বাংলাদেশের চিরায়ত নারী (১ম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ০২ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৮:০৫:২৭ রাত
পটভুমি :
ব্লগার লোকমান বিন ইউসুপ-সহ অনেকে ফেসবুকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রী সংস্হা নামক সংগঠণ নিয়ে স্যাটাস দিচ্ছিলেন ও সেসব স্যাটাসে মন্তব্য করছিলেন। আমি তাদের অনেক বিষয়ের সাথে এক মত ছিলাম না ।
আমি দু:খের সাথে লক্ষ্য করলাম অনেকেই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমন করে যাচ্ছিলেন । এতে আমি বিন্দুমাত্র কিছু মনে করেনি । পরে আমি লক্ষ্য করলাম আমার অনেক মন্তব্য অনেকেই মুছে দিচ্ছেন । বিষয়টি আমার কাছে মোটেও অবমাননাকর মনে হয়নি । তবে অনেকেই বাংলাদেশের চিরায়ত নারী সমাজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত নন । আমি অনেকে বলতে এখানে নারী পুরুষ উভয়কেই বুঝিয়েছি । আমার মতে এই সাইটে অনেক নারী ব্লগার পর্যন্ত চিরায়ত বাংলাদেশি নারীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত নন ।
উপরন্তু আমি সৌদি আরবের দৃষ্টিভঙ্গি ওহাবী মতবাদ ও সেক্সীজম শিরোনামে একটা নিবন্ধের ১ম পর্ব এই সাইটে দিয়েছিলাম । ওহাবীবাদ সম্পর্কে খুব কম লোকের ধারণা আছে । উপরন্তু সেক্সিজম সম্পর্কে লোকেরা খুব একটা জানেন না বলেই মনে হয় । কারণ নেটে এসম্পর্কিত কোন তথ্য নেই । বাজারেও এর উপর কোন বই নিয়ে । সেক্সিজম শব্দের বাংলা অনুবাদ করেন অনেকে লিঙ্গবৈষম্য , যৌনবাদ, যৌনবৈষম্য ইত্যাদি । আমার মতে কোন বাংলা অর্থই সঠিক নয় । আমি এই বিষয়টার ব্যাখ্যা সৌদি আরব সম্পর্কিত লেখায় দিবো ।
এই লেখা কেন লিখছি ? :
১. বাংলাদেশের চিরায়ত নারীর বৈশিষ্ট্য জানতে হবে । কারণ আমাদের দেশটা যদিও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও ইসলামের একটা বিকৃত রূপ ওহাবী মতবাদ আমাদের দেশের মানুষের চিন্তা-চেতনায় প্রবেশ করছে বলে সেক্সিজম আমাদের সমাজে প্রবেশ করেছে । তার ফল হিসেবে বাংলাদেশের নারীর চিরায়ত বৈশিষ্ট্য লোপ পাচ্ছে ।
আর এজন্য অনেক লেখক " এই কি চিরায়ত বাঙ্গালী নারী" শিরোনামে পত্রিকায় লেখা লিখছেন । লেখককে দেখছি, এজন্য পুজিবাদ-কে দায়ী করছেন ।
আমি অনেক চিন্তা ও গবেষণা করে দেখলাম । মুসলিম সমাজে পুজিবাদের প্রভাব আছে তবে তা ওহাবি মতবাদের রূপ ধরে আমাদের সমাজে প্রবেশ করেছে । অনেক অর্থনীতিবিদ পুজিবাদী অর্থনীতির একটা ভিন্ন রূপকে মৌলবাদের অর্থনীতি বলে আক্ষ্যায়িত করেছেন ।
আমি মনে করি, আমাদের মুসলিম সমাজে ওহাবীবাদ ও মৌলবাদী অর্থনীতির বিস্তারের কারণে বাংলাদেশের চিরায়ত নারীর বৈশিষ্ট্য লোপ পাচ্ছে । এর পরিনতি আমাদের সমাজের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি ঢেকে আনছে ।
২. যারা কোন সংগঠণকে মানবিকবোধ সম্পন্ন করতে চাচ্ছেন তারা যদি তাদের প্রধান মতাদর্শকে এড়িয়ে যান এবং চিরায়ত নারীর বৈশিষ্ট্যগুলোকে সংশ্লিষ্ট নারী সংগঠণ যদি লালন না করেন তাহলে সেই সংগঠণ বাংলাদেশের জনগণের কাছে স্হান করে নিতে পারবে না ।
চিরায়ত নারীর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য :
চিরায়ত নারীর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য আমি সরাসরি উল্লেখ না করে রবীন্দ্রনাথের একটা গল্প শেয়ার করছি । গল্পটা পড়লেই বাংলাদেশের চিরায়ত নারীর বৈশিষ্ট্য জানতে পারবেন । পরবর্তী পর্বে আমি এই বৈশিষ্ট্যটি আমার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করবো ।
গল্প : রাজরানী
লেখক : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উৎস : গল্পসল্প, বিশ্বভারতী ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ , http://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80
এক যে ছিল রাজা, তাঁর ছিল না রাজরানী। রাজকন্যার সন্ধানে দূত গেল অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ মগধ কোশল কাঞ্চী। তারা এসে খবর দেয় যে, মহারাজ, সে কী দেখলুম; কারু চোখের জলে মুক্তো ঝরে, কারু হাসিতে খসে পড়ে মানিক! কারু দেহ চাঁদের আলোয় গড়া, সে যেন পূর্ণিমারাত্রের স্বপ্ন।
রাজা শুনেই বুঝলেন, কথাগুলি বাড়িয়ে বলা, রাজার ভাগ্যে সত্য কথা জোটে না অনুচরদের মুখের থেকে। তিনি বললেন, আমি নিজে যাব দেখতে।
সেনাপতি বললেন, তবে ফৌজ ডাকি?
রাজা বললেন, লড়াই করতে যাচ্ছি নে।
মন্ত্রী বললেন, তবে পাত্র-মিত্রদের খবর দিই?
রাজা বললেন, পাত্র-মিত্রদের পছন্দ নিয়ে কন্যা দেখার কাজ চলে না।
তা হলে রাজহস্তী তৈরি করতে বলে দিই?
রাজা বললেন, আমার একজোড়া পা আছে।
সঙ্গে কয়জন যাবে পেয়াদা?
রাজা বললেন, যাবে আমার ছায়াটা।
আচ্ছা, তা হলে রাজবেশ পরুন— চুনিপান্নার হার, মানিক-লাগানো মুকুট, হীরে-লাগানো কাঁকন আর গজমোতির কানবালা।
রাজা বললেন, আমি রাজার সঙ সেজেই থাকি, এবার সাজব সন্নেসির সঙ।
মাথায় লাগালেন জটা, পরলেন কপনি, গায়ে মাখলেন ছাই, কপালে আঁকলেন তিলক আর হাতে নিলেন কমণ্ডলু আর বেলকাঠের দণ্ড। ‘বোম্ বোম্ মহাদেব’ বলে বেরিয়ে পড়লেন পথে। দেশে দেশে রটে গেল— বাবা পিনাকীশ্বর নেমে এসেছেন হিমালয়ের গুহা থেকে, তাঁর একশো-পঁচিশ বছরের তপস্যা শেষ হল ।
রাজা প্রথমে গেলেন অঙ্গদেশে। রাজকন্যা খবর পেয়ে বললেন, ডাকো আমার কাছে।
কন্যার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামল, চুলের রঙ যেন ফিঙের পালক, চোখ দুটিতে হরিণের চমকে-ওঠা চাহনি। তিনি বসে বসে সাজ করছেন। কোনো বাঁদি নিয়ে এল স্বর্ণচন্দন বাটা, তাতে মুখের রঙ হবে যেন চাঁপাফুলের মতো। কেউ বা আনল ভৃঙ্গলাঞ্ছন তেল, তাতে চুল হবে যেন পম্পাসরোবরের ঢেউ। কেউ বা আনল মাকড়সাজাল শাড়ি। কেউ বা আনল হাওয়াহালকা ওড়না। এই করতে করতে দিনের তিনটে প্রহর যায় কেটে। কিছুতেই কিছু মনের মতো হয় না। সন্নেসিকে বললেন, বাবা, আমাকে এমন চোখ-ভোলানো সাজের সন্ধান বলে দাও, যাতে রাজরাজেশ্বরের লেগে যায় ধাঁধা, রাজকর্ম যায় ঘুচে, কেবল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দিনরাত্রি কাটে।
সন্ন্যাসী বললেন, আর-কিছুই চাই না?
রাজকন্যা বললেন, না, আর-কিছুই না।
সন্ন্যাসী বললেন, আচ্ছা, আমি তবে চললেম, সন্ধান মিললে নাহয় আবার দেখা দেব।
রাজা সেখান থেকে গেলেন বঙ্গদেশে। রাজকন্যা শুনলেন সন্ন্যাসীর নামডাক। প্রণাম করে বললেন, বাবা, আমাকে এমন কণ্ঠ দাও যাতে আমার মুখের কথায় রাজরাজেশ্বরের কান যায় ভরে, মাথা যায় ঘুরে, মন হয় উতলা। আমার ছাড়া আর কারও কথা যেন তাঁর কানে না যায়। আমি যা বলাই তাই বলেন।
সন্ন্যাসী বললেন, সেই মন্ত্র আমি সন্ধান করতে বেরলুম। যদি পাই তবে ফিরে এসে দেখা হবে।
বলে তিনি গেলেন চলে।
গেলেন কলিঙ্গে। সেখানে আর-এক হাওয়া অন্দরমহলে। রাজকন্যা মন্ত্রণা করছেন কী করে কাঞ্চী জয় করে তাঁর সেনাপতি সেখানকার মহিষীর মাথা হেঁট করে দিতে পারে, আর কোশলের গুমরও তাঁর সহ্য হয় না। তার রাজলক্ষ্মীকে বাঁদি করে তাঁর পায়ে তেল দিতে লাগিয়ে দেবেন।
সন্ন্যাসীর খবর পেয়ে ডেকে পাঠালেন। বললেন, বাবা, শুনেছি সহস্রঘ্নী অস্ত্র আছে শ্বেতদ্বীপে যার তেজে নগর গ্রাম সমস্ত পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আমি যাকে বিয়ে করব, আমি চাই তাঁর পায়ের কাছে বড়ো বড়ো রাজবন্দীরা হাত জোড় করে থাকবে, আর রাজার মেয়েরা বন্দিনী হয়ে কেউ বা চামর দোলাবে, কেউ-বা ছত্র ধরে থাকবে, আর কেউ-বা আনবে তাঁর পানের বাটা।
সন্ন্যাসী বললেন, আর-কিছু চাই নে তোমার?
রাজকন্যা বললেন, আর-কিছুই না।
সন্ন্যাসী বললেন, সেই দেশ-জ্বালানো অস্ত্রের সন্ধানে চললেম।
সন্ন্যাসী গেলেন চলে। বললেন, ধিক্।
চলতে চলতে এসে পড়লেন এক বনে। খুলে ফেললেন জটাজূট। ঝরনার জলে স্নান করে গায়ের ছাই ফেললেন ধুয়ে। তখন বেলা প্রায় তিনপ্রহর। প্রখর রোদ, শরীর শ্রান্ত, ক্ষুধা প্রবল।
আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে নদীর ধারে দেখলেন একটি পাতার ছাউনি। সেখানে একটি ছোটো চুলা বানিয়ে একটি মেয়ে শাকপাতা চড়িয়ে দিয়েছে রাঁধবার জন্য। সে ছাগল চরায় বনে, সে মধু জড়ো করে রাজবাড়িতে জোগান দিত। বেলা কেটে গেছে এই কাজে। এখন শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে শুরু করেছে রান্না। তার পরনের কাপড়খানি দাগপড়া, তার দুই হাতে দুটি শাঁখা, কানে লাগিয়ে রেখেছে একটি ধানের শিষ। চোখ দুটি তার ভোমরার মতো কালো। স্নান করে সে ভিজে চুল পিঠে মেলে দিয়েছে যেন বাদলশেষের রাত্তির।
রাজা বললেন, বড়ো খিদে পেয়েছে।
মেয়েটি বললে, একটু সবুর করুন, আমি অন্ন চড়িয়েছি, এখনই তৈরি হবে আপনার জন্য।
রাজা বললেন, আর, তুমি কী খাবে তা হলে।
সে বললে, আমি বনের মেয়ে, জানি কোথায় ফলমূল কুড়িয়ে পাওয়া যায়। সেই আমার হবে ঢের। অতিথিকে অন্ন দিয়ে যে পুণ্যি হয় গরিবের ভাগ্যে তা তো সহজে জোটে না।
রাজা বললেন, তোমার আর কে আছে।
মেয়েটি বললে, আছেন আমার বুড়ো বাপ, বনের বাইরে তাঁর কুঁড়েঘর। আমি ছাড়া তাঁর আর কেউ নেই। কাজ শেষ করে কিছু খাবার নিয়ে যাই তাঁর কাছে। আমার জন্য তিনি পথ চেয়ে আছেন।
রাজা বললেন, তুমি অন্ন নিয়ে চলো, আর আমাকে দেখিয়ে দাও সেইসব ফলমূল যা তুমি নিজে জড়ো করে খাও।
কন্যা বললে, আমার যে অপরাধ হবে।
রাজা বললেন, তুমি দেবতার আশীর্বাদ পাবে। তোমার কোনো ভয় নেই। আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো।
বাপের জন্য তৈরি অন্নের থালি সে মাথায় নিয়ে চলল। ফলমূল সংগ্রহ করে দুজনে তাই খেয়ে নিলে।
রাজা গিয়ে দেখলেন, বুড়ো বাপ কুঁড়েঘরের দরোজায় বসে।
সে বললে, মা, আজ দেরি হল কেন।
কন্যা বললে, বাবা, অতিথি এনেছি তোমার ঘরে।
বৃদ্ধ ব্যস্ত হয়ে বললে, আমার গরিবের ঘর, কী দিয়ে আমি অতিথিসেবা করব
রাজা বললেন, আমি তো আর কিছুই চাই নে, পেয়েছি তোমার কন্যার হাতের সেবা। আজ আমি বিদায় নিলেম। আর-একদিন আসব।
সাত দিন সাত রাত্রি চলে গেল, এবার রাজা এলেন রাজবেশে। তাঁর অশ্ব রথ সমস্ত রইল বনের বাহিরে। বৃদ্ধের পায়ের কাছে মাথা রেখে প্রণাম করলেন; বললেন, আমি বিজয়পত্তনের রাজা। রানী খুঁজতে বেরিয়েছিলাম দেশে বিদেশে। এতদিন পরে পেয়েছি— যদি তুমি আমায় দান কর, আর যদি কন্যা থাকেন রাজি।
বৃদ্ধের চোখ জলে ভরে গেল। এল রাজহস্তী— কাঠকুড়ানি মেয়েকে পাশে নিয়ে রাজা ফিরে গেলেন রাজধানীতে।
অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের রাজকন্যারা শুনে বললে, ছি!
উপসংহার :
চিরায়ত বাঙ্গালী বা বাংলাদেশি নারী মানবিক ও দেশজ মূল্যবোধে বিশ্বাসী । লোকমান বিন ইউসুপ ভাই , আশা করি বুঝতে পেরেছেন ।
বিষয়: বিবিধ
২৬৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন