সবাইকে হিজরী নববর্ষের শুভেচ্ছা ! স্বাগতম ১৪৩৬ হিজরী !
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ২৬ অক্টোবর, ২০১৪, ১২:৫৭:৫৮ রাত
পটভুমি :
[ এই পোস্টটি সম্পাদক মহোদয়কে স্টিকি করার জন্য অনুরোদ করছি । ]
স্বাগত হিজরী ১৪৩৬। ২৬ অক্টোবরর ২০১৪ তারিখ রবিবার বাংলাদেশে ১৪৩৬ হিজরী বছরের প্রথম দিন ।
ইসলামী নববর্ষ পালন ও হিজরী সনের তাৎপর্য বিষয়ক বাংলা ভাষায় গাওয়া একমাত্র গান ।
সূচনা :
ফেলে আসা দিনগুলোর গ্নানিকে মুছে ফেলে ও দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন বছরের শুরুর সময়টার গুরুত্ব রয়েছে । মুসলিম হিসেবে হিজরী নববর্ষ উদযাপন কিংবা মুসলিমদের গৌরবের দিনটি পালনের ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকতা লাভ করেনি। অনেকে আমরা জানি না যে, মুসলিমদের নববর্ষ কোন মাসে হয়? আবার কেউ হয়তবা হিজরী বর্ষ গণনার সঠিক ইতিহাস জানেন না । হিজরী সনের তারিখের খবরও রাখেন না । এর প্রতি মানুষ আকর্ষণও অনুভব করেন না । হিজরীর প্রথম দিনে বাংলাদেশের কোন পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখে না এবং সরকারী ছুটিও থাকে না (অনেক মুসলিম প্রধান দেশের অন্যতম সরকারী ছুটির দিন ) যা অত্যন্ত গ্লাণিকর ও লজ্জার ।
হিজরী সন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ত্যাগ এর ঐতিহাসিক স্মারক। হিজরী সন আমাদের মনে করিয়ে দেয় কিভাবে অবিশ্বাসীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পৃথিবী হতে সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি আজো জাগরূক হয়ে আছেন মুসলিম বিশ্বে।
মনে রাখা জরুরী যে, হিজরী সনের প্রথম মাস মহররম । এ মাসের ৯, ১০ ও ১১ তারিখে রোযা রাখা ভাল। মুহাররম মাস শুধুমাত্র কারবালার ঘটনা স্মরণ করার মাসই নয় এমাস গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার, ত্যাগের, ভালো কাজ করার, খারাপ কাজ হতে বেঁচে থাকার এবং মুসলিম বিশ্বকে নতুন করে গড়ার প্রতিজ্ঞা করার মাস ।
হিজরী নববর্ষ আমাদেরকে ইসলামের ত্যাগের আদর্শের দিকেই আহবান করছে। আসুন ইসলামের আলোয় আলোকিত হই।
হিজরী সনের গুরুত্ব :
তফসীরে কবীর ১৬ তম ভাগ ৫৩ পৃষ্ঠায় ইমাম রাজী (রহ.) কুরআন – হাদিস সূক্ষাতিসূক্ষভাবে গবেষণা করে বলেছেন যে, মুসলিমরা তাদের যাবতীয় কাজ করবে হিজরী সন দিয়ে ।
কিছু ক্ষেত্র হিজরী সন, যেমন : রোযা, ফিৎরা, ঈদ, হজ্ব, যাকাত এবং কিছু ক্ষেত্রে, যেমন : ব্যবসা – বাণিজ্য ,ব্লগ সাইটে তারিখ লেখা, রাজনৈতিক কাজে, আইন – আদালতে,আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে, মহাকাশ গবেষণায়, যে কোন দিবস পালন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাফের ও মুশরিকদের সন গ্রহণ করা আল্লাহর কাছে অগ্রহণযোগ্য । কারণ হিজরী সন মুসলিম জাতির ক্যালেন্ডার। তাফসীর গ্রন্হগুলো আমাদের তাই বলে থাকে ।
হিজরী নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আমাদের করণীয় :
১. আত্মসমালোচনা করা : একটি বৎসরের বিদায় নিল আর নতুন আরেকটি বৎসরের আগমনের মধ্যে রয়েছে চিন্তা ভাবনার খোরাক। আত্মসমালোচনা করে দেখতে হবে, কেমন ছিল গত বৎসরে আমার আমলনামা। কী পরিমান বরকতময় আমলসমূহ করেছি তা হিসাব করতে হবে । কম হলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে ।
এই ভিডিওটি দেখুন :
২.বিগত বছরে কী করা হবে তার পরিকল্পনা নেওয়া :
ক) বরকতময় আমলসমূহ করার জন্য সময় ভাগ করে নিতে হবে ।
খ) নিজের পেশাগত জীবনকে উন্নত করার জন্য পরিকল্পনা সাজাতে হবে ।
যেমন : কোন আপু যদি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিতে চান তাহলে তাকে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার হতেই বিএমএ লং কোর্স পড়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি গাইড পড়া ও কোচিং সেন্টারে ভর্তির পরিকল্পনা নেওয়া ।
ডাক্তার হতে আগ্রহী কলেজ ১ম বর্ষের ছাত্রের মেডিক্যাল ভর্তি গাইড এক বছরে বুঝে মুখস্হ করা এবং সব পরীক্ষায় ১ম হওয়ার জন্য পরিকল্পনা করা । এপদ্ধতিটাই ডাক্তার হওয়ার জন্য ইসলামের দৃষ্টিতে যথাযথ প্রথম পদক্ষেপ ।
সাধারণ ছেলেদের গতানুগতিক পদ্ধতি হলো : ইন্টার পরীক্ষা শেষ, তাবলীগে এক চিল্লা দাও , কিছু দিন ঘুরো , তারপর কোচিং সেন্টারে দৌড়াও । এপদ্ধতিতে সফলতার হার ১০ % মাত্র ।
গ) আখেরাতের জন্য ভাল লোকদের খুজে বের করা : বিভিন্ন সাইট, প্রতিষ্ঠান ও নিজের পরিবেশ হতে ভাল লোকদের খুজে বের করতে হবে যারা বরকতময় আমলসমূহ করতে সাহায্য করবে , মারা গেলে দু,আ করবে এবং ইসলাম প্রচার ও প্রসারে সাহায্য করবে । এরাই মূলত বন্ধু ।
ঘ) আয় বর্ধক কাজের পরিকল্পনা নেওয়া : কলেজ ১ম বর্ষের ছাত্রটার উচিত হবে বা – মার উপর নির্ভর না থেকে আয় বর্ধক কাজ করার পরিকল্পনা নেওয়া । যেমন : টিউশনি , ছাগল পালন, বাড়ির ছাদে গোলাপ ফুল চাষ , আউট সোর্সিং ।
ঙ)বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন : আরবী ভাষাসহ নূন্যতম অপর একটি ভাষা শিখার পরিকল্পনা নিতে হবে । কারণ মুসলিম জাতির সদস্যদের একক ভাষা আরবী এবং তারা চার হাজারেরও অধীক ভাষায় কথা বলে । মুসলিম জাতির সদস্যরা জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান । এক্ষেত্রে আরবীর পাশাপাশি তুর্ক,রাশিয়ান, ফ্রান্স, চীনা ইত্যাদির কোন একটা শিখা যেতে পারে । এক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে হবে ।
চ) সামাজিক কাজ করার পরিকল্পনা নিতে হবে :
পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান, মসজিদের জন্য ভাল হুজুর সংগ্রহ ,স্বাক্ষরতা অভিজান চালানো, কুরআন শেখার কোর্স পরিচালনা করা এবং আকাশ চেনা – গাছ চেনা – সাতার শেখার কাজের পরিকল্পনা নিতে হবে ।
ছ ) মহররম মাসের ৯,১০,১১ তারিখ রোজা রাখতে হবে । এভাবে প্রতি মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখ রোজা রাখতে হবে । প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতে হবে । এসব আমল হাদিস দ্বারা প্রমাণিত ।
শিক্ষণীয় দিক ও করণীয় :
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করেছেন যাতে আমরা তার পথে দাবিত হই । হযরত মূসা (আ) ও ফেরাউনের ঘটনা। সেখানে ইসলাম বিজয়ী হয়েছ ।এ ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটেছিল পবিত্র মহররম মাসের ১০ তারিখে। এদিনকে বলা হয় আশুরা ।
ইসলাম ও কুফরের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে মুমিনের মনে আশুরার শিক্ষা সর্বদা অনুপ্রেরণার সঞ্চার করে, মিথ্যা যতই শক্তির অধিকারী হোক না কেন তার পতন অনিবার্য। আল্লাহর সাহায্যে মুমিনদের বিজয় আসে। মিথ্যা যতই শক্তির অধিকারী হোক না কেন তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে ।
আশুরা অর্থাৎ মহররম মাসের দশম দিবস এ কারণেই এত ফযীলতের। ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) মদীনা শরীফে হিজরত করে আসার পর দেখতে পেলেন, ইহুদীরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, কি কারণে তোমরা আশুরার দিবসে রোজা রাখো। তারা উত্তর দিলেন, এটা হচ্ছে একটা মহান দিন। আল্লাহ এদিন মূসা (আ) এবং তাঁর জাতিকে উদ্ধার করেছিলেন। আর ফেরাউন ও তার লোকজনকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। মূসা (আ) আল্লাহর শোকর আদায়ের উদ্দেশ্যে এ দিনে রোযা রাখতেন। আমরাও তাই করছি।
রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, মূসা (আ) এর ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমাদের হক ও করণীয় আরও বেশি। তারপর থেকে রাসূলুল্লাহ (সা) আশুরার দিবসের রোযা রাখা শুরু করলেন এবং সাহাবীদেরকেও রাখতে বললেন।-(বুখারী ও মুসলিম)
আরেকটি রেওয়াতে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা) আশুরার রোযা রাখা শুরু করলে এবং রাখার জন্য সাহাবীদেরকে বললে অনেকেই বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ। এটা তো ইহুদী ও খৃষ্টানদের একটা পবিত্র দিন। তিনি বললেন, ‘‘আগামী বৎসর যদি বেঁচে থাকি ইনশাআল্লাহ তাহলে ৯ই মহররম ও রোযা রাখব।’’ আগামী বৎসর আসার পূর্বেই অবশ্য তিনি ওফাৎ লাভ করেন।-[মুসলিম ]
অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে, আশুরার আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি রোযা রাখো। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এ বরকতময় আমল করার তাওফিক দিন। আমীন!
বাংলাদেশে হিজরি সনের আবির্ভাব :
ইসলাম প্রচারের সাথে সাথেই বাংলাদেশে হিজরী সনের প্রচলন ঘটেছে। বাংলাদেশে ১২০৪ খৃষ্টাব্দ হতে সর্বক্ষেত্রে হিজরী সন ব্যবহার শুরু হয় ( তবাকাতে নাসিরী )। উপমহাদেশে প্রায় ৫৫০ বৎসর রাষ্ট্রীয়ভাবে এই হিজরী সন স্বীকৃত ছিল। ইংরেজ শাসনকালে আমাদের দেশে কুফরী খ্রিস্টীয় সনের প্রচলন হয় ( ১৭৯০সাল হতে ) যা আজও আমরা অন্ধের মতো ব্যবহার করছি ।
হিজরী সনের ইতিহাস :
৬২২ খৃস্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মদ সাঃ মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেন। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ বা ১৫ জুলাইয়ের সূর্যাস্তের সময়কে হিজরী সন শুরুর সময় হিসেবে নির্ধারন করেছেন। হিজরী সন ১৭ হিজরী সাল (৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ) হতে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শাসক হযরত ওমর (রাঃ) - এর শাসন আমলে হিজরী সন গণনা শুরু হয়। হযরত ওমর (রাঃ) এর কাছে ইরাক ও কুফার প্রশাসক আবু মুসা আশআরী (রাঃ) এক চিঠিতে লেখেন,” বিশ্বাসীদের নেতা! আপনার পক্ষ হতে আসা শাসন কার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট উপদেশ, পরামর্শ এবং নির্দেশ সম্বলিত বিভিন্ন চিঠিপত্র ও দলিলে কোন সন-তারিখ না থাকায় আমরা তার সময় ও কাল নির্ধারনে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হই। অধিকাংশ সময় এসব নির্দেশনার সাথে পার্থক্য করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে বলে আপনার নির্দেশ ও উপদেশ পালন করতে যেয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।” এগুরুত্বপূর্ণ পত্র পাওয়ার পর হযরত ওমর (রাঃ) মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। পরামর্শ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে রাসুল (সাঃ)- এর মদীনায় হিজরত করার ঐতিহাসিক দিন থেকে নতুন একটি সন তৈরী করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে হিজরী সন শুরু করার কারণ হলো রাসুল (সাঃ)- এর মদিনায় হিজরত করার মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করে, মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, মুসলিমদের শক্তিমত্তা বাড়তে থাকে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বর্হিবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, ইসলাম বিজয়ী শক্তিতে পরিনত হয় এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা রাসুল (সাঃ) এর হিজরতের কথা গুরুত্বের সাথে কোরআনে উল্লেখ করেছেন। হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে বানানো হয়েছে বলে এ সনকে হিজরী সন বলা হয়।
হিজরী সনের তাৎপর্য :
ওমর (রাঃ) তার খেলাফতকালের চতুর্থ বছর ( ৬৩৮ খৃস্টাব্দ ) হতে হিজরী বর্ষ পদ্ধতিগত গণনার ভিত্তিতে প্রসার ও প্রচলন শুরু করেন। এ সময় থেকেই ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আদর্শগত ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতে মুসলিমরা মুহাররম মাস দ্বারা বর্ষ গণনা শুরু করেন।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ও ধর্মীয় চিন্তা-চেতনায় হিজরী সনের প্রভাব সর্বাধিক। আমরা অনেকেই জানি না, মুহাররম মাসের প্রথম দিন ইসলামী নববর্ষ - আনন্দের দিন। কেননা ইসলামের ঘটনাবহুল ইতিহাসের একটি অতি তাৎপর্যমন্ডিত ঘটনাকে স্মরণীয় রাখার দিনটি হচ্ছে মহররম মাস। বিশ্বের মুসলিমদের কাছে ইসলামী সন হিসেবে হিজরী সন অতি পবিত্র ও অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ।
মুসলিমদের কাছে হিজরি সন বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত সন । আল্লাহ তার রাসুল সাঃ কে নবুওয়াত দান করলেন । তিনি ইসলামের দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন । তখন থেকেই রাসুল সাঃ এর একান্ত আপন জনেরা দুরে সরে যেতে লাগল। সবাই তার বিরোধীতা করতে লাগল। অল্প কিছু লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল। গোপনে গোপনে তিন বছর দাওয়াত দিলেন। এর পর আল্লাহর নির্দেশে সাফা পাহাড়ে প্রাকশ্যে এক আল্লাহর উপর ঈমান আনয়নের ঘোষণা করেছিলেন। তখন থেকেই আরম্ভ হলো নির্যাতন। পথে প্রান্তে তাকে অপমানিত লাঞ্চিত করা হতো। নামাজরত অবস্থায় উটের নাড়ী ভুড়ি তাঁর পিঠের উপর চাপিয়ে দেয়া হতো। গমনা-গমনের পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখা হতো। শিয়াবে আবু তালিব নামক স্হানে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা হলো। এরপর তার সাহাবীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হলো। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হযরত খাব্বাব,তালহা, আবদুর রহমান বিন আউফ, বেলাল রাঃ, আম্মার ইয়াছির ও সুমাইয়া রাঃ। বেলাল রাঃ কে তো মরু ভূমির উত্তপ্ত বালুকারাশির উপর চিৎ করে শোয়ায়ে বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো। এই অবস্থায় অত্যাচারী উমাইয়া বিন খলফের চাবুকের প্রচন্ড আঘাতে তার গোটা শরীর জর্জরিত হয়ে যেত। হযরত আম্মার ইয়াছির, সুমাইয়া এদের উপরও এই নির্যাতন চালানো হযেছে। কাফেররা নবীজীকে শারীরিক নির্যাতন করে দাওয়াত থেকে বিরত করতে পারল না । তখন তারা মানুষিক নির্যাতন করার জন্য নানা রকম ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে লাগল। তারা তাকে পাগল, কবি, জাদুকর ইত্যাদি বলে অপপ্রচার করতে থাকলো। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হলো না। একদিন তারা নদওয়া নামক তাদের মন্ত্রণাগৃহে একটি বৈঠক করলো। সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নিল মুহাম্মদ সাঃ কে দুনিয়া হতে সরিয়ে দেওয়ার । সবাই এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করলো । মক্কার শক্তিশালী লোকরা একত্রিত হয়ে শপথ নিয়ে বের হল মুহাম্মদ সাঃ এর বাড়ী ঘেরাও করে তাকে হত্যা করবে । আল্লাহ ইসলাম প্রচারের সুবিধা ও মুসলিমদের কথা ভেবে মক্কা থেকে মদিনায় দেশান্তরিত হবার আদেশ দেন রাসুল সাঃ কে । এই দেশান্তরিত হওয়াকেই আরবিতে হিজরত বলে। সে দিন ছিল ১২ই সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রীষ্টাব্দ।
আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন, হে নবী মক্কার মানুষ আপনাকে চায় না। মদীনার মানুষেরা আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আপনি মদীনায় হিজরত করে চলে যান। মহানবী ( সাঃ )আল্লাহর এই ঘোষণা পাওয়ার পর রাতের অন্ধকারে নিজ বিছানায় হযরত আলী ( রাঃ ) কে রেখে মদীনার পথে রওনা দিলেন। সাথী হিসেবে বন্ধু আবু বকর ( রাঃ ) কে সঙ্গে নিলেন । তাঁরা চললেন মদীনা অভিমুখে। চলতে চলতে রাত হয়ে গেল। রসুল ( সাঃ ) ও আবু বকর ( রাঃ ) তখন মক্কার অনতি দূরে সওর নামক পর্বতের কাছে। তারা ভাবলেন কাফেরেরা হয়ত তাকে বাড়ীতে না পেয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এখানে তারা রাতে লুকিয়ে থাকলেন । সওর পর্বতের একটি গুহার মধ্যে ঢুকলেন। এই গুহায় বিষধর সাপ ছিল। হযরত আবু বকরকে সাপ কামড় দিল। এদিকে সকাল পর্যন্ত কাফেরেরা রসূল ( সাঃ ) এর বাড়ীর ঘিরে রাখলো । তাকে বের হতে না দেখে তারা বাড়ীতে ঢুকে পড়ল। তারা রসূল সাঃ এর ঘরে হযরত আলী রাঃ কে পেয়ে তাকেই জিজ্ঞাসা করল- বল! তিনি কোথায়? হযরত আলী রাঃ বললেন, মুহাম্মদ ( সাঃ ) কোথায় সেটা তোমরা দেখ, আমি কি বলব? এমতাবস্থায় কাফেরেরা মুহাম্মদ সাঃ খুঁজতে বের হলো । এসময় কাফেরেরা রসূল ( সাঃ ) ও আবুবকর যে গুহায় ছিলেন সেদিকে এলো । হযরত আবু বকর রাঃ ভয় পেলেন। মহানবী সাঃ তাকে সান্তনা দিলেন । তারপর ঐ গুহার মুখে মাকড়সা জাল বুনলো। একটি কবুতর ডিম পেড়ে গুহার মুখে তা দিতে থাকল। কাফেররা যখন ঐ গুহার পাশে এলো, তখন একজন বললো : দেখ দেখ এই গুহাটি দেখ। কারণ এখানেও তিনি থাকতে পারেন। অন্য একজন বললো, এই গুহায় যে তিনি নেই, তা আমি নিশ্চিত বলতে পারি। কারণ গতরাতেই যারা এসেছে তারা যদি এই গুহায় ঢুকতো তাহলে মাকড়সার জাল ছেড়া থাকতো। আর যে গুহায় লোক থাকে তার মুখে কবুতর ডিমে তা দেয় কেমন করে? সুতরাং অন্যদিকে চলো। এরপর কাফেররা মক্কা থেকে মদীনায় যাওয়ার সকল পথে পাহারাদার নিযুক্ত করলো। কিন্তু মহানবী ( সাঃ ) এই গুহায় তিনদিন তিন রাত থাকার পর অচেনা-অজানা পথে লোহিত সাগরের তীর দিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে চলতে থাকলেন। পথে সুরাকা মহানবী ( সাঃ ) কে হত্যা করতে এসে নিজেই মুসলিম হয়ে গিয়েছিল। বারিদা নামক অন্য আরেকজন পুরস্কারলোভী ৭০ জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের নিয়ে পথে দাঁড়িয়েছিল। তারাও মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। এরপর মদীনায় পৌঁছলেন। মদীনার সকলে মহানবী ( সাঃ ) কে স্বাগতম জানালেন। তাকে মদীনার মানুষেরা নেতা বানালেন। তিনি মদীনা রাষ্ট্রের অধিপতি হলেন। এরপর ইসলামের দাওয়াত সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল।
উপসংহার :
রাসুলুল্লাহ (সা.) - এর হিজরতের এই প্রেক্ষাপট ও পটভূমি যদি হিজরী নববর্ষে স্মরণ করা হয় তাহলে ইসলামি ভাই-বোনরা ইসলামী সাংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারবে। তখনই কেবল ইসলামি সাংস্কৃতি বিমুখ হৃদয় পরিবর্তিত হয়ে ইসলামী হৃদয়ে পরিনত হবে।
রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে হিজরী সন ব্যবহার করার জন্য আমাদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে । আমাদের অপসংস্কৃতি ও অমুসলিম ঐতিহ্য গ্রহণ করা হতে বিরত থাকতে হবে ।
আমাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে ও গ্রঠণমূলক কাজ করার জন্য নতুনভাবে উজ্জিবীত হতে হবে এবং এই লক্ষ্যে সম্মিনিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে সামনের দিকে আল্লাহর উপর ভরসা করে এগিয়ে যেতে হবে ও কাজে নেমে পড়তে হবে ।
আপনাদের সবাইকে হিজরী নববর্ষের শুভেচ্ছা । হিজরী ১৪৩৬ সাল আপনার জন্য সুখ-সমৃদ্ধি-সফলতা-ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার বছর হোক - এই দুয়া-ই করি আল্লাহ তায়ালার কাছে ।
http://www.makkahcalendar.org/
http://www.moonsighting.com/
বিষয়: বিবিধ
৫১৬৫ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আপনার জন্য নতুন বছরটিকে সাফল্যমন্ডিত করুন ।
আপনার এই নতুন বছরটি হোক ঈমানী জীবন গড়ার বছর আর নতুনভাবে উজ্জীবিত হওয়ার বছর ।
তবে আমরা শুধু বলতে পারি , ভাল কাজ করলে সোয়াব হয় ও খারাপ কাজ করলে গুনাহ হয় ।
আপনার এই নতুন বছরটি হোক ঈমানী জীবন গড়ার বছর আর নতুনভাবে উজ্জীবিত হওয়ার বছর ।
আপনাকে বাংলাদেশের সব মুসলিমদের পক্ষ হতে দুয়া করছি ও আপনার জন্য রইল শুভ কামনা , "আল্লাহ আপনাকে সুখ সমৃদ্ধি ও সফলতা দান করুন ।"
নতুন বছরটি হোক সাফল্যময় ।
"আল্লাহ আপনাকে সুখ সমৃদ্ধি ও সফলতা দান করুন । "
নতুন বছরটি হোক সাফল্যময় ।
নতুন বছরটি হোক সাফল্যময় ।
"আল্লাহ আপনাকে সুখ সমৃদ্ধি ও সফলতা দান করুন । "
নতুন বছরটি হোক সাফল্যময় ।
নতুন বছরটি হোক সাফল্যময় ।
খৃষ্টাব্দ আর বঙ্গাব্দ অস্বীকার করার সুযোগ নেই, এসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত শিরক এবং অশ্লিলতা বর্জন করতে হবে কেবল। ধন্যবাদ
আর গোড়ায় গলদের ব্যাপারটা না বললে, নিজেকে অপরাধী মনে হবে- তাই লিখছি ।
১। Happy new year এর অনূকরনে ‘ইসলামী নববর্ষ উদযাপন’, বা এর শুভেচ্ছা বিনিময় ইসলামের আইনে বৈধ কি? রাসূল (সাঃ) ‘র জামানায়, সাহাবা এমনকি তাবে তাবেঈনদের যুগেও এমন কোন নববর্ষ উদযাপন’ এর উদাহরণ রয়েছে কি?
ইসলামের অনুসারীগণ কি এতই দেউলিয়া হয়ে গেছে যে, তাদেরকে বিধর্মী বা বিজাতীয় অনুকরণের উৎসব বা অনুষ্ঠান না করলে আর চলছে না? রাসুল এর প্রদত্ত বিধান অনুসারে – মুসলিমদের উৎসব শুধু দুটো, দুই ঈদ। এর বাইরে জন্মদিন বলুন, মৃত্যুদিন, বিয়েবার্ষিকী বা নববর্ষ বলুন, আমাদের আওতার বাইরে! চিন্তা করে দেখুন আরেকবার।
আপনা ২য় প্রতিপাদ্যঃ
একদিনে ঈদ পালনের কিছু টেকনিক্যাল ( Astronomical) সমস্যা আছে। চাঁদের মাস হয় ২৯, নাহলে ৩০ দিনে, চাঁদ দেখার উপরে নির্ভরশীল; যদি কোন কারনে চাঁদ ২৯ দিনে না দেখা যায়, তবে মাস ৩০ দিন পূরো করে ঈদ করা হবে, এমন নিয়ম শরিয়া আইনের। টেলিস্কোপ হাতে নিয়ে আপনি চাঁদ দেখছেন, এবং ঈদ করলেন সেভাবে, কিন্তু হাজার মাইল দূরে কোন প্রত্যন্ত বেদুঈন পল্লী বা কোন নিভৃত এলাকায় যেখানে অধুনিক বিজ্ঞান পৌঁছুতে পারেনি, তার জন্য তো সরিয়া আলাদা কোন আইন করে নি! ইসলামে সবার জন্য একই আইন! কাজেই ইনটারনেটে বা ওয়েবসাইটে ঘোষণা দিয়ে সারা পৃথিবীতে একদিনে ঈদ করার চিন্তা করা গেলেও বাস্তবে তা সম্ভব নয় বা সবাই তা মানবেও না। তার অর্থ নিজের চোখে চাঁদ দেখার বিকল্প তৈরী কোন সিস্টেম তৈরী করা যাচ্ছে না। আর চোখে দেখতে চাইলে, সে সময়ে চাঁদের অবস্থান, সূর্যের সাথে কৌণিক দূরত্ব, দিন বা রাতের কোন সময়, দর্শনকারী কোথায়- বাতাসে আদ্রতা বা ধুলির পরিমাণ এ সব বিবেচনায় আসবে।
সমস্যা হল, ভৌগলিক কারনেই পৃথিবীর সব জায়গা থেকে একই দিনে একই সময়ে চাঁদ দেখা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। উলামাদের মতে, এই visibility’র ভিত্তিতে পৃথিবীকে যদি তিনটা জোনে ভাগ করা যায়, তবে হয়তো তিন অঞ্চলে তিনদিনে চাঁদ দেখা সম্ভব, এবং সে কারনে তিন দিনে ধারাবাহিক ভাবে ঈদ হতে পারে। এনিয়ে অনেক থিসিস হয়ে গেছে। এক দিনে নয়।
তবে একই ভূখণ্ডে বা একই দেশে বসবাস করে ভিন্ন ভিন্ন দিনে ঈদপালন শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, একতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত বিপদজনক ও বটে। ভিন্ন মাজহাব এর অনুসারীরা ভিন্ন ব্যখ্যা অনুসরণ করলেও করতে পারেন ( যেহেতু সবগুলোই বৈধ।) তবে উম্মাহর সামগ্রিক – স্বার্থ রক্ষায় ‘একতা’ বজায় রাখার গুরুত্ব সবার বুঝা উচিত।
মন্তব্য করতে লগইন করুন