...
ক-এ কলা , খ-এ খাই
এতো বেশী খেতে নাই..সবাই বলো ওওও
https://www.youtube.com/watch?v=PAALHDGsqzk
সমস্বরে :
ক-এ কলা , খ-এ খাই
এতো বেশী খেতে নাই
গ-এ গরু, ঘ-এ ঘাস
কত ঘাস খেতে চাস
ঙ বলে কোলা ব্যাঙ
সারাদিন ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ
ক খ গ ঘ ঙ....।। (ডবল দাড়ি)
খালামনি : বাহ! সবার মনে আছি দেখছি ! খুব ভাল ...এসো এবার পরের গানে যাই -
https://www.youtube.com/watch?v=DPA0TnUK-1g
জাদুর পেনসিল, আহা জাদুর পেনসিল
আমার থাকতো যদি এমন একটি জাদুর পেনসিল....সবাই বলো ওওওওও
সমস্বরে :
জাদুর পেনসিল, আহা, জাদুর পেনসিল
আমার থাকতো যদি এমন একটি জাদুর পেনসিল
তাতে যা আঁকা যায়, যদি সত্যি হতো
তবে হাতের মুঠোয় পেতাম রে ভাল বিশ্বনিখিল ।। (ডবল দাড়ি)
খালামনি : বাহ! এবার একজন একজন করে ..অন্তরাটুকু...তুমি বলো ...
জনৈক বাচ্চা :
খিদে পেলে সে পেনসিলে মিঠাই মন্ডা আঁকতাম
তারপরে ভাই পেটটি পুরে খেতাম এবং চাটতাম
রসে ভরা রসগোল্লা, খাজা-গজা কালো জাম
তোমাদেরও খানিক দিতাম হয়ে দরাজ দিল ....
খালামণি : সবাই বলো ..ওওওও
সমস্বরে : জাদুর পেনসিল , আহা, জাদুর পেনসিল ....
খালামনি : খুব ভালো হয়েছে, তোমারদের মনে আছে সব দেখি ! এবার আমরা আরেকটা গান করব -
https://www.youtube.com/watch?v=1wXGg1jITT8
ছোট্ট কণা থেকেই তো হয়
গোলাপি মুক্তো ...ওও....সবাই ....ছোট্ট....
সমস্বরে :
.... কণা থেকেই তো হয়
গোলাপী মুক্তো,
.... ..... গড়েই তোলে
.... ঝিনুক তো...ওওওও ।। (ডবল দাড়ি)
খালামণি : কথায় কেউ কেউ গোলামাল করছো; স্বপন, তোমার গানের কথা ভুল হচ্ছে এইখানে
খাতা খুলে দেখো
.... আবার গাই ঠিক করে সবাই ...
ছোট্ট কণা থেকেই তো হয়
গোলাপী মুক্তো,
তিলে তিলে গড়েই তোলে
তাকেই ঝিনুক তো...ওওওও ।। (ডবল দাড়ি)
খালামণি : বাহ ! অন্তরা গাইতে গাইতে বাড়ি যাবো আমরা .....
সমস্বরে :
দেহের কোথাও আটকে গেলে
বালু কিনবা ওমনি কিছু
ঝিনুক তাকে রুখতে তখন
যায় লেগে ভাই ভীষণ পিছু
বলে দেখি সাহস কেমন আছে
একটু এগুক তো...ওওও..
টেলিভিশনে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো অনুষ্ঠান ‘এসো গান শিখি’৷
৪৭ বছর ধরে সে অনুষ্ঠানে গান শেখানোর সুবাদে শিশুদের কাছে ‘খালামনি’ হিসেবেই পরিচিত ফেরদৌসি রহমান৷
১৯৬৪ সালের কথা৷ বিটিভি সবে যাত্রা শুরু করেছে৷ পশ্চিম পাকিস্তান সরকার তখনো বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী জনগণের সংস্কৃতির উপর আঘাত হেনে যাচ্ছিল ৷
https://www.youtube.com/watch?v=BL4gdRnCHmA
টেলিভিশন চ্যানেল উদ্বোধনের পর প্রথম গান৷ শিল্পী ফেরদৌসি রহমান৷ দু দিন পর আবার ডাক পড়ে তাঁর৷
বলা হলো, একটা অনুষ্ঠান শুরু হবে, সেখানে বাচ্চাদের গান শেখাতে হবে৷ গান শেখানোয় খুব আপত্তি ছিল ফেরদৌসির৷ ততোদিনে বেশ প্রতিষ্ঠিত এবং খুব জনপ্রিয় হয়ে গেলেও মনে হচ্ছিল ‘‘গানের ভুবনে নিজেই তো শিক্ষার্থী, অন্যদের শেখাবো কী!''
কিন্তু মোস্তফা মনোয়ার আর কলিম শরাফির মতো দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বের অনুরোধ অগ্রাহ্য করা তো সম্ভব নয়, অগত্যা রাজি হতেই হলো৷ ক্ষতি হয়নি তাতে৷
‘এসো গান শিখি'- ফেরদৌসি রহমানের এ আহ্বানে আজও বাংলাদেশের শিশু সংগীত শিক্ষার্থীরা ছুটে গিয়ে বসে টেলিভিশনের সামনে!
https://www.youtube.com/watch?v=ZPmEIW0mIlY
[টেলিভিশনে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো অনুষ্ঠান ‘এসো গান শিখি’ ]
অথচ ৪৭ বছরে কত কী হয়েছে ! পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের চরম বৈষম্যমূলক শাসননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে, তাদের লেলিয়ে দেয়া সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজের পরও পরাধীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে মুক্তিকামী জনতা ৷
১৯৬৪ সালের শিশুদের অনেকেই এখন ষাটোর্ধ প্রবীণ৷ গান গাইতে গেলে অনেকের কণ্ঠ কাঁপে, বেসুরো শোনায়৷ তবে এখনো বাড়িতে আছে ‘এসো গান শিখি'৷
‘এসো গান শিখি'র সঙ্গে কয়েক প্রজন্মের এমন সুরের বন্ধন সম্পর্কে ফেরদৌসি রহমান বলছিলেন : ‘‘সাতচল্লিশ বছর তো অনেকটা সময়৷ এ সময়ের মধ্যে কয়েকটা প্রজন্ম ধরে এ গানের অনুষ্ঠানের শ্রোতা তৈরি হয়েছে৷ কিছু ছেলেমেয়ে আছে যাঁরা ভালো গান করছে এখনো, আবার অনেকে গান গাইছে না, অন্যদিকে চলে গেছে৷
যেমন একটা ছেলে আছে ডালিম কুমার, সে আমার কাছে গান শিখতো এখন অনেক ভালো অ্যাকুইস্টিকস বাজায়৷ তারপর হুমায়ূন আহমেদ সাহেবের স্ত্রী শাওন আছে যে ভালো গান করে৷ ‘এসো গান শিখি' থেকে আরো অনেক শিল্পী বেরিয়েছে৷''
https://www.youtube.com/watch?v=PphQixv-hp4
৪৭ বছর আগের শিক্ষার্থীদের কারো কারো সন্তান, সন্তানের সন্তান, এমনকি তাদের সন্তানও গান শিখেছেন বা শিখছে ফেরদৌসি রহমানের কাছে৷ নিজের বয়সও ৭০ ছাড়ালে কী হবে, বরেণ্য শিল্পী ফেরদৌসি এখনো তরুণ, কণ্ঠ এখনো তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে৷
‘এসো গান শিখি'র শুরুটা হয়েছিল অবশ্য অন্য নামে৷ প্রথম দু বছর নাম ছিল ‘‘সংগীত শিক্ষার আসর৷'' তারপর দু বছর বন্ধ থাকার পর আবার যখন শুরু হলো তখন থেকেই নাম ‘এসো গান শিখি৷' সময়ের দাবিতে পরিবর্তন এসেছে কিছু৷
শিশুদের খেলার ছলে, মজা করে করে গান শেখাতে অনুষ্ঠানে যোগ হয়েছে পাপেট ‘মিঠু' আর ‘মন্টি'৷ তারা আছে আর আছেন ফেরদৌসি৷ নিজের লেখাপড়া, শিল্পী হিসেবে বিদেশ সফর বা অনুষ্ঠান একঘেয়েমি আসতে না দেয়ার ভাবনা থেকে ফেরদৌসির সানন্দ সম্মতিতে আজাদ রহমান, কলিম শরাফি, খান আতাউর রহমান এবং ফিরোজা বেগমও গান শিখিয়েছেন এ অনুষ্ঠানে৷ সেই পরিবর্তন অনেক আগের এবং খুবই কম সময়ের জন্য৷ ওই অতি সাময়িক পরিবর্তনগুলো বাদ দিলে ‘এসো গান শিখি' আর ফেরদৌসি রহমান অবিচ্ছেদ্য ছিলেন এবং সবাইকে অবাক করে এখনো আছেন!
বিষয়টি খুব অবাক হবার মতো, কেননা, বাংলাদেশে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিটিভিও বদলায়৷ শিল্পী-তালিকায় আমূল পরিবর্তন তো তখন অনিবার্য৷ সবার সৌভাগ্য যে ‘এসো গান শিখি'কে সেরকম পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে হয়নি কখনো৷
এ অনুষ্ঠান নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনে ফেরদৌসি রহমানও সেরকমই জানিয়েছেন৷
কিন্তু তাঁকে রাখলেও অনুষ্ঠানকে অনাগত আগামীর জন্য ধরে রাখার কোনো উদ্যোগ কি নিয়েছে বিটিভি? সিডি বা ডিভিডিতে অন্তত সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ কি নেয়া হয়েছে এখনো? আব্বাস উদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা ফেরদৌসি জানালেন, ‘‘না, ডিভিডি-সিডি নেই, তবে ১৩টা গান নিয়ে আমি একটা অডিও সিডি বের করেছি৷ ওটার এখনো অনেক চাহিদা রয়েছে৷ এখনো অনেকে, বিশেষ করে বিদেশে গেলে অনেকে আমাকে বলে যে, এরকম আরো সিডি কেন বের করছেন না, বের করলে আমাদের সন্তানরা, যারা বিদেশে বড় হচ্ছে, তারা একটু বাংলা গান শিখতে পারতো৷ ডিভিডির কথাও অনেকেই আমাকে বলেছেন৷ কিন্তু এ সম্পত্তিটা (এসো গান শিখি) তো আসলে বিটিভির সম্পত্তি৷ তারা বোধহয় এটা ভালোভাবে সংরক্ষণও করেননি৷''
কিছুদিন হলো অনুষ্ঠান চলছে খুব দায়সারাভাবে৷ দেশের সবচেয়ে পুরনো এবং শিশুদের গান শেখানোর একমাত্র অনুষ্ঠানটি এখন আর সাপ্তাহিক নেই, দু'সপ্তাহ পরপর একদিন প্রচারিত হয় ‘এসো গান শিখি'৷ তা-ও আবার সবসময় নির্দিষ্ট সময়ে নয়৷ অনুষ্ঠানটির এখন কী অবস্থা – জানতে চাওয়ায় বড় দুঃখ নিয়েই নিজের অসন্তোষের কথা জানালেন ফেরদৌসি রহমান, ‘‘এখন হচ্ছে অনুষ্ঠানটা৷ দু'সপ্তাহ পরপর শনিবারে দেখানো হচ্ছে৷ আমি এ নিয়ে খুব বেশি খুশি নই৷ এটা প্রত্যেক সপ্তাহে যদি ঠিক সময়মতো না যায়, বাচ্চারা একটা সপ্তাহ যদি দেখতে না পায়, তাহলে উৎসাহটা চলে যায়৷ আমি ওদের (বিটিভি) সঙ্গে এ নিয়ে কিছুটা কথাও বলেছি যে, আপনারা আদৌ যদি প্রোগ্রামটা কনটিনিউ করতে চান, দেন ডু ইট সিরিয়াসলি৷''
http://www.dw.com/bn/%E0%A6%8F%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%BE-%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%96%E0%A6%BF/a-16391175
সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী ফেরদৌসী রহমান
যারা আমার মত বিটিভি থেকে এই গান শিখেছেন তারা এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন আমি কার কথা বলছি, কোন খালামনির কথা বলছি। টেলিভিশনে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো অনুষ্ঠান ”এসো গান শিখি”। ৪৭ বছর ধরে সে অনুষ্ঠানে গান শেখানোর সুবাদে শিশুদের কাছে ”খালামনি” হিসেবেই পরিচিত কিংবদন্তী : ফেরদৌসী রহমান সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী। আমার খুব প্রিয় একজন শিল্পী। ফেরদৌসী রহমান বাংলা ভাষী নারী সঙ্গীত শিল্পীদের ভিতর শ্রেষ্ঠতম । তার উচ্চারণ বাচনভঙ্গী , কী সব কিছুই রোমান্টিক মোহনীয়? এবং নিখুঁত। তিনি সঙ্গীতের সব ধারায় সমভাবে পারদর্শী।
https://www.youtube.com/watch?v=Gat0xRNGhcs
আমরা যখন খুব ছোট ছিলাম তখন বিটিভি ছাড়া আর কোন চ্যানেল ছিল না। টিভির অনুষ্ঠান শুরু হতো বিকালে, আর ৫টার দিকে হতো কার্টুন। শুক্রবার সকাল থেকে বিটিভির অনুষ্ঠান শুরু হতো। আমি মহা খুশীতে থাকতাম, সকাল থেকেই অপেক্ষা করতাম এসো গান শিখি অনুষ্ঠান দেখার জন্য। টম এন্ড জেরী, থান্ডার ক্যাটস, মিকি মাউস, দ্যা থ্রি স্টুজেস, টারজান, পাপাই শো আরো অনেক কার্টুন আর টিভি সিরিয়াল ছিল। আমার সবচাইতে প্রিয় ছিল গান শেখার অনুষ্ঠান ”এসো গান শিখি”। আগে থেকেই খাতা কলম নিয়ে তৈরি হয়ে বসে থাকতাম টিভি সেটের সামনে। খুব মজা পেতাম এটা দেখে...খালামনি আমি...খালামনি আমি বলে পরিক্ষা দেবার জন্য সবাই যখন চিৎকার করতো।
”এসো গান শিখি” আমার অনেক প্রিয় একটি অনুষ্ঠান ছিল। এখনও মাঝেমাঝেই মনে পড়ে ফেরদৌসী রহমান আর সেসব গান। অনেকেরই গান ও নাচের টিচার থাকার পরেও উনি মনে হয় ছিলেন আমাদের সবার কমন গানের টিচার। এখনকার বাচ্চারা এই অনুষ্ঠান দেখে কিনা বা মিঠু মন্টিদেরকেও চিনে কিনা জানি না।
১৯৬৪ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর তারিখে ঢাকার ডিআইটি ভবনের ছোট্ট একটি অংশজুড়ে একটি টেলিভিশন কেন্দ্র তার গৌরবময় যাত্রা শুরু করেছিল। সেই ছোট্ট টেলিভিশন কেন্দ্রটির নাম ”বাংলাদেশ টেলিভিশন”। শুরুতে এর নাম পাকিস্তান টেলিভিশন থাকলেও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) নামকরণ হয়।
সেই সময় বাংলাদেশ টেলিভিশন বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল। সে সময় কলিম শরাফী সাহেব ছিলেন টেলিভিশনের জিএম। তখন মুস্তাফা মনোয়ারও ছিলেন। ’’ওই যে আকাশ নীল হল আজ সে শুধু তোমার প্রেমে’’ - ফেরদৌসি রহমানের গাওয়া এ গানটিই ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম গান। আধুনিক গানটি আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা, সুর করেছেন নিপুণ সরকার। অনুষ্ঠানটির ঘোষিকা ছিলেন হেনা কবীর। প্রযোজনা করেছিলেন এম মনিরুল আলম। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ডিআইটি ভবনের স্টুডিও থেকে প্রচারিত প্রথম নাটক ছিল ’’একতলা দোতালা’’। মুনীর চৌধুরীর নাটক। এ দেশের টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রচারিত প্রথম নাটক এটি। একতলা দোতলার প্রযোজক ছিলেন এ দেশের টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রনায়কদের অন্যতম মরহুম মনিরুল আলম। শিল্পী ছিলেন লিলি চৌধুরী, ডলি ইব্রাহিম, খন্দকার রফিকুল হক, রামেন্দু মজুমদার, ফরিদ আলী, রবিউল আলম ও ফেরদৌসী মজুমদার। উদ্বোধনের দু দিন পর টেলিভিশনে আবার ডাক পড়ে ফেরদৌসী রহমানের । বলা হলো, একটা অনুষ্ঠান শুরু হবে, সেখানে বাচ্চাদের গান শেখাতে হবে। গান শেখানোয় খুব আপত্তি ছিল ফেরদৌসী রহমানের।
ফেরদৌসী রহমানের জন্ম ১৯৪১ সালের ২৮ জুন কুচবিহারের পশ্চিমবঙ্গে। পল্লীগীতির সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদের কন্যা ফেরদৌসী রহমান। সঙ্গীতের সঙ্গেই নিত্য উঠাবসা। খুব ছোটোবেলা থেকে সংগীতে ঢেলেছিলেন মনপ্রাণ। প্রায় পাঁচ দশক ধরে তাঁর সংগীত জগতে পদচারণা চলছে। পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক এবং প্লে ব্যাক সব ধরনের গানই তিনি করেছেন। ফেরদৌসী রহমানের গানে হাতে খড়ি হয় তাঁর পিতার কাছে। পরবর্তীতে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ইউসুফ খান কোরেইশী,কাদের জামেরী, গুল মোহাম্মদ খান, নাজাকাত আলী খানের মত নামজাদা ওস্তাদদের কাছে। খুব অল্প বয়স থেকে তাঁর স্টেজ পারফরম্যান্স শুরু হয়। মাত্র ৮ বছর বয়সে রেডিওতে খেলাঘর নামের অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
ফেরদৌসী রহমান ১৯৪৮ সালে প্রথম রেডিওতে গান করেন। তখন তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন।
১৯৫৬ সালে প্রথম বড়দের অনুষ্ঠানে গান করেন।
১৯৫৭ সালে প্রথম গান রেকর্ড করেন এইচ এম ভি থেকে।
১৯৬০ সালে ‘আসিয়া’ নামের চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম প্লে ব্যাক করেন এবং রবীন ঘোষের সাথে ‘রাজধানীর বুকে’ নামক চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন।
১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আরও কয়েকটি ছবির মধ্যে ছিল শবনম-রহমান অভিনীত হারানো দিন। সুরকার রবিন ঘোষ। এই ছবিতে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ফেরদৌসী রহমান কালজয়ী জনপ্রিয়তা পান ’আমি রূপনগরের রাজকন্যা’ গানটির জন্যে।
১৯৬৪ তে এলো সুভাষ দত্তের সুতরাং । ”নদী বাঁকা জানি, চাঁদ বাঁকা জানি, তাহার চেয়ে আরও বাঁকা তোমার ছলনা” কথাঃ সৈয়দ সামসুল হক। সুরঃ সত্য সাহা। ফেরদৌসী রহমান ও মোস্তফা জামান আব্বাসী, ভাই -বোন মিলে বেশ মজার এই গানটি করেন।
১৯৬৬ সালে কাগজের নৌকা গানের জন্য খ্যাতি লাভ করেন।
১৯৬৭ সালে আয়না ও অবশিষ্ট ছবির জন্য ফেরদৌসী রহমান গাইলেন-
”যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে, সেকি তুমি নও ওগো তুমি নও”।
কথাঃ সৈয়দ সামসুল হক। সুরঃ সত্য সাহা।
৬০ ও ৭০-এর দশকের অনেক চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ফেরদৌসী রহমান। তিনি চলচ্চিত্রে প্রায় ২৫০টি গান গেয়েছেন। বাংলা ছাড়াও উর্দু, ফারসী,আরবী, চীনা, জাপানী, রুশ, জার্মান সহ আরো বেশকিছু ভাষায় গান গেয়েছেন। ৩টি লং প্লে সহ প্রায় ৫০০টি ডিস্ক রেকর্ড এবং ১৮ টিরও বেশী গানের এ্যালবাম বের হয়েছে ফেরদৌসী রহমানের।
এসো আমার দরদী নামের ১ টি মাত্র সিডি বের হয়েছে ফেরদৌসী রহমানের। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার গানের রেকর্ড হয়েছে তাঁর।
তিনিই প্রথম মহিলা সংগীত পরিচালক। ফেরদৌসী রহমান নজরুল ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন।
আমাদের সঙ্গীত ভুবনে অবদান রাখার জন্য তিনি জাতীয় পর্যায়ে নানাভাবে সন্মানিত হয়েছেন। তাঁর অর্জিত উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে আছে লাহোর চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার (১৯৬৩ সাল), প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৬৫ সাল), টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৫), জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক (১৯৭৭), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (১৯৭৬), একুশে পদক (১৯৭৭ সাল)। এছাড়া তিনি নাসিরউদ্দিন গোল্ড মেডেল পুরস্কার, মাহবুবুল্লাহ গোল্ড মেডেল, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পুরস্কার লাভ করেন।
শুধু গান নয়, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায়ও ফেরদৌসী রহমানের সাফল্য অবাক করার মতই।
ফেরদৌসী রহমান ম্যাট্রিকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন। এইচ.এস.সিতে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বাদশ অবস্থানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন ১৯৬২ সালে। ১৯৬৩ সালে ইউনেসকো ফেলোশিপ নিয়ে চলে যান লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিকে।
১৯৬৬ সালের ২৬শে অক্টোবর তিনি বিয়ে করেন রেজাউর রহমানকে। উনি একজন মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরেই ফেরদৌসী বেগম থেকে তিনি হলেন ফেরদৌসী রহমান।তাদের ২ ছেলে রুবাইয়াত ও রাজন আজ প্রতিষ্ঠিত। ওরা যে যার সংসার ও কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। এ বয়সে সময় পেলে বিদেশে ছেলেদের কাছে তিনি বেড়াতে যান। তিনি ১৯৬৩ সাল ও ১৯৬৬ সালে রাশিয়া এবং চীনে বেডাতে যান এবং গান করেন।
ফেরদৌসী রহমানের ভাই সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল আব্বাসী ড. নাশিদ কামালের পিতা। আরেক ভাই কণ্ঠশিল্পী ও গবেষক মোস্তফা জামান আব্বাসী। বিচারপতি মোস্তফা কামাল ১৯৯৯ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
আজকাল ফেরদৌসী রহমান তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আব্বাস উদ্দিন সঙ্গীত একাডেমির পেছনেও বেশ সময় দিচ্ছেন। এই একাডেমিকে আরও সম্প্রসারণ করার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বাবা আব্বাস উদ্দিন আহমেদের গাওয়া গানগুলো তার মনে আগের মতোই নাড়া দেয়। শুধু তার অন্তরে নয়, এ প্রজন্মের সঙ্গীত শিল্পীরাও আবার গাইছেন আব্বাস উদ্দিনের গান।
ফেরদৌসী রহমান তার নিজের আত্মজীবনী লেখার এমন একটা পরিকল্পনা আছে। জীবনকাহিনীটা একফাঁকে লিখে ফেলতে চান একটু একটু করে। সবমিলিয়ে মোটাসোটা একটা বই বের করার ইচ্ছে আছে তার। কোচবিহার আর বলরামপুরে ফেলে আসা শৈশবের গল্প। সেই ১৯৪৭ সালে ওপার থেকে এপারে পাড়ি জমানোর গল্প। বাবা আব্বাসউদ্দীনের কোলে বসে গান শোনার গল্প। গান শোনা আর গান গাওয়া শুরু করার গল্প। টিভি-রেডিও, দেশে-বিদেশে কত ঘটনা-ই আছে এই ছোট্ট জীবনে। আছে নানা বেদনা, প্রাপ্তি এবং সুখস্মৃতি। মানুষের অভাবনীয় ভালোবাসা ও মমতার গল্প। আদ্যেপান্ত জীবনটা তার তুলে আনার ইচ্ছে সেই বইয়ে।
http://tokyo.eidesh.com/bangladesh/blogs/view/753
চলবে .............
বিষয়: বিবিধ
২৫৫৯ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এতো দিন কোথায় ছিলেন?
যাউকগ্যা আপনে আপনার স্ববিরোধী ও মিথ্যা মন্তব্যের প্রতি মন্তব্যটা কইরা দেন। আমরা বে-আক্কেল মানুষ আমনের কাছে শিখতাম চাই স্ববিরোধী ও মিথ্যা কথাকে আওয়ামী স্টাইলে কিভাবে হাচা কথায় পরিবর্তন করা যায়। আমনে দয়া কইরা মন্তব্যটা সাইরা ফেলান।
গান নিয়ে গবেষণা। আপনি গানের স্কুল খুলবেন নাকি?
ধন্যবাদ....
গানের স্কুল-ই নয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপরই একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ইচ্ছা আছে ।
আমি অন্তত কোন কিছু লেখা ও বলার ক্ষেত্রে কুরআনের এই কথাটা মনে রাখি :
وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولـئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولاً
যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।
সুরা বনি ইসরাইল : ৩৬ ।
দয়া করে, আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে কিছু বলবেন কি ?
নিজেকে ইসলামী জ্ঞানের ভান্ডার হিসেবে জাহির করেন কিন্তু গানের আয়োজন করে গোমরাহীর পরিচয় দিলেন।
নিজের ভেতরে নিজেকে খুজতে চেষ্টা করুন...! মনে হয় জ্ঞান জাহির করতে গিয়ে নিজের আত্মার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছেন!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন